খিঁচখিঁচে বুড়ো

খিঁচখিঁচে বুড়ো 

ছোটাচ্চুর অফিসে তার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসতে খুব আরাম। টুনি যখনই আসে খানিকক্ষণ সেখানে বসে থাকে। আজকেও সে বসে থেকে ছোটাচ্চুকে লক্ষ করছে। ছোটাচ্চুকে দেখেই টুনি মোটামুটি বুঝতে পারে ছোটাচ্চুর মনের অবস্থাটা কী রকম। যখন ঘ্যাসঘ্যাস করে গাল চুলকায় তখন বুঝতে হবে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছে। যখন মাথার চুলের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে চুলগুলি টানাটানি করে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা নিয়ে ছোটাচ্চু দুশ্চিন্তা করছে। যখন কানের ভেতর কেনে আঙুল ঢুকিয়ে কান চুলকায় তখন বুঝতে হবে কোনো কিছু নিয়ে মেজাজটা ভালো। 

আজকে ছোটাচ্চু চেয়ারে হেলান দিয়ে তার কেনে আঙুল দিয়ে কান চুলকাচ্ছে, চোখ দুটি আধখোলা। তখন রিসেপশনের মেয়েটি ছোটাচ্চুর ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “স্যার, একজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।” 

এই মেয়েটি ছোটাচ্চুর অফিসে কাজ করতে এসেছে। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে এসেছে কিন্তু দেখলে মনে হয় ক্লাস এইটে পড়ে। 

ছোটাচ্চু চোখ না খুলেই বলল, “নীলিমা, তোমাকে আমি কতবার বলেছি যে আমাকে স্যার ডাকবে না।”

নীলিমা নামের রিসেপশনিস্ট মেয়েটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সরি স্যার। আসলে মনে থাকে না, সবসময়ই দেখে আসছি বসদের স্যার ডাকতে হয়—সেই জন্য—”  

ছোটাচ্চু চোখ দুটো একটু খুলে বলল, “আমাদের আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কোনো বস নাই। এটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলির মতো। বুঝেছো?” 

নীলিমা মাথা নাড়ল। বলল, “বুঝেছি।” 

ছোটাচ্চু আবার তার চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে কেনে আঙুল দিয়ে তার কান চুলকাতে লাগল। নীলিমা জিজ্ঞেস করল, “একজন দেখা করতে এসেছে— তাকে পাঠিয়ে দেবো?” 

ছোটাচ্চু বলল, “দাও। পাঠিয়ে দাও।” 

ছোটাচ্চু এবার সোজা হয়ে বসল, মুখটা একটু গম্ভীর করল। টুনির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল, যার অর্থ, টুনি তুই এখানে বাসে আছিস কেন? বিদায় হ। দেখতে পাচ্ছিস না আমার একজন ক্লায়েন্ট আসছে?” 

টুনি অবশ্য ছোটাচ্চুর ভুর কুঁচকানো না দেখার ভান করে তার হাতের গল্প বইটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। কান খাড়া রাখল ছোটাচ্চু আর তার ক্লায়েন্ট কী নিয়ে কথা বলে সেটা শোনার জন্য। কেউ যখন কোনো একটা কেস নিয়ে ছোটাচ্চুর কাছে আসে সেটা শুনতে টুনির খুব ভালো লাগে। 

একটু পরেই ছোটাচ্চুর দরজায় একজন মানুষ দাঁড়াল, বলল, “আসতে পারি?” 

ছোটাচ্চু মুখটা আরো গম্ভীর করে বলল, “জি আসেন। বসেন।” 

মানুষটি বসল। ছোটাচ্চু বলল, “আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?” মানুষটি বলল, “আমার নাম নাজমুল হাসান। আমি একটা বিশেষ বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।” 

ছোটাচ্চু বলল, “কী বিপদ, বলেন।” 

“বিষয়টা খুবই লজ্জার, বলতেও আমার লজ্জা লাগছে।” 

ছোটাচ্চু বলল, “একসময় ডাক্তার আর উকিলদের সামনে কোনোরকম লজ্জা না পেয়ে সবকিছু বলতে হতো। আজকাল ডিটেকটিভদের সাথেও কোনোরকম লজ্জা না করে সবকিছু বলে ফেলতে হয়। বলে ফেলেন।”

“জি বলছি। কিন্তু আমি সেটা খুবই গোপনে বলতে চাই। শুধু আপনার সাথে—” বলে মানুষটি চোখের কোনা দিয়ে টুনির দিকে তাকাল। মুখে না বললেও বুঝিয়ে দিলো মানুষটি টুনির সামনে তার লজ্জার কথাগুলো বলতে চায় না। টুনি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বোঝাই যাচ্ছে তাকে এখন চলে যেতে হবে। 

ছোটাচ্চু বলল, “টুনি—এই টুনি—”  

টুনি মাথা তুলে বলল, “আমাকে কিছু বলছো?” 

“হ্যাঁ। আমাদের এখন একটু কনফিডেন্সিয়াল কথা আছে। তুই বাইরে গিয়ে বস।” 

টুনি বলল, “ঠিক আছে।” তারপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো। শাহানাপুকে বলে একটা যন্ত্র তৈরি করতে হবে, সেটা দিয়ে ঘরে না বসেও ঘরের ভিতর কী কথা হচ্ছে সেটা যেন বাইরে বসে শোনা যায়। মানুষটির লজ্জার কথাটি কী টুনির খুবই শোনার ইচ্ছা করছিল। 

* * * 

রাত্রিবেলা যখন বাচ্চাকাচ্চারা তাদের পড়াশোনা (কিংবা পড়াশোনার ভান শেষ করে দাদির ঘরে হুটোপুটি করছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। প্রত্যেক দিনের মতো আজকেও বাচ্চারা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “ ছোটাচ্চু! আজকে আমাদের জন্য কী এনেছো?” 

ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “বুকভরা ভালোবাসা!” 

বাচ্চারা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না। ভালোবাসার দরকার নাই। খাওয়ার জন্য কী এনেছো বলো!” 

ছোটাচ্চু বলল, “প্রত্যেক দিন খাই খাই করিস—ব্যাপারটা কী?” 

একজন বলল, “মনে নাই, চুক্তিপত্রে আছে তোমার ইনকামের তিরিশ পার্সেন্ট আমাদের দিতে হবে?” 

“তিরিশ পার্সেন্ট খাবার কিনে দিতে হবে তো বলা নাই। বড় হলে যখন চাকরি-বাকরি পাবি না তখন একটা গরু কিনে দিবো। সেটার দুধ বিক্রি করে সংসার চালাবি।” 

বিষয়টা চিন্তা করে বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। একজন বলল, “গরুটা কিন্তু থাকবে তোমার ঘরে!” 

চেঁচামেচি-হইচই একটু কমে আসার পর টুনি গিয়ে ছোটাচ্চুর পাশে বসল। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তোমার অফিসের লোকটা কি তোমাকে তার লজ্জার কাহিনিটা বলেছে?” 

টুনি মোটেও আশা করেনি যে ছোটাচ্চু তাকে সেই লজ্জার কাহিনিটা বলবে, কিন্তু দেখা গেল যে ছোটাচ্চু কথা বলার মুডে আছে। আনন্দে হা হা করে হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ বলেছে। ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং স্টোরি।” 

‘ইন্টারেস্টিং স্টোরি’র কথা শুনে এবারে অনেকেই ছোটাচ্চুকে ঘিরে ধরল, জিজ্ঞেস করল, “কী ইন্টারেস্টিং স্টোরি ছোটাচ্চু?” 

যে কথাটা মানুষটা গোপনে শুধু ছোটাচ্চুকে বলেছে, টুনির সামনে পর্যন্ত বলতে রাজি হয় নাই, ছোটাচ্চু বেশ সহজেই সেই গল্পটা অন্যদের বলতে শুরু করে দিলো। গল্পট এ রকম : 

মানুষটা বড় সরকারি অফিসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কিংবা ডেপুটি সেক্রেটারি এ রকম কেউ হবে। ছোটাচ্চুকে বলল, “আমার বলতে খুবই লজ্জা লাগছে—আমার বাসায় ড্রাগস নিয়ে সমস্যা।” 

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী করম সমস্যা?” 

“বাসায় একজন ড্রাগ এডিক্ট, কিছুতেই থামাতে পারি না। সমাজ নিয়ে থাকতে হয়, জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

“কী ড্রাগস?” 

মানুষটি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “মারিজুয়ানা। সোজা বাংলায় যেটাকে গাঁজা বলে সেইটা।” 

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কে গাঁজা খায়? আপনার ছেলে?” 

ভদ্রলোক মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমার বাবা।” 

গল্পের এই জায়গায় ছোটাচ্চু আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “চিন্তা করতে পারিস? ছেলে কাঁচুমাচু হয়ে বলছে বাবা গাঁজা খায়! সে লজ্জায় মারা যাচ্ছে!” 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “মানুষটার বাবা কী করে? কত বয়স?” 

ছোটাচ্চু বলল, “অনেক বয়স—আশি-পঁচাশি হবে। এখন কিছু করে না। ইঞ্জিনিয়ার ছিল, এখন রিটায়ার করেছে।’ 

“তোমাকে কী করতে হবে?” 

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “এইটা ইন্টারেস্টিং!” 

ইন্টারেস্টিং শুনে সবাই আরো কাছে এগিয়ে এলো। ছোটাচ্চু বলল, “বুড়ো মানুষটা ঘর থেকে বের হয় না, একেবারে নিজেদের লোক ছাড়া তার ঘরে কেউ ঢুকেও না কিন্তু তার পরেও কীভাবে কীভাবে জানি তার কাছে গাঁজার সাপ্লাই চলে আসছে। ঘরে গেলেই দেখা যাবে সিগারেটের ভেতর গাঁজা ঢুকিয়ে টেনে যাচ্ছে!” 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কয়তলা বাসা?” 

“ছয়তলা। বুড়োর জন্য ছয়তলায় আলাদা ছোট ঘর।” 

শান্ত হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “ড্রোন! ড্রোন!” 

ছোটাচ্চু বলল, “বুড়োর ঘরের বাইরে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। কে যাচ্ছে কে আসছে সবসময় দেখা হয়। কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু দেখা যায় নাই।” 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “বুড়ো ইঞ্জিনিয়ার সময় কাটায় কী করে?” 

ছোটাচ্চু বলল, “বুড়ো মহা ক্রিয়েটিভ। খুব ভালো ইঞ্জিনিয়ার ছিল, অনেক টাকা কামাই করেছে। এই ছয়তলা বাসাটাও বুড়ো তৈরি করেছে। বউ মারা যাওয়ার পর একা। ঘরে বসে বসে লেখালেখি করে।” 

“লেখালেখি করে?” 

“হ্যাঁ।” 

“কী লেখালেখি করে?” 

“ডিটেকটিভ উপন্যাস।”

“বই ছাপা হয়েছে?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ! কে ছাপবে? উপন্যাসের নাকি কোনো মাথামুণ্ডু নাই। গাঁজা খেয়ে উপন্যাস লিখলে তার মাথামুণ্ডু থাকবে কেমন করে?” 

শান্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে লেখকদের সমস্যা। গাঁজা না খেলেও লেখা পড়ে মনে হয় গাঁজা খাওয়া উপন্যাস।” 

টুম্পা লেখকদের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করল, “সব লেখা গাঁজাখুরি না। ভালো ভালো লেখা আছে।” 

শান্ত আরো গম্ভীর হয়ে বলল, “লেখা ভালো হলে হতেও পারে কিন্তু লেখকদের অনেক সমস্যা। সবসময় বানিয়ে বানিয়ে, প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে লেখে, তাই তাদের ব্রেনে গোলমাল হয়ে যায়।” 

ছোটাচ্চু নিজেই যেহেতু অনেক দিন থেকে একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছে তাই এবারে শান্তকে একটা ধমক দিলো, “তুই চুপ কর দেখি। কয়টা লেখককে জীবনে দেখেছিস যে এ রকম উল্টাপাল্টা কথা বলছিস?” 

আলাপের যেহেতু কোনো মাথামুণ্ডু নাই তাই টুনি সেটা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তুমি কেসটা কেমন করে সলভ করবে?” 

ছোটাচ্চু মুখ বাঁকা করে বলল, “এইটা সলভ করা আবার কঠিন নাকি? একেবারে পানির মতো সোজা।” 

একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন? কেন এইটা পানির মতো সোজা?” 

“বুঝতে পারছিস না? ছয়তলা একটা ঘরে এই বুড়ো ইঞ্জিনিয়ার থাকে, তাই যা কিছু হওয়ার সব এই ঘরের মাঝে হতে হবে। পাঁতি পাঁতি করে খুঁজলেই বের হয়ে যাবে।” 

“কিন্তু বাসার সবাই তো খুঁজেছে, কিছু তো পায় নাই।” 

ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল। বলল, “বাসার সবাই খুঁজেছে সাধারণভাবে। আমি খুঁজব অসাধারণভাবে। তারা তো আর ডিটেকটিভ না, তাই ডিটেকটিভের চোখ দিয়ে খুঁজতে জানে না। আমরা খুঁজব প্রফেশনালদের মতো, খাঁটি ডিটেকটিভের মতন।” 

মুনিয়া বলল, “খাঁটি ডিকেটটিভরা কেমন করে খোঁজে? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “যখন দরকার তখন ম্যাগনিফাইং গ্লাস, না-হয় মাইক্রোস্কোপ, না-হয় কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস ফিল্ডে গেলে বোঝা যাবে কোন পদ্ধতি খুঁজতে হবে।” 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি খুঁজতে যাবে?” 

“না, না! আমার যেতে হবে না। দুইজন ডিটেকটিভকে চাকরি দিয়েছি না? এটা হবে তাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট।” 

টুনি ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু তোমার বুড়ো ইঞ্জিনিয়ার কি তাদেরকে ঘরে খুঁজতে দিবে?” 

ছোটাচ্চু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে কি এত বোকা পেয়েছিস? তার ছেলেকে বলেছি বুড়ো ইঞ্জিনিয়ারকে এক-দুই ঘণ্টার জন্য বাসা থেকে বাইরে নিতে, তখন আমার ডিটেকটিভ যাবে। বুড়োর ছেলে রাজি হয়েছে। বলেছে কালকে সকালে তার বাবাকে মেডিক্যাল চেকআপের জন্য নিয়ে যাবে। তখন আমার নূতন ডিটেকটিভ যাবে ঘর চেক করতে। আমি ভালো করে বুঝিয়ে দেবো কী করতে হবে।” ছোটাচ্চু মুখে লাখ টাকার একটা হাসি ফুটিয়ে একটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, “আগামীকাল, একই জায়গায় একই সময় সবাইকে জানানো হবে কীভাবে একজন বুড়ো ইঞ্জিনিয়ার সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ড্রাগ সাপ্লাই চালিয়ে যাচ্ছে!” 

মুনিয়া বলল, “আর যদি বের করতে না পারো?” 

ছোটাচ্চু মুনিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে মুখ বাঁকা করে হাসল। 

***

পরের দিন একই সময় একই জায়গায় বাসার সব বাচ্চা থাকলেও ছোটাচ্চুর কোনো দেখা নেই। যখন সবাই ছোটাচ্চুর সব আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন ছোটাচ্চুকে দেখা গেল। ছোটাচ্চুর তেজ যথেষ্ট কম, কেমন যেন মনমরা এবং অন্যমনস্কভাবে মাথার চুলে আঙুল ঢুকিয়ে সেগুলো টানছে। বোঝা গেল বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে আছে। 

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু! কীভাবে গাঁজা সাপ্লাই দেওয়া হয় বের করেছো?” 

ছোটাচ্চু প্রথমে না শোনার ভান করল, যখন শান্ত ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল তখন ছোটাচ্চু বলল, “না-মানে-ইয়ে আসলে হয়েছে কী— যখন–তার মানে—” তারপর কথা বন্ধ করে চুল টানতে লাগল। 

মুনিয়া বলল, “তার মানে তোমার ডিটেকটিভ বের করতে পারে নাই। এখন কি তার চাকরি চলে যাবে?” 

“না। কারো চাকরি যাবে না। কেসটা যত সহজ ভেবেছিলাম তত সহজ না। বুড়োটা একটা সমস্যা।” 

“কেন সমস্যা?” 

“বুড়োটা হচ্ছে খিঁচখিঁচে বুড়ো। তার মেডিক্যাল চেকআপ শেষ করে ঘরে ঢুকেই বুঝে গেছে যে তার রুম সার্চ করা হয়েছে। তারপর যা একটা কাণ্ড করেছে সেটা বলার মতো না। খিঁচখিঁচে বুড়োর মাথায় বুদ্ধি ঠিকই আছে। কীভাবে কীভাবে জানি বুঝে গেছে আমি আমার ডিটেকটিভ পাঠিয়েছি।” 

“সত্যি বুঝে গেছে?” 

“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু কেমন জানি মনমরা হয়ে বলল, “কীভাবে কীভাবে জানি আমার নম্বর জোগাড় করেছে, তারপর আমাকে ফোন করে সে কী গালি!” ছোটাচ্চু কেমন জানি শিউরে উঠল! 

শান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বলে গালি দিয়েছে?” 

ছোটাচ্চু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বলার মতো না। খিঁচখিঁচে বুড়োর মুখ বন্ধ করার কোনো উপায় নাই। যা-তা বলতে থাকে।”

“সত্যি?” 

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “সবচেয়ে ডেঞ্জারাস কি জানিস?”

“কী?” 

“সেই খিঁচখিঁচে আমাকে বলে, সাহস থাকলে সামনাসামনি আস! আমি যখন নাই তখন চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে ঢুকতে লজ্জা করে না?” 

টুনি বলল, “তার মানে তোমাকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছে?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “আজকে তোমার ডিটেকটিভ খিঁচখিঁচে বুড়োর অফিসে কী করেছে?” 

বিছানা, “পুরো ঘর তন্নতন্ন করে দেখেছে। পুরো ঘর, বারান্দা, বাথরুম, টেবিল, বিছানার নিচে, টেবিলের নিচে—সবকিছুর ছবি তুলে এনেছে।” 

“ছবিগুলো দেখেছো?” 

“হ্যাঁ। সবাই মিলে ছবিগুলো দেখেছি, সন্দেহের কিছু পাওয়া যায় নাই।” টুনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “তোমার কাছে ছবিগুলি আছে?” ছোটাচ্চু বলল, “কয়েকটা আছে।“ 

তারপর তার স্মার্ট ফোনটা বের করে টুনির দিকে এগিয়ে দিলো। টুনি ছবিগুলো বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। হঠাৎ একটা ছবি দেখে সে থেমে যায়, ছবিটা ভালো করে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কিসের ছবি?” 

ছোটাচ্চু ছবিটা এক নজর দেখল, তারপর বলল, “এই খিঁচখিঁচে বুড়ো তার ছয়তলার বারান্দায় টবে গাছ লাগিয়েছে। যখন লেখালেখি করে না, টেলিফোনে লোকজনকে গালাগালি করে না, তখন ছাদের টবে বাগান করে।“ 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিসের বাগান?” 

ছোটাচ্চু নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, গাঁজা গাছের বাগান না। প্রথমেই সেইটা পরীক্ষা করা হয়েছে। নানা রকম ফুলের বাগান, লেবুর বাগান—“ 

টুনি তার পরেও অনেকক্ষণ ছবিটা দেখল। তারপর অন্য ছবিগুলি দেখতে থাকে। খিঁচখিঁচে বুড়োর ডেস্কের একটা ছবি দেখে সে থেমে গেল। ডেস্কের ওপর তার লেখালেখির কাগজ, টেবিলে কলম, পেন্সিল, স্ট্যাপলার, স্কচ টেপ, ছোট একটা কাঁচি—এ রকম স্টেশনারি। কোনো একটা কারণে টুনি এই ছবিটাও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে ছোটাচ্চুকে তার স্মার্ট ফোনটা ফেরত দিলো। তার এখন ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু অন্য বাচ্চাদের সামনে সে কথা বলতে চাইছে না। 

ছোটাচ্চু যখন শেষ পর্যন্ত দাদির ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে রওনা দিলো তখন টুনি তার পিছু পিছু গেল। ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকে টুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো? কিছু বলবি?” 

টুনি মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী বলবি?” 

“তোমার খিঁচখিঁচে ইঞ্জিনিয়ার বুড়ো তোমাকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছে, তুমি সেই চ্যালেঞ্জটা নিবে না?” 

“কোন চ্যালেঞ্জটার কথা বলছিস?” 

“ওই যে সামানসামনি তার সাথে কথা বলা।” 

ছোটাচ্চু কেমন জানি শিউরে উঠল। বলল, “টেলিফোনেই আমার সাথে যে রকম ব্যবহার করেছে—সামনাসামনি গেলে মনে হয় কাঁচা খেয়ে ফেলবে।“ 

টুনি গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু তোমাকে ওই খিঁচখিঁচে বুড়োর চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে ছোটাচ্চু। যদি না নাও তাহলে তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির মানসম্মান থাকবে না।” 

ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “তুই তাই মনে করিস?” 

“হ্যাঁ। খিঁচখিঁচে বুড়োর সাথে তোমার সামনাসামনি কথা বলতে হবে।” 

“কিন্তু—” ছোটাচ্চু কথা শেষ না করে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে টুনির দিকে তাকাল! 

টুনি বলল, “তোমার কোনো ভয় নাই ছোটাচ্চু। আমি থাকব তোমার সাথে।” 

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই কেন থাকবি? বড় মানুষের ব্যাপারে তুই বাচ্চা মানুষ কেন যাবি?” 

“আমি যদি থাকি তাহলে ওই খিঁচখিঁচে বুড়ো বেশি কিছু করার সাহস পাবে না।” 

“কেন?” 

“আমি ছোট। ছোটরা থাকলে বড়রা কন্ট্রোলে থাকে। তা ছাড়া—” টুনি হঠাৎ থেমে গেল। 

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “তা ছাড়া কী?” 

“তা ছাড়া আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা সত্যি কি না দেখে আসতে পারি।” 

ছোটাচ্চু চমকে উঠল, “তুই কী সন্দেহ করছিস? কেমন করে সন্দেহ করছিস?” 

“ছবি দেখে।” 

“ছবিতে কী দেখেছিস?” 

টুনি ইতস্তত করে মাথা নাড়ল, বলল, “আমি এখনও সিওর না ছোটাচ্চু। নিজের চোখে দেখলে বুঝতে পারব।“ 

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ চোখ কটমট করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর ঘ্যাসঘ্যাস করে একটু গাল চুলকাল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। কালকে বিকালে তোকে নিয়ে যাব। কিন্তু—”  

“কিন্তু কী?” 

“বেইজ্জতি যেন হতে না হয়।” 

“ছোটাচ্চু, আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট মনে আছে? আমার জন্য তোমাকে কোনোদিন বেইজ্জতি হতে হবে না।” 

* * * 

দরজায় কলিংবেল টিপতেই ভিতরে একটা শব্দ হলো। কয়েক সেকেন্ড পর বড় সরকারি অফিসার মানুষটা নিজেই দরজা খুলে দিলো। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আসুন, আসুন।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ভাতিজি? সেদিন আপনার অফিসে একেই দেখেছিলাম না?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “জি। মাঝে মাঝেই আমার বেবি সিটিং করতে হয়। সময় বাঁচানোর জন্য একে নিয়েই চলে এসেছি।“ 

মানুষটি ইতস্তত করে দুর্বলভাবে বলল, “ও, আচ্ছা! আমার বাবার সামনে না পড়লেই হলো। বাবা ছোট বাচ্চাদের দুই চোখে দেখতে পারে না।” 

ছোটাচ্চু বলল, “সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। টুনিকে আমি সামনে পড়তে দিবো না।” 

মানুষটি মাথা চুলকাল, “সেটা কতটুকু সম্ভব হবে আমি জানি না। আমার বাবার চোখ খুবই সাপ। কিছু চোখ এড়ায় না। সেদিন আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট চলে যাবার পর বাবা কিন্তু ঘরে ঢুকেই বুঝে গিয়েছে। 

ছোটাচ্চু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “জানি। আমাকেও ফোন করেছিলেন।”

মানুষটি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “আমি খুবই সরি। বাবার এত বয়স হয়েছে, তারপরেও মানুষের সম্মান রেখে কথা বলতে পারেন না। ফোনে আপনাকে নিশ্চয়ই অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে।” 

ছোটাচ্চু বলল, “সেটা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। চলেন, আপনার বাবার সাথে কথা বলে আসি।” 

মানুষটি উঠে দাঁড়াল, বলল, “চলেন।” 

ছয়তলার ছাদটা বড় এবং খোলামেলা। রেলিংয়ের পাশে বড় বড় টব, সেখানে নানা রকম গাছ। বেশির ভাগই ফুল গাছ, সেখানে নানা রকম ফুল ফুটে আছে। টুনিকে স্বীকার করতেই হলো খিঁচুখিঁচে বুড়োর যত সমস্যাই হোক, বাগানের হাত ভালো। ছাদে চমৎকার একটা বাগান তৈরি করেছে। যে মানুষ এত সুন্দর করে বাগান তৈরি করতে পারে সে ছোট বাচ্চা পছন্দ করে না, সেটা কেমন করে সম্ভব? 

সরকারি অফিসার মানুষটি ছোটাচ্চুকে নিয়ে এক পাশে খিঁচখিঁচে বুড়োর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। টুনি তাদের সাথে গেল না, বাগানের গাছগুলো আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে গেল। টুনি দেখল মানুষটি ছোটাচ্চুকে নিয়ে তার বাবার ঘরে ঢুকেছে। টুনির ধারণা সত্যি হলে একটু পরই খিঁচখিঁচে বুড়োর চেঁচামেচি শুরু হবে। 

টুনি যখন বাগানটি ঘুরে ঘুরে দেখছে তখন হঠাৎ করে বুড়ো ইঞ্জিনিয়ারের ঘর থেকে ক্রুদ্ধ গলার স্বর শুনতে পেল। তার খুবই কৌতূহল হচ্ছিল মানুষটিকে এক নজর দেখার, কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে যাওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না। ঠিক তখন একটা টবের কাছে সে একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখল, মনে মনে সে এটাই খুঁজছিল। টুনি মুচকি হেসে জিনিসটা তুলে নেয়, এবারে খিঁচখিঁচে বুড়োর ঘরে যেতে কোনো আপত্তি নেই। টুনি জিনিসটা মুঠিতে চেপে বুড়োর ঘরের দিকে এগুতে থাকে। 

দরজার কাছে গিয়ে টুনি থামল, শুনল ছোটাচ্চু কথা বলছে, গলার স্বর বেশ শান্ত। ছোটাচ্চু বলছে, “আপনি আমার ওপর রাগ করছেন সেটা আপনার সমস্যা আমার সমস্যা না। আপনার ছেলে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার ড্রাগের সাপ্লাই লাইন খুঁজে বের করতে—সে জন্য আমি এসেছি। আমি মোটেও তামাশা করতে আসি নাই, সিরিয়াস কাজে এসেছি, মাদক এই দেশে খুবই সিরিয়াস ব্যাপার—” 

টুনি এইবার খিঁচখিঁচে বুড়োর গলার স্বর শুনতে পেল, চিৎকার করে বলল, “আমি ড্রাগস খাই না রসগোল্লা খাই, তাতের তোমার বাপের কী? তোমার সাধ্য থাকলে বের করো।” 

সরকারি অফিসার মানুষটি বলল, “বাবা, তুমি এটা কী রকম ভাষায় কথা বলছো?” 

খিঁচখিঁচে বুড়ো বলল, “আমার মুখ দিয়ে আমি যে ভাষায় ইচ্ছা কথা বলব! নিজের বাপের বিরুদ্ধে টিকটিকি লাগাতে তোর লজ্জা করে না? দূর হ আমার সামনে থেকে। টিকটিকি নিয়ে দূর হ।” 

ছোটাচ্চু বলল, “শব্দটা টিকটিকি না। শব্দটা হচ্ছে ডিটেকটিভ।”

বুড়ো চিৎকার করতে লাগল, “টিকটিকি টিকটিকি টিকটিকি….”

টুনি ঠিক তখন দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “আসতে পারি?”

বুড়ো চিৎকার থামিয়ে অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনিও বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। শুকনো কাঠির মতো একজন মানুষ। মাথায় এলোমেলো সাদা চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে চশমা, চশমার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল ক্রুদ্ধ চোখ। গাল ভাঙা এবং মুখ খুলতেই দেখা গেল মুখভরতি ধারালো হলুদ দাঁত। দাঁতের ফাঁকে একটা তোবড়ানো সিগারেট, যেটা নিশ্চয়ই গাঁজা দিয়ে তৈরি। খিঁচখিঁচে বুড়ো বললে যে রকম একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে মানুষটা হুবহু সে রকম। 

বুড়ো মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি কে?”

টুনি ভিতরে ঢুকে গেল, বলল, “আমার নাম টুনি।”

“তুমি কোন সাহসে আমার ঘরে ঢুকছো? বের হও।” 

টুনি ছোটাচ্চুকে দেখিয়ে বলল, “আমি ডিটেকটিভ শাহরিয়ারের সাথে এসেছি।” তারপর যে কাজটি আগে জীবনেও করেনি, সেটা করল, বলল, “আমি ডিটেকটিভ শাহরিয়ারের অ্যাসিস্ট্যান্ট।” 

বুড়ো মানুষটি এমনিতেই রেগে ছিল এবারে মনে হয় ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠল, বলল, “মাইয়া, তুমি আমার সাথে রং-তামাশা করো? আমি তোমার রং-তামাশার মানুষ? ছেমড়ি তোমার নাকে টিপি দিলে দুধ বের হবে আর তুমি ডিটেকটিভের অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডিটেকটিভ বানান করতে পারো?” 

টুনি ধৈর্য ধরে থাকল, বলল, “পারি।” 

বুড়ো মানুষটা এবারে আরো রেগে উঠল। তার ছেলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “তোর এত বড় সাহস, আমার ঘরে খালি টিকটিকি আনিস নাই, আউলাঝাউলা পোলাপান আনছস? আমি যদি তোদের গুষ্টি শেষ না করি—” 

খিঁচখিঁচে বুড়োর ছেলে কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেল, তখন টুনি বলল, “আমি চলে যাচ্ছি—আসলে আমি আপনাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি।” 

বুড়া মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “কী জিনিস?” 

টুনি হাত খুলে ছোট একটা কাঁচি বের করল। খুবই ছোট কিন্তু খুব ধারালো কাঁচি। কাঁচিটা বুড়োর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে আপনার কাঁচি। পরে খুঁজে না পেলে আপনার সমস্যা হয়ে যাবে। 

খিঁচখিঁচে বুড়ো থমথমে গলায় বলল, “কী সমস্যা?” 

“আপনার গাঁজার গাছগুলোতে নূতন পাতা বের হচ্ছে। সেগুলোর পাতাগুলো কেটে অন্য রকম করতে হবে না?” 

মনে হলো ঘরের মাঝে একটা বাজ পড়ল। টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “গাঁজার গাছে পাঁচটা করে চিকন পাতা বের হয়। আমি দেখলাম আপনি সব জায়গায় গোড়ার দুইটা করে পাতা কেটে রেখেছেন, এখন তিনটা করে পাতা, তাই চেনা যায় না।” 

খিঁচখিঁচে বুড়োর চোয়াল ঝুলে পড়ল, তার হলুদ দাঁতের ফাঁকে কালচে জিভ নড়তে থাকে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না। 

টুনি না দেখার ভান করে বলল, “আপনি অবশ্য কোনো রিস্ক নেন নাই। পাতার পাশে খাঁজকাটা অংশ কেটে সমান করেছেন, প্রত্যেকটা পাতার সাইজ ছোট করেছেন, পাতার ডিজাইনটা বদলে দিয়েছেন। আপনার নিশ্চয়ই অনেক সময়, এতগুলো পাতাকে ডিজাইন করতে সময় লাগে—” 

হঠাৎ করে খিঁচখিঁচে বুড়ো কেমন যেন বানরের মতো লাফ দিয়ে টুনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। এক পাশ থেকে ছোটাচ্চু অন্য পাশ থেকে তার ছেলে বুড়োকে সময়মতো ধরে ফেলল বলে বুড়ো টুনিকে ধরতে পারল না। বুড়ো হিংস্র গলায় চিৎকার করতে লাগল, “খুন করে ফেলব, এই ছেমড়িকে খুন করে ফেলব, কল্লা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলব, জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব—“ 

টুনি একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, “আপনার বয়স হয়েছে, এখন এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক হবে না। হার্টে প্রেশার পড়তে পারে—” 

ছোটাচ্চু বলল, “অনেক হয়েছে টুনি। এবারে তুই চুপ কর।”

টুনি মুখে এগাল-ওগাল জোড়া হাসি দিয়ে চুপ করল। 

* * *

রাত্রিবেলা সবাই বসে আছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকলল। তার হাতে বিশাল একটা কেক। বাচ্চাদের চিৎকারে পুরো বাসা কেঁপে ওঠে। তবে এই প্রথমবার চিৎকারটি কেকের জন্য নয়—চিৎকারটি খিঁচখিঁচে বুড়োর কী হয়েছে সেটা জানার জন্য। ছোটাচ্চু বসার পর সবাই তাকে ঘিরে ধরল, তাদের নানা রকম প্রশ্ন। টুনির কাছ থেকে আগেই তারা খবর পেয়ে গেছে, তারপর কী হয়েছে সেটা নিয়ে কৌতূহল। তাদের প্রশ্নগুলো এ রকম : 

“ছোটাচ্চু খিঁচখিঁচে বুড়োকে কি পুলিশে দিয়েছো?” 

“কয় বছর জেল হবে? নাকি ফাঁসি?“ 

গাঁজার গাছগুলোর এখন কী হবে?” 

“একটা গাছ নিয়ে আসলে না কেন, তাহলে দেখতাম।” 

“ইয়াবার কি গাছ হয় ছোটাচ্চু?” 

“খিঁচখিঁচে বুড়োর ছবি আছে তোমার কাছে?” 

“টেলিভিশনের খবরে কি খিঁচখিঁচে বুড়োকে দেখাবে?” 

“টুনিকে ধরতে পারলে খিঁচখিঁচে বুড়ো কী করত?” 

ছোটাচ্চু যতটুকু সম্ভব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলো। তারপর পকেট থেকে একটা গাছের পাতা বের করে বলল, “এই যে তোদের দেখানোর জন্য একটা গাঁজার পাতা এনেছি।” 

“দেখি দেখি—” বলে সবাই দেখার জন্য ঝুঁকে পড়ল। দেখা শেষ হবার পর শান্ত বলল, “পাতাটা আমাকে দেবে ছোটাচ্চু?” 

সবাই তখন একসাথে চিৎকার করে উঠল, “না না না–কক্ষনো না— শান্তকে কক্ষনো না—” 

1 Comment
Collapse Comments

This story is taken from one of the story of Byomkesh Bokshi. Writer should mention the courtesy that it’s a shadow story.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *