দুই
এল পাসো।
গ্র্যাণ্ড নদীর তীরের ছোট একটা শহর, রোদের নিয়ত অত্যাচারে শুষ্ক। একমাত্র চওড়া রাস্তাটার দু’ধারে দোকান আর বাড়ি। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে ওয়্যাগন স্কুনারের দীর্ঘ লাইন। হিচরেইলগুলোতে বাঁধা আছে বেশ কিছু ঘোড়া। দোকানগুলোর ক্যানোপির ছায়ায় বসে আছে চওড়া ব্রিমের সমব্রেরো পরা মেক্সিকান পুরুষরা। গোটা চিত্রটা দেখলে মনে হয় অলসতায় ডুবে আছে শহর, যেন ঘুমন্ত কোন র্যাটল স্নেক।
করালের উল্টো পাশের দীর্ঘ হলদে অ্যাডোবির ঘরটাকে বড় বলা যাবে না। ভেতরে গরম কম হলেও ঘামছে সবাই। মোট ছ’জন। কঠোর লোক। কঠোর হতে হয়েছে বাঁচার তাগিদে। রেঞ্জের সাধারণ পোশাক সবার পরনে, বুকে ডেপুটি ইউ এস মার্শালের ব্যাজ। গম্ভীর প্রত্যেকের চেহারা।
একটু দূরেই মেক্সিকোতে যাবার পথ। রিয়ো গ্র্যাণ্ড এখানে অগভীর। পারাপারের উপযোগী। অসংখ্য লোকের আনাগোনা চলছে শহরে। কেউ আসছে মেক্সিকো থেকে, কেউ যাচ্ছে মেক্সিকোয়, আবার জড়ো হয়েছে স্মাগলাররা। সীমান্তের সমস্ত আপদ এসে জুটেছে শহরে। সর্বক্ষণ আইন ভাঙার ঝুঁকি। তবে সেকারণে ইউ এস মার্শালদের চেহারা গম্ভীর নয়। তারা ভাবছে বেন স্টার্কের কথা।
রাগান্বিত বাঘের দৃষ্টিতে নিজের লোকদের দেখল ইউ এস মার্শাল ওয়েন ডি ওভারহোলসার, কুঁচকে আছে ভ্রূ দুটো, তারপর আবার হাতের দিকে তাকাল।
একটা রোলটপ ডেস্কের পেছনে পিঠ সোজা চেয়ারে বসে আছে সে। চওড়া কাঁধ, ছোট করে ছাঁটা চুল, এক নজরে দেখলে বুনো মোষের কথা মনে পড়ে যায়। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু নরম হয়নি মানুষটা। মরু অঞ্চলের রোদে পুড়ে চামড়া বাদামী রং ধরেছে। এখন তার চেহারায় ক্লান্তি আর অবসন্নতার ছাপ। বিরাট এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আইন রক্ষার কাজে সে যেন হেরে যাচ্ছে। একটা ওয়ান্টেড পোস্টার দেখছে সে, ঠোঁটের কোণে পুড়ছে সিগার। ছোট্ট চৌকো জানালা দিয়ে বাইরের রোদে পোড়া উঠানের দিকে তাকাল। ওপাশে আছে জেলখানাটা। কিন্তু কিছুই দেখছে না সে।
জেলখানার পাশে ছোট ছোট অ্যাডোবির তৈরি বাড়ি। ওগুলো ডেপুটিদের বাসস্থান। বাড়িগুলোর সামনে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্থূলবুদ্ধির জাগি। ডেপুটিদের কাজের লোক সে। বোকা। মুখে সর্বক্ষণ লেগে আছে অর্থহীন ফাঁকা হাসি। বেশ কিছুদিন হলো এশহরে এসে জুটেছে সে। রয়ে গেছে এখানেই। খাবার আর থাকার জায়গার বদলে ডেপুটিদের ফাই ফরমাশ খাটে।
সিগারটা ফেলে দিয়ে নিজের লোকদের ওপর নজর বোলাল ওভারহোলসার। কিছুক্ষণ পর কর্কশ স্বরে বলল, ‘কথাটা মাথায় গেঁথে নাও। বিশপ শকুনের খাবার হয়ে গেছে।’
‘বেন স্টার্ক?’ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল এক ডেপুটি।
‘হ্যাঁ। ওর ঘোড়াটা ফিরে এসেছে। ঠিক যেমন ফিরেছিল জিম কার্সন আর বিল হারভের ঘোড়া। বুঝতে পারছি বিশপ কিলার্স ক্যানিয়নের খোঁজ পেয়েছিল।’
‘আর বেন স্টার্ক পেয়েছিল ওর খোঁজ,’ বলল আরেকজন ডেপুটি। হাতের নোটিসটা আরেকবার দেখল ওভারহোলসার। ব্লক ক্যাপিটাল লেটারে লেখা রয়েছে:
জীবিত অথবা মৃত, বেন স্টার্ককে ধরে দিতে পারলে পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার। তার শারীরিক কোন বর্ণনা নেই। আন্দাজ করা হয় সে আইরিশ-স্কচ রক্তের। স্টার্ক দলের নেতা। প্রেয়ারি সিটি, কপার টাউনে ব্যাঙ্ক ডাকাতি এবং হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। স্টেজ এবং ট্রেইন ডাকাতির অভিযোগও প্রমাণিত। লুটের মাল উদ্ধার করতে পারলে বিশ পার্সেন্ট পুরস্কার।
আইন কীভাবে লোকটাকে ধরবে, আনমনে ভাবল ওভারহোলসার, যখন লোকটার কোন বর্ণনাই নেই! কেউ জানে না সে দেখতে কেমন!
‘লোকটা এখন নিশ্চয়ই দাঁত বের করে টিটকারির হাসি হাসছে,’ তিক্ত গলায় বলল এক ডেপুটি।
‘হ্যাঁ। স্টার্ক হয়তো আমাদের অফিসে এল, কিন্তু আমরা তাকে চিনতে পারব না। নোটিসে কিচ্ছু নেই।’
চেয়ার ছেড়ে অস্থির পায়ে পায়চারি শুরু করল ওভারহোলসার। ‘চালাক লোক এই বেন স্টার্ক, কিছুটা যেন নিজেকেই বলল। ‘আজ বারো বছর আইনের কাজ করছি, এমন চতুর লোকের দেখা পাইনি আগে কখনও। দলটা আক্রমণ করেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। স্রেফ গায়েব হয়ে যায়।
‘একটা কথা আঁচ করছি, আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ সে জানে। কোন ডেপুটি খোঁজ করতে বের হলেই খবর পৌঁছে যায় তার কাছে। এইবার সাপটাকে আমি ফাঁকি দেব।’
কাজে নতুন যোগ দেয়া যুবক ডেপুটির দিকে তাকাল সে। লোকটার নাম রন জনসন। বড়জোর আটাশ হবে বয়স। পেশিগুলো দড়ির মত পাকানো। দীর্ঘ লোক। কুচকুচে কালো চুল। চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। অতীত সম্বন্ধে মুখ বন্ধ রাখে। সে কী করত তা জানা যায়নি। শুধু বলেছে রেড রিভারে গরুর পাল হারিয়ে কাজ খুঁজছিল। লোকটাকে পছন্দ হয়ে যায় মার্শাল ওভারহোলসারের। লোক দরকার • ছিল তার। একটা শূটিং প্রতিযোগিতা হচ্ছিল শহরে। প্রতিযোগিতায় রন জনসন অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়ে জিতে যাওয়ায় নিজে থেকে তাকে ডেপুটি হবার প্রস্তাব দিয়েছিল ওভারহোলসার। রন জনসন রাজি হয়েছে। আজ দশদিন হলো সে ইউ এস ডেপুটি মার্শালের কাজ করছে।
জাগি চলে এসেছে জানালার কাছে। জানালার কাঁচ মুছতে শুরু করল। কাঁচে বসা মাছি তাড়াচ্ছে মনের আনন্দে।
বিরক্ত হলো ওভারহোলসার, ধমকে উঠল, ‘ভ্যামুস!’
একগাল হাসল জাগি, তারপর সরে গেল জানালার সামনে থেকে। তরুণ ডেপুটির দিকে আবার নজর ফেরাল মার্শাল। ‘রন, এঘরে আমরা যারা আছি তাদের প্রত্যেকের চেহারার বর্ণনা জানে বেন স্টার্ক। প্রত্যেকে এক বছরের বেশি হলো এই পোস্টে আছে। কিন্তু তুমি ব্যতিক্রম। এক মাসও হয়নি তুমি সার্ভিসে যোগ দিয়েছ। সেকারণে তোমাকেই আমি দায়িত্ব দিচ্ছি কিলার্স ক্যানিয়ন খুঁজে বের করার।’
নতুন একটা সিগার বের করে ধরাল সে। ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে চিন্তিত চেহারায় ডেপুটিকে দেখল। ‘সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়বে তুমি। আমরা খবর ছড়িয়ে দেব যে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছ তুমি। শহরে দু’একদিন থাকবে তুমি। ভাব দেখাবে আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে আছো। বলবে আমার সঙ্গে বনিবনা হয়নি। তারপর জিলা কাউন্টির দিকে রওনা হয়ে যাবে। বিশপ ওদিকেই গিয়েছিল। ঘুরঘুর করবে তুমি ওদিকে। স্টার্ক গায়েব হয়ে যেতে পারে না। তাকে ধরা পড়তেই হবে। তার লোকদের মদ দরকার হবে, খাবার আর মেয়েমানুষও লাগবে। সতর্ক থাকলে খোঁজ পাবেই ওদের।’
শার্টের পকেট থেকে মোটা একটা কালো সিগার বের করে ধরাল রন জনসন। চেহারা নির্বিকার। বলল, ‘জিলা কাউন্টি আমি চিনি না। টেক্সাসের সমতলে জন্ম আমার। সমতলেই অভ্যস্ত।’
চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো ওভারহোলসারের। ‘কী বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো।’
‘স্টার্কের হাতে খুন হওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার,’ শান্ত গলায় বলল বেনন।
কিছুক্ষণ কী করবে ভেবে পেল না ওভারহোলসার। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে নতুন ডেপুটির দিকে। তারপর হুঁশ ফিরল। অস্বাভাবিক নীরব হয়ে গেছে ঘরের ভেতরটা। ডেপুটিরা ওভারহোলসারের দিকে চেয়ে আছে। নীরবতা ভাঙল ওভারহোলসার। ‘তুমি কি আমাকে বলতে চাইছ তুমি ভয় পেয়েছ?’
বিব্রত মনে হলো না বেননকে, নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘দোজখের আগুনে বরফের টুকরো যেমন মুহূর্তে গলে যাবে ততটুকু সময়ও আমি টিকব না জিলা কাউন্টির আশপাশে ঘোরাঘুরি করলে।’
‘কাজেই যাবে না তুমি?’
‘ঠিক ধরেছ।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ওভারহোলসার। চেহারা রাগে টকটকে লাল হয়ে গেছে। নিজেকে তিরস্কার করল। এতদিন তার ধারণা ছিল মানুষ চেনে সে। এখন সেই ধারণা প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি খেয়েছে। রন জনসন কাপুরুষ এটা সে ভাবতেও পারেনি। শুকনো স্বরে বলল, ‘তুমি কি জানো তুমি ওপরওয়ালার আদেশ অমান্য করছ?’
জবাব দিল না বেনন।
‘গ্রেফতার করা হলো তোমাকে,’ ধমকে উঠল ওভারহোলসার। ‘টম, ওর গানবেল্ট আর ব্যাজ কেড়ে নাও! জেলে ভরো ওকে।’
শীতল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাতের ঝাপটায় বেননের আঙুল থেকে সিগারটা ফেলে দিল ডেপুটি টম। গানবেল্ট কেড়ে নিয়ে ব্যাজটা হ্যাঁচকা টানে শার্ট থেকে খসিয়ে আনল।
ডেস্কের কাছে গিয়ে একটা হাতকড়া চাবি সহ ডেপুটি টমের হাতে ধরিয়ে দিল ওভারহোলসার।
পিঠে ধাক্কা খেয়ে সামনে বাড়ল বেনন, পেছন দরজা দিয়ে ওকে ঠেলে বের করা হলো। নির্বিকার চেহারায় বাইরে বের হলো বেনন। দেখল সূর্যের প্রখর আলোয় জাগি বসে আছে জানালাটার নিচে, চোখ দুটো বন্ধ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। অল্প অল্প নাক ডাকছে। ব্যাপারটা বেননের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল। আশপাশে প্রচুর ছায়া থাকার পরও জাগির ওভাবে খর তাপে থাকার কোন কারণ নেই সে যতবড় পাগলই হোক না কেন।
অফিসের ভেতরে, দরজা দিয়ে বন্দি আর প্রহরী ডেপুটির দিকে তাকিয়ে আছে ওভারহোলসার। বিড়বিড় করে বলল, ‘লোকটা আমাকে আশ্চর্য করল। দেখে মনে হয়েছিল ও এমন এক লোক যার ওপর নির্ভর করা যায়।’
‘ঘোড়ার চামড়া দেখে জন্তুটা কেমন তা বোঝা যায় না,’ দার্শনিক উক্তি ঝাড়ল এক ডেপুটি।
নাক দিয়ে বিরক্তির একটা আওয়াজ বের হলো ওভারহোলসারের।