তিন
ভোঁতা একটা আওয়াজ করে বেননের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল জেলখানার লোহার দরজাটা। একেবারেই যাচ্ছেতাই একটা ঘরে বন্দি রাখা হয়। রাখা হয় শুধু এক রাতের জন্যে, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় কাউন্টি জেলে, অথবা স্টেট পেনিটেনশিয়ারিতে। বিরাট একটা ঘর। তিনদিকের দেয়াল ঘেঁষে কাঠের বেঞ্চ। সেটাতেই শোবার ব্যবস্থা। একদিকের দেয়ালে অনেক ওপরে লোহার গরাদে দেয়া একটা জানালা। সেটা দিয়ে সূর্যের সামান্য আলো আসছে।
ধপ করে বেঞ্চে বসল বেনন, সিগার বের করে ধরাল একটা। মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করছে সিগার ওরা কেড়ে নেয়নি বলে। কাপুরুষতা যদি ওকে বিব্রত করেও থাকে, চেহারা দেখে তা বোঝার কোন উপায় নেই। নির্বিঘ্ন শান্ত ভাবভঙ্গি, যেন যুক্তিসঙ্গত কাজই করেছে।
যেখানে বসে আছে সেখান থেকে মার্শালের অফিসটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জাগি এখনও শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে ডেপুটিদের আকৃতি দেখা যাচ্ছে। বেননের বুঝতে অসুবিধে হলো না কী নিয়ে তারা আলাপ করছে।
স্টোররূম থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসায় জেগে উঠল জাগি। টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে চলল। কোনা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সময় পার হচ্ছে, আস্তে আস্তে ঘন হচ্ছে ছায়া। একসময় পায়ের শব্দ পেল ও, এগিয়ে আসছে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার শিকে হাত রেখে দাঁড়াল।
জাগি আসছে,, হাতে একটা ছোবড়ার ম্যাট্রেস। তার পেছনে একজন ডেপুটি।
দরজাটা খোলা হলো। ফাঁকা হাসি হাসতে হাসতে ম্যাট্রেসটা এককোণে ছুঁড়ে ফেলে দিল জাগি।
‘খেতে দেবে কখন?’ জিজ্ঞেস করল বেনন।
‘তোমার মত একটা কালো মনের কেঁচোর মত কাপুরুষের পেছনে খামোকা সরকারী খাবার নষ্ট করার কোন অর্থ হয় না,’ ঘড়ঘড়ে গলায় জবাব দিল জেলার। চোখে তাচ্ছিল্য, বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা নিয়ে বেননকে দেখছে সে। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। জেলার চলে গেল। জাগি বসে পড়ল দরজায় হেলান দিয়ে। যেকোন সময় সে ঘুমাতে পারে। এখনও তার তাই ইচ্ছে। ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ।
অন্ধকার নেমেছে। উঠানের ওপাশে অফিসের জানালা দিয়ে বের হচ্ছে লণ্ঠনের হলুদ আলো। হালকা হালকা নাক ডাকছে জাগির।
জাগির দিকে মনোযোগ দিল বেনন। কাত হয়ে পড়ে আছে লোকটা 1 শুকনো হাঁটু ঢুকে আছে শিকের ভেতরে। শীর্ণ কাঁধ দুটো দেখলে মনে হয় কঙ্কালের। লোকটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেনি বেনন গত কয়দিনে। তবে এটা বুঝতে পেরেছে যে যতটা পাগলাটে ভাব দেখায় লোকটা ততটা পাগলাটে আদতে সে নয়। দু’একবার অসতর্ক অবস্থায় তাকে পেয়েছে বেনন। তখন জাগির কালো চোখে খেলা করছিল চাতুরি।
পকেট থেকে একটা সোনার ঈগল বের করল বেনন। বিশ ডলার। ‘জাগি!’ ডাক দিল নিচু স্বরে।
আবছা আলোয় পাশ ফিরল জাগি, মুখে অর্থহীন ফাঁকা হাসি।
কয়েনটা উঁচু করে ধরল বেনন। ‘এই সোনার টাকা চাই তোমার?’
উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে আড়মোড়া ভাঙল জাগি। শিক ধরে হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল।
‘শোনো!’ চাপা শোনাল বেননের কণ্ঠ। ‘অফিসে যে ডেপুটি ডিউটি দিচ্ছে সে মাঝে মাঝে কফি খেতে রান্নাঘরে যায়। খেয়াল রাখবে তুমি। সে গেলেই আমার গানবেল্ট নিয়ে চলে আসবে এখানে। জেলের চাবিটাও আনবে। দরজা খুলে দিলেই সোনার টাকাটা দিয়ে দেব তোমাকে। বুঝেছ?’
‘বুয়েনো,’ সায় দিল জাগি। ‘রাত বারোটার সময়। ডেপুটি আগে ঘুমাক।’
লোকটার বুঝে নেয়ার ক্ষমতা দেখে মনে মনে গাল দিল বেনন। ‘আরও বিশ ডলার চাই তোমার?’
ঘন ঘন মাথা দোলাল জাগি।
‘চাই।’
‘আমার বেডরোলটা বার্নে নিয়ে রেখে এসো, তা হলে পাবে আরও বিশ ভলার।’
শুকনো হাত শিকের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল জাগি। ফাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘আগে বিশ ডলার দাও।’
‘শালা জাতে মাতাল তালে ঠিক!’ মনে মনে গাল দিল বেনন। ‘আর লোকে একে মনে করে পাগল!’ সোনার কয়েনটা জাগির হাতের মুঠোয় ছেড়ে দিল ও বিতৃষ্ণ চেহারায়।
কয়েনটা পেয়ে পা ঘষটে ঘষটে চলে গেল জাগি।
অতি ধীরে পার হচ্ছে সময়। শিকের সামনে দাঁড়িয়ে সিগার ফুঁকছে বেনন, তাকিয়ে আছে আকাশে, দেখছে সহস্র কোটি নক্ষত্রের আলোয় সৃষ্টি অদ্ভুত নক্সা। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। মাঝরাত হতে চলল প্রায়। এখনও জাগির কোন দেখা নেই।
হয়তো সে আসবে না। জাগি হয়তো সত্যিই উত্তপ্ত কড়াইয়ে পড়া পপকর্নের মতই পাগলাটে। হয়তো লোকটা সম্বন্ধে ওর ধারণা ভুল। হয়তো কোন ডেপুটিকে সব বলে ফেলেছে লোকটা। হয়তো কোন এক কোণে বসে সব ভুলে সোনার কয়েনটা নিয়ে খেলা করছে বাচ্চাদের মত। কিছুই নিশ্চিত হবার উপায় নেই এখনও। সবটাই এখন জুয়া খেলা।
তারাজ্বলা রাতে সাদা কাপড় পরা কে যেন এগিয়ে আসছে, হঠাৎ করেই তাকে দেখতে পেল বেনন। শ্বাস আটকে তাকিয়ে থাকল।
দরজার কাছে পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে এসে দাঁড়াল জাগি। তালার ভেতরে চাবি ঢোকানোর মৃদু ধাতব শব্দ হলো। বোল্ট খোলা হলো ঘটাং করে। বিরক্ত হলো বেনন। বিরক্তি প্রকাশ না করে বেরিয়ে এল জেল থেকে, তারপর নিঃশব্দে ভিড়িয়ে দিল লোহার দরজা। আবার তালা লাগাল জাগি। ঢোলা শার্টের তলা থেকে বেননের গানবেল্ট বের করে বাড়িয়ে দিল।
চট করে গানবেল্টটা পরে নিল বেনন, ৪৫টা উরুর পাশে ঝোলাতে পেরে নিশ্চিন্ত বোধ করছে।
‘আমার রোলটা বার্নে নিয়ে রেখে এসেছ?’ ফিসফিস করল ও।
মাথা দুলিয়ে নোংরা একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিল জাগি, সদ্য মুক্ত বন্দির দিকে চেয়ে ফাঁকা হাসি হাসছে। পকেটে হাত ভরে দ্বিতীয় স্বর্ণ ঈগলটা বের করে তার ঘর্মাক্ত হাতে দিল বেনন।
‘ধন্যবাদ,’ বিড়বিড় করল জাগি। ছায়ার মত সরে গেল সে, একটু পরই একটা কোনা ঘুরে চলে গেল চোখের আড়ালে।
জাগি চলে যাবার পরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বেনন। মুক্তিটা বড় বেশি সহজে পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর। এটা কোন ফাঁদ হতে পারে। জাগি কোন চালাকি করেনি তো?
শীঘ্রি জানা যাবে, ভাবল বেনন। জেলখানার দেয়াল ঘেঁষে বার্নের দিকে পা বাড়াল ও, চোখ-কান পূর্ণ সজাগ। হঠাৎ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল। অফিসের পেছনের দরজা খুলে এক ডেপুটি বেরিয়ে এসেছে। পেছনের আলোয় তার আকৃতি কালো দেখাচ্ছে। রাতের প্রহরী সে। পুরো এক মিনিট জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। লোকটা কি জেনেশুনে বেরিয়ে এসেছে, প্রশ্ন জাগল বেননের মনে। একটু পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ডেপুটি।
আবার সামনে বাড়ল বেনন। পোস্টের পুবদিকে বেশ দূরে ঘোড়ার বার্ন, যাতে ঘোড়ার নাদার বাজে গন্ধ অফিসে না আসে।
জেল অফিস পেছনে ফেলে সামনে এগোল বেনন, চলে এল বিশাল বার্নের ছায়ায়। চৌকো দরজাটা সামনেই। উকি দিল ভেতরে। একটা পেগ থেকে ঝুলছে লণ্ঠন, হলুদ আলো ছড়াচ্ছে। সে আলোয় ওর ঘোড়াটা দেখতে পেল। স্যাডল, ব্রিডল চাপানো রয়েছে, ক্যান্টলের পেছনে বেডরোল-যাত্রার জন্যে তৈরি।
অস্বস্তির-বোধ পেয়ে বসল ওকে। ধরিয়ে দেয়ার জন্যে লণ্ঠন জ্বেলে রেখে গেছে কি জাগি? ছায়ার ভেতরে কোথাও আছে লোকটা।
হঠাৎ ঘটাংঘট আওয়াজ শুরু হলো। ট্রেইনের বক্সকারগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি খাচ্ছে। এঞ্জিনের বেল বাজতে শুরু করল টুংটাং শব্দে।
আওয়াজগুলো ওর সরে যাবার শব্দকে ঢেকে দেবে, ভাবল বেনন। ঘোড়ার দড়ি ঢিলে করে লণ্ঠন নিভিয়ে বেরিয়ে এল বার্ন থেকে। স্যাডলে চাপল। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছে হেঁকে উঠে থামতে বলবে কেউ। ঘোড়াটা সামনে বাড়ছে। ইউ এস মার্শালের অফিস পাশ কাটিয়ে সদর রাস্তায় উঠে এল। বাধা দিল না কেউ।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেনন। এবার জিলা উপত্যকা আর ক্যানিয়নে যেতে কোন অসুবিধে নেই। কেউ জানবে না যে ও যাচ্ছে ওদিকে।
.
ঝোপের ভেতর পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙল ওর। বিরাট একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। নদীর ওপর ঘন কুয়াশা ভাসছে, তারই ফাঁক দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে ক্ষীণ সূর্যালোক। আড়মোড়া ভেঙে কফি তৈরিতে মন দিল। এই শীতে কফি দারুণ জমবে।
পটে পানি দিয়ে আগুনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নদীর তীরে চলে এল ও। আস্তে আস্তে বয়ে চলেছে নদী। পানিটা খাওয়ার যোগ্য বলেই মনে হচ্ছে, তবে কাদাময়। মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে সরে এল আগুনের কাছে। সারাদিন নড়ল না জায়গা ছেড়ে। কেউ টের পাবে না ওর উপস্থিতি। নদীর তীরে ঘন হয়ে জন্মেছে চ্যাপেরাল বন। সময় বয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে পেটের খিদে। সন্ধ্যার আগে ছাগলের ডাকে কৌতূহলী হয়ে ঝোপের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল বেনন। এক বুড়ো মেক্সিকান রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে শহরের দিকে চলেছে। বেননকে দেখে চোখে ভয়ের ছাপ পড়ল। কোমরে গোঁজা ছুরির বাঁটে শক্ত করে চেপে বসল তার হাত।
মোটামুটি ভাল স্প্যানিশ জানে বেনন। কয়েকটা রুপোর কয়েন বের করে জানাল একটা ছাগলের বাচ্চা কিনতে চায় ও। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ডাকাতের মত চেহারার আগন্তুকের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবার জন্যে বেশি দরদাম না করেই রাজি হয়ে গেল লোকটা।
সন্ধ্যার পর ছাগলের রোস্ট খেতে বসল বেনন। মনে হলো জীবনে কোনদিন মাংসের এত স্বাদ তা আগে বুঝতে পারেনি। খাওয়া শেষ করে স্থির করল এবার সরে পড়ার সময় হয়েছে। ছাগল-পালক মুখ খুলবে শহরে গিয়ে এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়।
চাঁদ ওঠার পর রওনা হলো বেনন। রুক্ষ জমির ওপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল মেসিলার উদ্দেশে। ক্যান্টিন ভরে নিয়েছে নদীর ঘোলাটে পানিতে।
মিসৌরি আর ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রেইলের মাঝখানে প্রায় ঘুমন্ত একটা বসতি এই মেসিলা। এপথে সবচেয়ে দ্রুত জিলা ক্যানিয়ন অঞ্চলের দিকে যাওয়া যায়। ইউ এস মার্শাল ওয়েন ডি ওভারহোলসার ভুলেও কখনও ভাববে না ওদিকে যাচ্ছে বেনন।
শীতার্ত ভোর এল আবার। বেনন তখন দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ জমির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটা স্টেজ রোড অনুসরণ করে। মরুভূমিতে ফিসফিস আওয়াজ তুলে বইতে শুরু করল হিমেল বাতাস। পাথুরে একটা গর্তের ভেতর ঢুকে পড়ল একটা র্যাটল স্নেক। একাকী বেনন শীতে শিউরে উঠল।
সুদূরবর্তী নীল পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে উঁকি দিল রক্তলাল সূর্য। চোলা গাছগুলো রুপোলি দেখাল সে আলোয়। তারাগুলো ম্লান হয়ে মিলিয়ে গেল। দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে চারপাশ, মনে করিয়ে দিচ্ছে একটু পরই দোজখের আগুনের মত তাপ ছড়াবে মরুভূমি।
ঘোড়া থামিয়ে নামল বেনন, হ্যাটের ভেতর পানি ভরে ঘোড়াটার ধুলো ভরা নাকের সামনে ধরল। তৃপ্তির সঙ্গে পানিটুকু শেষ করল জন্তুটা। এবার স্পিকার খুলে ক্যান্টলের পেছনে বাঁধল ও। সিগার ধরিয়ে ভাল করে দেখল চারপাশ। চারদিকে ঢেউ খেলানো জমি। এখানে ওখানে পড়ে আছে লাল আর হলদে রঙের পাথর খণ্ড। ওগুলোর মাঝে জন্মেছে গ্রীসউড আর সেজ। আন্দাজ করল এল পাসো বিশ মাইল পেছনে ফেলে এসেছে। তবে ওর পালানোর খবর ছড়িয়ে পড়বে দ্রুত। ওভারহোলসার কঠোর কর্তব্যপরায়ণ লোক। দায়িত্বে অবহেলা সে সহ্য করবে না। এতক্ষণে টেরিটোরির সব কজন আইনরক্ষকের কাছে খবর চলে গেছে যে অবাধ্য একজন পদচ্যুত ডেপুটি জেল ভেঙে পালিয়েছে। মেসিলাকে এড়িয়ে এগোতে হবে ওকে।
স্যাডলে চেপে আবার এগোতে শুরু করল বেনন, বিশাল বিস্তারের মাঝে ছোট্ট একটা বিন্দু। হঠাৎ করেই ঘোড়াটার কান দুটো খাড়া হয়ে গেল। সতর্ক হয়ে উঠল বেনন, রাশ টেনে জন্তুটাকে থামাল, নজর বোলাল সামনে। এক ঝাড় পাইনের মাথায় অনেক ওপরের আকাশে দুটো শকুন ঘুরে ঘুরে উড়ছে, এছাড়া আর কোন নড়াচড়া বা প্রাণের লক্ষণ ওর চোখে পড়ল না। মরুভূমিতে শকুন মানেই জীবন অথবা মৃত্যুর চিহ্ন। মৃতদেহ দেখে থাকবে হয়তো কুৎসিত প্রাণীগুলো। অথবা অপেক্ষা করছে কোন মানুষকে দেখে, সময় সুযোগ মত যে হবে ওদের খাবার। কেউ হয়তো স্টেজ রোডের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। সেক্ষেত্রে সে জানে ওর আগমনের কথা। ধুলো ওর উপস্থিতি অনেক আগেই ফাঁস করে দিয়েছে।
হোলস্টারে সিক্সগানটা আলগা করে নিল বেনন, হাতে রাশ তুলে নিয়ে ধীর গতিতে সামনে বাড়ল, সরে যাচ্ছে স্টেজ রোডের ধার থেকে। চোখ আটকে গেল একটা বোল্ডারের পাশে সামান্য নড়াচড়া চোখে পড়ায়। অস্ত্রটা বের করেও আবার ঢুকিয়ে রাখল ও। লোকটার পড়ে থাকার ভঙ্গিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আক্রমণের অবস্থায় নেই ওই লোক।
বোল্ডারের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে ওর আগমন দেখছে সুদর্শন লোকটা। চোখে বিস্ময়ের পাশাপাশি আশার ছাপ। শহুরে লোক, এক পলক দেখেই সিদ্ধান্তে পৌছল বেনন। শক্তিশালী আকৃতি, লম্বা-চওড়া দেহ। কাঁধ দুটো প্রকাণ্ড চওড়া। বয়স খুব বেশি হলে তিরিশ। লোকটার পরনে একটা সাদা শার্ট, এখন ধুলোয় হলদে। চমৎকার কালো প্যান্ট, পালিশ করা জুতো-সবই শৌখিন মানুষের পরিচয় বহন করছে। নিঃসন্দেহে এ এলাকার লোক নয়। কোন গানবেল্ট নেই তার কোমরে। কোন র্যাঞ্চার বা মরুভূমিতে অভ্যস্ত কেউ কখনও এমন এলাকায় অস্ত্র ছাড়া আসে না।
লোকটার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি সমান করে ছাঁটা। অবশ্য তাতে তার চেহারার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবটা অপ্রকাশিত থাকেনি। এখন শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আছে সে, ফলে চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে গেছে। রোদে পোড়া চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ।
‘হাওডি!’ বলে ঘোড়া থেকে নামল বেনন, মুহূর্তের জন্যেও লোকটার ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না।
‘দোজখে কোন সুন্দরী পরী এসে আমাকে বেহেস্তে নিয়ে যেতে চাইলেও আমি অতটা খুশি হতাম না যতটা তোমাকে এখানে দেখে হয়েছি,’ বলল লোকটা। গলার স্বর ভরাট। অভিজাত।
‘সভ্যতা থেকে এতদূরে কী জন্যে?’ জিজ্ঞেস করল বেনন। এখনও সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হতে পারেনি।
‘দুর্ভাগ্য আমাকে পেয়ে বসেছে,’ বলল লোকটা। সুগঠিত হাত ডান পায়ে বোলাল সে। ব্যথায় ঠোঁট বেঁকে গেল। ‘ঘোড়ার দড়ি ঠিক করতে নেমেছিলাম, এমন সময়ে ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করল। ওয়্যাগনের একটা চাকা আমার পায়ের ওপর দিয়ে গেছে। ভেঙে গেছে পা-টা। গতকাল বিকেল থেকে এখানে অসহায় পড়ে আছি, অপেক্ষা করছি মৃত্যুর জন্যে।’ বেননকে ছাড়িয়ে আকাশের গায়ে ঘুরতে থাকা শকুনগুলো দেখল সে। ‘ওরা অধৈর্য হয়ে উঠছে। ভেবেছিলাম ওদের হতাশ হতে হবে না। তুমি আসায় বাঁচার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।’
‘তুমি কি ড্রামার নাকি? পেশা কী?’
‘আমি প্রফেসর রুবেন,’ জবাবে গম্ভীর চেহারায় জানাল পঙ্গু লোকটা। গলার স্বর শুনে মনে হলো নিজের পরিচয় হিসেবে এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে বলে মনে করে। ‘সান্টা ফে থেকে শুরু করে সমতল পর্যন্ত সবাই আমাকে চেনে। আমি মানুষ এবং জন্তুর চিকিৎসা করি। নিশ্চয়ই রুবেনের ব্যথা নিরোধক মোক্ষম ওষুধের নাম শুনেছ?’
‘শুনিনি,’ বলল বেনন। ‘যেমন তুমি শোনোনি আমার নাম। আমি হচ্ছি রন জনসন।’ ক্যান্টিনটা খুলে ঘোড়া থেকে নামল ও। ‘তোমার বোধহয় পানি খাওয়া দরকার, প্রফেসর। চলবে দু’এক ঢোক? তোমার ওষুধের মত ব্যথা কমবে না বটে, তবে তৃষ্ণা মিটবে।’
ফাটা ঠোঁট জিভ দিয়ে চাটল প্রফেসর রুবেন। বলল, ‘যেকোন ধরনের পানীয় এখন আমার কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদের সামিল।’
আধা ভর্তি পানির ক্যান্টিন লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল বেনন। সূর্যের খর উত্তাপের কারণে পানিশূন্যতায় ভুগছে লোকটা, বুঝতে পারছে বেনন। সাধারণ বোধসম্পন্ন কেউ হলে ক্যান্টিন খালি করে ফেলত। কিন্তু প্রফেসর সময় নিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। রিয়ো গ্র্যাণ্ডের ঘোলাটে পানি ধীরে ধীরে উপভোগ করে গিলছে। ক্যান্টিন যখন ফেরত দিল তখনও ভেতরে যথেষ্ট পানি রয়েছে। সাধারণ শহুরে লোক নয় এ, সিদ্ধান্ত পাল্টাল বেনন। এ লোক জানে মরুভূমিতে পানির মূল্য সোনার চেয়ে ঢের বেশি। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে এর। তার চেয়েও বড় কথা, সঙ্গীর সুবিধে অসুবিধে বোঝার ক্ষমতা আছে। জানে তার উদ্ধারকারীরও পানির দরকার পড়বে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা সুদর্শন লোকটার ব্যাপারে বেননের ধারণা কয়েক ডিগ্রী চড়ে গেল।
ক্যান্টিনে কর্ক আটকে ও বলল, ‘তুমি বললে তোমার ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করেছিল। কোন দিকে গেছে ওগুলো?’
‘উত্তরে, মেসিলার দিকে।’
‘এতক্ষণে বোধহয় ওয়্যাগন উল্টে পড়ে আছে ওরা কোথাও,’ বলল বেনন। তাকাল রুবেনের ভাঙা পায়ের দিকে। ‘পায়ের চিকিৎসা পরে হলে অসুবিধে আছে?’
আস্তে করে মাথা নাড়ল প্রফেসর রুবেন।
লোকটাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়া যাবে না, বুঝতে পারছে বেনন। এটাও বুঝতে পারছে যে লোকটাকে নিয়ে শহরে যাওয়াও অসম্ভব। আইনের লোক ওকে পেলেই খপ করে ধরবে। তাতে ওর উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।
‘চিন্তা কোরো না,’ বলল প্রফেসর রুবেন। ‘পায়ের অবস্থা অতটা খারাপ নয়। হাড় ভেঙেছে, কিন্তু চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেনি।’
‘আমি তা হলে এগোচ্ছি,’ সিদ্ধান্তে এসে বলল বেনন। ‘ট্রেইল ধরে গেলে আশা করি তোমার ওয়্যাগনের দেখা পাব।’
শান্ত চোখে বেননকে দেখল প্রফেসর।
অন্তর্যামী হওয়া লাগে না সে কী ভাবছে বুঝতে। রুক্ষ বন্ধুর এক এলাকা এটা। মানবিকতার প্রকাশ এদিকের মানুষের মধ্যে ক্বচিৎ দেখা যায়। বেনন বুঝতে পারল, লোকটা ভাবছে চলে যাচ্ছে ও তাকে ফেলে। ভাবছে সেটাই বুদ্ধিমান লোকের কাজ হবে। রিয়োর এদিকে দয়ামায়া দেখানো বিলাসিতা।
রুবেনের পরবর্তী কথা বেননের ধারণাকে দৃঢ় ভিত্তি দিল। রুবেন নিরাবেগ স্বরে বলল, ‘পঞ্চাশ ডলার পাবে তোমার ক্যান্টিনের জন্যে।’
জবাব না দিয়ে ক্যান্টিনটা প্রফেসরের হাতে ধরিয়ে দিল বেনন, তারপর উঠে বসল স্যাডলে। সোজা এগিয়ে চলল স্টেজ রোড ধরে।