তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

খেলা

খেলা

কলকাতার উত্তরাঞ্চলে একটি ব্রিজ। সেই ব্রিজের তলা দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন। ওপর দিয়ে রাজপথ। গত তিরিশ বছর রোজ সকালে আমি এই পথ দিয়ে একবার দক্ষিণে যাই, আর রাতে আবার ফিরে আসি উত্তরে। দিনে দুবার আমাকে এই ব্রিজের ওপর দিয়ে আসাযাওয়া করতে হয়। বহু আগে, ইংরেজ আমলে তৈরি এই পোলটির তেমন সুদর্শন চেহারা নয়। ধনুকের মতো উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শক্তপোক্ত একটি পারাপার সেতু।

পোলের নীচে রেলইয়ার্ড। ছোটবড় নানা মাপের ঘর, গোডাউন ইতস্তত ছড়ানো তার মাঝখান দিয়ে সার সার রেললাইন। ব্রিজে ওঠার মুখে নীচের থেকে একটি বাড়ি উঠে ব্রিজের মাথা বরাবর একটি নাতিপ্রশস্ত ছাদ মেলে দিয়েছে। বহুকাল, কে বা কারা সেই ছাদটিকে ঘিরে-ঘারে তিন-চারটি খুপরি বের করে নিয়েছে। যে দেশে দু-দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষকে রাজনৈতিক কারণে মিলেমিশে থাকতে হয়েছে, সেদেশে জবরদখল আইনের চোখ এড়িয়ে যেতে বাধ্য। তিনটি খুপরির একটিতে একজন সাইন-পেন্টারের স্টুডিয়ো। আর দুটিতে মানুষের বসবাস।

গত তিরিশ বছর ধরে আমি তিন ধরনের জীবনলীলা দেখে আসছি। খুপরির মাথার ওপর ভাঙাচোরা টিন সাজিয়ে ছাদ। ঝড়ের বাতাসে টিন যাতে পাখা মেলতে না পারে, তার জন্যে অজস্র পাথরখণ্ড চাপানো। পাশেই রেলইয়ার্ড। পাথর বোঝাই ওয়াগন খালাস হয়। সুতরাং পাথরের অভাব নেই। খুপরির যা উচ্চতা, তাতে একজন মানুষ কোনও রকমে দাঁড়াতে পারে। শুধু মাত্র একটি প্রবেশপথ আছে। আলো বাতাস ঢোকার দ্বিতীয় আর কোনও পথ নেই। আবার সেই প্রবেশপথটি কেমন! ব্রিজের রেলিং টপকে নামা ওঠা। সহজ, সাবলীল কোনও ব্যবস্থা নয়।

আমার চোখের সামনেই সেই সাইনপেন্টারের কুঞ্চিত ভ্রমরকৃষ্ণ চুল দুগ্ধ-ধবল হয়ে গেল। সুঠাম যৌবন গলে গেল কাঠি আইসক্রিমের মতো। এখন তাঁর ভাঙা গাল, উদ্ধত চোয়াল। কোটরগত হলুদ চোখ। ঠোঁটে আধপোড়া বিড়ি। সামনে খাড়া রং করা টিনের পাত। তার ওপর হেলানো একটি লাঠি। সেই লাঠিতে তুলি ধরা হাতের ভর রেখে গোটা গোটা অক্ষরে আজও লেখেন, কৃষ্ণ সাইকেল স্টোর্স কী ফেবারিট কেবিন। শিল্পী কত ব্যাবসার কত সাইনবোর্ড জীবনভর লিখে গেলেন। কত লোকের গাড়ি বাড়ি, ফুলবাগান হয়ে গেল। কেবল প্রশ্ন মানুষটির অবস্থার পরিবর্তন হল না। পোলের ওপর দিয়ে সময় বহে গেল। ডিজেলের ধোঁয়া ছেড়ে বছরের পর বছর চলে গেল সশব্দে। ষাটের বয়েস হয়ে গেল অষ্টআশি। অভিজ্ঞতা আর জরা ছাড়া মানুষটির কিছুই লাভ হল না।

তিরিশ বছর আগে একদিন সকালে দেখি, সাইনপেন্টারের স্টুডিয়োর পাশের খুপরির দোরগোড়ায় এক মহিলা বসে আছেন। খুপরির নতুন ভাড়াটে। চোখ কেড়ে নেওয়ার মতো সুঠাম সুন্দর চেহারা। লম্বাচওড়া। এদেশ বিদেশ হলে মহিলাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ব্রিজিদ বার্দো করে রুপোলি পরদায় তুলে দিত। সম্পূর্ণ একা একজন মহিলা, সঙ্গে দ্বিতীয় আর কোনও প্রাণী নেই। খুব কৌতূহল হত জানার, কে এই মহিলা, কি তাঁর জীবিকা? কেন তিনি একা! বাসের জানালার ধারে বসে নিত্য এক লহমার দেখা। প্রশ্নের উপায় নেই। প্রশ্ন করার প্রশ্নই ওঠে না। এমন কত জীবন সারা শহরে ছড়িয়ে আছে। কে কার খবর রাখে! রাখার উপায় নেই। রাখার প্রয়োজনও নেই। মহিলার চেহারাটাও এমন ছিল যে, চোখ না পড়ে উপায়ও ছিল না।

মাঝে মাঝে নিজেকে আমি প্রশ্ন করতুম, কেন ওই মহিলাটির দিকে আমি তাকাই। কীসের আকর্ষণে? শরীর। না, শরীর নয়, তাকাই এক ধরনের শ্রদ্ধায়। তাকাই নিজের মনে বল সঞ্চয়ের জন্যে। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। দিন আসে, দিন যায়। আমরা খেয়াল করি না, কত রকমের অনিশ্চয়তা আমাদের ঘিরে রেখেছে। সেই সময় আমার এক বন্ধু বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ কি একটা অসুখে সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে গেল। এমনকি তার কথা পর্যন্ত জড়িয়ে গেল। সুন্দর, স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে। সদ্য বিয়ে করেছে। সুন্দরী স্ত্রী। তার ওই পরিণতি দেখে ভয়ে রাতের ঘুম চলে গেল। সেই সময় আমি এমন একটা চাকরি করতুম, রোজ সকালে বেরোবার সময় মনে হত, আজ অফিসে গিয়ে চেয়ারটা দেখতে পাব তো। আমাকে পথে বসাবার জন্যে আমার ওপরওয়ালা প্রতিদিনই আমার দিকে এমন এক-একটা কাজ ঠেলে দিতেন যাতে আমার জিভ সামনে আধহাত ঝুলে পড়ে। প্রতিদিনই ঘরে ডেকে যেকোনও ছুতোয় টানা এক দেড় ঘণ্টা ঝাড়তেন। আমাকে মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দিতেন, তুমি একটা চাকর। তোমার পেট আমার কাছে বাঁধা। সামান্য একটা চাকরির ভয়ে আমি কেঁচো হয়ে থাকতুম আর গাধার মতো খাটতুম। সেই সময় আমার এমন অবস্থা চাকরিটা চলে গেলে সংসারের হাঁড়ি সিকেয় উঠবে। সেই সময় আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলুম পৃথিবীর কিছু মানুষ বেড়ালের স্বভাব নিয়ে ইঁদুরের মতো কিছু মানুষকে থাবায় নাড়াচাড়া করে ভীষণ আনন্দ পায়। তোমাকে আমি ভাতে মারব। আমার সংসার তখন বহুকাল তেল-না-পড়া চুলের মতো রুক্ষ হয়ে আছে। পরিবারের সকলের মুখ তখন থমথমে। পোড়া ঝলসানো চেহারা। ওই মন নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আমি একটু বল পেতুম। পোলের এক ধাপ উঁচুতে, রেলিং-এর ওপাশে মহিলাটি তার খুপরির দরজায় তালা লাগাচ্ছে। চেহারায় লেগে আছে আত্মবিশ্বাস। আমার মনে হত, একা এই মহিলাটি যদি বেঁচে থাকতে পারে, আমিও পারব। জীবনযুদ্ধে সহজে হেরে যাব না। ওই সাইনপেন্টার, ওই দীর্ঘকায়া মহিলা আমাকে দেখাবার জন্যেই যেন রেলকম্পানির একতলা কোঠার ছাদে তাদের জীবনসংগ্রামের একটা বাস্তব প্রদর্শনী খুলে রেখেছে। সাইনপেন্টার মাঝে মধ্যে একটা ভাঙা টিনের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতেন। পরনে একটা মোটা ধুতি আর সাদা হাফহাতা আধময়লা শার্ট। ঠোঁটে লেগে থাকত একটা বিড়ি। মুখের চারপাশ দিয়ে ফিনফিনে ধোঁয়া উঠছে। সামনে অর্থসমাপ্ত একটি সাইনবোর্ড। শিল্পীর মতো তুলিরাও বিশ্রাম নিচ্ছে। ওই মুহূর্তে মানুষটিকে মনে হত আমার পৃথিবীর রাজা। খোদমালিকের কাছে ছাড়া আর কোনোও কুঁচো মালিকের কাছে তাঁকে নিত্য আমার মতো জবাবদিহি করতে হয় না। পাশের ঘরের অমন এক চরিত্র সম্পর্কেও তাঁর কোনও কৌতূহল নেই। আমি বরং মনে মনে চাইতুম, নায়কের মতো দেখতে ওই মানুষটির সঙ্গে নায়িকার মতো দেখতে ওই রমণীর একটা প্রেম হোক। খোলা আকাশের তলায় প্রায় প্রকাশ্যে এইভাবে একা-একা বেঁচে থাকাটাকে মনে হয় ফাঁকা মাঠে অনিশ্চিত দৌড়ের মতো, পেছনে তাড়া করে আসছে, একপাল পাগলা কুকুর। ভাবতুম, মহিলাটিরই বা কীসের এত অহঙ্কার। কোনও এক বর্ষার বিদ্যুৎ ঝলসানো, মাধবী কাঁপা রাতে, তার নীল শাড়িটি পরে, পরিপাটি খোঁপায় একটি চাঁপাফুল গুজে কেন শিল্পীর সামনে নায়িকার মতো গিয়ে দাঁড়াচ্ছে না। আসলে, সংগ্রামী মানুষের জীবনে সিনেমার রুপোলি প্রেম থাকে না। শিল্পী থাকেন শিল্পীর মতো। মহিলা মহিলার মতো। দুজনেই নি:সঙ্গ। মানুষ পায়রার মতো ছাদের খুপরিতে বসবাস। এইভাবেই চলতে থাকে বছর। অসংখ্য মাস যেন অসংখ্য শিশুর অদৃশ্য একটি মিছিল। টলতে টলতে দুহাত তুলে এগিয়ে চলেছে শতাব্দীর সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। সকলেরই দেহদরজা খুলে বেরিয়ে আসছে অবাধ্য সময় শিশু। হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালার বাঁশি তাদের স্থির থাকতে দেয় না।

একদিন দেখি মহিলাটি তাঁর খুপরি ঘরের দরজায় তালা লাগাচ্ছেন, পায়ের কাছে নামানো রয়েছে একটা টিফিন কেরিয়ার। খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল; যাক মহিলার তাহলে একটা জীবিকা আছে। ভেবে নিলুম, কাছাকাছি অনেক কলকারখানা আছে, প্ল্যাস্টিক কারখানা আছে, মহিলা হয়তো তারই যেকোনও একটার শ্রমিক। বড় শান্তি পেলুম। আমার কোনও ব্যাপারই নয়, তবু উদ্বেগ কিছুটা কমল। শুধু আর একটি দুশ্চিন্তা রয়ে গেল, মহিলার পাশে কবে একটি সুন্দর পুরুষকে দেখব। এমন সুশ্রী স্বাস্থ্যবতী মহিলার তো একা থাকা উচিত নয়। বিপদের সম্ভাবনা আছে। একটাই ভরসা, চটুলা, চপলা নয়। বেশ ভারী একটা ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

দিন যায়। মাস যায়। আমার কৌতূহলও এক সময় মরে যায়। আর কোনও প্রশ্ন নেই আমার। নিত্য যাওয়া আসা। কলকাতার পরিস্থিতি পালটাল। রাজনীতি বদলাল। পোলের তলায় এসে গেল চক্ররেল। পাশাপাশি খুপরি তিনটি রয়েই গেল। সাইনপেন্টার সাইনবোর্ড লেখেন। মহিলা টিফিন কেরিয়ার হাতে রেলিং টপকে ব্রিজে নামেন। হঠাৎ মনে হল, মহিলাকে কোনও দিন আমি কারোর সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম না। জীবন যদি উপন্যাস হত, তাহলে মহিলাটির সঙ্গে সাইনপেন্টারের প্রেম হত। মধ্যরাতে বদ কোনও মানুষ আসত মৎস্যলোভে বেড়ালের মতো। তাই নিয়ে বেঁধে যেত দাঙ্গাহাঙ্গামা। পাড়াটা মধ্যবিত্তের পাড়া নয়; তাই বোধহয় এই সব কিছুই হল না। নীচের তলার মানুষদের তেমন ছিঁচকে স্বভাব হয় না। তাদের নিজস্ব একটা নীতিবোধ থাকে। মদ খেয়ে নিজের বউকে পেটাতে পারে, অন্যের বউয়ের হাত ধরে টানাটানি করে না।

এমনি করেই মহিলাটির যৌবন চলে গেল। চুলের ঢাল ছোট হয়ে এল। মাথায় কাঁচাপাকা ছোট একটি বড়ি খোঁপা। দেহত্বকে সে লালিত্য আর নেই। দেহ খাঁচাটি অবশ্য ঠিকই আছে। গত বছরে মহিলাটি আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন বহু বছর পরে। খুপরির দরজাটি খোলা। প্রৌঢ়া বসে আছেন হেঁট হয়ে। উলটোদিকে বসে আছেন এক প্রৌঢ়। চেহারা দেখলেই মনে হয়, যৌবনে মহিলাটির মতোই শক্তসমর্থ ছিলেন। দুজনের মাঝখানে পাতা রয়েছে একটি লুডোর ছক। দুজনে গভীর মনোযোগে লুডো খেলছেন। বেশবাসে দারিদ্র্যের ছাপ; কিন্তু মনে তার স্পর্শ নেই। ব্যস্ত পৃথিবীর দিকে পেছন ফিরে সুখী এক দম্পতি লুডো খেলায় মত্ত। আমি তখন ভেবে নিলুম, এই দিকে আমার মনোযোগ যখন কমে এসেছিল, তখন মহিলাটির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামীটি খুব ভোরে বেরিয়ে যেত, আর অনেক রাতে ফিরত, যে কারণে আমার সঙ্গে দেখা হত না। এখন দুজনেই অবসরভোগী।

দুজনের এই লুডো খেলা আমাকে অবাক করে দিত। এমন সুখী দম্পতি কি ভদ্রঘরে দেখা যায়? শিক্ষিত পরিবারে। যেখানে নিত্য ভুল বোঝাবুঝি, মনান্তর আর মতান্তর, আমি মনে মনে ভাবতাম, এঁদের মতো করে আমার জীবনের সুর বাঁধব। কেউ না শিখুক, এঁদের দেখে আমি শিখব।

এই সেদিন সকালে, খুপরিটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সেই পরিচিত দৃশ্যের বদলে অন্য দৃশ্য। দুয়ারের সামনে কৃশ একটি মালা, কয়েক গুচ্ছ ফুল, একটি খাটিয়া। পাশে পাহারায় বসে আছে ছোট্ট একটি মেয়ে। জ্যামে আমার গাড়ি আটকে গেছে। তাই খুটিয়ে দেখার সুযোগ। খুপরির আলো-আঁধারে পথের দিকে মাথা করে, অর্থাৎ পশ্চিমে অনড় শুয়ে আছেন সেই বৃদ্ধ। আমি তাঁর মাথার মধ্যভাগ ও উঁচু নাকের অংশটুকু দেখতে পাচ্ছি। কেউ কোথাও নেই। মেয়েটি হাঁটুতে চিবুক রেখে বসে আছে উদাস। লাগোয়া খুপরিতে সাইনপেন্টার বসে আছেন উবু হয়ে চশমাটি ঝুলে পড়েছে নাকের ডগায়। সদ্য রং করা সাইনবোর্ডের গায়ে লম্বা কয়েক গাছা তুলি ঠেস দিয়ে রাখা। প্রৌঢ়া মহিলাটি কোথায়! মনে হয় খাটিয়ার কাঁধ দেওয়ার লোক খুঁজতে গেছেন। জ্যাম খুলে গেল, আমিও চলে গেলুম জীবনের চাকা ঘোরাতে।

তারপর! সেই খুপরি। বৃদ্ধা। সামনে লুডোরছক। দান ফেলবেন। প্রতিদানে ছক ফেলার মানুষটি ঘরে উঠে গেছেন। খেলা আছে কিন্তু তাঁর খেলা এবারের মতো শেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *