দশ
পরদিন ভোরেই আইরিসের বাড়ি ছাড়ল টেড। মেয়েটার সেবায় ওর বাম হাতের ব্যথা পুরো সেরে গেছে। ডান হাতের ব্যথা প্রায় সারলেও আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে। শক্ত হাতে পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে দেখেছে, খুব ব্যথা লাগে।
ডেভের ব্যাপারটা আপাতত স্থগিত রাখা সে মেনে নিয়েছে। পরে ফিরে এসে ওর ব্যবস্থা করবে। এখন কোমাঞ্চি ওয়েলসে পৌঁছে রেক্স বিলিঙের মোকাবিলাই হবে ওর প্রথম কাজ।
জেল হাউসে ঢুকে নিজের জিনিসপত্র স্যাডলব্যাগে গুছিয়ে ঢোকাল। বাড়তি পিস্তলটাও রাখল ব্যাগে। তার পুরোনো রাইফেলটাও সাথে নিল। তারপর জেলঘরের পিছনে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপল।
ভোরের আলো ফুটেছে। শহর ছাড়ার আগে আস্তাবলের মালিক ট্যানারের সাদে টেডের দেখা করতে হবে। ঘোড়ার যত্ন নেয়ার জন্যে লোকটা ওর কাছে বায়েকটা ডলার পাবে। যদিও শিপরকে আবার ফিরে আসার সঙ্কল্প নিয়েছে সে, তবু শহর ছাড়ার আগে দেনাটা শোধ করে যাওয়াই উচিত।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগোতে যাচ্ছে এইসময়ে বেশ্যাবাড়িগুলোর পিছন দিক থেকে চারজন লোককে গলিতে নামতে দেখল। ডেভ, চার্লস আর রেডকে সে চিন-চতুর্থজন ওর অচেনা। হাসাহাসি করে গল্প করছে ওরা।
টেডের ভিতর রাগটা ফুঁসে উঠছে। মার্শালের হাতের আঙুল চিরদিনের মত থেঁতলে দিয়েছে মনে করে এখন ওদের সাহস বেড়ে গেছে। ডেভের ভুল ভাঙবে।
এখনই ওকে শাস্তি দিতে পারলে সে খুব শান্তি পেত। কিন্তু এই মুহূর্তে জখম হাতে সে পিস্তল ধরতে পারবে না। হাতটা ভাল হলেই সামনা সামনি টেড ওর মোকাবিলা করবে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে লিভারি আস্তাবলের দিকে রওনা হলো মার্শ।
আস্তাবলে পৌঁছে জানল জেরি তখনও আসেনি-ঘণ্টাখানেক পরে পৌঁছবে | আস্তাবলরক্ষীর হাতে টাকাটা দিয়ে বলল তার কিছুদিন দেরি হতে পারে, কিন্তু ও আবার ফিরবে।
পথ চলতে-চলতে সে ভাবছে কোমাঞ্চি ওয়েলসের কাজটা সেরে বেভিন মিলারের থেকে টাকাটা সংগ্রহ করে সিলভার সিটিতে সেসিলার ওখানে যাবে। কি ঘটেছে, আর কেন ঘটেছে, সব ওকে জানানো দরকার। পশ্চিমে এই ধরনের খবর খুব দ্রুত ছড়ায়। সেসিলা কাউন্সিলের লোকজনের দিকটাই শুনবে। কিন্তু ওকে সে নিজের দিকটাও শোনাতে চায়।
সহজ গতিতে এগোচ্ছে টেড। কোমাঞ্চি ওয়েলস তিনদিনের পথ। ওখানে আরও আগে পৌঁছে কোন লাভ নেই। আইরিস বলেছে ওর হাত সারতে সময়া নেবে। আসার আগে ওষুধে ভিজিয়ে কাপড়ের ফালি দিয়ে ওর হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছে মেয়েটা। তাছাড়া…
জোরে লাগাম টানায় টেডের ঘোড়া পিছনের দুপায়ে উঠে থেমে দাঁড়ালা। ঘোড়ার পিঠে তিনজন লোক পিস্তল হাতে ওকে কাভার করে আছে। একটা বড় মেসকিট ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা।
‘ঠিক আছে, মার্শাল-চুপচাপ বসে মাথার ওপর হাত তোলো!’
নির্দেশ মত ধীরে হাত তুলল টেড। চোখ সরু করে বক্তাকে লক্ষ করছে সে। লোকটাকে চেনা-চেনা ঠেকল। কঠিন নির্দয় চেহারা। সম্ভবত বেইটসদের একজন।
‘আমরা বেইটস,’ ওর ধারণা সমর্থন করতেই যেন বলল আরোহী। ‘তোমাকে ধরে আনার জন্যে আমরা শহরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথেই তোমার দেখা পেয়ে আমাদের অনেক ঝামেলা বেঁচে গেল।’
এগারো
আড়ষ্ট হলো মার্শ। একটা ঠাণ্ডা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নামল। সামনে কঠিন বিপদ। বোনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই ওরা এসেছে। একজনের বিরুদ্ধে তিনজন। ওদিকে তার হাতেরও জখম অবস্থা। ওদের চেনার কোন লক্ষণ চেহারায় প্রকাশ করল না টেড।
‘বুঝলাম তোমরা বেইটস,’ শান্ত স্বরে বলল সে। ‘কিন্তু তাতে আমার কি?’
‘তোমার মরণ! পাজি খট্টাশ! তুমিই আমার বোন লানা আর তার স্বামীকে খুন করেছ। ওদের তুমি গুলি করে মেরেছ। অস্বীকার করতে চাও, মার্শাল?’
‘না,’ জবাব দিল সে। ‘আমিই ওদের মেরেছি, এটা ঠিক। কিন্তু ও তার স্বামীকে ডাকাতিতে সাহায্য করে স্টোরের মালিককে জখম করেছে। তারপর ধরা না দিয়ে গুলি ছুঁড়ে আমাকে মেরে পালাতে চেষ্টা করেছিল।
‘মিথ্যে কথা! লানা…সে কখনও এমন বোকার মত একটা কাজ করতে পারে না!’ সবথেকে বড়ভাই বলল। ‘ওর হতচ্ছাড়া স্বামীই ওকে ওসব করতে বাধ্য করেছে। এটা লানার কাজ হতেই পারে না। অসম্ভব!’
‘সে ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিল, এতে সন্দেহ নেই। ওর হাতে পিস্তলাও
ছিল, এবং দোকানের মালিক রজার্সকে সেও পিটিয়েছে।’
‘ওসব কৈফিয়তে এখন আর কোন কাজ হবে না,’ ছোটভাই বলল। ‘তুমি আমার বোনকে হত্যা করেছ, এখন আমাদের হাত থেকে তোমার রেহাই নেই। এটাই পশ্চিমের রীতি।’
‘তোমাদের কার নাম কি?’
একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে আমাদের নাম জেনে তোমার কোন লাভ হবে না। তবু তোমার কৌতূহল মেটাবার জন্যে জানাচ্ছি, আমার নাম ক্লোভিস। ও আমার ভাই ডৌবি,’ ভারি গড়নের একজনকে দেখিয়ে বলল সে। ‘আর ওই তরুণ ছেলেটা পল। ডোবি, ওর গানবেল্ট আর পিস্তলটা কেড়ে নাও, রাইফেলটাও নিতে ভুলো না। তাড়াতাড়ি করো, মা আমাদের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে।’
‘না,’ ঠাণ্ডা স্বরে বলল মার্শ। ‘আমি তোমাদের সাথে কোথাও যাব না। তোমার বোনের ব্যাপারে আমি দুঃখিত, কিন্তু একজন আউটলর সাথে কাজে নেমে ভুলটা সে-ই করেছে।’
‘তুমি না চাইলে তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাব,’ তরুণ ছেলেটা রেগে উঠল। ‘ঘোড়ার পিছনে বেঁধে তোমাকে হিঁচড়ে টেনে নিতে হলেও দ্বিধা করব ना।
‘আমার ভাই ঠিকই বলেছে,’ বলল ক্লোভিস, ‘তোমার মিছে আপত্তি তোলার কোন মানে নেই, মার্শাল। শুনলাম হত্যার জন্যে তুমি নাকি চাকরি হারিয়েছ? সত্যি?’
নীরবে মাথা ঝাঁকাল টেড। কথা বলে লাভ নেই-ওরা বুঝবে না।
‘এতেই প্রমাণ হয় ওদের খুন করা তোমার উচিত হয়নি,’ মন্তব্য করল ক্লোভিস। ‘তাহলে লোকে যা বলে সেটাই ঠিক-তুমি একজন খুনে মার্শাল।’
‘মোটেই ঠিক নয়। আমি কেবল মার্শাল হিসেবে আমার কর্তব্য পালন করেছি।’
‘বাজে কথা রাখো, কর্তব্য করলে তোমাকে বরখাস্ত করা হত না,’ বলে, ডোবির দিকে চেয়ে সে ধমকে উঠল, ‘তুমি কি ওর গাগুলো নেবে, নাকি দাঁড়িয়েই থাকবে?’
ক্লোভিস পিস্তল ধরে থাকায় মাথার উপর হাত তুলেই বসে আছে টেড। ডোবি আর পল ঘোড়ার পিঠেই ওর পাশে হাজির হলো। একজন খাপ থেকে রাইফেলটা তুলে নিল। অন্যজন পিস্তলসহ গানবেল্টটা খুলে ফেলল। মার্শ টের গেল একটা দড়ির ফাঁস ওর দিকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মুহূর্তে ফাঁসটা এড়াতে ডানপাশে সরে ডোবির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। আঁকড়ে ধরে ওকে নিয়েই মাটিতে পড়ল। দুজনের হাত দুজনকে শক্তভাবে ধরে আছে।
টেড মার্শ ডান হাতটাকে রক্ষা করে মাটিতে শুয়েই হাঁটু দিয়ে ডোবির তলপেটে মারল। ব্যথায় কুঁকড়ে বেইটসের মুঠো আলগা হলো। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টেড। বাম হাতে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল ওর চোয়াল লক্ষ্য করে।
অজ্ঞাতেই টেডের মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এল। বাম হাতে ব্যথা পেয়েছে। ডান হাতে ঘুসি মারার জন্যে তৈরি হলো ও। জখমের কথা ভুলে গেছে। মেরেই ব্যথায় ককিয়ে উঠল। হাতটা টনটন করছে। মারটা বৃথা যায়নি ধরাশায়ী হয়েছে ডোবি।
উঠে দাঁড়াল ডোবি। চার্জ করে ছুটে আসছে।
টেড শুনতে পেল, ‘যাও, ভাইকে সাহায্য করো,’ ছোটভাইকে আদেশ দিল ক্লোভিস।
ডোবির চার্জ পুরোপুরি এড়াতে পারল না টেড। ধাক্কায় আধপাক ঘুরে হাঁটুর ওপর পড়ল সে। পরক্ষণেই ওর মাথার পিছনে পিস্তলের আঘাত হানল পল।
‘ওঠাও! ওকে তুলে দাঁড় করাও!’ ক্রুদ্ধস্বরে বলল ডোবি। ‘ওই পাজি খট্টাশটার কাছে আমার দেনাটা শোধ করব!’
আচ্ছন্ন অবস্থাতেই টেড টের পেল হাত মুচড়ে পিঠে ঠেকিয়ে ওকে টেনে দাঁড় করানো হচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখল ডোবির ঠোঁট উল্টে হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড ঘুসিটা ওর চোয়ালে এসে লাগল। আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে হাঁটুর ওপর পড়ল সে।
অজ্ঞান টেডকে আবার তুলে দাঁড় করাচ্ছিল পল। ‘ওকে ছেড়ে দাও!’ কঠিন স্বরে আদেশ করল ক্লোভিস। ‘যথেষ্ট হয়েছে। ওকে জ্যান্তই মায়ের কাছে হাজির করতে হবে।’
ছেড়ে দেয়ায় টেডের অজ্ঞান দেহ ঝপ কোরে মাটিতে পড়ল। ‘দড়ির ফাঁসটা আবার লাগাও,’ বলল ক্লোভিস। ‘আর হাত দুটোও বেঁধে ফেলো। ওর থেকে আর কোন ঝামেলা আমি চাই না।’
তাই করা হলো।
‘ওকে ঘোড়ার পিঠে বসাও।’
ডোবি আর পল টেডকে ঘোড়ার পিঠে বসাল। পাদানিতে ওর পা দুটো ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়ার পর পল বলল, ‘আমার মনে হয় না ও ঘোড়ার পিঠে টিকতে পারবে। প্রায় অজ্ঞান অবস্থা ওর।’
‘মিছে ভাবছ,’ নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিল ক্লোভিস। ‘যদি পড়ে যায় ওকে আমরা হাঁটিয়ে বা ছেঁচড়ে র্যাঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যাব।’
‘ডোবি আর আমি ওর দুপাশে রাইড করলে ও পড়বে না।’
ধুলোয় থুতু ফেলল ক্লোভিস। ‘তার কোন দরকার নেই। ওরটা ওকেই বুঝতে দাও। ডোবিকে আমি অন্য একটা কাজে পাঠাতে চাই।’
‘আমাকে অর্ডার করার অধিকার তোমাকে কে দিল?’ প্রশ্ন করল ডোবি। ‘আমি সবার বড়-সেটাই যথেষ্ট,’ জবাব দিল ক্লোভিস। ‘তুমি শিপরকের আণ্ডারটেকারের কাছ থেকে লানার লাশটা আনতে যাবে।’
‘খরচ কত পড়বে?’
‘কিছুই না। আমরা ওদের সৎকার করার ব্যবস্থা করতে বলিনি। বলবে বেইটসরাই ওর কবর দেবে।’
‘কাজ হবে?’
‘না হলে ওকে বোলো আমি নিজে বোঝাপড়া করতে আসব। তাতেই কাজ হবে।’
বোনের লাশ আনার দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়েছে ডোবি। ‘লাশটা কিভাবে আনব? জিনের ওপর ওকে শুইয়ে র্যাঞ্চে ফেরাটা ভাল দেখায় না।’
‘তা করবে কেন? জেরি ট্যানারের কাছে একটা ওয়্যাগন চাইলে ___ দেবে সে।’
ডোবির চেহারা মুহূর্তের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে আবার নিষ্প্রভ হলো।
‘আবার কি ভাবছ?’ প্রশ্ন করল ক্লোভিস।
‘ডেভ স্কটের লাশটার কি হবে? ওটাও র্যাঞ্চে নিয়ে আসব?’
‘কোন দরকার নেই। ওই পাজি বেজন্মাকে শহরের লোকরাই দাফন করুক। ওর লাশ র্যাঞ্চে নিয়ে এলে মা ওর সাথে তোমাকেও শুয়োর দিয়ে খাওয়াবে!’
কাজ বুঝে নিয়ে শিল্পরকের দিকে রওনা হলো ডোবি।
বারো
ঘোরের মধ্যেও বেইটসদের কথাবার্তা টেডের কানে পৌঁছেচে। ওকে নিয়ে র্যাঞ্চের পথ ধরল দুই ভাই। ক্লোভিস লীড করছে। মার্শের পাশাপাশি চলছে পল। ধীরে মার্শালের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। এখন ওর মাথাটা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারছে-কঠিন বিপদে পড়েছে ও। বেইটসরা তাকে খুন করে বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু বর্তমানে বাঁধা অবস্থায় তার কিছু করার উপায় নেই।
একটাই সান্ত্বনা, সে এখনও বেঁচে আছে। এবং তাকে হত্যা করাটা যে সহজ কাজ হবে না, বেইটস গোষ্ঠী তা হাড়েহাড়ে টের পাবে।
মার্শের ডান হাতটা টনটন করছে। বিবেচনা না করে ডোবির চোয়ালে ঘুসি মারার পর থেকেই ওই অবস্থা। হাত দুটো একসাথে শক্ত করে বাঁধায় ব্যথাটা আরও জোরাল হয়েছে। কিন্তু কিছুই বলল না সে জানে, বলেও লাভ হবে না- কোন সহানুভূতি সে পাবে না। তাই নীরবেই ওদের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড়গুলোর দিকে এগিয়ে চলল।
বেইটসরাও পথে নিজেদের মধ্যে বিশেষ কথা বলেনি। শেষ পর্যন্ত আবর্জনায় ভরা র্যাঞ্চের উঠানে এসে ওরা থামল। জীর্ণ চৌকো বাড়িটা ঠিক র্যাঞ্চহাউসের পর্যায়ে পড়ে না। রে। বাঁকা দরজাটা চামড়ার তৈরি কজার ওপর ঝুলছে। দরজা বাইরের দিকে খোলে দেখে বোঝা যায় ওটা আগে একটা ছাপরার গুদাম গোছের কিছু ছিল, পরে ওটাকে বাসের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। জানালা মাত্র একটাই। ওটার অর্ধেকটা কাঁচ ভাঙা। পাতলা একটা চামড়া দিয়ে গর্তটা বন্ধ করা হয়েছে।
শুয়োর আর মুরগিগুলো স্বাধীনভাবে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওপাশে পাহাড়ের পাথর খুঁড়ে তৈরি গুদামের সামনে একটা গরু জাবর কাটছে। পুরো র্যাঞ্চটার চেহারা বেইটসদের মতই রুক্ষ আর অমার্জিত।
‘এই যে এক্স-মার্শাল, নিচে নামো!’ ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এগিয়ে এসে আদেশ করল ক্লোভিস।
ডান পা ঘুরিয়ে এনে লাথি দিয়ে পাদানি থেকে বাম পা ছাড়িয়ে নিচে নামল টেড।
‘ওই যে, মা আসছে,’ ঘোষণা করল পল।
ঘুরে তাকিয়ে টেড দেখল বাড়ির ভিতর থেকে নোঙরা একজন স্ত্রীলোক বেরিয়ে এসেছে। পরনে ময়লা কালো শার্ট, আর রঙ জ্বলা স্কার্ট। মাথার পাকা চুল কয়েক গোছা দড়ির মত মাথার দুপাশ দিয়ে ঝুলছে। পাতলা গড়নের মুখে ছোট ছোট চোখ দুটো তার ছেলেদের মতই নিষ্ঠুর।
‘তোমরা দেখছি ঠিকই ওকে ধরে এনেছ!’ পৈশাচিক উল্লাসে কথাটা বলে স্কার্টে হাত মুছল সে।
‘তুমি কি ভেবেছিলে আমরা পারব না?’ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল ক্লোভিস।
টেডের ওপর থেকে বরফ-শীতল চোখ না সরিয়েই মহিলা বলল, ‘আমি জানতাম তোমরা পারবে, কিন্তু এত জলদি পারবে ভাবিনি।’
‘শিপরক থেকে পাত্তাড়ি গুটিয়ে টেক্সাসে যাচ্ছিল ও,’ বলে উঠল পল। ‘আমরা…’
‘তুমি থামো, আমি বলছি,’ রূঢ়ভাবে ধমকে ছোটভাইকে থামিয়ে দিল ক্লোভিস। ‘আমরা ওকে শহর থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে যাবার ট্রেইলে ধরেছি, মা। মার্শালের পদ থেকে ওকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেই ব্যাটা টেক্সাসের পথ ধরেছিল।
ধীরে মাথা ঝাঁকাল মহিলা। ঘৃণার চোখে টেডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মাথাটা একটু পিছিয়ে নিয়ে মার্শালের মুখে থুতু ছিটাল সে।
রাগে জ্বলে উঠল টেড। বাঁধা হাত দুটো মুঠি পাকিয়ে পাজি স্ত্রীলোকটার দিকে এগিয়েছিল, কিন্তু ক্লোভিস ওর দড়ির ফাঁসটা টেনে ধরায় থামতে বাধ্য হলো।
‘হ্যাঁ, আমি এখন কিছুটা ভাল বোধ করছি,’ বলে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছল মহিলা।
নিরুপায় টেড কাঁধ উঁচিয়ে শার্টের হাতায় মুখ মুছল।
‘মার্শাল!’ বিষ ঝরিয়ে বলল প্রৌঢ়া, ‘আমার লানাকে হত্যা করার শোধ আমি তুলব। তুমি একটা পাজি বেজন্মা খুনে ছাড়া আর কিছুই নও। শুনছ, এক্স-মার্শাল? তুমি একটা খুনে মার্শাল!’ প্রচণ্ড রাগে তার কণ্ঠ শেষ দিকে খুব চড়া শোনাল।
‘আমি খুনী নই!’ প্রতিবাদ করল টেড। ‘আমি আত্মরক্ষার জন্যেই হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি। আইন রক্ষার খাতিরে যে কোন মার্শালই তাই করত!’
রোষের সাথে মাটিতে থুতু ফেলল মহিলা। ‘হ্যাঁ, খুন করে এখন সাফাই গাওয়া হচ্ছে! অন্যায় না করলে ওরা তোমাকে বরখাস্ত কেন করল?’
মহিলার সাথে যুক্তিতর্কে গিয়ে লাভ নেই জেনেই চুপ করে রইল টেড।
‘তুমি লানার লাশ আনতে শহরে যাচ্ছ, ক্লোভিস?’
‘না, মা। ডোবিকে পাঠিয়েছি। কিন্তু ওকে স্কটের লাশ আনতে মানা করেছি আমি।’
‘ঠিক করেছ। এই র্যাঞ্চের সীমানার মধ্যে ওই শয়তানটার লাশও আমি ঢুকতে দেব না।’
‘ওকে নিয়ে এখন কি করতে বলো, মা?’ টেডকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল ক্লোভিস।
‘বার্নে নিয়ে আটকে রাখো। ওকে যে এখানে আনা হয়েছে তা কেউ জানে না। তাই ওকে খুঁজতে কেউ আসবে না। লানাকে কবর দেয়ার পর ওর ব্যবস্থা করব। ওকে এমন জায়গায় পুঁতে রাখব যে কেউ খুঁজে পাবে না। ‘
টেড জানে, সত্যিই ওকে খুঁজতে আসার মত মানুষ কেউ নেই। যা করার তার নিজেকেই করতে হবে। ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় তাকেই ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বের করতে হবে।
ওকে ঠেলতে ঠেলতে বার্নের দরজার সামনে এনে পল দরজা খুলল।
‘ভেতরে ঢোকো!’ আদেশ করল ক্লোভিস।
বিনা প্রতিবাদে ভিতরে প্রবেশ করল টেড। ভিতরটা অন্ধকার।
‘ওকে খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলব?’ প্রশ্ন করল পল।
‘দরকার নেই,’ জবাব দিল ক্লোভিস। ‘এখান থেকে ও বেরোতে পারবে না। কিন্তু তবু সাবধান থাকা ভাল- ওর বাঁধন খুলে পিছমোড়া করে বাঁধো।’
নির্দেশ পালন করল পল। ক্লোভিস নিজে চামড়ার ফিতের বাঁধন পরীক্ষা কোরে সন্তুষ্ট হলো।
‘এখন আর ওকে বেরোতে হবে না,’ বলল সে। ‘আর বেরোতে পারলেও বাঁধা অবস্থায় ঘোড়ার পিঠে উঠতে পারবে না।’
দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে খিল আটকে চলে গেল ওরা। দরজা বন্ধ করায় ভিতরটা আরও অন্ধকার হলো। কান পেতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টেড। দরজার পাশে বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হুড়কোটা যথাস্থানে এঁটে দেয়ার শব্দ ওর কানে এল।
দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে দেখল মার্শ। লানা হত্যার প্রতিশোধ নিতে ওরা যে তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাইরে থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। ডোবির লাশ নিয়ে ফিরতে যা সময় লাগে তারমধ্যেই হয়তো ওরা কবর খুঁড়ে তৈরি রাখবে-অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দিতে ওদের কিছুটা সময় লাগবে—ওই সময়ের মধ্যেই নিজেকে মুক্ত করে পালাবার একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে ওর মরণ নিশ্চিত।
দেয়াল ছেড়ে বার্নের চারপাশটা ঘুরে দেখল টেড। ব্যবহার করার মত কিছুই নেই ওখানে। চারকোনা মাথাওয়ালা একটা গজালের ওপর এসে ওর চোখ আটকে গেল। মোটা খুঁটিতে পোঁতা গজালটা ইঞ্চিখানেক বেরিয়ে আছে। কাছে গিয়ে মরিচা ধরা লোহাটা পরীক্ষা কোরে দেখল ওটার কোনাগুলো মোটামুটি ধারালোই আছে!
তাড়াতাড়ি র্যাঞ্চহাউসের মুখোমুখি দেয়ালটার পাশে দাঁড়িয়ে দুটো তক্তার ফাঁকে চোখ রাখল টেড। বেইটসদের কাউকে দেখতে পেল না। বুঝল ওরা ডোবির লাশ নিয়ে ফেরার অপেক্ষায় বাড়ির ভিতরেই আছে। চট কোরে খুঁটির কাছে এসে পিছন-ফিরে দাঁড়াল। গজালের ধারাল মাথায় ঘষে হাতের বাঁধনটা কাটার কাজে লেগে গেল সে।
খুব ধীর গতির কাজ। বেইটসরা কেউ তাকে ওই অবস্থায় দেখে ফেললে নিজেকে মুক্ত করার একমাত্র সুযোগটা সে হারাবে। তাই কাজের ফাঁকে কান খাড়া রাখল। ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর চামড়ার দড়িটা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলো। তার চেষ্টা বৃথা যায়নি—চামড়াটা ক্ষয়ে কিছু আঁশ বেরিয়ে এসেছে।
অল্পক্ষণ পরেই দূর থেকে একটা ওয়্যাগন আসার শব্দ ওর কানে এল। একটা সুবিধা মত ফাঁকে চোখ রেখে দেখল ওয়্যাগনে লানার লাশ নিয়ে ডোবি ফিরে আসছে। আবার বাঁধন কাটার কাজে ব্যস্ত হলো টেড। আর একটা মুহূর্তও নষ্ট করা চলবে না।
বার্নের ভিতরে ভাপসা একটা গরম। কেবল তক্তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সামান্য বাতাস ঢুকছে। পরিশ্রমে ঘেমে উঠেছে টেড। হাত দুটো টনটন করছে। একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থেমে উঠানে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। আবার তক্তার ফাঁকে চোখ রেখে দেখল লানার লাশটা বাড়ির ভিতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সম্ভবত ওখানেই মৃতদেহটাকে কফিনে ভরা হবে। ঠিক তাই একটু পরেই সে দেখতে পেল পাইন কাঠের একটা লম্বা কফিন নিয়ে ক্লোভিস বাড়ির ভিতর ঢুকল। বাইবেল পাঠ আর প্রার্থনা সেরে পেরেক ঠুকে কফিন বন্ধ কোরে লানাকে কবর দিয়ে ফিরতে ওদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যেই টেডকে যা করার করতে হবে।
আবার বাঁধন কাটার কাজে ব্যস্ত হলো সে। আধঘণ্টা পর বাড়ির ভিতর থেকে পেরেক ঠোকার আওয়াজ এল। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
তেরো
দশ মিনিট কঠিন পরিশ্রমের পর চামড়ার ফিতেটা আবার পরীক্ষা কোরে দেখল ওটা দুর্বল হয়ে এখন অনেক আঁশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। উৎসাহিত হয়ে নতুন উদ্যমে কাজে নামল টেড।
কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই উঠানে পায়ের শব্দ শুনে আবার তক্তার ফাঁকে চোখ রাখল। তিন ভাই কফিনটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে- ক্লোভিস সবার আগে। পিছন পিছন চলেছে ওদের মা-সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে ঋজু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাঁটছে-ঠিক যেন একটা নিষ্ঠুরতার প্রতীক।
নীরবে বিষণ্ণ চেহারায় বার্ন পার হয়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে গেল ওরা। ওটাই ওদের গোরস্থান।
ওরা কিছুটা দূরে সরে যেতেই আবার কাজ শুরু করল টেড। ওদিকে কবরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে মা-বেইটস তারস্বরে চিৎকার কোরে বলছে, ‘লর্ড, এই যে, এখানে রয়েছে আমার মেয়ে, লানা। আমরা ওকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। জানি, মেয়েটা একটু জেদি আর বুনো ছিল। মাঝেমাঝে পাগলামি করলেও সে আসলে ভালই ছিল। লোকে যতটা বলে তত খারাপ মোটেও ছিল না। কিন্তু স্কটের পালায় পড়ে ওকে বিয়ে করে…’
এতক্ষণে মার্শের কঠিন পরিশ্রম সার্থক হলো। একটা ঝাঁকির সাথে চামড়ার ফিতের শেষ কয়েকটা আঁশও ছিঁড়ে গেল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল টেড। হাত মুক্ত হওয়ায় বার্ন থেকে বেরিয়ে নিজের ঘোড়ার কাছে পৌঁছবার সুযোগ হয়তো হতে পারে।
‘…কিন্তু ওর যা অপরাধ সেটা তুমি নিজ গুণে ক্ষমা করে নিয়ো, লর্ড…’ চিৎকার করে বলে চলল মা বেইটস।
চামড়ার ফিতেটা হাত থেকে খুলে ফেলে পকেট থেকে ফোল্ডিঙ ছুরিটা বের করল টেড। ওটার ফলা ছোট হলেও দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে হুড়কোটা উঁচু করে ঠেলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট লম্বা।
….আমি আর লানার বাবা, লর্ড, তার আত্মাকে শান্তি দিও-আমরা চেয়েছিলাম একজন সুন্দর সৎ মানুষকে মেয়েটা বিয়ে করে-নাতি-নাতনীর জন্ম দেবে-কিন্তু তা আমাদের ভাগ্যে জুটল না…’
দরজার সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে ফাঁক দিয়ে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে দিল টেড। হুড়কোর বাম পাশটা ব্র্যাকেট থেকে উঠিয়ে বাইরের দিকে ঠেলে দিয়ে বাম কপাট কয়েক ইঞ্চি ফাঁক কোরে হুড়কোর সাথে ঠেসে ধরল। হুড়কো নিচে পড়লে শব্দ যদি বেইটসদের কানে যায় তবেই বিপদ। দরজার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে হুড়কো ধরে টান দিয়ে অন্য ব্র্যাকেট থেকে মুক্ত করে ওটাকে বার্নের ভিতর নিয়ে এল।
‘….আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু একটাই অনুরোধ, লানাকে তুমি ক্ষমার চোখে দেখো…’
আর বেশি সময় নেই-সাবধানে দরজা দিয়ে বেরিয়ে হুড়কোটা আবার লাগিয়ে দিল টেড। নিজের ঘোড়ার কাছে পৌঁছে বেইটসদের অগোচরে সরে পড়তে পারলে ওরা ভাববে সে বার্নের ভিতরেই আছে।
দেয়াল ঘেঁষে কুঁজো হয়ে দৌড়ে বার্নের কোনা ঘুরে আড়ালে চলে এল মার্শ। এখন বেইটস আর ওর মাঝখানে বার্ন। ওরা এখনও লানার কবরের পাশেই জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ঘোড়ার কাছে পৌঁছে এক টানে হিচ-রেইল থেকে ঘোড়ার লাগামটা খুলে নিয়ে ওটার পিঠে চেপে বসল সে। একটা কুকুর ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল-ওর সাড়া পেয়ে একবার মুখ তুলে চেয়ে আবার সামনের পা দুটোর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকল। নিঃশব্দে ঘোড়াটাকে বেশ কিছুদূর হাঁটিয়ে নেয়ার পর ধীরে ঘোড়ার গতি বাড়াল। খুরের শব্দ এত দূর থেকে বেইটসদের কানে পৌঁছবে না।
মার্শের পিস্তল আর রাইফেল বেইটসরা রেখে দিয়েছে মনে পড়ল ওর। ওগুলো র্যাঞ্চহাউসে সহজেই চোখে পড়ার মত কোন জায়গায় আছে। কিন্তু ওসব উদ্ধার করতে যাওয়াটা নেহাত বোকামি হবে। তার কপাল ভাল ওদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। বাড়তি ৪৪ পিস্তলটা দিয়েই ওকে ঠেকার কাজ চালাতে হবে। স্যাডলব্যাগ থেকে ওটা বের করে কোমরে গুঁজল সে।
যতটা সম্ভব ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে এগোচ্ছে টেড। ট্রেইল এখনও আট-দশ মাইল দূরে। কোনাকুনিভাবে এগোলে দূরত্ব কিছুটা কম হবে বটে, কিন্তু বেইটসদের তৈরি ট্রেইল ধরে এগোলেই যাত্রাটা সহজ আর দ্রুত হবে। বেশ কিছুটা উপরে উঠে এসেছে মার্শাল। ছোট টিলাটা পেরিয়ে ওপাশের ঢালে নামার আগে পিছন ফিরে তাকাল সে। বেইটসদের উঠানটা উঁচু থেকে বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লক্ষ করে দেখল ওদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। বুঝল ওর সরে পড়ার ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে। র্যাঞ্চ থেকে ঘোড়ার পিঠে রওনা হলো একজন। দূর থেকেও মার্শ চিনল-লোকটা ডোবি।
মনেমনে একটা গালি দিয়ে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে রওনা হলো টেড। আশা করেছিল হুড়কোটা লাগিয়ে আসায় ওর অনুপস্থিতি টের পেতে বেইটসদের কিছুটা দেরি হবে, এবং সেই ফাঁকে সে অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু অদৃষ্ট খারাপ, সেটা আর হলো না।
ঘোড়ার গতি বাড়াল মার্শাল। একবার প্রধান ট্রেইলে উঠতে পারলে তার রোনটার পক্ষে পথ চলা আরও সহজ হবে। মার্শের ঘোড়াটা ভাল, ডোবি ঘোড়া ছুটিয়ে কিছুতেই ওকে ধরতে পারবে না।
রোনটাকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিল টেড। মাঝেমাঝে পিছন ফিরে দেখছে। কিন্তু গত এক ঘণ্টায় ডোবির কোন চিহ্নই সে দেখতে পায়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। মনেমনে সে চাইছে ডোবি ফিরে যাক, কারণ ওই লোকটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা তার মোটেও নেই। কিন্তু ডোবি যদি ওকে ধরে ফেলে তবে সেটাই করতে ও বাধ্য হবে। পুরো ব্যাপারটাই অনর্থক-নিজেকে রক্ষা করার জন্যেই লানাকে তার গুলি করতে হয়েছে!
জিনের ওপর নড়েচড়ে বসে রোনের গতি আরও কমাল টেড। ডেভিস্ কিচেনের দিকে এগোচ্ছে ঘোড়া। রোদে-ফোস্কা-পড়া পাথুরে একটা এলাকা। স্থানীয় লোকে বলে ওই সমতল পাথরগুলো সারাদিনে রোদে পুড়ে এমন উত্তপ্ত হয় যে ওর ওপর মাংস ভাজাও সম্ভব তাই এলাকাটা ডেভিল্স্ কিচেন নামেই পরিচিত।
খারাপ এলাকা এড়াবার জন্যে দক্ষিণে এসপানিওলা শহরের দিকে মোড় নিল টেড। ওখান থেকে একটা ভাল রাস্তা পুব-টেক্সাসে গেছে।
অস্থিরভাবে বাম হাত দিয়ে মাথার পাশটা মালিশ করল মার্শাল। ওখানে একটা ভোঁতা ব্যথা। ডোবির কাজ। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে চেয়ে একজন অশ্বরোহী ওর নজরে পড়ল। বাঁক ঘুরে লোকটা তখনই মাত্র দৃষ্টির আওতায় এসেছে। এত দূর থেকে চেনা যাচ্ছে না, কিন্তু সম্ভবত লোকটা ডোবি। অন্য কেউও হতে পারে, তবে লোকটাকে ডোবি বলে ধরে নিয়ে সাবধান হওয়াই ভাল।
বিরক্তিতে থুতু ফেলল সে। জাহান্নামে যাক হতচ্ছাড়া। ব্যাটা আসে আসুক। বেইটসদের সাথে নতুন কোন ঝামেলায় ও যেতে চায় না। কিন্তু ভীত খরগোশের মত সে আর পালাবে না।
চোখ তুলে সোজা সামনের দিকে চাইল মার্শ। এসপানিওলায় যাওয়ার পথটা সামনেই বাঁক নিয়েছে। শহরে পৌছে হোটেলে উঠে আয়েশ কোরে একটা ঘুম দিতে হবে। গতরাতে ভাল বিশ্রাম হয়নি।
ছোট ছোট টিলার নিচের অংশে অনেক ঝোপ আর গাছ জন্মেছে। গাছপালার কারণে এলাকাটা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। প্রধান ট্রেইল ধরে পুবে যাওয়ার থেকে এই পথে চলাটা অনেক ভাল। হঠাৎ কি মনে করে একটা ঢালের মাথায় থেমে পিছন ফিরে চেয়ে দেখল।
পিছনের আরোহী যে-ই হোক, এখন আর তার কোন চিহ্ন দেখা গেল না। লোকটা যদি ডোবি হয়, সে জানে মার্শ টেক্সাসে যাচ্ছে। টেড নিজেই ওদের তা জানিয়েছে। মনে হচ্ছে কথাটা স্মরণে রেখে প্রধান ট্রেইল ধরে সোজা টেক্সাসের দিকেই এগিয়ে পুবে চলে গেছে ডোবি।
নিজের মনেই হাসল মার্শ। শার্টের হাতায় ভুরুর ঘাম মুছে আবার এগোল সে। ভালই হয়েছে, বর্তমানে ডোবিকে নিয়ে আর তাকে মাথা ঘামাতে হবে না। বেচারা ডোবি! ডেভিল্স্ কিচেন পার হওয়ার সময়ে ওকে গরমে রোস্ট হতে হবে, কারণ এই সময়ে ওই এলাকার তাপ একশো বিশ ডিগ্রীরও বেশি থাকবে।
চোদ্দ
অস্বাভাবিক ঘটনাচক্রে টেড মার্শের বরখাস্ত হওয়ার খবর ওর চাকরি যাওয়ার পরদিনই সেসিলার কাছে পৌঁছে গেল।
সেসিলার বাবা প্যাট্রিক হিউ। ওই নাদুসনুদুস আর গোলাপী টসটসে গালের লোকটাই সিলভার সিটির একমাত্র টেলিগ্রাফার। নিউ মেক্সিকোতে উল্লেখযোগ্য যা কিছু ঘটে, তা তারের মাধ্যমে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে জেনে যায়। রাতে খাবার টেবিলে বসে বৌ আর মেয়েকে মুখ বন্ধ রাখার প্রতিজ্ঞা করিয়ে তাজা খবরগুলো পরিবেশন করা তার অভ্যাস। এইভাবে খবরটা পরদিনই সন্ধ্যায় সেসিলার কানে পৌছল।
বিপর্যস্ত মনে সাপার মুখে তুলতে পারল না সেসিলা। মেয়েকে শিপরক থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পর এই প্রথম ওরা টের পেল শিপরকের মার্শাল তাদের মেয়ের মনে কত গভীর দাগ কেটেছে।
‘ছি,’ বলে উঠল প্যাট্রিক, ‘মার্শাল মার্শ তোমার মন জুড়ে বসে আছে জানলে কথাটা আমি তুলতামই না!’
‘ওহ, ড্যাডি, এটা…এটা তোমার দোষ নয়। আমারই দোষ। ওর প্রতি দুর্বলতার কথা তোমাদের আমার আগেই জানানো উচিত ছিল। কিন্তু ওর মনোভাব আমি নিশ্চিত জানি না-তাছাড়া তোমরা আমার দিকটা ঠিক বুঝবে কিনা জানতাম না। তাই বলিনি। আমি…’ আর বলতে পারল না সেসিলা, কান্নায় ভেঙে পড়ল।
‘শান্ত হও, বাছা,’ বলে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিল মা। ‘তোমার বাবা যে খবর এনেছে তাতে খুব চোট পেয়েছ বুঝতে পারছি।’
কোন জবাব না দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সেসিলা
‘সত্যিই আমার খুব খারাপ লাগছে, মা,’ বিষণ্ণ সুরে বলল প্যাট্রিক। ‘কথাগুলো ফিরিয়ে নিতে পারলে…’ কথা বুজে এল তার।
‘এসো, মা মণি,’ ডাকল মিসেস হিউ, ‘উপরে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিলে তোমার ভাল লাগবে। এসো!’ মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে দোতলায় উঠল।
ভুরু কুঁচকে ভাবছে প্যাট্রিক। মার্শের সাথে অল্প সময়ের জন্যে শিপরকে ওর দেখা হয়েছিল। মেয়েকে সিলভার সিটিতে নিয়ে আসার জন্যে শিপরকে গেছিল সে। আত্মবিশ্বাসে ভরা লম্বা মার্শালকে ওর ভাল লেগেছিল। লোকটা সাবলীল ভঙ্গিতে ঘোড়া চালিয়ে স্টেজের পাশেপাশে থেকে শহরের সীমানা পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিতে এসেছিল। কিন্তু মার্শের সম্পর্কে এর বেশি সে আর বিশেষ কিছুই জানে না। তবে এটা শুনেছে, লোকটা প্রথমে কাউবয় ছিল, পরে লম্যান হয়েছে। পাত্র হিসেবে এটা তার কাছে সন্তোষজনক বলে মনে হচ্ছে না। তার বিশ্বাস সেসিলার আরও ভাল পাত্র পাওয়া উচিত।
প্রাক্তন টাউন মার্শাল বেন জুনিয়রের সাথে বিয়েতে সে মত দিয়েছিল, কারণ তার ধারণা ছিল একদিন সে তার বাবার র্যাঞ্চে ফিরে গিয়ে হাল ধরবে। ওর বাবা, বেন সিনিয়র যদি নিউ মেক্সিকোর সবথেকে ধনী র্যাঞ্চার না হত তবে কিছুতেই সেসিলার বিয়েতে সে মত দিত না।
ব্যাঙ্ক ডাকাতি ঠেকাতে গিয়ে যখন বেন জুনিয়র আহত হলো তখন প্যাট্রিকের মনটা লম্যানের প্রতি কিছুটা দুর্বল, হয়েছিল। কিন্তু মাস খানেক পরেই বেচারা মারা গেল। ছেলের মৃত্যুর শোকে কয়েকদিন পরে তার বাবাও হার্ট অ্যাটাকে মরল। তখনই প্যাট্রিক তার একমাত্র মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে চায় না এত দুঃখের পরে মেয়েটা আরও আঘাত পাক। নিজের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে মেয়েকে সে আগলে রাখতে চেয়েছে।
আজ সন্ধ্যায় মার্শালের বরখাস্ত হওয়ার খবরটা বলার আগে সে বোঝেনি টেডকে তার মেয়ে মনেমনে ভালবাসে।
‘অসম্ভব!’ নিজের মনেই বলে উঠল হিউ। তার মেয়ে বিবাহিত অবস্থায় স্বামীর বন্ধুর সাথে নিশ্চয় প্রেম করেনি। তবে…হাতের আঙুলে তার মেয়ে কতদিন হলো বিধবা হয়েছে গুনে দেখল। সাত মাস। গভীর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ভাবছে, নিশ্চয় বিবাহিত অবস্থাতেই সেসিলা টেডকে ভাল বন্ধু হিসেবে পেয়েছিল, পরে বাবার কাছে সিলভার সিটিতে এসে থাকতে এসে টের পেয়েছে টেডের প্রতি ওর কতটা টান।
‘অসম্ভব,’ আবার বিড়বিড় করে বলল হিউ, ‘মেয়েলি মন আমি পুরোপুরি কোনদিন বুঝতে পারব না!’ আপন মনেই মাথা নাড়ল সে।
‘প্যাট্রিক।’
ডাক শুনে মাথা তুলে তাকাল সে। চিন্তায় বিভোর থাকায় কখন যে ওর স্ত্রী নিচে নেমে এসেছে টেরই পায়নি।
‘এখন কেমন বোধ করছে ও?’ প্রশ্ন করল হিউ।
‘কিছুটা ভাল। কিন্তু আমার মনে হয় ওর সাথে আমাদের আলাপ করে জানা দরকার এই মার্শের সাথে ওর কি ধরনের সম্পর্ক। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছুটা আলাপ করে নেয়া উচিত।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ, অ্যালিস।’ পাইপে তামাক ভরে আলোচনা করার জন্যে তৈরি হলো সে।
‘এই মার্শ লোকটার সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। সেসিলাকে আনতে গিয়ে ওর সাথে সামান্য পরিচয় হয়েছে।’
‘ওর সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?’
এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবল হিউ।
‘এত অল্প পরিচয়ে কারও সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা কঠিন। তবে স্বীকার করতেই হবে ওকে আপাতদৃষ্টিতে আমার ভালই লেগেছে।’
‘সেসিলা আমাকে বলেছে তার স্বামীর ডেপুটি হিসেবে কাজ করত মার্শ। এর আগে সে বেন সিনিয়রের অধীনে কাউবয় ছিল। বেন জুনিয়রের সঙ্গীও ছিল সে। পরে ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টায় চাকরি ছেড়ে চলে যায়।’
‘বুঝলাম…কিন্তু তাহলে সে শিপরকে আবার কিভাবে ফিরল?’
‘বেন জুনিয়রই ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল। মার্শ ওর বাবার র্যাঞ্চে কাজ করার সময়েই ওদের গাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাবার মাতলামি ঠেকাতে না পেরে বেন ওকে ডেকে পাঠাতেই সে চলে আসে। ব্যাঙ্ক ডাকাতের মোকাবিলায় ওরা দুজনই পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। দুই বেনের মৃত্যুর সময়ও মার্শই পাশে ছিল। মার্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল সেসিলা। আমাদের কাছে থাকতে চলে আসার আগে সেসিলাকে সে সব রকম সাহায্য করেছে। এই সময়েই মার্শের প্রতি মেয়েটা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, এবং এখনও ওকে চায়।’
‘বুঝলাম, মেয়েটা কেন ওভাবে ভেঙে পড়েছিল। আমি যদি জানতাম…’
‘সত্যি কথা বলে অনুতাপ করে লাভ নেই। ওর দিকটা বুঝে ওর সাথে তুমি একটা সমঝতায় আসতে পারলে ভাল হয়। ওর সাথে তোমার খোলাখুলি আলাপ করা দরকার।’
‘আমি আলাপ করব, অ্যালিস।’
হেসে মাথা ঝাঁকাল মিসেস হিউ। সে জানে সেসিলাকে একমাত্র প্যাট্রিকই ফেরাতে পারবে। অ্যালিসও বিশ্বাস করে তার মেয়ের কাউবয় বা লম্যানের থেকে ভাল পাত্র পাওয়া উচিত। ভাল বংশের, শিক্ষিত, সুদর্শন আর বিত্তশালী কোন যুবককেই সে জামাই করতে চায়।
সেই সন্ধ্যায় অ্যালিস নিজের কামরায় যাওয়ার কিছু পরে সেসিলা নিচে নামল। বাবাকে একা বসে থাকতে দেখে অবাক হয়নি ও। জানে, বাবা তার সাথে আলাপ করার জন্যেই বসে আছে। আগে হোক পরে হোক বাবার সাথে খোলাখুলি আলাপ তাকে করতেই হবে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাবার মুখোমুখি বসল সে।
‘বাবা, সন্ধ্যায় আমি অবুঝের মত আচরণ করেছি। খবরটা আমাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিল।’
হেসে পাইপে তামাক ভরে আলাপ করার প্রস্তুতি নিল হিউ। পাইপ ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মেয়ের দিকে তাকাল সে।
‘বাবা, আমি টেড মার্শ সম্পর্কে তোমার সাথে আলাপ করতে চাই।’
‘নিশ্চয়, বাছা! আমিও মনে মনে সেটাই চাইছিলাম।’
নিজের নার্ভাস অবস্থা লুকোবার জন্যে কোলের ওপর হাত রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
‘তুমি তো শিপরকে টেডকে দেখেছ। প্রথমে বলো, ওকে তোমার কেমন লেগেছে?’
খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে পাইপ থেকে ওঠা ধোঁয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে সে বলল, ‘খুব কম সময়ের জন্যে দেখা হলেও ভাল লাগেনি বললে মিথ্যে বলা হবে।’
একটু হেসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেয়েটা। ‘আমি মনেপ্রাণে এটাই চাইছিলাম। আমি জানি তোমাকেও ওর ভাল লেগেছে।’
অল্পক্ষণ নীরবতার পর হিউ বলল, ‘আচ্ছা, ওকে তুমি কতদিন হয় চেনো?’
মাকে সে যা বলেছে, বাবাকেও একই কথা জানাল। তার সাথে আরও একটু যোগ করে বলল, ‘সে বেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল বলে আমার সাথেও ওর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। হয়তো বন্ধুর স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য হিসেবেই আমার জন্যে সে এত কিছু করেছে। কিন্তু ওর প্রতি আমার মন দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরপর দু’দুটো মৃত্যুর পর আমি নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারতাম না-টেডই আমাকে সাহস আর সহ্য করার শক্তি জুগিয়েছে। ও নিজেও শক্ত চরিত্রের মানুষ।’
‘এবং এইসব কারণেই তুমি ওই লোকটাকে ভালবেসে ফেলেছ?’
নিজের কোলে রাখা হাত দুটোর দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ, ওকে আমি ভালবাসি।’
‘তুমি জোর দিয়ে বলতে পারো এটা ভালবাসা-ক্ষণিকের আকর্ষণ নয়?’
‘হ্যাঁ, আমি সত্যিই ওকে ভালবাসি।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্যাট্রিক প্রশ্ন করল, ‘আর এই টেড মার্শও কি তোমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসে?’
অপরাধীর মত মেঝের দিকে চেয়ে থেকে সে বলল, ‘আমি জানি না, বাবা, স্পষ্ট করে সে কখনও কিছু বলেনি।’
চিন্তাযুক্ত মনে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল হিউ। তারপর পাইপে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘তাহলে মার্শ তোমার প্রতি ভালবাসার কথা একবারও প্রকাশ করেনি?’
‘না, ড্যাডি, মুখে বলেনি। কিন্তু আমি জানি সেও আমাকে ভালবাসে।’
‘কিন্তু তা কি করে হয়? ও যদি তোমাকে কিছুই না বলে থাকে, তুমি কিভাবে বুঝলে লোকটা তোমাকে ভালবাসে?’
সরাসরি বাবার দিকে মুখ তুলে চাইল সেসিলা। ‘আমি জানি, বাবা। বিশ্বাস করো…মুখে না বললেও আমি জানি ও আমাকে ভালবাসে।’
হাসল হিউ। ‘নিশ্চয়, বাছা—নিশ্চয় সে তোমাকে ভালবাসে—তুমি যখন বলছ, হয়তো তাই হবে।’
বাবার চোখে বিদ্রূপের আভাস দেখতে পেয়ে রাগ হচ্ছে সেসিলার। কিন্তু সংযত থাকল সে।
‘শিপরকের ওরা যখন টেডকে বরখাস্ত করেছে, আমার মন বলছে এবার ও আমাকে নিতে আসবে। নিতে এলেই প্রমাণ হবে, আমাকে ভালবাসে।’
এক গাদা ধোঁয়া হঠাৎ গিলে ফেলে কাশতে কাশতে হিউ-এর চোখে পানি এসে গেল। রুমাল বের করে চোখ মুছে পরে নাক ঝাড়ল সে।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে সেসিলা।
‘টেড মার্শ…সে কি তোমাকে বলেছে শিপরক ছাড়লে তোমার জন্যে এখানে আসবে?’
‘না, ড্যাডি, তা বলেনি। কিন্তু আমি জানি আসবে। এখানে এলে তুমিই তাকে জিজ্ঞেস কোরো ও আমাকে চায় কিনা।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপের ছাই ঝাড়ল হিউ। ‘যখনই মিস্টার মার্শ আসে…মানে…তোমার জন্যে আসে, আমি আনন্দের সাথেই তার সাথে কথা বলব!’
‘চমৎকার! কথা বললেই তুমি বুঝবে আমাকে ও কত ভালবাসে-তুমি দেখে নিয়ো!’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়। যাক, এখন আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।’
‘গুড নাইট, ড্যাডি। সুইট ড্রীম্স্।’
মাথা ঝাঁকিয়ে ক্লান্ত পায়ে উপরে উঠল হিউ। আজ রাতে কারও সুখ-স্বপ্ন দেখার সৌভাগ্য হবে না।