খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
মহীতোষবাবুর বয়েস ষাটের খারাপ দিকে, এখনও সত্তরের ঘরে পৌঁছতে দু-তিন বছর লাগবে। কিন্তু তার জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে; অদ্য শেষ দিবস বা শেষ রজনী, মহীতোষবাবুর পরমায়ু আজকেই শেষ।
মারাত্মক অসুখ হয়েছে মহীতোষবাবুর। এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে জীবনের শেষ প্রহর গুনছেন।
কী অসুখ? কেন অসুখ? কেমন অসুখ? কবে থেকে অসুখ?
এই সামান্য সংক্ষিপ্ত রম্যরচনায় এসব প্রসঙ্গে যাওয়া অনুচিত হবে। তা ছাড়া যেকোনও অসুখের আদ্যন্ত বিবরণ খুব ক্ষতিকর, মন খারাপ করে, দুশ্চিন্তা হয়, ভয় হয় এই অসুখ হয়তো আমারও হয়েছে, বিশেষ করে অসুখের লক্ষণগুলো খুব চট করে মিলে যায় নিজের সাম্প্রতিক দেহকষ্টের সঙ্গে।
আর তা ছাড়া, এই রম্য গল্পে অসুখ ব্যাপারটা গৌণ, মুখ্য ব্যাপার হল মৃত্যু, মহীতোষবাবুর মৃত্যু, যে ব্যাপারটা অনতিদূরেই রয়েছে।
মহীতোষবাবু বিছানায় শুয়ে ধুঁকছেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন।
ডাক্তার গতকাল সকালেই জবাব দিয়ে দিয়েছেন, আর আশা নেই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের খবর পাঠানো হয়েছে। তাঁরা ঘন ঘন সশরীরে উপস্থিত হয়ে, টেলিফোন করে মহীতোষবাবুর শেষ অবস্থার খবর নিচ্ছেন।
মহীতোষবাবুর এক ছেলে। এক মেয়ে। ছেলে মহীতোষবাবুর সঙ্গেই থাকে, এখনও বিয়ে করেনি। বয়েস সাতাশ-আটাশ। সে গত দুদিন ধরেই বাবার শরীরের অবস্থার অবনতি দেখে অফিসে যাচ্ছে না, ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছে।
মহীতোষবাবুর মেয়ে ছেলের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। তিন বছর আগে আসানসোলে তার বিয়ে দিয়েছেন। এখনও ছেলে-পিলে কিছু হয়নি। সে আজ সকালের ট্রেনেই বাবার অবস্থার খবর পেয়ে আসানসোল থেকে তার বাপের বাড়ি মহীতোষবাবুর এই দমদম নাগেরবাজারের বাসায় চলে এসেছে।
মহীতোষবাবুর ছেলে আর মেয়ে দুজনের নামই অনু, অনুতোষ আর অনুকণা।
এ ছাড়া এই নাগেরবাজারের বাড়িতে আছেন মহীতোষবাবুর স্ত্রী, দুই অনুর মা। তার নামটা জানা হয়নি। আপাতত তাকে মহীতোষিণী বলে উল্লেখ করলেই কাজ চলে যাবে।
কিন্তু শ্রীযুক্তা মহীতোষিণীকে এতটা দায়সারাভাবে নেওয়া উচিত নয়। তিনিই এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিয়োগান্ত কাহিনির নায়িকা।
দীর্ঘ তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর দাপটের সঙ্গে সংসার চালিয়েছেন মহীতোষিণী দেবী। দাপটটা অবশ্য শতকরা একশো ভাগই পতিদেবতা মহীতোষবাবুর ওপর। তবে দু-চারবার ছেলেমেয়ে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অথবা বাড়ির কাজের লোক এদের ওপরে দাপট খাটাতে যাননি তা নয়, কিন্তু যা হয় আর কী, তেমন সুবিধে করতে পারেননি। অবশেষে পুরো দাপটটাই মহীতোষবাবুর ওপর দিয়ে গেছে।
সমস্ত জীবন মহীতোষবাবু স্ত্রীর ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিলেন। টিপে টিপে, মেপে মেপে চলতেন। কীসে কী দোষ হয়, গাফিলতি হয় কিছুই অনুমান করতে না পেরে দুরুদুরু বক্ষে সদাসর্বদাই স্ত্রীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন।
জামাকাপড়, জুতো নতুন কিছু কিনলেই সেটা মহীতোষিণী দেবীর নজরে পড়ত এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহীতোষবাবুকে জানিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করতেন না যে এগুলো ভদ্রলোকের ব্যবহাযোগ্য নয়। তিনি স্বামীর রুচিবোধ নিয়ে ধিক্কার দিতেন, টিটকিরি কাটতেন।
মহীতোষবাবুর খাবার-দাবার সম্পর্কে তাঁর ছিল ভয়াবহ সতর্কতা। দেড় কেজি ইলিশ মাছ হয়তো মহীতোষবাবু বাজার থেকে এনেছেন তার থেকে দুবেলায় মাত্র দু টুকরো মাছ বরাদ্দ মহীতোষবাবুর। এক কেজি মাংস আনলেও ওই দুটুকরো দিনে রাতে। কোনও দিন প্রাণভরে বাসায় খেতে পাননি মহীতোষবাবু, তাই ইদানীং এদিকে ওদিকে লুকিয়ে চুরিয়ে খারাপ ভাল দ্রব্যাদি নিজে কিনে খেতেন।
আজ মহীতোষবাবু মারা যাবেন। তার দীর্ঘ, নির্যাতিত জীবনের এই শেষ দিনে এসব কথা স্মরণ করে লাভ নেই।
একটু আগে ডাক্তার এসে ঘুরে গেছেন। নাড়ি দেখে, স্টেথসকোপ দিয়ে হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে চলে গেছেন।
বোধ হয় আর কিছুক্ষণ মাত্র। ব্যাপারটা মহীতোষবাবুও বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন, তার বিদায় আসন্ন।
কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল মহীতোষবাবুর জ্ঞান, বুদ্ধি সব কিন্তু টনটনে রয়েছে। চোখেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, কানেও মোটামুটিও শুনতে পাচ্ছেন। তার শয্যার পাশেই ছেলেমেয়ে, দু-চারজন আত্মীয়স্বজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের সঙ্গে কখনও কখনও দু-চারটে কথাও বলছেন।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। মহীতোষবাবুর এই একতলায় শোয়ার ঘরে বাইরে থেকে দক্ষিণের খোলা দরজা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। বছর কয়েক আগে শেয়ালদায় রথের মেলা থেকে একটা গোলাপ গাছ কিনে এনেছিলেন তিনি, সেটা লাগিয়েছিলেন ওই দক্ষিণের দরজার বাইরে বারান্দার নীচের উঠোনে।
দুয়েকটা গোলাপ ফুটেছে তার মৃদু গন্ধ আসছে বাতাসে। কে একজন ঠান্ডা হাওয়া আসছে বলে দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, মহীতোষবাবু তাকে হাত নেড়ে বারণ করলেন। তার ঘ্রাণশক্তি এখনও বেশ প্রবল রয়েছে, এই শেষসন্ধ্যায় গোলাপের মধুর গন্ধ তার বেশ ভালই লাগছে।
এমন সময় অন্য একটা সুঘ্রাণ এসে তাকে চনমনে করে তুলল। খেজুরে গুড়ের পাকের গন্ধ। দুয়েকবার শুকে তিনি তার মাথার কাছে দাঁড়ানো মেয়ে অনুকণাকে বললেন, রান্নাঘরে তোর মা বোধ হয় খেজুরে গুড়ের সন্দেশ বানাচ্ছে? অনু বলল, হ্যাঁ ঠিকই তাই।
মৃত্যুমুখী মহীতোষবাবু কেমন প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন, মেয়েকে বললেন, দ্যাখ, তোর মা তো সারাজীবন আমাকে ভাল-মন্দ কিছুই খেতে দেয়নি। আজ যা তো, রান্নাঘর থেকে দুটো সন্দেশ নিয়ে আয়, মরার আগে খেয়ে যাই।
মেয়ে মাকে ভালই চেনে। একটু দোনামনা করে সে রান্নাঘরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফিরে এল।
মহীতোষবাবু মেয়েকে বললেন, কীরে, সন্দেশ কী হল?
মেয়ে বলল, মা দিল না। ও সন্দেশগুলো শ্মশানবন্ধুদের জন্যে বানানো হচ্ছে। তুমি মারা যাওয়ার পরে তোমাকে পুড়িয়ে ফিরে এসে তারা ওই সন্দেশগুলো খাবে। ওর একটাও তোমার জন্যে নয়।