অ্যাপারটিফ কাকে বলে?
এক কথায় এমন এক অ্যালকোহল যুক্ত তরল পানীয়, যা খিদে বাড়ায়। এই শব্দটা ফরাসি হলেও এর মূলে আছে ল্যাটিন অ্যাপেরের, যার মানে উন্মুক্ত করা। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে নতুন থিয়োরি আসে, সেই মতে মানুষের দেহ চারটি মূল হিউমার বা স্তম্ভে দাঁড়িয়ে। কবিরাজি অনুযায়ী যেমন বায়ু, পিত্ত আর কফ। এদের কোনও একটা বেড়ে বা কমে গেলেই শরীর খারাপ হতে বাধ্য। যদি রোগীর জ্বর হয় তো কিছু রক্ত মোক্ষণ করে দাও। যদি খিদে না পায় তাহলে তিতো কিছু খাইয়ে দাও, যাতে লিভারের পিত্তরস বেশি ক্ষরিত হয়ে খিদে বাড়িয়ে দেয়। ঠিক এই জায়গাতেই প্রথমে তিতো কিছু আয়ুর্বেদিক তরল থাকলেও ধীরে ধীরে ডুবোনেট, লিলেট বা ভারমুথের মতো তেতো মদ জায়গা করে নিল। অকারণ চিরতার জল খেয়ে খাওয়ার আগে কে মুড অফ করতে চায়? বরং খাবার আগে পানীয়র এই মৌতাত পানীয়লোভী ইউরোপীয়দের পানের একটা ডাক্তারি কারণ অন্তত দিল। ইউরোপ থেকে আমেরিকায় এই খাবার আগে মদ খাওয়ার সামাজিক নিয়ম আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার ঘরে ঘরে অ্যাপারটিফ জাঁকিয়ে বসেছিল। জিন, টনিক, মার্টিনিরা আমেরিকার জাতীয় পানীয়ে পরিণত হয়। ইংরাজিতে ‘whetting your appetite’ নামে নতুন প্রবাদ চালু হয়ে যায়। এই whet মানে ধার দেওয়া বা তীক্ষ্ণ করা, আর তাই খিদেকে ধারালো করতে অ্যাপারটিফের জুড়ি নেই।
জিন ও টনিক
জানি না কেন, কিশোর বয়সে শুনেছিলাম জিন নাকি ঘোড়া পান করে। আমি আজ অবধি একটাও মাতাল ঘোড়ার সাক্ষাৎ পাইনি, পেলে জিজ্ঞাসা করা যাবে তাদের এই জিন ভক্তির কারণ কী। অবশ্য পরে বুঝেছি গোটা ব্যাপারটা বিশুদ্ধ ফাজলামো। ঘোড়ার উপরে চড়ার মোটা কাপড়কে জিন বলে আর তাই খুব সহজেই এই ভিনদেশি পানীয়কে ঘোড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা হয়েছে মাত্র। যাই হোক, জিনের ইতিহাস কিন্তু বেশ ভয়ানক। আলাদিনের জিন কজনের প্রাণ নিয়েছে জানি না, তবে এই জিন অগুনতি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এতটাই যে, এর আর-এক নাম Mother’s ruin।
গোড়া থেকে বলা যাক। ব্রিটেনে জিন আসে হল্যান্ডের রাজা উইলিয়াম অফ অরেঞ্জের হাত ধরে। ১৬৮৯ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসন দখল করে তিনি ব্রিটিশদের গাজর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিন পানের অভ্যাসটাও ধরিয়ে দিয়ে যান। জিন শব্দটা এসেছে ডাচ জেনেভার থেকে, যার মানে জুনিপার গাছ। এই গাছের ফলের রস থেকেই তৈরি হত এই মদ। ইংল্যান্ডবাসীদের এই নতুন পানীয়র রং লাগতে বেশি সময় লাগেনি, বিশেষত যখন তারা দেখল এতে বিয়ারের চেয়ে অনেক কম খরচায় অনেক জাঁকালো নেশা করা যায়। সরকার যখন জিন তৈরির উপরে লাইসেন্স তুলে নেয়, তখন ব্রিটেনের অলিতে গলিতে হাজার হাজার জিনের দোকান (যাদের পোশাকি নাম ছিল জিন প্যালেস) গজিয়ে উঠল। ফল যা হবার তাই। বদলোক দেশে দেশে কালে কালে ছিল। তারা বুঝে গেল জুনিপারের ফলের বদলে তারপিন তেল মেশালে খরচ আরও কম আর লাভ চারগুণ। ফলাফল হল মারাত্মক। উইলিয়াম হোগার্থ তাঁর বিখ্যাত এনগ্রেভিং জিন লেন-এ ১৭১১ সালে এক করুণ ছবি এঁকেছেন। লন্ডনের রাস্তায় মানুষ অসুস্থ হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। কেউ কেউ মারা গেছে। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নেশার চোটে মায়ের কোল থেকে সন্তান পড়ে যাচ্ছে। সে এক নারকীয় দৃশ্য। ১৭৩০ নাগাদ ব্রিটেনেই জিনের উৎপাদন ছিল বিয়ারের প্রায় ছয়গুণ। ইংরেজ শ্রমিকরা জিন ছাড়া অন্য কিছু পান করতেন না, বা তাঁদের সাধ্য ছিল না। তাঁরা জিন পান করতেন আর অকালে মরতেন। হোগার্থের ছবি সরকারকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। ১৭৩৬ সালে জিন আইন পাশ হল, যাতে জিন বিক্রেতাদের উপর প্রচুর কর বসানো হয়। ফল হল উলটো। জিনের দাম গেল বেড়ে। ইংল্যান্ডের রাস্তায় জিনের জন্য দাঙ্গা বেধে গেল। ফলে ১৭৫১-তে দ্বিতীয় জিন আইন চালু হল, যাতে জিনের উৎপাদকরা শুধুমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানিদের মদ দেবেন, আর অন্য মদের মতো একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানেই জিন বিক্রি করা যাবে। এই আইনে কাজ হল। লন্ডনের ডিস্টিলাররা লন্ডন ড্রাই জিন নামে নতুন এক ধরনের জিনের রেসিপি বানান, যা ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আর এই জিনের সঙ্গে একেবারে মাস্ট যে টনিক, তা কিন্তু একেবারে ভারতীয় জিনিস। ষোড়শ শতকে আমেরিকার জেসুইট পাদরিরা খেয়াল করলেন যে, ওখানকার কোয়েচা রেড ইন্ডিয়ানরা সিঙ্কোনা নামে একটা গাছের ছালের তিতো রস খায়। সে রস খেলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ তো কমেই, এমনকি সেরেও যায়। তাঁদের হাত ধরে এই তিতো ছালের গাছ রোমে আসে। সেই সময় রোমে ম্যালেরিয়ার দারুণ প্রকোপ। একজন পোপ আর বেশ কিছু কার্ডিনাল মশার কামড়ে প্রাণ দিয়েছেন। সিঙ্কোনা গাছের ছালের রস খেয়ে বাকিরা অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। সেই থেকেই ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এলাকায় কেউ গেলেই তার কোঁচড়ে কিছু সিঙ্কোনা ছাল বেঁধে দেওয়া হত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা ভারতে এলে তাঁদেরকেও একইভাবে সিঙ্কোনার ছাল দেওয়া হয়েছিল। প্রথম প্রথম নিয়ম মেনে তাঁরা জলে ভিজিয়ে খেতেন। তারপর সোডা ওয়াটারে। শেষে সেই সোডা ওয়াটারে জিন মিশিয়ে দেখলেন, আরে বাঃ, এ তো দারুণ অ্যাপারটিফ! খিদে বাড়ানো, ম্যালেরিয়াকে দূর হটানো, সব এক চুমুকে সম্ভব। এই নতুন তেতো তরলের নাম তাঁরা দিলেন টনিক, মানে রোগহারক। সূর্য ডুবতে না ডুবতে মশা ঘিরে ফেলত চারদিক আর সাহেব মেমসাহেবরা সানডাউনার নামে এই জিন আর টনিক মিশিয়ে পান করতেন। তারপরেই আসত রাতের খাওয়া। কেমন করে যেন ইংরেজদের কালচারে এই জিন আর টনিক ঢুকে গেল। আজও খাঁটি ব্রিটেনে সাহেবরা ডিনার পার্টির আগে জিন আর টনিক খান এটা না জেনেই যে এর আসল কারণ ছিল ভারতের মশককুল।
মার্টিনি-শেকেন নট স্টার্ড
‘একটা ড্রাই মার্টিনি, বড়ো শ্যাম্পেনের গ্লাসে।’
‘ঠিক আছে, মঁসিয়ে।’
‘শোনো, তিনভাগ গর্ডন নেবে, এক ভাগ ভদকা আর অর্ধেক কিনা লিলেট। এবার ভালো করে ঝাঁকাবে, যতক্ষণ না বরফঠান্ডা হয়ে যায়, শেষে লম্বা সরু একটা লেবুর টুকরো দেবে। বুঝলে?’
‘ক্যাসিনো রয়াল’ উপন্যাসে জেমস বন্ড নিজেই নিজের প্রিয় পানীয়র রেসিপি দিয়েছেন, আর এখান থেকেই সেই আইকনিক লাইন ‘শেকেন নট স্টার্ড’-এর জন্ম। মার্টিনির জন্মও কিন্তু খিদে বাড়ানোর জন্যই। ১৮৯৬ সালের এক বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই, স্ত্রী স্বামীর হাতে পায়ে ধরছেন যাতে স্বামী ওষুধ হিসেবে মার্টিনি খান। কী থাকত এই মার্টিনিতে? থাকত জিন, ভারমুথ আর একটা অলিভের টুকরো। কীভাবে এই ককটেল এল বা এর নাম মার্টিনি হল কীভাবে, তা নিয়ে অনেকরকম গল্প প্রচলিত। মার্কিনরা বলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মার্তিনেজ নামে এক ক্লান্ত পথিককে চাঙ্গা করতে এক নাম না-জানা বারম্যান এটা বানান। ব্রিটিশরা অবশ্য বলেন এই নাম এসেছে ১৮৮০ নাগাদ। ব্রিটেন সেনাবাহিনীতে মার্টিন হেনরি নামে এক রাইফেল দেওয়া হত, যা ঘোড়ার চেয়ে বেশি “কিক” দিত। এই মদের কিক সেইরকম, তাই এমন নাম। ইতালিয়ানদের কাহিনি আবার অন্য। তাঁরা খুঁজে বার করেছেন ১৮৬৩ নাগাদ মার্টিনি অ্যান্ড রোসি নামে এক বিক্রেতা এই ককটেল বানাতেন। তখন এর নাম ছিল মার্টিনি রসো ভারমুথ। নাম যে কারণেই হোক, প্রথম ছাপা আকারে এর রেসিপি প্রকাশ পায় ১৮৮৮ সালে। লেখক ছিলেন হ্যারি জনসন, এক মার্কিন।
আমেরিকায় মদ ব্যান হলে সবচেয়ে বেশি গোপনে বিক্রি হত এই মার্টিনিই। ভারমুথের তেতো ভাব আর জিনের কষা স্বাদ মার্কিন অভিজাত থেকে সাধারণ মানুষ সবাইকে তৃপ্ত করেছিল। লেখক লেখিকারা কোনও এক অজানা কারণে মার্টিনির ভক্ত হয়ে পড়েন। স্কট ফিটজেরাল্ড, ডরোথি পার্কার থেকে ইয়ান ফ্লেমিং… সবাই মার্টিনির আমেজে মজে যান। জেমস বন্ডের প্রিয় পানীয় কি আর এটা সাধে হয়েছে?
ব্লাডি মেরির ইতিহাস
ব্লাডি মেরির আসল নাম মেরি টিউডর। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ও রানি ক্যাথেরিন অফ আরাগনের একমাত্র কন্যা মেরির জন্ম ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন মেরি মাত্র ১৭ বছর বয়সি তরুণী, তখন তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। হেনরি ক্যাথেরিনকে একটি পুরাতন দুর্গে নির্বাসিত করেন। তখন থেকেই পিতা ও পিতার ধর্মের উপর আক্রোশ জন্মায় মেরির হৃদয়ে। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্পেনের রাজা ফিলিপ ক্যাথলিক ধর্মের প্রবর্তনে রাষ্ট্রে ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মেরি ফিলিপকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। আর কিছু না, নির্মম উপায়ে ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম নির্মূল করাই ছিল এই বিয়ের উদ্দেশ্য। ফিলিপের সহযোগিতায় মেরি প্রোটেস্ট্যান্ট বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করতে শুরু করেন। অমানবিক অত্যাচার থেকে উদ্ধার পেতে ইংল্যান্ডবাসী মেরির বিরুদ্ধে গিয়ে এলিজাবেথকে তাদের রানি হিসাবে পেতে চাইল। তাদের এই প্রতিবাদে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মেরি। ফিলিপ ইংল্যান্ডেও ইনকুইজিশন ব্যবস্থা চালু করতে উৎসাহিত করেন মেরিকে। ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রবর্তন করেন তিনি। আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন তিন শতাধিক প্রোটেস্ট্যান্টকে। তাঁর এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডে সমস্ত ইংল্যান্ডনিবাসী স্তব্ধ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একে ‘Marian Persecutions‘ বলে অবহিত করা হয়।
মেরির এই রক্তপিয়াসী অমানবিক হত্যাযজ্ঞের ফলেই তিনি ‘ব্লাডি মেরি’ হিসাবে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। আইনত তখন প্রোটেস্ট্যান্টদের শিরশ্ছেদে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রীতি ছিল। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মানুসারীদের শাস্তি হিসাবে পুড়িয়ে মেরে ফেলার নিয়ম। তাই ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের ভেতর আতঙ্কের সৃষ্টি করতে ফিলিপ রানি মেরিকে প্রোটেস্ট্যান্টদের পুড়িয়ে হত্যার পরামর্শ দেন। ভদকা, টমেটো জুস, গোলমরিচের গুঁড়ো আর উরচেস্টার সস দেওয়া এই কড়া ককটেল তাই একদিকে হ্যাংওভার কাটাতে অব্যর্থ, অন্যদিকে টমেটোর লাল রং বহন করে অত্যাচারী রানির রক্তাক্ত স্মৃতি।
খুব ভালো হত, এখানেই যদি লেখাটা শেষ করা যেত। মুশকিল হল, মেরি টিউডরের সঙ্গে ব্লাডি মেরি ককটেলের এই গল্প শুনতে যতই ভালো লাগুক না কেন, এদের মধ্যে আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। ১৯২১ সাল অবধি এই ককটেলের নাম কেউ জানত না। ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে ফার্দিনান্দ পেতি নামে এক ফরাসি শেফ দাবি করেন ১৯২১ সালে তিনিই প্রথম এই ভদকা আর টমেটো জুস মেশানো পানীয়টি আবিষ্কার করেন। সেন্ট রেজিস হোটেলের কিং কোল রুমে প্রথম দিন সার্ভ করা মাত্র কীভাবে এই পানীয় জনপ্রিয় হয় সে কথাও তিনি জানিয়েছেন। পেতি মিথ্যে বলেননি। পরে সমকালীন আরও দুই-তিনজন পেতির কথার সমর্থন জানিয়েছিলেন। অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স আসে তখনই, যখন পেতি জানান রানি মেরির নাম অবধি তিনি জন্মে শোনেননি। তাহলে এমনধারা নাম কেন রাখলেন পেতি?
পেতির উত্তর ছিল, ‘আজ্ঞে, নির্বাক যুগের সেরা অভিনেত্রী মেরি পিকফোর্ড আমার বড্ড পছন্দের ছিল কিনা…’
ডিয়ার বিয়ার
পানীয়র আলোচনা হবে আর তাতে বিয়ার থাকবে না সে কি হয়? বিয়ারই বোধহয় একমাত্র মদ, যা নিয়ে গোটা একটা বিদ্যা আছে। গ্রিক শব্দ zythos হল বিয়ার (আরও সঠিকভাবে বললে গেঁজানো) আর logos মানে জ্ঞান, অর্থাৎ কিনা বিয়ার সংক্রান্ত জ্ঞানই হল জাইথোলজি, মতান্তরে গ্যাঁজানোর জ্ঞান। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণে নজর দিলে দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো অ্যালকোহলিক পানীয় এই বিয়ারের প্রথম লিখিত ইতিহাস উদ্ধার হয় অধুনা ইরান থেকে, যা কিনা খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। মজার ব্যাপার, সেই ইরানেই এখন অ্যালকোহলিক বিয়ারের কেনাবেচা আইনত নিষিদ্ধ। বিয়ার শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন বিবরে থেকে, মানে পান করা।
প্রাচীন মিশরের গিজা শহরের বিখ্যাত পিরামিড তৈরির সময় শ্রমিকদের প্রতিদিন মাথাপিছু নাকি চার লিটার করে বিয়ার বরাদ্দ ছিল। আবার ব্যাবিলনের সম্রাট হামুরাবির আমলে কিউনিফর্ম হরফে লেখা শিলালিপি থেকে জানা যাচ্ছে, বিয়ারে জল মেশালে উনি রীতিমতো কোতল করার ফরমান জারি করেছেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর নোবেল পুরস্কার পান আর সেই সম্মানে গর্বিত হয়ে সে দেশের বিয়ার কোম্পানি কার্লসবার্গ তাঁকে একটি বাড়ি উপহার দিয়ে বসে। কার্লসবার্গ বিয়ার ফ্যাক্টরির পাশে অবস্থিত বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল রান্নাঘরের কলে, কল খুললেই বিয়ারের ধারা বইবে চব্বিশ ঘণ্টা। খামির বা ইস্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন খাদ্যশস্য অথবা ফলমূল গেঁজিয়ে বা চোলাই করে তা থেকে তৈরি হয় বিয়ার। বিয়ার তৈরিতে ব্যবহার হয় মূলত যব বা বার্লি, তবে যবের সঙ্গে কখনও সখনও ব্যবহার হয় চাল, গম, ভুট্টা, মায় কাসাভা অবধি। শর্করা দ্রবণে ইস্ট নিজের বংশবিস্তার করে এবং তার সঙ্গে তৈরি করে বিভিন্ন উৎসেচক, উৎসেচকের প্রভাবে বার্লির শর্করা গেঁজে উঠে তৈরি হয় অ্যালকোহল আর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। বিয়ারের গেলাসে যে ফেনা দেখা যায় তা এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের বুদবুদ মাত্র।
অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ারের আগমন ঘটে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাত ধরে এবং আরও পাকাপাকিভাবে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়লাভের পরে। কালা নেটিভদের দেশে সাহেবরা যখন গরমে হাঁফিয়ে যেতেন, তখন দু-এক গেলাস ঠান্ডা বিয়ার তাঁদের শরীরে নতুন জোশের জোয়ার নিয়ে আসত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই উপমহাদেশে বিয়ার ছিল দুর্মূল্য, কারণ ইংল্যান্ড থেকে প্রায় ছয়মাস যাবৎ জাহাজ যাত্রা শেষে যখন বিয়ার এসে পৌঁছোত ততদিনে বহু বিয়ারের পিপে জাহাজ যাত্রার ধকলে ঠোকাঠুকি লেগে ভেঙে নষ্ট হয়েছে; আবার, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে বিয়ার খারাপ হওয়ার ফলেও অনেক বিয়ার নষ্ট হত। ফলত বেঁচেকুচে থাকা বিয়ার অগ্নিমূল্যে না বেচলে পড়তায় পোষাত না। অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসাহে লন্ডনের জর্জ হজসন ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেন পেইল এল্; যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ইন্ডিয়ান পেইল এল্ বা সংক্ষেপে IPA নামে। জর্জ সাহেবের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল এমন এক বিয়ার বানানোর, যা ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসার ছয়মাস জাহাজ যাত্রার পরেও ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে নষ্ট হবে না। জর্জসাহেব সেই সময়ে লন্ডনে প্রচলিত অক্টোবর এল্ নামে একটি জনপ্রিয় এলের স্বাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশি অ্যালকোহল এবং অতিরিক্ত হপ যুক্ত এই ইন্ডিয়ান পেইল এল্ তৈরি করেন, pale শব্দ যোগ করা হয় এই এল্-এর হালকা রঙের জন্য। জানা যায়, ভারতে বসবাসকারী ধনী ইংরেজদের কাছে এই এল্ ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে IPA তৈরি করার কয়েক বছরের মধ্যেই হজসনের দুই ছেলে বুড়ো বাপের থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে হজসন বিয়ার শুরু করে একচেটিয়া ব্যবসা। সম্ভবত বিশ্বের প্রথম গ্লোবাল বিয়ার ব্র্যান্ড এই হজসন, যাদের লোগো ছিল একটি লাল রঙের ত্রিভুজ। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হজসন কোম্পানি অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তোয়াক্কা না করে নিজেই সরাসরি বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে ব্যবসা শুরু করে। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লভ্যাংশ কমতে থাকে এবং কোম্পানির কর্তারা বিকল্প অনুসন্ধানে মনোযোগী হন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের শেষাশেষি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তাব্যক্তি ইংল্যান্ডের বার্টন-অন-ট্রেন্ট শহরের একটি বিয়ার কোম্পানির মালিক স্যামুয়েল অ্যালসপকে চ্যালেঞ্জ দেন হজসন বিয়ারের থেকেও ভালো স্বাদের বিয়ার বানানোর। কয়েক মাসের মধ্যেই অ্যালসপ তৈরি করেন আরও ভালো স্বাদের IPA, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি তৎকালীন খবরের কাগজ ক্যালকাটা গেজেটেও এই IPA-র গুণগান করে খবর ছাপা হয়। অ্যালসপের প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বার্টন শহরের আরও অনেক বিয়ার তৈরির কোম্পানি এই অলিখিত প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় এবং এর ফলে অবশেষে হজসনের একচেটিয়া ব বসার অবসান হয়।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পাদরি সাহেব উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখা ‘A view of the history, literature and religion of the Hindoos’-এ তৎকালীন ছাপোষা বাঙালিদের খাদ্যাভাসে পানীয় বলতে কিন্তু জল, ডাবের জল, ঘোল বা দুধ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। অথচ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাস’ পড়লে দেখা যায় যে, উচ্চবিত্ত বাঙালিবাবুরা সবিশেষ পানপটু ছিলেন। বাঙালির বিয়ার পানের সপক্ষে প্রথম লিখিত ঐতিহাসিক রেফারেন্স পাওয়া যায় ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিনের পাতায়। ডিরোজিওর নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের যে সূত্রপাত, তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “… (young Bengalees) cutting their way through ham and beef, and wading to liberalism through tumblers of beer.” সুতরাং মধ্যবিত্তদের মধ্যপ্রাশনে ড্রুজো সায়েবের কীর্তি কম ছিল না।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় জানা গিয়েছে বিয়ার আদতে স্বাস্থ্যকর পানীয়, ওয়াইনের চাইতেও বেশি প্রোটিন আর ভিটামিন বি এতে আছে। সাদা বা হলদে রঙের উদ্ভিজ্জ দ্রব্যে যে সকল রঞ্জকপদার্থ পাওয়া যায় তাদের একত্রে বলে ফ্ল্যাভোনয়েড (flavonoid), আর বিয়ারে এই ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে যা আসে হপ থেকে। এ সমস্ত ফ্ল্যাভোনয়েড মানুষের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, ঠিক যেমন ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই করে থাকে। গবেষকরা বলছেন নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে বিয়ার পান করলে প্রস্টেট ক্যানসার থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, রক্তাল্পতা, কিডনির পাথর, মায় হার্ট অ্যাটাক অবধি বিবিধ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, উপরন্তু শরীরের হাড়গোড় হয় মজবুত। তবে শুধু স্বাস্থ্য কেন, সৌন্দর্যায়নেও বিয়ারের উপস্থিতি সর্বঘটে কাঁঠালিকলার মতো, অনেক বিউটি টিপস্-এ স্নানের সময় বিয়ার দিয়ে চুল ধোয়ার কথা বলা হয়, বিশেষত যাঁদের চুলে জট পড়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে। ফার্মেন্টেশনের পরেও বিয়ারের মধ্যে স্বল্প পরিমাণে স্টার্চ বা শ্বেতসার বেঁচে থাকে এবং বিয়ার দিয়ে চুল ভিজিয়ে ধুয়ে নিলে প্রত্যেকটি চুলের ওপর এই স্টার্চের একটা সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়ে যায়, যা চুলকে জটমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
ইউরোপ মহাদেশে বেলজিয়াম এমন একটি দেশ, যেখানে প্রায় একহাজার ছশো বিভিন্ন জাতের বিয়ার পাওয়া যায়। প্রতি বছর মাথা পিছু বিয়ার পানের কম্পিটিশনে বেলজিয়ামকে বাইশ নম্বরে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে বসে আছে বেলজিয়ামের পড়শি দেশ চেক রিপাবলিক (পূর্বতন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ)। চেক রিপাবলিকের একজন মানুষ বছরে গড়পড়তা প্রায় ১৪২ লিটার বিয়ার পান করে থাকেন। বিখ্যাত আইরিশ কোম্পানি Guiness Brewery এবং এদের তৈরি স্টাউট বিয়ার বিশ্বপ্রসিদ্ধ। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই কোম্পানির বিয়ার সর্বাধিক বিক্রি হয় নাইজেরিয়ায়, নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে নয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড-সহ বহু ইউরোপিয়ান দেশে, ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর বা কলম্বিয়াতে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শহরে বিয়ার উৎসবে শয়ে শয়ে মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। আপনার কাছে যদি এক সেকেন্ডে বিশ্বভ্রমণের কোনও উপায় থাকত, তাহলে দেখতে পেতেন যে-কোনো মুহূর্তে প্রায় পাঁচ কোটি লোক এই আনন্দধারায় মেতেছে । আজ্ঞে হ্যাঁ, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জানা গেছে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি হাজার জনে অন্তত সাতজন লোককে মাতাল অবস্থায় পাওয়া যায়।