খিঁচাকবলা সমাচার – সমরেশ বসু
চকবাজারের তিন রাস্তার মোড়ে, এখন এই প্রথম সালের ব্যস্ত কেনাবেচার সময়ে, রাস্তার অনেক ভিড়ের মধ্যে, একজনের দিকে চোখ পড়তেই, সবরকমের দোকানি আর ক্রেতাদেরই ভুরু কুঁচকে উঠল। সকলের চোখেই সন্দেহ, কারো কারো চোখে রাগ আর বিদ্বেষও। কারো কারো চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এমন কি তিন রাস্তার মোড়ে যে সেপাইটা দাঁড়িয়েছিল, পোকা বাঁধের দিক থেকে বা বোলতলার দিক থেকে আসা দু-একটা বাস লরিকে হাত দেখাচ্ছিল, আর বেশির ভাগ সময় আশেপাশে কারো না কারো সঙ্গে গল্প করছিল, মাঝে মাঝে সাইকেল রিকশার ভেঁপু শুনে বিরক্ত বোধ করে হাঁকছিল, ‘শালা তুকেও হামার হাত দিখাইতে হবে?’ তারও ভুরু আর চোখের কোণ দুটো কুঁচকে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের মুঠি পাকিয়ে শক্ত করল। এবং চিত্রটি স্থির না, যে যার কাজে ব্যস্ত, আর নির্বাকও মোটেই না, কারণ দু-একজন নিজেদের ব্যস্ততার মধ্যেও গরগরিয়ে উঠল, ‘ই শালা এখন ইখানে আইচে ক্যানে?’
সকলেই যে-যার কাজে কথায়, দর কষাকষি বেচা-কেনায়। কেউ বা নিতান্ত চকের সামনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে বেকার গুলতানি করছিল, এবং সকলেই আপনার আপনার মনে বেশ ছিল। মাত্র একজনের আবির্ভাবে, চক এলাকার সমস্ত চেহারাটাই যেন বদলিয়ে গেল। ব্যাপারটাকে কোনরকম সম্মোহন জাতীয় ঘটনার থেকেও তুলনাটা মানুষের ক্ষেত্রে খারাপ শোনালেও, মনে হল যেন, এক পাল কুকুরের রাজ্যে, বেপাড়ার একটা কুকুর এসে পড়েছে। সন্দেহ, রাগ ছাড়াও, সকলের চোখে-মুখেই একটা সাবধানী অভিব্যক্তি।
যার আবির্ভাবে এইরকম একটা পরিবর্তন, তার মুখে খোশামুদে চাটুকারিতার হাসি। গল্প কথার শেয়ালের হাসির মতই অনেকটা, এবং যথাসাধ্য সরল অমায়িক নিস্পাপ ছোট ছোট চোখে সকলের দিকেই দেখতে লাগল, খুব নিরীহ ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে মোড়ের দিকে এগিয়ে চলল। তার ছোট ছোট চোখ দুটো প্রায় গোলাকৃতি, ঝকঝকে, শিক্রে বাজের মতই, অথচ একটা অস্বাস্থ্যকর লাল হলুদের ছোপও যেন আছে। রোগা লম্বা হিলহিলে, হঠাৎ দেখলে রুগ্ণ মনে হয়। বিশেষ করে তার রঙ-ওঠা বিবর্ণ, বোতামহীন, ফুটো-ফাটা, নানা জায়গায় সেলাই করা হাফ শার্ট, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা, মাপে খাটো, গোড়ালি থেকে অনেকটা ওপরে, সরু কোমরে আর লম্বা সরু ঠ্যাং-এ কাপটি আঁট ফুল প্যান্টের নানান জায়গায় লম্বা সেলাই, দু-একটা তাপ্পি আর বড় বড় নখওয়ালা খালি ময়লা পা-জোড়া দেখলে, রুগ্ণ আর দুঃস্থ ছাড়া তাকে কিছুই মনে হয় না। তার লম্বা সরু দুই হাত, বড় বড় ময়লা নখ, রুক্ষু আকাটা, ঘাড়ে কপালে বেয়ে পড়া খয়েরি-কালচে চুল, সবকিছুতেই তাকে সেইরকম মনে হয়। নাকটা যে তার কেন চোখা, মিশকালো ভুরু দুটো মোটা, এটা যেন চিন্তার বিষয়। এমনকি মুখে অনেক কাটাকুটির দাগ, যা দেখলে মনে হয় দাগগুলো সবই যেন নিপুণ হাতে আঁকা, কেননা প্রাচীন পাথরের মূর্তির মুখের মত মোটেই ক্ষয়িষ্ণু এবড়ো-খেবড়ো না, এ-সব সত্ত্বেও, তীক্ষ্ণ চিবুক, পান-পাতার মত মুখের গড়নে প্রায় একটা মেয়েলি কোমলতা, এবং পান-বিড়ি-সিগারেটের ছোপ থাকা সত্ত্বেও নিখুঁত দাঁতের পাটি কেমন যেন চিন্তিত করে তোলে। দু-একদিনের মধ্যেই গোঁফ-দাড়ি কামানো হয়েছে। সেজন্যই মুখটা কিছু সাফ সুরত দেখাচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যেই পাতলা-শ্যাওলার মত ছোপ ধরেছে।
এ ধরনের চেহারার মানুষের বয়স অনুমান করা খুব কঠিন। কুড়ির ঘর থেকে তিরিশের ঘরে একটা ধরে নিলেই হয়। সে তিন রাস্তার মোড়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সেপাইয়ের দিকে তাকাল। প্রায় পুরো খোলা দাঁতের পাটিতে সেই তোষামুদে হাসি। প্রায় গোল চোখে, বেমানান সরল নিস্পাপ দৃষ্টি। অবাঙালী সেপাইয়ের গোঁফ-জোড়া খাড়া হয়ে উঠল, অসুরের মত তার দাঁত দেখা গেল। ডান হাত মুঠি পাকানো, বাঁ হাতে গোঁফ-জোড়া একবার চুমড়ে নিল। চোখের কোণ দুটো আরও বেশি কুঁচকে উঠল। সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ন দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই শালা খিঁচাকবলা, কীধার তু যাবি?’
সেপাইটির ধারণা, সে বাংলা বলতে পারে, এবং তা স্থানীয় আঞ্চলিক বিষ্ণুপুরী ভাষা। যার আবির্ভাবে গোটা চকবাজার এলাকায় সহসা এমন পরিবর্তন, তার নাম খিঁচাকবলা। হয়তো এই নামের পিছনে কোন ইতিহাস আছে। হয়তো তার অন্য কোন নাম একদা ছিল। কিন্তু এখন এই শহরে এই নামেই তাকে সবাই চেনে। শুধু চেনে বললে ভুল হবে, এমন বিশেষভাবে চেনে। চকবাজার অঞ্চলের ভূতুড়ে মন্ত্ৰপড়া হঠাৎ পরিবর্তন দেখলেই তা বোঝা যায়। নামের পিছনে যদি কোন ইতিহাস থেকে থাকে, তবে হয়তো তার একটা মানেও আছে। হয়তো না, ইতিহাস এবং মানে, দুই-ই আছে। ও যখন বালক ছিল, শহরের চকবাজারে রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াত, এবং চলে যেত সোনামুখী, বাঁকুড়া, দূরান্তে পুরুলিয়া, তখনই একটা আশ্চর্য শারীরিক কৌশল আয়ত্ত করেছিল, যা লোকচক্ষে করুণ আর উদ্বেগজনক। কৌশলটা আর কিছুই না, হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে যত্রতত্র পতন, হাত-পায়ের দুরন্ত খিঁচুনি, গোঙানি, ধূলাবালিতে মুখঘষা, মুখের লালায় ফেনা গাঁজিয়ে তোলা, ইত্যাদি মিলিয়ে, একটি মৃগী রুগীর পাকা অভিনয়। বালক বয়সে ভিক্ষা আর ছোটখাটো হাতসাফাই চুরি বাদ দিলে, এটাই ছিল ওর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সেই থেকেই ও খিঁচাকবলা, কিন্তু নামটা মুখে মুখে ছড়িয়েছিল কিছুটা করুণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। তখন ওর মা-বাবা ছিল। মা বনবাদাড় জলাশয় ঢুঁড়ে নানা রকমের ছোড়ক ছাতু, শামুক-গুগলি যোগাড় করে বাজারে বিক্রি করত, বাপ এক টেমিওয়ালার ঘরে টেমি বানাত। ভাই-বোন জন্মাত বছর বছর। বাপ প্রচুর মদ খেত, আর মায়ের সঙ্গে রোজই ঝগড়া-মারামারি হত। ভাইবোনের কোন হিসাব ছিল না, অন্তত খিঁচাকবলা হিসাব করতে পারত না। ওর পাঁচ-ছ বছর বয়সেই, ওকে ভিক্ষা করতে পাঠানো হয়েছিল। চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত কোনরকমে ভিখিরির ভূমিকাটা বজায় রাখতে পেরেছিল। তারপরে আস্তে আস্তে ওর ভূমিকা বদলিয়ে গিয়েছিল। সেই পরিবর্তনের কাহিনী বহু সমাচারের বিষয়ভুক্ত। তবে মৃগী রোগের ছলনাটা ধরা পড়ে গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যেই।
খিঁচাকবলাকে আজকাল রোজদিন বিষ্ণুপুর শহরে দেখা যায় না। সেটা সম্ভবও না। ওর বিচরণক্ষেত্র বহুদূর বিস্তৃত। বাঁকুড়া পুরুলিয়া ছাড়াও, দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমান পর্যন্ত। কখনো কখনো বোলপুর, সিউড়ি, রামপুরহাটও। অতএব সচরাচর ওকে চকবাজার এলাকায় দেখা যায় না। দেখা গেলেই, সমস্ত এলাকা মুহূর্তেই সন্দেহে রাগে গরগরিয়ে ওঠে। আসলে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
খিঁচাকবলা সেপাইয়ের কথায় কোন জবাব না দিয়ে, একবার ডাইনে তাকাল, আর-একবার বাঁয়ে। মুখে সেই খোশামুদে হাসি, চোখে নিস্পাপ সরল দৃষ্টি। সেপাই ডানহাতের ঘুষি তুলে হুমকে উঠল, ‘শালা কই দুকানপর তু গোড় বাড়াইছ, ত এক ঘুষা মে তোর নাক ফাটাই দিব।’
খিঁচাকবলা সেপাইয়ের দিকে তাকাল। সেলাই আর তালিমারা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে, তুলে নিয়ে দেখাল কিছু খুচরো পয়সা, আর চাটুহাসিটা ছড়িয়ে গেল এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত। সেপাই এইভাবে হুমকানি দিল, ‘শালা, উসব চোরাই পয়সা হামি দেখতে চাই না। ইখান সে আভি ভাগ যা!’
খিঁচাকবলা আশেপাশে দোকানের এবং লোকদের দিকে একবার দেখল। হাসিটা একটুও ছোট হল না। পয়সাগুলো পকেটে ঢুকিয়ে,ও বাঁ দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। রাস্তার দুপাশের, বিশেষ করে দোকানদারদের দৃষ্টি, মুখের অভিব্যক্তি চকবাজার এলাকার মতই। ও দুপাশে দেখতে দেখতে, কাটাকুটির দাগভরা মুখে হাসি নিয়ে, বোল্তলার মোড় পেরিয়ে, ডানদিকে ময়রার দোকানের সামনে দাঁড়াল। একজন জিলিপি ভাজছিল, আর একজন হাতে গরম, শালপাতায় বিক্রি করছিল। যে বিক্রি করছিল, সে খিঁচাকবলাকে দেখেই, এক টানে জিলিপির কাঠের পাত্রটা পিছনে সরিয়ে নিল। আর যে খালি গা লোমশ লোকটা জিলিপি ভাজছিল, সে ঝাঁজরি হাতাটা তুলে ক্ষেপে উঠে বলল, ‘দ্যাখ্ শালা, জিলিপিতে হাত দিয়া করেচু কি তোর গায়ে গরম তেল ছিটাই দুব।’
খিঁচাকবলার হাসিটা একটু ছোট হল, গোল চোখ দুটোর হলুদ লাল ছোপ থেকে কালো তারা দুটো যেন শিকরে বাজের চোখের মত ঝলকিয়ে উঠল। তারপরেই আবার হাসিটা ছড়িয়ে গেল, আর প্যান্টের পকেট থেকে দুটো দশ নয়া বের করে, ভাজাওয়ালার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল। যে বিক্রি করছিল, সে দশ নয়া দুটো আগে হাতে নিয়ে দেখল। দেখে, একটা শালপাতায় দুটো জিলিপি মুড়ে এগিয়ে দিল। যারা জিলিপি কিনছিল, তারা কিছুটা ফারাকে সরে গিয়েছে। খিঁচাকবলা একটা জিলিপি বের করে খেতে খেতে আবার এগিয়ে চলল।
রাস্তার দুপাশে, লোকজন দোকানদারদের সেই একই মুখের অভিব্যক্তি, চোখের দৃষ্টি। আপাতদৃষ্টিতে দুঃস্থ রুগ্ণ খিঁচাকবলা তাকিয়ে তাকিয়ে জিলিপি খেতে খেতে, বাউরিপাড়ার মোড় পর্যন্ত এল। জিলিপি দুটো খাওয়া শেষ। মোড়ে কয়েকটা সাইকেল রিকশা, এবং সেগুলোর চালক। একমাত্র রিকশাচালকদের মুখ চোখের অভিব্যক্তি দৃষ্টি ভিন্ন। ওদের চোখে কৌতূহল, হেসে নিজেদের সঙ্গে চোখাচোখি করল। একজন বলে উঠল, ‘অই ওস্তাদ, কেমন আচ হ্যা?’
খিঁচাকবলা তখন রাস্তার ধারে টিউবওয়েলের কলের মুখে এক হাত চেপে, অন্য হাতে হাতলে চাপ দিচ্ছে। রিকশাওয়ালাদের দিকে না তাকিয়েই গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বের করল, অনেকটা বিদঘুটে ঢেকুর তোলার মত। রিকশাওয়ালারা হেসে উঠল। খিঁচাকবলা নিচু হয়ে কাছে মুখ নিয়ে জল খেল। খেয়ে, ভেজা হাত মাথায় মুখে মুছতে মুছতে কোনদিকে না তাকিয়ে আবার এগিয়ে চলল।
‘শালা কালিন্দী বাঁধের ধারদে যেয়্যা খরগা।’ একটা চিৎকার শোনা গেল।
খিঁচাকবলা দাঁড়াল, বাঁদিকে দোকানঘর আর লোকজনদের দিকে তাকাল। হাসিটা ছোট হতে হতে, ঠোঁট ছুঁচলো হয়ে উঠল, চোয়াল দুটো শিকরে বাজের চোখের মত ঝলকিয়ে উঠল। চিত্রটা এখন স্থির, একটা স্তব্ধতা এবং স্পষ্টত এগোলে কালিন্দী বাঁধ, তার পাশেই শ্মশান। চিৎকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, খিঁচাকবলাকে শ্মশানে গিয়ে মরতে বলছে। আক্রমণের আগে, হাতি যেমন শুঁড় গুটিয়ে নেয় ওর ছুঁচলো ঠোঁটের ভঙ্গিটা অনেকটা সেইরকম। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর ঠোঁট আবার হাসিতে ভরে উঠল, চোখের দৃষ্টি সরল আর নিস্পাপ। ও এগিয়ে চলল। কালিন্দী বাঁধের আগেই, ডানদিকের রাস্তায় বেঁকে গেল।
এ রাস্তায় কোন দোকানপাট নেই। গাছপালা, বন-বাদাড়, রাস্তার ধারে দু-চারটে মাটির ঘর, গরীব হাড়ি ডোমের বাস। খিঁচাকবলা এগিয়ে চলল, চার রাস্তার মোড়ে এল। একটা রাস্তার নাম বম্বে রোড। এখানকার লোকে বলে বমবে রোড। আসলে রাস্তাটা চন্দ্রকোণাগড় গড়বেতা হয়ে, খড়গপুরের কাছে বম্বে রোড়ে গিয়ে মিশেছে। সেই জন্য বম্বে রোড। কাছেই বিঁড়াই নদী, সেজন্য এ জায়গাটাকে বিঁড়াইয়ের মোড় বলে। বম্বে রোডটার আসল নাম পিল্গ্রিম রোড। এই রাস্তায় নবদ্বীপের নিমাই মিশ্র পুরীতে গিয়েছিলেন। এ রাস্তায় উড়িষ্যা যাওয়া যায়। একটা রাস্তা গিয়েছে সোনামুখীর দিকে। বিপরীতে বাঁকুড়ার দিকে। খিঁচাকবলা যেদিক দিয়ে এল, ওটা বিষ্ণুপুরের দিকে।
বিঁড়াইয়ের মোড়ের একটু দূরেই পেট্রল পাম্প। মোড়ের একপাশে, দূরগামী ট্রাকের সারি। পাশে মস্ত বড় একটা চালাঘর। ঘরের একদিকে রান্না হচ্ছে, কতকগুলো খাটিয়া পাতা। ট্রাক-ড্রাইভারদের খাওয়া আর বিশ্রামের জায়গা। ট্রাকের যান্ত্রিক খুঁটিনাটি গোলযোগ সারানো, জল খাওয়ানো, জলে ধুয়ে সাফ-সুরত করা, সবই এখানে হয়। আর ঠিক জায়গা বুঝেই, রাস্তার ধার থেকে একটু ভিতরে, মাঠের ওপর একটা দেশি মদের দোকান। সরাইখানার একপাশে বড় একটা পুকুর। ড্রাইভাররা নিজেদের ধোয়াতে পারে, গাড়িও ধুতে পারে। একটা ছোটখাটো মেরামতি কারখানাও রয়েছে। জায়গা বুঝেই করা হয়েছে। বিঁড়াইয়ের মোড় ট্রাক-ড্রাইভারদের সবদিক থেকেই আদর্শস্থল।
খিঁচাকবলা ট্রাকের সারির পাশ দিয়ে বড় মাটির ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকজন ড্রাইভার আর তাদের সহকারী, কেউ শুয়ে কেউ বসে। দু-তিনজন ঘুমোচ্ছে। দুজন শিখ মদের বোতল আর কাঁচা পেঁয়াজ নিয়ে বসেছে। অন্যদিকে উঁচু উনোনে দাঁড়িয়ে একজন রান্না করছে। সবাই খিঁচাকবলার দিকে তাকাল। কিন্তু শহরের লোকজনের মত, এখানে কারো চোখেই সন্দেহ বা মুখে রাগ রুষ্টতা নেই। খিঁচাকবলার মুখে সেই হাসি, চোখে সেই নিস্পাপ দৃষ্টি। এখন খোশামুদে হাসিটা যেন একটু করুণ।
চুল খোলা খালি-গা যে দুজন শিখ ড্রাইভার মদের বোতল নিয়ে বসেছিল, তাদের মধ্যে একজন, খিঁচাকবলাকে ওর ভগ্নীর নামে গালাগাল দিয়ে সস্নেহ সম্ভাষণ করে হিন্দিতে যা বলল, তার বাংলা এই রকম, ‘কী রে—খিঁচা, এই করে তুই কিলিনার হবি? এত বেলায় তোর জন্য কোন গাড়ি পড়ে থাকবে? সব ধোলাই সাফ করা হয়ে গেছে।’
এখানে খিঁচাকবলা পরিচিত, এবং এখানে ওর পরিচয় একজন কর্মী হিসাবে। ক্লিনার। গাড়ি ধুয়ে মুছে সাফ করে, তেল ন্যাকড়া নিয়ে যন্ত্রপাতি মোছামুছি করে। পারিশ্রমিক হিসাবে কোন পয়সা পায় না। একটু চা, একটা রুটি, দু-একটা বিড়ি, এবং সব থেকে ওর যেটা বড় দরকার, ট্রাকে চেপে এদিকে ওদিকে যাওয়া। ও ওর করুণ হিন্দিতে যা জবাব দিল, তা হল, ‘কী করব সর্দারদাদা, মা মরো মরো, তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছলাম।’
অন্তত পনের বছর আগে খিঁচাকবলার মা মারা গিয়েছে। আর এই হোটেল বা ধাবড়া বা আড্ডা বা সরাইখানা, যাই হোক, বিষ্ণুপুর শহরের এত কাছে হলেও, দূর বিদেশের মত। শহরের ভিতরের কারো কোন খবরই এরা কেউ রাখে না। সর্দার ড্রাইভার কোন জবাব না দিয়ে, মদের গেলাসে চুমুক দিল। সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
খিঁচাকবলাও কিছুই বলল না, এগিয়ে গিয়ে, সদার ড্রাইভারের পায়ের কাছে বসে, তার পা টিপতে আরম্ভ করল। ব্যাপারটা এমনই স্বাভাবিক, কেউ অবাক হল না, বা কিছু বলল না। এমনকি সর্দারদাদা ড্রাইভারও না। সে পেঁয়াজে কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে সঙ্গীর সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগল। প্রায় দশ মিনিট পরে খিঁচাকবলার চুল টেনে দিয়ে, ওর ভগ্নীর নাম করে আবার আদর করে গালাগাল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চা পান করবি?’
‘না সর্দারদাদা।’ খিঁচাকবলা সর্দারদাদার কোমর টিপতে টিপতে ওর হিন্দিতে বলল, ‘আমাকে একটা গাড়ি ধরে দিন, আমি একবার সোনামুখী যাব।’
সর্দারদাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তাই বল। কিন্তু এখন কি সোনামুখী যাবার মত কোন লরি মিলবে? চল দেখি রাস্তায়, চলন্ত লরি পেলে, ধরে দেব।’ সে তার ডোরাকাটা ঢলঢলে ইজের পরেই উঠে দাঁড়াল।
খিঁচাকবলার হাসিটা এখন ছোট, নিরীহ, চাটুও বটে। সর্দারদাদার সঙ্গে চার রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। ব্যস্ত মোড়, গাড়ি ট্রাক সব সময়েই চলছে। কিন্তু সোনামুখীর দিক থেকে ঘন ঘন লরি এলেও, সোনামুখীগামী লরি সহসা দেখা যাচ্ছে না। সর্দারদাদা নানারকম খিস্তি আরম্ভ করল। খিঁচাকবলাকে ঠিক না। লরি না আসার কারণেই, ওর ভাগ্যের উদ্দেশে। প্রায় দশ মিনিট পরে বাঁকুড়ার দিক থেকে একটা খালি লরি সোনামুখীর রাস্তায় বাঁক নিতেই, সর্দারদাদা হাত তুলে চিৎকার করল।
লরিটা দাঁড়িয়ে গেল। সর্দারদাদা এগিয়ে গিয়ে হাত তুলে হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কীধর যানা?’
লরির ড্রাইভার হিন্দিতে বলল, ‘সামনের বড় নদীর চর থেকে বালু বোঝাই হবে।’
খিঁচাকবলা বুঝে নিল, বড় নদী মানে বিঁড়াইয়ের পরে দ্বারকেশ্বর নদীর কথা বলছে। বিষ্ণুপুরের লোকেরা অবশ্যি দ্বারকেশ্বরকে যশোদা নদী বলে। ও তাড়াতাড়ি ওর হিন্দিতে বলে উঠল, ‘ওই নদীর বিরিজ পর্যন্ত যেতে পারলে, আবার নতুন একটা দেখে নেব।’
সর্দারদাদা তার ভাষায় বলল, ‘একে একটু নিয়ে যাও।’
লরির ড্রাইভার ঘাড় নেড়ে খিঁচাকবলাকে পিছনে ওঠার ইঙ্গিত করল। পিছনে কিছু মেয়ে আর পুরুষ কুলি-কামিন ছিল। সর্দারদাদা বলল, ‘চলে যা খিঁচা।’
খিঁচাকবলা সামনের পা-দানিতে পা রেখে, এক লাফেই পিছনে উঠে পড়ল। লরিটা চলতে আরম্ভ করল। খিঁচাকবলা একবার দেখে নিল, কুলি-কামিনদের কেউ চেনা কি না। কেউ চেনা না। অন্য এলাকার। দেখলেই বোঝা যায় সকলেই বাউরি। মেয়েরা সবাই নিচে ধার ঘেঁষে বসেছে। পুরুষরা গায়ে গা ঠেকিয়ে। লরির সামনে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। খিঁচাকবলা পুরুষদের কাছে গিয়ে, একজনের কাঁধে হাত রেখে, ভারসাম্য বজায় রাখল। হাসল লোকটার দিকে তাকিয়ে। ওরা সবাই হাসল, নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। খিঁচাকবলাকে দেখল আপাদমস্তক। কেউ কোন কথা বলল না।
কুড়ি মিনিটের মধ্যেই লরিটা দ্বারকেশ্বরের লম্বা ব্রিজের ওপর এসে উঠল। নিচে চৈত্রের নদী। বিশাল চওড়া। ওপার ঘেঁষে একটা ক্ষীণ স্রোতের ধারা। মাঝে মাঝে টুকরো আয়নার মত জল। বাকীটা সবই বালিতে ধুধু করছে। লরিটা ব্রিজ পেরিয়ে দাঁড়াল। খিঁচাকবলাকে নামাবার জন্যই। কারণ লরিটা এবার আরও এগিয়ে, বাঁদিকের ঢালুতে কোথাও কাঁচা রাস্তা দিয়ে নেমে যাবে। খিচাঁকবলা একটা হালকা ন্যাকড়ার টুকরোর মত লাফিয়ে মাটিতে রাস্তায় পড়ল, ড্রাইভারের উদ্দেশে হাত নাড়ল। লরিটা এগিয়ে গেল।
খিঁচাকবলা একটু দূরের একটা গাছতলার দিকে তাকাল, তারপর দূরের রাস্তার দিকে। এখন ওর মুখে হাসি নেই, চোখের কালো তারা দুটো কেবল ঝকঝক করছে। একটু দূরের গাছতলায় কিছু গ্রামের মেয়ে পুরুষ। বাসের যাত্রী। সোনামুখী থেকে আগত বাসে বিষ্ণুপুর বা বাঁকুড়ায় যাবে। খিঁচাকবলাও আসলে সোনামুখীর নাম করে এখানেই নামতে চেয়েছিল। সর্দারদাদাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। এখানে নামার কথা বলা যায় না, কারণ এখানে নামার কোন দরকার থাকতে পারে না। অথচ খিঁচাকবলার আছে। ও প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে পয়সা বের করল, গুনল। গাছতলার দিকে যেতে যেতে উচ্চারণ করে বলল, ‘বিষ্টুপুরের ভাড়া থেক্যা বেশি পয়সা রইচে। বিষ দিয়া মারিস্ না মা মনসা, ডংশনটি ছুট্যে না যায়।’ কপালে হাত ঠেকাল।
খিঁচাকবলার সময়জ্ঞান খুব টনটনে। বেলা আর রোদ দেখেই বুঝতে পেরেছিল। যশোদা নদীর ইস্টাপে সোনামুখীর বাস কখন এস্যে দাঁড়াবেক। ও গাছতলায় পৌঁছুতেই উত্তর দিক থেকে গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে এল। দূরে বাস দেখা গেল। যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠল। হাতের পোঁটলা পুঁটলি হাতে নিল। যেন এখনই নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দেবে, এমন একটা ব্যস্ততা। দোষ দেওয়া যায় না। দেখাই যাচ্ছে, বাসটা ছাদ-ভরতি লোক নিয়ে এসে দাঁড়াল। এখানে নামার যাত্রী নেই, সবই ওঠবার। খিঁচাকবলার ছাদে ওঠাই উচিত ছিল, একটা বিটা ছেলা যাত্রী। কিন্তু ও নিমেষেই পিছলে ভিতরে ঢুকে গেল। দাঁড়াবার জায়গাও নেই। তবু কনডাকটর মেয়ে যাত্রীদের পোঁটলার মতই ভেতরে ঠেলে দিল। তারপরেই চিৎকার, ‘জেট!’ বাস সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিল।
খিঁচাকবলাকে এখন দেখাচ্ছে আরও দুস্থ, রুগ্ণ, অসহায় আর করুণ। একজনের ঘাড়ে পড়ে তো, ঠেলা খেয়ে আর একজনের ঘাড়ে। পয়সার মুঠি তুলে বলল, ‘বিষ্টুপুরের একখান টিকিট দিয়া কর গ দাদা।’
কেউ জবাব দিল না। অবিশ্যি কনডাকটর ঠিক আদায় করবেই। ভিড়ের মধ্যে সে আগে দরজার কাছে যাত্রীদের টিকিট দিচ্ছে। খিঁচাকবলা চারদিকে দেখতে লাগল। চোখের হলুদ লাল ছোপ থেকে, শিকরে বাজের চোখ ঝকমকিয়ে উঠল। উঁচু আকাশ থেকে যেন, জঙ্গলের গভীরে সাপ, বিছে, ইঁদুর, পতঙ্গ, খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর তার মধ্যেই থেকে থেকে ককিয়ে উঠছে, ‘আই, মের্যা ফেলাবেক গ, খাড়া থাকতে লারছি।…
দু-একজন দয়ালু চেপে চুপে একটু ফাঁক দিতে চাইছে। হঁ, ইয়াদের ভিতর বাবু ভদ্দরলোক রইচে। গাড়ি দ্রুত ছুটছে। এখন কোর্ট কাচারির সময়। মহকুমা আর জেলা সদরে অনেকে চলেছে। শিকরে বাজের চোখ, আশেপাশে, নিচে, সবখানে বিদ্যুতের মত হানছে। চশমা চোখে, শার্ট প্যান্ট পরা একটা বাবু। ঘামছে, কিছু ভাবছে। খিঁচাকবলার হাত সাপের মত দ্রুত, নিঃশব্দে, বাবুর প্যান্টের পকেটে ঢুকে গেল। অই, বাবুর ব্যাগখানি মোটা! ডংশন করিলা নাগ মা মনসার আজ্ঞায়। দ্রুত, যেন হাওয়ায় হাত বেরিয়ে এল পকেট থেকে। চলে গেল নিজের পেট কোমরে। বাঁ হাতে কাজটা সারল। প্যান্টের পেট কোমরে বস্তুটি গুঁজে দিয়ে, যেমন দাঁড়িয়ে টলছিল, তেমনি টলতে লাগল। সবাই টলছে। কিন্তু খিঁচাকবলা এখন ঘামছে। টলতে টলতে ইঞ্চি ইঞ্চি পিছু হটছে।
দ্রুতগামী বাস বিঁড়াইয়ের মোড় ছাড়িয়ে দাঁড়াল। বিষ্ণুপুরের যাত্রীরা এখানে নামবে। খিঁচাকবলা পিছলে দরজার কাছে গিয়ে, পয়সার মুঠি খুলে দিল কনডাকটরের সামনে। কনডাকটর পয়সা নিয়ে টিকেট দেবার আগেই, যেন যাত্রীদের ধাক্কায় ও বাইরে ছিটকে পড়ল। বেশ কিছু যাত্রী নামল। খিঁচাকবলা কারো দিকে তাকাল না। একবার হোটেল আড্ডার দিকে দেখল, তারপরে পিছন ফিরে, ওরা যাকে বমবে রোড বলে, সেই রাস্তায় হাঁটতে আরম্ভ করল।
এ রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। গাড়ি চলে কম। খিঁচাকবলা লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটছে, প্রায় দৌড়ের মত। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছে। বাস চলে গিয়েছে। যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে-যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। একটাই মাত্র লোক এ রাস্তায় আসছে। হাঁটুর কাছে কাপড় তোলা, ময়লা একটা জামা গায়ে। ওকে নিয়ে ভাববার কিছু নেই। বাঁ হাত দিয়ে পেট কোমরে একবার চাপ দিল। ঠিক আছে। সামনে তাকিয়ে দেখল। অদূরেই জয়পুরের শালবন। ডাইনে কেষ্ট বাঁধের উঁচু পাড়। কলকাতার বাস ওই রাস্তায়, বাঁধের ধার দিয়ে বিষ্ণুপুরে ঢোকে। ও হাঁটতে হাঁটতে মোড়ে এসে একবার দাঁড়াল। পিছন ফিরে দেখল। সেই লোকটাই আসছে। জয়পুর বা কোতুলপুরের বাস ধরতে বোধ হয়। জায়গাটা নিরালা।
খিঁচাকবলা বাঁধের ওপরে উঠল। উঠে আবার নিচে নামল। বাঁধের জল অনেকখানি সরে গিয়েছে। সামনেই বেড়াগাছের ঝাড়। বাঁ দিকে একটু দূরে কতগুলো শাল গাছ, খানিকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিচ্ছিন্ন, যেন নিজেদের একটা আলাদা শালের সংসার, বনের বিস্তৃতিতে মিশে নেই। খিঁচাকবলা সেই দিকে গেল। কেষ্ট বাঁধের এদিকে কেউ নাইতে আসে না। চারদিকে ঝোপঝাড় জঙ্গল, আর শুকনো পাতা ছড়ানো। খিঁচাকবলা শালগাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে একবার দেখে নিয়ে, একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে, পা ছড়িয়ে বসল। পেটকোমর থেকে মানিব্যাগটা টেনে বের করল, কপালে ছুঁইয়ে, মুখ খুলল। প্রথম ভাঁজে কিছু কাগজ, শুকনো বেলপাতা আর ফুল। পরের ভাঁজে টাকা !…বুকে ঢাকের দগড় বেজে উঠল। দশ টাকার নোট, একটা পাতলা গোছা। খানকয়েক পাঁচ টাকা। খিঁচাকবলা সব নোটগুলো বের করে গুনতে আরম্ভ করল। অই শালা, ইয়াকে কী বুলবেক গ! একশ পঁচিশ টাকা! তা বাদে, একটা বোতামবন্ধ ছোট ঘরে কিছু খুচরো।
খিঁচাকবলা আপনমনে মাথা নাড়ল। ওর শিক্রে বাজের চোখ দুটো এখন খুশিতে চকচক করছে, জ্বলছে না। উচ্চারণ করল, ‘হঁ কী কাণ্ড দ্যাখ ক্যানে, অ্যাঁ? এত টাকা ই ভাবে পকেটে নিয়ে কেউ পথে ঘাটে বেরায়?’
‘হিঃ হিঃ হিঃ…।’ উৎকট হাসিটা ঠিক পিছনেই শোনা গেল, ‘বেরাবেক নাই ক্যানে? বাবুটার কপালের দোষ।’
খিঁচাকবলা কাঠবেড়ালির মত লাফিয়ে উঠে ছিটকে সরে দাঁড়াল। এক হাতের মুঠিতে টাকা, অন্য হাতে ব্যাগ, বুকটা ধকধক করছে। সেই লোকটা, পিছনে পিছনে আসছিল। হাঁটুর ওপরে তোলা ময়লা খাটো ধুতি, তার চেয়ে ময়লা একটা বুক খোলা নীল রঙের জামা। বেঁটে খাটো শক্ত মাজা মাজা রঙের চেহারা। বয়স বোধ হয় খিঁচাকবলার থেকে কিছু বেশি হবে। মাথার চুলে ধূলা। চোখ দুটো বড় আর লাল, নাকটা মোটা। দাঁত বের করে হাসছে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। খিচাকবলা জীবনে বোধ হয় এমনভাবে কখনো চমকে ওঠেনি। কিন্তু লোকটা পুলিশ বা সেই বাবুটা নয় দেখে, যেন কিঞ্চিৎ ভরসা পেল, যদিও সন্দেহটা পুরোপুরি ঘুচল না। মনে মনে যে-কোন অবস্থার জন্য তৈরি হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তু?’
‘পেরকাশ।’ লোকটা খুশিতে ডগমগ হেসে বলল।
খিঁচাকবলা জিজ্ঞেস করল, ‘কুথা থেক্যা আইচু?’
‘ক্যানে, সনামুখীর উ বাসটা থেক্যা আইচি।’ পেরকাশ নামে লোকটা হি হি করে হাসল।
খিঁচাকবলার হলুদ লাল ছোপ চোখের ভিতরে কালো তারা দুটো অঙ্গারের মত জ্বলে উঠল। পেরকাশ ঘাড় ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আবার বলল, ‘অই বাবা, কী হাত গ তোমার। দেখ্যেচি, দেখ্যেচি!…উই শালা, আমার বুকটা ধড়ফড়াইচিল গ! মাক্কালীর দিব্যি, শালা আমার লিশ্বেস আটকাই গেইচিল। অই, কী হাত গ তোমার! হি হি হি।’ সে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খিঁচাকবলার দিকে এগিয়ে এল।
খিঁচাকবলা ঝটিতি পাক খেয়ে খানিকটা সরে গেল, ‘অ্যাই শালা, আমার কাছকে এয়েচু কি তোর গদ্দন লিয়ে লুব। তোর ঘর কুথা?’
‘রামসাগর।’ পেরকাশ একটুও না দমে খুশি-ডগমগ হেসেই বলল, ‘ক্যানে, আমার গদ্দান লিবে ক্যানে? আমি ত কারুক্কে কিছু বুলি নাই।’
খিঁচাকবলা সে কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করিস তু?’
‘বাউনাদিগের জমি চষি, বগার খাটি, মুনিষ মান্দার যা বুলা কর।’ পেরকাশ বলল, ‘সনামুখীতে বাউর ঘর, শাউড়ির ব্যায়রাম, ফুট্যে যাবেকগা, উয়াকে দেখতে গেইচিলাম। ঘরকে ফিরার পথে তোমাকে—উ বাবা, কী তোমার হাত গ! ভগবান দেখাই দিয়া করচে।’ সে আবার নাচতে নাচতে খিঁচাকবলার দিকে এগিয়ে গেল।
খিঁচাকবলা কাঠবেড়ালির মতই, গাছের আড়াল দিয়ে খানিকটা সরে গেল, ‘কী চাস তু?’
‘কী চাই? হি হি হি।’ পেরকাশের হাসি আর ধরে না, ‘কী চাই? অই, কী হাত গ তোমার। ছ কুড়ি পাঁচ টাকা, দেখ্যেছি, তুমি গণা করচিলে, হি হি হি, অই বাবা কী হাত গ তোমার। শালা, আমার কী বুক ধড়ফড়াইচিল, কিন্তু একটা কথা বুলি নাই।’
খিঁচাকবলার কাটাকুটি দাগ মুখটাও এখন চোখের মত দপদপে অঙ্গার, ‘ও শালা কী চাস তু?’
‘হি হি হি, কী চাই?’ পেরকাশ দুবার নেচে নিল। তারপরে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে খিঁচাকবলার হাতের দিকে দেখাল।
‘কারুক্কে কিছু বুলি নাই, তোমার পিচু পিচু চল্যে আইচি। আমার সনা তুমি, আদাআদি দিয়া কর।’
খিঁচাকবলা প্যান্টের পকেটে সব ঢুকিয়ে দিয়ে, খ্যাঁক করে উঠল, ‘শালা, তোর বাপের টাকা পেয়েচু? আদাআদি? এক পাই দুব নাই, যা ফুট্যে যা শালা।’
‘আঁ, এক পইসা দিবে নাই?’ পেরকাশ যেন বিষম খেল, তারপরেই হঠাৎ ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, ‘অই আমার সনা তোর পায়ে ধরা করচি, মরে যাবকগা।’ বলেই খিঁচাবলার দিকে ঝাঁপ দিল, আর আছড়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে, ‘তোর পা ধরা করচি, উ টাকার আদা না পেল্যে মরে যাবকগা।’ আঁউ আঁউ করে কাঁদতে লাগল।
খিঁচাকবলা জীবনে এমন চমকায়নি, এত অবাকও বোধ হয় কখনো হয়নি। লোকটার কান্না শুনে কেউ না আবার এসে পড়ে। ও আশেপাশে তাকাল, কয়েক পা সরে গিয়ে বলল, অ্যাই শালা, অ্যাই ক্যাল্লাইটা ওঠ্। পাঁচ টাকা দুব, লিয়ে ফুট্যে যা।’
‘অই সনা আমার ঘরে যাবকগা।’ পেরকাশ মুখে জামায় ধূলা মেখে, উঠে ঝুঁকে বসল। মুখ তুলল, লাল চোখে জল, বলল, ‘উ বড় মাথার টাকা রে সনা। অই বাবা, কী তোর হাত। কী করবি তু উ টাকা দিয়া? মদ খাবি? য্যাতো খাবি, আমি দুব। বারোভাতারিদিগের ঘরকে যাবি? ক্যানে সনা, তু আমার ঘরকে চল, তোকে একভাতারি দিয়া করবক?’
খিঁচাকবলার মোটা ভুরু শুয়াঁপোকার মত ঢেউ দিল, ‘একভাতারি?’
‘হঁ, আমার বউ, দুই বিয়ানী বউ, কিন্তুল গতরে এখনো শাঁস ভরা জল, মাক্কালীর দিব্যি।’ পেরকাশ দু হাত তুলে জোড় করল, ‘উ তোকে তুষে খুশে খাওয়াবেক। তু আমার ঘরকে চল সনা।’ সে যেন থরথর করে কাঁপছে। ধূলার আর গালের জলে মুখটা যেন থেকে থেকে দলা পাকিয়ে উঠছে। ঠাস ঠাস করে বুক চাপড়ে বলল, ‘উ টাকা লিয়ে, তু আমার ঘরকে চল র্যা সনা। বউ তোক তুষে খুশে খাওয়াবেক। কথা না মানলে, উয়াকে আমি খুন করবক। চল্ সনা, চল্।’
খিঁচাকবলা হতবাক। ওর জীবনে এমন কাণ্ড কখনো ঘটেনি। শালা বুলে কী হ্যা? দেখে মনে হচ্ছে, লোকটার কোন ব্যায়রাম আছে। তা না হলে কেউ এরকম করে? এসব কথা বলে? পাগলও হতে পারে। এখনই হাতে পায়ে খিঁচুনি লাগবে না তো? লোকটাকে আসল খিঁচাকবলা মনে হচ্ছে। আর যদি এইভাবে কেঁদে ককিয়ে চেঁচাতে থাকে, তা হলে লোকজন এসে পড়বেই। ভাবতে ভাবতে খিঁচাকবলা মন ঠিক করে ফেলল। চারপাশে দেখল, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠো করে টাকা ব্যাগ ধরল।
‘দিবি সনা। টাকা দিবি?’ পেরকাশের জলে ভেজা লাল চোখে একটা উৎকট ঝলক লাগল। গোটা শরীর থরথর করে কাঁপছিল, ঠোঁটের কষে গ্যাঁজলা।
খিঁচাকবলা ঘূর্ণিবাতাসের মতন পিছন ফিরল। তারপরে পুব দিকে বাঁধের উঁচু পাড়ের দিকে হাওয়ার আগে ছুটল। পিছন থেকে মরণের আর্তনাদ ভেসে এলো। ‘অই মানিক আমার, সনা র্যা আমার, টাকা দিয়া যা—অই-ই-ই…।’
খিঁচাকবলা একটুও না থেমে, একবারও পিছু না ফিরে, বাঁধ টপকে রাস্তার বাঁদিকে শালবনে ঢুকে, দৌড়তে লাগল। বনের ভিতর দিয়ে, দুরন্ত বেগে, ধাক্কা বাঁচিয়ে পুব দিকে ছুটতে ছুটতে এক সময়ে দাঁড়াল। না, লোকটার পায়ের শব্দ প্রথম থেকেই শোনা যাচ্ছিল না। চিৎকারটাও জঙ্গলে ঢোকার পরে আর শুনতে পায়নি। খিঁচাকবলা হাঁপাচ্ছে, দরদর করে ঘামছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল, অনেকটা ছুটে এসেছে। জয়পুরের এই জঙ্গলটাকেও বিশ্বাস নেই। এ হাত সাফাইয়ের ধন তাকে খাবে। হ্যাঁ, এ বনে অনেক কাঁচাখেকো বাঘেরা ছুরি বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করে। ও তাড়াতাড়ি দক্ষিণে ঘুরে রাস্তার দিকে চলল। আর ভাবতে লাগল, কী নাম শালার? পেরকাশ। ব্যায়রাম আছে, না পাগল? কী করে বাসের মধ্যে দেখল? যদি একবার মুখ খুলত—উই শালা! মার খেয়ে মরে যেতে হত। তা বলে আধাআধি বখরা? কেউ দেয়? আন্খা একটা লোক, পুলিশ না, বাবু না, আধাআধি? আবার বলে কিনা, একভাতারি বউকে দেবে? উই শালা।… কিন্তু দশ বিশ দেওয়া উচিত ছিল। খিঁচাকবলার বিচারে, মনটা একটু নরম হয়ে গেল। সত্যি, শালা বাসের মধ্যে টু শব্দ করেনি। না, পঁচিশ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল যে?
ভাবতে ভাবতে, আর শিকরে বাজের চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে, রাস্তায় এসে পড়ল। পড়তেই গোঁ-গোঁ শব্দ শুনে, পুবে তাকিয়ে দেখল, একটা বাস আসছে। দেখেই চিনতে পারল, আরামবাগের বাস, বিষ্ণুপুরে যাবে। ও ঝটিতি পকেটে হাত দিয়ে ব্যাগটা বের করে, বোতাম খুলে কিছু খুচরো পয়সা বের করে নিল। আবার পকেটে সব ঢুকিয়ে, ভিতরে মুঠো পাকিয়ে রাখল। বাসটা এসে পড়েছে। ও হাত তুলল। বাসটা একটু গতি কমাল। ও লাফিয়ে উঠে পড়ল। পকেটটা সাবধান। চোরের ওপর না বাটপাড়ি হয়ে যায়।
পরমুহূর্তেই খিঁচাকবলার মনে একটা সন্দেহ কাঁটার মত ফুটল। পেরকাশও যদি বাসের জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে? যদি বাসে ওঠে? উই শালা সব বরবাদ। তবে বাসটায় ভিড় আছে। ওর নাম খিঁচাকবলা। ঠিক লুকিয়ে পড়তে পারবে। ভাবতে ভাবতেই বাসটার গতি কমে এল। কমতে কমতে দাঁড়িয়ে পড়ল। কনডাকটর হাঁকল, ‘কী হইচে, ডাঁড়াইচ ক্যানে?’
ড্রাইভারের গলা শোনা গেল। ‘রাস্তার মাঝখানকে একটা লোক শ্যালা শুয়্যা রইচে। মাতাল হচ্ছে।’
কনডাকটর নামল, সঙ্গে আরো কয়েকজন কৌতূহলী যাত্রী। খিঁচাকবলা নির্ভয়। রাস্তায় মাতাল শুয়ে আছে। পেরকাশ না। জায়গাটা অবিশ্যি বিষ্ণুপুরে ঢোকার মুখের কাছেই।
কনডাকটরের চিৎকার শোনা গেল। ‘অই, ই লোকটা ফুট্যে গেইচে, মড়া।’
চিৎকার শুনে আরও কিছু লোক নামল! মড়া? খিঁচাকবলা দরজার কাছে মুখ বাড়াল। পেরকাশ! মড়া?
কনডাকটর আবার চিৎকার করল, ‘মুখের কষে রক্ত। বুকে ধুকধুকি নাই। নিশ্বাস পড়ছে নাই। মড়া।’
খিঁচাকবলা নেমে পড়ল। ড্রাইভার হাঁকল, ‘আরে, সব রিয়া দেখতে যাইচে কী? চল চল, থানায় যেইয়ে খবর দিতে হবেক।’ সে জোরে জোরে হর্ন বাজাল।
যাত্রীরা দৌড়ে বাসে উঠল। সব শেষে কনডাকটর। কিন্তু খিঁচাকবলা উঠল না। বাসটা জঙ্গলের একেবারে ধার ঘেঁষে মৃতদেহটা বাঁচিয়ে পেরিয়ে গেল। খিঁচাকবলা রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা পেরকাশের কাছে গেল। হ্যাঁ, ঠোঁটের কষে রক্ত, চোখ দুটো আধ বোজা, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মড়া? ও নিচু হয়ে গায়ে হাত দিল। এখনো গরম, কিন্তু সত্যি বুকের ধুকধুক নড়ছে না। নাকে নিশ্বাস নেই। দেখলেই বোঝা যায়, মরে গিয়েছে। কেন? মরে গেল কেন? সত্যি ব্যায়াম ছিল নাকি? না, টাকার শোকে?
খিঁচাকবলা সোজা হয়ে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে ওকে ভূতগ্রস্তের মত দেখাচ্ছে। মরে গেল কেন? খুব কাঁদছিল। খুব আশা করেছিল, টাকা পাবে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। খিঁচাকবলা সচেতন হয়ে পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। লোকটার পকেট ট্যাঁক একবার ঘেঁটে দেখে গেলে হত না? কিছু কি আর নেই? ও মৃত পেরকাশের দিকে একবার তাকাল। তারপর মনে মনে বলল, ‘যাক গা, উয়রটা উয়ারই থাক।’ ও হাঁটতে আরম্ভ করল। কোথায় যেন ঘর বলছিল? রামসাগর। নাম পেরকাশ। সত্যি, শালা যদি বাসে একটু আওয়াজ দিত, উই শালা। ভাবা যায় না। চলতে চলতে উচ্চারণ করল, ‘একবার রামসাগরকে যেত্যে হবেক। হুঁ, উয়ার ঘর গেরস্তি দেখ্যা আসব। উয়ার দুই বিয়ানী বউ…কিন্তু শালা আমতাবাড়ি ফুট্যে গেইল ক্যানে?’…