খুনি – সমরেশ মজুমদার
এত তাড়াতাঢ়ি সন্ধে হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি ওরা। কাউকে না বলে দশ মাইল দূরে পলাশবাড়িতে খেলতে এসেছিল হায়ারে, এখন সাইকেলে উঠে সন্তুর বুক ঢিপঢিপ করছে, দীপুর মুখ শুকনো। দিনটাকে যদি হনুমানের মতো আর একটু ধরে রাখা যেত তা হলে পাঁই পাঁই করে ঠিক বাড়ি পৌঁছে যেতে পারত।
হাওয়ায় সাইকেল দুটো যেন উড়ছিল৷ পিচের রাস্তাটা মসৃণ এবং ঢালু। কিন্তু মরাঘাটের মোড় পার হতেই টুপ করে সূর্যটা ডুবে গিয়ে সন্ধেটাকে ছুড়ে দিল চার পাশে। উত্তেজনায় ওরা এতক্ষণ কথা বলছিল না। সামনের রাস্তাটা যখন কালো হয়ে গেল, দু’পাশে জঙ্গলের ঝিঁঝিগুলো যখন একসঙ্গে শব্দ করে উঠল তখন দীপু বলল, “আমি কিছু দেখতে পারছি না রে।” সন্তুর কপালে ঘাম কিন্তু হাত-পা ঠান্ডা, ফিসফিসিয়ে বলল, “জোরে চালা, এই জঙ্গলে হাতি আছে।”
ডুয়ার্সের ওদিকটায় হাতির আনাগোনা বেশি। দীপু বলল, “তা হলে গান গাইতে গাইতে চল।” বলেই “দুর্গম গিরি কান্তার মরু” গাইতে লাগল কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে। মাথার ওপরে রাস্তার দু’পাশের গাছের ঝাঁকড়া ডাল ছাদের মতো ঝুলে আছে। তার গায়ে বসে থাকা পাখির চিৎকার ওদের গানের শব্দে যেন থেমে গেল আচমকা। অন্ধকারে তিনটে শেয়াল একসঙ্গে ডেকে উঠল ঘাবড়ে গিয়ে।
বিনাগুড়ির মোড়টা পেরিয়ে গেল শাঁ করে। আর মাইল চারেক। তারপর কোনওরকমে সাইকেল রেখেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়া শুরু করে দেবে। একবার পড়তে আরম্ভ করলে বাবা আর কিছু বলবেন না, ওতে নাকি পড়ুয়ার মনোযোগ নষ্ট হয়। কিন্তু তার আগে বাবার মুখোমুখি হলে না-বলে সাইকেল নিয়ে সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকার জন্য—আরও জোরে প্যাডেলে চাপ দিল সন্তু। ওরা যখন “আজি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা” লাইনটায় পৌঁছেছে ঠিক তখনই ঘটে গেল ব্যাপারটা। দড়াম করে একটা শব্দ, সন্তুর মনে হল ও শুন্যে উঠে যাচ্ছে, সাইকেলের সিটটা পায়ের সঙ্গে জড়ানো। তারপরেই দুটো কনুই আর হাঁটু যেন থেঁতলে দিল পিচের রাস্তাটা। আর সেইসময়েই গায়ে কাঁটা দেওয়া আর্তনাদ উঠল অন্ধকার কাঁপিয়ে। ভয়ে ব্যথায় সিঁটিয়ে ছিল সন্তু, অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। খানিক বাদেই চাপা ডাক এল, “সন্তু, সন্তু, কোথায় তুই?”
আস্তে আস্তে উঠতে চেষ্টা করল সে। দীপুর গলা। কিন্তু সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর এবং হাত-পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। দীপুর কিছু হয়নি, বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে সে। “উঠে দাঁড়া, হেভি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তুই কেমন আছিস?”
কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সন্তু বলল, “ভাল।” সঙ্গে সঙ্গে ও টের পেল দু’হাত আর পা দিয়ে কিছু চটচটে জিনিস গড়িয়ে নামছে। রাস্তার একপাশে ওর সাইকেলটা কেমন বেঁকে পড়ে রয়েছে। দীপু সাইকেল থেকে নেমে সেটাকে টানাটানি করতে করতে বলল, “হ্যান্ডেলটা ঘুরে গিয়েছে, চালাতে পারবি? জলদি পালানো দরকার। লোকটা বোধহয় মরে গিয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল এবং এই সময় অন্ধকারেও সন্তু বুঝতে পারল রাস্তার একপাশে ছায়া ছায়া একটা মানুষের শরীর নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। লোকটা অন্ধকারে চুপচাপ তাসছিল আর সে ওকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে। দীপুর তাগাদায় ও কোনও রকমে সাইকেলে চাপল। হাত-পা জ্বলছে, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তার মানে কপাল থেকেও রক্ত ঝরছে। সাইকেলের পেছনের চাকা একটু বেঁকে যাওয়ায় ঘসঘস শব্দ হচ্ছে। লোকটার কাছ থেকে পালাতে চাইল ওরা। যদি ও মরে গিয়ে থাকে তা হলে পুলিশ নিশ্চয়ই ওকে ধরবে। ফাঁসি কিংবা জেল হয়ে যাবে। সন্তু কী করবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, “ও মরে গেছে?” দূরে আলো দেখা যাচ্ছে এখন। সাইকেলে গুম হয়ে বসে দীপু বলল, “হুঁ।”
“একবার ফিরে গিয়ে দেখবি?” সন্তুর শরীর ঠান্ডা, ব্যথাগুলো টের পাচ্ছে না।
“মাথা খারাপ! বইতে পড়িসনি খুনিরা খুনের স্পটে ফিরে যায় বলেই ধরা পড়ে।”
“আমি খুনি নাকি।” প্রায় কেঁদে ফেলল সন্তু।
“পুলিশ তাই বলবে। তোর সঙ্গে ছিলাম বলে আমিও বিপদে পড়ব। খুনির হেলপার। তাই তোর ধরা দেওয়া চলবে না। একটা প্ল্যান করা দরকার।
ওরা আলোর কাছাকাছি এসে যেতেই দীপু চমকে উঠল। “ইস, কী চেহারা করেছিস। এভাবে বাড়িতে ঢুকবি কী করে?” সন্তু শুনে কেঁদে ফেলল।
দীপু আবার মাথা খাটাল। “বাজারের মধ্যে দিয়ে গেলে সবাই টের পেয়ে যাবে। তার চেয়ে চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে বোবা কম্পাউন্ডারের কাছে চল, ওষুধ লাগানো দরকার।”
বোবা কম্পাউন্ডার একলা থাকেন। সম্ভকে দেখে ওষুধ লাগিয়ে একটা কাগজে খসখস করে লিখলেন, “কী করে হল?” দীপু গোটা গোটা অক্ষরে পাশে লিখে দিল, “গাছ থেকে পড়ে গেছে।” একগাদা ট্যাবলেট নিয়ে ওরা চোরের মতো বাড়ির সামনে এল। এখনও এদিকে ইলেকট্রিক আসেনি। দীপু অন্ধকার মাঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “খবরদার কাউকে কিছু বলবি না। এখন স্কুল ছুটি, তাই বাঁচোয়া। বাড়ি থেকে একদম বের হবি না। যা খবর আমি দিয়ে যাব। এখন আমরা ক্রিমিন্যাল।”
ডিটেকটিভ বই সস্তুও পড়ে, বুঝতে অসুবিধে হল না। বাড়িতে ঢুকতেই মা চিৎকার করে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বাবার চোখ দেখে সন্তু বুঝল, শরীরে ব্যান্ডেজ না থাকলে আজ আড়ংধোলাই খেতে হত।
সমস্ত শরীরে ব্যথা, সন্তু ঘুমুতে পারছিল না। লোকটা মরে গেল? অন্ধকারে চুপচাপ আসার কী দরকার ছিল? ওরা অবশ্য ঘন্টি বাজায়নি কিন্তু গান গাইছিল তো, শোনেনি লোকটা? সে একটা লোককে খুন করে ফেলল! ইচ্ছে করে করেনি এটা পুলিশকে কী ভাবে বোঝাবে? বাবাকে সত্যি কথা বলে দেবে, যদি কিছু ব্যবস্থা হয়? দীপুর উপদেশ মনে পড়ল, আগ বাড়িয়ে ধরা দেবার কোনও মানে হয় না। এমনও তো হতে পারে লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। তাই যদি হয়, রাত্তিরে কোনও ছুটন্ত লরি ওকে চাপা দিয়ে যেতে পারে অথবা জঙ্গলের জন্তু- জানোয়ার খেয়ে ফেলতেও পারে। বাঘ নেই এদিকে, কিন্তু শেয়াল—শেয়াল কি মানুষ খায়? নেকড়ে তো আছে? ঘামে শরীর জবজবে হয়ে গেল ওর।
সকাল সাতটা নাগাদ দীপু এল। বিজন মাস্টারের কাছে পড়তে যাওয়ার নাম করে বলে গেল কেউ কিছু টের পায়নি। এদিকে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, কেমন জ্বরো জ্বরো ভাব। এমন সময় একজন লোক ওকে ডাকতে এল। বাবা অফিসে চলে গেছেন। মা রান্নাঘরে। সন্তু তাড়াতাড়ি লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে কোনওদিন এই ধরনের কোনও লোক খুঁজতে আসেনি কখনও। তা হলে কি সব ধরা পড়ে গেছে? লোকটা বলল, বোবা কম্পাউন্ডার তার খোঁজ করছেন, এখনই যেতে বলেছেন। তার মানে হয়ে গেল। সন্তু ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে তাকাল। এই চাঁপাফুলের গাছ, মাঠ, চা-বাগান, বাবা-মা সবাইকে ছেড়ে চেলে যেতে হবে তাকে। কাউকে কিছু না বলে লোকটির সঙ্গে হাঁটতে লাগল সে। কাউকে দেখানোর মতো মুখ তার নেই। দীপুকে খবর দেওয়া দরকার। না, ওকে জড়িয়ে কী হবে।
চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে বোবা কম্পাউন্ডারের বাড়িতে যেতে হয়। পুলিশের গাড়িটা সামনে নেই কেন? সবাই কি ভেতরে বসে আছে! ও ঢুকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত-কড়া পরিয়ে দেবে? তা ওরা ওদের বাড়িতেও আসতে পারত! বোধহয় বোবা কম্পাউন্ডারের সাক্ষী চাইছে। সঙ্গের লোকটা ভেতরে ঢুকল না। সন্তু আড়ষ্ট পায়ে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমে বোবা কম্পাউন্ডারকে দেখতে পেল। একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। আর সেই সময় কে যেন তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভয়ে আধমরা হয়েই ছিল, সন্তু দু’হাত তুলে সারেন্ডার করতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ও শুনল হাউমাউ করে কে ওর পায়ের সামনে বসে কাঁদছে। প্রচণ্ড বিস্ময়ে সন্তু দেখল কুলিগোছের একটা রোগা লোক দুটো হাত মুখের ওপর জোড় করে বলল, “মাপ কিজিয়ে খোকাবাবু, হাম থোড়া বেহোঁশ থা, আপকো বহুত চোট লাগায়া হাম। মাপ কিজিয়ে—।” হু হু করে কাঁদছিল লোকটা। সন্তু ঘাবড়ে গিয়ে দেখল লোকটার মুখচোখ ফুলে-ফেঁপে বীভৎস হয়ে গেছে। চোখ তো ভাল করে দেখাই যাচ্ছে না। জামায় হাতে -পায়ে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে।
এই লোকটাকে সে কাল ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছিল, অথচ আজ ও তার কাছে ক্ষমা চাইছে উলটে! সন্তুর চোখে জল এসে গেল, কোনওরকমে বলল, “নেহি, নেহি—।”
“হাম আপকো মার ডালা—কসুর মাপ কর দিজিয়ে।” লোকটা নাছোড়বান্দা।
এমন সময় বোবা কম্পাউন্ডার আঙুল নেড়ে ডাকলেন। কাছে আসতে একটা কাগজ নিয়ে খসখস করে লিখলেন, “তুমি মিথ্যেবাদী!”
কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল সন্তু, হ্যাঁ।
খুশি হয়ে বোবা কম্পাউন্ডার আবার লিখলেন, “কার ক্ষমা চাওয়া উচিত?”
হাত থেকে পেন্সিলটা নিয়ে বড় বড় করে সন্তু লিখল, “আ মা র।”
১৬ জানুয়ারি ১৯৮০
অলংকরণ: মাখন দত্তগুপ্ত