খেয়াল
বড়মামা বললেন, সবাই নতুন বাড়ি কেনে, আমি একটা পুরনো বাড়ি কিনব। সন্ধানে সে-রকম কোনও বাড়ি আছে?
জগন্নাথবাবু বললেন, পুরনো বাড়ি কত আছে! গঙ্গারধারে দাঁয়েদের বাড়ি। বিক্রি করতে চাইছে। নীচের আর ওপরের মিলিয়ে আটখানা ঘর। ছাদে চিলেকোঠা। সারিয়ে-সুরিয়ে নিলে অনেকদিন চলবে।
জগন্নাথবাবু জমি, বাড়ির দালালি করেন। অম্বল আর আলসারের রুগি। বড়মামার কাছে প্রায়ই আসেন চিকিৎসার জন্যে।
ওষুধের কিছু ফ্রি-স্যাম্পল দিতে দিতে বললেন, ‘ধুস ও পুরনো বাড়ি নয়, আমি চাইছি সাবেককালের কোনও জমিদারের ভাঙা বাড়ি। বট, অশত্থ গাছ গজিয়ে গেছে। এপাশ, ওপাশ ধসে পড়ে গেছে। সিঁড়ির কিছুটা আছে, কিছুটা নেই। বড় বড় খিলান। অলিন্দ যেতে যেতে ঢুকে গেছে ধ্বংসস্তূপে। একটা দুটো ঘর ঠিক আছে, বাকিগুলোর ছাদ মেঝেতে নেমে এসেছে। চারপাশে ঝোপ-ঝাড় আগাছা। পাঁচিলে সাপের খোলস। চিলেকোঠায় বাদুড় ঝুলছে। ভাঙা ঘরে পূর্বপুরুষের অয়েল পেন্টিং ঝুলছে। কোনও ঘরে পড়ে আছে ভাঙা সোফা। একপাশে পড়ে আছে শুকনো দুপাটি জুতো। কোনও ঘরে এক তাক বই। হাত দিয়ে টানলে ধোঁয়ার মতো ধুলো উড়বে। পাতাগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়বে। ঠাকুরঘরে ফাটল-ধরা বেদিতে মা দুর্গার পট ধুলো পড়ে পড়ে ঝাপসা। সিঁদুরের টিপটা ঠিকই আছে। উপুড় করা পেতলের ঘটি। একটা ঘণ্টা। কালো হয়ে গেছে। দেয়ালে ঘড়ির খাঁচা। পেণ্ডুলামটা খুলে পড়ে আছে। খাটের ওপর ছাদ ভেঙে পড়েছে। রান্নাঘরের একটা দিক নেই। পর পর কটা উনুন পড়ে আছে। দেয়ালে তেলচিটে কালির দাগ। পেরেকে একটা সসপ্যান ঝুলছে। ঠিক এইরকম একটা বাড়ি চাই।’
‘টেলিভিশান-সিরিয়াল করবেন বুঝি? টিভিতে আজকাল খুব ভূত খাচ্ছে।
‘সিরিয়াল-টিরিয়াল নয়। এই রকম একটা বাড়ি সন্ধানে থাকলে বলবেন। আমি কিনব। রাত্তিরবেলা মাদুর বগলে, হাতে জলের বোতল, সঙ্গে একটা টর্চ, মোটা একটা মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে দোতলার যে-ঘরটা মোটামুটি ভালো সেই ঘরে শুতে যাব। সারারাত চিত হয়ে পড়ে থাকব। চোখ দুটো ছানাবড়া। চারপাশের ভূতের দাপাদাপি। পূর্বপুরুষ জমিদার ইন্দির নারায়ণ, মাথায় সাদা বাবড়ি। পরনে চোঙ্গা চাপকান। পায়ে নাগরা। হাতে হাঙরমুখো ছড়ি। মাঝরাত্তিরে এসে বলবেন, একবার দেখ তো ডাক্তার বুকটা সব সময় এত ধড়ফড় করে কেন?’
জগন্নাথবাবু একটু সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘আমারও ওই একই অবস্থা। ভীষণ ধড়ফড় করে। কী রকম জানেন, আমি হাঁটছি, আর আমার হার্ট দৌড়চ্ছে। ধড়ফড়, ধড়ফড়!’ বড়মামা বললেন, ‘ও কিছু না। ধড়টা পড়ে গেলেই প্রাণটা ফরফর করে বেরিয়ে যাবে। বেরোতে পারছে না বলেই ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। এই তো এই ওষুধটা দুবেলা খান না।’ বড়মামা হাত বাড়িয়ে ফ্রি-স্যাম্পেল-এর ডিপো থেকে চার-পাঁচটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘লেটেস্ট। মনে হয় উপকার পাবেন। বাড়িটার কথা মনে রাখবেন। এই ওষুধটা খেলে আপনার যৌবন ফিরে আসবে। বাড়িটা যদি নদীর ধারে হয়, তাহলে তো কোনও কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে টাকা অ্যাডভানস করে দেবেন। পেছন দিক দিয়ে একটা রাস্তা বেরিয়ে গিয়ে ভাঙাচোরা পাঁচিল পেরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে যাবে নদীতে। দু-চারটে জেলেডিঙি জলে দোল খাচ্ছে। কিছুটা দূরে জেলেগ্রাম। জাল শুকোচ্ছে রোদে। পরান মাঝি বসে আছে নদীর ধারে। মুখে একটা বিড়ি। আমাকে দেখে জিগ্যেস করবে, জমিদার বাড়িটা কিনলেন বুঝি! কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল সব চোখের সামনে। আমি তার পাশে বসে পড়ে একটা বিড়ি চেয়ে নিয়ে ধরাব।’
‘আপনি তো বিড়ি সিগারেট খান না?’
‘প্রথম টানটা মেরে ভীষণ কাশব। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে। দু’জন বন্ধু হয়ে যাব। তার নাম হবে পরান মাঝি। একদিন জানতে পারব তার স্ত্রী খুব অসুস্থ। আমি তখন তার চালা বাড়িতে যাব। উঠোনে একটা সজনে গাছ। তার তলায় দড়ি ঝুলে যাওয়া একটা খাটিয়া। উঠোনটা খুব পরিষ্কার করে নিকোনো। চালের ওপর লতিয়ে উঠেছে একটা চালকুমড়ো গাছ। সাতটা চালকুমড়ো এদিকে ওদিকে শুয়ে আছে। রোদ পোয়াচ্ছে। দুটো জবা গাছ। ফুলে ফুলে ভরে আছে। একটা লাল আর একটা সাদা। দূরে দেখতে পাচ্ছি, উঁচু রকঅলা শীতলা মন্দির আর বাবার মন্দির। বাবা পঞ্চানন। চৈত্রের শেষে চড়কে মেলা বসে।’
জগন্নাথবাবু বললেন, ‘আমার একটু কাজ আছে।’
বড়মামা পাত্তা দিলেন না। বললেন, ‘থাক। এখনো প্রেসার দেখা হয়নি…একপাশে ছোট্ট একটা মাঠ। একদল বাচ্চা খেলা করছে। চিৎকার চেঁচ্যামেচি। আমি ঘরে গেলুম। মিষ্টি একটা আলো। নদীর দিকে ছোট্ট জানালাটা খোলা। মিষ্টি হাওয়া আসছে। হাওয়ায় উড়ে আসছে নদী-নদী গন্ধ। বাইরে চচ্চড়ে রোদ। নদীর জল ঝলসে ঝলসে উঠছে। ঘরের ভেতরে নীল আলোর খেলা। সামান্য খাটে পরিষ্কার বিছানা। বিছানায় পরিষ্কার এক মহিলা শুয়ে আছে। গায়ের ওপর পরিষ্কার একটা চাদর দুভাঁজ করা। চিত হয়ে শুয়ে আছে। যেন এক কিশোরী। খুবই সুন্দরী। দু-চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।’
‘ডাক্তারবাবু, প্রায় বারোটা বেজে গেল।’
‘বাজুক। বারোটা বাজলে তবেই না এক আসবে। এখনো আপনার স্ত্রীর সুগার আর প্রেসারের ওষুধ দেওয়া হয়নি।’
‘…আমি দেখেই বললুম, এ কি করেছ পরান মাঝি? এ তো অ্যানিমিয়া। একটু একটু জ্বর হবে, হাত পা ফুলবে। দাঁড়াও দেখি আমার কাছে কী ওষুধ আছে? তুমি আমার সঙ্গে চলো।’
‘পরানকে নিয়ে আমার পোড়ো বাড়ির দোতলায় আসব। ভাঙা, ফাটা মেঝেতে একটা মাদুর, একটা বালিশ, গায়ে দেবার জন্যে পাতলা একটা চাদর। বালিশের পাশে স্টেথিসস্কোপটা দেখে পরান বলবে, ‘তুমি ডাক্তার না কি? তুমি আমার কাছে বিড়ি চেয়ে খেলে! অবাক কাণ্ড যে!’
এক প্যাকেট সাদা আয়রন ক্যাপসুল দিয়ে বললুম, ‘বউকে নিয়ম করে খাওয়াও। আমি ব্লাড-টেস্ট করাব।’
‘আপনি ডাক্তারবাবু!’
‘আপনি বললে ওষুধ কেড়ে নেব। তুমি। তুমি। আর আমার ফি হল, তোমার গাছে অনেক কাগজি লেবু হয়েছে, দুটো দিয়ে যাবে।’
ভাঙা ছাদের ঘরে তোলা উনুনে রান্না করব। স্বপাক। নদীতে স্নান করব।
জগন্নাথবাবু তড়াং করে লাফিয়ে উঠলেন। চেয়ারটা উলটে পড়ে যায় আর কি। আর্তস্বরে বললেন, ‘আর পারছি না, আর চেপে রাখতে পারছি না।’ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছেন।
বড়মামা হেঁকে বললেন, ‘কোলাইটিস, কোলাইটিস। খুব ভালো ওষুধ বেরিয়েছে।’