খুন
গণেশ চৌকীদার থানার ঠিক পিছনের রাস্তাটার ধারেই পাঁচ আইন ভঙ্গ করতে দাঁড়িয়ে পড়ে অবচেতনিক অভ্যাসেই এদিক ওদিক তাকাল, আর তখনি দেখতে পেল হতভাগাটাকে।
রোজকার মতই উগ্রচণ্ডা মূর্তিতে হনহনিয়ে আসছে। যেমন লক্ষ্মীছাড়া চেহারা, তেমনি লক্ষ্মীছাড়া কেশবেশ, সন্দেহ নেই বাসি মুখেই চলে এসেছে।…গণেশ চৌকীদারের হঠাৎ মনে হল নিশ্চয় লোকটার মাথায় উকুন আছে।
মাথায় উকুনওলা একটা হতভাগা লোক ঠিক এই সময়ই হঠাৎ উদয় হয়ে গণেশের শান্তি ভঙ্গ করবে, এটা অসহ্য বইকি। গণেশের ইচ্ছে হল পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাথুরে ঢিলগুলো থেকে একটা কুড়িয়ে নিয়ে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু ইচ্ছেটা সামলে নিতে হল। একবার ওইরকম ঢিল ছুঁড়ে ভারী ফ্যাসাদে পড়তে হয়েছিল গণেশকে। পেয়ারা গাছে চড়ে হুটোপুটি করতে আসা ডাকাবুকো ছেলেটা যে সামান্য একটা ঢিল খেয়ে লটকে গাছ থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়বে, এটা কে জানতো? পড়ল তো পড়ল একেবারে পটলই তুলল ছোঁড়া!
থানার ওসি সেই পেয়ারাতলা থেকে একখানা কোণ-ভাঙা থান ইট তুলে নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, এটা গণেশের কাছে সামান্য কিনা।
গণেশ বেচারা মাটি হাতড়ে হাতড়ে অনেকগুলো মাটির ঢেলা তুলে তুলে দেখিয়েছিল, মা কালীর দিব্যি গেলেছিল, বদমাইস ওসিটা সে কথা মানতেই চায় নি। বলেছিল, তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত।
তা ফাঁসি অবশ্য হয়নি গণেশের, তাই যদি হবে, তা হলে বটবৃক্ষের ছায়া কথাটার মানে কী? ছায়ায় আছে বলেই না? খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে, চট করে কি থান ইট তুলতে সাহস আসে? সে যাক, ফাঁসি টাসির প্রশ্ন নয়, তবে ওই যুধিষ্ঠির ওসিটার হস্তক্ষেপে দুর্গতি ঘটেছে গণেশের। কালনার মত ভাল শহুরে সদরখানা থেকে বদলী হয়ে এই কেষ্টপুরে এসে পড়েছে।
থানা ছোট্ট হলেও, থানার কম্পাউন্ডটা মস্ত। জায়গা জমির তো অভাব নেই এখানে। এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই ছোট দারোগার কোয়ার্টার্স, ছালওঠা ইটের বেঁটে একতলা, জানলা দরজায় আলকাতরার প্রলেপ। ও হদ্দ থেকে দূরে এ হদ্দে গণেশ আর রঘুর টিনের চালা। মাঝখানে রাস্তার ওপর তিনটে সিঁড়ি উঠে থানা। তার পিছনে হাজত ঘর।
অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই।
তবু গণেশের মন হুহু করে। যেন নির্বাসন দণ্ড হয়েছে তার।
আর সেই হুহু করা মনের ওপর রোজ এই জ্বালা।
হতভাগার না কি একমাত্তর ছেলেকে কোন একরাত্রে পুলিশ ধরে এনেছিল, নিগূঢ় কোনও সন্দেহে। তারপর মানে জিজ্ঞাসাবাদের পর না কি ছেড়েও দিয়েছিল, কিন্তু উনিশ-কুড়ি বছরের সেই ছেলেটা নাকি সেই রাত থেকেই নিখোঁজ।
নিখোঁজ তো নিখোঁজ, পুলিশে কী করবে? পুলিশ তার কর্তব্য করেছে বইতো নয়।
পেটের কথা আদায় করতে খানিক ধোলাই দিয়েছে, এছাড়া আর কোন পদ্ধতি জানা আছে পুলিশের? ছেলে যদি নিখোঁজ হয় পুলিশের কী দোষ? কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া হতভাগাটার দাবি কী? না, পুলিশ যখন মাঝ রাত্তিরে ঘর থেকে ছেলে তুলে এনে আটক করেছিল, তখন নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজে বার করে এনে দেওয়া পুলিশেরই ‘কোর্তব্য’।
যেন কোর্তব্য করতেই পুলিসের জন্ম।
যেন মানব সেবা করতেই তাদের আবির্ভাব। মাটির মানুষ ছোট দারোগা কি কম বুঝ দেয় লোকটাকে? গণেশের তো দেখেশুনে অবাক লাগে। অন্য কেউ হলে কবেই জন্মের শোধ হতভাগার ঘ্যানঘ্যানানি ঘুচিয়ে দিতো।…
কিন্তু ছোট দারোগা কেবল বুঝ দেয়, আচ্ছা তোর ছেলে যদি নিজেই বেবাগী হয়ে যায়, পুলিশের কী দোষ? দু ঘা চড় চাপড় দিয়ে সেই রাতেই তো বাবা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। এখন তাকে কোথায় পাবো?
কিন্তু পাজীটা মানবে না সে কথা।
রোজ রাত না পোহাতেই বাসি মুখে হনহনিয়ে চলে আসবে, আর একঘেয়ে শ্লোগান দিয়ে চলবে, মাজ আত্তিরে বেছনা থেকে টেনে তুলে নে এসে ছেলডারে হাপিস করে দিলি তোরা আর খুঁজে দিবিনে?
প্রত্যেক দিন এই এক হল্লা। কটুকুৎসিত বিরক্তিকর।
গণেশ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে রঘুকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মাটির মানুষ হলেও সত্যি তো আর মাটি বালি নয়। এতো সহ্যি করে কী করে দারোগাবাবু?
ভগবান জানে। কথায় দারিদ্দির রঘু। সব প্রশ্নের উত্তরের দায়িত্ব ভগবানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চুপ মেরে থাকে। শুধু একদিনই বলে ফেলেছিল, দারোগারও দারোগা থাকে রে গণশা। সেই ভয়েই কর্তা মাটি বালি হয়ে বসে আছে। নইলে ছ মাস আগে যদি আসতিস, দেখতিস কত্তার মূত্তিখানা।
ব্যস আর নয়, ওই পর্যন্তই।
ওই ঊর্ধ্বতন দারোগাটি যে কে সে রহস্য আজও গণেশের কাছে দুর্ভেদ্য হয়ে আছে।
কিন্তু ধৈর্যের একটা সীমা আছে। মাটিও সময়ান্তর ফেটে চৌচির হয়।
গতকাল ছোট দারোগা সেই ফাটা ফেটেছিল। আর ওই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা শেয়ালমুখো দাঁড়কাকটাকে জম্পেস একটি টাইট দিয়ে বলেছিল, ফের যদি ঘ্যানঘ্যানাতে আসিস, রাম ধোলাই খেতে হবে তা বলে দিচ্ছি।
পুলিশের রাম ধোলাই যে কী বস্তু তাও সমঝে দেওয়া হয়েছিল লোকটাকে, হাজত ঘরের পিছনের উঠোনে নিয়ে গিয়ে।…সেখানে তখন ভোলাই চলছিল, বেস্পতির হাটের কুঞ্জ ব্যাপারীর ওপর।
দুর্বুদ্ধি কুঞ্জ পুলিশের পেয়াদাকে হাটের সওদা থেকে ইচ্ছে মত তোলা তুলে নিতে তো দেয়ই নি, তার ওপর আবার মুখ করেছিল। না কি আসপদ্দার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রঘুর হাত থেকে জিনিস কেড়ে নিয়ে বলেছিল, যা যা ভাগ। বলে দিগে যা তোর পুলিশ বাবাকে, দেখব সে আমার কী করে। মন্ত্রীদের রাজ্যে বাস করছি বইতো মগের মুলুকে বাস করছি নে।
তা সেই দুর্মতির ওই ফল!
আধাজোয়ান লোকটাকে উদোম করে তার কাপড় দিয়ে তাকে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে… চামড়ার বেল্ট লোহার কাটার চাবুক, থানায় কিছুর অভাব আছে কি? হলেই বা ছোট থানা, জাত সাপের ছানা তো!
এক এক ঘা কোঁড়া খাচ্ছিল কুঞ্জ আর চীৎকার মারছিল, আমি উসব কতা বলি নাই। আমি উসব কতা বলি নাই, মিচে কতা। সব মিচে কতা।
কিন্তু কে শুনছে তার কথা?
তা সেই দৃশ্য দেখে যাবার পর আবারও আজ এসেছে লোকটা? প্রাণে ভয় ডর বলে কিছু নেই? ছোট দারোগা যা বলে তাই নয় তো?
ছোট দারোগা বলে পাগল। বদ্ধপাগল।
হল্লার মাত্রা বেশি বাড়ালেই দারোগা গণেশ আর রঘুকে হাঁক পেড়ে ডেকে বলে পাগলাটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বনে জঙ্গলে শেয়াল কুকুরের মুখে ছেড়ে দিয়ে আয় দিকি। আর তো সয় না। আচ্ছা এক ফ্যাসাদে পড়া গেছে।
কিন্তু এইটুকু বলেই যদি ক্ষান্ত হত কত্তা, তা হলে যা করবার গণেশ আর রঘুতেই করে ফেলতে পারতো। শেয়াল কুকুর বাঘ ভালুক হাঙর কুমীর, যাই দরকার হোক মানুষ আর কোন্ ভূমিকাটা না নিতে পারে? পারলে কি হবে, ধরে নিয়ে যাবার হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই যে দারোগাবাবু আর এক হুকুম জারি করে বসে–মারধোর করিসনে বাপু, মারধোর করিসনে, পাগলছাগলদের শুনেছি বেটরে লেগে ফেগে গেলে রক্ত বমি হয়ে চড়ি ওলটায়।
কে জানে পুঁথিপড়া বিদ্যেয় বলে, না জ্ঞান গোচরের বিদ্যেয় বলে। যাই হোক, বলে তো? তারপর আর কী করবার থাকতে পারে গণেশদের?
গণেশ রাগে গরগর করতে করতে চুপি চুপি বলে, দারোগাবাবুটা ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে রে? আজকাল তো মেয়েছেলেয় সব হয়, জজ ম্যাজিস্টেট উকিল ব্যালিস্টের সব। আর পেন্টুলও পরে মেয়েছেলেরা। নিঘাত মেয়েছেলে, নচেৎ এত অপমান গায়ে বেঁধে না?
রঘু খি খি করে হেসে বলে, ঘরের মধ্যে তো জলজ্যান্ত একটা পরিবার বসানো আছে। তোর কপাল মন্দ তাই কত্তার আসল রূপটা দেখতে পেলিনে। এই বাণ খাওয়া মূত্তি দেকচিস।
কিন্তু আড়ালে যা বলুক সামনে তো আর অবাধ্য হতে পারে না? তাই নিসপিস করা হাত দুটোকে কোনমতে বশে এনে শুধু লোকটাকে দুজনে দুদিক থেকে ধরে হিচড়োতে হিচড়োতে নিয়ে চলে যায়।…দুটো দুটো চারটে হাত-পা দুজনে ভাগ করে নেয়, লোকটার ঘুসি লাথির আক্রমণ থেকে জান বাঁচাতে।
নিয়ে যায় চ্যাংদোলা করে।
থানার এলাকা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে কাটা বনে, শ্যাওলার পুকুরে। আর মুখটা চালিয়ে যায় সমানে। তাতে তো আর পাগলের রক্তবমির ভয় নেই। গণেশেরই যেন বেশি রাগ।
লোকটার ওপর কী গণেশের কোনও কারণ ঘটিত পূর্ব আক্রোশ আছে? তাই এত নিসপিস করে?
তা ঠিক নয়।
.
চাকরী জীবনে জীবনভোর যা দেখে অভ্যস্ত তার ব্যতিক্রম দেখে ছটফটানি ধরে গণেশের। ধোলাই খাবার এমন প্রকৃষ্ট কারণ থাকতেও লোকটা ভোলাই খাচ্ছে না, এটা কী সহ্য করার মত ব্যাপার?
হাতের সুখই যদি না করতে পেল, তবে আর পুলিশে কাজ করতে আসা কেন?
তবে গতকাল একটু যেন আশার আলো দেখতে পেয়েছে গণেশ, দারোগাবাবু কাল আচ্ছা করে শাসিয়েছে লোকটাকে। ফের যদি এসে হল্লা করে তো রেয়াৎ পাবে না। এমন কি কুঞ্জ ব্যাপারীর ধোলাইয়ের দৃশ্যটা দেখিয়ে, সমঝে দিয়েছে, এটা কিছুই নয়, আরও যা যা পদ্ধতি আছে শুনে রাখ। ভয়ঙ্কর বীভৎস সেই পদ্ধতিগুলো অবলীলায় শুনিয়ে দিয়েছিল দারোগাবাবু।
শুনতে শুনতে আহ্লাদে গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছিল গণেশের। আহা আছে এ সব ব্যবস্থা কেষ্টপুর থানায়? ..তবে এও ভেবেছিল সে রোমাঞ্চ অনুভব করবার সুখ আর গণেশের ভাগ্যে হবে না। এ সব শুনে কাল আর আসবে না লোকটা।
আশ্চর্য! আজও সেই একইভাবে এসে হাজির হয়েছে লোকটা।…কাল কোথায় ফেলে দিয়ে এসেছিল ওকে গণেশরা? ধান কেটে নেওয়া শুকনো ক্ষেতের মধ্যে না?
ছুরির আগার মত ধারালো খড়ের আগার ওপর।…
গণেশ আরব্ধ কাজ না সেরেই মুঠোয় চাপা নিমকাঠিটা দাঁতের ফাঁকে আটকে নিম পাতার রসে জারিত গলায় বলে ওঠে, আবার আজ এসেছিস শালা? পেরাণে ভয় নেই?
লোকটা হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে লাল লাল চোখ দুটোয় আগুন ছিটকে বলে চোপরাও হারামজাদা শুয়োর! তুই বলবার কে? তোর কাঁচে এইচি আমি?
অ্যাঁ! কী বললি?
গণেশ প্রথমটা প্রায় হতচকিত হয়ে যায়।
অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন বোকার মত তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। চুলগুলো-নোংরা ধুলো মাখা চারটি পাটের মত, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি, পরনে একটা বর্ণহীন লুঙ্গি, গায়ে একটা ফালি ফালি শার্ট। পুরো পাগলের চেহারা। আর জ্বলন্ত আগুনের ঢেলার লালচে ধ্বকধ্বকেচোখ দুটো যেন ওই চেহারার সমাপ্তি রেখা, শেষ তুলির টান।
তা যাই হোক, তবু আজ পর্যন্ত গণেশ চৌকীদারকে এভাবে অপমান করেনি কখনো।
গটগটিয়ে আসে, দারোগার বাসার সামনে গিয়ে হল্লা করে। যদিও চেঁচানিটা নৈর্ব্যক্তিক।
শালার পুলিশ! ছেলে খুঁজে এনে দিবিনে মানে? তোর বাবা দেবে। মাজ আত্তিরে ছেলেডারে বেছনা থেকে টেনে তুলে নে এসে হাপিস করে দিয়ে এখন মিচে করে বলছিস কিনা সে বেবাগী হয়ে গেছে। কেন? কিসের দুস্কে বেবাগী হতে যাবে দুদের বালক ছেলেডা? বল কোতায় গুম করে রেকেচিস তারে? কোতায় চালান করে দিচিস!
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কটা কথাই বলে।
নতুন কথা পাবে কোথায়? পেটে বোমা মারলে ক বেরোবে?…রোজ সকালে এই একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে গণেশের ইচ্ছে হয় ওই শিরফোলা গলাটা টিপে দিয়ে জন্মের শোধ আওয়াজ ঘুচিয়ে দেয়, কিন্তু হবার জো নেই সেটা।…ছোট দারোগা যে কালার পার্ট প্লে করে তখন। …অনেকক্ষণ হয়ে গেলে তবে গণেশ আর রঘুকে হাঁক পেড়ে বলে, এই, পাগলাটাকে ধরে শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দিয়ে আয় তো।
তবে কাল পরিস্থিতি অন্যদিকে গড়িয়ে ছিল।
আজ আবার এই।
গণেশ বিস্ফারিত চোখে বলে উঠল, অ্যাঁ কী বললি?
লোকটা সে কথার জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, গণেশ পিছন থেকে তার ঘাড় চেপে ধরল। কড়া গলায় বলে উঠল, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?
লোকটা ঝটকা মেরে ঘাড় ছাড়িয়ে নিতে যায়, পারে না, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘাড় ধরা হাতটায় দাঁত বসাতে চেষ্টা করে, পেরে ওঠে না। অতএব আকাশ ফাটিয়ে একটা চীৎকার করে ওঠে। জান্তব চীৎকার। একমাত্র পাগলের স্বরযন্ত্র দিয়েই এমন অমানুষিক শব্দ বেরোনো সম্ভব।…
এই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছোট দাবোগার সেই ছাল ওঠা ইটের তৈরি বেঁটে একতলা বাসাটার আলকাতরা প্রলেপ দেওয়া দরজাটা খুলে যায়। গণেশ আশান্বিত চিত্তে তাকায়। মুহূর্তে কল্পনা করে নেয় বন্দুক হাতে বেরিয়ে আসছে দারোগাবাবু, নিদেন পক্ষে শঙ্কর মাছের ল্যাজের চাবুকটা। কিন্তু এটা কী হল? দরজাটা খটাং করে খুলল কে? গণেশ যদি দিনে কানা হয়ে ভুল না দেখে থাকে তো পষ্ট দেখতে পেল একটা চওড়া পাড় শাড়ির আঁচলের কোণ।…
তার মানে দারোগা গিন্নী।
কিন্তু সে ওই চকিতের মত।
পরক্ষণেই প্যান্টের বেল্ট আঁটতে আঁটতে দারোগাবাবুই বেরিয়ে আসেন। গণেশের মনে হয়, এখুনি একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটে যাবে। আকাশ থেকে চন্দ্র সূর্য খসে পড়বে, শব্দ তাণ্ডবে বুক কেঁপে উঠবে।
প্রত্যাশার পাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গণেশ।
কিন্তু কোথায় কী?
কোথায় সেই প্রলয়ঙ্কর গর্জন!
বেল্ট আঁটতে আঁটতেই গণেশকে বলে ওঠেন দারোগাবাবু, অ্যাই কী হচ্ছে? ঘাড় ছাড়।
ছাড়!..
অতএব ছাড়তেই হবে। মনের ঘেন্নায় মনে হয় গণেশের চাকরীটাই ছেড়ে দেবে। এই আলু ভাতের চাকরী আর নয়।
দারোগাবাবু, এখন যথারীতি মিঠেকড়া গলায় প্রশ্ন করেন, আবার এসেছিস আজ? কী বলেছিলাম কাল?
উঃ। কী অসহ্য, কী অসহ্য।
ঘাড় ছেড়ে দিতে বলায় যতটা না অপমানাহত হয়েছিল গণেশ তার চারগুণ আহত হল দারোগাবাবুর এই খাদে নামা কণ্ঠস্বরে। গণেশ হেঁট মুণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকে।…কিন্তু কানটা তো হেঁট করা যায় না? তাই কানে এসে ঢোকে আপনি আমার ছেলে খুঁজে এনে দাও, আর আসবনি।
বন্ধ দরজার এপিঠে দাঁড়িয়ে পুলিশ নামক একটা অশরীরী আত্মাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে তুই তোকারি করা যায়। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো জলজ্যান্ত ব্যক্তি মানুষটাকে কি আর তা করা যায়? লোকটা তাই এখন আপনি দিয়েই আবেদন জানায়, আপনি আমার ছেলে খুঁজে এনে দ্যাও, আর আসবনি।
দারোগা ক্রমশ ধৈর্য হারান, ফের সেই একঘেয়ে কথা, হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা। তোর ছেলে আমায় বলে কয়ে হারিয়ে গেছে? তাই তাকে খুঁজে এনে দেব?
পাগলের মাত্ৰাজ্ঞান থাকে না, তাই সেও সমান গলা চড়ায়, মুখ খারাপ করবেনি বাবু। যা বলবে ভদ্রলোকের মতন বলে।
কী? কী বললি? পাগল ছাগল বলে ছেড়ে দিই বলে বড় বাড় বেড়েছে না? এখনও বলছি ভাল চাস তো বেরিয়ে যা। নইলে–
নইলে?
লোকটা ঘৃণায় মুখটা বিকৃত করে বলে ওঠে, নইলে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেবে। জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেবে, নোয়া পুড়িয়ে পুড়িয়ে গালে ছ্যাকা দেবে, কাপড় খুলে নিয়ে পিটোবে এই তো? তা কর। কিন্তুক ছেলে আমার চাই-ই চাই।
গণেশ অবাক হয়ে দ্যাখে রাগে অপমানে ছোট দারোগার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, চোখ দিয়ে আগুন ছিটকোচ্ছে, তবু ছোট দারোগা কেন কে জানে নিজেকে সামলাচ্ছে।…ছোট দারোগার খোলা দরজার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে যে একটা চওড়া পাড় শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ে উড়ে এক একবার দৃশ্যমান হচ্ছে, সেটাই কি কারণ? কিন্তু ওটা তো দারোগার পিছন দিকে। কই পিছন পানে তো তাকাচ্ছে না বাবু!
তাকাচ্ছে না, তবু মনে হচ্ছে বুঝি তাকাচ্ছে, আর তাকাচ্ছে বলেই নিজেকে সামলাচ্ছে। আবার গলা নামিয়ে বলছে, পাগলকে আর কী বুঝ দেব বাবা। তোর ছেলেকে খুঁজে এনে দেবার সাধ্যি পুলিশের বাবারও নেই। কে জানে কোন্ চুলোয় গেছে।
পাগল যখন তখন ক্ষেপে ওঠবার অধিকার তার আছে। সেই ক্ষ্যাপা গলায় লোকটা পরিত্রাহী গলায় চেঁচায়, মিচে কতা বলচ আপনি। আপনি জানো কোতায় তারে চালান করে দেচো।..পুলিশের বাপের সাদ্যি নাই? তার অসাদ্যি কিছু আচে না কি?..কাউর প্রিতি সন্দ হলি আপনারা সগগো মত্তে পাতাল ছুঁড়ে তারে খুঁজে বের করো না? শ্যালের গত্ত থেকে উটকে বের করতে পারো আপনারা, মায়ের গভ্যো থেকে হিঁচড়ে টেনে আনতি পারো, আর আপনাদের হ্যাঁফাজত থেকে একটা ছেলে কঞ্জুরের মতন উপে গেল। তার সন্ধান নিতি পার না? আলবাৎ পারতি হবে। ক্যানো? গরীব বলে মানুষ নয়? তার মা বাপের পেরাণ পেরাণ নয়? আজ আপনার ছেলেডারে যদি কেউ ধরে নে গিয়ে গুম করে রাকে, ক্যামন লাগে?
অ্যাঁ। অ্যাঁ! কী বললি? অকথ্য একটা সম্বোধন করে দারোগাবাবু চীৎকার করে ওঠেন। তুই আমায় ভয় দেখাচ্ছিস?…গণেশ! রঘু।..যা তো এটাকে নিয়ে গিয়ে রাম ধোলাইয়ের কলে ফেলগে যা।…শালা ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। যাঃ। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে…তক্তা বানিয়ে
কাঁপতে কাঁপতে বোধহয় কথা শেষ করতে পারেন না ছোট দারোগা। কিন্তু যা বলা হয়েছে। তাই তো যথেষ্ট, উৎফুল্ল উত্তেজিত দুই বীর সতেজে এগিয়ে আসে।
আসে, কিন্তু মুহূর্তে পাথরের দেয়াল বনে যায়। এমন কি পাগলাটাও।
দরজার পাশ থেকে একেবারে এই ভোলা উঠোনে চলে এসেছে সেই চওড়াপাড় শাড়ির আঁচল। আর সে আঁচল বাতাসে এত উড়ছে বলেই আঁচলের অধিকারিণীর মুখ মাথায় আবরণ দেবার দায়িত্বটা ভুলে গেছে। সেই নিরাবরণ মুখ থেকে স্পষ্ট আর তীব্র একটি কণ্ঠস্বর যেন ছুরির ফলার মত বেরিয়ে আসে।
কষ্ট করে আর অত বোঝাবার দরকার কী? যা বোঝবার তা তো ওরা বুঝেই নিয়েছে। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলার পর আর কী করতে হয়, সে কী ওদের অজানা? কি গো বাবারা? জানা নেই?
এই ঘৃণা আর বিদ্বেষে ভরা হিংস্র মুখটা যেন সমস্ত পরিবেশটাকেই পাথর করে দেয়।
বাবারা স্তব্ধ নিস্পন্দ। কিন্তু তাদের বাবা? বোধ করি বরদাস্তর সীমা ছাড়ায় বলেই পাথর হয়ে যাওয়া পরিবেশটাকে ফাটল ধরিয়ে গর্জন করে ওঠেন, তুতুঃ তুমি কিঃ কিঃ করতে এখানে? ভেঃ ভেঃ ভেবেছো কীঃ তুমি? যাও যাঃ ও ভেতরে।
তুমির মুখে আরও হিংস্র হাসি ফুটে ওঠে, না গেলে? আমারও ধোলাইয়ের ব্যবস্থা হবে? তা হয় তোক।
ফিরে দাঁড়ান পাগলাটার দিকে, স্থির গলায় বলেন, তা তোমায় এই আজ বলে দিচ্ছি বাপু। এদের হাত থেকে বেঁচে যদি বাড়ি ফেরো–তো ছেলে খুঁজতে আর এসো না। এ পৃথিবীর কোনোখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে। বুঝতে পেরেছ?…আর এসো না।…এই ছোট দারোগাবাবু তাকে সেই রাত্তিরেই–ঘটনাটা কী ঘটেছিল রঘু? তুমি তো ছিলে। শুধু রগের ওপর একটা থাপ্পড়, তাই না? তাতেই
গণেশ অবাক হয়ে ওই মুখটার দিকে তাকায়। জীবনে অনেক হিংস্র মুখ দেখেছে গণেশ, কিন্তু এরকম কি দেখেছে কখনও?
গণেশের চোখের সামনে থেকে একটা ঝাপসা পর্দা সরে যায়।…ওঃ এই তাহলে সেই দারোগার উপর দারোগা। ঘরের লোকের হাতেই মরণবাণ, তাই দারোগাবাবু এমন নখ-দাঁতহীন। ফাঁস হয়ে যাবার ভয়। অবিশ্যি ফাঁস হয়ে গেলেই যে ফাঁসির দড়ি গলায় উঠবে সে ভয় নেই! সামান্য মানুষ চৌকীদার, তারই ওঠে না, তা ওপরওলাদের।…তবে ফ্যাসাদ তো আছে।
ঘরের লোক ফাঁস করে দিল।
কী লজ্জা। কী লজ্জা!
ওপরওলার মুখের দিকে তাকাতে পারে না গণেশ, ভয় হচ্ছে আগুনের মালসাটা বুঝি ভেঙে ছত্রখান হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। অথবা এই লোকটাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে–
পাগলে কী না করতে পারে।
দুজনে দুদিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরবার জন্যে আলগোছ হয়ে থাকে।…কিন্তু আশ্চর্য, কোন দিকে কিছু হয় না।
জায়গাটায় যেন বোবায় ধরেছে।
লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে একবার ওই মুখটার দিকে তাকায়, যে মুখটা থেকে এখনি একটা অমোঘ বাণী উচ্চারিত হল।…তারপর হঠাৎ দু হাতে মাথা চেপে হাউ হাউ করে কেঁদে চেরা ফাটা গলায় বলে ওঠে, দারোগাবাবু তো তারে মারেন নাই মা ঠাকরোণ, সে তো আমার ছেলে। আমি যে আমার জলজেবন্ত ছেলেডারে বুকের মদ্যি ভরে রেখে দিন গুজরোছেলাম। আপনি আমার সেই আস্তো ছেলেডারে এককোপে খুন করে ফ্যালালে গো
কোনও দিকে তাকায় না, হনহনিয়ে চলে যায়।
কারুর মনে পড়ে না ওকে ধরা দরকার ছিল।
কিন্তু গণেশ চৌকীদারের কী সম্পর্ক এ ঘটনার সঙ্গে? সে কেন হঠাৎ নিজের চালাঘরের কোণে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে বসে?
সংশয়ের বাতাবরণে বাস্তব ঘটনা! দারুন লাগল