খেলার সঙ্গী
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পায়ের শব্দেই মানুষ চেনা যায়। বাবা ফিরছেন অফিস থেকে। অভির বাবা বেশ লম্বা-চওড়া মানুষ, তিনি কাজ করেন টেলিফোন অফিসে। অফিস থেকে ফেরেন অনেক দেরি করে। আবার বাড়িতে ফিরেও মেতে থাকেন কাজ নিয়ে।
তবে, বাবা প্রায় রোজই কিছু-না-কিছু জিনিস নিয়ে ফেরেন। কোনোদিন গরম সিঙাড়া, কোনোদিন আইসক্রিম, কোনোদিন সবেদা বা কমলালেবু।
বাবা বসবার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে বললেন, কচুরি-তরকারি এনেছি, খাবি নাকি?
অভি খেলা করছিল কম্পিউটারে। সে বুঝে গেল, এবার তাকে উঠতে হবে। কচুরি খাওয়ার জন্য বড়োজোর দশ-পনেরো মিনিট, তারপরই পড়তে বসা। বাবা তখন বসবেন কম্পিউটারে।
মা গান করেন, বাড়িতেও অনেক ছেলে-মেয়েকে গান শেখান। এখন দশ-বারোটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটা ক্লাস চলছে, সবাই মিলে একসঙ্গে গাইছে, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…।’
বাবা বাড়ি ফিরলেই এই ক্লাস ছুটি হয়ে যায়।
এরপর খাওয়ার টেবিলে বসে জলখাবার খেতে খেতে খানিকটা গল্প হয়। তারপর বাবা বসে যান কম্পিউটারে, মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সংসারের কাজে। রান্না করেন অবশ্য সুশীলা মাসি, তবু কতরকম কাজ থাকে, বিশেষ করে বারবার টেলিফোন।
অভি ক্লাস এইটে পড়ে, কিন্তু বাড়িতে তার জন্য কোনো মাস্টারমশাই আসে না। অঙ্কে সে খুবই ভালো, ইতিহাস-ভূগোলেও ভালো নম্বর পায়, শুধু ইংরেজিতে একটু কাঁচা।
মা মাঝে মাঝে এসে সাহায্য করেন অভিকে। মা যেমন ভালো গায়িকা, তেমনি ইংরেজিও জানেন খুব ভালো। একসময় একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন, এখন ছেড়ে দিয়েছেন, এখন নিজেরই তো বাড়িতে গানের স্কুল।
এত ছেলে-মেয়েকে গান শেখান মা, কিন্তু নিজের ছেলেকে গান শেখাতে পারলেন না। কয়েকদিন গানের ক্লাসে অভিকে জোর করে বসিয়েছিলেন। তারপর একদিন হতাশভাবে বললেন, যা:, আমার ছেলেটার দ্বারা গান হবে না। গলায় একদম সুর নেই।
বাবাকে মা বলেছিলেন, গিটার কিংবা সেতারের মতন কোনো যন্ত্রসংগীত শেখালে হয় অভিকে। একজন ভালো মাস্টার দরকার।
সে ব্যবস্থা এখনও হয়নি। কিন্তু একটা যন্ত্র অভি খুব ভালো পারে। কম্পিউটার।
প্রথম প্রথম বাবার কম্পিউটারে হাত দিলেই মা এসে বকাবকি করতেন। যদি নষ্ট হয়ে যায়। বাবা কিন্তু আপত্তি করেননি। বাবা বলেছিলেন, কম্পিউটার চট করে খারাপ হয় না। আর ছোটোরা বড়োদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি শিখে যায়।
এখন অভি ইন্টারনেট খুলতে পারে। অচেনা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলাও যায়, অবশ্য লিখে লিখে। কী করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো জায়গা চলে আসতে পারে চোখের সামনে।
একবার কম্পিউটারের সামনে বসলে অভির আর উঠতেই ইচ্ছে করে না।
কিন্তু বাবা বাড়িতে থাকলে অভি আর সুযোগ পায় না। তা ছাড়া ইস্কুলে যাওয়া, বিকেলে সাঁতার কাটা, হোমটাস্ক করা আছে। তবু যখনই সময় পায় বসে পড়ে।
একদিন ছুটির দুপুরে অভি কম্পিউটারে দাবা খেলছে, হঠাৎ একটা অদ্ভুত কান্ড হল।
এই দাবা খেলায় তো উলটো দিকে কোনো মানুষ থাকে না। কম্পিউটার নিজেই খেলোয়াড়। অভি একটা চাল দিলে কম্পিউটার মুহূর্তের মধ্যে উলটো চাল দিয়ে দেয়। একটু ভুল চাল দিলে আর উপায় নেই। কম্পিউটার ফেরত নিতে দেবে না।
অভি এ পর্যন্ত কম্পিউটারকে একদিনও দাবা খেলায় হারাতে পারেনি। যদিও তার বন্ধুরা কেউ পারে না তার সঙ্গে। আজকাল অভির বয়েসি অনেক ছেলেও দাবা খেলার কম্পিটিশনে বিদেশে যায়। দিব্যেন্দু বড়ুয়া আর সূর্যকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের কত নাম হয়েছে। অভিরও ইচ্ছে সে একদিন বিদেশে যাবে। এর মধ্যে সে গোর্কি সদনে দুটো প্রতিযোগিতাতেও জিতেছে।
সেই দুপুরে, কম্পিউটারের সঙ্গে দু-বার হেরে যাবার পরে অভি যখন আর একবার খেলা শুরু করতে যাচ্ছে, হঠাৎ কম্পিউটারে একটি ছেলের মুখ ভেসে উঠল।
মুখখানা প্রথমে বেশ চেনা চেনা মনে হল।
তারপরেই সে চমকে উঠল, আরে:। এ তো তার নিজেরই মুখ। আয়নায় যেমন দেখা যায়!
কিন্তু কম্পিউটারে তো নিজের মুখ ফুটে উঠতে পারে না। এটা তো এমনি ছবি নয়, জ্যান্ত মুখ।
মুখখানা প্রথমে বেশ চেনা চেনা মনে হল।…
মিটিমিটি হাসছে।
সে চেঁচিয়ে বলল, মা, শোনো, একবার দেখে যাও?
দুপুরে খাওয়ার পর মা-র অনেকক্ষণ খবরের কাগজ পড়া অভ্যেস। কাছেই বসেছিলেন তিনি। কাগজ পড়তে পড়তেই অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী?
অভি উত্তেজিতভাবে বলল, এখানে এসো। আমি নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছি।
মা কাগজ হাতে নিয়ে উঠে এসে অভির পাশে দাঁড়ালেন। কম্পিউটারের পর্দা থেকে এর মধ্যেই সেই মুখটা মুছে গেছে, সেখানে এখন দুটো গাড়ির রেস চলছে।
অভি বলল, যা:, চলে গেল। সত্যিই আমার মুখটা ফুটে উঠেছিল। একেবারে স্পষ্ট।
মা অভির দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বললেন, চল, একটু শুয়ে নিবি।
অভি বলল, তুমি বিশ্বাস করছ না? সত্যি দেখেছি।
মা বললেন, অনেকক্ষণ কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়। তাতে লোকে ভুলভাল দেখে। কম্পিউটার কী আয়না যে নিজের মুখ দেখবি! ওটা অসম্ভব! এক যদি ছবি হয়, কেউ ছবি পাঠিয়ে দেয়।
অভি বলল, না ছবি নয়। নড়াচড়া করছিল।
এর মধ্যে টেলিফোন বেজে উঠল। মা পাশের ঘরে যেতে যেতে বললেন, আর খেলতে হবে না। এবার বন্ধ করে শুতে চলে যা—।
মা চলে যেতেই আবার ফিরে এল অভির মুখ।
অভি ভুরু কুঁচকোতেই সেই মুখটারও ভুরু কুঁচকে যায়। অভি জিভ ভ্যাঙালে সেও ভ্যাঙানো জিভ বার করে। অভি একটা চিমটি কাটল নিজের গালে, সেও চিমটি কাটল বটে, কিন্তু হাসতেও লাগল। অভি তখন হাসছে না।
তার মানে আয়নার ছবির মতনও তো নয়।
তাহলে কী পৃথিবীতে কোথাও ঠিক তার মতন চেহারার একটা ছেলে আছে? তা হতেও পারে।
অভি জিজ্ঞেস করল, এই, তুমি কে? তোমার নাম কী?
সেই ছেলেটি বলল, অভিরূপ মজুমদার। ডাক নাম অভি।
অভি বলল, যা: ওটা তো আমারও নাম। তুমি আমার নাম চুরি করেছ?
সে বলল না। তুমি আমার নাম চুরি করেছ।
অভি অবিশ্বাসের সুরে বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?
সে বলল, ক্লাস এইট।
অভি আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাক তুমি?
সে বলল, সে অনেক দূরে। সে জায়গাটার নাম দিকশূন্যপুর।
আবার অভি বেশ চমকে গেল। কম্পিউটার তো কথা বলে না। মানে গলার আওয়াজে কোনো উত্তর আসে না। সব প্রশ্নের উত্তর লেখায় ফুটে ওঠে।
কিন্তু এখানে সে ওই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছে কী করে?
আর কিছু জিজ্ঞেস করা গেল না। মা এ ঘরে ফিরে আসতেই মিলিয়ে গেল মুখটা।
মা বললেন, এখনও বসে আছ? বললাম না, বন্ধ করো। চলো, আমার পাশে আধঘণ্টা শোবে।
এরপর দু-দিন আর কিছুই হল না। দেখা গেল না সেই মুখ। অভি কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলে যথারীতি হারতে লাগল।
তৃতীয় দিন, বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছেন, মা গেছেন একটা গানের জলসায়, বাড়িতে অভি একা। সে পড়তে না-বসে সন্ধ্যে বেলা মনের আনন্দে খেলা করতে লাগল কম্পিউটারে।
হঠাৎ ফিরে এল সেই মুখটি।
আজ সে নিজেই আগে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখনও পড়তে বসোনি? বেশ মজা, তাই না?
অভি বেশ কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যি করে বলো তো, তুমি কে?
ছেলেটি বলল, বা:, সেদিন বললাম তো, আমার নাম অভিরূপ মজুমদার।
অভি দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল, না। তোমার চেহারাটা আমার মতন হতে পারে, কিন্তু নামটাও কী করে এক হবে?
ছেলেটি কিন্তু মাথা নাড়ল না। মুচকি হেসে বলল, এরকম হয়। অনেক কিছু হয়। এই বিজ্ঞানের যুগে কত কান্ডই না-হচ্ছে।
অভি তবু অবিশ্বাসের সুরে বলল, তোমার বাবার নাম কী?
ছেলেটি বলল, প্রাণেশ মজুমদার। মায়ের নাম অরুণিমা। আমার মা খুব ভালো গান করেন। আমি অবশ্য গান গাইতে পারি না।
মিলে যাচ্ছে। সব কিছু মিলে যাচ্ছে। শুধু ছেলেটা থাকে অন্য জায়গায়। দিকশূন্যপুর না কী-যেন নাম বলেছিল জায়গাটার।
অভি বলল, তুমি ঝাল খেতে পার?
ছেলেটি বলল, একটু একটু, খুব বেশি না।
অভি বলল, তুমি কী খেতে ভালোবাস? মাছ না মাংস?
ছেলেটি বলল, দুই-ই। তবে মাছের মধ্যে চিংড়িমাছ আমার সবচেয়ে ফেভারিট।
অভি বলল, তুমি কখনো দার্জিলিং গেছ?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ।
অভি বলল, তুমি কী কী খেলতে ভালোবাস?
ছেলেটি বলল, সাঁতার, শীতকালে টেবিল টেনিস, আর দাবা। দাবা খেলাই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তুমিও তো দাবা খেল। আমাকে হারাতে পারবে?
অভি বলল, তুমি কেমন খেল, তা তো আমি জানি না। তবে অনেকেই আমার কাছে হেরে যায়। গোর্কি সদনে একটা কমপিটিশনে আমি জুনিয়ার গ্রূপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।
ছেলেটি অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বলল, ইস, ভারি তো চ্যাম্পিয়ন! ভালো খেলোয়াড় কেউ ছিলই না। আমার সঙ্গে লড়ে দেখ না। আমি বলে বলে তোমায় হারাব।
অভিও হেসে বলল, তাই নাকি! দেখা যাক তাহলে।
অমনি পর্দায় ভেসে উঠল একটা দাবার ছক। তার একপাশে বাবু হয়ে বসে আছে ছেলেটি। সে বলল, তুমি সাদা নেবে, না কালো? যেটা ইচ্ছে। তুমিই প্রথম চাল দাও।
ঠিক সাত মিনিটের মধ্যে হেরে গেল অভি।
সে রেগে গিয়ে বলল, তুমি কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েছ। কম্পিউটারের সঙ্গে কেউ পারে?
ছেলেটি বলল, মোটেই না। আমি নিজে খেলছি। ঠিক আছে, আর এক দান হোক। এবারে তুমি দুটো ভুল চাল ফেরত নিতে পারবে। কম্পিউটার তো সে সুযোগ দেয় না!
পরের দানে অভি হেরে গেল ন-মিনিটে। এরপর থেকে শুরু হয়ে গেল ওদের দু-জনের মধ্যে একটানা প্রতিযোগিতা। যখনই সুযোগ পায়, অভি ওই ছেলেটির সঙ্গে দাবা খেলতে বসে। প্রত্যেকবার সে হারে।
যত হারে, তত জেদ বেড়ে যায় অভির। ওকে একদিন-না-একদিন হারাতেই হবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ঘরে অন্য লোক ঢুকলেই ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন খেলা থেমে যায় মাঝপথে।
একেবারে নিরিবিলি সময় পাওয়াই মুশকিল। মা আর বাবা দু-জনেই বাড়িতে থাকবেন না, এমনও তো হয় খুব কম।
অভি ভোরবেলা উঠে কম্পিউটার খুলতে লাগল।
একটা সুবিধা এই, মা দেরি করে জাগেন। তারপরেও অনেকক্ষণ অন্য ঘরে বসে গানের গলা সাধেন।
বাবা ঘুম থেকে উঠে অভিকে কম্পিউটারের সামনে দেখলেও বকাবকি করেন না। বাবা বাথরুমে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান, সেখানে বসে খবরের কাগজ পড়েন। তারপর বসবার ঘরে এলেই অভি কম্পিউটার ছেড়ে উঠে যায়।
এইরকম চলল মাসের পর মাস।
এখন আর অভির অন্য কোথাও বেড়াতে যেতেও ইচ্ছে করে না। ওই ছেলেটাকে একবার না-হারাতে পারলে তার মনে শান্তি হবে না।
এর মধ্যে গোর্কি সদনে আর একটা প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়ে অভি সব ক-টা রাউণ্ডে জিতে এল, অথচ এ ছেলেটাকে হারানো যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রত্যেকবার জিতে গিয়ে ছেলেটা যখন হাসে, রাগে অভির গা জ্বলে যায়।
এর মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে নানারকম গল্পও হয়। সব ব্যাপারেই দু-জনের খুব মিল, শুধু দাবা খেলার ক্ষমতা ছাড়া।
এক রবিবার দুপুরে বড়োমামা নিয়ে এলেন অনেকগুলো প্রকান্ড সাইজের গলদা চিংড়ি।
সে চিংড়ির কী অপূর্ব স্বাদ। মাথায় হলদে রঙের ঘিলু। দাড়াগুলোও বড়ো বড়ো। দারুণ মালাইকারি রান্না করলেন মা নিজে। অভি দু-দুটো চিংড়ি খেয়ে ফেলল।
সন্ধ্যে বেলা বড়োমামাকে নিয়ে মা-বাবা টিভি-তে কী একটা বাংলা সিনেমা দেখছেন পাশের ঘরে। অভি এসে খুলে ফেলল কম্পিউটার।
ছেলেটির মুখ দেখা যেতেই অভি জিজ্ঞেস করল, আজ দুপুরে কী খেয়েছ?
ছেলেটি হেসে বলল, তুমি বুঝি ভাবছ, আমার চেয়েও ভালো ভালো খাবার খেয়ে তুমি জিতবে? মোটেই না। আমিও আজ গলদা চিংড়ি খেয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো খাবার।
হঠাৎ অভির মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল।
সে বলল, তুমি একদিন আমাদের বাড়িতে আসবে?
ছেলেটি বলল, কেন?
অভি বলল, কেন, মানে, তুমি এলে আমরা সামনাসামনি অনেক গল্প করব। তুমি বই পড়তে ভালোবাস? আমার অনেক বই আছে।
ছেলেটি বলল, কী করে যাব? আমি তো কলকাতায় থাকি না। আমার বাড়ি অনেক দূরে, দিকশূন্যপুর। তুমিই বরং একদিন এসো আমার বাড়িতে। আমার কাছেও অনেক বই আছে।
অভি বলল, এসো, একটু খেলি।
ছেলেটি বলল, এত বার হেরেও তোমার শিক্ষা হয়নি! বলেছি তো, আমার সঙ্গে তুমি পারবে না।
অভি বলল, তোমাকে যদি একবার না-হারাতে পারি, তাহলে আমার নামই মিথ্যে। আমি খেলা ছেড়ে দেব। তুমি যদি আমাদের বাড়িতে আসতে পারতে, তাহলে মুখোমুখি বসে দাবার ছক পেতে খেলতাম।
সেই ছেলেটি বলল, তার মানে, তুমি আমাকে এখন অবিশ্বাস করছ? তুমি ভাবছ, আমি কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে তোমাকে চিটিং করছি? মোটেই না। আমি তিন সত্যি করে বলছি, পুরোটাই আমি নিজে নিজে খেলি! তোমার মতন আমি মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাই না। বারবার হেরে গিয়ে যদি তোমার রাগ হয় তো বলে দাও, আমি আর আসব না। আমি আর খেলব না!
অভি বলল, না, না, আমি খেলব। একদিন-না-একদিন তোমাকে হারাবই! এবার শুরু হোক!
সেবারেও হেরে গেল অভি।
বাবা কিংবা মা ব্যাপারটা কোনোদিনই জানতে পারলেন না। ওঁরা ঘরে এলেই যে ছেলেটি মুছে যায়।
এক এক সময় অভি খেলায় এমনই তন্ময় হয়ে থাকে যে বাবা কিংবা মা ঘরে এলেন কিনা সে টেরও পায় না। কিন্তু ছেলেটা ঠিক টের পায়। খেলার মাঝপথে কম্পিউটারের পর্দা হঠাৎ সাদা হয়ে যায়, কিংবা অন্য ছবি ফুটে উঠলেই অভি ঘাড় ফিরিয়ে দেখে মা কিংবা বাবা দরজা দিয়ে এ ঘরে ঢুকছেন।
একদিন এইরকম খেলার সময় তার মামাতো বোন রিনি এসে পড়েছিল। রিনি আর অভি প্রায় সমান সমান। ওরা থাকে দক্ষিণেশ্বরে, তাই বেশি দেখা হয় না। তবে মাঝে মাঝে আসে।
অভি তখন কম্পিউটারে খেলা নিয়ে মেতে আছে, রিনি চুপিচুপি পেছন দিক থেকে এসে ওর চোখ টিপে ধরল।
তারপর বলল, বলো তো আমি কে?
এ আর বলা শক্ত কী? গলার আওয়াজটাও চেনা, আঙুলের ছোঁয়াটাও চেনা।
তাই অভি বলল, রিনি! কখন এলি!
রিনি বলল, এইমাত্র! তুই কম্পিউটারের সাদা স্ক্রিনের সামনে বসে কী করছিলি? ঘুমোচ্ছিলি নাকি?
তার মানে রিনিকে দেখেও সে ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। অভি ছাড়া আর কারুর কাছেই সে দেখা দেবে না। এ তো বেশ মজার ব্যাপার।
চোখ থেকে রিনির আঙুল সরিয়ে নিয়ে সে দেখল, সত্যিই কম্পিউটারের পর্দাটা একেবারে সাদা।
রিনি হাসতে হাসতে বলল, অনেকে ঘুমোয়। আমার দাদাও কম্পিউটারে বসে কাজ করতে করতে ঘুমে ঢুলে পড়ে।
অভি অবশ্য কোনোদিন ঘুমে ঢুলে পড়েনি।
আগে আগে রিনি এলে তার খুব ভালো লাগত। দু-জনে গল্প হত কতরকম। রিনিদের বাড়িটা তো অভিদের মতন ফ্ল্যাটবাড়ি নয়। সেখানে সামনে অনেকখানি বাগান। অভি দক্ষিণেশ্বরে মামাবাড়ি গেলে সেই বাগানে ব্যাডমিন্টন খেলেছে।
আজ কিন্তু রিনির সঙ্গে গল্প তেমন জমছে না। অভি মনে মনে ভাবছে, আবার কখন ওই ছেলেটার সঙ্গে খেলা হবে। ওই অংহকারী ছেলেটাকে না-হারিয়ে তার শান্তি নেই।
এর কয়েকদিন পরে এক বিকেলে আবার একটা দারুণ ব্যাপার হল।
অভি ইস্কুল থেকে ফিরেই কম্পিউটার নিয়ে বসেছে। আজ আর সাঁতারে যাবার কথা নেই। বাবা অফিস থেকে ফেরেননি, মা কোণের ঘরে গানের ক্লাস নিচ্ছেন।
খেলা শুরু হয়ে গেছে। অভি একসময় জিজ্ঞেস করল, শোনো, তোমাদের ওই দিকশূন্যপুর জায়গাটা কেমন?
ছেলেটি বলল, ভারি সুন্দর। পাহাড় আছে, ঝরনা আছে, মেঘ আছে, কতরকম পাখি, আর সবুজ ধানের খেত।
অভি বলল, কত দূরে? দক্ষিণেশ্বরের থেকে দূরে? কিংবা ঝাড়গ্রাম?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, তার চেয়েও দূরে।
অভি জানতে চাইল, কী করে সেখানে যেতে হয়?
ছেলেটি তাকে ধমক দিয়ে বলল, খেলায় মন দাও, নইলে এক্ষুনি কিস্তি হয়ে যাবে কিন্তু।
অভি বলল, অত সোজা নয়!
এটা ঠিক, ছেলেটি প্রত্যেকবারই অভিকে হারিয়ে দেয় বটে, কিন্তু আগের মতো অত সহজে সাত মিনিটে বা ন-মিনিটে পারে না।
এক এক সময় তাকেও বেশ মাথা ঘামাতে হয়।
একটু পরে অভি আবার জিজ্ঞেস করল, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। ঘরে অন্য কেউ এলেই তুমি হাওয়া হয়ে যাও কেন?
ছেলেটি বলল, আমায় দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে? কম্পিউটারে কারুর সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারে? এটা আমি একটা বিশেষ কায়দা বার করেছি। এখনও তোমাকে ছাড়া আর কারুকে জানাইনি। এখন কেউ হঠাৎ দেখে ফেললে চ্যাঁচামেচি করবে। কী করে হল, কেমন করে হল, এই নিয়ে শোরগোল চলবে, ওসব কী ভালো লাগবে? একদিন সারা পৃথিবীকে একসঙ্গে এই আবিষ্কারের কথা জানাব। তখন শুধু তুমি আমার পাশে থাকবে।
তারপরই সে চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই!
অভি বলে উঠল, —চেক! এবার?
সেই ছেলেটির রাজার ঠিক সামনে অভির মন্ত্রী আর একপাশে পজিশান নিয়ে আছে তার ঘোড়া। রাজার আর বাঁচার পথ নেই।
অভি বলল, কী, আর চাল দিতে পারবে?
ছেলেটি হতাশভাবে বলল, না।
অভি বলল, তাহলে তোমাকে হারিয়েছি? স্বীকার করছ?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, স্বীকার করছি।
জয়ের আনন্দে অভির ইচ্ছে হল লাফিয়ে উঠতে। ঘরের মধ্যে দু-হাত তুলে নাচতে।
কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে জিজ্ঞেস করল, আর এক দান খেলবে? আবার তোমাকে হারাব!
ছেলেটি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সিঁড়িতে শোনা গেল ভারি জুতোর শব্দ।
বাবা চেঁচিয়ে বললেন, অভি! অভি কোথায়?
অভির বুকটা কেঁপে উঠল। খারাপ কিছু হয়েছে নাকি? বাবা তো কখনো সিঁড়ি দিয়ে ডাকতে ডাকতে ওঠেন না। গলার আওয়াজটাও কেমন যেন অস্বাভাবিক।
মা-ও বেরিয়ে এসেছেন গানের ঘর থেকে।
বাবা ওপরে এসে উত্তেজিতভাবে বললেন, আজ কী হয়েছে জান? তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না। একটু আগে আমার অফিসে কে ফোন করেছিলেন? স্বয়ং ক্রীড়ামন্ত্রী!
মা উৎকন্ঠিতভাবে বললেন, কেন?
বাবা অভির দিকে তাকিয়ে বললেন, এদিকে আয়।
অভি এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমাদের অভি জার্মানি যাবে। ক্রীড়ামন্ত্রী ফোন করে বললেন, জুনিয়ার দাবা গ্রূপে আমাদের দেশের হয়ে খেলতে যাবে অভি, কম্পিউটারে বারবার ওর নামই উঠেছে।
প্রথম খেলা হবে বার্লিনে, বাবা-মা দু-জনেই যাবেন অভির সঙ্গে। মা তক্ষুনি টেলিফোনে এই ভালো খবরটা জানাতে লাগলেন আত্মীয়-বন্ধুদের।
অভি ভাবল, সেও খবরটা দেবে তার খেলার সঙ্গীকে।
কম্পিউটারের পর্দাটা সাদা হয়ে আছে। অভি অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু সেই ছেলেটিকে আর পাওয়া গেল না।
এরপর কয়েকদিন ধরে অভির জার্মানি যাবার সব ব্যবস্থা হতে লাগল। পাসপোর্ট পেতে হবে, কিনতে হবে শীতের দেশের জামাকাপড়, সময় বেশি নেই।
এরই ফাঁকে ফাঁকে সে কম্পিউটারে খুঁজতে লাগল ছেলেটিকে। কিন্তু আর কিছুতেই তাকে ধরা যাচ্ছে না। দাবার বোর্ড দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে সে নেই।
আর কী কোনোদিন দেখা হবে না তার সঙ্গে?
দিকশূন্যপুর কী করে যেতে হয়, সেটাও শেষপর্যন্ত জানা হয়নি।
অভি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর একটু বড়ো হয়ে সে নিজেই ঠিক খুঁজে বার করবে দিকশূন্যপুর। সেখানে দেখা করবে ঠিক তার মতন চেহারার ছেলেটির সঙ্গে। এই বন্ধুটিকে সে চিরকালের মতন হারিয়ে যেতে দেবে না।