খেলা
খুব ভোরে ইনডোর সুইমিং পুলের ধারে তিনি এসে দাঁড়ালেন, মুখে হাসি নেই, গাম্ভীর্যও নয়, একটু চিন্তিত বোধহয়, প্যান্টের দু-পকেটে হাত, কাঁধটা একটু উঁচুতে তোলা, দু-পা পরস্পরের সঙ্গে কাটাকুটি করা, গায়ে সাদাকালো একটা ব্যানলনের গেঞ্জি। নিথর জলে তাঁর ছায়া পড়েছে। একটু ঝুঁকলেই নিজের ছায়া তিনি দেখতে পারেন। কিন্তু গত বিশ–বাইশ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর হাজারও পত্রপত্রিকায়, পোস্টারে, চলচ্চিত্রে বা টেলিভিশনে নিজের এত ছবি দেখছেন যে নিজের ছায়া বা প্রতিবিম্ব দেখতে তাঁর আর কোনও ইচ্ছেই হয় না। সারাটা জীবন তাঁকে তাড়া করছে হাজারও ক্যামেরা, ফ্ল্যাশ লাইট, হাজারও সাক্ষাৎকার, লক্ষ-লক্ষ লোকের জয়ধ্বনি, স্তুতি ও ভালোবাসা।
এই হোটেলটা কতদূর ভালো তা তিনি বলতে পারেন না। এই শহরটাই বা কীরকম তাও তাঁর জানা নেই। গতকাল গভীর রাতে তিনি এই শহরে নেমেছেন বিমান থেকে। বিমানবন্দরে অত রাতেও অগুন্তি লোক অপেক্ষা করছিল। গভীর জয়ধ্বনি সমুদ্র গর্জনের মতো রোল তুলল তিনি বিমান থেকে বেরোতে–না-বেরোতেই। তিনি মানুষ দেখে-দেখে ক্লান্ত–একথা বলা যায় না। তবে মানুষ কি তাঁকে দেখে-দেখে ক্লান্ত হয় না কখনও? জয়ধ্বনি তাঁর আজকাল একইরকম লাগে, যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় তাঁকে স্বাগত জানায়। তবু ধ্বনি কিন্তু প্রায় এক।
শহরটা তিনি দেখতে পেলেন না। দেখার ইচ্ছেও ছিল না। লাক্সারি বাসে তাঁর টিমসহ যখন তাঁকে তোলা হয় তখনও সাংবাদিকরা কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছে। তাঁর দেহরক্ষী কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়নি বটে, তবু ওর মধ্যেই এক আধজন যেন কী কৌশলে ঢুকে পড়েছিল। তাদেরই একজন পাশ থেকে ভয়ে-ভয়ে চুরি করে তাঁকে দুটো চারটে কথা বলতে অনুরোধ করে। তাঁর বড় মুশকিল, তিনি কাউকেই প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। দেহরক্ষী তেড়ে এসেছিল, তিনি করতলের মুদ্রায় তাকে নিরস্ত করে ছদ্মবেশী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
তাঁর সম্পর্কে আর কী জানার থাকতে পারে লোকের? এই ভেবে তিনি আজকাল অবাক হন। তাঁর নিজের আত্মজীবনী ছাড়াও কয়েক ডজন বই লেখা হয়েছে তাঁর ওপর। প্রতিটি বই পৃথিবীর সব প্রধান ভাষায় লাখ লাখ বিকিয়েছে। তাঁর সব ক্রীড়াকৌশল দেখানো হয়েছে বারংবার সিনেমায়, টিভিতে, স্থিরচিত্রে। তবে মানুষ আর কী জানতে চায়। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়েসের এ জীবনে তাঁর আর কোন গুপ্ত সংবাদ থাকবে যা লোকে জানে না? তিনি যখন যা বলেন তা তৎক্ষণাৎ টেপ করা হয়, নয়তো তুলে নেওয়া হয় শর্টহ্যান্ডে, তিনি যখন যা বলেন তাই প্রচারিত হয়ে যায় সাধারণ্যে।
আজ এই খুব ভোরে তিনি কিছুটা অনিশ্চয় একা। একা হওয়ার অভ্যাস তাঁর নেই–ই প্রায়। অবশ্য একা বলতে ঠিক যা বোঝায় তা তিনি কখনওই হতে পারেন না। তাঁর দেহরক্ষী ছায়ার মতো পিছু নেয়। তাঁর দু-পকেটে দুটো রিভলভার, মজবুত ও সতর্ক ওই প্রহরীটি তার কর্তব্য পালন করার জন্য কারও অনুমতির অপেক্ষা রাখে না। তাঁরও নয়। কারণ, এই রক্ষীকে নিয়োগ করেছে একটি বিমা কোম্পানি–যে কোম্পানিতে তিনি কয়েক মিলিয়ন ডলারে বিমাবদ্ধ রয়েছেন।
কোনওদিনই ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে নিজেকে তিনি কখনও মুক্ত মানুষ বলে অনুভব করতে পারেন না। তিনি যা বলেন, যা করেন তা সব সময়েই গোচরে বা অগোচরে মানুষ লক্ষ করে। তাই যতক্ষণ জেগে থাকেন তিনি, ততক্ষণ তাঁকে সচেতন থাকতে হয়। নিজের মতো থাকা তাঁর আর হয়ে ওঠে না।
আজ এই ভোরে ইনডোর সুইমিং পুলের ধারে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর জীবনের নানা বেড়াজালের কথা ভাবছিলেন। কিংবা তাও নয়। তাঁর হয়তো ইচ্ছে করছিল, একা একটু রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে। একা ঘুরে-ঘুরে এ শহরটা একটু দেখে আসতে। কিন্তু তা হওয়ার নয়। কাল রাত থেকে হোটেলের বাইরে হাজার হাজার মানুষ চাপ বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি নেই। ওরা একবার তাঁকে দেখতে চায়। বেরোলেই ওই অতি উৎসাহীরা ঘিরে ধরবে, ছোঁবে, ছাপবে, তারপর আদরের উন্মাদনায় শ্বাসরোধ করে ফেলবে তাঁর।
তিনি জানেন, তাঁর কোনও শত্রু নেই। কিন্তু জনপ্রিয়তাই যে কতবড় শত্রু তা তিনি আজ বুঝে গেছেন।
কাল রাতে তাঁর ভালো ঘুম হয়নি। ঘুমহীনতায় কোনও রোগ নেই, উদ্বেগ নেই, দুশ্চিন্তাও নেই। তবু তাঁর ঘুম সহজে আসে না।
নিঃশব্দে স্ত্রীর ঘুম না ভাঙিয়ে তিনি উঠেছেন, কফি খেয়েছেন একা, বেরিয়ে এসেছেন ঘর থেকে। তিনি যেদিকে আছেন হোটেলের সেদিকটা সম্পূর্ণ আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কোনও অনভিপ্রেত লোকজন আসতে পারে না এদিকে। নিরাপত্তা প্রায় নিশ্চিন্ত।
তত ভোরে সুইমিং পুলের ধারে কেউই নেই। কিন্তু কে জানে, কোনও গুপ্ত জানালা থেকে, কোনও ফাঁক ফোঁকর দিয়ে, কোনও দূর অলিন্দ বা কক্ষ থেকে এই বিশাল হোটেলের কেউ না কেউ তাঁকে দূরবিণ দিয়ে দেখছে না, বা টেলি লেন্সে ফটো তুলছে না? আসলে ওই সন্দেহটাই নিশ্চিত সত্য। কেউ না কেউ সব সময়েই তাঁকে দেখছে। এ পৃথিবীর কোটি কোটি লোক তাঁর অচেনা, কিন্তু তাঁকে চেনে পৃথিবীর প্রায় সবাই। এইটেই সবচেয়ে জটিল ঘটনা।
সুইমিং পুলটা দুবার প্রদক্ষিণ করলেন তিনি। তারপর ভোরের প্রথম জাগ্রত মানুষটির দেখা মিলল।
লোকটা লম্বাটে, এশীয় ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থায় একটা পাইপ কামড়ে পকেটে দেশলাই বা লাইটার খুঁজতে-খুঁজতে খুবই উদভ্রান্ত অন্যমনস্কতায় চতুরে বোধহয় এসেছিল। তাঁর দিকে একবার দৃষ্টিক্ষেপ করেই অবহেলা ভরে চোখ সরিয়ে নিল। লাইটার বের করে পাইপ ধরিয়ে আবার একবার চাইল। তারপরই কেমন হতভম্ব আর ফ্রিজ হয়ে চেয়ে রইল তাঁর দিকে।
ধূমপান তিনি পছন্দ করেন না। নাকটা একটু কুঁচকে নিলেন। আর লোকটার ওই হতভম্ব ভাবটা তিনি একটুও উপভোগ করলেন না। বরং ভারী সঙ্কোচ হল তাঁর। অপ্রত্যাশিত তাঁর দেখা পেলে লোকে কেন ভূত দেখে?
যে সৌভাগ্য লোকটা সারাজীবনও কল্পনা করতে পারেনি তিনি আজ ভোরে লোকটার জীবনে সেই সৌভাগ্যের কারণ ঘটলেন। একটু হেসে তিনি বললেন–গুড মর্নিং।
লোকটা তোতলাতে লাগল। সম্পূর্ণ বিকারগ্রস্তের মতো বলতে লাগল–মাই গড!…ইউ.ইউ আর…ওঃ, গুড মর্নিং…গুড মর্নিং! গুড মর্নিং…!
তিনি স্মিত হাস্যে লোকটাকে আনন্দের ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকেন।
লোকটা জানে যে তিনি ধূমপান পছন্দ করেন না। পৃথিবীর সব মানুষই তাঁর পছন্দ অপছন্দের কথা জেনে গেছে। পাইপ নিভিয়ে অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে পিছু–পিছু হাঁটতে-হাঁটতে বলল –আপনার সঙ্গে যে আমার দেখা হয়েছিল একথা তো কেউ বিশ্বাস করবে না! আপনি কি দয়া করে আমাকে একটু স্মারক দেবেন না? ছোট স্বাক্ষর একটি?
তিনি মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাস্যে বললেন–এই সাক্ষাৎকার কি আপনার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ?
–বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
–কেন?
–আমি এক সম্রাটের সাক্ষাৎ পেয়েছি যিনি ক্রীড়াজগতে গত বিশ বছর তাঁর অপ্রাকৃত জাদুবিদ্যা দেখিয়েছেন, যাঁর মতো কেউ কখনও জন্মায়নি, আগামী একশো বছরে কেউ জন্মাবেও না।
তিনি বললেন–মানুষের সাধ্য যা নয় আমি তা কী করে করতে পারি? আমি যা করেছি তা মানুষের সাধ্যায়ত্ত নিশ্চয়ই। আর জাদুবিদ্যা আমি কিছুই জানি না, সারাজীবন আমাকে কঠোর অনুশীলন করতে হয়েছে।
–এ সবই আমরা জানি। কিন্তু তবু আপনি অলীকতার সীমারেখা ছুঁয়েছেন। বিশ্বকাপের এক ফাইনালে দেখেছি আপনার ভৌতিক ড্রিবলিং। সে যে না দেখেছে…
খুবই ক্লান্ত লাগে তাঁর। হয়তো এরা ঠিকই বলে। তাঁর মধ্যে কিছু একটা আছে। ধাঁধার মতো, রহস্যের মতো, অলৌকিকত্বের মতো। তিনি নিজে কোনওদিনই তা টের পাননি। কিন্তু অন্যেরা বলে যেসব কৌশলে আর পাঁচজন বড় খেলোয়াড় খেলে তাঁর নিজের কৌশল তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু প্রয়োজনের ক্ষেত্রে হয়তো তিনি বেশি ত্রুটিহীন। আর সেটাই হাজারও লোক। মিরাকল বলে মনে করে। তিনি বললেন–আমি যা করি তা সবই চেষ্টার দ্বারা।
বলতে-বলতে তিনি চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলেন, তাঁর দেহরক্ষী অধৈর্য হয়ে পড়ছে, এগিয়ে আসতে চাইছে। উটকো এই লোকটা যদি কোনও বেতাল নড়াচড়া করে তবে তাঁর দেহরক্ষী ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
তিনি তাই তাড়াতাড়ি বললেন–আপনি অটোগ্রাফ চাইছিলেন না?
–হ্যাঁ। হ্যাঁ। বলে লোকটা একটা দশ টাকার নোট বের করে পকেট থেকে। একটা ডটপেনও।
তিনি দশ টাকার নোটটা নিয়ে পকেটে ভরে নিশ্চিন্তে হাঁটতে লাগলেন। এ রকম মজা তিনি। প্রায়ই করেন। লোকটা চোরের মতো পিছু পিছু আসছে আর মাঝে-মাঝে হেঁ–হেঁ শব্দ করছে।
তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন–টাকাটার জন্য ধন্যবাদ। এটা দিয়ে আমার বাল বাচ্চার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাব।
লোকটা হাত কচলে বলে–সম্রাট, আপনাকে আমার কিছুই দেওয়ার থাকতে পারে না। আমি কী দেব আপনাকে? দয়া করে আমাকে লজ্জা দেবেন না।
তিনি হাসলেন। তোলা হাঁটুতে নোটটা রেখে ডটপেন দিয়ে বারো অক্ষরের নাম সই করে দিলেন অভ্যস্ত দ্রুত বেগে।
তারপর সামান্য ক্লান্তি ও গরম বোধ করে ফিরে এলেন ঘরে। স্ত্রী এমন চমৎকারভাবে সেজেছেন। অপেক্ষা করছেন প্রাতঃরাশের জন্য। তিনি স্ত্রীকে একটু চুমু খেলেন। স্ত্রী উজ্জ্বল মুখ করে তাকালেন তাঁর দিকে। সেই চোখের দৃষ্টিতে সুগভীর তৃপ্তি ও অহংকার তাঁর স্বামীকে নিয়ে।
স্ত্রী বললেন–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এত খেলার ধকল এবার সত্যিই শেষ হচ্ছে।
তিনি বিছানায় শুয়ে থেকে বললেন হ্যাঁ। আজ আমার শেষ খেলার আগের খেলাটি।
–তুমি কি নামবে মাঠে?
–নিশ্চয়ই?
–খুব সাবধান। এদের মাঠ ভালো নয় শুনেছি।
তিনি হাসলেন। বললেন–আমিও শুনেছি। তুমি কিন্তু অকারণে দুশ্চিন্তা কোরো না। এটা আর একটা খেলা মাত্র। খেলাই, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। যুদ্ধে সৈন্যরা এর চেয়ে অনেক শক্ত কাজ করে।
প্রাতঃরাশের পর তিনি ঘুমোলেন।
বেশিক্ষণ নয়। একটু বাদেই দরজায় টোকার শব্দ। বিশিষ্ট লোকরা আসছেন। ফোনে খবর নিচ্ছেন। অন্য সব খেলোয়াড়রা দেখা করতে চাইছে। আসছে সাংবাদিক, ফোটোগ্রাফার, টি ভি বা রেডিওর লোক, আসছে ম্যাসাজ করতে মেসেউয়ার।
তাঁর স্ত্রী বহুক্ষণ এই ভিড় ঠেকিয়ে রাখলেন, আর ভিড় ঠেকাল তাঁর মজবুত দেহরক্ষী। তবু এক সময়ে তাঁকে উঠতে হয়। হাসতে হয়। কথা বলতে হয়।
দুপুর গড়াতে না গড়াতে খেলা–পাগল এক শহর ভেঙে পড়ে স্টেডিয়ামে। কী গভীর আনন্দের চিৎকারে ভরে ওঠে পরিমণ্ডল।
তিনি মাঠে নামেন এগারো জনের সঙ্গে। সবই অভ্যস্ত তাঁর। সেই জয়ধ্বনি, ক্যামেরা, ভিড়।
তারপর সব সরে যায়। হঠাৎ দেখেন, তিনি স্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছেন। দাবার খুঁটির মতো সাজানো বাইশজন খেলোয়াড় দুদিকে। মাঝখানে সেই ফুটবল। পৃথিবীর মতো গোল। এই বল তাঁকে সব দিয়েছে যা হয়তো সবটাই পাওনা ছিল না।
শরীরে এতটুকু ক্লান্তি বা অসুস্থতা ছিল না। মাঠ যথেষ্ট ভালো না হলেও কিছুটা খেলা যায়। চারদিকের আকুল চোখগুলি তাঁর দিকেই চেয়ে আছে তিনি জানেন। সমস্ত ক্যামেরার লেন্স তাঁরই দিকে নিবদ্ধ তিনি জানেন। সমস্ত ভাষ্যকার কণ্ঠ বারংবার তাঁরই নাম উচ্চারণ করছে তিনি জানেন। তাঁর সমস্ত চলাফেরা, ছোটা, বল ধরা বা মারা এ সবগুলিই বারংবার দেখানো হবে, বর্ণিত হবে, ব্যাখ্যা করা হবে। মাঠের বাইশজনের মধ্যে বাদ বাকি একুশজনের কোনও গুরুত্বই নেই এই হাজার লক্ষ কোটি মানুষের কাছে।
এত দিয়েছি তোমাদের–তবু কেন চাও? এবার চোখ ফিরিয়ে নাও আমার দিক থেকে। ফিরিয়ে নাও। আমি যে কখনও নিজমনে থাকতে পারি না।–এই কথা তিনি মনে-মনে বললেন।
চেষ্টাহীন রইলেন সারাক্ষণ। ছুটলেন না, উদ্যোগ করলেন না, বল কেউ কেড়ে নিতে এলে সহজেই ছেড়ে দিলেন। জানেন, তিনি চেষ্টা করলে কিছুতেই ওরা কেড়ে নিতে পারবে না। জানেন, তিনি যদি বল পায়ে ছোটেন তবে এরা বৃক্ষরাজির মতো স্থির হয়ে যাবে। তিনি অনায়াসে গোলরক্ষককে ঠেকিয়ে বল পাঠাতে পারেন জালে। কিন্তু কেন তা করবেন তিনি? আরও হাজার লক্ষ কোটি চোখকে নিজের ওপর টেনে আনতে? আরও অনির্জন, একাকিত্বহীনতাকে বরণ করবেন? ভক্তের মৃগয়া কি এক সময়ে শেষ করা উচিত নয়? ওরা ভাবুক তিনি জাদুকর নন, স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ মাত্র।
খেলা শেষ হল। ড্র। তিনি বুঝলেন, তাঁর দল ম্লানতার ছায়ায় ফিরে যাচ্ছে ড্রেসিং রুমে। সবাই বলছে–উনি আজ খেলতে পারেননি।
তিনি হাসলেন আপনমনে। আজ একরকম আনন্দ হয় তাঁর। আনন্দটা নিখাদ নয়। একটু বিষাদের বিষ তাতে মিশে থাকে।
পরদিন রাতে সুদুর স্বদেশের দিকে ধাবমান বিমানে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। ঘুমের মাঝখানে অকারণে জেগে উঠলেন একবার। কেন জাগলেন তা বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু জাগলেন। মনে হল, খুবই ক্ষীণ একটা বাঁশির আওয়াজ যেন ঘুমঘোরে শুনেছেন তিনি। কোনও নিয়মভঙ্গের জন্য রেফারি যেমন বাঁশি বাজায়।
তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে চারদিকে চাইলেন। সবাই ঘুমে। বাইরে নীল রাত্রির আকাশ তীর বেগে উঠে যাচ্ছে।
নিয়ম ভঙ্গ ঘটল নাকি কিছু? কখন? কোথায়? তিনি ভাবলেন, খুঁজলেন মনে-মনে। তাঁর সারামুখে, শরীরের অজস্র শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের বন্ধুরতা। ডান গালে একটি প্রিয় ক্ষত চিহ্নে তিনি প্রায়ই আঙুল বুলিয়ে নেন। এখনও নিলেন, কিছু মনে পড়ল না।
আবার ঘুমোতে চেষ্টা করলেন তিনি। হেলানো সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুঝলেন। খুব স্বস্তি পেলেন না। তাঁর ভিতর থেকে কে যেন বলছে–ঠিকই শুনেছিলে। বাঁশি বেজেছিল।
এবার তিনি মৃদু হাসলেন। মাথা নাড়ালেন আপন মনে। জানেন, তিনি জানেন। নিয়মভঙ্গের জন্য কোথাও কে যেন বাঁশি বাজিয়েছে। ঠিক কখন নিয়মভঙ্গ ঘটেছে তা তিনি জানেন না। ফাউল? না হ্যান্ডবল? অফসাইড নয় তো?
এসব নয়। তিনি তা জানেন। খেলার মাঠটা আর ছোট থাকছে না। বড় ছড়িয়ে পড়ছে এবার। বিশাল তার পরিধি। সারা পৃথিবীময় আকাশময়, খেলাও এবার কত বিচিত্র! কত নিয়ম, কত অনিয়ম! অলীক রেফারি তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছে, সতর্ক করছে।
প্রসন্ন মনে তিনি মাথা নাড়লেন।