খুন হলেন জাদুকরি
খাস কলকাতায় প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এমন এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, যেখানে খুনের থেকেও খুনির সাবধানতা এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। আর এই সত্যকাহিনিকে দিয়েছিল একটা খাঁটি গোয়েন্দাগল্পের আকার।
পটভূমি সত্তরের দশকের পার্ক সার্কাস, কলকাতা।
সাতসকালে একটা ফোন গেল থানায়,
—হ্যালো স্যার!
—কে বলছেন?
—আজ্ঞে স্যার, আ—আমি রহমান। আগে বড়োবাজার থানার কনস্টেবল ছিলাম। রিটায়ার করেছি বচ্ছরদুই হল, এখন এই পার্ক সার্কাসে একটা পান—বিড়ির দোকান দিয়েছি স্যার!
—ও। তা কী দরকার বলুন? কাকে চান?
—ইয়ে স্যার, আ—আমাদের পাড়ায় একটা খুন হয়ে গেছে। আমিই প্রথম লাশটা দেখেছি, তাই বড়োরাস্তার একটা দোকান থেকে ফোন করছি।
—কে খুন হয়েছেন? আপনি পার্ক সার্কাসের কোথা থেকে বলছেন?
—স্যার, দিলখুশা স্ট্রিট থেকে বলছি। খুন হয়েছেন একজন ভদ্রমহিলা, শরিফা আজমি। একাই থাকতেন। স্যার, ঢুকে তিনটে বাড়ি পেরিয়ে ডান হাতে দোতলা বাড়ি। বেগুনি আর হলুদ মেশানো। খুব সুন্দর বাড়ি, এলেই চোখে পড়বে।
ততক্ষণে ইনস্পেক্টর ফোন রেখে দিয়েছেন, গাড়ি বের করতে বলার অর্ডার চলে গেছে।
দু—জন কনস্টেবলকে নিয়ে ওসি তড়িঘড়ি ছুটলেন অকুস্থলে।
গিয়ে দেখলেন রহমান নামে পুলিশের প্রাক্তন কনস্টেবল রাস্তার মোড়েই অপেক্ষা করছে, ”আসুন স্যার! এ—এই যে এদিকে!”
”আপনি এখানেই থাকেন?” ইনস্পেক্টর মনীশ ভৌমিক গাড়ি থেকে নেমে গলিতে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন।
”আজ্ঞে স্যার। রিটায়ারের পর এখানে একটা গুমটি দোকান দিয়েছি। দুই মেয়ের শাদি হয়ে গেছে, বুড়োবুড়ির ভালোই চলে যায়।” রহমান লোকটার মাথার চুল থেকে মুখের লম্বা দাড়ি সব ধবধবে সাদা, কিন্তু শরীর এখনও বেশ শক্তপোক্ত দেখলেই বোঝা যায়। তার পরনে একটা সবুজ—লাল প্রিন্টের লুঙ্গি আর সাদা শার্ট।
তিনটে বাড়ি পেরিয়েই মনীশ বুঝতে পারলেন রহমান কোন বাড়িটার কথা বলছেন। খুন হয়েছে বলে বাড়ির সামনে ইতিউতি জটলা তো রয়েইছে, তার চেয়েও বড়ো কথা, এই চত্বরে এমন রাজকীয় বাড়ি যেন খুবই বিসদৃশ।
আশপাশের বস্তি বা ঘুপচি ঘরগুলোর মাঝে ঘিঞ্জি রাস্তার ওপরে ঝকঝকে দোতলা বাড়ি। উজ্জ্বল বেগুনি রং, তার ওপর হলুদ রঙের ডিজাইন। বাড়ির বাইরের ব্যালকনিতে রাখা ফুলগাছ, কেয়ারি করা বাগানের পাতাবাহারগুলো দেখতে দেখতে মনীশ গৃহকর্তার রুচির তারিফ না—করে পারলেন না।
বাড়ির ঠিক সামনেই একটা চা—সিগারেটের গুমটি। রহমান বলল, ”স্যার, ওই যে আমার দোকান।”
জটলা সরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মনীশ রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ”এই বাড়ির মালিক কে রহমান?”
রহমান ভিড় পাতলা করছিল, ”এই, দূর হাটো! তফাত যাও জলদি!”
পুলিশ থেকে রিটায়ার করে গেলেও পাড়ায় তাকে এখনও লোকে পুলিশ বলে বেশ মান্যিগন্যি করে।
সে বলল, ”স্যার, মালিক নয় মালকিন। ওই যে বললাম শরিফা ম্যাডাম। উনি একাই থাকতেন। আমি রাতে নজর রাখতাম বাড়ির ওপর।”
”সেকী!” মনীশ বিস্মিত হলেন, ”এত বড়ো বাড়িতে একজন মহিলা একা একা থাকতেন?”
আজ থেকে প্রায় চার যুগ আগেকার ঘটনা। ওই সময়ে পার্ক সার্কাসের মতো এলাকায় এত বড়ো বাড়িতে একজন ভদ্রমহিলার একাকী থাকাটা একটু বিসদৃশ বই—কী!
ঘরে ঢুকে মনীশ চমকে উঠলেন। বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে এক ক্ষতবিক্ষত নারীশরীর।
দেহে কোনো আবরণ নেই। কপাল পেরিয়ে গোটা মাথায় চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। কপালের সেই রক্ত এসে গোটা মুখটাকে লাল করে তুলেছে।
তা সত্ত্বেও বোঝা যায়, মহিলা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী।
মনীশ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন জায়গাটা। একজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিলেন থানায় চলে যাওয়ার জন্য। এই সমস্ত কেসে পুলিশ কুকুর খুব সাহায্য করে। ”বিজয়, ডিসি সাহেবকে বলে স্নিফার ডগ নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করো। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টেও খবর দাও।” বলতে বলতে তাঁর খেয়াল হল সারা ঘরে উগ্র পারফিউমের গন্ধ।
মহিলা কি মারা যাওয়ার আগে এত চড়া পারফিউম মেখেছিলেন?
মনীশ রহমানের দিকে তাকালেন, ”রহমান, ডেডবডি প্রথম কে দ্যাখে? এই বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই?”
”আজ্ঞে স্যার, বিবিজি সারাক্ষণের লোক রাখা পছন্দ করতেন না। ভোর বেলা কাজের আর রান্নার জন্যে দুটো মেয়ে আসত, তারা বোধ হয় আজ ভোরে এই দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়েছে।”
”তাহলে ডেডবডি তুমিই প্রথম দেখেছ? তুমি এই মহিলাকে কতদিন ধরে চেনো?”
রহমান এবার বলল, ”স্যার, আমি যতটুকু জানি আপনাকে বলছি। বিবিজি মানে শরিফা ম্যাডাম কী কাজকর্ম করতেন জানি না, তবে ওঁর প্রচুর টাকাপয়সা ছিল। সারাদিন সকাল—বিকাল এই বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো গাড়ি করে লোকজন আসত। তাদের বিবিজির সঙ্গে কী দরকার থাকত তাও আমি জানি না। এই পাড়ার কেউই জানে না। উনি কারুর সাথে মেলামেশা করতেন না। একা থাকতেন বলে আমাকে শুধু রাতের বেলা এই বাড়ির দিকে নজর রাখতে বলেছিলেন। আমি সেইজন্য খেয়াল রাখতাম। আমাকে সেইজন্য মাসোহারাও দিতেন। আর অতিথি এলে আমার দোকান থেকে পান, সিগারেট, কোলা এইসবও আনাতেন। রোজ সকালে আমি যখন দোকানের ঝাঁপ খুলতাম, দেখতাম বাইরের টেরেসে বসে বিবিজি চা খাচ্ছেন। কিন্তু আজ দেখতে পাইনি বলে একটু সন্দেহ হয়েছিল। তারপর খেয়াল করলাম, বাড়ির সামনে কোনো গাড়িও নেই, অন্যদিন আটটা বাজতে—না—বাজতেই একদম লাইন পড়ে যায়। তারপর এসে দেখি এই সাংঘাতিক কাণ্ড!” রহমান একটা নিশ্বাস নিল, ”কী বলব স্যার, এত বছর পুলিশলাইনে চাকরি করেছি, কিন্তু এমন নৃশংস খুন কখনো দেখিনি!”
মনীশ কোনো কথা না—বলে সারা ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। বিছানার উলটোদিকেই একটা সুন্দর সোফা, তার পাশে দেরাজ।
শরিফাবিবি একা থাকতেন, কিন্তু তার বাড়িতে দামি দামি সব গাড়ির লাইন পড়ত।
কেন? শরিফাবিবির পেশা কী ছিল?
মনীশ হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, দেরাজের ওপর থরে থরে ছবি সাজানো। ছবি বলতে ফোটোগ্রাফ। প্রতিটা ফোটোই এক—একটি পুরুষের পোট্রেট।
অদ্ভুত ব্যাপার তো! মনীশ ভ্রূ কুঁচকে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কাছে গিয়ে দেখলেন, প্রতিটা ছবিই শক্ত কাগজে বাঁধিয়ে আড়াআড়িভাবে দাঁড় করানো রয়েছে। কোনো ফ্রেম নেই।
বেশিরভাগ ছবিই কলকাতার মান্যগণ্য ব্যক্তিদের। কয়েকটা ফোটো দেখে তো মনীশ রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কেউ নামকরা রাজনীতিবিদ, কেউ প্রখ্যাত খেলোয়াড়, কেউ আবার স্বনামধন্য অভিনেতা। এঁদের মধ্যে বেশ কিছু জনকে মনীশ ব্যক্তিগত পরিসরেও চেনেন।
একটা ছবি আলগোছে তুলে নিলেন ইনস্পেক্টর, নাড়াচাড়া করতে গিয়েই খেয়াল করলেন ছবির উলটো দিকে লেখা—
”শরিফা, আমার স্বপ্নের রাজকন্যাকে …!”
আশ্চর্য হয়ে মনীশ অন্য ছবিগুলোও উলটে দেখতে লাগলেন আর আবিষ্কার করলেন প্রতিটা ছবি পেছনেই প্রশংসা আর গদগদ স্তুতির বন্যা।
কোথাও লেখা, ”অপরূপা শরিফা আমার মনের দেবী!” কোথাও লেখা, ‘তোমার রূপে আমি সব ভুলেছি, ওগো নিরুপমা!”
মনীশ চোখ সরু করলেন। তখনও কলকাতার বাজারে সফিস্টিকেটেড কলগার্ল পেশাটা অতটা সহজলভ্য হয়নি; তবু মনীশের মনে সেই সেই সন্দেহ উঁকি দিল, এত বিত্ত—বৈভবের আড়ালে এই শরিফাবিবি নামক সুন্দরী মহিলা কি দেহব্যবসা চালাচ্ছিলেন?
কিন্তু এত মান্যগণ্যরা এখানে আসতেন—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কিছু ছবি এমন মানুষের, যাঁরা সমাজে রীতিমতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
মনীশ ভাবতে ভাবতে আরও কয়েকটা ছবি উলটে দেখলেন। তখন তাঁর চোখে পড়ল নতুন কিছু কথা—
”পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরিকে …!”
”কলকাতা কেন, গোটা ভূভারতে এমন জ্যোতিষী মেলা ভার …!”
”শরিফা ম্যাডাম, আপনি রূপ এবং অলৌকিকতার এক আশ্চর্য মিশেল!”
শরিফাবিবি কি হাত—টাত দেখত নাকি?
মনীশের থানায় কিছু কাজ ছিল। আগের দিন রাতে একটা ছিনতাইবাজদের বড়ো গ্যাং ধরা পড়েছে। তিনি বাকি দু—জন এস আইকে যথোপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল ঘণ্টা খানেক বাদেই। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডিসি সাহেব ইতিমধ্যেই সব জানতে পেরে জরুরি তার পাঠিয়েছেন, এখনই যেন মনীশ তদন্তের ভার নেন।
মনীশ আবার যখন শরিফাবিবির বাড়িতে এলেন, তখন দুপুর প্রায় একটা। ইতিমধ্যে প্ল্যানমেকাররা লাশের নকশা এঁকে ফেলেছে, ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্টরাও তাদের কাজ সেরে চলে গেছে।
সাব ইন্সপেক্টর বিজয় মনীশকে আসতে দেখে এগিয়ে এল, ”স্যার! স্নিফার ডগ নিয়ে এসে কিছু লাভ হল না!”
”কেন?” মনীশ টুপি খুলে ঘরে ঢুকলেন।
লাশ তখনও একইভাবে পড়ে আছে। আর একজন ফোটোগ্রাফার তার বিশাল ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে লাশের ছবি তুলছে। মর্গ থেকে গাড়ি আসছে, ছবি তোলার পর্ব মিটলেই লাশ চলে যাবে মর্গে।
ফোটোগ্রাফারকে দেখেই চিনতে পারলেন মনীশ, মাইকেল। মাইকেল ট্যাপসেল। ও ঠিক পুলিশের ফোটোগ্রাফার নয়, তবে প্যানেলে নাম আছে। প্রয়োজন পড়লে ডাকা হয়। বাঙালি খ্রিস্টান।
বিজয় বলল, ”এত পারফিউমের গন্ধ, কুকুর দিশেহারা হয়ে গেল স্যার! এই দেখুন না!” বিজয় মনীশকে ঘরের এক কোণে নিয়ে গেল, ”পাঁচ—ছ—টা বড়ো বড়ো পারফিউমের শিশি ভেঙে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে মার্ডারের পর।”
”হুম। খুনি তাহলে বেশ পাকাপোক্তক!” বিড়বিড় করলেন মনীশ। পাশ ফিরে তাকালেন ফোটোগ্রাফারের দিকে, ”আরে মাইকেল যে! কি খবর! অনেক কাল পাত্তা নেই যে!”
”স্যার, আপনারা ডাকেননি তাই দেখেননি!” একগাল হাসল মাইকেল, ”ডাক পেলেই আসতাম।”
মনীশ হাসলেন, ”ভালো করে ছবি তোলো। দেখেছ, কত সব সুন্দর সুন্দর পোর্ট্রেট?”
মনে রাখতে হবে সময়টা আজ থেকে কয়েক দশক আগের, তখনও ফটোগ্রাফ একটা দুর্লভ শৌখিন জিনিস, মানুষ উৎসব—পার্বরে স্টুডিয়োতে গিয়ে বা ফোটোগ্রাফার দিয়ে সেজেগুজে একটা ছবি তোলে। মানুষের হাতে হাতে মুঠোফোনে ছবি তোলা তখন অলীক কল্পনা মাত্র!
মাইকেল কখনো হেলে, কখনো শুয়ে, কখনো ঝুঁকে পড়ে ছবি তুলছিল ক্ষতচিহ্নগুলোর। একবার আলগোছে দেরাজের দিকে তাকিয়ে বলল, ”দেখলাম। ভি আই পি সব লোকের ছবি। তবে স্যার, আপনারা তো ডাকেন খালি হেজে যাওয়া মড়ার ছবি তুলতে। একবার শুভকাজে তুলতে ডেকে দেখুন না, আমার ফোটো কথা বলে বুঝলেন? সবাই বলে। হু হু।”
মাইকেল ট্যাপসেলের ছবি তোলা হয়ে গেলে লাশ মর্গে চালান হয়ে গেল।
মনীশ বাড়ির দরজা সিল করে বাইরে পাহারা বসিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষমুহূর্তে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সেই সময়েই তিনি আবিষ্কার করলেন আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য।
যে দেরাজের ওপরে ছবিগুলো সাজানো ছিল, সেই দেরাজের নীচের হাতল ধরে চাপ দিতেই বেরিয়ে এল একগাদা ছবি।
শরিফাবিবির অন্যান্য ছবি দেওয়ালে ইতিউতি লাগানো ছিল, তাই দেখে এই ছবিগুলোতেও শরিফাকে মনীশ চিনতে পারলেন।
প্রতিটা ছবিতেই শরিফা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাঁর দেহে কোনো পোশাক নেই। কিন্তু ছবিগুলোর সৌন্দর্য অনস্বীকার্য। অদ্ভুত সুন্দর কোণ থেকে শরিফার এক—একটি দেহবল্লরীকে ফোকাস করে ছবি তোলা হয়েছে—কোথাও মসৃণ দেহলতার ওপর সূর্যের রোদ লুকোচুরি খেলছে, কোথাও আলোআঁধারির মায়াজালে নিমগ্ন এক অপরূপা।
আর প্রতিটি ছবিতেই শরিফার অভিব্যক্তি রীতিমতো আবেদনময়। দেখলেই বোঝা যায়, লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, স্বেচ্ছায় তোলা হয়েছে এই ফোটোগুলো।
কিন্তু একজন ভদ্রমহিলা এইভাবে নিজের নগ্ন ছবি কেন তোলাবেন?
সাব ইনস্পেক্টর বিজয় বলল, ”স্যার, আজকাল অনেক ধনী মহিলাই এমন ছবি তোলায়। নিজেদের শরীর এইভাবে নিজেরাই দেখে স্যার।”
মনীশ নারীমন সম্পর্কে বিজয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে দু—একটা লঘু রসিকতা করে বেরিয়ে এলেন।
দেরাজে ওই ছবিগুলো ছাড়া একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কাটিং ও পাওয়া গেল—”ম্যাডাম শরিফা দু—মাসের জন্য কুয়েত যাচ্ছেন। ফিরে এলে আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।”
ফিরে এলে কাদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে? কেনই—বা বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে? শরিফাবিবি কি জ্যোতিষচর্চা করতো? নাকি বিবস্ত্র ছবি দিয়ে আকৃষ্ট করে দেহব্যবসাই ছিল তাঁর জীবিকা?
ইনস্পেক্টর মনীশ ভৌমিক তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এই খুনের পেছনে যেন লুকিয়ে রয়েছে কোনো গভীর রহস্য।
খুনি পুলিশকে বিভ্রান্ত করে পারফিউমের শিশি ভেঙে ছড়িয়ে গেছে, শরিফাবিবির জীবনযাপনও রহস্য প্রকট।
মনীশ প্রথমেই কুয়েত পুলিশের হেডকোয়ার্টারে জরুরি তার পাঠালেন।
উত্তরও এল একদিনের মধ্যেই, ”শরিফাবিবি কুয়েতের সুলতানের ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে কুয়েতভ্রমণে গিয়েছিলেন। দু—মাস সেখানে ছিলেন। তেহরান, কাবুল এবং আরও কিছু স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি ফিরে যান।”
মনীশ নড়েচড়ে বসলেন। কুয়েতের খোদ সুলতানের ব্যক্তিগত অতিথি হওয়া তো যে—সে ব্যাপার নয়! তিনি আরও সতর্কভাবে তদন্ত চালাতে লাগলেন।
দিন কয়েকের মধ্যেই খবর এল, শরিফা আজমি ছিলেন মুর্শিদাবাদের খানদানি মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রতাপসম্পন্ন খানবাহাদুর। খানবাহাদুরের ওই একটি কন্যা ব্যতীত বংশে কেউ ছিল না।
খানসাহেব যখন মারা গেলেন, শরিফা তখন তেইশ। শরিফা মুর্শিদাবাদের বাড়ি ছেড়েছুড়ে পার্ক সার্কাসে এসে থাকতে শুরু করলেন। তখনই তিনি জ্যোতিষবিদ্যা, হিপনোটিজম, গ্রাফোলজি—এইগুলো সব শিখেছিলেন।
একে সুন্দরী, তায় বুদ্ধিমতী। শরিফার প্র্যাকটিস অল্পদিনেই ফুলে—ফেঁপে উঠল।
মনীশ ভাবলেন তাহলে ওই সমস্ত মান্যগণ্য ব্যক্তিরা কি শরিফার কাছে ভবিষ্যৎ জানতে গিয়েছিলেন? তাঁদের ছবি তুলে রেখে শরিফা কি নতুন কাস্টমারদের কাছে বিজ্ঞাপন করতেন? যে ”দ্যাখো, এত বড়ো বড়ো মানুষজন আমার ওপর ভরসা করেন!”
এক সপ্তাহ কেটে গেল, মনীশ কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। ইতিমধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিপার্টমেন্ট জানিয়ে দিয়েছে, ওই মান্যগণ্য ব্যক্তিদের ছবিগুলোতে শরিফার নিজের এবং দুটো কাজের মেয়ের হাতের ছাপ ছাড়া আর কারুর ছাপ নেই।
মনীশ হাল ছাড়লেন না, উপরমহলে কথা বলে হানা দিলেন এক সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে, যাঁর ছবি শরিফার ঘরে পোট্রেট আকারে রাখা ছিল।
ভদ্রলোকের নাম বললে এখন হয়তো অনেকেই ভ্রূ কুঁচকবেন, তাই এইটুকু বলাই ভালো, তখনকার কলকাতার তিনি ছিলেন এক কিংবদন্তী চিকিৎসক।
ব্যস্ত চেম্বারে রুগিদের ভিড় মিটলে মনীশ গিয়ে তাঁকে খুলে বললেন সবকিছু, সবশেষে ছবিটা দেখালেন, ”ডাক্তারবাবু, ছবির পেছনে প্রশংসা করেছেন যখন, তখন এনার কাছে আপনি হাত দেখিয়ে নিশ্চয়ই উপকার পেয়েছিলেন! একটু বললেন ভদ্রমহিলা ঠিক কী করতেন?”
ডাক্তারবাবু গম্ভীর মানুষ। ভ্রূ সামান্য উপরে উঠেই আবার নেমে গেল। মনীশের হাত থেকে নিজের ফোটোগ্রাফখানা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন, তারপর উলটে পেছনদিকের লেখাটাও পড়লেন মনোযোগ দিয়ে, ”চা খাবেন তো ইনস্পেক্টর?”
মনীশ হাসলেন, ”না ধন্যবাদ। আসলে আমি একটু তাড়ায় আছি। একটু যদি সাহায্য করেন, তদন্তে খুব সুবিধা হয়!”
ডাক্তারবাবু এবার ছবিটা মনীশকে ফিরিয়ে দিলেন, ”সাহায্য করার কোনো প্রশ্নই নেই ইনস্পেক্টর ভৌমিক, সেই ক্ষমতাই আমার নেই। কারণ ছবিটা আমার, সেটা আমি স্বীকার করছি বটে, কিন্তু ছবির পেছনের ওই হাতের লেখা কখনোই আমার নয়; আর আমি আপনার এই যাদুকরিকে কস্মিনকালেও চিনতাম না, সাক্ষাৎ করে উপকার পাওয়া তো দূরের কথা! আমি এইসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না।”
মনীশ ভ্রূ কুঁচকলেন, ”মানে …আপনি পার্ক সার্কাসে শরিফা বিবির কাছে যাননি?”
ভদ্রলোক বিরক্ত চোখে এবার তাকালেন, ”কী মুশকিল, কোথাকার কে শরিফা, আমি তার কাছে যেতে যাব কেন? আমার কি সময়ের দাম নেই নাকি!”
”তাহলে … তাহলে এই ছবি? কোথায় তুলিয়েছিলেন আপনি এই ছবিটা?”
ছবিতে ডাক্তারবাবু হাসিমুখে বসে রয়েছেন স্টুডিয়োর এক কৃত্রিম ঝরনার পাশে, সেদিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ”আমার এইসব হালফ্যাশনের জিনিস পোষায় না। আমার গিন্নির এইসব ছবি—টবি তোলার শখ হয়েছিল। তিনি আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক স্টুডিয়োতে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এক ছোকরার স্টুডিয়ো। ছবি তোলার হাত ভালোই।”
”আচ্ছা।” মনীশ ঝড়ের গতিতে নোট করছিলেন, ”কী নাম?”
ডাক্তারবাবু হাত এলিয়ে দিলেন পেছন দিকে, ”স্টুডিয়োর নামটা ঠিক মনে নেই, তবে ছেলেটার নাম মনে আছে। বেশ আলাপী ছিল। মাইকেল। মাইকেল ট্যাপসেল।”
মনীশ লেখা থামিয়ে চমকে উঠলেন। আগেই বলেছি, মাইকেল ট্যাপসেল ছিল পুলিশের প্যানেলে এনলিস্টেড থাকা একজন ফোটোগ্রাফার, যে কিনা প্রথমদিন শরিফাবিবির মৃতদেহের ছবি তুলতে এসেছিল।
পরের তিনদিনে মনীশ আরও সাত—আটজন মানুষের কাছে গেলেন, যাদের ছবি ছিল ঘরে, প্রত্যেকেই শরিফাবিবির নাম শুনে আকাশ থেকে পড়লেন বটে; কিন্তু একবাক্যে সবাই জানালেন, ”মাইকেল ট্যাপসেলের কাছে ছবি তুলিয়েছিলাম তো!”
এতদিনের তদন্তে এই প্রথম যেন একটা আলোর উৎস পাওয়া গেল।
মনীশের মনে পড়ল, মাইকেল সেদিন লাশের ছবি তুলতে এসে ছবিগুলো দেখেছিল, মশকরাও করেছিল। কিন্তু ছবিগুলো যে তারই তোলা সে ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও করেনি। চিন্তিত মুখে মনীশ হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টদের ফোন করলেন।
রিপোর্ট এল জলদি। মনীশের সন্দেহই নির্ভুল। ছবির পেছনের হাতের লেখাগুলো আর কারুর নয়, খোদ মাইকেল ট্যাপসেলের।
মনীশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর ডেকে পাঠালেন মাইকেলকে। মাইকেল এল বিকেল বেলা, ”বলুন স্যার! কোথায় যেতে হবে?”
”বসো মাইকেল।” মনীশ উলটোদিকের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলেন, ”কেমন চলছে তোমার স্টুডিয়ো?”
”ভালো স্যার!” একগাল হাসলেন মাইকেল, ”এই তো কাস্টমার এসে বসেছিল, আমি পরে আসতে বলে বন্ধ করে এলাম।”
”বাঃ বেশ বেশ!” মনীশ মাথা নাড়লেন, ”তা মাইকেল, সেদিন শরিফা আজমির বাড়ির ছবিগুলো কার তোলা ছিল বলো তো?”
মাইকেলের মুখ পলকে সাদা হয়ে গেল। ঢোঁক গিলল, ”স্যার, মানে … আমি … ইয়ে!”
মনীশ সামনে রাখা জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন, ”কোনো ভয় নেই। এই জলটা খাও। তারপর যেটা তোমার আমাকে আগেই বলা উচিত ছিল সেটা বলো।”
মাইকেল ততক্ষণে পুরো নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সে ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে বলল, ”স্যার! বিশ্বাস করুন, আ—আমি কিছু করিনি!”
”ঠিক আছে। তুমি যা জানো সেটাই বলো।” মনীশ অভয় দিলেন।
মাইকেল তবু ইতস্তত করতে লাগল, ”স্যার, আমার বউ যদি জানতে পারে—?”
”কেউ কিছু জানবে না।” মনীশ বললেন, ”তুমি নিশ্চিন্তে বলো।”
”স্যার! গতবছর শরিফা আজমি কোথাও থেকে নম্বর পেয়ে আমার স্টুডিয়োতে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন ছবি তোলাতে চান। আমি সেইমতো এক ছুটির দিন সকালে ক্যামেরা, স্ট্যান্ড সব কিছু নিয়ে হাজির হই ওই পার্ক সার্কাসের বাড়িতে।” মাইকেল থামল।
”তারপর?”
”যাওয়ার পরে শরিফা বলেন, তি—তিনি নিজের ন্যুড ছবি তোলাতে চান। আমি তখন তুলতে পারব না বলে বেরিয়ে আসি বাড়ি থেকে।”
”কেন তুলতে পারবে না বললে?” মনীশ প্রশ্ন করলেন।
”আপনি জানেন না স্যার! এইসব নিয়ে অনেকসময় ইচ্ছাকৃত ব্ল্যাকমেইল করার চল আছে। ধরুন ছবি তুলছি, অমনি সাজিয়ে রাখা স্বামী এসে হাজির হয়ে হুজ্জুতি করল, তখন ফোটোগ্রাফারকেই মোটা টাকা দিতে হয় ঝামেলা এড়ানোর জন্য। এরকম অনেক কেস আছে।” মাইকেল উত্তেজিত হয়ে উঠল।
”আচ্ছা। তারপর?”
”তারপরের দিনই শরিফা আজমি ওঁর বাড়ির কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালেন আমাকে, তাতে লেখা ছিল, অপবাদের কোনো ভয় নেই। উনি একা মানুষ, নিজের শখের জন্য ওই ছবি তোলাতে চাইছেন। প্রতিটা পোজের জন্য এক—শো টাকা করে দেবেন, সঙ্গে ট্যাক্সি ভাড়া।” মাইকেল বলল, ”সঙ্গে দু—শো টাকা অ্যাডভান্সও পাঠিয়েছিলেন।”
”তুমি ছবি তুলতে গেলে?”
”হ্যাঁ স্যার। অতগুলো টাকা, আর না করতে পারিনি। ছবি তুলে চলে আসি। তারপর ডেলিভারি দিতে গিয়ে …!” মাইকেল মাথা নীচু করল, ”আমরা দু—জন একসঙ্গে ছবিগুলো দেখছিলাম। সেই দেখতে দেখতে কখন যে … মানে … শরিফা নিজেই এমনভাবে সমর্পণ করেছিলেন নিজেকে …!”
”বুঝেছি। তারপর বলো।”
”তারপর স্যার, আমি প্রায়ই শরিফার কাছে যেতাম। ভালোবাসা কি না জানি না, কিন্তু শারীরিক মোহ তো ছিলই। তখনই শরিফা আমাকে বলে যে আমার স্টুডিয়োতে তোলা কিছু বিখ্যাত মানুষের ছবি যদি আমি প্রিন্ট করে এনে দিই, ও সেগুলোকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।” ধরা গলায় মাইকেল ঝুঁকে পড়ল, ”বিশ্বাস করুন স্যার! শুধুমাত্র ওর কথা রাখতে গিয়ে আমি ওইসব লেখাগুলো লিখেছিলাম। আমি আর কিচ্ছু জানি না বিশ্বাস করুন! ওকে যে কে মারল, কেন মারল …!”
মাইকেল ট্যাপসেল চলে যেতেই মনীশ জলের গ্লাসটা পাঠিয়ে দিলেন ফিঙ্গার প্রিন্ট দপ্তরে।
এইবারই উদ্ঘাটিত হল চমকপ্রদ তথ্য।
ফিঙ্গার প্রিন্ট ডিপার্টমেন্ট সাফ জানিয়ে দিল, ”এই হাতের ছাপ যে মানুষের, তার রেকর্ড ইতিমধ্যেই পুলিশ রেকর্ডে আছে। তার আসল নাম জোসেফ উইলটন। পুলিশের খাতায় সে বছর কয়েক আগেই নাম লিখিয়ে ফেলেছে।”
”কে সে?” বিমূঢ় মনীশ জিজ্ঞেস করলেন, ”পুলিশি প্যানেলে মাইকেল ভুয়ো নামে এনলিস্টেড ছিল তাহলে?”
”জোসেফ উইলটন ছিল মুর্শিদাবাদ শহরের ডাক্তার। গোপনে অবৈধ গর্ভপাত করিয়ে পয়সা রোজগার করত। তারপর একটা মহিলার ওপর অত্যাচারের দায়ে জেল খাটে।”
”সেকী!”
”দাঁড়ান মি ভৌমিক, এতেই চমকে যাবেন না। জেল থেকে বেরিয়ে সে ওই মহিলাকে খুনও করেছিল বলে অভিযোগ, কিন্তু কোনো শক্তপোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জেল খাটার জন্য তার ডাক্তারির লাইসেন্সটা বাতিল হয়ে যায়।”
ইনস্পেক্টর মনীশ ভৌমিক আর দেরি করলেন না। সার্চ ওয়ারেন্ট সমেত হানা দিলেন মাইকেলের ফ্ল্যাটে।
জাদুকরি হত্যারহস্যের যবনিকা পতন হল সেখানেই।
সেখান থেকে উদ্ধার হল রক্তমাখা শার্ট, প্যান্ট আর লোহার একটা হাতুড়ি। সবেতেই লেগে থাকা রক্ত শরিফার রক্তের সাথে মিলে গেল।
শোনা যায়, জোসেফ উইলটন ওরফে মাইকেল ট্যাপসেল ছিল এক বিচিত্র মানুষ। শরিফা জানত না তার অতীত।
পুলিশি জেরায় অনুতাপ তো দূরের কথা, মাইকেল রীতিমতো নিজের প্রশংসা করে চলেছিল। তার সেই অদ্ভুত বক্তব্যগুলো দিনের পর দিন পরিবেশিত হত সংবাদপত্রে।
আদালতে তোলার সময়েও সে কোনো কিছু ভ্রূক্ষেপ না—করে চিৎকার করছিল, ”আমাকে ভয় দেখানো? হিপনোটাইজ করে জেনে নিয়েছিল আমি আগে খুন করেছিলাম, আর সেই টেপ রেকর্ড করে ব্ল্যাকমেইল করা? ওই শরিফা আজমি ভেবেছিল ওই দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে কেনা চাকর করে রাখবে?”
জনতা হাঁ করে শুনত তার নিজের মনে উচ্চৈঃস্বরে বকে চলা প্রলাপ।
মাইকেল নিজের বুকে ঘুষি মারতে মারতে বলত, ”আমাকে চেনে না, আমার নাম জোসেফ উইলটন, ওইসব ম্যাজিকওয়ালিদের আমি পকেটে রাখি। দিয়েছি পৃথিবী থেকে সরিয়ে, বুঝলে?”