1 of 3

খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)

এখানেই আমার দাঁড়াবার কথা ছিল। ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটের ঠিক উলটো দিকের গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডান দিকে প্রথম যে নারকেল গাছটি পড়বে, সেই গাছের নিচে। বলেছিল, ‘মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়াবে, নয়তো রাস্তার লোকগুলো আবার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। আমি মাঠেই থাকব, ঠিক ছ’টায়, কেমন?’ কোথায় ছ’টা? ছ’টা বেজে পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেল। তবু রতনের দেখা নেই। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউট দেখে নিলাম। উলটো দিকের সবচেয়ে কাছের গেট এটিই। রতনের তো এরকম দেরী হবার কথা নয়! ব্যাগের ভেতর দামি সব জিনিসপত্র,একা এ-সব নিয়ে এই গাছের নিচে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও নিরাপদ নয়। এর মধ্যে ছ’সাতজন যুবক ঘুরেফিরে বারবারই যাচ্ছে সামনে দিয়ে। আমি চোখ নামিয়ে রাখি, যেন ‘ভদ্রঘরের মেয়ে’ বলে ভাবে আমাকে। কেউ কেউ শিস দেয়। হিন্দি ছবির গান গায়, একজন তো কোমর দুলিয়ে নাচল, আর একজন আড়চোখে দেখলাম, লুঙ্গি ওপরের দিকে ওঠাতে ওঠাতে এত বেশি উঠিয়ে ফেলল যে লজ্জায় আমিইঅন্য দিকে মুখ ঘোরালাম। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না। বাড়ির দিকেও যাওয়া যাবে না। বাড়িতে এর মধ্যেনিশ্চয়ই খবর হয়ে গেছে – রীতা পালিয়েছে। মা’র গয়না, ভাবীর গয়না সব চুরি করে পালিয়েছে বাড়ির অষ্টাদশী মেয়ে। সাতটা বাজে। সন্ধ্যে নেমে এলো। যুবকেরা ছ’সাতজনের জায়গায় এখন বারো-তেরো জন হয়েছে। এদিক-ওদিক বিচ্ছিন্ন দাঁড়িয়ে সকলে দেখছে আমাকে। যেন আমি অদ্ভুত একটি মানুষ এসে জুটেছি এখানে। এখানে বেশ্যারা দাঁড়ায়, দুলে দুলে হাঁটে, পুরুষ দেখলে হাসে। আমি এ-সবের কিছুই করছি না। আমি সাজগোজ করিনি, কারও দিকে তাকাচ্ছি না, হাসছি না, বারবার ঘড়ি দেখছি। এসবের মানে আমি বেশ্যা নই, আমি কারও জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বেশ ভয়ও লাগছিল,অন্ধকার নেমে এলে এরা যদি আমাকে ঘিরে ধরে, আমি বেশ্যা নই জেনেও আমাকে এই পার্কের ভেতরে নিয়ে যায়, আরও অন্ধকারে! খাদে, ঝোপঝাড়ে নিয়ে এই দাঁড়িয়ে থাকা, হেসে ওঠা, শিস দেওয়া, গান গাওয়া যুবকেরা যদি অমন লুঙ্গি ওঠাতে ওঠাতে একেবারেই উঠিয়েই ফেলে পুরো?

 

২.

রতন পৌনে আটটায় এলো। ভয়ে আমার গা ঘামছে। ব্যাগটাকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। রতন এসে ফিসফিস করে বলল – ‘এসো’। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুটারে উঠলাম দুজন। আমি রতনের একটা হাত চেপে ধরলাম।

বললাম, দেরী করলে কেন? কণ্ঠ এত ভেজা, নিজেই অবাক হলাম যে, এতক্ষণ গাছের সঙ্গে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ভেতরে আমি নিশ্চয়ই কাঁদছিলাম! রতন আবার ফিসফিস করে বলল, ‘ওগুলো কোথায়?’ আমি ব্যাগ দেখালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত দেরী করলে কেন? আমার কী ভীষণ ভয় লাগছিল!’

রতন হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘ভয়? ভয় কেন?’

দু’জন ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে – ‘কত?’

‘তুমি কত বললে?’ রতন হেসে আমার দিকে তাকালো।

রতনকে চিনি ছ’মাস। এই ছ’মাস কলেজ পালিয়ে আমরা পার্কে সিনেমায় দেখা করেছি, রেস্তোরাঁয় খেয়েছি, বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি, শুয়েছি। হ্যাঁ, শুয়েছিও। কী করব, রতন মানে না। বলে, ‘ভাবো না কেনো বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের?’ মনে-মনে আমি তা-ই ভাবতাম, আমাকে রতন শোবার আগে ভাবতে শেখাতো আমরা স্বামী-স্ত্রী। বলত, ‘বিয়ে বোধহয় আমাদের পালিয়েই করতে হবে।’ আমি এসব পালানো-ফালানোয় ভীষণ লজ্জা পেতাম। বলতাম, ‘আমার দ্বারা ওটি হচ্ছে না।’ শেষ পর্যন্তঅবশ্য রাজি আমাকে হতেই হল, কারণ দু’মাস আমার মাসিক হচ্ছে না।

ডাক্তার বলেছে, ‘বাচ্চা পেটে।’ ব্যাস, পালাতে হল। রতন হিসেব-নিকেশ করে আমাকে বুঝিয়েছে খেয়ে পরে বাঁচতে হলে হাতে কিছু টাকা পয়সা থাকা চাই। যেহেতু টাকা পয়সা রতনের হাতে নেই, চাকরিবাকরি করে না, বি কম পাস করে তিন বছর বসে আছে, যেহেতু ওর বাবা মাও এখন বিয়ে করাবে না, অগত্যা আমাকেই টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে বেরিয়ে আসতে হল।

 

৩.

মিরপুরের ছোট্ট একটি বাড়ির সামনে স্কুটার থামে, রতনের পেছনে হাঁটছি, হাতে শক্ত করে ধরে আছি ব্যাগ। ব্যাগে মা’র আর ভাবীর গয়না, আলমারি খুলে ভর দুপুরে বাড়ির সবাই যখন ঘুমোচ্ছিল – নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে ওরা কি থানায় খবর দিয়েছে? মনে হয় না। মা অন্তত এই কাজ করতে দেবে না। যত হোক, নিজের মেয়ে তো! মা নিশ্চয়ই কাঁদছে, খানিকটা মায়াও হয় মা’র জন্য। ভাবী নিশ্চয়ই আমার নামে মা’কে শুনিয়ে শুনিয়ে অকথ্য সব কথা বলবে। মা কি জবাব দেবে এর! এতকাল কূটকচাল করতে গেলে মা রুখে দাঁড়িয়েছে, বলেছে, ‘ছেলের ওপর আমার দাবি আছে। এই ছেলে বানের জলে ভেসে আসেনি। ছেলের বাড়িতে তার মা থাকবে বোন থাকবে। থাকবেই তো!’

রতন একতলা বাড়িটির তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারে হঠাৎ গা-ছমছম করে উঠল, নিজেকে বোঝালাম রতন আছে পাশে, কীসের ভয়! দেশলাই জ্বালাতে চোখে পড়ল কাঠের একটি টেবিল, টেবিলের ওপর মোমবাতি। রতন আরেক কাঠি জ্বেলে মোমবাতি ধরাল। রতন নিশ্চয়ই এ ঘরটি ভাড়া নিয়েছে। নিজের সংসারে এই একটি টেবিল ছাড়া কিছু নেই। না থাক, ব্যাগের সোনাদানা বিক্রি করে ঘরখানা সাজিয়ে নেবো। রতন আমার কত কাছের মানুষ, স্বামীর চেয়ে আপন পৃথিবীতে আর কে আছে? বাপ-মা, ভাই বোন সবই তো আসলে পর!

আমাকে ঘরে একলা রেখে রতন রাতের খাবার আনতে গেল; দেরী করেনি, ও ফিরে এলেই এত আনন্দ হয় যে ওকে জড়িয়ে ধরি! রাতে খেয়েদেয়ে দুজন এই প্রথম পুরো রাত কাটালাম। এর আগে পুরো রাত তো আমরা পাইনি! আমার ঘুম আসে না খানিকটা দুশ্চিন্তায়, খানিকটা আনন্দে। আনন্দ রতনকে নিবিড় করে পাওয়ার। আর দুশ্চিন্তা বাড়ির মানুষগুলো এর মধ্যে কী কী করছে না জানি ভেবে, এই বাড়িতে ক’দিন থাকা হবে, রতন কী কাজ করবে অথবা আমিই বা কি করব, এসব নিয়ে রতনেরসঙ্গে কথাবার্তা বলাটা খুব জরুরী অথচ আমি ওকে যত জিজ্ঞেস করি কি হবে না হবে, ও আমার গায়ের জামা খুলতে খুলতে বলে – ‘আজ সব বাদ, আজ শুধু আদর, আদর আর আদর!’ হ্যাঁ, আমারও ভাল লাগে আদরে ডুবে থাকতে। কিন্তু জীবন যাপনেরও তো নানা ঝামেলা আছে! না, রতন কিছু শুনবে না। ও ডুবে গেলো শরীরে। অনেকটা রাত অবধি আমার জেগে থাকার দিকে তাকিয়ে বারবারই বলল, ‘ঘুমোও তো! না ঘুমোলে শরীর খারাপ করবে।’

‘তুমি চাকরির চেষ্টা করবে কবে থেকে?’

‘কাল থেকে।’

‘এই ঘর কি ভাড়া নিলে?’

‘হুঁ।’

‘ঘর গুছোতে হবে না?’

‘হুঁ।’

‘কবে গুছোবো?’

‘কাল।’

‘কিছু জিনিসপাতি তো কিনতে হবে। আপাতত বিছানার তোষক, বালিশ, মশারি আর থালাবাসন, চুলো, তাই না? কবে কিনবে?’

‘কাল।’

‘ভাইজান যদি আমাকে খুঁজতে বেরোয়, পাবে?’

‘আরে না!’

‘তোমাদের বাড়িতেই বরং উঠলে পারতে। তোমার মা-বাবাকে ঘটনাটা জানাও। কবে জানাবে গো?’

‘কাল।’

‘আচ্ছা, বিয়েটা আমাদের কবে হবে?’

‘কাল।’

বলতে বলতে রতন নাক ডাকল আর আমি একটি সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিদ্রাহীন পার করলাম রাত। ভোরের দিকে ঘুম নামল চোখে।

 

৪.

ঘুম ভাঙল জানালা গলে রোদ এসে চোখ তাতাল, তারপর। উঠে দেখি রতন উঠে গেছে আগেই। কী লজ্জা, বউ ঘুমোচ্ছে, আর স্বামী উঠেছে, নিশ্চয়ই মুখ ধুচ্ছে কোথাও, মাঠে একটা টিউবওয়েলের মত চোখে পড়েছে রাতে। নাকি নাশতা আনতেই গেলো! ভাবতে ভাবতে চুল আঁচড়াব, চিরুনি নিতে গিয়ে ব্যাগ খুলে দেখি ব্যাগে গয়নাগুলো নেই। সব আছে, আমাদের এতদিনকার লেখা চিঠি, ডাক্তারের কাগজ, চিরুনি, কলম, মুখের ক্রিম সবই ঠিকঠাক আছে। আচ্ছা, রতন কি এগুলো বিক্রি করে ঘরের জিনিসপত্র কিনে আমাকে চমকে দেবে? আমার একবার ভালও লাগে, আরেকবার কষ্টও হয়। কেন না জানিয়ে যাবে ছেলে?

 

৫.

সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। রতন ফেরেনি। বিকেলে চার-পাঁচজন ছেলে দরজা ঠেলে ঢুকল। ঢুকে আমাকে দেখে অবাক, বলল – ‘তুমি কে? এখানে কেনো?’ আমি বললাম -’এটা তো আমার ঘর, তোমরা কে?’

‘আমরা?’ বলে চার-পাঁচজন তুমুল হেসে উঠল! বলল, ‘বাইরে সাইনবোর্ডে কি লেখা দেখে এসো, লেখাপড়া জানো নিশ্চয়ই?’

সাইনবোর্ড? বেশ একটু অবাক হয়ে বাইরে গিয়ে দেখি ঘরের ওপর সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘নবারুণ যুব সংঘ’। এর মধ্যে ওদের বয়সের একটি ছেলে মাথায় করে একটি ক্যারাম বোর্ড নিয়ে ঢুকল। আমার আর ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করেনি। বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘রতনকে চেনো?’

ওরা জিজ্ঞেস করলম, ‘কোন পাড়ার?’ আমি জানি না রতন কোন পাড়ার, কল্যাণপুরে বাড়ি বলেছিলো, সিটি কলেজে পড়ত, ব্যাস, এটুকুই জানি। ঘুরে বেড়ায়, গান গায়, মাঝে মাঝে কবিতাও বলে। ওর বাবা উকিল। না, রতনকে ওরা কেউ চেনে না।

আমি কি অপেক্ষা করব? সন্ধ্যে নামতে থাকে, আমার আর অপেক্ষা করা কি মানায়? খিদেয় পেট জ্বলে যায়, কেউ তো ভিক্ষেও দেবে না। ফিরে যাব বাড়িতে? ভাবী বলবে, চোর। ভাই বলবে, মা-ও বোধ হয় মনে মনে বলবে। তাদের সামনে কী মুখে দাঁড়াব এখন? আমি, আমার কাছেই খুব অবাক লাগে, বাড়ি যাচ্ছি না, বাড়িতে প্রথমে মারধোর করলেও পরে তো এক সময় ক্ষমাই করে দেবে, তবু লজ্জার অপমানে মুখ তুলতে পারছি না, তার ওপর পেটের মধ্যেও তো উটকো আরেক ঝামেলা! একটি স্কুটারে চেপে ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটের সামনে এলাম। মনে মনে রতনকেই খুঁজছিলাম কি না, কে জানে। উলটো দিকেরগেটে ঢুকে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দেখি আমার গা-হাত-পা কেমন কাঁপছে। আমার এ কেমন পরাজয়! কোথাও এখন আশ্রয় নেই। স্কুটারঅলাকে হাতের ঘড়ি খুলে দিয়েছি। এখন নিজের কাছে নিজের শরীর ছাড়া কিছু নেই। অন্ধকারে কে একজন গায়ে হাত রাখে। চমকে উঠি। হাত রাখা লোকটি ঠা ঠা করে হাসে, এত কাছে তার মুখ যে, মুখের দূর্গন্ধও আমার নাকে এসে লাগে। বলে, ‘এই মেয়ে, এদিকে আয়!’

আমার তখন পেটে খিদে। প্রচন্ড খিদে। মাথা বনবন করে ঘুরছে। লোকটি আমাকে হাত ধরে টেনে স্কুটারে ওঠাল। আমি চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম। আমি এক স্কুল মাস্টারের মেয়ে রীতা। ছোটবেলায় নীতি আর আদর্শের বাক্য শিখে বড় হয়েছি। বাবা মারা যাবার পর ভাইয়ের সংসারে পাখির মত পালকে ঢেকে মানুষ করেছে মা। আর আমি কি না অমাবস্যার রাতে অচেনা এক পুরুষের সঙ্গে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানি না!

পাশের লোকটির নাম কি রতন? আমার, জানি না কেনো, একেও রতন নামের কেউ বলে মনে হয়।

পুনশ্চঃ পাঠক, এই গল্প কি আসলেই খারাপ মেয়ের গল্প?

এভাবেই চলতি স্রোতে গা ভাসিয়ে,মেয়েরা নিজেদের করে বিকলাঙ্গ ।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *