খুনে ক্যানিয়ন – ১০

দশ

প্রফেসর রুবেনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই বেননের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা উঠানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওকে দেখে ফেলতে পারে। ফ্ল্যানারিকে মুক্ত করতে গিয়ে কারও চোখে ধরা পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। ছায়ার মত বেরিয়ে এল ও বাঙ্ক হাউসের বারান্দায়, তারপর দেয়াল ঘেঁষে খালি করালের দিকে পা টিপে টিপে এগোল। রাতের মত ঘোড়াগুলোকে একটা বেড়া দেয়া ঘাসজমিতে ছেড়ে দিয়েছে র‍্যাংলার। সকালে ওগুলোকে আবার করালে ফিরিয়ে আনা হবে। ওখান থেকে ঘোড়া ধরে যে যার মত রেঞ্জ প্রহরায় বেরিয়ে পড়বে গানম্যানরা। পোল গেটের কাছে খড় রাখার বার্নে নিজেদের স্যাডল- গিয়ার রেখেছে বেশির ভাগ লোক।

করালের রেইলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকল বেনন, চলে এল অপর প্রান্তে। বার্নের ছায়ায় মিশে যেতে কোন অসুবিধে হলো না। প্রথমে যে স্যাডলটা-পেল সেটাই তুলে নিল ও কাঁধে। স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট আর ব্রিড্‌ল্ অন্য হাতে তুলে নিয়ে পা বাড়াল ঘাসজমির দিকে। জানে, মাইক ফ্ল্যানারিকে ওর মুক্ত করার পরিকল্পনা শুধু তখনই সফল হবে, যদি ও ঘোড়াগুলোকে ভয় না পাইয়ে একটা ঘোড়ায় স্যাডল চাপাতে পারে। রাতে অপরিচিত কাউকে দেখলে ঘাবড়ে যায় ঘোড়া। ওরা যদি ভয় পায় তা হলে ঘুরে ঘুরে বেড়ার পাশ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করবে। তাতে শক্ত জমিতে খুরের যে আওয়াজ হবে তা ধরা পড়ার জন্যে যথেষ্টরও বেশি। রাত বিরেতে অন্যের স্যাডল ব্রিডল সহ ধরা পড়লে ফ্ল্যানারির মতই ছয় ফুট বাই দুই ফুট একটা জমি বরাদ্দ করা হবে ওকে চিরদিনের জন্যে।

সরঞ্জাম নামিয়ে তিন সারি কাঁটাতারের ভেতর দিয়ে প্যাসচারে ঢুকল বেনন। স্যাডল থেকে খুলে নিল ল্যাসো, তারপর নিঃশব্দে ধীর পায়ে এগোল ঝিমন্ত ঘোড়াগুলোর দিকে। ছায়ায় আবছা আকৃতি দেখা যাচ্ছে ওগুলোর। কোন কোনটা দাঁড়িয়ে আছে, আবার কোন কোনটা শুয়ে। ওকে এগোতে দেখে কয়েকটা ঘোড়া সরে গেল। কান খাড়া করে ফেলেছে কে লোকটা তা আন্দাজ করার জন্যে। থমকে থেমে দাঁড়াল বেনন। এক চুলও নড়ছে না। তারপর আস্তে আস্তে ডান হাতে একটা ফাঁস তৈরি করল। ওর চোখ স্থির হয়ে আছে কাছেই শুয়ে থাকা একটা ডান ঘোড়ার ওপর। হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল ঘোড়াটা। বাতাসে ভেসে গেল ল্যাসো, আলগোছে ঘোড়াটার মাথা গলে গলায় আটকে গেল।

ধীরেসুস্থে দড়ি ধরে সামনে বাড়ল বেনন। আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে কথা বলছে ঘোড়াটাকে নিশ্চিন্ত করতে। পনেরো মিনিট পর ঘোড়াটা নিয়ে কামারশালার পাশে চলে আসতে পারল ও। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখার কোন উপায় নেই। দিয়াশলাইও জ্বালানো যাবে না। ঘোড়া রেখে ভেতরে ঢুকল ও। তাকের ওপর হাতড়াতেই হাতে লেগে গেল ঘোড়ার স্যাডলে মাখানো গ্রিজ। এই গ্রিজ দিয়ে ঘোড়ার চামড়ার ছিলে যাওয়া অংশের চিকিৎসা করা হয়। রুমালে হাত মুছল বেনন। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেল যা খুঁজতে এসেছে। একটা রানিং আয়রন। লম্বা একটা লোহার দণ্ড।

বাইরে বেরিয়ে তারার আলোয় থামল কিছুক্ষণের জন্যে, তারপর চলে এল অ্যাডোবির ঘরটার কাছে। আড়া নামিয়ে সাবধানে সামান্য ফাঁক করল দরজাটা। ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘মাইক, জেগে আছো?’

অন্ধকার থেকে জবাব এল, ‘রন! ঈশ্বর তোমার ভাল করুন।’ ভেতরে নড়াচড়ার আওয়াজ হলো। ফ্ল্যানারি আবার বলে উঠল, ‘এমনিতেই মাথা ফেটে গেছে, তার ওপর দুশ্চিন্তা-ঘুম কি আর আসে?’

‘শীঘ্রি ভেগে না পড়লে চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে তোমাকে,’ শুকনো গলায় জানাল বেনন। এক পাশে সরে ফ্ল্যানারিকে বের হবার সুযোগ করে দিল। ‘সাবধান, উঠানে একটা মেয়ে আর তার প্রেমিক আছে, কোন আওয়াজ কোরো না।’

‘এখানে মেয়ে?’

‘হ্যাঁ। রিয়া নাম। র‍্যাঞ্চটার আসল মালিক মারা গেছে। তার বোন।’

আস্তে করে রানিং আয়রনটা মাটিতে নামিয়ে রাখল বেনন, তারপর ফ্ল্যানারির হাত ধরে ছায়ার মাঝ দিয়ে সাবধানে এগিয়ে চলল কামারশালার দিকে। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে ঘাসজমি-তার থেকে একটু দূরে কালো আকৃতিটা র‍্যাঞ্চ হাউস। চারপাশে বিরাজ করছে কবরের নিস্তব্ধতা।

‘কামারের ঘরের পাশে ঘোড়া পাবে,’ সরাসরি কাজের কথায় এল বেনন। ‘তার কেটে আগে সব ঘোড়া তাড়িয়ে দাও, তারপর স্যাডল চাপানো ঘোড়াটায় চেপে পালাও যত দ্রুত সম্ভব। আশা করি আমরা তোমার পিছু নিতে পারব না।’

‘আর তুমি?’ জিজ্ঞেস করল ফ্ল্যানারি। ‘তুমি আসছ না আমার সঙ্গে?’

‘তুমি পালানোর আগেই বাঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়ব আমি।’

‘অনেক ধন্যবাদ, রন।’

‘এ তোমার প্রাপ্য ছিল,’ বলল বেনন। ‘অ্যাপাচির আক্রমণের কথা মনে আছে? তুমি সময়মত গুলি না করলে এখন আমার মাথার চামড়া কোন এক অ্যাপাচির গলায় ঝুলত।’

কামারশালার দিকে পা বাড়াল ফ্ল্যানারি, অন্ধকারে মিশে গেল দেখতে দেখতে। বাঙ্ক হাউসে ফিরে এল বেনন, বাঙ্কে উঠে পড়ল। চারপাশে ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে ঘুমন্ত গানম্যানরা। স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেনন। ও ভাবেনি এত সহজে সমস্যাটা মিটে যাবে। কান খাড়া করে রাখল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরই হঠাৎ করে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ দূরাগত বজ্রপাতের মত শোনা গেল। বাঙ্ক হাউসের ভেতর গম গম করে উঠল সে আওয়াজ। চারপাশে মোচড়ামুচড়ির আওয়াজ পেল বেনন। ঘুম ভাঙছে লোকদের।

‘আমাদের ঘোড়া নাকি?’ ঘুমজড়িত স্বরে জিজ্ঞেস করল একজন।

‘বোধহয় কুগারের গন্ধ পেয়েছে,’ জবাব দিল আরেকজন।

রেডের তীক্ষ্ণ শুষ্ক কণ্ঠস্বর ধমকে উঠল, ‘কথা বন্ধ! জলদি বাইরে বেরিয়ে দেখো কী হচ্ছে।’

স্টেবল লণ্ঠনে আগুন জ্বালল একজন। ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে বাইরে বের হলো ওরা। দু’হাতে প্যান্ট টেনে পরছে। জুতোর ফিতে বাঁধছে কেউ কেউ। বাইরে থেকে দৌড়ে এল একজন, উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘কোন্ হারামজাদা যেন আমাদের ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে!’

অনেকেই জানত না বন্দি করে রাখা হয়েছে কাউকে। প্রথমে তার উধাও হওয়া আবিষ্কার করল রেড। আকাশে তখন দেখা দিয়েছে ভোরের আভাস-সরু একটা রুপোলি রেখা।

রেডের চিৎকার শুনে অ্যাডোবির ঘরটার দিকে পা বাড়াল বেনন। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেড আর রিয়ো।

‘মনে করে দেখো ঠিক ঠিক দরজা বন্ধ করেছিলে কিনা,’ বলল রেড।

‘আমাকে কি পাগল মনে হয়?’ জবাবে বলল বেনন। তাকাল রিয়োর দিকে। মাথা ঝাঁকাল গানম্যান। পাগল মনে হয় কি অন্য কথাটায় সে সম্মতি দিল তা ঠিক বোঝা গেল না স্পষ্ট।

‘কেউ একজন মুক্ত করে দিয়েছে হারামজাদাকে,’ মন্তব্য করল রেড।

উবু হয়ে রানিং আয়রনটা হাতে তুলে নিল রিয়ো।

‘আমার তো মনে হচ্ছে নিজেই পালিয়েছে হারামজাদা,’ বলল বেনন।

‘তাই মনে হয়,’ সায় দিল রিয়ো। ‘ভেতর থেকে আড়াটা খুলে ফেলেছে।’

তিক্ত গলায় বলল রেড, ‘তারমানে বলতে চাইছ ওর কাছে একটা রানিং আয়রন ছিল আর তোমরা তা সার্চ করে পাওনি?’

‘সার্চ করা হয়নি ওকে,’ জানাল বেনন। ‘অস্ত্র নিয়েই আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম।’

রিয়ো বলল, ‘অ্যাডোবির ভেতরেই হয়তো ছিল আয়রনটা। অনেকদিন হলো ঘরটা পরিষ্কার করা হয় না।’

.

সপ্তাহ পুরো হবার আগেই উধাও হয়ে গেল রেড তার ঘোড়াটা নিয়ে। কোথায় যাচ্ছে তা কারও কাছে বলে গেল না সে। তবে ভাব দেখে বেননের মনে হলো প্রত্যেকেই জানে কেন এবং কোথায় গেছে রেড কেলটন। আন্দাজ করল, বেন স্টার্ক তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

রেড যেদিন গেল সেদিনই হাজির হলো নতুন ফোরম্যান। জানা গেল তার নাম ফ্রস্টি। সাপারের সময় নতুন মনিবকে দেখল বেনন। বুঝতে পারল খামোকা এর নাম ফ্রস্টি হয়নি। কুড়োলের মত চেহারা তার, দড়ির মত পাকানো দেহ। চোখ দুটোয় বরফের মত শীতল দৃষ্টি। রোদে পোড়া বাদামী গোঁফ তার রেখার মত সরু ঠোঁটের ওপর ঝুলে আছে। নিজেও সে রোদে পোড়া, পুরানো স্যাডলের মত গায়ের রং গাঢ় বাদামী।

সাপারের পুরোটা সময় সে একটা কথাও বলল না। সবার প্লেট খালি হবার পর যখন সবাই সিগারেট ধরাচ্ছে তখন টেবিলে সে মগটা ঠুকল। টেবিলের দু’ধারে বসে থাকা গানম্যানদের ওপর ঘুরে এল তার সাপের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি, স্থির হলো রিয়োর ওপর। ‘রিয়ো আর রন, ভোরে ক্যানিয়নে যাবার জন্যে তৈরি থাকবে।’

‘অনেক দিন পর রেঞ্জের বাইরে যেতে ভাল লাগবে,’ বলল বেনন।

‘তোমার কাছ থেকে কিছু শোনার দরকার হলে আমি নিজে তোমাকে জিজ্ঞেস করব,’ ধমকে উঠল ফ্রস্টি। ‘নিজে থেকে কোন কথা বলবে না ভবিষ্যতে আর।’

কথা শেষ করে সে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

রাতটা আর কোন ঝামেলা ছাড়াই পার হলো।

ভোরে রওনা হলো বেনন আর রিয়ো। রেঞ্জ পেরিয়ে জিলা নদীর উজানের দিকে চলল। রেঞ্জ শেষ হতেই শুরু হলো মসৃণ ঢেউ খেলানো ঘাসে ছাওয়া টিলার পর টিলার সারি। দ্রুত এগোনোর ইচ্ছেটা জোর করে দমিয়ে রাখল বেনন। অনুভব করছে, শেষ পর্যন্ত ওকে দলের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে সম্ভবত বেন স্টার্ক। সম্ভবত এবার রহস্যময় বেন স্টার্কের মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য হবে ওর। আইসিসি র‍্যাঞ্চে সময় কাটানোটা এখন আর বৃথা সময়ের অপচয় বলে মনে হচ্ছে না।

দক্ষিণে চলেছে ওরা নদীর পাশাপাশি। সামনে রুক্ষ ভাঙাচোরা জমি। একটু পর পর গালি আর ক্যানিয়ন-মিশে গেছে অ্যারোয়োগুলোর সঙ্গে। বুনো একটা দুর্গম অঞ্চল এটা, তবে রিয়োর ভাব দেখে মনে হলো এই এলাকার প্রতিটি পাথর তার চেনা।

‘যেলোক এই ট্রেইলে চলতে পারে সে পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া গিরগিটিকেও ট্র্যাক করতে পারবে,’ মন্তব্য না করে পারল না বেনন।

রিয়ো বলল, ‘চোখ বন্ধ করে পথ চলতে পারব আমি। বহু আগে থেকে এখানে আছি।’

‘তাই নাকি!’ মুখ খোলাতে চাইছে বেনন।

‘হুঁ। বেন স্টার্ক যখন শোনেওনি যে এলডোরাডো একটা ট্রেডিং পোস্ট, সেই তখন থেকে আমি এই এলাকায় গরু রাসলিং করতাম।’

রিয়োর মন মেজাজ বেশ ভাল মনে হচ্ছে বেননের। যদিও লোকটা কখনও কখনও মাইলের পর মাইল নীরব থাকছে। একসময় বলতে শুরু করল সে নিজের কথা।

‘লর্ডসবার্গের কাছে আমার জন্ম। ওখানেই মানুষ হয়েছি। যত গরু আমি দক্ষিণে নিয়ে গেছি তার জন্যে যদি এক ডলার করেও পেতাম তা হলে বিরাট বড়লোক হয়ে যেতাম। ফ্রস্টি ছিল আমার সঙ্গী। একবার স্টীল ক্রীকের কাছে আমাদের ওপর হামলা করে বসে পাসি। জঙ্গলে পালাতে বাধ্য হই আমরা। ফ্রস্টির ঘোড়াটা মারা গিয়েছিল। দু’জনে আমার ঘোড়াটায় চাপলাম। জোরে হাঁটার ক্ষমতাও ছিল না ওটার।’ হাসল রিয়ো। ‘মনে হচ্ছিল ফাঁসির দড়ি এড়াতে পারব না কিছুতেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের চোখে ধুলো দিতে পারলাম আমরা।’ তাকাল সে বেননের দিকে। ‘জানতে চাও জিলার সবচেয়ে গোপন লুকানোর আস্তানা কোনটা?’

‘নিশ্চয়ই,’ উৎসাহী স্বরে বলল বেনন। ‘আইনের তাড়া খেলে ওটা আমার কাজে আসবে।’

নীরব হয়ে গেল রিয়ো। কিছুক্ষণ পর একটা পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে এগোতে হলো। অমসৃণ একটা দেয়াল। এখানে ওখানে ফাটা। সেসব জায়গায় গজিয়েছে নানা ধরনের বুনো গাছ। কোন কোন খাঁজ এতই গভীর যে ভেতরটা অন্ধকার লাগছে দেখতে। সাপখোপের জন্যে আদর্শ আশ্রয়।

একটা ফাটলের ভেতর থেকে বের হয়ে আকাশে মাথা তুলেছে দীর্ঘ একটা বুড়ো পাইন গাছ। বয়সের ভারে কাণ্ড ফেটে ফেটে গেছে ওটার। গাছটা পার হয়েই বেননকে বিস্মিত করে ঘোড়া থামাল রিয়ো। ফাটলটা এতই সরু যে কোনমতে ভেতরে ঢুকতে পারবে একটা ঘোড়া। ভেতরে ঢুকল রিয়ো। অনুসরণ করল বেনন। বুঝতে পারছে না লোকটার মতলব। সামনে স্পষ্টতই দু’পাশ থেকে চেপে এসে বন্ধ হয়ে গেছে এগোনোর পথ।

এগিয়ে চলেছে রিয়ো। পাশ থেকে বের হয়ে আসা একটা পাথর এড়াতে এক পাশে কাত হতে হলো বেননকে। ওটা পার হতেই বিস্ময়ে মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো ওর। উধাও হয়ে গেছে রিয়ো!

রহস্যটা সহসাই আর রহস্য থাকল না। ঘোড়াটা আর কয়েক পা এগোতেই ও দেখল দেয়ালের গায়ে বেশ বড় একটা গুহা। একেবারে কাছে না যাওয়া পর্যন্ত আবছা অন্ধকারে ওটা চোখে পড়ে না। আবার রিয়োকে দেখা যাচ্ছে। সরু একটা করিডর ধরে এগিয়ে চলেছে সে। পিছু নিল বেনন।

একটু এগোতেই দু’পাশের দেয়াল সরে গিয়ে সামনের পথ চওড়া হয়ে গেল। ওপরে উন্মুক্ত আকাশ। সূর্যের আলোয় জায়গাটা আলোকিত। ছোট্ট একটা বক্স ক্যানিয়নে হাজির হয়েছে ওরা। চারপাশে টিলার সুউচ্চ দেয়াল। ক্যানিয়নটা দৈর্ঘ্যে এবং চওড়ায় একশো গজের বেশি হবে না।

ঘোড়া থামাল রিয়ো, গম্ভীর চেহারায় বেননের দিকে তাকাল।

‘অবিশ্বাস্য!’ সত্যি কথাটাই বলল বেনন, বিস্ময় লুকানোর কোন চেষ্টা করল না।

‘পানিও আছে এখানে,’ বলল রিয়ো। রাশ নেড়ে ঘোড়াটাকে সামনে এক সারি সবুজ চ্যাপারাল গাছের দিকে নিয়ে চলল। পাথুরে দেয়ালের ফাটল থেকে চুইয়ে চুইয়ে নেমে এসে ছোট একটা ডোবায় জমেছে পাহাড়ী ঝর্নার পানি।

দু’জনই ওরা নামল ঘোড়া থেকে, আকণ্ঠ পান করল সুমিষ্ট সুশীতল জল। ঘোড়াগুলোর তৃষ্ণা মেটাল তারপর।

না ভেবেই রুমালটা বের করে পানিতে চোবাল বেনন। ওর মনেই ছিল না এটা দিয়ে ঘোড়ার স্যাডলের নিচে মাখানোর গ্রিজ মুছেছিল ও কামারের দোকানে, অন্ধকারে। সবুজ-কালো দাগ লেপ্টে রয়ে গেছে স্পষ্ট। চট করে ওটা লুকিয়ে ফেলার ইচ্ছেটা কষ্ট করে দমন করল ও। বুঝতে পারছে রিয়োর ঝাপসা নীল চোখের দৃষ্টি কিছুই এড়াচ্ছে না। দাগটা দেখে কিছুই রিয়োর বোঝার কথা নয়। তবু বেনন বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে বাকস্কিনটার স্যাডল সোর ঠিক করতে গিয়ে রুমালটা নষ্ট করে ফেলেছি।’

বাদামী আউট-ল কোন কথা বলল না।

স্যাডলে উঠে বসল বেনন, দ্রুত রওনা হয়ে যাবার তাগিদ অনুভব করছে। ‘চলো এবার,’ বলল ও।

‘কোথাও যাচ্ছ না তুমি,’ শীতল গলায় জানাল রিয়ো। এক ঝাঁকিতে অস্ত্রটা বেরিয়ে এল তার হাতে।

বিস্মিত চোখে সিক্সগানের নলটার কালো গহ্বরের দিকে তাকাল বেনন। .৪৫ কোল্ট তাকিয়ে আছে ওর হৃৎপিণ্ডের দিকে। ঢোক গিলল বেনন।,

‘ঠাট্টা করছ নাকি!’

‘না,’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল রিয়ো। ‘তোমার বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়ে গেছে।’

‘পাগল হয়ে গেছ তুমি!’ বিড়বিড় করল বেনন। মন বলছে রুমালটা বের করা মাত্র ধরা পড়ে গেছে ও রিয়োর হাতে। কীভাবে এবং কেন তা ওর জানা নেই।

‘রেড কেলটন রানিং আয়রনের ধোঁকায় বুদ্ধ বনেছিল,’ বলল রেড, চোখে খেলা করছে চাতুরি, ‘আমি মোটেও বিশ্বাস করিনি। একটু ভাবতেই বুঝতে পারলাম বাঙ্ক হাউস থেকে বের হওয়া কোন বদমাশ কামারশালায় গিয়ে ওটা সংগ্রহ করেছে, তারপর মুক্ত করে দিয়েছে ওই বাউন্টি হান্টারকে।’

‘তার জন্যে আমাকে সন্দেহ করছ কেন?’

থুতু ফেলল রিয়ো। ‘দুটো বোকামি করেছ তুমি। প্রথমত, জুতো না খুলেই বাঙ্কে শুয়ে ছিলে তুমি, যেটা তুমি আগে কখনও করোনি। ব্যাপারটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়, কিন্তু তখনও সন্দেহটা স্থির বিশ্বাসে পরিণত হয়নি। তারপর দ্বিতীয়ত, তোমার রুমালে ওই গ্রিজ। ওটা আমাকে নিশ্চিত করে। কামারের ঘরে গ্রিজের দাগটা আমি দেখেছি। রানিং আয়রনের পাশেই ছিল গ্রিজ।’

‘গ্রিজ?’ প্রতিবাদের সুরে বলল বেনন। ‘বাকস্কিনের চিকিৎসা করতে গিয়ে ওটা রুমালে মাখিয়েছিলাম আমি।’

যেন ওর কথা শোনেইনি এমন সুরে বলল রিয়ো, ‘বাজি ধরতে পারি সেরাতে কামারের ঘরের ভেতরটা ছিল গাঢ় অন্ধকার। হাতড়াতে গিয়ে গ্রিজ লেগে যায় তোমার হাতে। রুমাল দিয়ে ওটা মোছো তুমি। তাছাড়া, তোমার ঘোড়ার স্যাডলের তলায় কোন ঘা নেই, আমি দেখেছি। কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনি ওটার গত কয়েক মাসে।’

টানটান হয়ে আছে বেননের পেশি। বুঝতে পারছে কথা বলে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার কোন উপায় নেই। রিয়ো তার ধারণায় একেবারেই নিশ্চিত। যেকোন মুহূর্তে ওই ৪৫ কোল্ট আগুন ঝরাবে ওর বুক লক্ষ্য করে। ভুল বোঝানোর সময় শেষ! এখন একমাত্র আশা যা ও করতে পারে, সেটা হচ্ছে বয়স্ক রিয়োর চেয়ে ওর গতি দ্রুত হবে, বেঁচে যাবে ও পাল্টা অস্ত্র ব্যবহার করে। যদিও সে সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। উদ্যত অস্ত্রের বিরুদ্ধে ড্র করা নির্বুদ্ধিতা, কিন্তু করার কিছু নেই এখন!

‘অনেক কথা বলেছ তুমি, বলল বেনন, ‘কিন্তু কোন প্রমাণ নেই তোমার হাতে।’

কথা শেষ হবার আগেই সিক্সগানের দিকে হাত বাড়িয়েছে বেনন, এক পাশে কাত হয়ে স্যাডল থেকে পড়ে যেতে যেতে বের করে আনল অস্ত্রটা, বুড়ো আঙুলে হ্যামার তুলে ট্রিগার স্পর্শ করল। ওর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল রিয়োর গুলি। বেননের গুলিও লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি, রিয়োর এক ফুট দূর দিয়ে গেল।

মাটিতে পড়ল বেনন, গড়িয়ে সরে গেল ঘোড়াটার কাছ থেকে, তারপর উঠে দাঁড়াল। রিয়ো তখনও অস্ত্র ঘোরাতে শুরু করেনি, চোখ দিয়ে বেননকে অনুসরণ করছে।

আবার গর্জে উঠল রিয়োর কোল্ট। বেননের পায়ের কাছে পাথরের কুচি ছড়িয়ে ছিটকে চলে গেল তার বুলেট। তৃতীয় গুলি লাগল বেননের বাকস্কিনের বুকে। ধড়াস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল জন্তুটা। কয়েকবার পা নেড়ে নিথর হয়ে গেল।

সামনে থেকে ঘোড়ার বাধাটা দূর হয়ে যেতেই কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হলো বেনন, গুলি করল দ্রুত-পরপর দু’বার।

রিয়োকে দেখে মনে হলো অদৃশ্য একটা হাত তাকে ধরে জোর স্যাডলের ওপর আধপাক ঘুরিয়ে দিয়েছে। বুক খামচে ধরল লোকটা,

থেকে অস্ত্র ফস্কে গেল, তারপর আস্তে করে কাত হয়ে পড়ে গেল সে মোড়ান পিঠ থেকে। মাটিতে পড়ে একবারও নড়ল না। প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেছে আগেই।

লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বেনন, অস্ত্র রিলোড করে নিল, সর্বক্ষণ ভাগ্যদেবীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। রিয়োর বদলে আসলে এখানে এখন পড়ে থাকার কথা ছিল ওর নিজের লাশ। বুঝতে পারছে রিয়োর বয়স আর বিশ বছর কম হলে বাঁচার কোন আশা ছিল না ওর। বয়স রিয়োকে ধীর করে দিয়েছিল। লোকটার জন্যে আফসোস হলো না ওর। বেঁচে থাকলে এভাবেই নিজের মৃত্যু কামনা করে রিয়োর মত লোকরা। অস্ত্র হাতে লড়াই করে মৃত্যু। কঠোর লোক ছিল সে, নিজের ধ্যান ধারণায় অবিচল এবং অনুগত।

সিক্সগানটা হোলস্টারে পুরে রাখল বেনন, রিয়োকে পাথুরে জমিতে কবর দেয়ার উপায় নেই দেখে কিছু পাথর খণ্ড এনে লাশটা ঢেকে দিল, যাতে শেয়াল শকুনের খাদ্য না হয়। এবারে নিজের স্যাডলটা খুলে রিয়োর ঘোড়ার স্যাডল খুলে সেটার জায়গায় বাঁধল ও, ধীর গতিতে রওনা হয়ে গেল ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে।

দক্ষিণে নদীর দিকে এগোতে এগোতে চিন্তায় ডুবে গেল ও। রিয়োর ঘোড়ায় চেপে ক্যানিয়নে একবার পৌছানোর পর কী ব্যবহার আশা করতে পারে ও? ওদের জানাতে হবে যে রিয়ো মারা গেছে। বলা যেতে পারত যে ট্রেইলে ওদের মাঝে ঝগড়া হয়, ফলাফল: গোলাগুলি বিনিময়ে রিয়োর মৃত্যু। কিন্তু সেটা ঠিক হবে? দলের আর কারও কাছে যদি রিয়ো বলে দিয়ে থাকে নিজের সন্দেহের কথা তা হলে ক্যানিয়নে বোধহয় অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু ওখানে যাবার ঝুঁকি না নিয়ে উপায়ও নেই কোন।

তবে ভরসার কথা যে রিয়ো স্বল্পভাষী লোক ছিল। সম্ভবত নিজের সন্দেহ সে নিজের কাছেই লালিত রেখেছিল, বলেনি আর কাউকে। গ্রিজের দাঁগওয়ালা রুমালটা দেখার আগে পর্যন্ত সে নিশ্চিত ছিল না যে বেননই ফ্ল্যানারিকে মুক্ত করে দিয়েছে। যেতে হবে ক্যানিয়নে, সিদ্ধান্ত নিল বেনন, এতদূর এসে এখন ফিরে যাবার কোন অর্থ হয় না। বেন স্টার্কের দলের সঙ্গে মিশে যাবার এই সুযোগ হেলায় হারালে আফসোস থেকে যাবে সারাজীবন।

এখন প্রধান সমস্যা খুনে ক্যানিয়ন খুঁজে বের করা। ওটা কোথায় তা আন্দাজ করতে পারছে বেনন, কিন্তু নিশ্চিত নয়। ভেবেচিন্তে ঘোড়াটাকে নিজের ইচ্ছেয় পথ চলতে দিল ও। ধূসরতার মাঝ দিয়ে পাথর খণ্ড পাশ কাটিয়ে আঁকাবাঁকা ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল ঘোড়াটা, ভাব দেখে মনে হলো জানে যে কোথায় যাচ্ছে ওটা। কিছুক্ষণ পরই একটা ধুলো ভরা ট্রেইল চোখে পড়ল বেননের। বহু ব্যবহৃত ট্রেইল। সম্প্রতি ব্যবহার করা হয়েছে। ঘোড়ার খুরের চিহ্ন তাই বলে। নির্দেশ দিতে হলো না, ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ডীন ঘোড়াটা।

ট্রেইল নিচু হয়ে একটা গালশের ভেতর দিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল ট্রেইল। সামনে দিয়ে অলস বয়ে চলেছে জিলা নদী। নদীর ওপর বিরাট একটা কটনউড গাছ ফেলে সেতু তৈরি করা হয়েছে। ওপারে অপ্রশস্ত একটা সমতলে সবুজ গাছ দেখা যাচ্ছে। পেছনে ক্লিফ। প্রাচীন পুয়েবলোর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে ক্লিফের গায়ে। সিঁড়ির পর উঠে গেছে সিঁড়ি, আস্তে আস্তে টিলার গায়ের দেয়ালটার গায়ে গভীর করে তৈরি করা হয়েছে। সিঁড়ির প্রতিটি তাকে একটা করে গুহামুখ দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট ঘর ওগুলো। দেখে মনে হচ্ছে বন্দিশালা। জানালা-দরজাগুলোয় কোন পাল্লা নেই, কালো মুখ হাঁ হয়ে আছে। ছাদগুলো কিছুটা ক্ষয়ে গেছে শত শত বছরের আবহাওয়ার অত্যাচারে।

সমতলে ঘাস খাচ্ছে বেশ কয়েকটা ঘোড়া। পুরুষ আর মেয়েরা পুয়েবলোর নিচে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।

রাশ হাতে তুলে নিয়ে ঘোড়া হাঁটিয়ে গাছের গুঁড়ির তৈরি সেতুর ওপর দিয়ে এগোল বেনন সাবধানে।

ওর আগমনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো না কারও মাঝে। ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে পার হয়ে গেল একজন অশ্বারোহী। পাথরের সিঁড়ির গোড়ায় বসা দাঁড়কাকের মত কালো চুলওয়ালা দু’জন মেক্সিকান তরুণী মিষ্টি হাসল বেননের উদ্দেশে।

প্রথম বারের মত খেয়াল করল বেনন, জমির সমতায় অবস্থিত ঘরগুলোতে কোন দরজা নেই। পুয়েবলোর গোড়ায় ওর ঘোড়া পৌঁছতে দেখতে পেল একটা অ্যাডোবি ঘরের দরজার বদলে আছে বড় একটা গর্ত। ওটা দিয়ে অনায়াসে ঢুকতে পারবে একজন লোক। ভেতর থেকে পুরুষমানুষের স্বর আর মহিলাদের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। ওখানে ঘোড়া থেকে পড়ল বেনন, ঘোড়াটা গ্রাউণ্ড হিচ করে ঘরের ভেতর ঢুকল গর্ত গলে।

সূর্যালোক থেকে আবছা আঁধারে প্রবেশ করায় প্রথমে কিছু দেখতে পেল না। থমকে দাঁড়িয়ে চোখ সইয়ে নিল আগে। সামনেই দেখতে পেল দুটো ব্যারেলের ওপর রাখা কাঠের একটা তক্তা। ওটাই অদক্ষ হাতে তৈরি বার কাউন্টার। তক্তার নিচে রাখা আছে বেশ কয়েকটা বাক্স। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো হোঁৎকা চেহারার বারটেণ্ডার বেননকে গম্ভীর দর্শন বিষণ্ণ একটা ব্লাড হাউণ্ডের কথা মনে পড়িয়ে দিল। তার মাথাটা বাদামী একটা ডিমের খোসার মতই ন্যাড়া। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, রক্তলাল। চোয়ালের মাংস ঝুলে পড়েছে নিচে।

কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা রুপোর ডলার বের করে তক্তার ওপর রাখল বেনন। সংক্ষেপে অর্ডার দিল, ‘বুরব।’

উবু হয়ে তক্তার পেছনে হাতড়াল বারকীপ। ভারী শরীরের তুলনায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সোজা হলো পরমুহূর্তে। তার হাতে ধরা নল-কাটা শটগানের ওপর আটকে গেল বেননের দৃষ্টি। সারাদিনে আজ দু’বার অস্ত্রের মুখোমুখি হতে হলো, তিক্ত মনে ভাবল বেনন।

‘আমি বুরবর কথা বলেছি, বন্দুকের গুলির কথা নয়, শুষ্ক গলায় বলল বেনন।

বারটেণ্ডারকে দেখে মাতাল মনে হচ্ছে, কিন্তু তার শটগান ধরা হাত কাঁপছে না একচুল।

‘রেড,’ হেঁকে উঠল লোকটা। ‘একে চেনো তুমি?’

পেছনে স্পারের চেইন ঝনঝন করতে শুনল বেনন। দীর্ঘদেহী ফোরম্যান পাশে এসে দাঁড়াল।

‘চিনি,’ বলল সে। ‘এ হচ্ছে রন জনসন। রিয়োর সঙ্গে আজকে এখানে আসার কথা ছিল ওর।’ বেননের দিকে তাকাল। বারটেণ্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ‘এ হচ্ছে আমাদের গলা ভেজানোর মালিক-হাউণ্ডি ম্যাগপাই।’

‘ও হাউণ্ড জাতের কুকুর হোক আর ম্যাগপাই পাখি হোক, ওকে দেখে বিরাট একটা হোঁৎকা ভালুক মনে হচ্ছে আমার। মদের ব্যারেলের কথাও মনে পড়ছে,’ শুকনো গলায় জানাল বেনন।

ঠোঁট প্রসারিত হলো বারকীপের। শটগানটা তক্তার পেছনে নামিয়ে রাখল সে, মোটা থলথলে একটা হাত বাড়িয়ে দিল বেননের দিকে। হাসিমুখে হাতটা গ্রহণ করে ঝাঁকিয়ে দিল বেনন। এবার একটা বোতল আর দুটো গ্লাস তক্তার ওপর রাখল হাউণ্ডি। মাথার ঝটকায় একটা টেবিলের দিকে ইশারা করল রেড কেলটন। তার পিছু নিয়ে বোতল গ্লাস হাতে টেবিলের দু’পাশে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় বসল বেনন। উল্টোদিকের চেয়ারটায় আসন নিল রেড।

বোতল থেকে তরল ঢালল বেনন গ্লাস দুটোয়, এক চুমুকে মদটুকু শেষ করে সিগার ধরাল। চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকাল চারদিকে। জীবনে কখনও এমন অদ্ভুত সেলুনে ঢোকেনি ও কখনও। ছাদের কয়েকটা চৌকো ফোকর দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করছে ঘরে। দেয়ালগুলো মসৃণ-ধবধবে সাদা। বাইরের উত্তাপের তুলনায় ভেতরটা বেশ শীতল।

কোনার একটা টেবিলে বসে তাস পেটাচ্ছে কঠোর চেহারার চার আউট-ল। আরেকটা টেবিলে মোটা এক সেনিয়রিটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা আরেক আউট-ল। সামান্যতেই হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা হচ্ছে সেনিয়রিটার।

রেডের কর্কশ গলার আওয়াজে মুখ ফেরাল বেনন।

‘রিয়ো আসেনি তোমার সঙ্গে?’

‘আসছিল, কিন্তু মাঝপথে আমাদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। সে এখন বেহেস্তের বাগানে হুর পরীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছে।’

‘তাই?’ তীক্ষ্ণ চোখে বেননকে দেখল রেড।

‘হ্যাঁ। ও-ই আগে ড্র করে। আমার ঘোড়াটা মারা যায়। জান বাঁচাতে পাল্টা গুলি করতে হয়েছিল আমাকে। এখন খারাপ লাগছে খুব। ব্যাপারটা এমন না হলেই ভাল হত।’

‘একেবারে যা-তা কাণ্ড,’ বিড়বিড় করল রেড। ‘রিয়োর মেজাজটা সবসময়েই চড়া ছিল, কিন্তু বিপদের সময় সঙ্গী হিসেবে ভাল ছিল সে নিঃসন্দেহে। খবরটা জানলে স্টার্ক ভাল ভাবে নেবে না।’

শ্রাগ করল বেনন। ‘সে ভাল ভাবে নেবে না ভেবে আমি কি গুলি খেয়ে মরব নাকি? আমাকে খুন না করে ক্ষান্ত হত না সে। সামান্য দু’এক কথায় ড্র করে বসল।’ সিগারে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল বেনন। ‘বেন স্টার্কের সঙ্গে আমার দেখা হবে কখন?’

‘এমনও হতে পারে ইতিমধ্যেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার,’ হালকা কণ্ঠে বলল রেড।

চট করে চারপাশে নজর বোলাল। ‘সে এখানেই আছে?’

‘না।’ বোতলটার দিকে ইঙ্গিত করল রেড। ‘বুরবঁটা আসলেই ভাল। মাল ঢালো আরও। পরেরটা পরে ভেবে দেখা যাবে।’

আবার গ্লাসে বুরব ঢালল বেনন। বুঝতে পারছে ঠিকই বলেছে রেড, সেলুনটা একটা গুহা হতে পারে, কিন্তু খুবই ভাল মানের মদ বিক্রি হয় এখানে।

আরাম করে বসে সিগারে টান দিল বেনন। ‘এই সেলুন কার নির্দেশে চলে?’

‘আপাতত আমি দায়িত্বে আছি। যত ইচ্ছে মদ গিলতে পারো। ফ্রী। স্টার্ক দেবে পয়সা।’

‘তা দিক, কিন্তু কোন উত্তেজনাপূর্ণ কাজ না থাকায় বিরক্তি ধরে গেছে আমার। কী করি বলো তো?’

‘শীঘ্রি পেয়ে যাবে বিপজ্জনক কাজ,’ আশ্বস্ত করল রেড। ‘এখন বোতলটা শেষ করো।’ উঠে দাঁড়াল সে, অলস পায়ে বেরিয়ে যাবার গর্তটার দিকে পা বাড়াল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে সিগার টানল বেনন। ভাবছে। বেন স্টার্ক গোপনচারী। একটা অস্পষ্ট ছায়ার চেয়েও বেশি রহস্যময়। এই ক্যানিয়নেরই কোথাও না কোথাও আছে সে। তবে খোলামেলা চলাফেরা বোধহয় তার নীতিবিরুদ্ধ।

আরেকটা ড্রিঙ্ক নিয়ে উঠে দাঁড়াল বেনন, দরজা নামের গর্তের দিকে পা বাড়াল। থামতে হলো ওকে মাঝপথে। হাউণ্ডি ম্যাগপাই তার চিকন গলায় চিৎকার করে ডেকেছে ওকে।

বেনন ঘুরে দাঁড়ানোয় বলল, ‘একটা জিনিস ভুলে ফেলে যাচ্ছ তুমি।’ রুপোর ডলারটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল সে বেননের দিকে। খপ করে ওটা ক্যাচ ধরল বেনন, ও ভুলে গিয়েছিল এখানে মদের দাম পরিশোধ করে বেন স্টার্ক স্বয়ং।

মনে একটা প্রশ্ন জাগল। রেড কেলটনই কি আসলে বেন স্টার্ক? ভ্রূ কুঁচকে উঠল ওর। না বোধহয়। লোকটাকে তেমন কর্তৃত্বপরায়ণ বা সংগঠনী শক্তির অধিকারী বলে মনে হয়নি ওর।

বাইরে এসে পুয়েবলোর দিকে তাকাল ও। সারি সারি জানালা আর দরজার ফুটোগুলো দেখল। তাকের পর তাক গুহাতে বাসা বেঁধেছে আউট-লরা। চমৎকার আস্তানা। আইসিসি রেঞ্জ পার না হয়ে এদিকে আসা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। মনে প্রশ্ন এল, কারা বানিয়েছিল এই দুর্গম ক্যানিয়নে সুবিশাল পাহাড়ী আবাস? কাদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে সেই সভ্যতা? জবাব জানা নেই ওর।

কাছেই একটা কুয়ো। কোমর সমান উঁচু পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ঘোড়াটাকে ওখান থেকে পানি তুলে খাইয়ে স্যাডল খুলল বেনন, তারপর ঘোড়ার পাছায় আলতো চাপড় মারল। ইঙ্গিত বুঝে ওটা চলে গেল ঘাস খেতে ব্যস্ত অন্য ঘোড়াগুলোর কাছে, মুখ ডোবাল ঘাসে। ঘোড়াটার আচরণ দেখে বেননের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে রিয়ো প্রায়শই এই ক্যানিয়নে আসত।

মালপত্র আর গিটার নিয়ে সবচেয়ে কাছের পাথুরে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ও। প্রথম তাকে উঠে সরু বারান্দা ধরে এগোল। অনেকগুলো ঘর পরপর—বেশিরভাগই খালি। খালি একটা ঘর বেছে নিয়ে রোল খুলে কম্বল বিছাল ও, তারপর শুয়ে পড়ল দুপুরের বিশ্রাম নিতে।

ওর যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে, নদীর ওপর দিয়ে ক্যানিয়নের দিকে এগিয়ে আসছে সাঁঝের ছায়া। নদীর দিক থেকে শীতল আরামপ্রদ বাতাস বইছে। ক্যানিয়নে বিরাজ করছে প্রশান্তিময় নীরবতা।

অন্ধকার আরও গাঢ় হতে গিটারটা হাতে তুলে নিল ও। দরজার কাছে বসে আনমনে বাজাতে শুরু করল একটা একাকীত্বে ভরা বিষাদময় মিষ্টি সুর। প্রত্যন্ত এই ক্যানিয়নের নীরবতায় চমৎকার একটা আবহ সৃষ্টি হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *