খুন-খুন খেলা – অসিত মৈত্র

খুন-খুন খেলা – অসিত মৈত্র

রহস্যকাহিনির পাতায়-পাতায় অনেক খুনের গল্পই আপনারা পড়ে থাকেন ৷ সেইসব গল্পের গোয়েন্দাদের দক্ষতা কী অসাধারণ! কত নিপুণ তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা! যে-কোনও জটিল চক্রান্তের বেড়াজাল তারা অনায়াসে বুদ্ধির ছুরি দিয়ে কেটে দু-ফাঁক করে দিচ্ছে, তাদের অদ্ভুত ক্ষমতার তারিফ না করে পারা যায় না ৷ মঁসিয়ে দ্যুপাঁ, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, মিস মারপল, ব্যোমকেশ বক্সী— এঁদের কাজ-কারবার তো রীতিমতো ভেলকি বলেই মনে হয় ৷ কিন্তু সত্যি বলতে কী, সাহিত্যের পাতা থেকে বাস্তব পৃথিবীটার ফারাক প্রায় আশমান-জমিন ৷ এই সমস্ত খুনের গল্পের জমকালো গোয়েন্দাদের যদি বইয়ের পাতা থেকে তুলে এনে পৃথিবীর খোলা হাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া যায়, তবে দেখবেন দু-দিনেই তাঁদের খ্যাতির ফানুস ফেটে চুপসে গেছে ৷ দৈনিক পত্রিকার পাতায় প্রায়ই তো সেইসব বিকৃত দেহের ছবি ছাপা হয়, রেললাইনের ধারে বা জংলা মাঠের মধ্যে যাদের মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে ৷ খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন, হত্যাকারীর হদিশ পাওয়া তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সঠিক পরিচয়টাই খুঁজে বের করতে পারে না পুলিশ৷ তা ছাড়া, পথে-ঘাটে খুন তো আকছারই ঘটছে ৷ তার মধ্যে কতগুলোর কিনারা হচ্ছে, আর কতগুলো পুলিশের ফাইলের চাপে পড়ে বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাচ্ছে তারই বা সঠিক হিসেব রাখছে কে!

 এই যেমন আমার কথাই ধরুন না ৷ এ-পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে, কচি-বুড়ো মিলিয়ে মোট পাঁচটা খুন করেছি আমি ৷ রাঁচির পাগলাগারদে বসে আমি আপনাদের গল্প শোনাচ্ছি ভেবে হাসবেন না ৷ আমি এই শহর কলকাতার একজন স্বাধীন নাগরিক ৷ যদি জিগ্যেস করেন, আমাদের সরকার কি এতই বেহেড যে, এমন একখানা খাসা স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরও তারা এখনও আমায় গ্রেপ্তার করছে না? অবশ্য সেদিকটাও আমি বেশ ভালো করে ভেবেচিন্তে রেখেছি ৷ তাদের কাছে এটাকে সোজা গপ্পো বলেই চালিয়ে দেব ৷ গপ্পো লেখার অধিকার তোআপনার-আমার সকলেরই আছে ৷

 তবে এমন মনে করবেন না, আমি একের-পর-এক এতগুলো খুন করে গেলাম আর পুলিশের গায়ে তার আঁচটুকুও লাগল না ৷ প্রথম খুনটার পর তো তারা আমাকে যথেষ্টই নেকনজরে দেখতে শুরু করেছিল ৷ জাঁদরেল দারোগা প্রকাশ মিত্তির বার-দু-তিন আমার ডেরায় এসে হানা দিল ৷ জেরায়-জেরায় আমাকে একবারে জেরবার করে তুলতে চাইল৷ কেন এসেছিল? কোথায় গেল? রোজ আসত কি না? আমার সঙ্গে মেয়েটার কীরকমের সম্পর্ক? কী-কী কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে? এই সমস্ত সাত-সতেরো নানান ধরনের প্রশ্ন ৷ কিন্তু আমিও তেমন কাঁচা ছেলে নাকি! সবক’টা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি হিসেব করে ৷ শেষকালে একসময় মুখ চুন করে আস্তে-আস্তে উঠে গেল প্রকাশ দারোগা ৷ এর পরেও অবশ্য কিছুদিন ফেউ-এর মতো লেগে রইল আমার পিছু-পিছু, তবে তাতে কাজ কিছু হয়নি, শুধু হয়রানিই সার হয়েছে ৷

 আমাকে যদি আপনারা সাধারণ আর-পাঁচটা পেশাদার খুনির মতো মনে করেন, তা হলেও মস্ত ভুল করবেন ৷ দস্তুরমতো ভদ্রঘরের ছেলে আমি ৷ লেখাপড়া শিখে বি.এসসি.পাশ করেছি ৷ খুন করা আমার পেশা নয় ৷ তবে ইদানীং সুবিধেমতো এবং মনের মর্জিমাফিক দু-চারটে খুন আমি করেছি ৷ লীনাকে দিয়েই আমার খুনের হাতেখড়ি ৷ এখন অবশ্য মাঝে-মধ্যে মেয়েটার জন্যে যে একটু-আধটু মনখারাপ না হয় এমন নয় ৷ আমাকে আপনারা এতটা নিষ্ঠুর ভাববেন না ৷ কিন্তু কথায় আছে, নিয়তির লিখন কে খণ্ডাবে? আমি তো ছার নিমিত্ত মাত্র! এই লীনাকেই তো একদিন বুকভরে ভালোবাসতাম আমি ৷ কলেজ-জীবনের সেই স্বপ্নমদির দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়! লীনার যেদিন বিয়ে হয়ে গেল সেদিন আমার গোটা হৃদয় কি শূন্য হয়ে যায়নি? আমার বুকের ভেতরকার আকাশ-পাখিটা কী অসহ্য যন্ত্রণাতেই না ভগ্নপক্ষ হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটির ওপর! তবে সময়ই সব ব্যথা মুছে দেয় মন থেকে ৷ ক্রমে-ক্রমে আমার বুকের ওপরও বিস্মৃতির প্রলেপ বুলিয়ে দিল সে ৷

 ছেলেবেলায় বাবাকে কবে হারিয়েছি সঠিক মনে পড়ে না ৷ তাঁর মৃত্যুর পর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর লাইফ ইনসিয়োরেন্সের একটা থোক টাকা এসে পড়ল মায়ের হাতে ৷ তার ওপর নির্ভর করেই মা আমাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ৷ দুঃখের সংসারের তিলমাত্র আঁচটুকুও কখনও আমার গায়ে লাগতে দেননি ৷ আমার মা ছিলেন যথেষ্ট মিতব্যয়ী প্রকৃতির ৷ তাই বাবার মৃত্যুর পর আঠারো বছর সংসার চালিয়েও সেই টাকার তখনও কিছু অবশিষ্ট রেখে যেতে পেরেছিলেন ব্যাঙ্কে ৷

 লেখাপড়ায় কোনোকালেই আমি নেহাত খারাপ ছিলাম না ৷ মায়ের নিজের বিদ্যের দৌড় ‘কথামালা’ আর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত ৷ কিন্তু ছেলের পড়াশুনোর দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রচণ্ড সজাগ ৷ প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমাকে পড়তে বসিয়ে নিজেও বসে থাকতেন কাশীরাম দাসের মহাভারতখানা কোলে টেনে নিয়ে ৷ আমি কী পড়ছি সেটা হয়তো সবসময় বুঝতেন না, কিন্তু পড়ায় আমার মন আছে কি না তা ঠিক বুঝতে পারতেন ৷ আর পাছে নষ্ট হয়ে যাই সেই আশঙ্কায় বাইরের কোনো ছেলের সঙ্গে আদৌ মিশতে দিতেন না আমায় ৷ তাই মা ছাড়া আমার বন্ধু বলতে বিশেষ কেউ ছিল না ৷

 স্কুল-জীবনটা মায়ের কড়া নজরের মধ্যে দিয়েই কাটাতে হয়েছে আমাকে ৷ তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় কলেজে এসে ঢুকলাম ৷ ছেলে এবার বড় হয়ে উঠেছে দেখে মায়ের প্রখর দৃষ্টি একটু-একটু করে শিথিল হয়ে এল ৷ তবুও ফার্স্ট ডিভিশনেই আই. এসসি. পাশ করলাম ৷

 লীনা যখন আমাদের কলেজে প্রথম অ্যাডমিশন নিল তখন আমি থার্ড ইয়ারের ছাত্র ৷ বড়লোকের মেয়ে ৷ দেখতে-শুনতেও বেশ ভালো ৷ তাই সকলেই একটু বুক ফুলিয়ে চলার চেষ্টা করত ওর সামনে দিয়ে ৷ আর রূপবান ধনীর দুলালেরও অভাব ছিল না আমাদের কলেজে ৷ কিন্তু অদৃষ্টের কী অদ্ভুত পরিহাস— হঠাৎ একদিনের আলাপের পর থেকে কেন জানি না, আমার সঙ্গেই তার সম্পর্কটা নিবিড় হয়ে উঠতে লাগল ধীরে-ধীরে ৷

 নারী-চরিত্রের বিচিত্রতম দুর্গমতার অন্ত আমার অজানা ৷ তাই আমার প্রতি লীনার এই আকর্ষণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করিনি কখনও ৷ তার এই ভালোবাসাকে সহজ, সত্য এবং স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম ৷

 ছেলেবেলা থেকেই আমি বরাবর নিঃসঙ্গ ৷ পৃথিবীতে সঙ্গী বলতে মা ছাড়া আমার কেউ ছিল না ৷ লীনার সঙ্গ আমায় কোন অপার্থিব আনন্দলোকে নিয়ে গেল! সে যে কী আনন্দ, ভাষায় তাকে ব্যক্ত করা অসম্ভব ৷ আমার দিন-রাতের সমস্ত স্বপ্ন লীনাকে ঘিরে উদ্বেল হয়ে উঠল ৷

 বুঝতেই পারছেন, আমার দেহ-মনে তখন নবীন যৌবনের জোয়ার ৷ বয়েস কম— অভিজ্ঞতা কম ৷ বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়িনি একবারও ৷ এই অবস্থায় কল্পনার পাখা কত না সুদূর-বিস্তৃত হয় ৷ আর, এই স্বপ্নগুলোর ওপর দিয়ে যেন দিনগুলো বরাবর হেঁটে চলেছে…হেঁটে চলবে, ভাবতে ভালো লাগে ৷

 সেবারে গরমের ছুটিতে লীনারা দার্জিলিং বেড়াতে গেল ৷ লীনার যদিও যাওয়ার ইচ্ছে আদৌ ছিল না, কিন্তু বাড়ির সকলেই যখন যাচ্ছে তখন কোন ছুতোয় বা সে কলকাতায় পড়ে থাকবে! অগত্যা মা-বাবার সঙ্গে তাকেও যেতে হল ৷ যাওয়ার আগের দিন লীনা নিজে থেকেই আমাকে আউটরাম ঘাটে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ৷ সেদিন থেকে কলেজে গরমের ছুটি পড়বে ৷ বিকেলের ক্লাস শেষ করে লীনা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ৷ গঙ্গার ধারে একটা নির্জন বেঞ্চে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম আমরা ৷ দুজনের বুকের ভেতর এত বেশি কথা এসে ভিড় করছিল যে, সেগুলোকে ধীরে-সুস্থে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ ৷ শুধু এক অব্যক্ত বেদনায় ছটফট করে গুমরে-গুমরে কেঁদে মরছিল মনটা ৷ একটু-একটু করে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এল তাকিয়ে দেখিনি ৷ আমাদের স্বপ্নের দিনগুলোর ওপরও বুঝি নিয়তি সন্ধ্যার কালো ছায়া টেনে দিল ৷

 মাস-দেড়েক বাদে যখন লীনা ফিরে এল, তখন আর তাকে যেন চেনাই যায় না ৷ আপেলের মতো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে ওর নিটোল গালদুটো ৷ সারা গায়ে টসটস করে ফেটে পড়ছে গোলাপি আভা ৷ শুধু চেহারাতেই নয়, ইতিমধ্যে হাবভাব, স্বভাব-চরিত্রেও যেন এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে ওর ৷ কলেজের করিডরে আমাকে দেখে আড়ষ্ট, ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওর মুখ ৷ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে চলে গেল দ্রুতপায়ে ৷ আমি ব্যথা-বিস্মিত দু-চোখ তুলে তাকিয়ে রইলাম ওর চলে-যাওয়া-পথের দিকে ৷

 এর পরের দিন থেকে লীনা আর কলেজেই এল না ৷ শুনলাম, ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে ৷ পাত্র এক তরুণ ডাক্তার ৷ দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে আলাপ হয়েছে দুজনের ৷ তারপর ছেলেটা সুযোগ বুঝে আত্মীয়তা পাতিয়ে নিয়েছিল ওদের পরিবারের সঙ্গে ৷ লীনার বাবাও মৃদু হেসে প্রসন্ন মনে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাকে ৷ এর মাসখানেক বাদে বিয়ে হয়ে গেল ওদের ৷

 আমার সে-দিনগুলোর কথা আপনাদের বোঝাই কেমন করে! দুঃখে, অপমানে, লজ্জায়, হতাশায় সমস্ত বিশ্বটাই ঝাপসা হয়ে এল দু-চোখের সামনে ৷ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বটাও বুঝি আর টের পাচ্ছিলাম না নিজের মধ্যে ৷ পাগলের মতো দিনকতক ঘুরে বেড়ালাম সকাল-সন্ধে ৷ তারপর একসময় লীনার স্মৃতিটা ঘুমিয়ে পড়ল বুকের গভীরে ৷

 আমি যেবার কলেজ থেকে পাশ করে বেরোলাম, সেই বছরের ডিসেম্বরে মা-ও গত হলেন ৷ এতদিন ধরে মাকে দেখে আসছি, কিন্তু তাঁর যে মরবার মতো বয়েস হয়েছে, এ-কথা কখনও ভাবিনি ৷ তাই প্রথমটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম ৷ মনে হল, এই দুনিয়ায় আমার আর কোনও প্রয়োজনই নেই ৷ সকলের মধ্যে থেকেও আমি যেন সম্পূর্ণ একা ৷ সঙ্গীহীন, সাথীহীন একক নিঃসঙ্গ জীবন ৷ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যেই সময় কাটিয়ে যাওয়া ৷

 মনের যখন এইরকম অবস্থা সেইসময় একদিন হঠাৎ ট্রামের মধ্যে নীরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ শুনলাম, টালিগঞ্জে ও এখন একটা পোলট্রি ফার্ম ফেঁদে বসেছে ৷ কী খেয়াল চাপল, নীরেনের সঙ্গে ওর পোলট্রি দেখতে গেলাম ৷ তারপর থেকে আমার মাথাতেও পোলট্রির মতলব ঘুরে বেড়াতে লাগল ৷ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে আমাকে একটা উপায়ের ব্যবস্থা দেখতে হবে ৷ আর শহরের ভিড়ে চাকরি করে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই আমার অসহ্য লাগে ৷ হিসেব করে দেখলাম, ব্যাঙ্কে এখনও হাজার পনেরোর মতো অবশিষ্ট পড়ে আছে ৷ সেই টাকা দিয়েই একটা চান্স নেব ঠিক করলাম ৷ সব যদি ডুবেও যায় তাতেই বা ক্ষতি কী? আমি এখন কোনো কিছুরই পরোয়া করি না ৷

 এইসব ভেবেচিন্তে দিনকতক নীরেনের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম ৷ পোলট্রি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হল আমার ৷ তারপর আমার কাজ শুরু করলাম ৷

 এদিক থেকে ভাগ্য আমার সুপ্রসন্নই ৷ বলতে হবে ৷ প্রথমে টলমল করলেও আস্তে-আস্তে আমার ফার্ম নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল ৷ আমিও দিনরাত এই ফার্ম নিয়েই পড়ে রইলাম ৷ শহরের এক নির্জন প্রান্তে একা-একা দিনগুলো মন্দ কাটছিল না ৷

 চার বছরের মধ্যে আমি আমার পোলট্রিটাকে মোটামুটিভাবে বৈজ্ঞানিক প্রথায় গড়ে তুললাম ৷ কাঠা-ছয়েক জমি নিয়ে আমার এই পোলট্রি ৷ চারধারে উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা ৷ মুরগিদের জন্যে জাল দিয়ে ঘেরা দুটো বিরাট খাঁচা ৷ এককোণে অ্যাসবেসটসের শেড দেওয়া আমার থাকার আস্তানা ৷ বারান্দার একধারে ইনকিউবেটর, আর মুরগিদের জন্যে মাংসের কিমা বানাবার প্রমাণ সাইজের সেই মেশিনটা ৷ যদিও আমার ছোট ফার্মের পক্ষে এত বড় মেশিনের দরকার ছিল না, তবে পার্ক স্ট্রিটের এক নিলামের দোকানে জিনিসটা খুব সস্তায় পেয়েছিলাম বলেই কিনে এনেছিলাম ৷

 সেটা শরৎকাল ৷ আকাশ থেকে হিম-হিম ঠান্ডা ঝরছিল সন্ধেবেলা ৷ আমার সারাদিনের কাজের লোক তিনকড়িও ছুটি নিয়ে চলে গেছে কিছু আগে ৷ একা-একা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে একটা বিলিতি ক্রাইম নভেলের পাতা ওলটাচ্ছিলাম অলসভাবে ৷ খুব বেশি আগ্রহ ছিল না বইটার ওপর ৷ এমন সময় সদরে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম ৷ এসে দেখি, ছোট একটা সুইকেস হাতে লীনা দাঁড়িয়ে ৷ লীনা যে আবার কোনো দিন আমার কাছে আসবে, আবার কোনো দিন আমি ওর দেখা পাব, সে-কথা স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ আমার বিমূঢ়, বিস্মিত চোখের সামনে লীনা দাঁড়িয়ে ছিল ৷

 আরও কিছুক্ষণ বাদে লীনাকে আমি ঘরে এনে বসালাম ৷ ওকে দেখে আমার মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল, না বেদনায় নীল হয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না ৷ আমার সমস্ত অনুভূতি একবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল ৷ লীনার সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারলাম না ৷

 আমার পেছন-পেছন লীনাও ঘরে এসে ঢুকল ৷ প্রথমে একটু ইতস্তত করল ৷ তারপর আমার অনুমতি নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল ৷ যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না ৷ কেননা, এই অসময়ে কেউ কোনোদিন আমার কাছে আসে না ৷

 প্রথম কথা কে বলবে লীনা বোধহয় তাই ভাবছিল ৷ দু-একবার ঢোক গিলল ৷ মুখ ফুটে কী যেন বলতে গেল ৷ তারপরই মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ৷

 বিস্ময়ের প্রথম চমকটা কেটে যাওয়ার পর আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ৷ এই ক’বছরে বেশ খানিকটা ভারী হয়ে পড়েছে লীনা ৷ দু-চোখের তারায়-তারায় ঝকমকে হাসির ছটাও কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে ৷ মুখটা আরও বেশি স্থুল ৷ এরমধ্যে পুরোপুরিই বদলে গেছে লীনা! ওকে দেখতে এখন আমার ভীষণ বিশ্রী লাগল ৷ ওর এই কান্নাটাও যেন রং-মাখা অভিনেত্রীর ছলাকলা ৷ চোখের জলে মুখের প্রসাধন ধুয়ে গিয়ে ওকে আমার রীতিমতো অসহ্য লাগছিল ৷

 আমার তখন সময়ের কোনও হুঁশ ছিল না ৷ কতক্ষণ ও ফুলে-ফুলে কাঁদল তা-ও জানি না ৷ অবশেষে একসময় বর্ষণ-ক্লান্ত লীনা একটু-একটু করে থেমে-থেমে ওর নিজের কথা বলল ৷

 ওদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম ক’টা বছর নিরবচ্ছিন্ন সুখের মধ্যে দিয়েই কেটেছিল ৷ আদরে সোহাগে ওর স্বামী ওকে ভরিয়ে রেখেছিল ৷ কিন্তু চিরটাকাল কবে কার একভাবে কেটেছে! ওদের স্বপ্ন-রঙিন প্রেমের আকাশেও অবসাদের কালো মেঘ জমে উঠল ৷ ওর তরুণ স্বামী ডাক্তার অরুণাংশু নবাগতা এক নার্সের আকর্ষণে বৃন্তচ্যুত হয়ে পড়ল ৷ প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা সে গোপন রাখার চেষ্টা করত ৷ লীনাকে কিছু বুঝতে দিত না ৷ কিন্তু ক্রমশই তার সে-ভাব কেটে গেল ৷ অরুণাংশু এখন প্রকাশ্যেই সেই নার্সকে নিয়ে ঘোরাফেরা করে ৷ নাইট শো- তে চৌরঙ্গি পাড়ায় সিনেমা দেখতে যায় দুজনে ৷ অনেক রাতে আকণ্ঠ মদ গিলে টলতে-টলতে বাড়ি ফেরে ৷ লীনা মরে গেলেও কিছুতেই অমন একটা লম্পট লোকের ঘর করতে পারবে না ৷ ইতিমধ্যে এক উকিলকে দিয়ে কোর্টে ডিভোর্সের আবেদন জানাবার ব্যবস্থা করেছে ও ৷ তারপর অনেক খুঁজে আমার বর্তমান আস্তানার সন্ধান পেয়েছে ৷ ও এখন নতুন করে আবার আমায় ফিরে পেতে চায় ৷

 একটু-একটু করে থেমে-থেমে লীনা ওর নিজের কথা বলছিল ৷ ওর নিজস্ব যা কিছু অলঙ্কার সব এই সুটকেসের মধ্যে ভরে নিয়ে এসেছে ৷ এখন এটা আমার কাছে রেখে যাবে ৷ হপ্তাখানেক বাদে ও যখন অরুণাংশুকে সবকিছু জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে, তখন যদি এগুলো নিয়ে কোনো গন্ডগোল বাধে, সেইজন্যেই আগে থেকে এই সাবধানতা ৷

 লীনাকে দেখে, লীনার কথা শুনে, আমার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল ৷ ভাবলাম, এ কী উটকো ঝঞ্ঝাট হঠাৎ করে আমার ঘাড়ে এসে চাপল! আমার নির্জন শান্তির প্রাঙ্গণে এই স্থুল আপদটা তবে কি চিরকাল অনড় হয়ে বসে থাকবে! কিন্তু লীনাকে আমি ফেরাই কোন মুখে? বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে ও আজ আমার কাছে এসেছে ৷ বিপদে পড়ে ছুটে এসেছে লীনা৷ কোন মুখে আমি ওকে ফিরে যেতে বলব!

 ভাবতে-ভাবতে আমি খুব বিব্রত হয়ে পড়লাম ৷ প্রথম যৌবনে ভালোবাসার যে-পাখিটা বুকের মধ্যে মরে গেছে, হাজার বসন্তের ডাকেও সে আর কখনও সাড়া দেবে না ৷ একটা জটিল প্রশ্নের জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতো লীনা আজ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ৷ আমি এর সমাধান করব কোন পথে?

 লীনা আমার মনের অবস্থা ঠিকমতো অনুভব করতে পারেনি ৷ সেদিকে কোনো নজর-ই ছিল না ওর ৷ ছটফট করতে-করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি ৷ ভাবনা-চিন্তার গ্রন্থিগুলো সব যেন জট পাকিয়ে গেল মাথার মধ্যে ৷ অতিরিক্ত রক্তের চাপে ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল কান দুটো ৷ আর লীনা তখনও টেবিলে মুখ গুঁজে আমার উত্তরের অপেক্ষায় বসেছিল ৷

 আমি যখন ঘুরতে-ঘুরতে ওর চেয়ারের পেছনে এসে-দাঁড়ালাম, তখনও লীনা আমার দিকে চোখ তুলে চায়নি ৷ মাঝে-মাঝে শুধু বোবা কান্নার দমকে থরথর করে কেঁপে উঠছিল ওর সারা শরীরটা ৷ কিন্তু আমি আর সে-দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলাম না ৷ সবল পেশল দুটো হাত দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ওর গলাটা টিপে ধরলাম ৷

 না…না, আমি ওকে ফিরে যেতে বলব কেমন করে?

 লীনা প্রথমটা ধড়ফড় করে উঠল ৷ ব্যাপারটা কী ঘটতে চলেছে বোধহয় বুঝতে পারেনি ৷ তারপরই আমার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল জোর করে ৷ কিন্তু ওর সে-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল ৷ দাঁতে দাঁত চেপে দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে আমি ওর গলাটা টিপে ধরেছিলাম ৷ ধীরে-ধীরে লীনার মাথাটা নেতিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর ৷ আর আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগলাম দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ৷ আমার সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছিল দরদরিয়ে ৷

 লীনাকে খুন করার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার কোনো বোধশক্তি ছিল না ৷ একটা চেয়ারে গা এলিয়ে নেশাচ্ছন্নের মতো বসে রইলাম চুপচাপ ৷ তারপর ক্রমে-ক্রমে সংবিৎ ফিরে পেলাম ৷

 আমি যে কী করলাম আর কেনই-বা করলাম ভেবে ঠিক করতে পারলাম না ৷ যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে গেল মাথার মধ্যে ৷ তুহিন-শীতল ভয়ের একটা স্রোত ছড়িয়ে পড়ল দেহের শিরায়-শিরায় ৷ লীনার মৃতদেহটা সাক্ষাৎ যমদূতের মতো ঘাড় মটকে পড়ে আছে চোখের সামনে ৷ ওকে যতই দেখতে লাগলাম, ততই ভয়ে আড়ষ্ট হতে শুরু করল আমার সর্বাঙ্গ ৷ একবার ভাবলাম, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই ৷ কিন্তু কোথায় যাব? কোথায় গেলে এই বীভৎসতার হাত থেকে নিস্তার পাব? এই দুনিয়াটা যে বড়ই ছোট! তা ছাড়া, আমার মনে হল, আমি যেখানেই যাই না কেন, লীনা নিশ্চয়ই তাড়া করে ফিরবে আমার পেছন পেছন ৷ কোনো দিনই ও আমাকে মুক্তি দেবে না ৷

 মার খেতে খেতে মানুষ একসময় মরিয়া হয়ে ওঠে ৷ ভয়ের হাতে মার খেতে খেতে আমিও এবার মরিয়া হয়ে উঠলাম ৷ যেভাবেই হোক না কেন, আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতেই হবে ৷ দু-হাত দিয়ে ভয়কে প্রতিরোধ করে দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়ালাম, আর আশ্চর্যরকমভাবে আমার সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিগুলো ক্রমশই তীক্ষ্ণ আর সচেতন হয়ে উঠতে লাগল৷ একাগ্র চিত্তে আমি উদ্ধারের পথ খুঁজতে সচেষ্ট হলাম ৷ এত রাতে আমার আস্তানায় যে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই ৷ অতএব, এইটুকু অবসরের মধ্যেই আমার অপকর্মের সমস্ত চিহ্ন পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হবে ৷

 প্রথমে ভাবলাম, লীনার মৃতদেহটা কোথাও গিয়ে পুঁতে দিয়ে আসি ৷ কিন্তু পরে মনে হল, তাতে বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর ৷ শেয়াল-কুকুরের দৌরাত্ম্য তো আছেই ৷ ওরা কোনোভাবে একবার যদি টের পায়, তবে ঠিক টেনে-হিঁচড়ে সেটাকে মাটির তলা থেকে বের করে আনবে ৷ তা ছাড়া, লীনা বাড়ি ফিরে না গেলে ওর স্বামী অরুণাংশু নিশ্চয় পুলিশে খবর দেবে৷ আর পুলিশও লীনার খোঁজ করতে-করতে আমার পোলট্রি পর্যন্ত এসে হাজির হবে ৷ এ-পর্যন্ত তারা লীনার হদিশ করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস ৷ কিন্তু তারপর যে লীনা কোথায় হারিয়ে গেল তার কোনো খোঁজই তারা পাবে না ৷ ফলে ওদের সমস্ত সন্দেহটা এসে পড়বে আমার ওপর ৷ আমি যে লীনাকে খুন করতে পারি এ-কথাও তাদের মনে হবে ৷ আর, খুন করার পর লীনার দেহটা কাছাকাছি কোথাও পুঁতে ফেলাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক ৷ ওরা তখন সেটার সন্ধান করতে শুরু করবে ৷ তাই আমি ভুলেও এ-পথ মাড়াব না বলে ঠিক করলাম ৷

 তবে আমার মুক্তির উপায় কি হবে না? কোন কুক্ষণেই যে লীনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল! নিজের মৃত্যু দিয়েও লীনা আমায় এ কোন বিপদের অতল গহ্বরে ঠেলে দিল! মনে হল, লীনা যেন ছল করে টেবিলে মাথা গুঁজে নিষ্ঠুরভাবে হেসে চলেছে আমাকে ব্যঙ্গ করে ৷ আমার জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রাহুর মতো গ্রাস করে নেওয়ার জন্যেই বুঝি ওর সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে ৷ বারে-বারে ও এসে আমার সব সোনার স্বপ্নকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ৷ ভাবতে-ভাবতে আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠছিল ৷ এর প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে! আর, ঠিক সেই মুহূর্তে মেশিনটার কথা আমার মনে পড়ল ৷ মুরগিদের খেতে দেওয়ার জন্যে মাংস কিমা করার বিরাট মেশিনটা তো আমার নাগালের মধ্যেই রয়েছে ৷ সাতশো লেগহর্ন আর পাঁচশো রেড আইল্যান্ডের জন্যে মাসে দু-বার মাংসের ব্যবস্থা করতে হয় ৷ … পৈশাচিক আনন্দে আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠল ৷ বিপদের উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে আমার মনটা এতক্ষণে বুঝি কোনও নিরাপদ বন্দরের আশ্রয় পেল ৷ নিষ্ঠুর আগ্রহে লম্বা ধারালো ছুরিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে প্রস্তুত হলাম আমি ৷

 সুষ্ঠুভাবে সমস্ত কাজটা শেষ করতে ঘণ্টা তিন-চার সময় লাগল আমার ৷ একটা বড় ঝুড়ির মধ্যে দলা-পাকানো কিমা করা মাংসের তালগুলোকে জড়ো করলাম ৷ লীনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ওর দেহ থেকে বিছিন্ন করার সময় ঘরের মধ্যে চাপ-চাপ রক্ত জমাট বেঁধে উঠেছিল ৷ নিজের হাতে ধুয়ে-মুছে সাফ করলাম সবকিছু ৷

 এতখানি অমানুষিক পরিশ্রমের পর স্বভাবতই আমার হাত-পা ক্লান্তিতে অবশ হয়ে এল ৷ চোখের পাতা দুটোও অসহ্য ভারী-ভারী ঠেকল ৷ আপাতত আমার কর্তব্য শেষ ৷ বাকি কাজটুকু খুব ভোরে উঠে সেরে ফেলতে হবে ৷ ঘড়িতে পাঁচটার অ্যালার্ম দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ৷ সঙ্গে-সঙ্গে আমার দু-চোখ জুড়ে ঘুমের ঘোলা বন্যা নেমে এল ৷

 পাঁচটা বাজার মিনিট-দুয়েক আগেই আপনা থেকে আমার ঘুম ভেঙে গেল ৷ আমার অবচেতন মন থেকে কে যেন সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমায় জাগিয়ে দিল ৷ মুরগিগুলো দু-একটা করে তখন সবে ভোরের ডাক ডাকতে শুরু করেছে ৷ বারোশো মুরগিদের মধ্যে আমি এক বিরাট ভোজ লাগিয়ে দিলাম ৷ আশাতীত সৌভাগ্যে ওরা বেশ মশগুল হয়ে উঠল ৷ আধঘণ্টার মধ্যে লীনার দেহের শেষ চিহ্নটুকুও অবলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে ৷

 যাক!…এতক্ষণ পরে আবার আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম ৷ সবচেয়ে কঠিন সমস্যার নিখুঁত সমাধান আমি করতে পেরেছি ৷ দিনের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে আমার মন থেকেও বিপদের অন্ধকার কেটে যেতে শুরু করল ৷ ভোরবেলার তরুণ সূর্য নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল বুকের মধ্যে ৷ এখন আর আমার কোনো ভয় নেই ৷

 নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে এসে লীনার সুটকেসটা খুলে দেখতে লাগলাম ৷ একজোড়া নেকলেস, গন্ডাকতক ইয়াররিং, আংটি, চুড়ি এবং এই জাতীয় আরও অনেক অলঙ্কারে ছোট্ট সুটকেসটা পুরো ঠাসা ৷ কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকার জিনিস তো হবেই! কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, সেগুলোর ওপর বিন্দুমাত্র লোভও আমার হল না ৷ বরং লীনার জিনিস বলে কেমন এক ধরনের বিতৃষ্ণার ভাব জাগল মনের মধ্যে ৷ আর তা ছাড়া, পুলিশ যে লীনার খোঁজ করতে-করতে আমার আস্তানা পর্যন্ত এসে হাজির হবে সে-বিষয়ে আমি প্রায় একশো ভাগ নিশ্চিত ৷ তখন যদি গয়না-ভরতি এই সুটকেসটা তাদের হাতে তুলে দিতে পারি, তা হলে টাকার জন্যে আমি যে লীনাকে খুন করিনি এটুকু অন্তত তারা বুঝতে পারবে ৷ লীনাকে খুন করার পেছনে আমার আর কী মোটিভ থাকতে পারে তার কোনো হদিশই তারা খুঁজে বের করতে পারবে না ৷ পুলিশের সন্দেহের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এই একটা সুবর্ণ সুযোগ ৷ এ-সুযোগ আমি হেলায় হারাতে পারি না ৷ তাই সযত্নে লীনার সুটকেসটা আয়রন সেফের মধ্যে তুলে রাখলাম ৷

 এরপরের দিন থেকেই আমি মনে-মনে পুলিশের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম ৷ এই একটি মাত্র বিপদের ঘাঁটি এখন আমায় পার হয়ে যেতে হবে ৷ তারপর আবার আমি আগেকার নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবনে ফিরে যেতে পারব ৷ বুকের মধ্যে থেকে এই অস্বস্তির কাঁটাটা যত তাড়াতাড়ি দূর হয়ে যায় আমার পক্ষে ততই মঙ্গল ৷

 পুলিশ এসে আমায় যে-কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, আমিই বা তার কী জবাব দেব, সে-সম্পর্কেও নিজেকে ভালো করে তালিম দিয়ে রাখলাম ৷ অবশ্য, ওরা যে আমায় এত সহজে রেহাই দেবে না, তা আমি জানি ৷ একবার যখন ওদের সন্দেহ আমার ওপর এসে পড়বে, তখন জেরায়-জেরায় আমাকে আরও নাজেহাল করে ছাড়বে ৷ কথার মারপ্যাঁচে কখন যে কী করে বসব তার ঠিক কী? কিন্তু বুদ্ধির খেলায় আমায় জিততেই হবে ৷ দক্ষ দাবাড়ুর মতো আমার প্রতিটি চালই নির্ভুল হওয়া চাই ৷ এর ওপরই আমার জীবন-মরণ সর্বস্ব নির্ভর করছে ৷

 এই ঘটনার সতেরো দিন বাদে বরানগর থানার জাঁদরেল দারোগা প্রকাশ মিত্তির আমার সঙ্গে দেখা করতে এল ৷ খুব সমাদর করেই তাকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে এলাম ৷ ঘরে ঢুকে প্রকাশ মিত্তির প্রথমে মাথা থেকে টুপি খুলে টেবিলের ওপর রাখল ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল ৷ তারপর লীনা যে-চেয়ারে বসে ধরাধাম ত্যাগ করেছিল সেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল ৷ আমি তিনকড়িকে চা আর জলখাবারের কথা বলে দিয়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম ৷

 আপনি মিসেস লীনা বোসকে চেনেন? ডাক্তার অরুণাংশু বোসের স্ত্রী?

 আমি চেয়ারে বসতে-না-বসতেই প্রকাশ দারোগা তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আমায় জেরা শুরু করে দিল ৷

 কেন বলুন তো?— আমার গলায় যুগপৎ বিস্ময় ও উদ্বেগের সুর ৷ — দিন পনেরো আগে লীনা একবার আমার এখানে এসেছিল ৷ আর শুধু চেনেন বলছেন কী, লীনা তো একসময় আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল! আমরা দুজনে একই কলেজে পড়তাম ৷

 আপনার এখানে তাহলে তিনি প্রায়ই আসতেন, বলছেন?

 না…না, প্রায় আসতে যাবে কেন! বিয়ের পর লীনার সঙ্গে এই আমার প্রথম দেখা ৷

 তবে যে বললেন লীনা দেবী আপনার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু? তা হলে কি তিনি মাঝে-মধ্যে এখানে আসতেন না?

 এবারে আমার গলায় খানিকটা রাগের সুর ফুটিয়ে তুললাম ৷ বেশ ঝাঁজালো স্বরে বললাম, কলেজ-জীবনে আমাদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক ছিল বটে, কিন্তু সেই সূত্রে বিয়ের পরও লীনা আমার এখানে আসত এমন আজগুবি খবর আপনি জোটালেন কোত্থেকে? তা ছাড়া, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সে-সম্পর্কেও দেখছি আপনার জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে!

 আমার শেষের কথাটায় বুঝি একটু আঁতে ঘা লাগল প্রকাশ দারোগার ৷ এভাবে কথাটা বলা যে উচিত হয়নি সেটা তার মগজে ঢুকল ৷ তাই একটু নড়েচড়ে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে বলল, আহা…আপনি একটুতেই এত চটে উঠছেন কেন! দিনরাত চোর-ডাকাতের সঙ্গে কারবার করতে হয় কিনা, তাই আমাদের কথাবার্তার ধরন-ধারণও কিছুটা কাটখোট্টাগোছের হয়ে গেছে ৷ ওটাকে ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করবেন না ৷ এখন আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, হপ্তাদুয়েক হয়ে গেল লীনা দেবীর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না ৷ অনুসন্ধান করে আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে এখানে আসার জন্যেই তিনি শেষ বেরিয়েছিলেন ৷ কিন্তু তারপর থেকেই মিসেস বোসের আর কোনো হদিশ নেই ৷ তিনি এখানে আদৌ এসেছিলেন কি না, যদি এসে থাকেন তবে তারপরই-বা কোথায় গেলেন, এটাই হচ্ছে আমাদের আসল জানার বিষয় ৷

 এমন সময় চা-জলখাবার হাতে নিয়ে তিনকড়ি ভেতরে ঢুকল ৷ চায়ের সঙ্গে ডবল ডিমের ওমলেট চিবোতে-চিবোতে প্রকাশ মিত্তির আমার কথা শুনতে লাগল ৷

 আগাগোড়া সমস্ত ইতিবৃত্তই তাকে খুলে বললাম ৷ লীনার সঙ্গে আমার আগেকার সম্পর্ক, তার বর্তমান দাম্পত্য জীবনের কথা, কেনই-বা সেদিন সন্ধেবেলা লীনা আমার কাছে এসেছিল ৷ সবকিছুই চোখ বুজে শুনে গেল দারোগাসাহেব ৷ অবশেষে লীনার গয়না-ভরতি সুটকেসটাও এনে দেখালাম ৷ বললাম, হপ্তাখানেক বাদে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লীনা সেদিন আমার কাছ থেকে বিদায় নিল ৷ আমি ওকে অবশ্য অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম ৷ অরুণাংশুর সঙ্গে গন্ডগোলটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্যেও বারবার অনুরোধ জানিয়েছি ৷ কিন্তু লীনা বরাবরই ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের ৷ আমার কোনো কথাই কানে তুলতে চাইল না ৷ বরং উলটে আমাকেই ভয় পাইয়ে দিল ৷ অভিমানের সুরে বলল, তুমি যদি আমায় আশ্রয় না দিতে চাও তবে আমাকে সুইসাইডই করতে হবে— এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই ৷ ওর কথা শুনে মনে-মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম ৷ তাই বাধ্য হয়ে শেষমেশ লীনার প্রস্তাবেই রাজি হতে হল আমাকে ৷ ভাবলাম, আপাতত এটা না-হয় আমার কাছেই থাকুক ৷ পরে ওর মতিগতি বদলে যেতে পারে ৷ তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে গয়নার বাক্সটা ফেরত দিলেই হবে ৷ কিন্তু এই ক’দিনের মধ্যে ওর আর কোনো সংবাদ-ই পাইনি ৷ আমার ধারণা ছিল, ওদের দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো মিটমাট হয়ে গেছে ৷ হাজার হোক, অরুণাংশু ওর স্বামী ৷ তাই লীনা হয়তো লজ্জায় আমার কাছে আসতে পারছে না ৷ কিছুদিন বাদে অন্য কাউকে আমার কাছে পাঠিয়ে সুটকেসটা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে ৷ এই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলাম আমি ৷— তারপর প্রকাশ দারোগাকে লক্ষ করে চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ভাব ফুটিয়ে বললাম, কিন্তু এখন তো মশাই, আপনি আমাকে বেশ ফ্যাসাদে ফেললেন দেখছি! লীনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ তার গয়না-ভরতি সুটকেসটা পড়ে রইল আমার কাছে! এটা নিয়ে আমি এখন কী করি?

 আমার কথাবার্তার ধরনে প্রকাশ মিত্তির একটু ঝিমিয়ে পড়ল ৷ এখান থেকে অনেক কিছু খোঁজখবর পাবে বলে ছুটে এসেছিল, কিন্তু যে-তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল ৷ তবু অমায়িক হেসে বলল, মিথ্যেই আপনি ভয় পেয়ে নার্ভাস বোধ করছেন ৷ আপনার আর ফ্যাসাদের কী আছে? শুধু একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে একবার আপনাকে থানায় যেতে হবে ৷ এই সুটকেসটা সেখানে আমরা জমা করে দেব ৷ এর মধ্যে কী-কী আছে তার একটা লিস্ট করা দরকার ৷ তারপর আপনার ছুটি ৷

 আমি ভয়ের সুরে বললাম, কী জানি মশাই, কোত্থেকে কী হয়ে যায়! কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা ৷ আপনারাও তো বাঘের চেয়ে কিছু কম যান না ৷

 আমার কথার ধরনে প্রকাশ দারোগা হো হো করে হেসে উঠল ৷ তারপর তার বাইকে চেপেই থানায় হাজির হলাম৷ তিনকড়িকে দিয়ে এককুড়ি ডিমও তুলে দিলাম তার ক্যারিয়ারে ৷ দারোগাসাহেব খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, আপনাদের মতো ইয়াং ছেলেদেরই তো এখন দরকার আমাদের দেশে ৷ কী গভীর অধ্যবসায়েই না তিল-তিল করে গড়ে তুলেছেন এই পোলট্রিটাকে! অথচ আজকালকার সব ছেলে-ছোকরাদের দেখুন…রকে বসে গুলতানি করছে, আর মাঝে-মধ্যে এর-ওর কাছ থেকে চাকরির জন্যে দরখাস্ত লিখিয়ে আনছে ৷ নিজের থেকে একটা কিছু করার আগ্রহ একবারেই নেই ৷

 আমি তার কথায় বাধা দিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, এ আর কী দেখছেন! কোনোরকমে এটাকে দাঁড় করিয়েছি মাত্র ৷

 থানা থেকে কাজ শেষ করে যখন বাইরে বেরুলাম তখন আমার প্রাণ মুক্তির আনন্দে ভরপুর ৷ বিপদের কালো পাথরটা এতদিন ধরে বুকের ওপর চেপে বসেছিল ৷ আজ সেটা নেমে যেতে মনটা হালকা হল ৷ জলভারহীন মেঘের মতো স্ফূর্তির হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে পোলট্রিতে ফিরে এলাম ৷ এখন ওরা অনন্তকাল ধরে লীনার খোঁজ করুক ৷

 খুন করাটা যে এত সহজ এ-কথা আগে কখনও ভেবে দেখিনি ৷ সত্যি বলতে কী, খুন করার পর লোকগুলো কী করে ধরা পড়ে সেটাই এখন আমার কাছে খুব আশ্চর্যের মনে হল ৷ আর এইসব মোটা মাথাওয়ালা প্রকাশ মিত্তিররাই তো তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পোরে!

 এর পরও প্রকাশ দারোগা আমার ডেরায় বারদুয়েক এসেছিল ৷ ঘুরে-ঘুরে সমস্ত পোলট্রি দেখল ৷ আমার সব কাজ-কারবারও লক্ষ করল খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ৷ অবশেষে একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে বিরস বদনে বিদায় নিল ৷

.

 এই ঘটনার মাসদুয়েক বাদে আমি তিনকড়িকে খুন করলাম ৷ তিনকড়ির সেবায় মুরগিগুলো বেশ ভালোই ছিল ৷ তিনকড়িকে সেবা করে তারা আরও পুলকিত হল ৷ ঘাড় ফুলিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করল না ৷ পরের দিন সকালে আমি নিজে থানায় গিয়ে তিনকড়ির নামে একটা ডায়েরি করে এলাম ৷ বললাম, গতকাল রাতে তিনকড়ি আমার আলমারি থেকে হাজার-দুয়েক টাকা নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেছে ৷ ডায়েরি লিখতে-লিখতে গম্ভীর গলায় প্রকাশ মিত্তির আমায় উপদেশ দিল : এখনকার দিনে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই, মশাই! কার মনে কোন মতলব খেলা করছে আগে থেকে তার কোনো আঁচ পাওয়া যায় না ৷ এবার তো শুধু দু-হাজার টাকার ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে গেছে ৷ ও যে আপনাকে খুন করে যথাসর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে যায়নি এর জন্যে মঙ্গলময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন ৷

 আমি বিনীত হাসি হেসে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম ৷ প্রকাশ দারোগাকে দেখে আজ আমার খুব মজা লাগছিল ৷

 গত দেড় বছরে আরও তিনটে খুন করেছি আমি ৷ তবে শেষের খুনটা আমার মনটাকে একেবারে বিষিয়ে দিয়েছে৷ অনেক খুঁজে-পেতে বিশুকে জোগাড় করেছিলাম ৷ শ্যামবাজারের এক রেস্তোরাঁয় বয়-এর কাজ করত ৷ বছর চোদ্দো বয়েস৷ খুব চটপটে, শরীর-স্বাস্থ্যও খুব ভালো ৷ মুখে সবসময় একটা হাসি-হাসি ভাব ৷ বেশি মাইনে কবুল করায় আমার পোলট্রিতে কাজ করতে রাজি হল ৷ দেশে তার বুড়ো বাপ-মা আছে ৷ মাসে-মাসে মানি-অর্ডার করে টাকা পাঠায় তাদের নামে ৷ মাসদুয়েক কোনো খোঁজখবর না পেয়ে একদিন বুড়ো-বুড়ি দুজনেই সশরীরে হাজির হল আমার ফার্মে ৷ কিন্তু আমি তো কোন ছার, আমার মুরগিগুলোও হয়তো এতদিনে বিশুর কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে ৷ তাদের বললাম, অনেকদিন হল বিশু আমার এখান থেকে কাজ ছেড়ে চলে গেছে ৷ তার হিসেব-পত্তরও সব কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দিয়েছি সঙ্গে-সঙ্গে ৷

 আমার কথা শুনে বুড়ি মা-টা তো ভেউভেউ করে কান্না জুড়ে দিল ৷— তবে আমাদের বিশু কোথায় গেল…বাবু? সে কি বুড়ো-বুড়িকে কোনও খবর না দিয়েই পালিয়ে গেল?

 তার এই নাকি কান্না আমার ভীষণ অসহ্য লাগল ৷ কড়া ধমক দিয়ে দুজনকেই গেটের বাইরে বের করে দিলাম ৷ কাঁদতে-কাঁদতে ফিরে গেল তারা ৷ কিন্তু এরপর থেকেই আমার মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেছে ৷ ভাবছি, এবার থেকে খুন করার অভ্যেসটা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করব ৷ বড্ড বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় ৷ আগে থেকে হিসেব করে আটঘাট বেঁধে কাজে নামা, কোথাও একচুল ভুলচুক হওয়ার উপায় নেই— তাহলেই একবারে আকাশ ভেঙে পড়বে মাথার ওপর ৷ আর সত্যি বলতে কী, এতে আমার লাভও তেমন কিছু নেই ৷ মাঝে-মধ্যে মুরগিদের পেছনে মাংসের খরচাটা বেঁচে যায় এইমাত্র! তার জন্যে মানুষ খুন করা খাটুনিতে পোষায় না ৷ তবে প্রকাশ মিত্তিরকে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায় ৷ ওকে বাগে পেলে আমি ছাড়ব না ৷ ওই গোবরগণেশ লোকটা মাসে-মাসে গভর্নমেন্টের এতগুলো করে টাকা গিলছে এটাই বা সহ্য করা যায় কেমন করে! একদিন ফাঁক বুঝে দারোগাসাহেবকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে আসতে হবে ৷ মুরগির বিরিয়ানি আর ঝাল-ঝাল কষা মাংসের লোভ দেখালে নিশ্চয়ই না এসে থাকতে পারবে না ৷ তবে সেটা লোকচক্ষুর অগোচরে হওয়া প্রয়োজন ৷ কেউ যেন তার আগমন-বার্তা ঘুণাক্ষরেও টের না পায় ৷ পুলিশের লোক বলে কথা! কোথা থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না ৷ তার জন্যে স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে ৷ তা ছাড়া, দারোগাসাহেব যদি আবার নিজের বাইকে চেপে আসে তবে তো আর-এক ফ্যাসাদ ৷ বাইকটার একটা সদগতির ব্যবস্থা আগে থেকে ভেবে রাখতে হবে ৷ কেননা, সেটা তো আর জোর করে মুরগিদের গিলিয়ে দেওয়া যাবে না ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *