তেরো
আইসিসিতে দেখা তিন গানম্যানের সঙ্গে তাসের টেবিলে যোগ দিল বেনন ড্রিঙ্ক সেরে। শুরু হলো স্টাড খেলা। গানম্যানদের আচরণে মনে হলো যে বেননের মতই তারাও জানে না তাদের পরবর্তী কাজ কী হবে বা বেন স্টার্ক কোথায় আছে। সন্ধ্যা নামল এক সময়। দুটো লণ্ঠন জ্বালল গোঁফওয়ালা বারটেণ্ডার। সে আলো পর্যাপ্ত নয়।
এক গানম্যান বেননকে জানাল লণ্ঠন আরও ছিল, কিন্তু ছেলেরা মাতাল হয়ে গতরাতে গুলি করে নষ্ট করে দিয়েছে ওগুলো। এখন দুটোই অবশিষ্ট আছে।
আলোর স্বল্পতার জন্যে একটু পরই তাস খেলা পণ্ড হয়ে গেল। আর কিছু করার নেই দেখে চারজন ওরা ড্রিঙ্ক করতে শুরু করল। কিকিং হর্সে যেটাকে হুইস্কি বলা হয় সেটা আসলে তরল আগুন ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু সেটাই এখন সময় কাটানোর একমাত্র অবলম্বন। গানম্যানরা যে আনন্দ খোঁজার জন্যে অন্য কিছু করতে চাইবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, তিক্ত মনে ভাবল বেনন।
বারে গিয়ে দাঁড়াল ফ্রস্টি, সিক্সগান বের করে ওটার নল দিয়ে কাউন্টারে জোরে কয়েকটা বাড়ি মেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আলাপ বন্ধ হয়ে গেল সবার। গানম্যানদের শীতল চোখ স্থির হলো কুড়ালের মত চেহারার ফ্রস্টির ওপরে।
‘শোনো, ‘শুরু করল সে, ‘স্টার্কের কাছ থেকে খবর এসেছে। সামনে কাজ আছে আমাদের। কাল রাতে আমরা এলডোরাডোর দুটো ব্যাঙ্কে হামলা করে ভল্ট খালি করব। পাল্টা শোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেছে স্টার্ক। খেপে বোম হয়ে গেছে। গোটা শহর আমরা তছনছ করব সেটা চায় ও। সকালে রওনা হবো আমরা। একজন দুইজন করে এলডোরাডোতে ঢুকব। বোনান্যা সেলুনে জড়ো হতে হবে। সেখানেই পৌঁছাবে পরবর্তী নির্দেশ।’
কথা শেষ করে শীতল চোখে আউট-লদের দেখল ফ্রস্টি। মৃদু আলোয় আবছা দেখাচ্ছে তাদের চেহারা। কারও মনোভাব চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। ‘আরেকটা কথা;’ বলল সে থেমে থেমে, ‘এর একটা কথাও যদি কারও মুখ দিয়ে বের হয় তা হলে তাকে আমি নিজের হাতে গুলি করে মারব।’
সে বার কাউন্টার থেকে সরতেই নিচু স্বরে কথা আরম্ভ হয়ে গেল আউট-লদের।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা একজন দু’জন করে। সেলুন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একটা লণ্ঠন টেবিলের ওপর এনে রাখল বেনন। আবার শুরু হলো স্টাড খেলা। খেলা যখন শেষ হলো তখন ওরা চারজন আর বারটেণ্ডার ছাড়া সেলুনে আর কোন জনপ্রাণী নেই। বারটেণ্ডার তার টুলে বসে কাউন্টারে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। বিকট নাক ডাকছে তার।
সেলুন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল বেনন। রাত নেমেছে বেশ আগেই। ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাং করে। রাতের পাখি চিকচিক আওয়াজ করছে উড়তে উড়তে। ওভারহোলসারের ডান ঘোড়াটা এখন একা দাঁড়িয়ে আছে রেইলে, বেননকে দেখে কান খাড়া করল। আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে জন্তুটার।
সেলুন পার করে ওটাকে নিয়ে চলল বেনন স্টেবলের খোঁজে। সেলুনের পেছনেই বার্নটা। ভেতর থেকে লণ্ঠনের আলো আসছে, দেখা যাচ্ছে দরজার একটা ফুটো দিয়ে। ঘোড়াটা নিয়ে সেদিকে পা বাড়িয়ে মানুষের মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল বেনন। কারা যেন নিচু স্বরে কথা বলছে। ফ্রস্টির গলা চিনতে ভুল হলো না ওর।
কোন কারণ নেই, তবুও থমকে গেল বেনন। ডানটাকে গ্রাউণ্ড হিচ করে উবু হয়ে স্পার খুলে ফেলল বুট জুতো থেকে। এবার নিঃশব্দে বার্নের কাছে চলে গেল। দরজার কাছে পৌছতেই শব্দমালা পরিষ্কার হলো। ফুটোয় চোখ রাখতে লণ্ঠনের আলোয় দেখতে পেল তিনজন আউট-ল একটা খড়ের গাদায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। আলাপের ফাঁকে তাদের হাত বদল হচ্ছে একটা হুইস্কির বোতল। ফ্রস্টির বক্তব্য শুনছে বয়স্ক দুই সঙ্গী। তিক্ত শোনাচ্ছে ফ্রস্টির গলা।
‘আমি ‘আমার স্যাডল বাজি ধরতে পারি,’ বলে চলেছে সে, ‘ওই রন জনসন একটা দু’মুখো সাপ। রিয়ো শপথ করে বলেছে সে-ই অ্যাডোবির ঘরটা থেকে ওই বাউন্টি হান্টারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। রিয়ো বদমাশটাকে শেষ করতে চেয়েছিল। আমি ওদের ক্যানিয়নের উদ্দেশে পাঠাই যাতে রিয়ো তার কাজ শেষ করতে পারে।
‘পারেনি রিয়ো। উল্টো ওই হারামজাদা রিয়োকে শেষ করে দিয়েছে। তারপর ক্যানিয়নে আক্রমণ হলো। পিছলা একটা সাপের মত পালিয়ে এসেছে রন জনসন। বাজি ধরতে পারি ল-ম্যানরাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভাগ্যের ওপর বেশি ভরসা করে ফেলেছে লোকটা। ওর ঘোড়াটা ইউ এস মার্শালের নিজস্ব ডান। আইসিসির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে। ক্যানিয়নে আমাদের সঙ্গে গাদ্দারি করেছে। এলডোরাডোতেও সে আমাদের বিপদে ফেলতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না।’
গোঁফওয়ালা আউট-ল জানতে চাইল, ‘তা হলে তার ব্যাপারে আমরা কী করছি?’
‘সেটা কি আমাকে বলে দিতে হবে?’ ক্রূর হাসল ফ্রস্টি। ‘এক গুলিতে মামলা ডিসমিস।’
‘পিট আর আমি কাজটা সেরে ফেলব,’ প্রতিশ্রুতির সুরে বলল অন্য আউট- ল। ‘এলডোরাডোর পথে ওর সঙ্গে যাব আমরা। তবে এলডোরাডোতে কোনদিন আর পৌঁছাতে হবে না ওকে।’ একটু থেমে বলল, ‘ডান ঘোড়াটা আমার পছন্দ।’
চুপ করে আউট-লদের বক্তব্য হজম করল বেনন। কিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারল না। এখন বুঝতে পারছে ফ্রস্টির আড়ষ্ট আচরণের কারণ। রিয়ো আর ফ্রস্টি পুরানো বন্ধু ছিল। ফ্রস্টির কাছে নিজের সন্দেহের কথা বলেছে রিয়ো। এখন ওকে শেষ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে!
বেন স্টার্কের দলের সঙ্গে মিশে তাদের ধরার আশা শেষ, বুঝতে দেরি হলো না বেননের। একবার ওর ব্যাপারে খবর ছড়িয়ে গেলে স্টার্কের দলের সবকয়জন আউট-ল ওকে খুন করার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠবে। কপাল ভাল যে বার্নে আসতে গিয়ে এদের আলোচনা কানে এসেছে ওর।
হালকা পায়ে ডান ঘোড়াটার কাছে ফিরে এল বেনন, ওটাকে হাঁটিয়ে অনেক দূর সরে এল। এখন আর ঘোড়াটার খুরের শব্দ পাবে না আউট-লরা, এটা নিশ্চিত হয়ে কিকিং হর্স শহর পেছনে ফেলে এগিয়ে চলল। শহরটা এখন ওর জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়। খামোকা ঝামেলায় জড়াতে সায় দিচ্ছে না ওর মন। তাতে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
এখন সোজা যেতে হবে এলডোরাডো। আশা করা যায় ওখানে বেন স্টার্কের দেখা পাওয়া যাবে।
জনবহুল ব্যস্ত এলডোরাডোতে ওর ধূলিধূসরিত ঘোড়া প্রবেশ করল পরদিন দুপুরে। এ ক’দিনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি শহরটার। রাস্তায় উড়ছে পুরু ধুলোর মেঘ। বিরাট বিরাট ‘ওর’ ওয়্যাগন হেলেদুলে এগিয়ে চলেছে বিভিন্ন দিকে। মাইনার, পাঞ্চার, ভ্যাকুয়েরো আর ব্ল্যাঙ্কেট মোড়ানো ইণ্ডিয়ানে গিজগিজ করছে বোর্ডওয়াক। সেলুন আর জুয়ার আড্ডাগুলো মানুষের ভিড়ে গমগম করছে। সব আওয়াজ ছাপিয়ে উঠছে স্ট্যাম্প মিলের একটানা দমাদম শব্দ।
হিচরেইলে শেষ পর্যন্ত একটা খালি জায়গা পেয়ে ঘোড়া বেঁধে নামল বেনন, ব্যাট উইং ঠেলে একটা সেলুনের ভেতরে ঢুকল। কনুইয়ের গুঁতো মেরে পথ করে শেষ পর্যন্ত কাউন্টারে পৌঁছে একটা বীয়ার নিল ও। কোনার দিকের একটা টেবিল খালি পেয়ে বসল, ডুবে গেল ভাবনায়। সূর্য ইতিমধ্যেই পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে। রাত নামলে হামলা করবে বেন স্টার্কের ডাকাত দল। ফ্রস্টি আর তার সঙ্গী এবং বেন স্টার্কের অন্যান্য স্যাঙাতদের ঠেকাতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেটা ওর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ওকেই খুঁজছে আইন। নিজের পরিচয় প্রকাশের সময় এখনও আসেনি। বেন স্টার্কের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত আইনের লোকদেরও বিশ্বাস করার উপায় নেই।
নিজের পরিচয় না দেয়া পর্যন্ত ও একজন পলাতক আসামী। শুধু তাই নয়, সে মার্শালের ঘোড়াও চুরি করেছে। এটা ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওর নামে রিওয়ার্ড পোস্টার বেরিয়ে গেছে। শেরিফের অফিসে গেলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। পরিচয় প্রকাশ না করলে কে বিশ্বাস করবে যে ও স্টার্কের দলের লোক নয়?
যতই ভাবছে ততই সমস্যার সমাধানের পথ সুদূরবর্তী মনে হচ্ছে বেননের। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সেলুন থেকে বেরিয়ে বোর্ডওয়াকে এসে দাঁড়াল ও। একটু পর ভিড়ের মাঝ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল, মাথায় চিন্তার পর চিন্তা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠ কানে আসতে থামল বেনন। একটা গলি থেকে এসেছে গলার আওয়াজ।
একদল লোক একটা হলুদ ওয়্যাগন ঘিরে ধরেছে। ওয়্যাগনটার টেইলগেট খোলা। প্রফেসর রুবেন হাসছে, হাতে ব্যথা নিরোধকের বোতল। একটার পর একটা বোতল দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের কাছে রাখা একটা ধাতব বাক্সে ঝনঝন শব্দে জমা হচ্ছে রুপোর ডলার।
মদের বাড়া জিনিস ওই ব্যথা নিরোধক। হু-হু করে বিক্রি হচ্ছে। হাসিমুখে একের পর এক কেস খুলে বোতল বের করছে আর বিক্রি করছে রুবেন স্টাসি। বেননের চোখের সামনে দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল সব কয়টা বাক্স।
বেচাবিক্রি শেষ হতেই ওয়্যাগনের কাছ থেকে সরে গেল মানুষের ভিড়। রুবেন একটা সিগার ধরিয়ে টাকার বাক্স সরিয়ে নিল ওয়্যাগনের আরও ভেতরে। এগিয়ে গেল বেনন। ওকে দেখে সহাস্যে বলে উঠল প্রফেসর, ‘আরে, রন জনসন যে! হঠাৎ এখানে! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আইসিসি র্যাঞ্চে কাজ নিয়েছ।’
‘নিয়েছিলাম,’ বলল বেনন। ‘তুমি হয়তো জানো না, আইসিসিতে হামলা করেছিল বেন স্টার্ক।’
‘জানলেও আমি কি আর মুখ খুলি!’ হাসল প্রফেসর।
‘আমিও আস্তে আস্তে কথা চেপে রাখতে শিখছি,’ বেননও হাসল। ‘তবে বেশ দেরিতে শিখলাম বলতে পারো। বেন স্টার্কের দল আমাকে খুন করার জন্যে খুঁজছে।’
‘একবার তোমাকে আমি আইনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম,’ বলল প্রফেসর। ‘এবার কি চাও, আমি তোমাকে বেন স্টার্কের দলবলের হাত থেকে রক্ষা করি?’
মাথা নাড়ল বেনন। ‘না। শুধু যদি আমার হয়ে শেরিফের কাছে একটা খবর নিয়ে যাও তা হলেই যথেষ্ট উপকার করা হবে।’
‘শেরিফ?’
‘হ্যাঁ, শেরিফ।’ ফ্ল্যানারি কীভাবে ওকে ইণ্ডিয়ানদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সেটা জানাল বেনন। বলল বিনিময়ে আইসিসি র্যাঞ্চে ফ্ল্যানারিকে উদ্ধার করে ও। রিয়োর সন্দেহের কথা বলল। জানাল রিয়োর সঙ্গে গানফাইটের কথা। কীভাবে খুনে ক্যানিয়ন থেকে উদ্ধার পেয়েছে সেটাও বলল। তারপর বলল কীভাবে আবার ও আউট-লদের সঙ্গে যোগ দেয়। ফ্রস্টি যে এলডোরাডোতে স্টার্কের দলের হামলার কথা ঘোষণা করেছে সেটা জানাল। তারপর জানাল কীভাবে ফ্রস্টি ওকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল। এখন ও চায় আউট-লদের ঠেকাতে।
সব শুনে জিভ দিয়ে টাকরায় আওয়াজ করল প্রফেসর। মন্তব্যের সুরে বলল, ‘রন জনসন, তুমি দেখছি গোলমালে জড়াতে এক নম্বরের ওস্তাদ লোক!’
সরাসরি কাজের কথায় এল বেনন। ‘আমার হয়ে আউট-লদের হামলার কথা শেরিফকে জানাবে তুমি?’
‘নিশ্চয়ই!’ চোখে কৌতূহল নিয়ে বেননকে দেখল রুবেন স্টাসি। ‘ওয়ান্টেড একজন লোক তুমি। তার ওপর বেন স্টার্কের দলের একজন। তারপর তোমার এধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে আশ্চর্যজনক।’
‘ফ্রস্টি আর ওর বন্ধুরা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে,’ তিক্ত শোনাল বেননের কণ্ঠ। ভাব দেখে মনে হলো বাধ্য হয়ে সে ওদের বিরুদ্ধাচরণ করছে।
‘চালনি বলে, সুঁই, তোর পেছনে কেন ফুটো!’ হাস প্রফেসর। ‘সে যাই হোক, নষ্ট করার মত সময় নেই আমাদের হাতে।’ তাড়াহুড়ো করে ওয়্যাগনের পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল সে। ওয়্যাগন থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরল গলির মুখ লক্ষ্য করে।
প্রধান সড়কে লোকটাকে ভিড়ে মিশে যেতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেনন। ওর মনে হলো ঘাড় থেকে মস্ত একটা বোঝা নেমে গেছে। এবার আইন তার নিজস্ব পথে চলবে। যা করার আইনের লোকরাই করবে। ওর কাজ বেন স্টার্ককে ধরা। সেদিকেই এবার নিশ্চিন্তে মনোযোগ দিতে পারবে ও।
ফিরে এসে ডান ঘোড়াটার দড়ি খুলতে শুরু করল বেনন। ঠিক তখনই একটা সিক্সগানের নল ওর পিঠে ঠেকল। ছোট্ট করে নির্দেশ দেয়া হলো। ‘নোড়ো না।’
মাথার ওপর হাত উঠিয়ে আস্তে করে ঘুরে দাঁড়াল বেনন। হোঁৎকা একটা লোক। বুকে তার শেরিফের ব্যাজ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক ডেপুটি।
‘রন জনসন,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শেরিফ। ‘খেল খতম তোমার। ঘোড়া চুরির শাস্তি দিই আমরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে।’
‘আমি এসেছি তোমাদের সতর্ক করতে,’ বোঝানোর চেষ্টা করল বেনন। ‘স্টার্কের লোকরা ডাকাতি করতে আসছে।’
‘গলা বাঁচানোর জন্যে মিথ্যে না বললেও চলবে,’ বলে উঠল ডেপুটি। বেননের পায়ের কাছে ঘৃণা ভরে থুতু ফেলল সে। ‘আমাদের কাছে তুমি একটা র্যা স্নেকের চেয়ে কোন অংশে ভাল নও। তোমার চাপাবাজি শোনার কোন ইচ্ছে নেই আমাদের।’
বেননের অস্ত্রটা হোলস্টার থেকে বের করে নিল শেরিফ। ডেপুটি এগিয়ে এসে ওর ঘাড় ধরে ঠেলা দিল। সোজা জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো ওকে।
সেলের ভেতরটা বেশ আঁধার। চুপ করে বসে আছে বেনন। ভাবছে শেষ পর্যন্ত পরিচয় পত্র দেখিয়ে এই বিপদ থেকে বের হতে হবে ওকে, যেটা ওর একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না।
রাত যত বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে এলডোরাডোর হৈ-চৈয়ের পরিমাণ। বোর্ডওয়ার্কে খটাখট আওয়াজ তুলছে চলমান বুটজুতো। মাতালদের কর্কশ গলার চিৎকার ভেসে আসছে। পেশাদার মেয়েমানুষ খিলখিল করে হেসে উঠছে খদ্দেরদের রসিকতায়। মাঝে মাঝেই হুঙ্কার ছাড়ছে অস্ত্র। দূর থেকে পাওয়া যাচ্ছে স্ট্যাম্প মিলের একটানা আওয়াজ।
ভোঁতা একটা বিস্ফোরণের আওয়াজে জানালার শিক ধরে দাঁড়াল বেনন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পাশের বাড়িটার দেয়ালের কাছে হঠাৎ চমকে উঠল তীব্র আলো। মনে হলো বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানি। অত্যন্ত জোরাল শোনাল দ্বিতীয় বিস্ফোরণের আওয়াজটা। পরমুহূর্তে তৃতীয় বিস্ফোরণ হলো। শহরের শব্দমালার ধরন ধারণ বদলে যাচ্ছে। কেমন যেন আতঙ্কিত একটা ভাব এখন লোকজনের চিৎকারে।
উত্তেজিত পুরুষ এবং ভীত মহিলাদের তীক্ষ্ণ চিৎকার চাপা পড়ে গেল ফায়ার বেলের একটানা সুতীব্র আওয়াজে। ঘেউ ঘেউ আওয়াজে মনে হলো সবখানে কুকুর ডাকছে। আরেকবার ঝলসে উঠল আলো। এবার আরও উজ্জ্বল। পরবর্তী আওয়াজটা এতই জোরাল যে কানে তালা ধরে গেল বেননের। জানালার শিকগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। প্রফেসর রুবেন স্টাসির সতর্কবাণী শোনেনি শেরিফ, আবার আইনকে ফাঁকি দিয়ে নিজের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বেন স্টার্ক, তিক্ত মনে ভাবল বেনন। আফসোস হলো কেন ও নিজের পরিচয় দিয়ে বাইরে থাকেনি ভেবে। বাইরে থাকলে হয়তো বেন স্টার্ককে ধরার একটা সুযোগ মিলত। কিন্তু বেন স্টার্ক নিজে কি এই ডাকাতির নেতৃত্ব দিচ্ছে? একটু ভাবল বেনন। ওর অন্তর বলল তা সম্ভব নয়। লোকটা কোন ঝুঁকি নেবে না।
চারপাশে হৈ-হট্টগোল উঠল। বিকট একটা বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিটকে পেছনের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল বেনন, মাথা ঠুকে গেল দেয়ালের সঙ্গে। কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। আবছা আচ্ছন্নতায় দেখল জেলখানার দেয়াল ধসে পড়েছে। অ্যাডোবির বড় বড় টুকরো খসে পড়ল ছাদ থেকে। জেলের একদিকের দেয়াল সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। ধসে পড়ল আরও দু’দিকের দেয়াল।
মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে জেল নামের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এল বেনন। ও বেরোনোর পরমুহূর্তেই ধসে পড়ল জেলের ছাদ। ঘন ধুলোয় দম আটকে আসতে চাইল। কাশতে কাশতে চট করে একটা গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। গলির মুখের কাছ থেকে প্রধান সড়কের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। গোটা শহর যেন একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মনে হলো প্রচণ্ড একটা সাইক্লোন তার তাণ্ডবলীলায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। বাড়ির পর বাড়ি ধসে পড়েছে বিস্ফোরণের ধাক্কায়। এখানে ওখানে ঝুলে আছে দোকানগুলোর ফল্স্ ফ্রন্ট। বোর্ডওয়াকে জমেছে অ্যাডোবির গুঁড়ো আর পুরু ধুলোবালি, বাতাসে ভাসছে ঘন ধুলোর পর্দা। একটা বাড়ি বেকায়দা ভঙ্গিতে কাত হয়ে আছে। জ্বলছে অন্য কয়েকটা বাড়ি।
রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে লোকজন। বেভুলা মনে হচ্ছে তাদের দেখে। কী করতে হবে যেন জানে না কেউ। সেলুন আর জুয়ার আড্ডাগুলো থেকে এখন আর কোন আওয়াজ ভেসে আসছে না। রাস্তায় জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তারা। বুঝতে বেননের দেরি হলো না যে বেন স্টার্কের দল গোটা শহরে বোমা ফাটিয়ে শহরটা তছনছ করে দিয়ে যা নেয়ার নিয়ে চলে গেছে বিনা বাধায়।
কী করবে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই বেননের মনে হলো একটা অস্ত্র দরকার ওর আগে।
শেরিফের অফিসটার দিকে তাকাল। কোমর সমান উঁচু একটা স্তূপ হয়ে গেছে অফিস। অ্যাডোবি আর কাঠের খুঁটির ভেতর থেকে একটা রোল টপ ডেস্কের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। অর্ধেক চাপা পড়ে আছে এক লোক। তার বুক পকেটের ওপর ডেপুটির ব্যাজ দেখা গেল। চট করে চারপাশে তাকাল বেনন। কেউ ওর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।
শেরিফের অফিসের সামনে চলে গেল ও, উবু হয়ে মৃত ডেপুটির গানবেল্ট খুলে পরে নিল দ্রুত হাতে। নিজেকে আবার স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে হলো। এবার রাস্তা ধরে পা বাড়াল ও। জায়গায় জায়গায় জড় হয়েছে শহরের বাসিন্দারা, নিচু স্বরে আলাপ করছে। তাদের পাশ কাটিয়ে একটা লিভারি বার্নের সামনে চলে এল। দরজাটা খোলাই আছে, ভেতরের আবছা আঁধারে ঢুকল বেনন। কাউকে দেখা গেল না আশপাশে। স্টলগুলোর ভেতরে অস্বস্তি ভরে পা ঠুকছে ঘোড়াগুলো। একটার পর একটা স্টল পার হলো ও, খুঁজছে ওভারহোলসারের ডান ঘোড়াটা। পেছনের একটা স্টলে ওটাকে পেল। দেয়ালে গাঁথা একটা পেরেক থেকে ঝুলছে স্যাডল। ওটা বেঁধে নিল ঘোড়ার পিঠে। স্যাডলে ওঠার পর মাথা ঘুরে উঠল ওর। স্যাডল হর্ন আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর মাথা ঘোরাটা কমে যাওয়ার পর চোখ খুলল, স্টলের দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। বার্ন থেকে বেরিয়ে মন্থর গতিতে রাস্তা দিয়ে এগোল। কিছুক্ষণ পর পেছনে পড়ে গেল বিধ্বস্ত শহরটা।
রিজের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া ট্রেইল ধরে সামনে বাড়ছে ও। পুবের আকাশে সরু একটা রুপোলি রেখা দেখা দিয়েছে তখন। রাতের আকাশের তারাগুলো ম্লান হয়ে গেছে। পথের পাশে মেসকিট ঝোপের পেছন থেকে বেকন ভাজার গন্ধ পেল ও নাকে। পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল খিদে। সামনে হালকা ধোঁয়াও চোখে পড়ল। কাছে যাওয়ার পর আড়াআড়ি ভাবে রাস্তা পেরিয়ে ঝোপটার দিকে এগোল ও।
ঝোপের পাশে আগুনের সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে এক লোক। চিনতে দেরি হলো না। মাইক ফ্ল্যানারি।
‘আরেহ্, তুমি!’ ওকে দেখে হাসল ফ্ল্যানারি। ‘এই অবস্থা কেন? দেখে মনে হচ্ছে যেকোন সময় কাত হয়ে পড়ে যাবে স্যাডল থেকে। রাতে ঘুমাওনি?’
‘রাত কেটেছে একটা সেলে,’ জানাল বেনন। ‘তারপর সেলটার দেয়ালগুলো ধসে পড়ায় বেরিয়ে এসেছি। রাতে খাওয়া জোটেনি, এমন খিদে লেগেছে যে আস্ত একটা গরু খেয়ে ফেলতে পারব।’
‘নেমে পড়ো তা হলে,’ আমন্ত্রণ জানাল ফ্ল্যানারি। চোখে বিস্ময়, তাকিয়ে আছে সে মার্শালের ডান ঘোড়াটার দিকে। বলল, ‘দায়িত্ব পালন করতে হলে তোমাকে বন্দি করতে হয়। বাজি ধরে বলতে পারি এলাকার সব কয়জন ল- ম্যান তোমাকে খুঁজছে। তোমার এখন লেজে আগুন লাগা শয়তানের মত ভেগে যাওয়া উচিত।’
‘কী ঘটেছে জানো কিছু?’ অন্য প্রসঙ্গে সরে গেল বেনন। ‘এলডোরাডোতে গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। অবস্থা দেখে মনে হলো শহরটার নাম পালটে হেলডোরাডো রাখা দরকার। সারা শহরে বোমা ফাটিয়েছে বেন স্টার্কের দল। দুটো ব্যাংকের ভল্ট খালি করে নিয়ে গেছে।’
‘স্টার্ককে ধরতে পেরেছে ওরা?’
হাসিমুখে মাথা নাড়ল ফ্ল্যানারি। ‘স্টার্ককে ধরবে? স্টার্ক একটা ভূত। একটা অশরীরী। ওকে ধরা যায় না। কেউ দেখেনি তাকে, কাজেই চেনার প্রশ্নই ওঠে না।’
সন্দেহের দোলায় দুলছে বেননের মন। জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে একা একা কী করছ তুমি?’
‘আমার যা কাজ। দলটা পশ্চিমে গেছে। আমি তাদের অনুসরণ করছি।’
কিছু বলল না বেনন। নীরবে খাওয়া সারল। খাওয়া শেষে একটা সিগারেট ধার নিয়ে ধরিয়ে একবুক ধোঁয়া ছাড়ল। একটু পরই ক্যাচকোঁচ আওয়াজ কানে এল ওর। ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেল ওয়্যাগনটাকে। হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। হলুদ রং ওটার। প্রফেসর রুবেন স্টাসির গাড়ি। ছয়টা খচ্চর মিলে ঢাল বেয়ে টেনে আনছে ওটাকে। গতি অত্যন্ত ধীর। ওয়্যাগনটা পার হবার সময় রাস্তার পাশে ঝোপের ধারে বসে থাকা আগন্তুক দু’জনকে অলস চোখে দেখল রুবেন স্টাসি। চিনতে পেরে হাত নাড়ল।
হলুদ একটা কেন্নোর মত ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ওয়্যাগনটা। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এল ওটার আকৃতি। একটু পর আর দেখা গেল না।
‘মাইক,’ হঠাৎ বলল বেনন, উত্তেজিত বোধ করছে। ‘একটা কথা মনে হলো। শুনলে আমাকে তুমি পাগল ভাবতে পারো।’
‘বলো।’
ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে বেননের। ধীর গলায় বলল, ‘আমার ধারণা এই মাত্র আমরা বেন স্টার্ককে দেখলাম।’
ফাঁকা দৃষ্টিতে বেননকে দেখল ফ্ল্যানারি। আস্তে আস্তে তার ঠোঁট প্রসারিত হলো। হাসছে। বলল, ‘তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও, রন জনসন। জেলখানা বিধ্বস্ত হবার সময় মাথায় বোধহয় জোর আঘাত লেগেছে।’
‘বললাম না আমাকে তোমার পাগল মনে হবে?’
চুপ করে আছে ফ্ল্যানারি। বেনন বলল, ‘কথাটা আগে শুনে দেখো।’ কিকিং হর্স থেকে রওনা হওয়া এবং ফ্রস্টি ওকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল—সবই খুলে বলল ও। তারপর বলল, ‘তারপর আমি এলডোরাডোতে এলাম শেরিফকে সতর্ক করে দিতে। পরে মনে পড়ল আমি একটা চুরি করা ঘোড়া ব্যবহার করছি। রুবেনকে পেয়ে তার মাধ্যমে শেরিফকে জানানোর ব্যবস্থা করলাম। সে কথা দিল আইনকে জানাবে। কিন্তু সে যা করল সেটা হচ্ছে আমাকে ধরিয়ে দেয়া। জেলখানায় বোমা মারল যাতে আমি মারা পড়ি। আমি নিঃসন্দেহ যে রুবেন স্টাসিই বেন স্টার্ক।’
‘হয়তো তোমার কথা সত্যি,’ দ্বিধাজড়িত স্বরে বলল ফ্ল্যানারি ‘আমি নিশ্চিত,’ বলল বেনন। ‘রুবেনের ওয়্যাগনটা খালি থাকার কথা। কাল সন্ধ্যায় সে সমস্ত মালপত্র বিক্রি করে দিয়েছে। অথচ লক্ষ করেছ যে ছয়টা খচ্চর মিলে কত কষ্টে ওয়্যাগনটা ঢাল বেয়ে তুলে আনছিল? আমার ধারণা লুটের মাল নিয়ে সরে পড়ছে স্টার্ক সবার চোখের সামনে। খেয়াল করেছ ওয়্যাগনের বাক্সটা কী ওজন নিয়ে চেপে বসে ছিল স্প্রিঙের ওপর?’
‘তোমার চোখে তো কিছুই এড়ায় না দেখছি!’ কিছুটা উৎসাহিত মনে হলো ফ্ল্যানারিকে দেখে।
উঠে দাঁড়াল বেনন। ‘চিকিৎসকের ছদ্মবেশের চেয়ে ভাল বেন স্টার্কের জন্যে আর কী হতে পারে! বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ডাকাতির পরিকল্পনা করে সে এটা কে ভাবতে পারবে? টোকা মেরে দেখা দরকার।’ ঘোড়ার দিকে পা বাড়াল ও।
‘আমিও আসছি,’ উঠে দাঁড়াল ফ্ল্যানারি। ‘বাউন্টি মানি অর্ধেক অর্ধেক।’
‘রাজি।’
’দেখাই যাক না চেষ্টা করে।’
ঢাল বেয়ে ওঠার পর সামনে বিস্তীর্ণ উপত্যকা চোখে পড়ল ওদের। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে জিলা নদী। সূর্যের আলোয় রুপোলি একটা সুতোর মত লাগছে দেখতে।
‘নদীতে বান ডেকেছে,’ মন্তব্য করল ফ্ল্যানারি। ‘পাহাড়ে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে।’
বেননের চোখ সামনে নিবদ্ধ। দূরে হলুদ একটা ফোঁটা দেখা যাচ্ছে ধূসরতায়। আঙুল তাক করে বিন্দুটা দেখাল বেনন। ফ্ল্যানারি বলল, ‘তাড়াহুড়ো করে ঘোড়াগুলোকে পরিশ্রান্ত করার কোন দরকার নেই। সামনে সারাদিন পড়ে আছে। আর আমাদের বন্ধুর সামনে এগোনোর পথও বন্ধ। জিলার পানি না কমলে ওয়্যাগন নিয়ে পার হতে পারবে না সে।’
এক ঘণ্টা পর উপত্যকার মেঝেতে নেমে এল ওরা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন হলুদ ওয়্যাগনটাকে। আর মাত্র দু’মাইল সামনে আছে ওটা।
পাশাপাশি চলেছে বেনন আর ফ্ল্যানারি দুলকি চালে। ‘প্রফেসর হয়তো ত্যাড়া কথায় আমাদের চামড়া ছিলে নেবে,’ উদাস গলায় মন্তব্য করল ফ্ল্যানারি। ‘এমনও হতে পারে আবার রসদ কিনে ওয়্যাগন ঠেসেছে সে। হয়তো সেজন্যেই খচ্চরগুলোকে ওটা কষ্ট করে টানতে হচ্ছে।’
না দমে বলল বেনন, ‘কিন্তু চিন্তা করে দেখো, আমি আইনকে সতর্ক করে দিতে বলার পরও কিছুই করেনি শেরিফ। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় শহরটায় আক্রমণ চালিয়েছে ডাকাত দল।’
ওরা ওয়্যাগনটার এক মাইলের মধ্যে চলে এসেছে।
হঠাৎ করেই গতি বাড়ল ওয়্যাগনের। প্রথমে দুলকি চালে ছুটতে শুরু করল খচ্চরগুলো। তারপর গতি আরও বেড়ে গেল। ছুটছে এখন জন্তুগুলো। বিপজ্জনক ভাবে হেলেদুলে এগিয়ে চলেছে ওয়্যাগনটা নদীর দিকে।
স্পারের স্পর্শে ঘোড়ার গতি বাড়াল বেনন আর ফ্ল্যানারি। বেননের মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। দোষী না হলে পালানোর চেষ্টা করবে কেন রুবেন স্টাসি?
সাপের মত আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে ওয়্যাগন। পূর্ণ গতিতে ঘোড়া নিয়ে ধাওয়া করছে বেনন আর মাইক ফ্ল্যানারি। রুবেন স্টাসিকে দেখতে পেল বেনন, উন্মত্তের মত রাশ ঝাঁকি দিয়ে গতি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে সে।
সামনে নদীটা দেখা যাচ্ছে। বিপুল জলরাশি বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে। নিশ্চিত একটা বাধা। এত ভরা নদী পার হবার কোন উপায় নেই ওয়্যাগন নিয়ে। স্রোতে ভেসে যাবে সব। এমনকী ঘোড়ায় করে পার হওয়াও এখন বিপজ্জনক। ভাল ফাঁদে আটকে গেছে প্রফেসর।
শেষ চেষ্টা করতে গিয়ে নদীর সমান্তরালে ওয়্যাগন ছোটাল প্রফেসর। উজানের দিকে চলেছে। মনে আশা কোথাও হয়তো পার হবার মত উপযুক্ত তীর পাওয়া যাবে। চাবুক কষাচ্ছে সে খচ্চরগুলোর পিঠে, তারপরও পরিশ্রান্ত জন্তুগুলোর গতি কমে যাচ্ছে।
বেনন আর ফ্ল্যানারি দু’জনই বুঝতে পারছে ধাওয়ার পরিসমাপ্তি শীঘ্রি ঘটতে চলেছে। ওদের অবাক করে দিয়ে ওয়্যাগনটা মোড় নিল। সোজা চলেছে উন্মত্ত নদীর দিকে! ওখানে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যু!
নীরবে ওয়্যাগনটাকে ঘুরতে দেখল ওরা। নদীর খাড়া পাড়ের দিকে ছুটে চলেছে ওটা।
‘এ স্রেফ আত্মহত্যা!’ বলল ফ্ল্যানারি। ‘পাগল হয়ে গেছে লোকটা। বদ্ধ উন্মাদ!’
রুবেনকে ওদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখল ওরা। পরমুহূর্তে শূন্যে লাফ দিল ওয়্যাগন। নিচে পড়ল একরাশ জল ছিটিয়ে।
‘নিজের চোখে না দেখলে কে বিশ্বাস করবে!’ বিড়বিড় করল ফ্ল্যানারি। শ্রাগ করল বেনন। ‘একটা কথা এখন নিশ্চিত যে রুবেন স্টাসিই ছিল বেন স্টার্ক।’
ওয়্যাগনটা যেখানে নদীতে পড়েছে সেখানে গিয়ে ঘোড়া থামাল ওরা। খাড়া পাড়ের নিচে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়। বিশ ফুট বা তারও কিছু বেশি নিচে হবে, পড়ে আছে ওয়্যাগনটা। অর্ধেক জমিতে, অর্ধেক নদীতে। ফেনা তুলে ওটাকে পাশ কাটাচ্ছে ছুটন্ত ‘স্রোত। এখনও লাগামে বাঁধা আছে খচ্চরগুলো। নদীতে ডুবে মারা গেছে। তীব্র স্রোত রুবেনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, আন্দাজ করল বেনন।
‘একেবারে উন্মাদ ছিল লোকটা,’ বিষণ্ণ স্বরে বলল ফ্ল্যানারি। ‘নিজে তো মরেইছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে নিরীহ ছয়টা খচ্চরের প্রাণ।’
‘লুটের মাল সরাতে পারেনি,’ কাজের কথায় এল বেনন। ‘সব কিছু ওই ওয়্যাগনেই আছে। নদীর পানি কমতে বড়জোর আর দু’দিন লাগবে, তারপর উদ্ধার করা যাবে সহজেই।’
ঘোড়া থেকে নেমে বিধ্বস্ত ওয়্যাগনটার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। ‘মাল টানার ঘোড়া লাগবে ওয়্যাগনটাকে সরাতে,’ মন্তব্য করল বেনন। ‘কাছের কোন – র্যাঞ্চে গিয়ে ঘোড়া সংগ্রহ করব আমি, তুমি পাহারায় থেকো। স্টার্কের দলবল
হাজির হতে পারে।’
‘আসবে না, এলেও কোন অসুবিধে নেই,’ বলল ফ্ল্যানারি। ‘লুটের মালের কাছে পাহারায় থাকতে ভালই লাগবে আমার। পুরস্কারের টাকা কীভাবে খরচ করব সেই স্বপ্ন দেখে সময় কাটিয়ে দেব।’
কিছুক্ষণ ঘোড়াকে বিশ্রাম দিয়ে উপত্যকা ধরে ফিরে চলল বেনন, সতর্ক হয়ে আছে-নতুন কাউকে দেখলেই গা ঢাকা দেবে। মনের ভেতরটা কেমন যেন খচখচ করছে ওর। রুবেন স্টাসি ওরফে বেন স্টার্ক তার শেষ কাজটা উন্মাদের মত করেছে। ওর মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। লোকটা এত বোকা বা বেপরোয়া নয় যে অমন একটা কাজ করবে। নিশ্চিত মৃত্যুকে নির্দ্বিধায় বরণ করে নেবে তেমন মানুষ বলে মনে হয়নি বেন স্টার্ককে ওর।
ধরা পড়ার ভয়ে লোকটা আত্মহত্যা করবে সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত হত যদি সে লড়াই করে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করত। মন যা-ই বলুক নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করার উপায় নেই। সত্যি লোকটা নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে ওয়্যাগনটা নদীতে নামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে।
সবচেয়ে কাছের র্যাঞ্চটা আইসিসিই হবে, আন্দাজ করল বেনন। ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওভারহোলসার এখনও বোধহয় তার দলবল নিয়ে আইসিসিতেই অবস্থান করছে। শেষ সময়ে কৃতিত্ব তার হাতে তুলে দেবার কোন অর্থ নেই। উল্টোদিকে এগিয়ে চলল ও।
পরদিন সকালে থ্রী পিস্ নামের টিলা সারির কাছে একটা র্যাঞ্চ চোখে পড়ল ওর। সামান্য টাকাতেই খচ্চর ধার দিতে রাজি হয়ে গেল র্যাঞ্চার। সঙ্গে সে-ও এল। স্টার্ক আর নেই জেনে খুশি।
সন্ধ্যার সময় বিধ্বস্ত ওয়্যাগনটার কাছে পৌছল ওরা। ফ্ল্যানারিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
অস্বস্তির বোধ পেয়ে বসল বেননকে। কোন ঘোড়া নেই। ফ্ল্যানারির দেখা নেই। ক্যাম্পের আগুনেরও কোন চিহ্ন নেই। মরুভূমির অন্যান্য নদীর মতই জিলার পানিও নেমে গেছে দ্রুত। ডাঙায় নদীর পাড়ে পড়ে আছে পরিত্যক্ত ওয়্যাগনটা।
ফ্ল্যানারি কোথায়?
র্যাঞ্চারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বেনন। ভাবছে, ফ্ল্যানারি কি তা হলে লুটের মাল নিয়ে একাই সরে পড়ল? তেমন লোক বলে মনে হয়নি তাকে।
থেমে দাঁড়িয়ে খচ্চরগুলোকে সামলাচ্ছে র্যাঞ্চার।
একটা ক্যাম্পফায়ারের আগুন চোখে পড়ল বেননের। নিচু স্বরে গাল বকল ও। আগুনের ধারেই পড়ে আছে আড়ষ্ট শরীরটা। নিভে যাওয়া আগুনের ওপর বসে আছে একটা কফি পট। ফ্ল্যানারির লাশের ডান হাতে এখনও একটা কফি মগ ধরা। হোলস্টার থেকে অস্ত্রটাও বের করতে পারেনি সে, তার আগেই অতর্কিত আক্রমণে মারা গেছে।
ঘোড়া থেকে নামল বেনন। লাশের কাছে গিয়ে দেখল হৃৎপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ফ্ল্যানারির। বেশি কষ্ট পেয়ে মরতে হয়নি তাকে।
গম্ভীর হয়ে উঠল বেননের চেহারা।