খেলার আসর
কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন
তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব
প্রথম প্রকাশ: ২০১১
এক
গরমের এক দিনে পেনসিলভেনিয়ার ফ্রগ ক্রীকের বনভূমিতে উদয় হয় রহস্যময় এক ট্রী হাউস।
তিন বন্ধু ট্রী হাউসে উঠে দেখে ওটা বই দিয়ে ঠাসা।
শীঘ্রিই ওরা টের পায় ট্রী হাউসটা জাদুর। বইয়ে উল্লেখ করা নানান জায়গায় ওদেরকে নিয়ে যেতে পারে ওটা। ওদের শুধু কোন ছবিতে আঙুল রেখে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয়, ব্যস।
এভাবেই একটা সময় ওরা জানতে পারে, ট্রী হাউসটার মালিক মরগ্যান লে ফে। রাজা আর্থারের সময়কার এক জাদুকরী লাইব্রেরিয়ান সে। টাইম ও স্পেসে ভ্রমণ করে বই সংগ্রহ করে।
তিন বন্ধু আর জিনাকে ‘ML লেখা গোপন লাইব্রেরি কার্ড দিয়েছে মরগ্যান। ওরা যাতে প্রাচীন লাইব্ররিগুলো থেকে গল্প জোগাড় করতে পারে…
.
‘জেগে আছ?’ আঁধার ভেদ করে ভেসে এল জিনার কণ্ঠ
‘হ্যাঁ,’ নিজের বিছানা থেকে বলল কিশোর।
‘উঠে পড়ো, সূর্য ওঠার আগেই ট্রী হাউসে পৌছতে হবে আমাদের।’
‘আমি রেডি,’ জানাল কিশোর।
কম্বল ছুঁড়ে ফেলে এক লাফে বিছানা ছাড়ল ও। পরনে জিন্স আর টি-শার্ট।
‘কাপড় পরেই ঘুমিয়েছিলে নাকি?’ প্রশ্ন করল জিনা।
‘সময় নষ্ট করতে চাইনি,’ বলল কিশোর। ব্যাকপ্যাক তুলে নিল।
হেসে উঠল জিনা।
‘প্রাচীন গ্রীসে যেতে বুঝি তর সইছে না?’ বলল ও।
‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল কিশোর।
‘গোপন লাইব্রেরির কার্ডটা আছে তো?’
‘হ্যাঁ, তোমারটা?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
‘নিশ্চয়ই। ব্যাকপ্যাকে রেখে দাও,’ বলে নিজের কার্ডটা কিশোরকে দিল জিনা। ‘আমি ফ্ল্যাশলাইটটা নেব।’
‘অল সেট, বলল কিশোর।
পা টিপে টিপে নীচে নেমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
বাইরে বাতাস টাটকা আর ঠাণ্ডা।
‘চাঁদ নেই,’ বলল জিনা। ‘শুধু তারা।’
ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল ও।
‘টা-ডা!’ বলল। ‘চলো।’
আলোর রশ্মি অনুসরণ করে ইয়ার্ড পেরোল ওরা। রাস্তায় উঠল।
প্রাচীন গ্রীসে যাচ্ছে বলে মহা উত্তেজিত কিশোর। কিন্তু কিছু একটা জ্বালাচ্ছে ওকে।
‘গ্রীসে যাওয়ার পর কী ঘটবে বলে মনে করো?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘এটাই কি আমাদের শেষ মিশন?’
‘আশা করি না,’ বলল জিনা। ‘তোমার কী মনে হয়?’
‘জানি না। চলো মরগ্যানের সাথে কথা বলি,’ বলল কিশোর।
‘জলদি!’
দৌড়তে শুরু করল ওরা। ফ্ল্যাশলাইটের আলো উড়ছে ওদের সামনে, আলোকিত করছে পথ।
ফ্রগ ক্রীক বনভূমিতে পৌঁছে হাঁটার গতিতে নেমে এল ওরা। চারদিকে আলকাতরা অন্ধকার। গাছ-গাছালির মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় আকাশে ফ্ল্যাশলাইটের আলো তাক করল জিনা। শেষমেশ ম্যাজিক ট্রী হাউসের কাছে পৌঁছে গেল ওরা।
‘চলে এসেছি!’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
‘উঠে পড়ো,’ বলল কিশোর।
জিনা দড়ির মইটা বেয়ে উঠতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করল কিশোর।
ট্রী হাউসের চারধারে ফ্ল্যাশলাইটের আলো বোলাল জিনা।
জানালায় বসে ছিল মরগ্যান লে ফে। মুখের উপর আলো পড়তেই চোখে হাত চাপা দিল।
‘লাইটটা বন্ধ করো, জিনা, প্লিজ,’ মৃদু কণ্ঠে বলল।
তা-ই করল জিনা।
‘ওয়েলকাম,’ আঁধার ভেদ করে বলল মরগ্যান। ‘তোমরা কি পরের মিশনের জন্যে তৈরি?’
‘হ্যাঁ!’ বলল কিশোর। এবার ঠাণ্ডা হয়ে এল ওর কণ্ঠ। ‘এটাই আমাদের শেষ মিশন নয় তো?’
‘এবারের মিশন শেষ হলে প্রশ্নটা কোরো। মুসা আর রবিন কই? ওরা যাবে না?’
‘ওরা এবার হিরু চাচার এখানে আসেনি। মুসার জ্বর আর রবিন গেছে খালার বাসায় বেড়াতে,’ জানাল জিনা। ‘এবার আমি আর কিশোর যাব।’
‘আমরা আরও অনেক জায়গায় যেতে চাই,’ বলল কিশোর।
‘সাহসী ছেলে,’ বলল মরগ্যান। একটা খস খস শব্দ উঠল। ‘এই যে এবারের টাইটেল। তোমার ফ্ল্যাশলাইটের আলো, জিনা।
ফ্ল্যাশলাইটটা আবারও জ্বালল জিনা। কাগজের উপর পড়ল আলো।
‘গ্রীক নাকি?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘হ্যাঁ,’ জানাল মরগ্যান।
আলখেল্লার ভিতরে হাত ভরে একটা বই বের করল সে।
‘তোমাদের রিসার্চের জন্য,’ বলল সে।
বইটা ওর হাত থেকে নিল কিশোর। প্রচ্ছদের উপরে আলো
ফেলল জিনা। পড়ল ওরা: ‘এ ডে ইন এনশেন্ট গ্রীস।’
‘একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে। কী সেটা?’ মরগ্যান প্রশ্ন ছুঁড়ল।
‘রিসার্চ বইটা আমাদেরকে গাইড করবে,’ বলল কিশোর।
‘কিন্তু চরম বিপদের সময় শুধুমাত্র হারানো গল্পটাই আমাদেরকে বাঁচাতে পারবে,’ বলল জিনা।
মাথা ঝাঁকাল মরগ্যান।
‘তোমাদের গোপন লাইব্রেরি কার্ড সবচাইতে জ্ঞানী মানুষটিকে দেখাবে,’ বলল ও।
‘ভাববেন না। দেখাব। বাই!’ বলল জিনা।
কিশোর বইটার প্রচ্ছদে আঙুল রেখে উত্তেজনায় শিউরে উঠল।
‘আমরা ওখানে যেতে চাই,’ বলল ও।
‘আমরা আরও অনেক জায়গায় যেতে চাই!’ যোগ করল জিনা।
বাতাস বইতে শুরু করল।
বন-বন করে ঘুরছে ট্রী হাউসটা।
দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে গতি।
এবার সব নিথর হয়ে এল।
চারদিক নিঃশব্দ।
দুই
কিশোর চোখ মেলল। ঝলমলে রোদ ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে ট্রী হাউসের ভিতরে।
‘এখানে ফ্ল্যাশলাইটের দরকার নেই,’ বলল ও।
ওদের পরনে এখন মরগ্যানের দেয়া প্রাচীন গ্রীসের পোশাক— টিউনিক আর স্যাণ্ডেল। ব্যাকপ্যাকের বদলে চামড়ার এক থলে।
জানালা দিয়ে বাইরে চাইল জিনা।
‘আমরা একটা জলপাই গাছে নেমেছি!’ বলল ও।
জানালা ভেদ করে চাইল কিশোর। শ্বাস চাপল।
‘ভুল জায়গায় নামিনি তো?’ প্রশ্ন করল।
‘জানি না,’ বলল জিনা। ‘গাছপালার ওদিকটায় দেখো। মনে হচ্ছে না বড় ধরনের মেলা বসেছে?’
কিশোর চাইল। জিনা ঠিকই বলেছে। জলপাই কুঞ্জের ওপাশের মাঠে সারি সারি সাদা তাঁবু। মাঠের ওপারে কয়েকটা লাল ইঁটের স্তম্ভওয়ালা দালান আর জনতার ভিড়।
‘কী হচ্ছে ওখানে?’ কিশোর প্রশ্ন করল।
চামড়ার থলে থেকে রিসার্চ বইটা বের করল ও। বাইরের দৃশ্যের এক ছবি খুঁজে পেল ও। ছবিটার নীচে এ কথাগুলো লেখা:
অলিম্পিকের আসর প্রাচীন গ্রীসে ২৫০০ বছর
আগে শুরু হয়। প্রতি চার বছর অন্তর ৪০,০০০
মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে অলিম্পিয়া শহরে আসত, অলিম্পিক খেলার
আসর যেখানে বসত।
‘হায়, আল্লাহ, আমরা প্রাচীন অলিম্পিক্সে চলে এসেছি!’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।
‘হ্যাঁ। চলো, গিয়ে দেখি!’ প্রস্তাব করল জিনা। দড়ির মই বেয়ে নামতে শুরু করল।
কিশোর রিসার্চ বইটা ছুঁড়ে দিল চামড়ার থলেতে।
‘ভুলে যেয়ো না আমাদেরকে মরগ্যানের গল্পটাও কালেক্ট করতে হবে,’ জিনাকে অনুসরণ করে বলল ও।
কিশোর মাটিতে না নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল জিনা। এবার জলপাই কুঞ্জ ভেদ করে হাঁটা দিল তাঁবুগুলোর উদ্দেশে।
বাঁশির শব্দ শুনল কিশোর, নাকে এল খাবার রোস্ট করার সুঘ্রাণ। দলে দলে ভাগ হয়ে মানুষজন উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে।
‘আজব ব্যাপার তো, এখানে কোন মেয়ে নেই,’ বলল জিনা।
‘হ্যাঁ, আছে তো।’
‘কোথায়? দেখাও দেখি।
কিশোর চারধারে নজর বুলাল। কিন্তু দেখতে পেল শুধু পুরুষ আর কিশোরদের-কোন মহিলা কিংবা মেয়ে নেই।
এবার এক পথ নাটক চোখে পড়ল ওর। এক মহিলা দাঁড়িয়ে মঞ্চে। মাথায় হলদে চুল, পরনে বেগুনী টিউনিক।
‘ওই যে,’ তর্জনী তাক করল কিশোর।
‘কী করছে ও?’ জিনার প্রশ্ন।
এক সৈন্য মঞ্চে তার সঙ্গে রয়েছে। পরনে দীর্ঘ আলখেল্লা। লাল ঝুঁটিওয়ালা শিরস্ত্রাণ পরায় মুখ ঢেকে রয়েছে।
মহিলা আর সৈন্য পরস্পরের উদ্দেশে হাত নাড়ছে আর উচ্চস্বরে তর্ক-বিতর্ক করছে।
‘ওরা নাটক করছে,’ বলল কিশোর। ‘দেখি তো।’
গ্রীক বইটা বের করে থিয়েটারের এক ছবি খুঁজে নিল ও।
‘শোনো,’ বলল। পড়ে শোনাল:
গ্রীকরা সবার আগে নাটক লিখেছে।
থিয়েটারের অনেক ইংরেজি শব্দ এসেছে
গ্রীক শব্দ থেকে, যেমন ড্রামা, সিনারি,
কোরাস। এখনও প্রচুর গ্রীক নাটক মঞ্চস্থ হয়।
‘অ্যাই, কিশোর, তুমি ভুল বলেছ,’ বলল জিনা।
কিশোর মুখ তুলে চাইতেই দেখতে পেল মহিলাটি তার পরচুলা খুলে ফেলেছে। ফলে বেরিয়ে পড়েছে মহিলার ছদ্মবেশ নেয়া এক কিশোর!
‘এমনকী ও-ও ছেলে, বলল জিনা। ‘অবাক ব্যাপার!’
‘হুম,’ বলে পড়ে চলল কিশোর:
কোন কোন অভিনেতা একাই নাটকের বিভিন্ন
চরিত্রে অভিনয় করতেন। নাটকে মহিলাদের
অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল, তাই পুরুষরাই
নারী চরিত্রে অংশ নিত।
‘এটা ঠিক নয়, বলল জিনা। ‘মহিলাদের কি নাটক করার ইচ্ছা থাকতে পারে না?’
‘ও নিয়ে ভেবো না,’ বলল কিশোর। বইটা সরিয়ে রাখল। ‘এসো অলিম্পিকস দেখি, তারপর গল্পটা খুঁজব।’
জিনাকে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিল এগোনোর জন্য।
ঠিক এসময় কারও কণ্ঠস্বর কানে এল ওদের।
‘দাঁড়াও!’
ঘুরে দাঁড়াল ওরা। ছোট করে ছাঁটা সাদা দাড়িওয়ালা এক লোক এগিয়ে আসছেন ওদের দিকে।
‘এই যে,’ বললেন লোকটি। জিনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ তাঁর। ‘তুমি কে?’
‘আপনি কে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল অবিচলিত জিনা।
তিন
দাড়িওয়ালা লোকটি জিনার দিকে চেয়ে হাসলেন।
‘আমার নাম প্লেটো,’ জানালেন।
‘আপনি প্লেটো? সেই বিখ্যাত দার্শনিক?’ বলে উঠল কিশোর।
শুধু মুচকি হাসলেন প্লেটো।
‘অলিম্পিয়ায় বুক ফুলিয়ে কোন মেয়ের ঘুরে বেড়ানো স্বাভাবিক দৃশ্য নয়,’ বললেন। ‘তোমরা নিশ্চয়ই বহু দূর থেকে এসেছ।’
‘আমরা কিশোর আর জিনা,’ বলল জিনা। ‘আমরা এসেছি পেনসিলভেনিয়ার ফ্রগ ক্রীক থেকে। জায়গাটা অনেক দূরে।’
বিস্মিত দেখাল প্লেটোকে।
কিশোরের দিকে ঘুরে চাইল জিনা।
‘ওঁকে বোধহয় আমাদের কার্ড দেখানো যায়। উনি জ্ঞানী মানুষ।’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। থলেতে হাত ভরে গোপন লাইব্রেরি কার্ড বের করল। প্লেটোকে ও দুটো দেখাল।
কার্ডে চকচক করছে ‘M’ আর ‘L’ অক্ষর দুটো। এর মানে
মাস্টার লাইব্রেরিয়ান।
‘আশ্চর্য!’ বলে উঠলেন প্লেটো। ‘এত কম বয়সী মাস্টার লাইব্রেরিয়ান আগে কখনও দেখিনি। তোমরা অলিম্পিয়ায় এসেছ কেন?’
গল্পের শিরোনাম সমৃদ্ধ কাগজটা টেনে বের করল কিশোর। ‘আমরা এই গল্পটা খুঁজছি,’ জানাল ও।
‘ও, হ্যাঁ, এটা অসাধারণ এক কবির লেখা—উনি আমার বন্ধু,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন প্লেটো।
‘কবি কোথায় থাকেন জানেন আপনি?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘খুব কাছেই।’
‘আপনি আমাদেরকে ওখানে নিয়ে যাবেন?’ জিনা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু একটা কথা। কাউকে বোলো না কবিটা কে। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়,’ বললেন প্লেটো।
‘বলব না,’ ফিসফিস করে বলল জিনা।
প্লেটো ওদেরকে পথ নাটকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
ধুলোটে এক রাস্তা ধরে পা বাড়াল ওরা। রাস্তাটা লোকে লোকারণ্য। সবাই গেমস দেখতে চলেছে।
প্লেটো থমকে দাঁড়ালেন এক বাড়ির দরজার সামনে। বালি রঙের বাড়িটার ছাদ ইঁটের তৈরি।
দরজা খুলে কিশোর আর জিনাকে ফাঁকা এক উঠনে নিয়ে এলেন তিনি।
‘এখানে দাঁড়াও,’ বলে এক দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন।
চারধারে নজর বুলাল ওরা।
কামরাগুলো রোদ ঝলমলে উঠনমুখো। চারধারে পিন পতন নিস্তব্ধতা।
‘লোকজন সব মনে হয় খেলা দেখতে গেছে,’ বলল জিনা।
‘মনে হয়, বলল কিশোর।
গ্রীক বইটা বের করে এক বাড়ির ছবি খুঁজে নিল। তারপর জোরে জোরে পড়ল:
গ্রীক বাড়িতে পুরুষ আর মহিলা আলাদা
আলাদা অংশে বাস করত। মহিলারা
সময় কাটাত সুতা কেটে, তাঁত বুনে আর রান্নাঘরের
দেখাশোনা করে। সাত বছর বয়স হলে ছেলেদেরকে
স্কুলে পাঠানো হত। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার
অনুমতি ছিল না।
‘মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না?’ রেগে গেল জিনা। ‘ওরা লিখতে- পড়তে শিখত কোথায়? এটা একটা কথা হলো?’
এসময় ফিরে এলেন প্লেটো। সঙ্গে এক যুবতী। তার পরনে রঙিন পাড়ের লম্বা আলখেল্লা। হাতে একটা স্কুল।
জিনা চওড়া হাসি হাসল।
‘শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ের দেখা পাওয়া গেল!’
‘কিশোর আর জিনা, তোমাদের অ্যানোনিমাস কবির সাথে পরিচিত হও,’ বললেন প্লেটো।
চার
মহিলা কিশোর আর জিনার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
আপনি লেখা-পড়া শিখলেন কীভাবে?’ জিনার প্রশ্ন।
‘নিজে নিজে শিখেছি।’
‘ও একটা কবিতা লিখে আমার কাছে নিয়ে আসে,’ বললেন প্লেটো। কারণ আমি লোকেদের বলেছি এবং লিখেওছি, গ্রীক মেয়েদের স্কুলে পড়তে পাঠানো উচিত।’
‘ওটা কি কবিতা?’ বলল কিশোর। স্ক্রলটার দিকে ইশারা করল।
‘হ্যাঁ,’ জানাল মহিলা।
‘ওটা চমৎকার এক কাহিনি,’ বললেন প্লেটো। ‘কিন্তু এটা আমাদের দেশে পড়া হলে ওর বিপদ হয়ে যাবে। তোমরা এটা নিজেদের দেশে নিয়ে যেয়ো। ওখানে নিরাপদ থাকবে জিনিসটা।’
মহিলা কবি কিশোরের হাতে স্ক্রলটা তুলে দিল। কিশোর ওটা থলেতে রাখল।
‘আপনার নামটা বলুন, যাতে মানুষকে বলতে পারি গল্পটা কে লিখেছে,’ বলল জিনা।
মাথা নাড়ল মহিলা।
‘সেটা সম্ভব না,’ বলল। জিনার বিষণ্ন মুখের চেহারা দেখে আরও বলল, ‘তোমরা মানুষকে বলতে পারো এটা এক অ্যানোনিমাস লিখেছে।’
‘অ্যানোনিমাস আপনার নাম?’ প্রশ্ন করল জিনা।
‘না, অ্যানোনিমাস মানে বেনামী,’ বললেন প্লেটো।
‘কিন্তু এটা তো সত্যি নয়!’ বলে উঠল জিনা।
‘সত্যের মধ্যে ঝুঁকিটা বড় বেশি,’ বললেন প্লেটো।
মহিলার দিকে চাইল জিনা।
‘আমি দুঃখিত,’ বলল ও। ‘এটা ঠিক নয়-একেবারেই ঠিক নয়।’
মহিলা কবি স্মিত হাসল ওর দিকে চেয়ে।
‘তোমরা আমার গল্পটা তোমাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছ আমি এতেই খুশি। হয়তো একদিন সবখানে মহিলারাও পুরুষদের মত বই লিখবে।’
‘লিখেছে তো,’ জোর গলায় বলল কিশোর।
মহিলা ওর দিকে চাইল, হতচকিত।
‘হ্যাঁ, সত্যি!’ বলল জিনা।
‘ধন্যবাদ, জিনা। ধন্যবাদ, কিশোর,’ বলল মহিলা। মাথা নুইয়ে সম্মান দেখিয়ে তড়িঘড়ি উঠন ত্যাগ করল।
‘দাঁড়ান!’ বলল জিনা
কবির পিছু নিতে যাবে, ওকে বাধা দিলেন প্লেটো।
‘এসো, খেলা এখুনি শুরু হবে,’ বললেন।
ছেলে-মেয়েদেরকে পিছনে নিয়ে বাড়িটা থেকে ধুলোময় রাস্তায় আবারও বেরিয়ে এলেন প্লেটো।
‘মেয়েরা গল্প লিখতে পারে না,’ গজগজ করে বলল জিনা। ‘তারা স্কুলে যেতে পারে না। অভিনয় করতে পারে না। যথেষ্ট হয়েছে, প্রাচীন গ্রীসে আর নয়। চলো, চলে যাই এখান থেকে।’
‘দাঁড়াও,’ বলল কিশোর। ‘অলিম্পিক্স দেখবে না?
‘ও, হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম।’ চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল জিনার। ‘তো,’ ধীর গলায় বললেন প্লেটো। ‘তোমাদের দুজনকেই গেমস দেখতে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। দর্শক সারিতে আমার জন্যে বিশেষ আসন আছে। কিন্তু…’ জিনার দিকে চাইলেন।
‘আর বলতে হবে না,’ বলল জিনা। ‘মেয়েরা অলিম্পিকসেও যেতে পারে না।’
মাথা ঝাঁকালেন প্লেটো।
‘গেলে ভয়ানক বিপদে পড়তে হবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিনা।
‘এসব মোটেই ভাল কথা নয়।’
‘আমি দুঃখিত। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। নাগরিকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’ বললেন প্লেটো।
‘জিনা ঠিকই বলেছে। এগুলো অনুচিত। আমরা বরং বাড়ি ফিরে যাই,’ বলল কিশোর।
‘না, কিশোর। তুমি অলিম্পিক্সে যাও।’ বলল জিনা। ‘তুমি অন্তত কী দেখলে আমাকে জানাতে পারবে। নোট নিয়ো কিন্তু।’
‘তুমি কী করবে?’ কিশোরের জিজ্ঞাসা।
‘আমি পথ নাটকের ওখানে ফিরে যাব। তোমার কাজ হয়ে গেলে
ওখানে আমার সাথে দেখা কোরো,’ বলল জিনা।
জিনাকে একা ছাড়তে চাইল না কিশোর। কিন্তু অলিম্পিক্স দেখার সুযোগ হারানোরও ইচ্ছে নেই ওর।
‘যাও! মজা করো!’ বলল জিনা। হাঁটা ধরল। ‘পরে দেখা হবে। বাই, প্লেটো!’
‘বাই, জিনা,’ বললেন প্লেটো।
জিনা আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল।
‘আমি তোমাকে সব জানাব।’ চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
‘এদিকে,’ বললেন প্লেটো।
তিনি কিশোরকে নিয়ে মিশে গেলেন জনতার ভিড়ে। অলিম্পিক মাঠের উদ্দেশে চললেন।
পাঁচ
‘আজকে গেমসের প্রথম দিন,’ প্লেটো বললেন কিশোরকে। ‘আজ রথ প্রতিযোগিতা হবে।’
‘বাহ, চমৎকার,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।
বিশ্বাসই হতে চাইছে না রথ প্রতিযোগিতা দেখতে চলেছে ও। আধুনিক অলিম্পিক্স গেমসে এটা নেই।
রেস ট্র্যাকের দিকে হেঁটে গেল ওরা। প্লেটো রাস্তার কাছের বিশাল এক দালানের উদ্দেশে তর্জনী দেখালেন।
‘ওটা জিমনেশিয়াম,’ বললেন। ‘অ্যাথলেটরা ওখানে ট্রেনিং নেয়। দৌড়নো, জ্যাভেলিন আর ডিসকাস ছোঁড়া চর্চা করে ওরা।’
‘আমাদের স্কুলেও জিম আছে,’ জানাল কিশোর।
‘সারা দুনিয়ার মানুষ আমাদের গ্রীকদের নকল করে,’ জানালেন প্লেটো।
‘দাঁড়ান, জিনার জন্যে আমার নোটস নিতে হবে,’ বলে উঠল কিশোর।
নোটবই টেনে বের করে লিখল ও:
প্রাচীন গ্রীস খেলাধুলা আবিষ্কার করেছে।
‘এখন চলুন,’ বলল কিশোর। বগলের তলায় গুঁজে দিল নোটবইটা।
ওরা এগোচ্ছে, অপূর্ব সুন্দর এক গাছ দেখালেন প্লেটো।
‘জলপাই আমাদের পবিত্র গাছ,’ বললেন। ‘গেমসের বিজয়ী এর ডাল দিয়ে তৈরি মুকুট পরবে।’
‘তাই?’ বলল কিশোর। লিখল:
জলপাই গাছ পবিত্র
এরপর ওরা ডানাওয়ালা এক নারীর অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তির পাশ কাটাল।
‘কে ওটা?’ কিশোরের জিজ্ঞাসা।
‘ইনি নাইকি, জয়ের দেবী,’ জানালেন প্লেটো।
চটপট টুকে নিল কিশোর:
নাইকি হচ্ছে বিজয়ের দেবী
‘গেমসের জন্যে নাইকি গুরুত্বপূর্ণ,’ বললেন প্লেটো। ‘কিন্তু অলিম্পিকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ওই যে ওদিকে।’
বিশাল স্তম্ভওয়ালা ইঁটের এক দালানের কাছে কিশোরকে নিয়ে গেলেন তিনি। দরজা দিয়ে ভিতরে পা রাখল ওরা। জায়গাটা একটা মন্দির। কিশোর শ্বাস চাপল।
ওদের সামনে ওর দেখা সবচাইতে বড় এক মূর্তি।
মূর্তিটা অন্তত দোতলা সমান উঁচু। সিংহাসনে বসে আছেন শ্মশ্রুমণ্ডিত এক লোক।
‘এটা যিউসের মন্দির। আর ওটা যিউসের মূর্তি,’ বললেন প্লেটো। ‘অলিম্পিক্স গেমস খেলা হয় তাঁর সম্মানে। ইনি গ্রীক দেব-দেবীদের রাজা।’
‘আচ্ছা,’ ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর।
‘গতকাল সব অ্যাথলেট এখানে এসেছিল,’ বললেন প্লেটো। ‘তারা যিউসের সামনে শপথ করে বলে, দশ মাস ধরে ট্রেনিং নিয়েছে এবং তারা খেলার আইন-কানুন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়।’
মহান গ্রীক দেবরাজের মূর্তি কিশোরের দিকে চেয়ে।
নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে হলো কিশোরের।
‘হাই, যিউস, খাটো গলায় বলল ও।
হঠাৎই ট্রাম্পেটের শব্দ ভেসে এল বাইরে থেকে।
‘সময় হলো। জলদি চলো। এখুনি অলিম্পিক প্যারেড শুরু হবে!’ বললেন প্লেটো।
ছয়
হনহন করে রেস ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের পাশ কাটাল প্লেটো আর কিশোর। চারদিকে হৈ-হল্লা। হর্ষধ্বনি।
‘আমার আসন বিচারকদের পাশে,’ বললেন প্লেটো। উঁচু এক স্ট্যাণ্ড আঙুল ইশারায় দেখালেন। কয়েক সারি বেঞ্চি দেখা গেল ওখানে।
প্লেটো জনতার মাঝখান দিয়ে কিশোরকে নিয়ে এগোলেন। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলেন তিনি
‘ধন্যবাদ,’ জানাল কিশোর।
এখান থেকে চমৎকার দেখা যাচ্ছে আশপাশের সব কিছু।
অলিম্পিক প্যারেড ইতোমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে। বাঁশিবাদকরা রয়েছে সবার সামনে। তাদের পিছনে মার্চ করছে অলিম্পিক অ্যাথলেটরা-এরা সবাই গ্রীসের সেরা।
কিশোরের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। জিনা থাকলে উপভোগ করতে পারত।
‘সামনের অ্যাথলেটরা দৌড়বিদ,’ বললেন প্লেটো। ‘দৌড় হচ্ছে অলিম্পিকের সবচেয়ে পুরানো ইভেন্ট।’
কিশোর নোটবই বের করে লিখল:
দৌড় প্রতিযোগিতা সবচাইতে পুরানো ইভেন্ট।
‘দৌড়বিদদের পিছনে মুষ্টিযোদ্ধারা,’ বললেন প্লেটো। ‘ওরা বিশেষ ধরনের দস্তানা আর শিরস্ত্রাণ পরেছে।
‘ওদের পিছনে আছে কুস্তিগীররা,’ বললেন প্লেটো।
কিশোর নোটবইতে তথ্যগুলো টুকে নিল। ও মুখ তুলতেই দেখতে পেল সাইডলাইন থেকে এক সৈন্য সরাসরি ওর দিকে চেয়ে।
পথ নাটকের অভিনেতার মত পোশাক সৈন্যটির পরনে। লম্বা আলখেল্লা পরেছে সে। লাল ঝুঁটিওয়ালা শিরস্ত্রাণ তার মুখের বেশিরভাগটুকু ঢেকে রেখেছে।
কিন্তু একটা ব্যাপার চোখে লাগল। সৈন্যটা খাটো বেশ খাটো 1 ‘এবার আসছে ডিসকাস আর জ্যাভেলিন নিক্ষেপকারীরা,’ বললেন প্লেটো। ‘তারপর বর্ম পরা লোকেরা।’
‘কী করবে ওরা?’
‘ওরা বর্মে পুরোপুরি সেজে দৌড়বে,’ জানালেন প্লেটো।
দৃশ্যটা কেমন দেখাবে ভেবে আপন মনে হেসে ফেলল কিশোর। তথ্যটা টুকে রাখল নোটবইতে।
লেখা শেষ হয়েছে কিশোরের।
খাটো সৈন্যটির দিকে আবারও চাইল ও।
‘একটু পরেই রথ প্রতিযোগিতা শুরু হবে,’ বললেন প্লেটো। ‘এটায় জেতাটা প্রতিযোগিতার সবচাইতে সম্মানের বিষয়।’
কিশোর শুধু মাথা নাড়ল। তখনও খাটো সৈন্যটিকে লক্ষ করছে। সে-ও পাল্টা চেয়ে ওর দিকে।
হঠাৎই একটা হাত বেরিয়ে এল সৈন্যটির আলখেল্লার ভিতর থেকে। হাতছানি দিল।
সভয়ে শ্বাস চাপল কিশোর। জিনা হাত নাড়ছে!
খাটো সৈন্যটি আর কেউ নয়-জিনা।
সাত
আতঙ্কমাখা চোখে জিনার দিকে চেয়ে রইল কিশোর। ও নিশ্চয়ই থিয়েটার থেকে পোশাক ধার করেছে!
কোন মেয়ে অলিম্পিকে যোগ দিলে মারাত্মক বিপদে পড়বে, কথাটা মনে পড়ে গেল ওর।
কিশোর জিনার উদ্দেশে মাথা নেড়ে আঙুল তাক করল। বোঝাতে চাইল, ‘চলে যাও এখান থেকে!’
কিন্তু জিনা আবারও হাত নাড়ল ওর উদ্দেশে।
কিশোর শুধু মাথা নেড়ে চলল। মুঠোও ঝাঁকাল।
জিনা ঘুরে দাঁড়াল রথ দৌড় দেখার জন্য।
‘এটা ঠাট্টা-মশকরার ব্যাপার না!’ চেঁচাল কিশোর।
প্লেটো ঘুরে ওর দিকে চাইলেন।
‘অবশ্যই না,’ বললেন। ‘আমরা এটাকে খুবই সিরিয়াসলি নিই।’
মুখ গরম হয়ে উঠল কিশোরের। কড়া চোখে চেয়ে রইল জিনার পিঠের দিকে।
এমনিসময় ট্রাম্পেট বেজে উঠল।
‘রথগুলো যার যার জায়গা নিচ্ছে,’ বলল প্লেটো।
রেস ট্র্যাকে সারি বেঁধে দাঁড়াল ডজন খানেক রথ। প্রতিটি রথ টানছে চারটে করে ঘোড়া।
জিনার দিকে চাউনি হানল কিশোর। জিনা ওর দিকে চেয়ে রথগুলোর উদ্দেশে আঙুল ইশারা করল।
ট্রাম্পেট বেজে উঠল আবারও।
দৌড় দিল ঘোড়াগুলো!
উল্লাসে ফেটে পড়ল দর্শকরা। হৈ-হল্লা করছে, পা ঠুকছে।
রথগুলো ট্র্যাক ঘিরে ছুটতে লাগলে ধুলোর মেঘ উঠল.
জিনা ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগিতা দেখার জন্য। উত্তেজনায় হাততালি দিচ্ছে।
‘গো! গো! গো!’ চেঁচাচ্ছে।
কিছু দর্শক বেঁটেখাটো, আজব সৈন্যটির চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তাকাল।
আর সইতে পারল না কিশোর। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই জিনাকে সরাতে হবে ওর!
থলেতে নোটবইটা রেখে দিল ও।
‘আমি যাই!’ প্লেটোর উদ্দেশে চেঁচাল।
দার্শনিককে বিস্মিত দেখাল।
কিশোর তাঁকে বলার সাহস পেল না, জিনা আইন ভেঙেছে।
‘আমার খুব সুন্দর সময় কেটেছে। কিন্তু আমাকে এখন বাড়ি
ফিরতে হবে। সব কিছুর জন্যে ধন্যবাদ,’ বলল ও।
‘নিরাপদে বাড়ি ফিরো,’ বললেন প্লেটো।
কিশোর হাত নেড়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।
নীচে নেমে দেখে জিনা হেলমেট খুলে ফেলেছে।
লাফালাফি করার ফলে ওর পিগটেইল উপরে-নীচে উড়ছে।
‘গো! গো! গো!’ চেঁচাচ্ছে উন্মত্তের মতন।
ওর আলখেল্লা খসে পড়েছে।
এখন অনেকে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। কে একজন গার্ড ডাকল।
জিনা এসব কোন কিছুই খেয়াল করল না, এতটাই উত্তেজিত।
কিশোর দ্রুত পা বাড়াল।
কিন্তু বিশালদেহী দু’জন গার্ড জিনাকে আগে পাকড়াও করল।
আট
রথ প্রতিযোগিতার কাছ থেকে জিনাকে টেনে সরাতে চেষ্টা করল গার্ডরা।
জিনাকে হতবিহ্বল দেখাল। তারপর ক্রুদ্ধ।
‘ছেড়ে দিন আমাকে!’ তারস্বরে চেঁচাল ও।
ভিউয়িং স্ট্যাণ্ডের সিঁড়ির ধাপ ভেঙে তরতর করে নামছে কিশোর। লোকজনের ভিড় ঠেলে জিনাকে টেনে নিয়ে যেতে বেগ পেতে হচ্ছে গার্ডদের।
‘ওকে ছেড়ে দিন!’ চিৎকার ছাড়ল কিশোর।
ওর কণ্ঠ মিলিয়ে গেল কোলাহলের মধ্যে।
জনতার মধ্য দিয়ে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে পথ করে নিল কিশোর।
‘ওকে ছেড়ে দিন! ওকে ছেড়ে দিন!’ বারবার চেঁচাচ্ছে।
অবশেষে জিনা আর গার্ডদের কাছে পৌছতে পারল ও। জিনার হাত ধরতে যাবে, এক গার্ড বাধা দিল।
‘ওকে যেতে দিন! কথা দিচ্ছি ওকে বাড়ি নিয়ে যাব!’ চেঁচাল কিশোর।
আরও গার্ড হাজির হলো। জনতা গর্জে উঠল: ‘ওকে গ্রেপ্তার করো! গ্রেপ্তার করো!’
গার্ডরা টেনে নিয়ে চলল জিনাকে।
‘কিশোর! গল্পটা!’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
তাই তো! মনে পড়ে গেল কিশোরের। কবির গল্পটা! এখনই তো আমাদের চরম বিপদ!
থলেয় হাত ভরে কবির স্ক্রলটা বের করল ও।
গল্পটা তুলে ধরল আকাশের দিকে।
‘জিনাকে বাঁচাও!’ চিৎকার ছাড়ল।
কিন্তু কিশোরের কণ্ঠ আবারও চাপা পড়ে গেল জনতার গর্জনে। চার ঘোড়ার রথগুলো ছুটে চলেছে ধুলো উড়িয়ে।
উন্মাদের মতন চারধারে দৃষ্টি বুলাল কিশোর। কাউকে-কিংবা কিছুকে খুঁজছে-সাহায্যের আশায়।
এবার হঠাৎই থেমে গেল গর্জন।
সবার দৃষ্টি এখন প্রকাণ্ড এক সাদা ঘোড়ার দিকে। ধুলো ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে।
জনতা বিস্ময় আর উত্তেজনায় বিড়বিড় করে কী সব বলতে লাগল।
এত সুন্দর প্রাণী কিশোর আগে কখনও দেখেনি।
শূন্য এক রথ টানছে ওটা।
এবং টগবগ করে সোজা ছুটে আসছে কিশোরকে লক্ষ্য করে।
নয়
ট্র্যাকের পাশে, নিচু দেয়ালটা ঘেঁষে থমকে দাঁড়াল সাদা ঘোড়া।
‘ও আমাদের জন্যে এসেছে!’ উত্তেজিত জিনা চেঁচাল।
গার্ডরা ভীতিমাখা চোখে ঘোড়াটার দিকে চেয়ে।
জিনা হাত ছুটিয়ে এক দৌড়ে কিশোরের কাছে চলে এল। ওর হাত চেপে ধরে ঘোড়াটার উদ্দেশে ছুটল কিশোর।
গার্ডরা চিৎকার ছেড়ে ওদের পিছু নিল।
কিন্তু দেরি করে ফেলেছে ওরা। কিশোর আর জিনা ইতোমধ্যে দেয়াল টপকে চড়ে বসেছে অপেক্ষমাণ রথে।
‘গো! গো! গো!’ সাদা ঘোড়াটাকে তাড়া দিল জিনা।
ঘোড়াটা শূন্যে দু’পা তুলে বাতাসে থাবা মারল।
দেয়ালের কাছ থেকে সরে গেল জনতা।
গার্ডরা কাঠ-পুতুল।
কিশোর মুখ তুলে প্লেটোর দিকে চাইল। তিনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন।
সাদা ঘোড়াটা এবার সামনে ঝাঁপাল। পিছনের রথটাকে টানছে।
কিশোর এমনকী প্লেটোর উদ্দেশে হাত নাড়তেও পারল না। শক্ত হয়ে বসে রইল। ওদিকে ঘোড়াটা ছুটে চলল অলিম্পিক প্রতিযোগীদের পাশাপাশি।
প্রবল ঝাঁকুনি হজম করতে হচ্ছে, চোখে ধুলো-বালি ঢুকে গেল কিশোরের। চোখ বুজে ঝুঁকে বসে রইল রথের ভিতরে।
কোথায় চলেছে জানে না ও। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন সাদা ঘোড়াটার কাঁধে।
ছুটন্ত ঘোড়া আর রথের বজ্রগম্ভীর শব্দ কানে এল কিশোরের। জনতার হর্ষধ্বনি শুনতে পাচ্ছে।
মুখে ঝাপটা মারছে বালি, ঝাঁকুনি খেতে খেতে খরখর শব্দ তুলে ছুটে চলেছে ওদের রথ।
হঠাৎই পিছনদিকে ছিটকে পড়ল ও। হুশ করে এক শব্দ হলো, তারপর…
নীরবতা।
‘ওয়াও!’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
চোখ খুলে চাইল কিশোর। চোখে পড়ল নীল আকাশ। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও।
‘বাঁচাও!’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
সাদা ঘোড়াটার ডানা গজিয়েছে। রথটাকে আকাশে টেনে তুলছে ওটা।
রথের রেলিং চেপে ধরে বসে রইল কিশোর।
‘ট্রী হাউসে!’ চেঁচাল ও।
নীচে, জনতা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছে অসম্ভব ঘটনাটা।
পক্ষীরাজ ঘোড়াটা অলিম্পিককে পিছনে ফেলে, যিউসের মন্দির আর নাইকির মূর্তির উপর দিয়ে, পবিত্র জলপাই গাছ আর জিমনেশিয়াম নীচে রেখে উড়ে চলল।
কবির বাড়ি, গ্রীক থিয়েটার আর সাদা তাঁবুর ময়দান পড়ে রইল নীচে
শেষমেশ, পক্ষীরাজ ঘোড়াটা জলপাইকুঞ্জের কাছে এসে মাটিতে নামল।
রথের চাকা বাড়ি খেল ঘাসে। তারপর ধীরে ধীরে থেমে গেল ওরা।
রথ থেকে নেমে এল কিশোর আর জিনা। পা কাঁপছে কিশোরের।
জিনা ঘোড়াটার কাছে দৌড়ে গিয়ে গলায় হাত বুলিয়ে দিল।
‘ধন্যবাদ,’ বলল ফিসফিস করে।
কিশোরও ঘোড়াটার ফরসা, লম্বা ঘাড় চাপড়ে দিল।
‘ধন্যবাদ,’ বলল ও। ‘এটা ছিল আমার জীবনের সেরা রাইড।’
ঘোড়াটা খোঁত শব্দ করে মাটিতে খুর দাপাল।
‘চলো, জিনা। ওরা আমাদেরকে খুঁজে পাওয়ার আগেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।’
‘আমি ওকে ছেড়ে যেতে চাই না। ও দুনিয়ার সেরা ঘোড়া, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল জিনা।
চোখে অশ্রু টলমল করছে ওর।
‘উপায় নেই, যেতেই হবে,’ জানাল কিশোর।
ঘোড়াটা মাথা নুইয়ে নরম নাক দিয়ে জিনার কপাল স্পর্শ করল। এবার ট্রী হাউসের দিকে আলতো ঠেলা দিল।
জিনা ফুঁপিয়ে উঠলেও হাঁটা ধরল। কিশোর ওর একটা হাত ধরল। জলপাইকুঞ্জ ভেদ করে দড়ির মইয়ের কাছে চলে এল ওরা।
‘তুমি আগে,’ বলল কিশোর।
মই বাইতে শুরু করল জিনা। ওকে অনুসরণ করল কিশোর। ভিতরে ঢোকার পর জানালার কাছে ছুটে এল জিনা। কিশোর তুলে নিল পেনসিলভেনিয়ার বইটা।
ফ্রগ ক্রীক উত্সের একটা ছবিতে আঙুল রাখল ও।
‘আমি চাই—’
‘দেখো!’ বলল জিনা।
জানালা দিয়ে চাইল কিশোর। ঘোড়াটা ডানা মেলে দিয়েছে। উড়ে খাচ্ছে মাঠ থেকে।
অলিম্পিয়ার নীলাকাশে উড়াল দিল ঘোড়াটা।
এবার হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে।
‘বিদায়!’ বলল জিনা
দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল দু’গাল বেয়ে।
কিশোর আবারও ফ্রগ ক্রীকের বইটায় আঙুল তাক করল।
‘আমরা ওখানে যেতে চাই,’ বলল ও।
বাতাস বইতে শুরু করল।
ঘুরতে আরম্ভ করল ট্রী হাউস।
বন-বন করে ঘুরছে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে গতি।
এবার চারদিক নীরব।
একদম স্থির।
দশ
চোখ মেলল কিশোর।
সূচীভেদ্য অন্ধকার। দৃষ্টি চলে না।
পরনের কাপড়ে হাত বোলাল ও। এখন আবার টি-শার্ট আর জিন্স। চামড়ার থলেটা রূপান্তরিত হয়েছে ব্যাকপ্যাকে।
‘হ্যালো,’ বলল মরগ্যান লে ফে। ট্রী হাউসের কোনা থেকে এল তার কণ্ঠস্বর।
‘হাই!’ বলল জিনা।
‘জার্নিটা কেমন লাগল?’ মরগ্যানের প্রশ্ন।
‘ভাল, তবে প্রাচীন গ্রীসে মেয়েদের জন্য কোন আমোদ-ফুর্তির ব্যবস্থা নেই,’ জানাল কিশোর।
‘আমি একটা মজা নিতে পেরেছি,’ বিজ্ঞের মত বলল জিনা। ‘পক্ষীরাজে টানা রথে চড়েছি।’
‘খুব ভাল লেগেছে, না? লাগারই কথা,’ বলল মরগ্যান। ‘তোমরা নিতান্ত ভাগ্যবান যে আমাকে পেগাসাসের গল্পটা এনে দিতে পেরেছ!’
‘কার গল্প?’ বলল জিনা।
‘পেগাসাস,’ জবাবটা দিল কিশোর। ‘গ্রীক পুরাণের পক্ষীরাজ সাদা ঘোড়া।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাম শুনেছি,’ বলে উঠল জিনা।
কিশোর ব্যাকপ্যাক হাতড়ে স্ক্রলটা বের করল। ওটা মরগ্যানের হাতে দিল। এখনও আঁধারে মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে না ও।
‘এটা অ্যানোনিমাসের লেখা, বলল জিনা।
‘জানি,’ বলল মরগ্যান। ‘অনেক প্রতিভাময়ী নারী অতীতে নামটা ব্যবহার করত। ওর গল্পটা আমার ক্যামেলট লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করবে।‘
‘প্লেটো এটা আমাদেরকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন,’ জানাল কিশোর।
‘আহ, আমার বন্ধু প্লেটো,’ বলল মরগ্যান। ‘সে ছিল দুনিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা দার্শনিক।’
‘আর পেগাসাস দুনিয়ার সেরা ঘোড়া,’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিনা। ‘ইস, ওকে যদি আবার দেখতে পেতাম!
‘পাবে,’ মৃদু গলায় বলল মরগ্যান। ‘ও এখন এখানেই আছে।’
‘পেগাসাস? সত্যি?’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
জিনা ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দড়ির মই বেয়ে নীচে নামার পথ করে নিল।
কিশোর ওর ব্যাকপ্যাক তুলে নিয়ে অনুসরণ করল।
দু’জনেই মাটিতে নামার পর, অন্ধকার – গাছ-পালার দিকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ধরল জিনা।
‘পেগাসাস?’ ডাকল। ‘কোথায় তুমি? পেগাসাস?’
‘ফ্ল্যাশলাইট নিভাও, জিনা,’ বলল মরগ্যান। ট্রী হাউসের জানালা দিয়ে চেয়ে ছিল।
সুইচ অফ করল জিনা।
‘রাতের তারার মধ্যে তুমি পেগাসাসকে খুঁজে পাবে,’ বলল মরগ্যান।
‘কীভাবে?’ জিনার প্রশ্ন।
‘ভাল করে দেখো।’
নক্ষত্রের আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইল ওরা।
‘তাকালেই দেখতে পাবে,’ বলল মরগ্যান। হাত দোলাল।
পেগাসাসের মাথা, ডানা, আর ছুটন্ত পায়ের আভা ফুটে উঠল আকাশে।
‘দেখতে পাচ্ছি!’ বলল জিনা। ‘আই লাভ ইউ, পেগাসাস।’ বলল ফিসফিস করে।
কিশোরের মনে হলো পেগাসাস দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতেই নড়ে উঠল আকাশের তারাগুলো।
এক মুহূর্তের অটুট নীরবতার পর বাহু নামাল মরগ্যান। আকাশ আবার তারার মাঠ হয়ে গেল।
‘তোমরা মাস্টার লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চমৎকার কাজ করেছ। তোমাদের ওপর বিশ্বাস রাখা যায়,’ সপ্রশংস কণ্ঠে বলল মরগ্যান।
‘তারমানে আমাদেরকে আবারও ট্রিপে পাঠাবেন, তাই না?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘হ্যাঁ,’ জানাল মরগ্যান।
স্বস্তির হাসি ফুটল কিশোরের ঠোঁটে।
‘আমাদের পরের মিশন কবে?’ জিনা প্রশ্ন করল।
‘তোমাদেরকে প্রয়োজন পড়লেই আমি জানাব,’ বলল মরগ্যান। ‘এখন বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নাওগে।’
‘বিদায়!’ বলল জিনা।
‘বিদায়!’ বলল কিশোর।
‘ফেয়ারওয়েল,’ বলল মরগ্যান।
হঠাৎই হু-হু বাতাস বইতে লাগল, তারপর চোখ ধাঁধানো আলো। পরমুহূর্তে মরগ্যান লে ফে আর ম্যাজিক ট্রী হাউস উধাও হয়ে গেল।
রাতটা স্থির।
‘বাসা?’ জিজ্ঞেস করল জিনা।
‘শিয়োর,’ বলল কিশোর।
গাছ-গাছালি ভেদ করে ফিরতি পথ ধরল ওরা। চারদিকে কালিগোলা অন্ধকার।
কিশোরের দৃষ্টি চলছে না।
কিন্তু জিনাকে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালতে বলল না ও। জানে বাড়ির পথ খুঁজে নিতে চিন্তা করতে হবে না।
ওর মনে হলো কেউ—কিংবা কিছু-বনভূমির ভিতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে।
আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল কিশোর। ভোর আসন্ন। একে একে নিভে যাচ্ছে তারার আলো।
কিন্তু ওর মনে হলো অনেক উপরে কে যেন বিশাল দুটো ডানা ঝাপটাল।
***