তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

খুনি মিনি

খুনি মিনি

মার্কো তন্ময় তাঁর লেখা নিয়ে। আমি কিন্তু ঠিক দেখেছি। রক্তবর্ণা, থ্যাবড়া নাক, চার চৌকো চেহারা, ‘জান লেগা, তেরা জান লেগা’ করে তেড়ে আসছে। তিড়িং লাফ ফুটপাথে। আর একলাফে লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনা চাঁদির দোকানের রকে। বলা কি যায় সহজে! রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথ, ফুটপাথ ছেড়ে সেখানেও ঢুকে পড়তে পারে। আমাকে একবার সরাতে-সরাতে খানায় ফেলে দিয়েছিল। সি. এম. ডি. এ.-র তৈরি সরোবরে, বর্ষার জলে সারারাত গলা পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে উপুড় করা তারাভরা আকাশ দেখেছিলুম, বিশাল-বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপারের মাথায় লাল আলোর হুঁশিয়ারি লক্ষ করেছিলুম। বিমানের হোঁচট খাওয়ার ভাবনায় সিটি ফাদাররা শঙ্কিত, কিন্তু ফাদার অফ ম্যানের জন্যে একটা টিমটিমে টেমিও সে রাতে জোটেনি। সেই অচেনা জলাশয়ে পকেটে পড়ে থাকা ক্যারামের ঘুটির মতো সারারাত মজা করে পড়ে রইলুম। রাত একটা পর্যন্ত অবিরাম চিৎকার করেও ধারে কাছে কেউ এল না। ধরিত্রীর আর্তনাদে সাড়া দেওয়ার মত মানব-সন্তান এ শহরে নেই। ভোরবেলা ঠিকাদারের লোক কপিকলে করে টেনে তুলে পকেটে যা ছিল সব হাতিয়ে নিলে। বললে, সুরাপান আর কোরো না, গুরু, সুধা খেও জয় মা কালী বলে।

আমার লাফালাফি দেখে মার্কো বললেন, পালালে কেন হে! পালাব না! মিনি আসছে যে! মিনিতেই এই, ডুলো কী করবে! শুনে রাখো সায়েব, কলকাতার পথ-পরিবহন হিন্দি ছবির ধাঁচে সাজানো, রাষ্ট্রীয় পরিবহণ ফ্লপ নায়ক, ট্যাকসি খেয়ালী প্রয়োজক, মিনি হল ভিলেন। নিন লিখুন, মিনির অংশটা আমিই বলি—স্বভাবে একগুঁয়ে মাস্তান, বেগবতী, ধ্বংসপ্রবণ, আত্মঘাতী হওয়ার ইচ্ছাও প্রবল। আমাদের জীবনে ইহা এক ধরনের পরীক্ষা। যাঁহারা যোগের চর্চা করিয়াছেন তাঁহারা ধনুরাসন, কুর্মাসন প্রভৃতি শুনিয়াছে। মিনি সেই আসনের তালিকায় বঁড়শি মুদ্রা বা হুকমুদ্রার সংযোজন ঘটাইয়াছে। এই চলমান ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে যাঁহারা গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া দিনের পর দিন দাঁড়াইয়া যাওয়া-আসা করেন, তাঁহারা অচিরেই হেঁটমুণ্ড হুক বা বঁড়শির আকৃতি প্রাপ্ত হন। শুধু তাই নয়, ইহারা যে প্রজাতি সৃষ্টি করিবেন, তাহারাও হেঁটমুণ্ড হইবে। হেঁট মুণ্ড হইবার সুবিধা অনেক, যেমন—এক, ক্ষমতাশালী মানুষের সামনে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবার খেসারত দিতে হইবে না। দুই, পথ চলিবার সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো দৃষ্টি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে নিবন্ধ থাকিবার ফলে সুন্দরী মহিলাদের দেখিয়া প্রাণ আঁকুপাঁকু করিবে না। তিন, কেশ কর্তনের সময় নরসুন্দরের হাতের চাপে মাথা নীচু করিয়া থাকিবার ক্লেশ সহ্য করিতে হইবে না। চার, সংসারের নীচের দিকটিই ইহাদের নজরে আসিবে। কড়িকাঠের ঝুল দেখিয়া রবিবার ঝুলঝাড়ু লইয়া বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কসরত করিতে হইবে না। স্ত্রী কেন ঝুল ঝাড়িতে পারে না বলিয়া স্ত্রীকে ঝাড়িতে পারিবে না। পারস্পরিক ঝাড়াঝাড়ি বন্ধ হইবার ফলে ঝুলঝাড়ু ছুটি পাইবে, মাকড়সাদের সাধনা বাধাপ্রাপ্ত হইবে না। গৃহ কলহমুক্ত হইয়া গির্জার প্রশান্তি পাইবে। পাঁচ, বিবাহের জন্য পাত্রী পছন্দের সময় মুখশ্রী দেখিবার প্রয়োজন হইবে না, শুধুমাত্র পদযুগল দেখাইয়া আইবুড়োর বিবাহের বাজারে পার হইয়া যাইবে। ছয়, সন্তানের বখাটে মুখ কী স্ত্রীর তোলো হাঁড়ির মতো মুখ দেখিয়া মরমে মরিয়া যাইতে হইবে না। কিছু অসুবিধা মানিয়া লইতে পারিলে হেঁটমুণ্ড হইবার সুবিধা অনেক। অসুবিধার মধ্যে চলমান বাস বা ট্রামে যাঁহারা নিদ্রামগ্ন হন তাঁদের ঠোঁটের ফাঁক দিয়া লাল পড়িবার সম্ভাবনা। জলসহযোগে ক্যাপসুল গিলিবার অসুবিধা। ডাক্তারকে জিভ দেখাইবার অসুবিধা। দেওয়াল ঘড়ি দেখিবার অসুবিধা, ফলে এদেশের প্রধান ঘড়ি-শিল্প দেওয়াল ঘড়ির বিক্রয় বন্ধ হইবে। কিছু শিল্পী বেকার হইবে। অবশ্য সৌর ঘড়ির মতো ওয়ালক্লকের পরিবর্তে ফ্লোরক্লক চালু করিয়া সমস্যার সমাধান করা যাইতে পারে। পাদুকার মূল্য আরও বাড়িবে। হেতু, সকলের দৃষ্টিই পায়ে-পায়ে ঘুরিবে, সুতরাং পদমর্যাদা বাড়াইবার জন্য পাদুকার মর্যাদাও বাড়াইতে হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *