খেয়া
‘বাবু, খেয়া এসেছে রে, তোর সঙ্গে দেখা হয়নি?’
কোনওরকমে নাকে-মুখে চারটি ডালমাখা ভাত গুঁজতে গুঁজতে নবারুণ বলল, ‘খেয়া৷ সেটা কে?’
‘বলিহারি যাই, তোর ছোটোবেলার বন্ধু আর তোর মনে নেই৷’ বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ে নবারুণ, ‘উঁহুঁ, অফিস যাওয়ার সময় অত বাল্যকাল ভাবলে চলে না আমার৷ দেরি করলে শাশ্বতদা এমন বাপবাপান্ত করবে…’ ডাইনিং টেবিলের উলটোদিকে বসে পড়ে মানসী, ‘সত্যি, আজ বারান্দা থেকেই দেখলাম৷ মেয়েটা বিয়ের পর যেন আরও ফুটফুটে হয়েছে৷ আর সারাক্ষণ মুখে হাসি৷’
‘তা হাসি তো থাকবেই৷ বিয়ের পর মেয়েদের আর টেনশন কী…’ মা বড়োসড়ো একটা লেকচার দিতে যাচ্ছেন দেখেই নবারুণ উঠে পড়ে৷ কোনওরকমে মুখ হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘বেরোলুম, আজ একটু ফিরতে দেরি হবে৷’
কালও তো দেরি হল৷ আজ আবার…
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে একটা বাস ধরে নবারুণ৷ ধর্মতলায় এসে থামে৷ ট্রাফিকে কিছুক্ষণ আটকায়৷ এইজন্যেই ধর্মতলায় আসে নবারুণ৷ জ্যামে অনেকটা সময় কেটে যায়৷ একটা এসি শপিং মল খুঁজে নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়৷ কোথাও বিলিতি শখের ফুল সাজানো, কোথাও অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতরে রংচঙে মাছ ঘুরে বেরোচ্ছে, সেসব মন দিয়ে দ্যাখে৷ ঝুলন্ত আয়নায় চুল ঠিক করে নেয়৷ এমন করতে করতে মোটামুটি বিকেল হয়ে আসে৷ তারপর মেট্রো ধরে অ্যাকাডেমির সামনে চলে আসে৷ নাটক দ্যাখে৷
দিন পাঁচেক হল, নবারুণের চাকরিটা চলে গিয়েছে৷ তবে এখনও বাড়িতে জানিয়ে উঠতে পারেনি খবরটা৷ এই ক-দিন রাস্তাঘাটে একরকম চোরের মতোই ঘুরে বেড়িয়েছে নবারুণ৷ পাড়ার কেউ দেখে নিলে কেলো হয়ে যাবে৷ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করারও উপায় নেই৷ তারাও সহানুভূতি দেখাবে৷ সেই সঙ্গে খানিকটা খুশিও হবে মনে মনে৷
হুঁহুঁ, খুব বড়ো চোপা ছিল না? জয়েন্ট, মেডিক্যাল-জয়েন্ট ফুঁড়ে একেবারে ডাক্তার হয়ে বেরোবে৷ ছেলের নাকি হেব্বি মাথা৷ এদিকে কাজ করে সামান্য একটা ফার্মাসিউটিক্যালে৷ সেখান থেকেও লাথ খেয়েছে শুনলে খুশিই হবে তারা৷
আজ নাটকের টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েও কিন্তু হলে ঢুকতে পারে না নবারুণ৷ ওদের পাড়ার মানিকদা ওর থেকে হাত দুয়েক দূরেই লাইনে দাঁড়িয়েছে৷ নবারুণ লাইন ছেড়ে মানে মানে কেটে পড়ে৷ আজ খানিকটা টাকা বেঁচে গেল৷ এমনিতে ব্যাংকের টাকা তুলে নাটক দেখতে খানিকটা গা কড়কড় করে৷ কিন্তু উপায় কী? সময়টা তো কাটাতে হবে৷ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরে নবারুণ৷ একতলা থেকে হাত-মুখ ধুয়ে উপরে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই কীসের যেন গন্ধ পায়৷ এ ঘরে জন্ম থেকে পঁচিশ বছর আছে ও৷ ওর অনুপস্থিতিতে বাইরে থেকে কেউ এলেই সে অচেনা একটা গন্ধ পায়৷ একটা দামি পারফিউমের গন্ধ খেলা করছে ঘরময়৷ ল্যাভেন্ডারের গন্ধ৷ সিঁড়ির কাছে ফিরে গিয়ে গলা তুলে হাঁক দেয়, ‘মা, আমার ঘরে কে এসেছিল গো?’
‘তোকে সকালে বললাম, খেয়া এসেছে৷ ওর বিয়ের অ্যালবাম দেখাতে এসেছিল৷ এই তো একটু আগে গেল৷’
‘ওঃ…’
ঘরের ভিতর ঢুকে এসে পাখাটা চালিয়ে দিল নবারুণ৷ সারাদিন রোদে টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে মাথাটা ভার হয়ে আছে৷ তার মধ্যে এই ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা যেন শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে৷ গুনগুন করে একটা গান ধরল ও৷ তারপর শার্ট ছেড়ে একটা স্যন্ডো গেঞ্জি গায়ে গলাতে গলাতে বেরিয়ে এল বারান্দায়৷
(২)
বাইরের আলোটা ক-দিন হল খারাপ হয়ে গিয়েছে৷ অন্ধকারে ঢেকে আছে বারান্দাটা৷ বারান্দারই কোনও এক কোনা থেকে লুকানো ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটা৷ আজ স্কুলে স্লিপ বেয়ে নামতে গিয়ে হাঁটুতে ছড়ে গিয়েছে কিছুটা৷ জ্বালা করছে৷ পরনের হাফপ্যান্টটা হাঁটুর কিছুটা উপরেই শেষ হয়েছে৷ ফলে ছড়া জায়গাতে শনশনে হাওয়া লেগে জ্বালাটা বেড়ে উঠেছে৷
কত রাত হবে এখন? আড়াইটে তো নির্ঘাত৷ কেন যে ঘুমটা ভেঙে গেল নবারুণের কে জানে৷ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর বারান্দায় চলে আসতে ইচ্ছা করে৷
দেড় ফুটের গাঁথনির উপরে ছাদ অবধি গ্রিল দিয়ে ঘেরা মিটারখানেকের বারান্দা৷ একদিকের কোণে বসে পড়ে নবারুণ৷ টুকরো জ্যোৎস্না গ্রিলের গয়না পরে এসে পড়েছে মার্বেলের মেঝেতে৷ সেদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকে নবারুণ৷ বাইরের অন্ধকারের দিকে একবার তাকায়৷ নিশ্চল হয়ে আছে সব কিছু৷ আকাশের গা বেয়ে একটা বাদুড় উড়ে গেল বোধহয়৷
মুখ বাড়িয়ে সেটা দেখতে গিয়েই একটা শব্দ কানে আসে ওর৷ ফোঁপানো কান্নার শব্দ৷ প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল নবারুণ৷ জানলার বাইরে থেকে আসছে কান্নাটা৷ তবে কি…
নবারুণ খুব একটা ভীতু না৷ ভিতরের ভয়টা কাটিয়ে কান্নার আওয়াজটা ভালো করে শুনতে ব্যাপারটা বুঝল ও৷ একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসছে৷ ওদের বারান্দাটার ঠিক উলটোদিকেই আর-একটা ঝুল-বারান্দা আছে৷ সেখান থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজটা৷ এত রাতে কি ওপাশের বারান্দায় কেউ কাঁদছে?
আধ মিনিট চুপ করে বসে রইল নবারুণ৷ কান্নার আওয়াজ বেশ চাপা৷ ভালো করে কান না পাতলে শোনা যায় না৷ নবারুণের বিবেক বলল লুকিয়ে লুকিয়ে কারও কান্না শোনা উচিত নয়৷ হয়তো কারও সামনে কাঁদবে না বলেই বারান্দায় এসে কাঁদছে মেয়েটা৷
ইচ্ছা করেই খসখস করে কেশে উঠল নবারুণ৷ সঙ্গে সঙ্গে কান্নার শব্দ একটু পাতলা হল৷ কিন্তু থামল না৷ নবারুণ বুঝল, ব্যাপার গুরুতর৷ ও এবার একটু গলা তুলে বলল, ‘কে কাঁদছে?’
‘যে-ই কাঁদুক৷ তোর কী?’ কান্নামাখা গলাতেই ধমক শোনা গেল৷
‘না, কানে আসছে কিনা…’
‘কান বন্ধ করে থাক৷’
এ কী শাসানি রে বাবা৷ নবারুণ একটু থতমত খায়৷ হঠাৎ মনে পড়ে ওর৷ অপরদিকের বারান্দাটা অন্ধকারে ঢেকে থাকলেও মেয়েটাকে চিনতে পারে ও৷
‘এই, তুই হারুন কাকার ভাগনিটা না? কী যেন নাম…’
‘খেয়া৷’
‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷’ শেষকথাটা নিজের মনে মনেই বলে নবারুণ৷ ঠাকুরপুকুর না ঘটকপুকুর কোথায় যেন থাকে৷ কালেভদ্রে কাকার বাড়ি ঘুরতে আসে৷ এই বছরেই সরস্বতীপুজোয় পাড়ার ফাংশনে ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’ গানটায় দারুণ নেচেছিল৷ মালতীদিদির আর্ট স্কুলের একতলায় এক সপ্তাহ ধরে সেই নাচের মহড়া হচ্ছিল৷
ওইখানেই ঘুড়ি-লাটাই রাখে নবারুণ৷ একদিন সেসব আনতে সেখানে গিয়ে ফটাস করে দরজা খুলতেই তেড়ে এসেছিল মেয়েটা৷ এমন ভাব যেন ওর সেই চরম গোপনীয় নৃত্য দেখে চোখ সার্থক করতেই ঢুকেছে নবারুণ৷ আঙুল-টাঙুল তুলে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল৷ তারপর থেকেই নবারুণের রাগ মেয়েটার উপর৷
বয়সের তুলনায় মেয়েটার হাত-পাগুলো ছোটো ছোটো৷ ওইটুকু হাত-পা যার, তার অত আঙুল তুলে চমক-ধমক কীসের? স্টেজের উপর একটা কড়াইশুঁটির মালার মতো হার গলায় পরে সখী হয়ে নেচেছিল৷ নবারুণের গা জ্বলে গিয়েছিল৷ এখন তাকে কাঁদতে শুনে মনে আনন্দই হল নবারুণের৷
‘তা ব্যাপার কী?’ নবারুণ একটু বাঁকা স্বরেই জিজ্ঞেস করল৷
মেয়েটা রেগেমেগেই হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সামলে নিল৷ সম্ভবত ভিতরের ঘরে তার কাকিমা ঘুমোচ্ছে৷ জোরে চিৎকার করে কিছু বলতে পারবে না৷ তা ছাড়া নবারুণ দেখেছে, মানুষ অন্যের থেকে কান্না লুকোতে চায় বটে, কিন্তু একবার দৈবক্রমে কেউ তাকে কাঁদতে দেখে ফেললে তার কাছে আর কথা লুকোনোর প্রয়োজন বোধ করে না৷
‘তোকে বলে কী হবে? বললে তুই হাসবি৷’
‘হাসলেও তুই দেখতে পাবি না৷ বারান্দা তো অন্ধকার৷’
কান্নার শব্দ থেমে যায়, মেয়েটা কী যেন ভেবে চাপাস্বরেই বলে, ‘না, আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না৷’
আরও মিনিটখানেক চুপ করে বসে কান্নার শব্দ শোনে নবারুণ৷ তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে৷
ওপাশের অন্ধকারের ভিতর থেকে ডাক শোনা যায়, ‘এই, তুই চলে যাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, তুই তো বললি, কিছু বলবি না৷’
‘তা বলে চলে যেতে তো বলিনি৷’
‘কী করব বসে বসে?’
নবারুণ অনুভব করে, মেয়েটা হাতের তালুর উলটোদিক দিয়ে নিজের ভেজা ঠোঁট মুছছে, তারপর গলা শক্ত করে বলে, ‘শোন, তোকে একটা কথা বলি?’
‘হ্যাঁ, বল৷’
‘কেউ কাঁদলে তার কারণ জানাটা খুব দরকারি নয়৷ বরঞ্চ একটু বসে থাকতে হয়৷ আমি এই বারান্দায় এসে কাঁদি, বারান্দাটা আমাকে কারণ জিজ্ঞেস করে না৷ এই যে গ্রিলগুলো ধরে থাকি, এগুলো আমায় কারণ জিজ্ঞেস করে না৷ ওরা স্রেফ এইটুকু গ্যারান্টি দেয় যে আমি কাল এলেও ওরা এখানেই থাকবে, সব সময় থাকবে৷’
‘কিন্তু আমি থাকব না৷ আমার ঘুম আছে৷’ হাই তুলে বলে নবারুণ৷
‘সে তো আমিও রোজ আসি না৷ দুঃখ হলে আসি৷ আজ যেমন মা-বাবার জন্য দুঃখ হচ্ছিল খুব৷’
‘বাবা-মা কী করেছে আবার৷’
‘কিছু করেনি৷’ অনেকটা সময় নেয় খেয়া, যেন পরের কথাটা বলা উচিত হবে কি না সেটাই ভাবছে ও, শেষে মনস্থির করে বলে, ‘আমার মাঝে মাঝে ভাবলে খুব কষ্ট হয় যে আমি বেঁচে থাকতে থাকতে আমার মা-বাপি মরে যাবে৷ বিশেষ করে রাতে, ওদের থেকে দূরে কোথাও থাকলে…’
গ্রিলের দিকে এবার ঘুরে বসে নবারুণ, ‘এই, এটা আমারও হয়৷ কিন্তু এসব কথা বলতে পারি না কাউকে৷ আর সকালে উঠে কষ্টটা থাকেও না৷’
মেয়েটা এতক্ষণে উৎসাহ পেয়েছে, ‘আর বলিস না, একবার বলেই ফেলেছিলাম মা-কে৷ আর শালা, সে কী কান্না মাইরি৷ মা বলে, আমার কান্না শুনে নাকি মনে হয়েছিল, মা সত্যি মরে গিয়েছে৷ তারপর মাথা চাপড়ে বলেছিল, মরে গেলে মানুষ ভগবানের কাছে চলে যায়৷ এই, তুই বিশ্বাস করিস?’
‘কীসে?’
‘ভগবানে?’
‘ধুর, বেকার৷’
মেয়েটার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে, ‘হাত মেলা৷ আমিও করি না৷’
দু-জনে হাত বাড়ায়৷ কিন্তু দুটো বারান্দার মাঝের দূরত্বটা দুটো হাতের তুলনায় কিছুটা বেশি৷ অন্ধকারের ভিতর থেকে হাত ফিরিয়ে নেয় ওরা৷
‘এই ভগবানের কেসটা আবার বলিস না কাউকে, বাবা জানলে ক্যালাবে৷’
কথাটা বলে আবার কী ভাবে খেয়া, ‘আচ্ছা আয়াম সরি৷’
‘কীসের জন্যে?’
‘সেদিন তোকে ওভাবে তাড়িয়ে দিলাম রিহার্সাল থেকে৷ এখন ভাবলে খারাপ লাগছে রে৷’
‘ধুর, আমি কিছু মনে করিনি৷’
‘উঁহুঁ, অ্যাই উইল কম্পেনসেট৷ শোন, একটা ডিল আছে৷’
‘ডিল! কীরকম?’
‘আমি আপাতত এখানেই আছি, মাঝে মাঝেই রাতে এই বারান্দায় চলে আসব৷ তোর মন খারাপ হলে তুইও চলে আসিস৷ যা বলার, ওই গ্রিলের পাশে বসেই বলিস৷ আমি চুপচাপ শুনব৷ আসলে ছোটোকাকিমা পাশের ঘরে শোয় মাঝে মাঝে৷ এখান থেকে কথা বললে শোনা যায়৷ তাই কথা বলতে পারব না৷ কিন্তু শুনব৷ মন দিয়ে শুনব৷’
নবারুণ একটু ভেবে দ্যাখে ব্যাপারটা, তারপর বলে, ‘আচ্ছা বেশ, কিন্তু যেদিন যেদিন তুই আসবি না?’
‘আরে গাধা, তুই জানবি কী করে, কবে আমি এসেছি না আসিনি৷ আলো তো নেবানো থাকে, কথা তো আমি বলব না৷’
ব্যাপারটা পরিষ্কার করে মাথায় ঢোকে না নবারুণের৷ সে কী একটা যেন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, এমন সময় উলটোদিক থেকে একটা ডাক ভেসে এল৷
‘খেয়া… এত রাতে তুই আবার…’
‘এই, কাকিমা ডাকছে, আসছি রে…’
নবারুণ কিছু বলার আগেই উঠে চলে গেল মেয়েটা৷ আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে উঠে পড়ল নবারুণ৷ উলটোদিকের বারান্দার ভিতরটা এখনও আগের মতোই অন্ধকার হয়ে আছে৷
(৩)
বারান্দার ধারে বসে এখনও কী যেন ভেবে চলেছে নবারুণ৷ চোখ দুটো বন্ধ৷ সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে৷ বারান্দার খোলা হাওয়ায় এতক্ষণে ঘাম শুকিয়ে গেছে গায়ের৷ ঘরের ভিতর থেকে সেই ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা ভেসে আসছে এখনও৷ চোখ বুজলে কত পুরনো কথা মনে পড়ে যায়৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাচ্ছিল নবারুণ, এমন সময় উলটোদিকের বারান্দায় আলো জ্বলে ওঠে৷ ভিতরের দরজা খুলে একটা নারীদেহ বেরিয়ে আসে বাইরে৷ খেয়া৷ আগের তুলনায় একটু স্থূল হয়েছে ওর শরীর৷ চুলটাও অনেকটা ছোটো হয়ে গিয়েছে৷ প্রায় বছর পাঁচেক পর দেখল নবারুণ৷ অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছে এই পাঁচ বছরে৷
দুটো বারান্দাতেই এখন আলো জ্বলছে৷ খেয়া নবারুণের দিকে চেয়ে একগাল হেসে ওঠে, মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর৷
‘এই, একটু আগেই তোর বাড়ি থেকে ফিরলাম, কী খবর তোর?’
‘এই চলে যাচ্ছে৷’ কাষ্ঠহাসি হাসে নবারুণ৷
‘বিয়েতে তো এলি না আমার৷’
‘আসলে ওই অফিসের কাজে৷’
‘থাক থাক, সব জানি৷ এই শোন-না, আবির না তোর সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে৷’
‘আমার সঙ্গে! মানে…’
‘আরে, তোর কথা সব বলেছি ওকে৷ হি ওয়ান্টস টু মিট ইউ৷’
জোর করেই এবার হাসার চেষ্টা করে নবারুণ, ‘হ্যাঁ, ভালোই তো৷ একদিন চলে যাব না হয়…’
ভালো করে এপাশের বারান্দার গ্রিলগুলো দ্যাখে খেয়া, তারপর বলে, ‘গ্রিলগুলো নতুন রং করিয়েছিস, না? আগে কেমন জং-ধরা ছিল…’
‘হ্যাঁ, আসলে বাবা বেঁচে থাকতে…’
কথাটায় আমল দেয় না খেয়া, বলে, ‘এই, তোর মনে আছে, আমরা দুঃখ হলেই আগে এখানে চলে আসতাম৷ তারপর অন্ধকারের দিকে চেয়ে বকবক করে যেতাম… ভাবতাম…’
‘…উলটোদিকে কেউ বসে আছে… সব শুনছে…’ মিহি হাসে নবারুণ৷
তারপর গলা তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘এখন দুঃখ হলে কী করিস রে?’
খেয়া ঠোঁট ওলটায়, ‘এখন আর অত দুঃখ হয় না ছোটোবেলার মতো৷ মন শক্ত হয়ে গিয়েছে৷’
‘আচ্ছা?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার৷ মাঝে একটু ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম৷ চারবার সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম৷ সে এক কেলো…’
‘সুইসাইড! বলিস কী?’
‘এতে চমকানোর কী আছে? সুইসাইড সবাই একবার না একবার চেষ্টা করেছে লাইফে৷ কেন, তুই করিসনি?’ খেয়া কাঁধ ঝাঁকায়৷
‘উঁহুঁ, আমি ওসবে নেই৷’
খেয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঝুপ করে নিবে যায় আলোটা৷ লোডশেডিং৷
‘এই এক হয়েছে… রোজ সন্ধ্যাবেলা…’ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে নবারুণ৷
‘আমাদের কত দুঃখ পড়ে আছে এখানে, না রে?’ নৈঃশব্দ্য ভেদ করে ঘন গলায় উলটোদিকের অন্ধকারের ভিতর থেকে কথাটা বলে উঠেছে খেয়া৷ মুহূর্তে নবারুণের বুকের ভিতর একরাশ চেনা স্রোতের ঢেউ খেলিয়ে দেয় শব্দটা৷ একবার একটা হাতকাটা ভিখারি বুড়ি উলটোডাঙা ব্রিজের মাথায়, ‘দুটো পয়সা দিবি ভাই?’ বলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ওর দিকে৷ নবারুণের পকেটে পয়সা ছিল না৷ পরের দিন ফিরে এসে দেখেছিল সে বুড়ি আর নেই৷ তাকে আর কোনওদিন দেখেনি৷ একটা বিড়াল পুষেছিল নবারুণ, খুব ন্যাওটা ছিল ওর, সেটা মরে যেতে ভাসিয়ে দিয়েছিল গঙ্গায়, বাবার একটা গোটা মাসের মাইনে ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিল একবার৷ মুখে রক্ত তুলে রোজগার করত বাবা৷ ভুল করে ছাদ থেকে ইট ফেলতে গিয়ে একটা কুকুরকে থেঁতলে দিয়েছিল৷ কুকুরটার অবোধ রক্তমাখা চোখ দুটো আজও মনে আছে ওর৷ এত ছোটোছোটো দুঃখ কেন এত রক্তাক্ত করে ওকে?
রাতে এই বারান্দাটায় এসে হাপুসনয়নে চিৎকার করে কেঁদেছে নবারুণ৷ উলটোদিকের বারান্দার অন্ধকারে চুপ করে বসে থেকেছে খেয়া৷ ওর কান্না শুনে গিয়েছে সারারাত ধরে৷ বিরক্ত হয়নি, উঠে চলে যায়নি, জিজ্ঞেস করেনি কীসের দুঃখ৷ এই একটা জায়গা, যেখানে ইচ্ছামতো কান্নাকাটি করা যায় কারণ ছাড়াই৷ নবারুণ ইচ্ছা হলে বলেছে, না হলে আর বলা হয়নি কোনওদিন৷ আজও সেগুলো মিশে আছে এই দুই বারান্দার মাঝের কালো অন্ধকারটার মধ্যে৷ কোনও কোনও দিন দু-জনেই বসে থেকেছে চুপচাপ৷ ঢিমে তালে বয়ে গিয়েছে রাতের হাওয়া৷ ঝিঁঝির একটানা ডাক ভেসে এসেছে কেবল৷
কোনওদিন নৈঃশব্দ্য ভেঙে ডেকে উঠেছে নবারুণ, ‘খেয়া আছিস?’
‘আছি রে৷’
‘ঘুম পায়নি তোর?’
‘একটু পরে যাব৷ বল কী বলবি….’
‘মনটা ভালো লাগছে না ক-দিন৷ জানি না কেন৷’
‘আমারও৷ এসব অদ্ভুত মন খারাপ হলে কান্নাও পায় না…’
‘হাত মেলা তাহলে৷’
আবার দু-জনে বাড়িয়ে দেয় হাত দুটো৷ নাঃ, এখনও অতটা লম্বা হয়নি ওদের হাতগুলো৷ বাতাস স্পর্শ করে ফিরে আসে৷
‘ধুর, এ আর হবে না৷’ খেয়া মৃদু হাসে, ‘দরকারও নেই জানিস, আমার বান্ধবীরা দুঃখ হলে বয়ফ্রেন্ডের কাঁধে মাথা দিয়ে কাঁদে৷ আমার একদম ভালো লাগে না৷’
‘তাহলে?’
‘এই যে, এখানে এসে বকবক করি৷ কান্নাকাটি করি৷ আমাদের সবার এরকম একটা জায়গা থাকা দরকার, বুঝলি? এরকম একটা বারান্দা৷’
হঠাৎ খেয়ার গলার স্বরে চমক ফেরে নবারুণের৷ ওদিকের বাড়ি থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসছে৷ আকাশের বুকে পাতলা মেঘের চাদর মুখে টানছে চাঁদটা৷
‘এই, আসি রে আজ৷ কাল আয়-না একবার বিকেল করে৷’ খেয়া ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে৷ একটা বাচ্চা ছেলে ওকে টানছে ঘরের ভিতরে, ‘ও মাসি, তোমাকে ডাকছে৷’
‘বিকেলে তো অফিস৷ ফিরে যাব না হয়৷’
‘আচ্ছা বেশ, তুই তো ঘরের লোক৷ বলার কী আছে৷’
খানিকক্ষণ চুপ করে সেখানে বসে থেকে ঘরে ফিরে আসে নবারুণ৷ রাত হতে আলোটা নিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷
(৪)
‘নবা… আজ কাকিমা পুজো করবে সারারাত৷ আমি একটা পাশবালিশ চাদর চাপা দিয়ে কেটে পড়েছি৷’
‘বেশ করেছিস৷’
‘কী হয়েছে বল তো তোর?’
‘ভয় করছে৷’
‘কীসের?’
‘মা বলছিল, কাল তোরা চলে যাবি এখান থেকে৷ আবার কবে ফিরবি ঠিক নেই৷’
‘গরমের ছুটি পড়লে আসার কথা আছে৷ এসব ভেবে মন খারাপ করছিস কেন বল তো?’
‘কে বলেছে, মন খারাপ করছি? বললাম যে ভয় পাচ্ছি৷ এরপর আমার মন খারাপগুলো শোনার কেউ থাকবে না৷’
‘জমিয়ে রাখিস তাহলে৷’
‘অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে রে…’
‘শোন-না, একটা কথা বলি?’
নবারুণ জানে, খেয়া এই কথাটা বলার মানে হল, এবার বড়োসড়ো কিছু একটা বলতে চলেছে সে, ‘বল৷’
‘আমি তো বারান্দার গ্রিল নই, এই জমাট অন্ধকারটাও নই, আমি মানুষ৷ আমার এক জায়গায় থেকে যাওয়ার উপায় নেই রে৷ না হলে বিশ্বাস কর, থাকতাম৷ আমি এই রাতের হাওয়ার মতো৷ কখনও আসি, আবার কখনও চলে যাই, কবে কোন হাওয়াটাকে তুই দুঃখের কথাগুলো শুনিয়েছিলি, সেই হাওয়াটা আবার কবে দুনিয়া ঘুরে তোর ঠোঁটের কাছেই ফিরে এসেছে, তুই চিনতে পারিস? তেমনি করে আমিও একদিন ফিরে আসব, তুই জানতেও পারবি না৷’
কয়েক সেকেন্ড কোনও কথা বলতে পারে না নবারুণ, তারপর অস্ফুট স্বরে বলে, ‘ততদিন কষ্ট হবে খুব৷’
‘একদিন ঠিক শুনব সেই কষ্টটা, তোর অজান্তেই৷ দেখিস….’
(৫)
পরদিন একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে নবারুণ৷ আজ অ্যাকাডেমিতে একটা ভালো নাটকের শো আছে৷ কিন্তু সারাটা দিন কাটাবে কোথায়? আজ আর ধর্মতলার শপিং মলে যেতে ইচ্ছা করছে না৷
খানিক ভেবেচিন্তে গঙ্গার কথা মনে পড়ল নবারুণের৷ হ্যাঁ, সেখানে গিয়ে বসে থাকা যায় বটে৷
বাসে করে বাগবাজারে গঙ্গার ধারে চলে এল নবারুণ৷ একটা নিরালা ঘাট খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল সেখানে৷ অফিসের ব্যাগ হাতে শার্ট পরা একটা ছেলেকে এই ভরদুপুরবেলা গঙ্গার ঘাটে বসে থাকতে দেখে আড়চোখে তাকাল কেউ কেউ৷ নবারুণ তাদের কাউকে তেমন পাত্তা দিল না৷ তবে এমন রোজ রোজ তো টো টো করে বাইরে ঘুরে বেড়ানো যায় না৷ যেভাবেই হোক বাড়িতে চাকরির কথাটা জানাতে হবে৷
একটা ঘটি-গরমওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে ঘটি-গরম খেল নবারুণ৷ মুখটা ভিজে উঠেছিল ঘামে৷ রুমালটা আজ আবার বাড়িতে ফেলে এসেছে৷ জামার হাতাতেই মুখ মুছল৷
খেয়ার বর যেন কী করে? কোন একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ইলেকট্রিক বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার বলে শুনেছিল৷ চোখে না দেখলেও ফেসবুকে ছবি দেখেছে নবারুণ৷ বেজায় লম্বা, তাগড়া বলিষ্ঠ চেহারা৷ কেবল কপালটুকু একটু ভরাট গোছের৷ মানুষটা নাকি ভারী ভালো৷
খেয়া কি কখনও ভালোবেসেছিল নবারুণকে? উঁহুঁ, নবারুণের কখনও মনে হয়নি৷ এমনকি সে নিজেও যে খেয়াকে খুব একটা ভালোবেসে ফেলেছে, সে কথাও ওর মনে হয়নি কখনও৷ তবে ওর ছেলেবেলা থেকে বড়ো হয় ওঠবার একগোছা খামখেয়ালি দুঃখ রাখা আছে তার কাছে৷ হয়তো এমনও হয়েছে, খেয়া উলটোদিকের বারান্দায় বসে নেই অথচ তা-ও নবারুণ হাউহাউ করে বলে গিয়েছে ওর মনের সব কথা৷ ভেবেছে, কাকিমা পাশের ঘরে শুয়েছে বলে কথা বলতে পারছে না খেয়া৷
খেয়া… নবারুণের কি আজও কিছু বলতে ইচ্ছা করে খেয়াকে? নাকি ও নিজেও অনেকটা শক্ত হয়ে গিয়েছে? এই তো কাল সন্ধ্যাবেলা হেসে হেসে কথা বলল, একবারও ওর মনে হয়নি বলে ফেলে সব জমানো দুঃখের কথা৷ বাবার মৃত্যুর কথা, মা-কে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা, বেকারত্বের লজ্জার কথা… হ্যাঁ… নবারুণ নিজেও অনেকটা শক্ত হয়ে গিয়েছে৷
সন্ধ্যায় বাড়ি ঢোকার আগে বাড়ির বাইরে থেকেই নবারুণকে পাকড়াও করল হারুনকাকা৷ নবারুণ বাহানা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসব কিছুই কানে না নিয়ে একরকম জোর করেই টেনে নিয়ে গেল ওকে৷
মাত্র মাস ছয়েক হল বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই পাকা গৃহিণী হয়ে উঠেছে খেয়া৷ নিখুঁত করে শাড়ি পরতে শিখেছে, এমন যত্ন করে ঘর গোছায় যে ঘরে ঢুকে আগে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ৷ ছোটোবেলায় প্রচুর কবিতা লিখত খেয়া৷ কিছু কিছু পড়ে শোনাত নবারুণকে৷ ঘরে ঢুকে নবারুণ দেখল সেই কবিতার খাতাটা শোকেসে রাখা আছে৷
‘এই যে নবারুণ…’ নবারুণের হাতটা ধরে তাকে আবিরের সামনে টেনে আনল খেয়া, ‘আমার সব থেকে ভালো বন্ধু৷’
‘আরে ব্রাদার!’ নিজের দু-হাতে নবারুণের হাত দুটো চেপে ধরে আবির৷ ওর মুখ জুড়ে অকৃত্রিম হাসি খেলা করছে, ‘আমার বউ তো সারাক্ষণ তোমার কথাই বলে চলেছে…’
‘ও আসলে একটু…’
‘পাগলাটে তো?’ হো হো করে হেসে ওঠে আবির, ‘সে আর আমার থেকে ভালো কে জানে৷ সারাদিন সামলাতে হচ্ছে, তাহলেই ভাবো৷’
খেয়াও রাগ দেখিয়ে কপট হাসি হাসে৷ সেদিকে চেয়ে নবারুণের দুপুরের ভাবনাটা আবার ফিরে আসে৷ নাঃ, এমন হাসি মানুষ জোর করে হাসতে পারে না৷ সত্যি মন শক্ত হয়েছে খেয়ার৷ সে এখন আর ছোটোছোটো কারণে কান্নার বারান্দা খোঁজে না৷ ওদের ছেলেবেলার বারান্দা দুটোর প্রয়োজন নেই আর৷ থাকবেই বা কেন?
বাবা কি চিরকাল পিছন থেকে সাইকেল ধরে ছিল? একসময় নবারুণ চালাতে শিখে গেলে ঠিক ছেড়ে দিয়েছিল৷ বারান্দা দুটোও ওদের নিজেদের জীবনে ঠেলে দিয়ে অপ্রয়োজনে হারিয়ে গিয়েছে হয়তো৷
খানিকটা খুশি-মনেই বাড়ি ফিরে আসে নবারুণ৷
(৬)
‘খেয়া…’
ওপাশ থেকে কোনও শব্দ আসে না৷ কেবল সেই আগের মতো ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা৷ গুনগুন করে মিঠে সুর উঠেছে বাতাসে৷ আজও কীভাবে যেন জ্বলছে না নবারুণের বারান্দার আলোটা৷ ওপাশের বারান্দাটাও অন্ধকার৷
‘খেয়া…’ চাপাস্বরে আবার ডাকে নবারুণ, আবার উত্তর নেই৷ ও একা একাই বসে আছে এই বারান্দাটায়৷
মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর৷ ছোটোবেলায় একটা জিনিস ওদের কাছে ছিল না, আজ আছে৷ পকেট থেকে সেলফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বেলে অপরদিকের বারান্দায় ফ্যালে নবারুণ, আলোয় ভরে যায় বারান্দাটা৷ নাঃ, কেউ নেই৷
‘আমার না, অনেক কিছু বলার ছিল তোকে৷’ আলোটা নিবিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় নবারুণ৷
‘তাহলে বল৷’
চমকে ওঠে নবারুণ৷ খেয়ার গলাই ভেসে এসেছে বটে, কিন্তু অপরদিকের বারান্দা থেকে নয়, ওর পাশ থেকে৷ সেদিকে চেয়েই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ও, ‘তুই… তুই কী করে…’
‘হতভাগা! একতলার দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছ আজ৷’
মনে পড়ে নবারুণের৷ সত্যি মনে ছিল না ব্যাপারটা৷ কিন্তু খেয়ার সাহস আছে বলতে হবে৷
‘কিন্তু আবির…’
‘পাশবালিশ চাদর চাপা দিয়ে এসেছি, তুই বল-না৷ আমি শুনছি সব৷’
নবারুণের ব্যাপারটা মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে৷ ওর থেকে হাত দুয়েকের মধ্যেই দেওয়ালে পিঠ রেখে বসে আছে খেয়া৷ মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে৷ খোলা চুলগুলো দুলছে মাথার দু-পাশে৷ ওর গায়ে একটা বাড়িতে পরা গেঞ্জি৷
‘কই? বললি না তো৷’
‘বলব, কিন্তু তুই আগে বল, আমাকে সত্যি আর কিছু বলার নেই তোর?’
‘উঁহুঁ… বললাম যে মন শক্ত হয়ে গিয়েছে…’
‘ধুর…’ হালকা হাসির সঙ্গে কথাটা বলে নবারুণ, ‘তুই জানিস খেয়া? মানুষের মন শক্ত বা নরম হয় না৷ কেবল আর-একটা মানুষের কাছে নরম বা শক্ত হয়ে যায়৷ ছোটোবেলায় সবার কাছেই নরম থাকি আমরা৷ কষ্ট পেলে সবার সামনে কেঁদে ফেলি, কাউকে নিয়ে জেলাস হলে রাখঢাক করি না৷ তারপর বড়ো হতে হতে একটা একটা করে মানুষের কাছে আমরা শক্ত হয়ে যাই৷ কিন্তু মনটা তো মনই থেকে যায়, বল…’
‘আমরা দু-জন দু-জনের কাছে শক্ত হয়ে গিয়েছি৷’ খেয়া অকারণেই আকাশের দিকে চায়৷ চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে৷
নবারুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে, ‘মা-কে বলেছিলাম তুই কবে এখানে আসছিস, আমাকে যেন না জানায়৷ মা ভেবেছিল, আমাদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝামেলা হয়েছে৷ জানায়ওনি৷ আসলে আমি ভেবেছিলাম, যদি তুই কবে কবে উলটোদিকের বারান্দাটায় থাকবি, সেটা না জানি, তাহলে কবে কবে নেই তা-ও জানতে পারব না৷ অন্ধকারের দিকে চেয়ে মন খুলে বলতে পারব সব৷’
‘তুই পাগল একদম৷ এইটুকু সম্ভাবনার কথা ভেবে…’
‘মানুষ সম্ভাবনা নিয়েই বাঁচে খেয়া৷ আমি ভাবি, হয়তো পৃথিবীর কোনও এককোণে তুই সুখে সংসার করছিস, তোর মন সবার কাছে শক্ত হয়ে গিয়েছে, হয়তো মায়ের রোগটা তেমন ক্রিটিক্যাল নয়, হয়তো আবার একটা চাকরি পাব আমি, হয়তো আমার বাবা ভগবানের কাছে…’
ওপাশের খালি বারান্দাটার দিকে চায় নবারুণ, ‘হয়তো এখনও বছরে একদিন ওই বারান্দাটায় এসে বসিস তুই৷ পাশের ঘরে আওয়াজ যাবে বলে কথা বলতে পারিস না, কেবল শুনিস সব৷’
‘শুনতে ইচ্ছা করে রে খুব, বলতেও ইচ্ছা করে…’
‘কাল একটা দূরের মানুষকে কেমন টুক করে বলে ফেললি, চারবার সুইসাইড করতে গিয়েছিস৷ আমি পাঁচবার অ্যাটেম্পট করেছি, তার মধ্যে দু-বার সিরিয়াসলি৷ কিন্তু সেই অপরিচিত মানুষটার কাছে বলতে পারিনি, তোর মতো আমিও সবার কাছে শক্ত হয়ে গিয়েছি রে… শুধু… এই বারান্দাটার কাছে, দুই বারান্দার মাঝের ওই অন্ধকারটার কাছে আর…’
‘আর?’
‘আর তোর কাছে আজও ভীষণ নরম রয়ে গিয়েছি৷ আজ, এখন তোর কাছে নির্দ্বিধায় কেঁদে ফেলতে পারি৷’
‘আমার কাছে তো ছিল না এসব, বারান্দাটা, সম্ভাবনাটা, তুই…’ হঠাৎ একগাল হেসে ওঠে খেয়া, ‘বাদ দে এসব, বলেছিলাম না একদিন সব শুনব তোর দুঃখের কথা৷ আজ বল কী হয়েছে…’
‘আমার চাকরিটা চলে গিয়েছে৷’
‘ওঃ, আবার পেয়ে যাবি… এটা একটা টেনশন হল…’
নবারুণের চোখ বেয়ে জল নামছিল, সেটা মুছে নিয়ে সে বলে, ‘জানি, জাস্ট কাউকে বলার দরকার ছিল কথাটা৷ আচ্ছা, তোর ভয় লাগে না এত রাতে এভাবে এখানে এসে…’
‘আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস নবা?’
‘ধুর… আসলে বলছিলাম…’
‘এতদিন আমি ছিলাম না তো, বলে গিয়েছিলাম সব জমিয়ে রাখতে৷ এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল সব?’
‘বলব, তুই শুনবি?’ নবারুণ হাসিমুখে বলে৷
‘একদম চুপ করে৷ কিন্তু আগে হাত মেলা…’
‘কেন?’
‘তুইও পাঁচবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছিস, আমিও৷’
হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে যায় নবারুণ, ‘কাল যে বললি চারবার৷’ হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায় নবারুণের৷ রাতে নীচের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল বলে মা চিৎকার করছিল৷ চিৎকারটা এখনও মনে আছে ওর, ‘রোজ বলি বাবু, আমার পায়ে বাত… দরজাটা বন্ধ করে দিবি শোয়ার আগে, তা নয়, আমাকেই এতটা সিঁড়ি ডিঙিয়ে…’
তারপরেই একটা দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ৷
হাত বাড়ায় নবারুণ, কিন্তু সে হাত স্পর্শ করে না কিছু৷ খেয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে, ‘এটা আর হবে না আমাদের কোনওদিন৷ যাক গে, দরকারও নেই…’
কয়েক মিনিট আর কোনও কথা বলে না দু-জনে৷ নবারুণ হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে খেয়ার চাঁদের আলোয় ভেসে-যাওয়া মুখের দিকে৷
‘খেয়া, অনেক কথা বলার আছে তোকে…’
‘আমি তো শুনব বলেছি চুপ করে৷ সব সময়৷’
‘সত্যি তো?’
‘সত্যি…’