ভলিউম ১৮ – খাবারে বিষ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
১
রকি বীচ মেমোরিয়াল হসপিটালের আউটডোর পার্কিঙের কাছে এসে ঘাঁচ করে ব্রেক কষল মুসা। গাড়ির অভাবে অনেক কষ্ট করেছে। তাই কিনে ফেলেছে আরেকটা। অবশ্যই সেকেন্ড হ্যান্ড এবং পুরানো মডেল। একাশি মডেলের শিরোকো। গোঁ গোঁ করে দুবার গর্জে উঠে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার দুটো চলতে চলতে থেমে গেল মাঝপথে।
খাইছে! বলল সে, বৃষ্টি যা হচ্ছে না!
হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল পাশে বসা কিশোর পাশা।
শুধু বৃষ্টি না, ঝড়ো বাতাসও বইছে। ঝমঝম ঝমঝম অবিরত উইন্ডশীন্ডে আঘাত হেনে চলেছে বড় বড় ফোটা। আকাশ চিরে দিল বিদ্যুতের শিখা। বাজ পড়ল বিকট শব্দে।
থামবে না। এরই মধ্যে বেরোতে হবে, মুসা বলল। ভিজিটিং আওয়ারও শেষ হয়ে আসছে।
ফারিহাকে দেখতে এসেছে ওরা। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। ইদানীং ওর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠছে মুসার।
চুপ করে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
কি হলো, নাম না। ফারিহা অপেক্ষা করছে।
করুক। বৃষ্টি যে হচ্ছে সেটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছে। কার ওপর বিরক্ত হয়েছে কিশোর, বোঝা গেল না। সীটবেল্ট খুলল।
আসলে মেয়েদেরকে তুমি দেখতে পারো না।
কথাটা ঠিক না, মুসা। তবে ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শুরু করে যখন, তখন আর ভাল্লাগে না। আর যখন কোন ব্যাপারে অহেতুক চাপাচাপি শুরু করে, না বুঝে।
হেসে উঠল মুসা। জিনার সামনে বলে দেখ এসব কথা…
বললে কি হবে? খেয়ে ফেলবে নাকি?
জবাব দিল না মুসা। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা। উইন্ডব্রেকারের হুড তুলে দিয়ে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে। মাথা নিচু করে দিল দৌড়। কিশোরও বেরোল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মুসার পিছু নিল।
বারান্দায় উঠে উইন্ডব্রেকার খুলে ঝেড়ে পানি ফেলল। তারপর ভাঁজ করে। হাতে নিয়ে রওনা হলো রুম নম্বর ১১১১-এর দিকে।
ঢুকে দেখল বিছানায় শুয়ে আছে ফারিহা ডিকটার। ফোনে কথা বলছে। এক আঙুলে বার বার পেঁচাচ্ছে কোঁকড়া চুল। টিভি অন করা। মিউজিক শো চলছে। দেখে মনেই হয় না, মাত্র তিনদিন আগে অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে তার।
রকি বীচ হাই স্কুলে হাসিখুশি মিশুক মেয়ে বলে সুনাম আছে ফারিহার। মাস ছয়েক আগে হঠাৎ করেই মনে হয়েছে তার, মুসা খুব ভাল ছেলে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা চলে।
ওদেরকে ঢুকতে দেখে ফোনে বলল ফারিহা, আজ রাখি, শেলি। মুসা আর কিশোর এসেছে… কি বললে?… কিশোর?…জানি না।
নিজের নাম শুনে শূন্য দৃষ্টিতে একবার ফারিহার দিকে তাকিয়েই আরেক দিকে চোখ সরিয়ে নিল কিশোর।
ও তো সব সময়ই মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলে, ফারিহা বলল। আচ্ছা, দেখি জিজ্ঞেস করে, কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, শেলি কথা বলতে চায়।
ঢোক গিলল কিশোর। যত জটিল রহস্যই হোক, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ওর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যতই বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে, অভিজ্ঞ হচ্ছে, ততই যেন মেয়েদেরকে আরও বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে ওর। ওদের কোন কিছুই যেন বোঝা যায় না। না বলতে পারলেই খুশি হত কিশোর, তবু এভাবে মুখের ওপর বলে দেয়াটা অভদ্রতা। তাই হাত বাড়াল, দাও।
রিসিভার কানে ঠেকাল গোয়েন্দাপ্রধান। হ্যালো। কিশোর পাশা বলছি।
খিলখিল করে হাসল শেলি। ঘাবড়ে গেছ মনে হয়? তারপর? চলছে কেমন?
এই তো শুরু হলো ফালতু কথা! মনে মনে বলল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কি চলছে?
বোকা নাকি? কেমন আছ জিজ্ঞেস করছি, বুঝতে পারছ না?
তাহলে কেমন আছি, সেটা সোজা করে জিজ্ঞেস করলেই হয়।
আ মর, জ্বালা! তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি…
তাহলে বলো কেন?
হাসতে আরম্ভ করেছে মুসা আর ফারিহা। জানে, এরকমই একটা কিছু ঘটবে।
বলি কেন? এটা একটা কথা হলো…
ঘামতে শুরু করেছে কিশোর। ঠিক এই সময় লাল চুলওয়ালা একজন নার্স উঁকি দিয়ে বলল, ভিজিটিং আওয়ার শেষ। বেরিয়ে যেতে হবে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন কিশোর। তাড়াতাড়ি রিসিভারটা ফিরিয়ে দিল ফারিহার হাতে। ফারিহা বলল, শেলি, পরে কথা বলব। এখন রাখি…
বলেই চলে গেছে নার্স। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দুজন আদালী আর দুজন নার্স একটা চাকাওয়ালা বেড ঠেলতে ঠেলতে ঢুকল। সঙ্গে ঢুকলেন একজন ডাক্তার। লাফিয়ে সরে গেল কিশোর।
বেডটাতে একজন রোগী। একটা মেয়ে। কিশোরদেরই বয়েসী হবে। কালো কোঁকড়া চুল। সুন্দর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। জখম আছে। ব্যান্ডেজ লাগানো।
ফারিহা, ডাক্তার বললেন। তোমার নতুন রুমমেট। রোগীকে ফারিহার পাশের বিছানাটায় শোয়াতে নার্সদের সাহায্য করলেন তিনি। বেহুঁশ হয়ে আছে রোগী।
বেশি অসুস্থ? ফারিহা জানতে চাইল।
ওর জখমগুলো সুপারফিশিয়াল মনে হচ্ছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমার ধারণা, কনকাশন আর মাইল্ড শক থেকে সেরে উঠছে।
হাঁ হয়ে গেছেন ডাক্তার। অবাক হাসি ফুটল মুখে। ডাক্তারি পড়ছ নাকি?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। তবে অবসর সময়ে যে কোন বই হাতের কাছে পেলে পড়ে ফেলি।
নার্সেরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটার হাতে স্যালাইনের সুচ ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্যালাইনের সঙ্গে আরও নানারকম ওষুধ মিশিয়ে দিতে লাগল। কাজ শেষ করে সরে দাঁড়াল। চার্টে নোট লিখে দিতে লাগলেন ডাক্তার।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ফারিহা।
অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, ডাক্তার জানালেন। কাউন্টিলাইন ড্রাইভে। ও কিছু না। এ রকম রাতে অ্যাক্সিডেন্ট করবেই। দিনের বেলাতেই করে বসে, যে ভাবে বেপরোয়া চালায় আজ কালকার…
ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার দরজায় উঁকি দিল লাল চুলওয়ালা সেই নার্স। কিশোর আর মুসার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, যাওনি এখনও! বললাম না ভিজিটিং আওয়ার শেষ।
শুনেছি তো, বিরক্ত হয়েই বলল মুসা।
তাহলে যাচ্ছ না কেন? দারোয়ানকে খবর দেব?
ফারিহার দিকে তাকাল মুসা। চলি, ফারিহা। কাল আবার আসব। রাতে ইচ্ছে করলে ফোন কোরো। কিশোরদের বাড়িতেই থাকছি আজ।
নার্সের দিকেও নজর নেই কিশোরের, মুসা আর ফারিহার দিকেও না। সে তাকিয়ে রয়েছে নতুন রোগীর দিকে।
অ্যাই, এসো, ডাকল মুসা। কি দেখছ?
চার্টে নাম লিখে গেছেন ডাক্তার। জুন লারসেন। কে ও?
আমি কি জানি? চলো। ওই নার্সটা যদি এসে দেখে এখনও যাইনি…
চলো।
মেয়েটা কে মিনিটখানেক পরেই জেনে গেল দুজনে। এলিভেটরের দিকে চলেছে। এই সময় বিশালদেহী একজন মানুষ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন ওটার ভেতর থেকে। ছুটে গেলেন নার্সরা যেখানে বসে সেদিকে। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন লাল চুলওয়ালা নার্সের ডেস্কের সামনে। মাথা ঝুঁকিয়ে প্রায় মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে কোথায়? কোন ঘরে?
আরে এ তো হার্বার্ট লারসেন! চিনে ফেলেছে কিশোর। চিকেন!
হ্যাঁ, মুসাও চিনতে পেরেছে। দি চিকেন কিং! মুরগীর রাজা!
লাল, সাদা, নীল রঙের বিচিত্র সমাহার পোশাকে। বেশির ভাগ সময়েই যা পরে থাকেন সেই জগিং স্যুট। এই পোশাকে টিভিতেও দর্শকদের দেখা দিয়েছেন। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় সবাই চেনে তাঁকে। হাজার হাজার বার দেখেছে। টিভির পর্দায়। যে কোন চ্যানেল খুললেই কোন না কোন সময় চোখে পড়বেই বিজ্ঞাপনটা। ওখান থেকেই তাঁর ডাক নাম হয়ে গেছে চিকেন। আগের দি এবং পরের কিংটা বাদ দিয়ে দিয়েছে লোকে।
জুন লারসেন-হার্বার্ট লারসেন, বিড়বিড় করছে কিশোর। জুন নিশ্চয়ই লারসেনের মেয়ে।
রুম ওয়ান ওয়ান ওয়ান ওয়ান, মিস্টার লারসেন, নার্স বলল।
ওটা কি লাকি রুম? লারসেন বললেন, আমি চাই, আমার মেয়ে লাকি রুমে থাকুক। যেটাতে কোন রোগী মারা যায়নি। কোথায় ওটা? কোন দিকে? কোন ঘরটা?
ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। তার জন্যে খারাপই লাগল কিশোরের। এগিয়ে গেল নার্সের ডেস্কের কাছে। মিস্টার লারসেন, ওই যে ওই ঘরটা।
লারসেন যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। কিশোরকে ক্ষুদ্রই মনে হলো তার কাছে, যদিও সে-ও কম লম্বা নয়। ভুরু কুঁচকে তাকালেন কিশোরের দিকে, তুমি শিওর?
হ্যাঁ, এই মাত্র দেখে এলাম। ওঘরে আমাদের এক বন্ধুও আছে। জুন এখন ঘুমিয়ে।
কিছুটা যেন স্বস্তি পেলেন চিকেন কিং। সোয়েটশার্টের পকেট থেকে দুটো কুপন বের করে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও। দুটো টিকেট। আমার দোকানে গেলে ফ্রী খেতে পারবে চিকেন। আমার নিজের তৈরি সোনালি সসে চুবিয়ে। খেলে ভুলবে না।
নিতে দ্বিধা করছে কিশোর।
আরে নাও নাও, তাড়া আছে আমার, জোর করে কুপন দুটো কিশোরের হাতে গুঁজে দিলেন লারসেন। তোমরা ভাল সংবাদ দিয়েছ। সেজন্যেই দিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছে! থ্যাঙ্ক ইউ।
বিশাল শরীর নিয়ে বেশ দ্রুতই মেয়ের ঘরের দিকে ছুটলেন লারসেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে কুপনগুলো একটানে ছিড়ে ফেলল কিশোর। বাধা দিতে গেল মুসা। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে। হায় হায়, এ কি করলে!
গত হপ্তায় ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, মনে নেই? পেটের অসুখের জন্যে? ভাজাভুজি খেতে মানা করে দিয়েছেন।
সে তো তোমাকে দিয়েছেন। আমাকে নয়।
এখানে আমার তোমার বলে কোন কথা নেই। পেটের জন্যে যেটা খারাপ, সবার জন্যেই খারাপ।
যুক্তি খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল, মুসা। তবে এত ভাল একটা খাবার এভাবে নষ্ট করা হলো বলে মনে মনে রেগেই গেল কিশোরের ওপর।
আবার বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠল দুজনে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে রওনা হলো।
অ্যাক্সিডেন্টটা কি করে ঘটল জানতে পারলে হত, কিশোর বলল।
কিছু বলল না মুসা। একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। কিশোরের মনে কিসের খেলা চলছে ভাল করেই বুঝতে পারছে সে। পেয়ে গেছে রহস্য।
ইয়ার্ডে ঢুকল গাড়ি। সোজা এসে ওয়ার্কশপে ঢুকল দুজনে। ট্রেলারের ভেতরে তো পুরানো হেডকোয়ার্টার আছেই, ওয়ার্কশপটাকেও এখন আরেকটা হেডকোয়ার্টার বলা যায়। নানা রকম আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সাজিয়েছে কিশোর। এককোণে একটা ডেস্কের ওপর রাখা একটা অ্যানারিং মেশিন। ঢুকেই আগে ওটার কাছে এগিয়ে গেল সে। বোতাম টিপতেই মেসেজ টেপে শোনা গেল রবিনের পরিচিত হাসি হাসি কণ্ঠ, ফারিহাকে দেখতে যেতে পারলাম না। সরি। বস চলে গেছে শহরের বাইরে। নতুন আরেকটা ব্যান্ড চেক করতে গিয়েছিলাম। অফিসে ফিরে হাসপাতালে যাব ভাবছি, এই সময় ফোন করল এমিলি। ও আজকে দাওয়াত করেছিল, পার্টিতে, ভুলেই গিয়েছিলাম। এমন চাপাচাপি শুরু করল, না গিয়ে আর পারলাম না। জানোই তো ওর অবস্থা। ওকে কি করে ঠেকানো যায়, বলো তো কিশোর? তোমার কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করে দেখ, কোন একটা পরামর্শ দিতে পারে কিনা, আচ্ছা, কাল দেখা হবে।
ট্যালেন্ট এজেন্সিতে বড় বেশি সময় দিচ্ছে রবিন, গানের কোম্পানিটার কথা বলল কিশোর, যেটাতে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছে নথি-গবেষক।
হ্যাঁ, মুচকি হাসল মুসা। আরেকটা চাকরিতেও বড় বেশি সময় নষ্ট করছে আজকাল। মেয়েদের পেছনে। রবিনটা যে এমন হয়ে যাবে, কল্পনাই করতে পারিনি।
কি আর করা যাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল কিশোর। এটা আমেরিকা। যে দেশের যা সমাজ। ও তো আর আমার মত নয় যে মেয়েদের সঙ্গে ডেটিং অপছন্দ করবে…
তোমাকেই বা কে মানা করেছে?
করেনি। তবে আমার এসব ভাল লাগে না। একটা ব্যাপারেই কষ্ট হয়, রবিনকে আর আগের মত পাচ্ছি না আমরা।
কই, পাচ্ছি না কোথায়? তিন গোয়েন্দার কাজের সময় তো ঠিকই এসে হাজির হয়। আমি একটা কথা লিখে দিতে পারি, দেখ, ট্যালেন্ট এজেন্সিতে বেশিদিন টিকবে না ও। ব্যাপারটা সাময়িক। ও আবার ফিরে যাবে লাইব্রেরিতে, বইয়ের জগতে।
তাই যাওয়া উচিত। যেখানে যাকে মানায়।
আর কথা বাড়াল না। কিছু কাজ আছে ওদের। ছোট একটা যন্ত্র মেরামত করতে বসে গেল কিশোর। ওটা দিয়ে ইলেক্ট্রনিক লক কম্বিনেশন পড়া সম্ভব কিছু যন্ত্রপাতি এদিক ওদিক করে নিলে, কিশোরের অন্তত সে রকমই ধারণা। ওকে বিরক্ত করল না মুসা। একটা ফুয়েল ইনজেকটরের স্পেয়ার পরিষ্কারে লেগে গেল। ওর গাড়ির জন্যে কাজে লাগবে।
বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। কথা বলতে বলতে কাজ করে চলল দুজনে। কিশোরের একটা গাড়ি দরকার, সে কথা আলোচনা করল কিছুক্ষণ। আরও খানিকক্ষণ আফসোস করল রবিনকে আগের মত করে পাচ্ছে না বলে। এক সময় চলে এল চিকেন হার্বার্ট লারসেনের কথায়। জুন লারসেনের দুর্ঘটনার ব্যাপারটা এখনও মাথায় ঘুরছে কিশোরের। পুরোপুরি জানতে পারেনি বলে খুঁতখুঁত করছে মনটা।
হঠাৎ বাজল টেলিফোন। চমকে দিল দুজনকেই। ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় মধ্যরাত। এত রাতে কে করতে পারে, বিশেষ করে শুক্রবারের রাতে?
পুরানো একটা সুইভেল চেয়ারে বসেছে কিশোর। ওটাকে ঘুরিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়াল। হ্যালো, তিন গোয়েন্দা।
কিশোর, ফারিহা বলছি। তোমাদের স্পীকারের সুইচ দিয়ে দাও। দুজনকেই শোনাতে চাই।
ফারিহা, টেলিফোন লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সুইচ অন করতে করতে মুসাকে জানাল কিশোর। আরও একটা বিশেষ নতুন ব্যবস্থা করেছে সে, যাতে এপাশে যতজন থাকবে, সবাই ওপাশের লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।
মুসাও তারই মত অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, ফারিহা, কি হয়েছে? এত রাতে?
আবার সেই অনুভূতিটা হলো কিশোরের, রহস্যের গন্ধ পেলে যেমন হয়। তবে নিশ্চিত হতে পারছে না।
অদ্ভুত একটা কান্ড করছে জুন, জবাব দিল ফারিহা। ঘুমের মধ্যে গোঙাচ্ছে, আর বিড়বিড় করে কথা বলছে।
ওরকম অ্যাক্সিডেন্টের পর প্রলাপ বকাটাই স্বাভাবিক, কিশোর বলল।
তা ঠিক। তবে যা বলছে, তাতে ভয় লাগছে আমার। বলছে, হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক মারা যাবে! বার বার বলছে একই কথা।
চুপ হয়ে গেল কিশোর আর মুসা। জবাব দিতে পারছে না।
ফারিহা বলছে, এই শেষ নয়। ও বলছে, মুরগীতে বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ঠিক না! এটা অন্যায়! এমন ভঙ্গিতে বলছে, যেন নিজের চোখে বিষ মেশাতে দেখেছে। ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকছে বলে মনেই হয় না!
মৃদু শিস দিয়ে উঠল মুসা। সাংঘাতিক কথা!
ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোর বলল, কি, বলেছিলাম না? আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে?
বলেছ। কিন্তু কে জানত, চিকেন কিং আমার প্রিয় খাবারে বিষ মেশাচ্ছেন?
২
অ্যাই, শুনছ? কিশোরের ওয়ার্কশপে স্পীকারে ভেসে এল ফারিহার গলা। আছ নাকি ওখানে?
আছে ঠিকই, তবে জিভ যেন জড়িয়ে গেছে। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। কতবার খেয়েছে চিকেন কিঙের রেস্টুরেন্টে? শতবার? হাজার বার? কিশোরই খেয়েছে এতবার, খাবারের প্রতি যার ঝোক নেই তেমন। আর মুসা যে কতবার খেয়েছে তার তো হিসেবই করতে পারবে না। চোখে ভাসছে, টিভির পর্দায় দেখা হার্বার্ট লারসেনের চেহারা। চেহারাটাকে নিস্পাপ করে তুলে নিরীহ কণ্ঠে বলেন, আমার মুরগী সেরা মুরগী। খেয়ে খারাপ বলতে পারলে পয়সা ফেরত।
চিকেন লারসেন… খাবারে বিষ মেশায়…? বিড়বিড় করছে মুসা। বিশ্বাস করতে পারছে না। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে। আমার বিশ্বাস হয় না!
হওয়ার কথাও নয়, কিশোর বলল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার চিন্তিত ভঙ্গিতে। চাচী প্রায়ই বলে, আপাতদৃষ্টিতে যেটা ঠিক মনে হরে সেটা ঠিক -ও হতে পারে। কেন একেবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি আমরা?
মানে?
মানে, চিকেন লারসেনকে দোষ দিচ্ছি কেন আমরা? ঘোরের মধ্যে তাঁর কথাই বলছে জুন, কি করে জানছি? নাম তো আর বলেনি। অন্য কারও কথাও বলে থাকতে পারে, যে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। মস্ত একটা শক খেয়েছে সে। নানারকম ওষুধ দেয়া হচ্ছে। ওষুধের কারণেও দুঃস্বপ্ন দেখে অনেক সময় রোগী। হতে পারে ব্যাপারটা পুরোই দুঃস্বপ্ন।
অ্যাই, শোনো, ফারিহা বলল। জুনের মুখের কাছেই নিয়ে যেতে পারতাম। তাহলে নিজের কানেই শুনতে পারতে। কিন্তু কর্ডটা অতদূর যায় না। যতটা সম্ভব কাছে নিয়ে যাচ্ছি।…শোননা। শুনতে পাচ্ছ?
মাথা নাড়ল মুসা। কিশোর বলল, না। কি বলে?
আবার সেই একই কথা, ফারিহা বলল। বলছে, না না, দিও না…লোক মারা যাবে! ওকাজ কোরো না!
ও-কে, কিশোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কাল সকাল এগারোটায় জুনের সঙ্গে কথা বলব। ভিজিটিং আওয়ার স্টার্ট হলেই চলে আসব। দেখা যাক, ঘুম ভাঙে কিনা, কিছু বলতে পারে কিনা স্বপ্নের ব্যাপারে।
ভালই হয় এলে। তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারি, রহস্য একটা আছেই। পেয়ে যাবে।
কাল সকালে দেখা হবে, ফারিহা, মুসা বলল।
লাইন কেটে দিল কিশোর।
সে রাতে ভালমত ঘুমাতে পারল না কিশোর। ভাবছে, কোন লোকটা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিষ খাওয়াতে চায়? কেন? চিকেন লারসেন? নাকি কোন খেপাটে সন্ত্রাসী, যার দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে জুন? নাকি লারসেনের ব্যবসার ক্ষতি করার জন্যে কেউ বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে মুরগীর মাংসে তৈরি তার বিখ্যাত খাবারগুলোতে?
রাত একটায় রবিনকে ফোন করল কিশোর। পেল না বাড়িতে। তখনও ফেরেনি।
দুটোয় আবার করল। এইবার পেল। সব কথা জানিয়ে বলল, সকালে যেন হাসপাতালে হাজির থাকে।
কিশোরের ফোন পাওয়ার পর রবিনেরও ঘুম হারাম হয়ে গেল। সে-ও ভাবতে লাগল একই কথা, কে এ রকম পাইকারী হারে মানুষ মারতে চায়?
ফারিহাও ঘুমোতে পারছে না। জেগে রয়েছে বিছানায়। কান পেতে রয়েছে। আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্যে। যতবারই গুঙিয়ে ওঠে জুন, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে সে, জুন, কে? কৈ মুরগীতে বিষ মেশাচ্ছে বলো তো? কিন্তু জবাব দেয় না জুন।
মরার মত ঘুমিয়েছে কেবল মুসা। তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।
পরদিন সকালে জানালা দিয়ে যখন হাসপাতালের ঘরে রোদ এসে পড়েছে, তখন সেখানে পৌঁছল কিশোর আর মুসা।
প্রথমেই লক্ষ্য করল কিশোর, ফারিহাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘরে ফুলদানীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে, আর তাতে অনেক ফুল। জুনের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে একটা স্টাফ করা মুরগী, মাথায় সোনালি মুকুট। পর্দা টেনে ঘিরে দেয়া হয়েছে জুনের বিছানা।
পর্দা টানা জায়গাটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল কিশোর। জুন কোথায়? এখুনি ওর সঙ্গে কথা বলে রহস্যটার একটা সমাধান করে ফেলতে চায়। আর কেউ আছে?
শশশ! ঠোঁটে আঙুল রেখে কিশোরকে আস্তে কথা বলতে ইঙ্গিত করল ফারিহা। ফিসফিসিয়ে বলল শুধু, জুন ঘুমিয়ে আছে।
এই সময় ঘরে ঢুকল রবিন।
সরি। দেরি হয়ে গেল। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিল। পুরানো ফোক্সওয়াগনটা বিক্রি করে দিয়ে আরেকটা গাড়ি কিনেছে রবিন। লম্বা, একহারা শরীর। গায়ের কটন সোয়েটারটা খুলে গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। কয়েক বছর আগেও সে ছিল রোগাটে, হালকা পাতলা এক কিশোর। পায়ে চোট পেয়েছিল। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিল হাড়। সেটা বড় যন্ত্রণা দিত মাঝে মাঝে। এখন সব সেরে গেছে।
অনেক বদলে গেছে রবিন। লম্বা হয়েছে। গায়ে মাংস লেগেছে। চেহারায় চাকচিক্য। ধোপদুরস্ত পোশাক পরে। চাকরি করে বার্টলেট লজের ট্যালেন্ট এজেন্সিতে। কারাতের ট্রেনিং নিচ্ছে। ওকে দেখলে কেউ এখন কল্পনাই করতে পারবে না এই রবিন মিলফোর্ডই পার্ট টাইম চাকরি করত রকি বীচের লাইব্রেরিতে, আর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকত। রকি বীচ হাই স্কুলে মেয়েমহলে রবিন এখন একটা পরিচিত প্রিয় নাম।
কোথায় আমাদের কেস? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন। ডানা মেলে উড়ে গেল না তো চিকেন প্রিন্সেস?
কেস ওই পর্দার আড়ালে, মাথা নেড়ে পর্দাটা দেখিয়ে দিল মুসা। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারিনা আমরা।
চেষ্টা করলে কিশোর পারবে, হেসে বলল রবিন। তবে যুক্তি দেখাতে গেলে মুখ খুলবে কিনা…
খোলার অবস্থাতেই নেই এখন, নিচু গলায় বলল ফারিহা। অন্তত শান্ত তো হয়ে আছে। কাল রাতে যা করেছে না! কয়েকজন লোকও এসেছিল দেখা করতে।
রাত দুপুরে! অবাক হলো কিশোর। লাল চুলওয়ালা ওই নার্সের চোখ এড়াল কিভাবে?
শ্রাগ করল ফারিহা। রহস্যময় ব্যাপার, তাই না? কারা ওরা?
ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসেছে চিকেন লারসেন। গোটা দুই ফ্রী কুপনও দিয়েছে আমাকে।
সবাইকেই খালি কুপন বিলাচ্ছে। আর কে এসেছে?
টম হামবার নামে একটা সুন্দর লোক। নাম জানলে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কেন, গোয়েন্দা কি শুধু তোমরাই? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিহা। জিজ্ঞেস করেছিলাম। জুনের বয়ফ্রেন্ড ছিল এক সময়। ভোর চারটের দিকে এসেছিল সে। জুনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। যেন পাহারা দিচ্ছিল ওকে। তারপর ভোরবেলা এল আরেকজন। নাম বলল হেনা তানজামিলা। জুনের কলেজ হোস্টেলের নাকি রুমমেট সে।
হুমম, মাথা দোলাল কিশোর। ওর কথা ভুলে যেতে পারি আমরা।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
কারণ, জুন বলেছে লোকটা খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। আর ওই টমকে নিয়েও মাথাব্যথা নেই আমার। একজন ভূতপূর্ব বয়ফ্রেন্ড লাখ লাখ লোক মারার প্ল্যান করবে বলে মনে হয় না।
প্রতিশোধ নিতে চাইলেও না?
লাখ লাখ লোকের ওপর কিসের প্রতিশোধ নেবে?
আগেই তর্ক শুরু করে দিলে, বাধা দিয়ে বলল ফারিহা। চার নম্বর রহস্যময় লোকটার কথা তো এখনও শোনাইনি। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব খাদে নামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে।
জুনের বিছানা ঘিরে টানানো পর্দার দিকে তাকাল চারজনে। যেন শিওর হতে চাইছে, জুন জেগে গেছে কিনা। তারপর লোকটার কথা বলতে লাগল ফারিহা, চার নম্বর ভিজিটরটি একজন লোক বটে! ভীষণ বদমেজাজী। বয়েস তিরিশ মত হবে। বেশ তাগড়া শরীর। একটা আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসেছিল। আমার ওপর চোখ পড়তেই জ্যাকেটের কলার তুলে নিয়ে মুখ আড়াল করে ফেলল। হতে পারে, চেহারাটা বেশি কুৎসিত, সে জন্যেই দেখাতে চায়নি।
নাম জিজ্ঞেস করেছ? মুসা জানতে চাইল।
করেছি। শুয়োরের মত ঘোৎ ঘোঁৎ করে চুপ থাকতে বলল। ধমক দিয়ে বলল, আমি ওর নাম জেনে কি করব? তারপর জুনের বিছানার চারপাশের পর্দাটা টেনে দিল যাতে আমি কিছু দেখতে না পারি।
তারপর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নানারকম খুটুরখাটুর শব্দ শুনলাম। মনে হলো, জুনের ওপাশে যতগুলো ড্রয়ার আছে সব খুলে খুলে দেখেছে।
তাড়াহুড়ো করে, না আস্তে আস্তে?
তাড়াহুড়ো করে।
হাসল কিশোর। তারমানে আন্দাজে কিছু করতে আসেনি। যা করতে এসেছে, জেনে বুঝেই এসেছে। কি খুঁজছিল, জানে।
কিন্তু পায়নি। খালি হাতে ফেরত যেতে দেখেছি।
পায়চারি শুরু করল কিশোর। জুন না জাগলে আর কিছুই জানা যাবে না।
আর জাগলে যেন ভিজিটিং আওয়ারে জাগে, মুসা বলল মুখ বাঁকিয়ে। নইলে যে নার্সের নার্স। এক্কেবারে দজ্জাল। একটা মুহূর্তও আর থাকতে দেবে না আমাদেরকে।
জুনের পর্দার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করল রবিন। অবস্থা খুব একটা খারাপ লাগছে না। খবরের কাগজগুলো মন্তব্য করছে, বেঁচে যে আছে এটাই ভাগ্য। অ্যাক্সিডেন্টে গাড়িটার নাকি সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে, ঘুরে দাঁড়াল সে। দুর্ঘটনার জায়গাটা দেখেছ?
মাথা নাড়ল কিশোর। একভাবে পায়চারি করে চলেছে। এই সময় একগোছা ফুল নিয়ে ঘরে ঢুকল লাল চুলওয়ালা নার্স।
প্রথমে ফারিহার দিকে তাকাল সে, তারপর এক এক করে তিন গোয়েন্দার দিকে। তিনটে ছেলে! ফারিহার দিকে আবার তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এত বন্ধু জুটিয়েছ কেন? রোগ না সারিয়ে আরও তত বাড়াবে। এতজনে দেখতে আসার কোন দরকার আছে? জুনের বিছানার কাছে ফুলগুলো রেখে দরজার দিকে এগোল সে। বেরোনোর আগে ফিরে তাকিয়ে বলল, আবার আসব আমি, যেন হুমকি দিয়ে গেল।
কেন আসবে? নার্স বেরিয়ে যাওয়ার পর বিড় বিড় করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল মুসা।
ইনটারেসটিং, রেখে যাওয়া ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল রবিন। হেনরি অগাসটাস পাঠিয়েছে।
তাতে ইনটারেসটিঙের কি হলো? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কারণ, অগাসটাস রেস্টুরেন্টের মালিক সে। চিকেন লারসেনের প্রতিযোগী।
তুমি জানলে কি করে? তোমার আর কিশোরের কাছে তো কোন রেস্টুরেন্টেরই কোন মূল্য নেই। আগের রাতে কুপন ছিড়ে ফেলার পর থেকেই বিরক্ত হয়ে আছে মুসা। রাগটা ঝাড়ল এখন।
হেসে ফেলল রবিন। মনে হচ্ছে তোমার খাওয়ায় বাদ সেধেছে কিশোর? ফ্রী কুপন দিয়ে গিয়েছিল নাকি চিকেন লারসেন?
দিয়েছিল, কিশোর জানাল। আজেবাজে জিনিস খেয়ে পেট নষ্ট হয়। সে জন্যে ফেলে দিয়েছি। আর কেউ কিছু মুফতে খেতে দিলেই খেতে হবে নাকি?
শব্দ করে হাসল রবিন। মুসার রাগের কারণ এখন পরিষ্কার। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, না, রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে হেনরির সঙ্গে পরিচয় হয়নি। অগাসটাস রেস্টুরেন্টের শুভ উদ্বোধনী দিনে একটা ব্যান্ড পার্টি পাঠাতে হয়েছিল আমাকে। আমিও গিয়েছিলাম সঙ্গে। টাইম যখন দিয়েছিল তার অনেক পরে এসেছিল হেনরি। ওকে ছাড়া কাজ শুরু করা যায়নি। ঝাড়া চারটে ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের।
শক্রর মেয়েকে ফুল পাঠাল কেন কিছু আন্দাজ করতে পারো?
ওরকম করেই থাকে হেনরি। ব্যবসার কোন ট্রিকস হবে। তবে লোকটাকে বোধহয় তোমারও পছন্দ হবে না। শুনেছি, হেনরি আর চিকেন একজন আরেকজনের ছায়া দেখতে পারে না। লারসেন মরে গেলে তার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হত না। মুখেও বলে সেকথা। লারসেন অতটা খারাপ লোক নন। মুখে কিছু বলেন না বটে, তবে অন্তরের ইচ্ছা একই হবে।
যাক, বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতে ঘুসি মারল মুসা। সন্দেহ করার মত কয়েকজন পাওয়া গেল।
তা গেল, বলল কিশোর। কিন্তু কোন অপরাধ তো ঘটেনি। সন্দেহ করে কি হবে?
এই সময় দরজা খুললেন চিকেন লারসেন। ঘরে এত লোক দেখে যেন বরফের মত জমে গেলেন। তবে এক সেকেন্ডের জন্যে।
তার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। গোলগাল চেহারা? চোখের কোণে কালি কেন? মেয়ের জন্যে দুশ্চিন্তায়? নাকি উন্মাদের দৃষ্টি? পাগলের চোখেও ও দৃষ্টি দেখেছে সে। খাবারে বিষ মিশিয়ে লাখ লাখ মানুষকে মেরে ফেলার কথা তার মেয়ে বলে ফেলেছে বলেও দুশ্চিন্তা হতে পারে। কোনটা?
দরজায় দাঁড়িয়েই তিনি বললেন, আমি আমার মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। সুযোগ পাব?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরোতে হলো তিন গোয়েন্দাকে। চলে এল হলঘরে। চারপাশে একবার চোখ বোলাল কিশোর। তারপর হলের মাঝে নার্সরা যেখানে বসে সেদিকে এগোল। ডেস্কের পেছনে মাত্র একজন নার্স রয়েছে। সেই লাল চুলওয়ালা মহিলা। তার নেমট্যাগে লেখা রয়েছেঃ মারগারেট ইলারসন, আর এন।
শুনুন, মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর। কাল রাতে এখানে কে ডিউটিতে ছিল বলতে পারবেন?
অবাক কান্ড! ভুরু কুঁচকে ফেলল মারগারেট, তুমি জিজ্ঞেস করার কে? শুনতে চাও? আমি ছিলাম। আমি। আরেকজন যার ডিউটিতে থাকার কথা, সে হঠাৎ করে বিয়ে করে বসেছে। কাজেই দিনরাত এখন আমাকে ডিউটি দিতে হচ্ছে। একটানা চব্বিশ ঘণ্টা।
হাসল কিশোর। তাতে উত্তেজনা মিশে আছে। তাই নাকি। তাহলে তো জুন লারসেনকে যারা যারা দেখতে এসেছে সবার কথাই বলতে পারবেন। ওর বাবা বাদে আর যে তিনজন এসেছিল।
মাথা নাড়ল মারগারেট।!না। রোগীর পারিবারিক ব্যাপারে বাইরের লোকের নাক গলানো নিষেধ।
আলাপ শেষ। মহিলার চোখ দেখেই সেটা আন্দাজ করতে পারল কিশোর। একটানা ডিউটি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে আছে মারগারেট। মুখ গোমড়া করে রেখেছে। তাছাড়া কথা কম বলা স্বভাব। মেজাজ ভাল থাকলেও বলত না। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরেক দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান।
এগিয়ে এসেছে রবিন। লালচে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ম্যাম, ব্যাপারটা জরুরী।
কড়া চোখে তাকাল মারগারেট। বিনিময়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল রবিন। তারপর ভদ্র কণ্ঠে বলল, ট্যালেন্ট এজেন্সিতে যে ভাবে মক্কেলদের পটায় সেভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি! এ তো অমানবিক। নাহ, আপনার জন্যে মায়াই লাগছে আমার।
চোখের দৃষ্টি সামান্য নরম হলো মহিলার। রবিনের দিকে তাকিয়ে যেন সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছে, ভাগিয়ে দেবে না কথা বলবে। এত ভাল একটা ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা উচিত হবে না ভেবেই বোধহয় শেষে বলল, তিনজন তো নয়, দুজন এসেছিল। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে।
কেন, আর্মি জ্যাকেট পরা লোকটা? জানতে চাইল কিশোর। আসেনি?
বিস্ময় ফুটল মারগারেটের চোখে। আমি সাফ মানা করে দিয়েছিলাম, ঢুকতে পারবে না। আর বোলো না! লোকটাকে দেখলেই গা শিরশির করে। শুঁয়োপোকা দেখলে যেমন করে!
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
দেখতেই জানি কেমন। একের পর এক প্রশ্ন করে চলল। জবাব দিতে দিতে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার। আর কি সব প্রশ্ন!
যেমন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা কি বাঁচবে? যেন মরে গেলেই খুশি হয়। ওর জিনিসপত্রগুলো কোথায় রেখেছে, একথাও জানতে চাইল। আরও নানা রকম কথা। লারসেন পরিবারের লোক বলে মনে হলো না ওকে।
চেহারাটা দেখেছেন ভাল করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মাথা নাড়ল মারগারেট। লোকের মুখের দিকে কখনোই ভাল করে তাকাই না আমি। কেবল তার জ্যাকেট আর কথাগুলো মনে আছে। বদমেজাজী যে এটুকুও বুঝতে পেরেছি। তবে তার চেহারা বলতে পারব না।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সরে এল তিন গোয়েন্দা। কিশোর বলল, ধরা যাক, লোকটার নাম মিস্টার এক্স। এখন এই এক্সকে বিশেষ সুবিধের লাগছে না আমার। সন্দেহ জাগানোর মত চরিত্র। জুন হয়তো জানতে পারে লোকটার আসল পরিচয়। চলো, রুমে যাই। দেখি, জাগল কিনা।
অ্যাই, ছেলেরা, ওদের কথা শুনে ফেলেছে মারগারেট। জুনের অবস্থা কিন্তু খারাপ। ঘুম দরকার। ওর জাগতে সময় লাগবে।
তাহলে আর গিয়ে লাভ নেই। অহেতুক বসে থাকা। তার চেয়ে কাজের কাজ যদি কিছু করা যায় সেই চেষ্টা করল ওরা। মুসা রয়ে গেল হাসপাতালে। ফারিহাকেও সঙ্গ দেবে, জুনের কাছে কারা কারা আসে দেখবে, আর ওর ঘুম ভাঙে কিনা খেয়াল রাখবে। কিশোর আর রবিন চলল রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে, চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলতে।
আরেকটা ফোক্সওয়াগনই কিনেছে রবিন। গোবরে পোকার মত এই গাড়িগুলোই যেন তার বিশেষ পছন্দ। তার বক্তব্য, এই গাড়ি নাকি পথেঘাটে বন্ধ হয়ে বিপদে ফেলে না। যাই হোক, সেটা পরীক্ষার ব্যাপার। এই গাড়িটার রঙও আগেরটার মতই, লাল। সে বসল ড্রাইভিং সীটে। পাশের প্যাসেঞ্জার সীটে বসল কিশোর।
থানায় পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। চীফ আছেন। ছেলেদের সঙ্গে দেখা করার ফুরসত আছে তার আপাতত। ওরা ঢুকে দেখল, লাঞ্চ প্যাকেট খুলছেন তিনি। চিকেন লারসেনের ফ্রাইড চিকেন।
খাবে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
থ্যাংকস, বলে হাত বাড়াল রবিন। তুলে আনল সোনালি মাখন মাখানো এক টুকরো মাংস।
কিশোরের দিকে তাকালেন চীফ। নাও?
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল কিশোর। খামচে ধরেছে চেয়ারের হাতল। যেন বিষ মাখানো খাবার খেতে দেখছে দুজনকে।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন ফ্লেচার। কোন কারণ ছাড়া তো নিশ্চয় আসনি। কি কেস? একটা রান তুলে নিয়ে কামড় বসালেন তিনি। চিবাতে লাগলেন। আরাম করে।
জুন লারসেনের অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে জানতে এলাম, জবাব দিল কিশোর।
ওতে কোন রহস্য নেই, মুখ ভর্তি মুরগীর মাংস নিয়ে কথা বলায় স্পষ্ট হচ্ছে না কথা। কাজেই গিলে নিলেন চীফ। বৃষ্টির মধ্যে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। পাহাড়ী পথে এরপর যা হবার তাই হয়েছে।
অস্বাভাবিক কিছু নেই এর মধ্যে?
দুটো প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে। তবে অনেক দুর্ঘটনার বেলাতেই এটা ঘটে। অপরিচিত একজন ফোন করে খবরটা দিল। ওই লোকটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা। অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটতে দেখে থাকতে পারে। তাতে কোন রহস্য নেই। কিন্তু নাম বলল না কেন? আরেকটা ব্যাপার। দুই সেট চাকার দাগ ছিল। একসেট জুনের গাড়ির। সোজা রাস্তা থেকে নেমে গেছে। আরেকটা সেট ছিল তার পাশে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, তার কাছ থেকে আরও খানিকটা নিচে নেমে গেছে।
কি ঘটেছিল, অনুমান করার চেষ্টা করল কিশোর। দুটো গাড়ি আসছিল। একটা আগে, আরেকটা পেছনে। একটা জুনের গাড়ি। অন্যটা কার? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করল সে। ভিন্ন একটা দৃশ্য ফুটতে শুরু করেছে মনের পর্দায়। স্যার, ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল সে, যেন নিজেকেই বোঝাল। একটা সম্ভাবনার কথা কি ভেবেছেন আপনি? এমনও তো হতে পারে, জুন লারসেনকে তাড়া করেছিল কেউ?
৩
তাড়া করেছিল? কোল্ড ড্রিংকের গ্লাসটা তুলে নিয়েছিলেন চীফ, আস্তে করে নামিয়ে রাখলেন আবার সেটা। কি ভাবছ তুমি, কিশোর, বলো তো? অতি কল্পনা করছ না তো?
একটা সম্ভাবনার কথা বললাম, স্যার, হতেই তো পারে, সামনে ঝুঁকল কিশোর। ধরুন, পাহাড়ী পথ ধরে নামছেন আপনি। জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আপনার সামনের গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছলে গেল। রাস্তা থেকে সরে গিয়ে পড়তে শুরু করল। আপনি তখন কি করবেন?
চীফ বলার আগেই বলে উঠল রবিন, অবশ্যই ব্রেক করব, যত জোরে পারি। থামানোর চেষ্টা করব আমার গাড়িটা। স্কিড করে যতটা যাওয়ার যাবে গাড়ি, তারপর থেমে যাবে।
যেখানে দ্বিতীয় সেট চাকার দাগ দেখেছি সেখানে, রবিনের সঙ্গে একমত হলেন চীফ।
তারপর কি করবে? রবিনকে প্রশ্ন করল কিশোর।
তারপর পিছিয়ে নিয়ে যাব আমার গাড়িটাকে। যাতে ওটাও আগেরটার মত পিছলে পড়তে না পারে এবং তারপর যাব আগের গাড়িটার কি অবস্থা হয়েছে, লোকজন বেঁচে আছে কিনা দেখার জন্যে।
ঠিক তাই, সন্তুষ্টির হাসি হাসল কিশোর। দ্বিতীয় গাড়িটা কি তা করেছে? সাহায্য করতে গেছে জুনকে? বেঁচে আছে কিনা অন্তত সেটুকু দেখার চেষ্টা কি করেছে?
না, স্বীকার করলেন চীফ। যা প্রমাণ পেয়েছি, তাতে ওরকম কিছু করেনি। পথের পাশে নরম মাটি ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল। ওখানে চাকার দাগ পাইনি। জুতোর দাগ পাইনি। কেউ নামলে জুতোর দাগ পড়তই। আমার বিশ্বাস, প্রথম গাড়িটাকে পড়তে দেখে গাড়ি থামিয়েছিল বটে দ্বিতীয় গাড়িটা, তবে চুপ করে বসে ছিল ওটার আরোহী।
তাহলে কে সেই মানুষ? কিশোরের প্রশ্ন। যে একটা গাড়িকে পড়ে যেতে দেখেও সাহায্যের হাত বাড়ায়নি? বেচারা ড্রাইভারের কি হলো, তা পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করেনি? নিজেই জবাব দিল প্রশ্নগুলোর, হতে পারে, সেই লোক জুন লারসেনকে তাড়া করেছিল। গাড়িটা পড়ে যাওয়ায় খুশিই হয়েছিল। মেয়েটা মরেছে না বেঁচে আছে সেটা দেখারও প্রয়োজন বোধ করেনি।
ভাল বলেছ, চীফ বললেন। তথ্য-প্রমাণ কিছু দেখাতে পারবে?
সেই চেষ্টাই করব, উঠে দাঁড়াল কিশোর। দেখি, বের করতে পারি কিনা। রবিন, এসো।
দরজার কাছে যাওয়ার আগেই ওদেরকে ডাকলেন চীফ। বেশি কষ্ট করার দরকার নেই। জুন বেঁচেই আছে। ও জেগে গেলেই ওর মুখ থেকে সব শুনতে পারব আমরা।
ঠিকই বলেছেন চীফ। কি ঘটেছে জানার জন্যে তদন্তের প্রয়োজন নেই। কেউ তাকে অনুসরণ করছিল কিনা, হয়তো লক্ষ্য করেছে জুন। আর তাড়া করে থাকলে তো কথাই নেই। এমনও হতে পারে, ঠেলে ফেলে দেয়া হয়েছে ওর গাড়ি। হতে পারে, যে ফেলেছে, সেই লোকই খাবারে বিষ মিশিয়ে লাখ লাখ লোককে মারার ফন্দি করেছে।
সব প্রশ্নের জবাবই হয়তো আছে জুনের ঘুমন্ত মাথায়। এখন শুধু তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা। তারপরই জবাব পেয়ে যাবে তিন গোয়েন্দা।
কিন্তু আসল কথাটা হলো, জাগার পর সত্যি কথাগুলো বলবে তো জুন? যদি তার বাবা এসবে জড়িত থাকেন? বলবে? বাবাকে বাঁচানোর জন্যে মুখ বুজে থাকবে না?
থানা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল দুই গোয়েন্দা। খিদে টের পেল কিশোর। সে কথা বলল রবিনকে।
ভুল করলে তো না খেয়ে, রবিন বলল। ডাক্তার তো কত কথাই বলবে। কত কিছু নিষেধ করবে। সব শুনলে কি চলে?
বলাটা সহজ, মুখ কালো করে বলল কিশোর। পেটের যে কি অবস্থা হয়েছিল আমার, তোমার হলে বুঝতে। কি কষ্টটাই যে করেছি! এখন খাবার দেখলেই বিষ মনে হয় আমার!
পেট যখন আছে, ফুড পয়জনিং হবেই। সবারই হয়। তাই বলে কি খাওয়া ছেড়ে দেব?
তা কি দিয়েছি নাকি? বেছে বেছে খাচ্ছি। আর এতে বেশ ভালই লাগছে আমার। পেটে আর কোন অশান্তি নেই।
আচ্ছা, বাদ দাও ওসব কথা। তোমার যা ইচ্ছে খেয়ো। এখন কি করব, বলো।
কাজ একটাই করার আছে। কোন লোকটা জুনকে ফলো করেছিল, তাকে খুঁজে বের করা। কাল রাতে হাসপাতালে যে তিনজন দেখতে এসেছিল তাদের একজনও হতে পারে।
টম, হেনা, আর মিস্টার এক্স, এই তিনজনের একজন?
হ্যাঁ। হেনরি অগাসটাসের ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে আমাদের, লারসেনের শত্রু যখন। হেডকোয়ার্টারে ফিরে কম্পিউটারেই সেটা করার চেষ্টা করব। জিনিসটা যখন কিনলামই, কাজে লাগাই। ডাটাসার্ভে খোঁজ করে ওদের বিজনেস ফাইলগুলো বের করে নেব। দেখি, হেনরি আর তার রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে কি তথ্য দেয় কম্পিউটার। ওদের ডাটাবেজ হলো দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল। তথ্য জানাতেও পারে।
তুমি তো কম্পিউটার নিয়ে বসবে। আমি…
জানার চেষ্টা করবে, কাল রাতে হাসপাতালে জুনকে দেখতে আসার আগে কোথায় কি করেছে টম।
মাপ চাই। সময় নেই আমার। এজেন্সিতে যেতে হবে।
বেশ। তাহলে মুসাকে ফোন করে বলল, ও-ই চেষ্টা করুক। অহেতুক ফারিহার সঙ্গে বসে বসে বকবক করার চেয়ে একটা কাজ অন্তত করুক।
বেশ। হেনা আর মিস্টার এক্সের ব্যাপারে কি হবে?
হেনার ব্যাপারে আমার মাথাব্যথা নেই, কিশোর বলল। ওর কোন মোটিভ আছে বলে মনে হয় না। তবু, ওকেও একবার ফোন করব সময় করে। আর মিস্টার এক্সকে এভাবে খুঁজে বোধহয় বের করতে পারব না। সে এসবে জড়িত থাকলে এক সময় না এক সময় দেখা আমাদের হয়েই যাবে।
অনেক খিদে পেয়েছে কিশোরের। গুড়গুড় করছে পেটের ভেতর। রবিনকে অনুরোধ করল সুপারমার্কেটে নিয়ে যেতে। কিছু ফল কিনল কিশোর। গাড়িতে এসে বসে খেতে শুরু করল। ইয়ার্ডের দিকে গাড়ি চালাল রবিন। কিশোরকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তার কাজে। অফিসে গিয়ে মুসাকে ফোন করে জানাল কিশোর কি করতে বলেছে।
বিশেষ গুরুত্ব দিল না মুসা। কাজেই ফারিহার কাছ থেকে উঠতে উঠতে অন্ধকার হয়ে গেল। তখন আর টমের ঠিকানা খুঁজে বের করার সময় নেই। অত অন্ধকারে কে একটা গোবেচারা বয়ফ্রেন্ডের ঠিকানা খোঁজার মত ফালতু কাজ করতে যায়? রোববারের আগে আর কাজটা করতে পারল না মুসা। গাড়ি এনে রাখল লরেল স্ট্রীটে, ২৮ নম্বর বাড়ির সামনে, যেখানে বাস করে টমাস হামবার।
রকি বীচের কয়েক মাইল উত্তরে মেলটনের শান্ত সুন্দর পরিবেশে বাড়িটা। পথের পাশে একসারি সাদা কাঠের বাড়ি। সামনে চওড়া বারান্দা আর ছোট আঙিনা।
টমাসদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরানো বনেভিল কনভারটিবল গাড়ি। বারান্দার রেলিঙের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে সোনালি চুলওয়ালা এক তরুণ। পরনে রঙচটা নীল জিনস, গায়ে সাদা টি-শার্ট। মুসা আঙিনায় ঢুকতেই লাফ দিয়ে রেলিং থেকে নামল সে।
এসো! চিৎকার করে ডাকল সে। এক হাত সামনে বাড়ানো, আরেক হাত পিঠের পেছনে। দিনটা মাটি হতে বসেছিল আমার! তুমি আসাতে সেটা আর হলো না! মুসা বারান্দার কাছাকাছি যেতেই পেছনের হাতটা সামনে চলে এল। শক্ত করে ধরা একটা মোটর সাইকেলের চেন।
ব্যাপার কি? গতি বেড়ে গেল মূসার হৃৎপিন্ডের। হঠাৎ করে, কোন কারণ ছাড়াই একটা উন্মাদ হামলা করতে আসছে কেন তাকে! চেনের একটা মাথা হাতে পেঁচানো, আরেক মাথা ঝুলছে সাপের লেজের মত। স্থির হয়ে গেছে মুসা। কারাতের কৌশল ব্যবহার করবে? না পিছিয়ে যাবে?
এবার শুধু তুমি আর আমি, লোকটা বলল। এই তো চেয়েছিলে, তাই না? বলেই শপাং করে বাড়ি মারল কাঠের রেলিঙে।
না, কারাতের কথা ভুলে যাওয়াই উচিত। ওই চেনের এক বাড়ি মাথায় লাগলে সাতদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে। পিছাতে শুরু করল সে।
শিক্ষা আজ ভাল করেই দিয়ে দেব! চিৎকার করে উঠল আবার লোকটা। লাফিয়ে বারান্দা থেকে আঙিনায় নামল। বেশি বড় শরীর না। অর্থাৎ গায়েগতরে মুসার চেয়ে ছোট খাটোও, স্বাস্থ্যও খারাপ। কিন্তু চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে, আর মাথার ওপরে তুলে বনবন করে ঘোরাচ্ছে চেনটা।
আপনি ভুল করছেন, মুসা বলল। সে পিছাচ্ছে আর লোকটা এগোচ্ছে। লোকটার পায়ে চামড়ার বুট। গরিলার মত বাঁকা করে রেখেছে কাঁধ।
আপনি কি ভাবছেন বুঝতে পারছি না, মুসা বলল আবার। আমি এসেছি টমাস হামবারের খোঁজে, মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। আমি জুন লারসেনের বন্ধু।
থমকে গেল কালো বুট। থেমে গেল চেনের পাক।
সত্যি বলছ? লোকটা বলল।
কসম, মাথা ঝাকাল মুসা। সতর্ক রয়েছে। লোকটা হঠাৎ আক্রমণ চালালে যাতে ঠেকাতে পারে।
সরি, চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফোস করে ছাড়ল লোকটা। ঢিল হয়ে গেল যেন সমস্ত শরীর। আমিই টমাস হামবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে আমাকে। চুরি করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে ওরা। ভবঘুরে। একটা লোক তো শাসিয়েই গেছে সুযোগ পেলেই আমার গাড়িটা চুরি করে নিয়ে যাবে।
রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা ঝরঝরে বনেভিলটা দেখাল টম।
ওটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। অবশেষে হেসে রসিকতা করল, এমনিতেই ওটা দিয়ে দেয়া উচিত। হাহ, হাহ! চাকা তো বসে গেছে। আর যে হারে তেল লিক করছে…
ব্যাটারিও ডাউন হয়ে আছে দুই হপ্তা ধরে, যোগ করল টম। হাসছে সে-ও। তবু, ওদেরকে নিতে দেব কেন? কেড়ে রেখেছি অনেক কষ্টে। ব্যাটারা হাড়-মাংস জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার। কি বলছি বুঝতে পারছ? বারান্দার রেলিঙের দিকে চোখ পড়তে বলল, রেলিংটারই সর্বনাশ করলাম!…হ্যাঁ, জুনের সঙ্গে কি করে পরিচয় হলো তোমার, বলো তো?
আসলে, পরিচয় হয়নি এখনও, সত্যি কথাটাই বলল মুসা। আমার বান্ধবী আর ও একই রুমে রয়েছে হাসপাতালে।
ও, হ্যাঁ, দেখেছি একটা মেয়েকে, মুসাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে এল টম। চেন ঘোরাচ্ছে না। রাগও দূর হয়ে গেছে চেহারা থেকে। ওকে দেখতে আর ভয়ঙ্কর লাগছে না তখনকার মত। বরং ভদ্র, শান্ত একজন কলেজের ছাত্রের মতই লাগছে। ভেতরে আসবাবপত্রের চেয়ে পোস্টারই বেশি।
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম, মুসা বলল। শুক্রবার রাতে অত দেরি করে হাসপাতালে গিয়েছিলেন কেন?
খবরটাই পেয়েছি দেরিতে। জুনের রুমমেট হেনা ফোন করে আমাকে জানাল জুন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কয়েক মাস হলো ওর সঙ্গে আর ততটা দেখা হয় না, ঘনিষ্ঠতা নেই। তবু, একসময় তো ছিল, সেই সুবাদেই গেলাম দেখতে। হুঁশ ফিরেছে ওর?
না। বেহুশ ঠিক বলা যায় না, নার্স তাই বলল। গভীর ঘুম বলা যেতে পারে। ডাক্তারের কথা, অনেক বেশি ঘুম দরকার এখন ওর।
একটা মুহূর্ত আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল টম। হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল, যার সঙ্গে কথা বলছে সে পুরোপুরি অপরিচিত তার। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, জুনকে যদি না-ই চেননা, তাহলে এসব প্রশ্ন করছ কেন?
ফারিহা, আমার গার্লফ্রেন্ড বলল, অদ্ভুত একটা কিছু ঘটছে। সেটারই তদন্ত করছি। চিকেন হার্বার্ট লারসেনকে চেনেন?
তাকে চিনব না। জুনের সঙ্গে আমার গোলমালটা বাধানোর জন্যে সে-ই তো দায়ী।
মানে? আপনাকে পছন্দ করতেন না তিনি?
কি করে করবে? সারাক্ষণই তর্ক বেধে থাকলে কি আর পছন্দ করে কেউ? আমি নিরামিষ ভোজী। মাছ খাই না, মাংস খাই না, মুরগীও ভাল লাগে না। খাবার জন্যে প্রাণী হত্যা আমার মতে অপরাধ। আর বেচারা প্রাণীগুলোকে খুন করে যারা ব্যবসা করে তারা তো রীতিমত অমানুষ। লাগত এসব নিয়েই। শেষ দিকে তো আমাকে দেখলেই জ্বলে উঠত লারসেন। আস্তে আস্তে এসব নিয়ে জুনের সঙ্গেও কথা কাটাকাটি শুরু হলো আমার। শেষে যখন বলল, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাপের ব্যবসা দেখবে জুন, ব্যস, হয়ে গেল সব খতম। কাটাকাটি।
আরেকটা কথা। ভোর রাত চারটের সময় আপনি হাসপাতালে ঢুকলেন কি করে? ঢুকতে দিল?
নার্সকে মিথ্যে বলেছি আমি। বলেছি, জুনের সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছে, এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল টম। কথাটা সত্যি হলে খুশিই হতাম।
শেষ বিকেলে রবিন আর কিশোরকে তদন্তের ফলাফল জানাল মুসা। স্যালভিজ ইয়ার্ডে রয়েছে তিনজনে। রবিনের ফোক্সওয়াগনের ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে সে। কিছু জিনিস খারাপ হয়েছে, যার ফলে গোলমাল করছে ইঞ্জিন, সেটাই দেখছে আর কথা বলছে। ফ্যান বেল্টটা প্রায় বাতিল হয়ে গেছে। বদলানো দরকার। পুরানো বাতিল মালের অভাব নেই ইয়ার্ডে। অন্য একটা ইঞ্জিনের বেল্ট খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছে মুসা। লাগিয়ে দিয়ে দেখল চলে কিনা। চলছে। অন্তত আগেরটার চেয়ে ভাল। আঙুল দিয়ে টেনেটুনে দেখে বলল, শ দুই মাইল চালাতে পারবে। তারপর ঢিল হয়ে যাবে। রবিন, নতুন একটা কিনে নিয়ো।
ওসব ফ্যান বেল্টের কথার ধার দিয়েও গেল না এখন কিশোর। বলল, আমার কাছে সব চেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে যে ব্যাপারটা, তা হলো, টমের একটা গাড়ি আছে।
কিশোর, রবিন বলল। মাঝে মাঝে এত দুর্বোধ্য লাগে না তোমার কথা, কি বলব! মুসা বলছে এক কথা, তুমি চলে গেলে আরেক কথায়। কেন, কারও গাড়ি থাকতে পারে না?
মাথায় কথা রাখতে পারো না, সে জন্যেই তোমাদের কাছে এত কঠিন লাগে। কেন, ভুলে গেলে, জুনের গাড়িটাকে তাড়া করেছিল আরেকটা গাড়ি?
টমকে বাদ দিয়ে রাখতে পারো। ওর গাড়িটার চলারই ক্ষমতা নেই। টায়ারগুলো বসা। ব্যাটারি ডাউন হয়ে আছে দুই হপ্তা ধরে।
সত্যি কথা না-ও তো বলতে পারে?
বলেছে, জোর দিয়ে বলল মুসা। কারণ আমারও সন্দেহ হয়েছিল। তাই ওর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেছি।
ও। তার পরেও আরেকটা ব্যাপার বাকি থেকে যায়। লোকটার মেজাজ ভীষণ খারাপ। তোমাকে যে চেন নিয়ে মারতে এসেছিল, সেটাই তার প্রমাণ।
শ্রাগ করল মুসা। ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসল। ইঞ্জিনের থ্রটল পরীক্ষা করার জন্যে ইগনিশনে মোচড় দিল। মিনিট খানেক ঠিকমতই গুঞ্জন করল ইঞ্জিন, তারপরে বিচিত্র একটা শব্দ করল, মনে হলো বলছেঃ প্লা-হুপ্পা-গ্যাক!
এ রকম করছে কেন? রবিনের প্রশ্ন। হেসে বলল, ইঞ্জিনটাকে জিজ্ঞেস করো তো, এ কথার মানে কি?
বলতে চায়, আমাকে কিনে ভুল করেছ। বেচে দিয়ে আরেকটা কেন। আমি বুড়ো মানুষ, আর পারি না।
অনুরোধ করো না, আর কটা দিন যেন আমাকে একটু সাহায্য করে। আর কিছু পয়সা জমিয়ে নিই। ওকে মুক্তি দিয়ে দেব।
চেষ্টা করলে কিছুটা ভাল হয়তো করা যায়, মুসা বলল। তবে সময় লাগবে। আপাতত এভাবেই চালাও আগামী হপ্তায় দেখি। তার পর? আমার কথা তো বললাম। কিশোর, হেনা তানজামিলা আর হেনরি অগাসটাসের খবর কি?
হাসল কিশোর। হেনাকে ফোন করেছিলাম। অ্যাক্সিডেন্টটা যখন হয়, তখন আরও ছজন লোকের সঙ্গে এলিভেটরে আটকা পড়েছিল। চমৎকার অ্যালিবাই। তবে হেনরি অগাসটাসের ব্যাপারটা চমকে দেয়ার মত। ব্যবসায়ে চিকেন লারসেনের সব চেয়ে বড় প্রতিপক্ষ সে। দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল বলছে, এই কিছুদিন আগে চিকেনের পুরো ব্যবসাটা কিনে নিতে চেয়েছিল হেনরি।
তাই? আশ্চর্য! অবাক হলো রবিন। তাহলে তো রাস্তা থেকে ফেলার কথা লারসেনকে। তার মেয়েকে ফেলতে যাবে কেন?
জানি না, গাল চুলকাল কিশোর। অন্য ভাবে শাস্তি দিতে চেয়েছে হয়তো লারসেনকে। কিংবা ওর মেয়েকে মেরে ফেলে মন ভেঙে দিতে চেয়েছে। যাতে ব্যবসা নিয়ে আর মাথা না ঘামায় লারসেন।
লারসেনের মুরগীতে হেনরিই বিষ মেশাচ্ছে না তো?
না-ও হতে পারে। চিকেন নিজেই মেশাতে পারে। আর আরেকজন চরম সন্দেহভাজন লোক তো রয়েই গেছে। সেই লোকটা, যে হাসপাতালে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করেছিল। ফারিহাকে নাম বলেনি।
এই সময় হেডকোয়ার্টারে ফোন বাজতে আরম্ভ করল। ধরতে গেল মুসা।
তিন গোয়েন্দা। মুসা আমান বলছি, স্পীকারের সুইচ অন করে দিল সে।
ফারিহা ফোন করেছে হাসপাতাল থেকে। মাত্র তিনটে শব্দ উচ্চারণ করল সে। আর তা-ই তিন গোয়েন্দাকে গাড়ির দিকে ছুটে যেতে বাধ্য করার জন্যে যথেষ্ট। সে বলেছে, জুনের ঘুম ভেঙেছে!
৪
রবিনের ফোক্সওয়াগনে করে হাসপাতালে ছুটল তিন গোয়েন্দা। ভটভট ভটভট করে কোনমতে চলল গাড়ি। যতটা স্পীড দেয়া সম্ভব দেয়ার চেষ্টা করল রবিন। পথে তিনবার বন্ধ হলো ইঞ্জিন। নেমে নেমে ঠিক করতে হলো মুসাকে।
হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল কিশোর। দিল দৌড়। তার পেছনে ছুটল অন্য দুজন। অ্যাক্সিডেন্টের রাতে কি ঘটেছিল, আজ জানতে পারবে জুনের মুখ থেকে।
অ্যাই, যাচ্ছ কোথায়! থাম!
তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। সেই লাল চুল নার্স, মারগারেট ইলারসন।
সরি, যেতে পারবে না, আজ আর কর্কশ ব্যবহার করল না। হাসলও মৃদু। মেয়ের সঙ্গে রয়েছেন মিস্টার লারসেন। ডাক্তার পরীক্ষা করছেন জুনকে। তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে, রবিনের দিকে তাকাল। খারাপ না লাগলে আমার এখানেই এসে বসতে পারো।
হলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। পাঁচ মিনিট কাটতেই যেন পাঁচটা বছর লাগল। তারপর দশ মিনিট। এই অপেক্ষা যেন পাগল করে দেবে তাকে।
আর বসে থাকতে পারল না। এককোণে নিচু একটা টেবিলে কিছু পত্রপত্রিকা পড়ে আছে। এগিয়ে গেল সেগুলোর দিকে।
এত তাড়া কিসের তোমাদের? নার্স জিজ্ঞেস করল।
আছে। অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে জানতে চাই, ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল কিশোর।
কিছুই বলতে পারবে না ও। মনে করতে পারবে না। অ্যামনেশিয়ায় ভূগছে।
অ্যামনেশিয়া! ওই একটি শব্দই যেন হাজার টনী পাথরের মত আঘাত করল কিশোরকে। এত আশা, এত প্রতীক্ষা, সব যেন নিমেষে অর্থহীন হয়ে গেল।
অবশেষে জুনের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন লারসেন। বাইরে এলেন না, দরজায়ই দাঁড়ালেন। পরনে গাঢ় লাল জগিং স্যুট, হলুদ স্ট্রাইপ দেয়া। বুকের কাছে আঁকা কমলা রঙের মুরগী।
যাই, হ্যাঁ, মেয়েকেই বললেন বোঝা গেল। কাল আবার আসব। বাড়ি নিয়ে যাব তোকে। কিছু ভাবিসনে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হেসে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন লারসেন। হাসিটা মুছে গেল পরক্ষণেই। আনমনে বিড়বিড় করে কি বললেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যেই বোধহয় হাসি হাসি করে রেখেছিলেন মুখ। তিন গোয়েন্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটিবারের জন্যেও ফিরে তাকালেন না।
কি বলছেন শুনতে পারলে হত, নিচু গলায় বলল মুসা।
কি যে করি জাতীয় কিছু বললেন বলে মনে হলো, আন্দাজ করল রবিন।
চলো, জুনের ঘরের দরজার দিকে রওনা হলো কিশোর।
বিছানায় উঠে বসেছে জুন। বয়েস উনিশ-বিশ হবে। পিঠে বালিশ ঠেস দেয়া। এলোমেলো চুল। অনেক সময় একটানা ঘুমানোয় ফুলে আছে মুখ। তবে বড় বড় নীল চোখজোড়া স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার।
এসেছ, মুসার দিকে তাকিয়ে যেন ওই একটি শব্দেই হুঁশিয়ার করে দিতে চাইল ফারিহা। রবিন আর কিশোরও বুঝল ওর ইঙ্গিত। জুনের দিকে ফিরল সে, জুন, এই হলো আমাদের তিন গোয়েন্দা। ও কিশোর পাশা, ও মুসা আমান, আর ও হলো রবিন মিলফোর্ড।
হাই, খসখসে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল জুন। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি।
হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন, এখন কেমন লাগছে?
আর কেমন। মনে হচ্ছে দালানের তলায় চাপা পড়েছিলাম। একটা হাড়ও আস্ত নেই। সারা গায়ে ব্যথা। বাবা যে কাল কি করে বাড়ি নিয়ে যাবে কে জানে।
ও কিছু না। ঠিকই যেতে পারবে। কাল সেরে যাবে, দেখ।
এসব কথা ভাল লাগছে না কিশোরের। আসল কথায় যেতে চায়। কিছুটা অধৈর্য ভঙ্গিতেই ফারিহার বিছানার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে বসল জুনের বিছানার পাশে। তোমার অ্যাক্সিডেন্টটার কথা জানতে এসেছিলাম।
ফারিহা বলেছে, তোমরা আসবে। তবে আগেই একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার অ্যামনেশিয়া হয়েছে।
কিছুই মনে করতে পারছ না?
শেষ কথা মনে করতে পারছি, দুদিন আগে সকালে আমার বেড়ালটাকে, খাইয়ে বাবার অফিসে গিয়েছিলাম। আর কিছু মনে নেই। তবে ডাক্তার ভরসা দিয়েছে এই স্মৃতিবিভ্রম সাময়িক। শীঘ্রি আবার সব মনে করতে পারব। যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে স্মৃতি।
আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি, রবিন বলল। অনেক সময় কথা মনে করিয়ে দিলে মনে পড়ে যায় এসব অবস্থায়।
তাহলে অ্যাক্সিডেন্টের কথা কিছুই মনে করতে পারছ না? কিশোর তাকিয়ে রয়েছে জুনের মুখের দিকে। তোমার বাবার অফিসে কি জন্যে গিয়েছিলে?
কলেজ থেকে সবে ব্যবসার ওপর ডিগ্রী নিয়েছি, জুন জানাল। তাই বাবার ব্যবসাটায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এক ডিপার্টমেন্ট থেকে আরেক ডিপার্টমেন্টে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করছি। যতই বই পড়ে শিখে আসি না কেন, হাতে কলমে কাজ করাটা অন্য জিনিস।
গত শুক্রবারে শেষ কোন ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছিলে, কিশোর জিজ্ঞেস করল, মনে করতে পারো?
না।
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে কিছু কথা বলেছ। মনে করতে পারো?
মাথা নাড়ল জুন।
রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, চলো, বাইরে গিয়েই কথা বলি।
হলে বেরিয়ে এল তিনজনে। ভোতা গলায় কিশোর বলল, কোন লাভ হলো না।
ফারিহা আশা দিয়েছে, মুসা বলল। হবে।
হবে না। বসে বসে টেলিভিশন দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না ওর।
আমার তো এখন মনে হচ্ছে, কোন রহস্যই নেই, নিরাশ কণ্ঠে বলল কিশোর। ফারিহার কথাই আর বিশ্বাস করতে পারছি না।
ও এমনিতেও বাড়িয়ে কথা বলে, ফস করে বলে বসল রবিন।
রেগে গেল মুসা। ওর মাথায় আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি। কথা খুব ভাল মনে রাখতে পারে। কয়েক মাস আগেও কোন মেয়ে কোন পোশাকটা পরেছিল, কোন লিপস্টিক লাগিয়েছিল, ঠিক বলে দিতে পারে।
খুব ভাল, আরেক দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। যদি কোনদিন তিন গোয়েন্দা বাদ দিয়ে তিন ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে যাই, তাহলে ওকে আমাদের সহকারী করে নেব।
ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল মুসা।
রাগ কোরো না, ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। জুন একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। মাথায় গোলমাল হওয়াটা স্বাভাবিক। ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকাটা আরও বেশি স্বাভাবিক। এখন তো ধরেছে অ্যামনেশিয়ায়। ওর প্রলাপ বিশ্বাস করে রহস্য খুঁজতে যাওয়াটা কি ঠিক?
কেন, তোমার অনুভূতি কি এখন অন্য কথা বলছে…
অ্যাই, রাখ রাখ, হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেছে রবিন। একটা কথা…
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল কিশোর। কী?
একটা কথা খেয়াল করোনি? অ্যাক্সিডেন্টের দিনের কথা শুধু মনে করতে পারছে না জুন। কেন পারছে না? কেন একটা দিন স্মৃতি থেকে মুছে গেল?
তাই তো! ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগল কিশোর। তবে মনোযোগ দিতে পারল না। চেঁচিয়ে কথা বলছে নার্স মারগারেট, আমার কাজ আপনি করবেন? হাসালেন। এক ঘণ্টায়ই কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে আরম্ভ করবে। কানে রিসিভার ঠেকিয়ে মাথা কাত করে কাঁধ উঁচু করে রিসিভারটা ধরে রেখেছে সে। দুই হাত মুক্ত রেখেছে কাজ করার জন্যে। কিছু ফর্মে স্ট্যাম্প দিয়ে সীল মারছে। আপনি আমাকে বিরক্ত করে ফেলেছেন, বুঝলেন। আধ ঘণ্টা পর পরই জিজ্ঞেস করছেন জুন কেমন আছে। আরও তিরিশজন রোগী আছে এখন আমার হাতে। সবার আত্মীয়রাই যদি এভাবে ফোন করত, এতক্ষণে পাগলা গারদে পাঠাতে হত আমাকে। কেমন আছে জানতে চাইছেন তো? বলতে পারব না। হাসপাতালে এসে দেখে যান।
রেগে গেছে মারগারেট। চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়। ওপাশের কথা শুনতে শুনতে আরও রেগে গেল, ডাক্তারকেই জিজ্ঞেস করুন। ধরুন। খটাস করে রিসিভারটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গটমট করে হেঁটে রওনা হলো।
জুন কেমন আছে, এবার জিজ্ঞেস করছে কেন? দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল কিশোর।
কারণ, বেশি উদ্বিগ্ন, জবাব দিল মুসা।
উদ্বেগটা কি জুনের অসুখের কারণে? না সে মুখ খুলেছে কিনা জানার জন্যে? কেশে গলা পরিষ্কার করল কিশোর। মিস্টার এক্সও হতে পারে।
এক কাজ করো না, পরামর্শ দিল রবিন। গলার স্বর তো নকল করতেই পার। কথা বলো ওর সঙ্গে। লোকটার কণ্ঠস্বর চিনে রাখো। ডাক্তার হয়ে যাও।
ঠিক বলেছ। দুই লাফে টেবিলের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল নার্স আসছে কিনা। তারপর রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বলল, হ্যালো, ডক্টর পাশা বলছি। হঠাৎ করেই যেন অনেক বেড়ে গেছে তার বয়েস, ভারি হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর, কারও বাবারও বোঝার সাধ্যি নেই, তার বয়েস চল্লিশের কম।
কই, এ নাম তো শুনিনি? ওপাশ থেকে জবাব এল। মসৃণ কণ্ঠ। মাঝবয়েসী একজন মানুষ। দ্রুত কথা বলে। এ হাসপাতালে ওই নামের ডাক্তার আছে?
তাহলে আমি এলাম কোথেকে? নতুন এসেছি। আপনি জুন লারসেনের খোঁজ নিতে চাইছিলেন তো মিস্টার…
কিশোর আশা করেছে, নামটা বলবে লোকটা। বলল না। জিজ্ঞেস করল, ও কেমন আছে?
ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া এ খবর কাউকে জানানো নিষেধ। আপনি ওর কে হন?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জবাব দিল লোকটা, আমি ওদের পারিবারিক বন্ধু।
ঘনিষ্ঠ?
দেখুন, এত প্রশ্ন করছেন কেন? আমি একটা সহজ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, জুন কেমন আছে?
হুঁশ ফিরেছে। বিপদ কেটেছে।
ও, লোকটা খুশি হয়েছে না শঙ্কিত হয়েছে বোঝা গেল না ঠিকমত। তবে উদ্বিগ্ন হয়েছে বলে মনে হলো কিশোরের। জিজ্ঞেস করল, কিছু বলতে হবে জুনকে? কি নাম বলব?
না, কিছু বলতে হবে না, ডক্টর। থ্যাঙ্ক ইউ, লাইন কেটে গেল ওপাশ থেকে।
কি বলল? কিশোরকে চুপ হয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল মুসা।
তেমন কিছুই বলল না, আস্তে করে রিসিভারটা ডেস্কে রেখে দিল আবার কিশোর।
তরুণ একজন ডাক্তারকে নিয়ে ফিরে এল নার্স। রিসিভার কানে ঠেকিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলল। রেখে দিয়েছে! লোকটার মাথা খারাপ!
দুই সহকারীকে নিয়ে সরে এল কিশোর। নিচু গলায় বলল, নাহ, রহস্য একটা আছে, মানতেই হচ্ছে। কিছু একটা ঘটছে! কি, সেটাই বুঝতে পারছি না!
তার মানে কেসটা ছাড়ছ না? হেসে বলল রবিন। আরেকটু হলেই হতাশ করেছিলে আমাকে। কোন রহস্যের সমাধান না করে ছেড়ে দেবে কিশোর পাশা, ভাবাই যায় না।
ছাড়ব একবারও বলিনি। মনে হয়েছিল, কোন রহস্য নেই। এখন ভাবছি, ভয়ানক কোন বিপদ ঝুলছে জুনের মাথার ওপর। সেটা জানতে হবে যে, ভাবেই হোক। ওর কাছাকাছি থাকতে হবে আমাদের।
তবে থাকাটা সম্ভব হলো না। তিনজনেরই কিছু না কিছু কাজ আছে। বসে থাকে না ওরা কেউই। মুসা আবার গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছে। তবে গাড়ি বেচাকেনার চেয়ে মেরামতের দিকেই নজর দিয়েছে বেশি। নিক ওকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে ইঞ্জিনের ব্যাপারে (গাড়ির জাদুকর দ্রষ্টব্য)। ওর পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের করভেট গাড়িটার ইগনিশন নাকি ঠিকমত কাজ করছে না, মেরামত করে দেবে কথা দিয়েছে সে। বিনিময়ে অবশ্যই পারিশ্রমিক নেবে।
রবিনকে যেতে হবে ট্যালেন্ট এজেন্সিতে। একটা ক্লাব একটা রক ব্যান্ড চেয়ে পাঠিয়েছে। সেটা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আর কিশোর কথা দিয়েছে মেরিচাচীকে, পাশের বাড়ির মিসেস ব্যালানটাইনকে বাগানের ঘাস কাটায় সাহায্য করবে। মিসেস ব্যালানটাইন মেরিচাচীর বান্ধবী। কিশোর আগ্রহী হয়েছে অবশ্য অন্য কারণে। ওই মহিলারও পেটের চিরকালীন অসুখ আছে। কি কি খেলে ভাল থাকেন, বলতে পারবেন কিশোরকে।
কাজেই সেদিন আর জুনের কাছে থাকা হলো না কারোরই।
পরদিন সকালে হাসপাতালে মুসার সঙ্গে দেখা হলো কিশোরের। আগেই এসে বসে আছে মুসা। কারণ, ফারিহাকে সেদিন ছেড়ে দেয়ার কথা। আর জুনের বাবা বলেছেন, মেয়েকে এসে নিয়ে যাবেন সেদিনই।
হাসপাতাল ছাড়তে নারাজ ফারিহা। কারণ, জুনের প্রলাপ রহস্য ভেদ করার প্রবল আগ্রহ। কিন্তু থেকেও লাভ নেই। জুন তো আর থাকছে না। তাছাড়া ভাল হয়ে গেলে হাসপাতালই বা ওদেরকে রাখবে কেন?
জুনের শরীর অনেক ভাল হয়েছে। তবে স্মৃতি ফিরে আসেনি। বিছানায় বালিশ ঠেস দিয়ে বসে বাবার আসার অপেক্ষা করছে সে। বকবক করছে, বাবাকে তো চিনি। আসবে সেই জগিং স্যুট পরেই। আজ হয়তো দেখা যাবে গরিলা সেজেই এসেছে। ওরকম রোমশ পোশাকও অনেক আছে তার। ব্যান্ড পার্টি না নিয়ে এলেই বাঁচি। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি করা স্বভাব।
দশ মিনিট পর দরজায় দেখা দিলেন লারসেন। হাই, খুকি, চিনতে পারছ আমাকে? হেসে জিজ্ঞেস করলেন। বাদামী জগিং স্যুট পরেছেন। একটা প্লাস্টিকের তীর ঢুকিয়ে রেখেছেন চুলের মধ্যে। ওই লোকটাও পাগল, মনে হলো মুসার।
বাবা, জুন বলল। না চেনার কোন কারণ নেই। মাত্র চব্বিশটা ঘণ্টা মনে করতে পারছি না আমি। বিশ বছর নয়। নিশ্চয় চিনতে পারছি তোমাকে। যা আনতে বলেছিলাম এনেছ?
হাতে করে একটা ছোট সুটকেস নিয়ে এসেছেন লারসেন। মেয়ের সামনে এনে রাখলে সেটা। খুলল জুন। নীল সিল্কের একটা পাজামা বের করে তুলে ধরে বলল, এটা কি?
কি আবার, পাজামা, হাসি হাসি গলায় বললেন লারসেন। নীল ব্লাউজটাও নিয়ে এসেছি। দেখ। এগুলো আনতেই তো বলেছিলি, নাকি?
যেটাতে বলেছিলাম সেটাতে খোঁজোনি, হেসে বলল জুন। অন্য ওয়ারড্রোব থেকে এনেছ। এই কাপড় পরে বাইরে বেরোনো যায়? তুমিই বলো?
চোখের সানগ্লাসটা ঠেলে কপালে তুলে দিলেন লারসেন। মেয়ের হাত থেকে নিলেন পাজামাটা। কেন, পরা যাবে না কেন? এ জিনিস পরে পার্টিতেও যেতে পারিস। স্বচ্ছন্দে। খারাপটা কি দেখলি?
মা বেঁচে থাকলে তোমার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারত এখন। এ জিনিস পরে বাইরেই বেরোয় না মেয়েরা। আর পার্টিতে যাওয়া!
কেন, অসুবিধেটা কি? শরীর ঢাকা থাকলেই হলো, বলতে বলতে ফারিহার দিকে চোখ পড়ল লারসেনের। তুড়ি বাজিয়ে বললেন, ব্যস, মিটে গেল ঝামেলা। ওর একটা কাপড় পরে নিলে পারিস। এই মেয়ে, একশো পনেরো হবে না তোমার ওজন?
থ হয়ে গেল ফারিহা। আপনি জানলেন কি করে?
জানব না মানে? তিরিশ গজ দূর থেকেও যে-কোন মুরগী দেখলে বলে দিতে পারি ওটার ওজন। আর তুমি তো মানুষ। তোমার পোশাক জুনের লাগবেই। একই গড়ন।
বাবা, অস্বস্তি বোধ করছে জুন। চুপ করো তো। ফারিহা, কিছু মনে কোরো না। বাবার ধারণা, দুনিয়ার সবাই এক। কেউ কিছু মনে করে না, আবার বাবার দিকে ফিরল। বাবা, এটা তোমার অফিসের ইন্টারকমের বোতাম নয়, যে টিপে যা বলবে তাই হয়ে যাবে।
আমি কিছু মনে করিনি, হেসে বলল ফারিহা। নাও না। লাগলে নাও আমার একটা কাপড়। অনেক আছে স্যুটকেসে। পরে ফেরত দিয়ে দিয়ো।
আচ্ছাহ! হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন জুন। তার বাবার আনা পোশাকগুলো পরে বেরোনোর কথা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তার। স্যুটকেসের ডালা বন্ধ করল। কিছু মেকআপও ধার দিতে হবে। পারবে? আমার আব্বাজান আমার মেকআপ বক্সটা আনতেও ভুলে গেছেন, নেমে পড়ল বিছানা থেকে। বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো গালে। তোমার তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি, বাবা। তোমার অ্যামনেশিয়া হলো কি করে?
বোকার হাসি হাসলেন বাবা। আমারটা চিরকালের, জানিসই তো…তোর মা এ জন্যে কত বকাবকি করত…
জানি।
নিজের স্যুটকেসটা বয়ে জুনের এলাকায় নিয়ে এল ফারিহা। বিছানায় নামিয়ে রেখে বলল, নাও, যা ইচ্ছে বেছে নাও।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বাড়ি গিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দেব।
অত তাড়া নেই। যখন খুশি দিয়ো।
অ্যাই, শোন, জুন বলল। আমি জানি বাড়ি গিয়ে কি করবে বাবা। দুদিনের মধ্যেই একটা পার্টি দেবে। আমার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার জন্যে উৎসব। এক কাজ করো না, তোমরাও চলে এসো। সবাইকেই দাওয়াত, তিন গোয়েন্দার কথাও বলল সে। পার্টিটা দারুণ হবে, আমি এখনই বলে দিতে পারি। তোমার কাপড়গুলো তখনই নিয়ে যেয়ো।
আচ্ছা।
খারাপ লাগল না তো? এসে নিয়ে যেতে বললাম বলে?
আরে না না, কি যে বলো। বরং খুশি হয়েছি। সত্যি।
হাসতে গিয়েও চেপে রাখল কিশোর। অতি আগ্রহটা প্রকাশ করল না। মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে যাওয়ার জন্যে। চিকেন কিং লারসেনের বাড়িতে দাওয়াত পাওয়ার সৌভাগ্য হবে, লোকটাকে আরও কাছে থেকে দেখতে পাবে, কল্পনাই করেনি কোনদিন। কিছুটা দেখেছে যদিও এই হাসপাতালে, আরও অনেক কিছু দেখা বাকি। জুনের পার্টিতে যাওয়ার চেয়ে ভাল সুযোগ আপাতত আর কিছু হতে পারে না।
৫
বিছানার কিনারে বসে পায়ে মোজা টেনে দিল কিশোর। লারসেনের বাড়িতে আজ পার্টির দাওয়াত। অস্বস্তি লাগছে তার। জটিল রহস্যের তদন্ত করতে হবে বলে ভয়টা, তা নয়, ভয় হলো এ ধরনের পার্টিতে অনেক ধরনের মানুষের সমাগম হয়। তাতেও খারাপ লাগত না। কিন্তু পার্টিটা একটা মেয়ের। তাতে ছেলেরা যেমন আসবে, তেমনি আসবে মেয়েরাও। ওদের সঙ্গে এমন সব কথা বলতে হবে ভদ্রতার খাতিরে, এমন আচরণ করতে হবে, যা সে করতে চায় না। মোটকথা ন্যাকামি এবং ভণিতা তার ভাল লাগে না।
উঠে গিয়ে ওয়ারড্রোব থেকে একটা উজ্জ্বল রঙের পোলো শার্ট বের করে গায়ে দিল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের সুন্দর চেহারা এখন ওর জন্যে বিরক্তির কারণ। কোঁকড়া কালো চুল। গভীর কালো চোখে কেমন এক ধরনের মায়া, যেন স্বপ্ন ভরা। এই চোখের দিকে তাকিয়েই মেয়েরা… ধূর! আর ভাবতে চায় না!
আগে মোটামুটি সহজভাবেই মিশতে পারত মেয়েদের সঙ্গে। ইদানীং যতই বড় হচ্ছে, কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে ওর স্বভাব। ভাল অভিনেতা সে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় শুরু করল। ধরা যাক, একটা মেয়ে এসে আলাপ জমানোর চেষ্টা করল ওর সঙ্গে। বলল, এই যে, কিশোর পাশা। তোমার সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশি হলাম। তুমি খেয়াল করোনি। কিন্তু গত আধ ঘণ্টা ধরে তোমাকে লক্ষ্য করছি আমি।
কে বলল লক্ষ্য করিনি? আমি সব দেখি। আমার চোখে কিছুই এড়ায় না, জবাব দেবে কিশোর।
একটা চিকেন নেবে? সৌজন্য দেখিয়ে কাগজের প্লেটে করে চিকেন লারসেনের একটা বিশেষ খাবার বাড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
না, ধন্যবাদ, আয়নার দিকে তাকিয়ে কল্পিত মেয়েটাকে বলল কিশোর। আমি খাব না। আজেবাজে জিনিস খেতে মানা করে দিয়েছে ডাক্তার।
তাই নাকি? তোমার ওপর ভক্তি বেড়ে যাচ্ছে আমার, হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা। এ রকম মনের জোরওয়ালা মানুষ আমার ভাল লাগে।
তার মানে কিশোরকেও ভাল লাগে, এটাই বোঝাতে চাইল মেয়েটা। ধরা যাক, তখন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জুনের বন্ধু?
আসলে, আমি এসেছি খাবারে বিষ মেশানোর একটা ঘটনার তদন্ত করতে।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মেয়েটার। মানে! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে। তুমি গোয়েন্দা! কোন খাবারে বিষ মিশিয়েছে?
এখনও হয়তো মেশায়নি। হয়তো মেশানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্ভবত মুরগীতে।
আরও অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। সর্বনাশ! কঠিন একটা প্রশ্ন করে বসল, কেন মেশাবে? লক্ষ লক্ষ লোককে কে, কি কারণে মারতে চাইছে?
জবাবটা এখনও জানি না। হতে পারে হেনরি অগাসটাস লারসেনকে ব্যবসা থেকে তাড়াতে চাইছে। ওরকম আরও হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কোনটা যে ঠিক, এখনও বলতে পারছি না।
তোমার অনেক বুদ্ধি, কিশোরের কল্পনায় বলল মেয়েটা।
জানি। অনেকেই বলে সে কথা।
গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে তো অনেক বিপদে পড়তে হয়। পিস্তল চালাতে জানো? কারাতে, জুডো এসব…
কিছু কিছু আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারি। জুডো শিখছি। পুরোপুরি শেখা হয়নি এখনও।
কিন্তু হয়ে তো যাবে, থেমে গেল মেয়েটা। দাঁত দিয়ে নখ কাটল। তারপর আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল, তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে?
এই রে! সেরেছে! আমতা আমতা করে বলল কিশোর, ইয়ে…মানে…
কিশোর! তোমার হলো?
চমকে বাস্তবে ফিরে এল কিশোর। ফিরে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রবিন। নেভি ব্লু কাপড়ে লাল স্ট্রাইপ দেয়া পোলো শার্ট গায়ে। পরনে ধবধবে সাদা প্যান্ট। সুন্দর লাগছে ওকে।
কার সঙ্গে কথা বলছিলে? গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল রবিন।
কারও সঙ্গে না, জবাব দিল কিশোর। কেসটা পর্যালোচনা করছিলাম, লাল হয়ে গেছে মুখ।
কোন চিন্তা মাথায় থাকলে একা একা কথা বলে কিশোর, ভাবনাগুলোই বিড়বিড় করে ভাবে, জানা আছে রবিনের। তাই আর এ নিয়ে মাথা ঘামাল না।
বেল এয়ারে চিকেন লারসেনের বিরাট বাড়ি। আগেই হাজির হয়ে গেছে মুসা আর ফারিহা। কিশোরদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
বাড়ি দেখেছ! দুই বন্ধুকে দেখেই বলে উঠল মুসা। গেট থেকে পুল পর্যন্ত যেতেই বাস লাগবে! আরিব্বাপরে বাপ!
তিনতলা বিশাল বাড়িটায় আটচল্লিশটা ঘর। আইভি লতায় ছাওয়া দেয়াল। কত কোটি কোটি ডলার কামিয়েছেন চিকেন কিং, বাড়িটা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। আরেকটা জিনিস স্পষ্ট, কি ব্যবসা করে টাকা কামিয়েছেন তিনি। সর্বত্র মুরগীর ছবি। যেখানে সুযোগ মিলেছে, মুরগীর ছবি আঁকা হয়েছে। যেখানে আঁকার জায়গা নেই, যেমন লনে, সেখানে রবারের মুরগী বানিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাড়ির পেছনে পুলের ধারে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। ছেলে-বুড়ো মিলিয়ে কম করে হলেও দুশো জন তো হবেই। পুলটার চেহারাও বিচিত্র। মুরগীর আকৃতিতে তৈরি। তার পাশে ফ্রাইড চিকেন খেতে খেতে হাসাহাসি করছে একদল ছেলেমেয়ে।
আমরা কিন্তু এখানে শুধু মজা করতে আসিনি, ফিসফিস করে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। ফারিহা, গোয়েন্দা হওয়ার খুব শখ তো তোমার। ট্রেনিং নিতে শুরু করো। যা বলব ঠিক তাই করবে। জুনের কাছ থেকে কাপড়গুলো নেবে না, ভুলে যাওয়ার ভান করে থাকবে। তাতে আরেকবার ওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবে।
আচ্ছা, ঘাড় কাত করে বাধ্য মেয়ের মত বলল ফারিহা। চলো, জুনের কাছে যাই। তোমরা যে এসেছ দেখা করা দরকার।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল চারজনে। সবার হাতেই কাগজের প্লেট। এমন ভঙ্গিতে খাচ্ছে, যেন জীবনে এই প্রথম মুরগীর স্বাদ পেয়েছে। এই আরেকটা জিনিস বিরক্ত লাগে ওর। মানুষগুলো এমন করে কেন? পোশাক-আশাকে তো কাউকেই দরিদ্র বলে মনে হচ্ছে না। তার পরেও অন্যের বাড়ির খাবার পেলে এমন হাংলামো করে! বিরক্তিতে নাক কুঁচকাল সে।
কিশোর, রবিন বলল। একটা অন্তত খাও। একটাতে তো আর মরে যাবে না।
রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। মাথা নাড়ল, না, খাব না।
তুমি আসলেই একটা গোঁয়ার…
হাই, খানিক দূর থেকে বলে উঠল একটা মেয়ে। কিশোরদেরই সমবয়সী। খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল। এক হাতে মুরগীর প্লেট, আরেক হাতে খালি একটা কাপ, সোডা ওয়াটার ছিল, খেয়ে ফেলেছে। আঁতকে উঠেছিল কিশোর, তাকেই ডাকছে ভেবে। যখন দেখল রবিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
তুমি আসার পর থেকেই তোমাকে দেখছি, রবিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল মেয়েটা।
রবিনও হাসল। তোমাকে তো চিনলাম না?
চোখ কপালে তুলল মেয়েটা। হায় হায়, বলো কি! আমাকে চেনো না? আরে আমি, আমি, ভাল করে দেখো তো চিনতে পারো নাকি?
ব্যস, শুরু হয়ে গেছে ন্যাকামি। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
কিন্তু রবিন দিব্যি হেসে চলেছে। মেয়েটার কথার জবাব তার মত করেই দিচ্ছে।
মরুকগে! একটা লাউঞ্জ চেয়ারে বসে পড়ল কিশোর। চিকেন লারসেনকে দেখতে লাগল। নাইট ক্লাবের কমেডিয়ানের মত আচরণ করছেন বিশালদেহী মানুষটা। একটু পর পরই গমগম করে উঠছে তাঁর ভারি কণ্ঠ। হা হা করে হাসছেন। পুলের পানির ওপর দিয়ে যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সে হাসি।
হঠাৎ আরেকটা কণ্ঠ কানে আসতেই ঝট করে সেদিকে ফিরল কিশোর। ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। সাদা স্যুট পরা একটা মানুষ, নিজের পরিচয় দিচ্ছে সোনালি চুলওয়ালা এক মহিলাকে। একটা বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি ফেলিক্স আরোলা।
নোরা অরলিজ, মহিলা নিজের নাম বলল।
ভালই হলো দেখা হয়েছে, লোকটা বলল।
যতই শুনছে ততই নিশ্চিত হচ্ছে কিশোর, এই কণ্ঠ সে শুনেছে। চিনতে পারছে।
কথায় কথায় নোরা জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি করে।
মার্কেট রিসার্চ। কিছু বিশেষ খাবার চালানোর চেষ্টা করছি। খেয়ে দেখবেন? দেব? খুব ভাল লাগবে।
দিন। এতই যখন বলছেন। কাগজে মোড়ানো ছোট একটা ক্যান্ডি বের করে দিল আরোলা। ভাল করে দেখার জন্যে উঠে দাঁড়াল কিশোর।
অদ্ভুত নাম! মিরাকল টেস্ট! মোড়কে লেখা নাম পড়ে বলল মহিলা।
আমাদের কোম্পানির নতুন আবিষ্কার, আরোলা বলল হেসে।
মোড়ক খুলল নোরা। চকলেট রঙের একটুকরো মিষ্টি খাবার। তাতে মাখন মেশানো। দেখতে পাচ্ছে কিশোর।
কিন্তু ক্যান্ডি যে আমি খাই না? নোরা বলল।
ভয় নেই, অভয় দিয়ে বলল আরোলা। এতে ক্যালোরি বাড়বে না। জিরো ক্যালোরি। ওই যে মিরাকল কথাটা লেখা আছে না, খামোকা নয়। খেয়েই দেখুন।
মহিলার হাত ধরে প্রায় জোর করে ক্যান্ডিটা তার মুখে ঠেলে দিল আরোলা। খান। বুঝবেন, না খেলে কি স্বাদ মিস করতেন।
অবশেষে কামড় দিয়ে ছোট একটুকরো ভেঙে মুখে পুরল নোরা। বাহ! দারুণ তো!
খাবার লোভে নয়, কি এমন মজা সেটা বোঝার জন্যে জিভ প্রায় বেরিয়ে পড়ল কিশোরের। রহস্যময় লাগছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করল আরোলা। একটা বিজনেস কার্ড আর একটা ক্যান্ডি কিশোরের হাতেও গুঁজে দিল সে।
মোড়ক খুলে মুখে পুরে দিল কিশোর। মসৃণ, মাখন মাখন এক ধরনের স্বাদ।
কেমন লাগছে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
তিন ধরনের স্বাদ একসঙ্গে, জবাব দিল কিশোর। চকলেট, মার্শম্যালো আর মিন্ট। সত্যিই ক্যালোরি নেই? কি করে সম্ভব?
সম্ভব। ফ্লেভারটাই আসল। মিরাকল টেস্ট কি আর সাধে বলা হয়েছে। ক্যালোরি ছাড়া ক্যান্ডি, সাংঘাতিক আবিষ্কার, কি বলো?
বড় বড় হয়ে গেছে কিশোরের চোখ। সত্যিই চমৎকার স্বাদ। তারপর বলছে ক্যালোরি ফ্রী। কি করে সম্ভব? এতই আগ্রহী হয়েছে সে, আরোলার কণ্ঠস্বরের কথাই ভুলে গেল ক্ষণিকের জন্যে।
ওর কোন সন্দেহ নেই, এই লোকই ফোন করেছিল হাসপাতালে। নার্সকে বিরক্ত করেছিল। বার বার জুনের খবর জানতে চেয়েছিল।
তোমার কার্ড নেই নিশ্চয়? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল আরোলা। সমঝদার খানেওয়ালা তুমি, বুঝতে পারছি। তোমাকে টেস্ট করিয়ে ভাল করেছি। নাম ঠিকানা জানা থাকলে ভাল হত।
হেসে উঠল মহিলা। ওর আর কি কার্ড থাকবে? টিনএজার। হাই স্কুলে পড়ে বোধহয়। ব্যবসা-ট্যবসা কি আর করে?
কে বলেছে কার্ড নেই?—কথাটা প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল কিশোরের। সামলে নিল সময়মত। আর যাকেই দিক, এই মুহূর্তে ফেলিক্স আরোলাকে তিন গোয়েন্দার কার্ড দেয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই। সতর্ক হয়ে গেলে লোকটা তার কোন প্রশ্নেরই জবাব দেবে না। অনেকগুলো প্রশ্ন করার ইচ্ছে আছে কিশোরের। এই যেমন, কেন হাসপাতালে ফোন করেছিল? কেন রহস্যময় আচরণ করেছে ফোনে? জুন আর লারসেনের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?
এই সময় সেখানে এসে হাজির জুন। আরোলার হাত ধরল। আরেকটা ক্যান্ডি দিন। এত ভাল ভাবিইনি। একটার পর একটা যে খেতে চাইব, একথা কিন্তু একবারও বলেননি।
তাকে আরেকটা ক্যান্ডি দিল আরোলা। কিশোরকে দেখিয়ে বলল, ওরও ভাল লেগেছে। ও খুব সমঝদার, বুঝে গেছি…
থামুন থামুন, তাড়াতাড়ি হাত তুলল জুন। ওকে আপাতত পাবেন না। কাজে লাগাতে চান তো? হবে না। কারণ এখন ওকে আমি দখল করেছি। ওকে আর ওর দুই বন্ধুকে। ওরা তিন গোয়েন্দা। আমাকে সাহায্য করছে। অ্যাক্সিডেন্টের দিন কি কি ঘটেছিল আমার, বের করার চেষ্টা করছে।
ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও মুখটাকে স্বাভাবিক রাখল কিশোর। তার পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে মস্ত ক্ষতি করেছে জুন। তাই নাকি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখ সরু সরু হয়ে এল আরোলার। তোমাকে দেখে কিন্তু কিছুই মনে হয়নি।
মুসা আর রবিনকে এখন দরকার। জলদি। কোন ধরনের একটা সূত্র পেতে যাচ্ছে কিশোর, সেটা কি, এখনও বুঝতে পারছে না অবশ্য।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। আবোলাকে এক্সকিউজ মি বলে রওনা হলো ভিড়ের ভেতর দিয়ে, দুই সহকারীর খোঁজে। মুরগী পুলের ঠোঁটের কাছে জটলা করছে কিছু লোক, তার মাঝখানে যেন কিং হয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন চিকেন কিং লারসেন। সবার মাথার ওপর দিয়ে চোখে পড়ছে তার মাথা। পড়বেই। সাড়ে হয় ফুট লম্বা মানুষ খুব কমই আছে। চট করে চোখে পড়ার আরেকটা কারণ তার পোশাক। উজ্জ্বল কমলা রঙের জগিং স্যুট, বুকের কাছে এমব্রয়ডারি করে আঁকা রয়েছে একটা মুরগী।
বললাম তো জানি না, প্রায় চিৎকার করে কথা বলছেন লারসেন। ছাড়া পেলেই কেন যে রাস্তা পেরিয়ে আরেক দিকে দৌড় দিতে চায় মুরগীরা, এ রহস্য আমিও ভেদ করতে পারিনি, তারপর হা হাহ হা করে জোরে জোরে হাসলেন তিনি। কি মজা পেল শ্রোতারা ওরাই জানে, হো হো করে হাসতে লাগল।
মিস্টার চিকেন, একজন বলল। আচ্ছা বলুন তো, মাখন মাখানো মুরগীর মাংসের কেক নিয়ে কবে গোলমালটা হয়েছিল?
উনিশশো ছিয়াশিতে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন লারসেন। ওরকম খাবার সহ্য করতে পারছিল না আসলে লোকে, বেশি রিচ…
ছিয়াশি নয়, পঁচাশি, ফস করে বলে বসল কিশোর। জবাবটা মুখে এসে গেছে, না বলে পারল না। আপনার ভুল হয়েছে, স্যার।
একসঙ্গে সবগুলো মুখ ঘুরে গেল কিশোরের দিকে। চিকেন লারসেন সহ।
আমার মনে আছে, আবার বলল কিশোর। সে বছরই আপনি একটা ফোয়ারা বানিয়েছিলেন। তার পাশে হোস পাইপের ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনার রান্না করা মুরগী খাওয়ার পর বাচ্চারা যাতে পানি ছিটিয়ে মজা করতে পারে।
তুমি তো একটা জিনিয়াস হে! এগিয়ে এলেন লারসেন। ভালুকের থাবার মত বিশাল থাবায় চেপে ধরলেন কিশোরের হাত।
ঝাঁকাতে গিয়ে কিশোরের মনে হলো, ওই হাত নাড়ার সাধ্য তার নেই।
তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল, বুঝতে পারছি, লারসেন বললেন। এক কাজ করো না। আমি কি কি করেছি, সেই ইতিহাসগুলো তুমিই বলে দাও। সবাই শুনুক। আমিও শুনি। নিজের পুরানো দিনের কথা শুনতে ভালই লাগে মানুষের।
বেশ, ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। উনিশশো ছিয়াশি সালে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অয়েলে চিনি মিশিয়েছিলেন আপনি। আপনার রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে লম্বা একটা মুরগীর মিছিল পার করিয়েছিলেন। মুরগীগুলোর গলায় ঝুলছিল লাল রঙের মলাটের টুকরো। তাতে সোনালি অক্ষরে লেখা ছিলঃ চিকেন লারসেনের জন্যে আমি সব করতে রাজি।
নাহ, এই ছেলেটাকে আমি পালকপুত্র করে নেব! জনতার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করলেন লারসেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন মেয়েকে, জুন, তোর একটা নতুন ভাই জোগাড় করেছি!
মুরগীর ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনায় মগ্ন কিশোর আর লারসেন, মুসা আর ফারিহা তখন জুনের সঙ্গে আলাপ করছে। পুলের নিচু ডাইভিং বোর্ডের ওপাশে রয়েছে ওরা।
দারুণ পার্টি দিয়েছ, ফারিহা বলল। এত্তো লোক! কারা ওরা?
জানি না। কোথেকে দাওয়াত করে এনেছে বাবা, বাবাই জানে, জুতো খুলে পানিতে পা ডোবাল জুন। যাকে পায় তাকেই দাওয়াত করে বসে বাবা, কিংবা ফ্রী কুপন দিয়ে দেয়, স্বভাবই এরকম। আমি হয়েছি ঠিক উল্টো। ভালমত না জেনে না বুঝে কিছু করতে পারি না। এই স্মৃতিবিভ্রমের ব্যাপারটা খেপিয়ে দিচ্ছে আমাকে। কেবলই মনে হয়, কেন মনে করতে পারি না! লোকে এসে সান্ত্বনা দিয়ে বলেঃ তুমি ভাল হওয়ায় খুশি হয়েছি। যারা বলে তাদেরকে চিনতে পারি না। অসহ্য লাগতে থাকে!
লম্বা একটা লোককে দেখেছ কখনও, মনে পড়ে? মুসা জিজ্ঞেস করল। কুৎসিত চেহারা। আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট পরে?
মাথা নাড়ল জুন। নাহ। কেন?
তোমাকে ওর কথা বলতেই ভুলে গেছি, ফারিহা বলল। আমরা ওর নাম রেখেছি মিস্টার এক্স। যে রাতে তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সে রাতে হাসপাতালে তোমার ঘরে এসেছিল সে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, লোকটা তোমার অপরিচিত হওয়ার কারণ আছে। আর একটিবারও আসেনি সে এরপর।
ভুরু কুঁচকে গেল জুনের। চোখে ভয় দেখা দিল বলে মনে হলো মুসার।
থাক অসব কথা, হাত নেড়ে বলল সে। তোমার গাড়িটার কি অবস্থা, জুন? আমি ইঞ্জিনের কাজ জানি। চাইলে আমার সাহায্য নিতে পারো।
আমার গাড়ি? সোজা ওটাকে জাংকইয়ার্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে বাবা। একবার চোখের দেখাও দেখতে দেয়নি আর আমাকে। তার ধারণা, অপয়া গাড়ি।
অ্যাক্সিডেন্টের দিন যা ঘটেছিল কিছুই মনে করতে পারছ না? ফারিহা জিজ্ঞেস করল।
না। দিন গেলে হয়তো মনে পড়বে। আগামী হপ্তায়ও পড়তে পারে।
সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে ফিরে কিশোরের ওয়ার্কশপে আলোচনা করতে বসল তিন গোয়েন্দা। মুসা আর রবিন পিজ্জা চিবুচ্ছে। কিশোর এক টুকরো ফুটকেক নিয়ে এসেছে ফ্রিজ থেকে, মেরিচাচীর তৈরি। তাতে পেটের ক্ষতি হবে না।
হাসপাতালে ঘন ঘন ফোন না হয় করলই ফেলিক্স আরোলা, মুসা বলল একসময়। তাতে কি?
ওর বলার ধরনটাই পছন্দ হয় না আমার, সুইভেল চেয়ারে হেলান দিল কিশোর। সেজন্যেই সন্দেহটা জেগেছে।
বেশ, তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেব আমরা, রবিন বলল। লম্বা চুমুক দিল। কোকাকোলার বোতলে। তো, কাল তাহলে যাচ্ছ চিকেন লারসেনের ওখানে?
যেতে তো বলেই দিয়েছে, কিশোর বলল। পালকপুত্রই প্রায় করে নিয়েছে পার্টিতে। আমিও যতটা সম্ভব খাতির জমিয়েছি। কায়দা করে অনুমতি আদায় করে নিয়েছি, তার রিসার্চ ল্যাব আর মেইন অফিসে ঢোকার।
কি পারে বলে মনে হয়? মুসার প্রশ্ন। বিষের বাক্স? আঙুলে লেগে থাকা মাখন চেটে খেতে লাগল সে।
কি পাব জানি না। সব নির্ভর করে কতটা গভীরে ঢোকার সুযোগ পাব আমরা, কতখানি দেখতে পারব, তার ওপর।
যেতে পারলে খুবই ভাল হত, রবিন আফসোস করল। কিন্তু…
পারছ না, এই তো? ট্যালেন্ট এজেন্সিতে যেতে হবে। তা যাও।
আজকাল আর আমাকে দিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে না তিন গোয়েন্দার, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। ভাবছি এজেন্সির চাকরিটা ছেড়েই দেব…
তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ো না। দেখাই যাক না, কি হয়?
খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল তিনজনে। ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দিল কিশোর। রবিন আর মুসাকে এগিয়ে দিতে চলল লোহার বিশাল গেটের দিকে। ওদের গাড়িগুলো পার্ক করা রয়েছে ওখানে। লালচে হয়ে এসেছে আকাশ। তবে বেশিক্ষণ সে রঙ থাকল না।
অ্যাই, দেখো, হাত তুলল মুসা। রাস্তার ওপারে! বুকের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো রঙের পোরশে কনভারটিবল। কম করে হলেও ষাট হাজার ডলার দাম। দুর্দান্ত জিনিস।
গাড়ি দেখছে না কিশোর, তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। বনেটের ওপর ঝুঁকে রয়েছে যে। শান্ত কণ্ঠে বলল, দেখেছ। আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। আমাদের মিস্টার এক্সও ওই পোশাকই পরেছিল…।
তাই তো! গাড়ির দিকেই নজর ছিল কেবল মুসার, আর কোনদিকে নয়। বরফের মত জমে গেল যেন সে। একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই দৌড় দিল সেদিকে।
পায়ের শব্দ শুনেই বোধহয় ফিরল লোকটা। মুসাকে দেখেই বনেট নামিয়ে গিয়ে টান দিয়ে খুলল ড্রাইভিং সীটের পাশের দরজা।
অ্যাই, শুনুন! দাঁড়ান! চেঁচিয়ে বলল মুসা।
কিশোর আর রবিনও ছুটতে শুরু করেছে তার পেছনে।
কিন্তু থামল না আর্মি জ্যাকেট পরা লোকটা। তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হয়ে গেল।
চোখের পলকে ঘুরে গেল মুসা। ছুটল তার নিজের গাড়ির দিকে। একটানে দরজা খুলে ভেতরে বসেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সাঁই সাঁই করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে তুলে নিয়ে এল রাস্তায়। পিছু নিল পোরশের।
চল বেটা, জলদি কর, নিজের শিরোকোকে অনুরোধ করল মুসা। ওটাকে ধরা চাই। পালাতে না পারে।
কিন্তু মোড়ের কাছে পৌঁছে ব্রেক চেপেই বোকা হয়ে গেল সে। কিছুই হলো না। কাজ করছে না ব্রেক। প্যাডাল চেপে অযথাই পাম্প করে চলেছে সে, কিন্তু চাপ লাগছে না কোন কিছুতে।
পঞ্চাশ মাইল তুলে ফেলেছিল গতিবেগ। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি সামনের চৌরাস্তার দিকে। ট্রাফিক পোস্টের লাল আলো জ্বলছে।
৬
একটা মুহূর্তের জন্যে প্যাডাল চাপা বন্ধ করছে না মুসা। কাজ তো করা উচিত! সে নিজে সব কিছু চেক করে। ব্রেক ফুইড ঠিক আছে কিনা নিয়মিত দেখে।
কিন্তু, কথাটা সত্যি, ব্রেক কাজ করছে না। কোনমতেই চাপ দিচ্ছে না চাকায়। গতিরোধ করার চেষ্টা করছে না। পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ফলে গতি তো কমছেই না, আরও বাড়ছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চৌরাস্তায় গিয়ে পড়বে ভাগ্য ভাল হলে কোন গাড়ির গায়ে তো না লাগিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তবে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ লাল আলো জ্বলছে তার দিকটায়। অন্যদিকের গাড়িগুলো চলাচল করছে। ওগুলোর চালকদের জানার কোনই উপায় নেই যে মুসার গাড়ি ব্রেক ফেল করেছে।
মুসার মনে হচ্ছে তার গলার ভেতরে একটা আস্ত আপেল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বেরও করতে পারছে না, গলা দিয়ে নামাতেও পারছে না। ঘেমে ভিজে গেছে হাতের তালু।
কিন্তু মাথাটা এখনও ঠান্ডাই রেখেছে। ভেজা তালু দিয়ে চেপে ধরল গিয়ারশিফট নব। একটানে নামিয়ে নিয়ে এল ফোর্থ গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে। গতি কমানোর জন্যে। ইতিমধ্যে সামনের পোরশেটা মোড় নিল গতি না কমিয়েই। রাস্তায় ঘষা খেয়ে আর্তনাদ তুলল টায়ার। ঘুরে গেল গাড়িটা। দ্রুত সরে যেতে লাগল।
গতি কমছে শিরোকোর, তবে যথেষ্ট নয়। চৌরাস্তাটা আর মাত্র একশো গজ দূরে। হস হস করে বেরিয়ে যাচ্ছে ওপাশের গাড়িগুলো। এপাশের হলুদ সিগন্যাল এখনও জ্বলেনি।
জোরে হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করল একটা নীল হোন্ডা।
ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে মুসার হৃৎপিন্ড। গিয়ার আরও নিচে নামাল সে। তারপর চেপে ধরল হ্যান্ডব্রেক। একই সঙ্গে ডানে কাটল স্টিয়ারিং।
নিমেষে রাস্তা থেকে একটা শূন্য জায়গায় নেমে এল গাড়ি। কিছু বাড়িঘর উঠবে ওখানে, তারই প্রস্তুতি চলছে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। তাতে আরও কিছুটা গতি কমল গাড়ির। লম্বা ঘাসের ভেতরে পড়ে আছে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাব, সেগুলোতে ধাক্কা লেগে থেমে গেল শিরোকো।
প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগল। সীটবেল্ট বাঁধা না থাকলে উইওশীন্ডে গিয়ে বাড়ি লাগত মুসার মাথা।
মরতে মরতে বাঁচলাম! ভাবল সে। লম্বা দম নিতে লাগল নিজেকে শান্ত করার জন্যে। তারপর দরজা খুলে নেমে এল টর্চ হাতে। গাড়ির পাশে বসে পড়ে নিচে আলো ফেলে দেখতে লাগল ক্ষতিটা কোথায় হয়েছে। হুম, তাহলে এই ব্যাপার! ব্রেকের ফ্লুইড লাইন কাটা! ইগনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে। গোধূলি শেষ হয়ে অন্ধকার নামতে আরম্ভ করেছে তখন। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ফিরে চলল সে।
দুই ক্যান সোডা ওয়াটার গেলার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসার কাঁপুনি। হেডকোয়ার্টারের ট্রেইলারটা যে জঞ্জালের স্তুপের ভেতর লুকানো, তার বাইরে তিনটে পুরানো লোহার চেয়ারে বসেছে রবিন আর কিশোরের সঙ্গে।
যাক, কিশোর বলল। অবশেষে মিস্টার এক্সের দেখা মিলল।
ব্যাটা শয়তান, এখনও রাগ কমেনি মুসার। ব্রেকের লাইন ও-ই কেটে রেখেছিল। এমন ভান করছিল, যাতে আমি ওকে ফলো করি। কিংবা আমরা সবাই করি। এবং করলেই গিয়ে বাড়ি খাই পাহাড়ে।
তিন গোয়েন্দার নাম মুছে যেত তাহলে। কিংবা দুই গোয়েন্দা হয়ে যেত এতক্ষণে।
আমি ভাবছি, রবিন বলল। লোকটা কে? আমাদের পিছে লেগেছে কেন?
আর কি করেই বা জানল, যে আমরা তদন্ত করছি? যোগ করল কিশোর।
এটা আরেক রহস্য। পার্টিতে কিন্তু দেখিনি ওকে।
আর্মি জ্যাকেট পরা ওরকম কাউকে চেনে না জুন, মুসা বলল। তারমানে…
সে লারসেন পরিবারের কেউ নয়, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। কারও হয়ে কাজ করছে।
কার?
জবাব দিতে পারল না কেউ। তিনজনেই প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে ঘুমাল সে রাতে।
পরদিন সকালে ইয়ার্ডের গেটের বাইরে একটা অপরিচিত গাড়ি হর্ন দিতে লাগল, আর টেলিফোনটাও বেজে উঠল একই সঙ্গে। অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কিশোর। ওসিলোস্কোপ দিয়ে ওর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছিল সে। ফোনের রিসিভার কানে ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটা রহস্যের সমাধান হলো। অপরিচিত হর্নটা মুসার গাড়ির। অচেনা, তার কারণ শিরোকোটা আনেনি মুসা। নিয়ে এসেছে আরেকটা, ওর মায়েরটা।
টেলিফোনটাও অবাক করল কিশোরকে।
কিশোর, আমি জুন লারসেন বলছি। আমার ব্রিফকেস!
ইঙ্গিত কিংবা সঙ্কেত খুব ভালই বোঝে কিশোর, কিন্তু জুনের কথা তাজ্জব করে দিল ওকে। তবে সে প্রশ্ন করার আগেই জুন বলল, এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠেছি আমি। তখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমার ব্রিফকেসটা, পাচ্ছি না, লম্বা দম নিল সে। এর আগে পর্যন্ত ওটার কথা ভুলেই ছিলাম। আজ ঘুম থেকে ওঠার পর মনে পড়েছে।
উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। তোমার স্মৃতি ফিরতে আরম্ভ করেছে।
মনে হয়, জুন বলল। যাই হোক, ব্রিফকেসটা পাচ্ছি না। কেন ওটা এত খুঁজছি তা-ও বুঝতে পারছি না। ভেতরে বোধহয় জরুরী কিছু ছিল।
আমি আর মুসা তোমার আব্বার অফিসে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম।
অফিসেও ফেলে রেখে আসতে পারি। খুঁজতে যেতে চাইছিলাম, কিন্তু কদিন যেতে বারণ করে দিয়েছে বাবা। বলেছে রেস্ট নিতে। আচ্ছা, একটা কথা, শুক্রবারে অ্যাক্সিডেন্টটা হওয়ার আগে আমি কোথায় ছিলাম, বের করতে পারবে?
ঠিক এই কাজটা করার কথাই ভাবছিলাম, মনে মনে বলল কিশোর। জুনকে বলল, দেখি, খোঁজখবর করব। কখন কোথায় যাও, লিখেটিখে রাখার অভ্যাস আছে, ক্যালেন্ডারে? থাকলে ভাল হত। একটা সূত্র পেতাম।
রাখি। নীল রঙের মরক্কো লেদারে মোড়া একটা সুন্দর ডায়েরীতে। ব্রিফকেসেই রাখি ওটা।
গাড়ির হর্ন বাজাতে আরম্ভ করল আবার মুসা, তালে তালে, একটা বিশেষ ছন্দ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে। ব্যাপারটা নিয়ে সব রকমে ভেবে নিই, কিশোর বলল জুনকে। রাতে ফোন করব।
আচ্ছা। আমারও কিছু মনে পড়লে জানাব তোমাকে, লাইন কেটে দিল জুন।
বাইরে বেরোল কিশোর। ততক্ষণে বনেট খুলে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছে মুসা। ইঞ্জিন সামান্যতম গোলমাল করলে সেটা দেখা এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার।
জুন ফোন করেছিল, কিশোর জানাল। ওর ব্রিফকেসটা নাকি পাচ্ছে না। জরুরী কিছু ছিল বলে মনে হচ্ছে ওর।
কিশোরের দিকে না তাকিয়েই মুসা বলল, আমি শিওর, মিস্টার এক্স ওটাই খুঁজছিল হাসপাতালে।
মুখ তুললে দেখতে পেত উত্তেজনায় চোয়াল স্কুলে পড়েছে কিশোর পাশার। একটা সাতিক কথা বলেছ তো! মনেই হয়নি আমার!
গাড়িতে উঠে বসল দুজনে। রওনা হলো চিকেন লারসেনের স্যান ফারনানদো ভ্যালির অফিসে। যাওয়ার পথে দেখতে পেল ঢালের নিচে তরাইয়ে তেমনি পড়ে আছে মুসার গাড়িটা।
একটা পেট্রল স্টেশনে থামল মুসা। মেরিচাচীর বোনপো নিকি পাঞ্চকে ফোন করার জন্যে। যাকে এক ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তিন গোয়েন্দা। গাড়ির জাদুকর বলা যায় লোকটাকে। দিন কয়েক হলো আবার ফিরে এসেছে রকি বীচে। গাড়ি মেরামতের একটা গ্যারেজ করার কথা ভাবছে এখানে। উঠেছে ম্যালিবু বীচে এক বন্ধুর সঙ্গে একটা কটেজ ভাড়া করে। গরমকালটা কাটাবে এখানে, গাড়িটাড়ি মেরামত করবে, ব্যবসাটা জমে গেলে চিরস্থায়ীই হয়ে যাবে।
নিকিভাই? ফোনে বলল মুসা। মুসা। আমার গাড়িটা একটু দেখবেন?
কোনটা? শিরোকোটা?
হ্যাঁ। গাড়িটা পড়ে আছে। তুলে নিয়ে গিয়ে মেরামত করে নিন, কয়েক দিনের জন্যে চালাতে দেব। একটা গাড়ি আপনার দরকার বলেছিলেন না?
নিকির সঙ্গে আলোচনা করে গাড়ির একটা ব্যবস্থা করে আবার গাড়িতে ফিরে এল মুসা।
চিকেন লারসেন করপোরেশনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি রাখল। ছয়তলা একটা আধুনিক বাড়িতে লারসেনের অফিস।
চিকেন করপোরেশনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি ঢোকাল মুসা। জায়গাটা দেখে হাসি পেল দুজনেরই। এখানেও লারসেনের বিচিত্র রুচির নিদর্শন স্পষ্ট। আধুনিক ছতলা একটা বাড়ি আর এক চিলড্রেন পার্কের মিশ্রণ যেন। ভিজিটরস গেটে তালা দেয়া। ঢোকার আগে অনুমতি নিতে হয়। ইন্টারকমে কথা বলতে গেল মুসা। মুরগীর আকৃতিতে তৈরি ইন্টারকম দেখে হাসি পেল। কেন ঢুকবে, প্রশ্ন করা হলে খাবারের অর্ডার দিল সে। চিকেন লারসেন রেস্টুরেন্টে ঢোকার কথা বলল। ভাবল, আগে ভেতরে ঢুকি তো, তারপর দেখা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।
ইলেক্ট্রনিক সিসটেমে হাঁ হয়ে খুলে গেল গেট। লাল-হলুদ রঙ করা বাড়িটার দিকে গাড়ি চালাল মুসা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কাজ করেন লারসেন। চওড়া হাসি দিয়ে স্বাগত জানালেন ওদের। পরনে লাল জগিং স্যুট। কিশোরকে দেখেই বললেন, একটা ধাধার জবাব দাও। বলো তো কোন্ সালে পেষানো মুরগীর মাংসে গাজর মেশাতে আরম্ভ করেছি?
উনিশশো সাতাশি সালে। ছোট ছোট টিনে ভরে সাপ্লাই দিতেন।
অ্যাই, কি বলেছিলাম। বলিনি, ছেলেটা পারবেই! কাছাকাছি যত লোক আছে সবাইকে শোনানোর জন্যে চেঁচিয়ে বললেন লারসেন। গলা তো নয়, মাইক। তুমি একটা পাগল, পুত্র, সন্দেহ নেই, তবে আমার মত পাগল। দাঁড়াও, আইডেনটিফিকেশন ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা দুজনে যে কোন সময় ঢুকতে পারবে। আমাদের এখানে সিকিউরিটি খুব কড়া, চাপড় মেরে কিশোর আর মুসার পিঠে স্টিকার লাগিয়ে দিলেন তিনি।
কিশোরের পিঠে কি লাগানো হয়েছে, দেখে মুসা তো থ। সন্দেহ হতে নিজের পিঠেরটা দেখাল কিশোরকে। হো হো করে হেসে উঠল কিশোর। লেখা রয়েছেঃ মুরগীর ঠোকর। জিজ্ঞেস করল, আমার পিঠে কি? মুসা জানাল, মুরগীর খামচি। ওদের সঙ্গে সঙ্গে লারসেনও হাসতে লাগলেন।
হাসি থামলে বললেন, খেতে এসেছ বলে তো মনে হয় না। তা কি দেখতে এসেছ, বলো তো? মুরগী বেচে লাভ করা আমার প্রথম ডলারটা? ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। আমার অফিসে। আমার প্রথম স্ত্রীর ছবিটাও বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি। হাহ হাহ হা!
আসলে, কিশোর বলল। অফিসগুলো দেখারই লোভ। আপনারটা। আরও কিছু এবং বিশেষ করে জুনের নতুন অফিসটা।
আমি দেখতে চাই খাবার কি করে বানানো হয়, মুসা বলল। আর কি কি জিনিস দেয়া হয় মাংসের সঙ্গে।
ও, আমার পাগল বিজ্ঞানীগুলোকে দেখার শখ তোমার? হাসলেন লারসেন। বেশ। খাঁচা থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি ওদেরকে। তারপর, কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। একটা স্পেশাল খাবার দেব তোমাকে। চেখে দেখার জন্যে।
ভয় পেয়ে গেল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি খাবারের কিছু বুঝি! বুড়ো আঙুল দিয়ে মুসাকে দেখিয়ে বলল, ওকে দেবেন।
কিশোর আর মুসাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললেন লারসেন। আমার নতুন জিনিসটা দেখলে বুঝবে। বিশ্বাসই করতে চাইবে না। আমি নিজেই পারিনি। অথচ আমারই আবিষ্কার।
এলিভেটরে করে উঠে এল তিনজনে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন লারসেন। মাঝে মাঝে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে থামছেন। এই সুযোগে যাকে পাচ্ছে তার সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করছে কিশোর, জুনের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে। একজন অ্যাকাউনটেন্ট জানাল, সে সেদিন ওকে দেখেছে। তবে ব্রিফকেসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। কয়েকজন জানাল, কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পার্কিং লটে জুনের মাসট্যাং গাড়িটা দেখেছিল। তবে জোরাল কোন সূত্র কেউই দিতে পারল না।
অবশেষে দুই গোয়েন্দাকে মাটির তলার ঘরে নিয়ে এলেন লারসেন। বন্ধ কাচের দরজার ওপাশে বিশাল গবেষণাগার। ঢোকার অনেকগুলো দরজা। যারা ঢুকছে তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্যে ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা রয়েছে। অপরিচিতজন কিংবা যাদের ঢোকার অনুমতি নেই তাদেরকে ঢুকতেই দেবে না। সাবধান বাণী লেখা রয়েছে দরজার কপালে।
একটা ইলেকট্রনিক বক্সে একটা প্লাষ্টিকের কার্ড ঢুকিয়ে দিলেন লারসেন। খুলে যেতে লাগল কাচের দরজা। মুসা আর কিশোরকে বললেন, আমি যা বলব, সঙ্গে সঙ্গে তাই বলবে। কোড। হ্যাঁ, বলো, মুরগীর বাচ্চার কথা কাউকে বলব না।
তোতাপাখির বুলি আওড়ানোর মত করে বলল দুজনেই।
হ্যাঁ, হয়েছে, তারপর গলা চড়িয়ে ডাকলেন লারসেন, গমগম করে উঠল তার কণ্ঠ, কেঁপে উঠল যেন গবেষণাগারের কাচের দেয়াল, ডন!
এগিয়ে এল একজন বেঁটে, মোটা, টাকমাথা লোক। চোখে গোল্ডরিম চশমা। গায়ে ল্যাবরেটরির সাদা পোশাক। পকেটে একসারি মুরগীর মডেল ঝোলানো, সামরিক বাহিনীর লোকে মেডেল যেভাবে ঝোলায় সে ভাবে। কাছে এসে অনেকটা মিলিটারির মতই স্যালুট করল।
পরিচয় করিয়ে দিলেন লারসেন, ডন বারোজ, বিশাল থাবা দিয়ে চাপড় মারলেন লোকটার পিঠে। বাঁকা হয়ে গেল লোকটা। কল্পনাই করতে পারবে না আমার এখানে আসার আগে কোথায় কাজ করত ডন।
নিশ্চয় ডিজনিল্যান্ডে, ভাবল মুসা। জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
পেনটাগন, জবাব দিলেন লারসেন। ওয়াশিংটনে ছিল ওর ল্যাবরেটরি, পেনটাগনের পাঁচ ব্লক দূরে। তাহলে পেনটাগনই ধরা যায়, যদিও ওখানে কাজ করেনি। কাছাকাছি ছিল তো। হাহ হাহ।
আসলে, পেন্টাগন রয়েছে ভারজিনিয়ার আরলিংটনে, পটোম্যাক নদীর ধারে। চুপ করে রইল কিশোর। ভুলটা ধরিয়ে দিল না।
কাঁচুমাচু হয়ে গেছে বেচারা ডন। ভয়ে ভয়ে রয়েছে আবার কখন পিঠে আন্তরিকতার চাপড় পড়ে। একে একে গোয়েন্দাদের নাম বলে গেলেন লারসেন। হাত মেলাল ডন। ঘেমে গেছে হাতের তালু। ঠান্ডা।
ডন একজন সুগন্ধ বিশারদ, লারসেন বললেন। আমার আর অ্যান্ড ডি-র হেড, ভুরু কোঁচকালেন তিনি। বুঝলে না? রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। খুব ভাল কাজ জানে। আমি যা জানি তা-ও শেখাব। ওস্তাদ বানিয়ে ছেড়ে দেব। চিকেন ডন বারোজ হয়ে যাবে তখন। হাহ হাহ হা! ডন, ধর, ছেলেরা ড্রিপিং চিকেন খেতে চায়? দিতে পারবে?
কিশোর আর মুসার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ দেখা দিল ডনের চোখে। ওরা সিভিলিয়ান, স্যার?
তাতে কোন অসুবিধে নেই, অভয় দিলেন লারসেন। কোন বছর সেই খাবারটা বানিয়েছিলাম, যেটার নাম দিয়েছিলাম উইং অন আ স্ট্রিং? একটুকরো সাবানের ওপর দড়ি পড়ে থাকতে দেখে যে খাবারটা তৈরির ভাবনা মাথায় এসেছিল আমার?
নাইনটিন এইটি ফাইভ, জবাব দিল ডন।
তারিখ?
মাথা নাড়ল ডন।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর, বাইশে জুন, উনিশশো পঁচাশি।
দেখলে তো? হেসে বললেন লারসেন। কাকে নিয়ে এসেছি? ওকে আমি পালকপুত্র বানিয়েছি এ জন্যেই। জুনকেও বলে দিয়েছি। ছেলেটা একটা চলমান রেফারেন্স বুক। একেবারে কম্পিউটারের মেমোরি। ডনের দিকে তাকালেন, আর সন্দেহ নেই তো তোমার? যাও, ড্রিপিং চিকেন নিয়ে এসো।
যাচ্ছি, স্যার, এবার আর স্যালুট করল না ডন, তবে ভাব সাব দেখে মনে হলো করতে পারলেই খুশি হত। সেই সঙ্গে খটাস করে বুট ঠুকতে পারলে তো আরও। তবে ঘুরে যখন রওনা হলো, সাধারণ মানুষের মত হেঁটে মার্চ করে এগোল। ল্যাবরেটরির রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে চাবি বের করে তালা খুলল।
ড্রিপিং চিকেনটা কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।
বললে বুঝবে? আচ্ছা, বলি, লারসেন বুঝিয়ে দিলেন, মুরগীর মাংস থেকে পুরোপুরি হাড় আলাদা করে ফেলে, মেশিনে পিষে ফেলা হয়। বিস্কুটের গুঁড়ো মিশিয়ে ভেজে পুরো বাদামী করে ফেলে তার ওপর মাখিয়ে দেয়া হয় সোনালি রঙ করা মাখন। বুঝলে?
ছবি দেখতে পাচ্ছি, কিশোর জবাব দিল।
ছবি?
ও কিছু না।
আরও কিছু জিনিস মেশানো হয়, লারসেন বললেন। যেগুলো বললেও বুঝবে না। কাজেই, থাক।
আমার আর শোনারও দরকার নেই, জিভে পানি এসে গেছে মুসার।
আমার এই নতুন খাবারে বিশেষ একটা জিনিস মেশানো থাকবে, প্রতিটি বড়ার মধ্যে, লারসেন বললেন। লোকে মজা করে খাবে। তারপরই খাবে ধাক্কা। বুঝতেই পারবে না কিসে আঘাত করল ওদেরকে।
খাওয়া লাগল না, কথাটা শুনেই ধাক্কা খেলো দুই গোয়েন্দা। ভীষণ চমকে গেল। ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। পরস্পরের দিকে তাকাল। এক মুহূর্ত আগেও ড্রিপিং চিকেন খাওয়ার জন্যে লোভ ছিল দুজনের। এমনকি কিশোরও ভাবছিল, পেট এখন ভাল হয়ে গেছে, খানিকটা খাবার চেখে দেখবেই। লারসেনের কথা শোনার পর ইচ্ছেটা উবে গেছে। লোকে কেন ধাক্কা খাবে? কেন বুঝতে পারবে না… কিসে আঘাত করেছে ওদেরকে? আর খাওয়ার মধ্যে আঘাতের কথা আসে কেন? ড্রিপিং চিকেনে বিষ মেশানো হবে না তো?
খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। নতুন একটা খাবার আবিষ্কার করেছেন লারসেন। তার পরপরই ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখল জুন। কাকতালীয় হতে পারে…কিন্তু কিশোরের মনে হতে লাগল, এই খাবারটাই জুনের আতঙ্কের কারণ। কোথাও একটা যোগাযোগ আছে। কানের পর্দায় যেন ভাসতে লাগল কিশোরেরঃ মুরগীতে বিষ মেশাচ্ছে সে! লাখ লাখ লোক মারা যাবে!
রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল ডন, খুব সুন্দর হয়েছে! আর বেশ গরম!
এসো, দুই গোয়েন্দাকে বললেন লারসেন। আমার গিনিপিগ বানাতে চাই তোমাদেরকে। তোমরাই প্রথম চেখে দেখো, কেমন হলো ড্রিপিং চিকেন।
৭
চোখে অনেক আশা নিয়ে কিশোর আর মুসার দিকে তাকালেন লারসেন। যেন বোঝার চেষ্টা করছেন, ওদেরকে যে সম্মানটা দেয়া হচ্ছে সেটা ওরা বুঝতে পারছে কিনা।
ঘড়ি দেখল মুসা। লাঞ্চটাইম তো হয়নি এখনও।
ডাক্তার বলেছেন, কিশোর বলল। কোন রকম রিচ ফুড না খেতে। ভাজাভুজি তো একেবারে বারণ। পেটের অবস্থা ভাল না আমার।
ওই ডাক্তার ব্যাটাদের কথা শুনো না! প্রায় গর্জে উঠলেন লারসেন। ওরা তো কত কথাই বলে। সব শুনলে না খেয়ে উপোষ করে মরতে হবে রোগীকে। এসো। এখনও গরম গরম রয়েছে ড্রিপিং চিকেন। এই সুযোগ হারালে পরে পস্তাবে… বুঝতে পারছ না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোমাদেরকে। কোথায় পাঠানো হবে।
ঠিকই পারছি! নরকে! ভাবল মুসা।
তর্ক করে লাভ হবে না। সন্দেহ না জাগিয়ে লারসেনকে কোন কিছু বলেই নিরস্ত করা যাবে না এখন। কি আর করে? ধীরে ধীরে তার সঙ্গে এগোল দুজনে।
একটা ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ডন। দুই গোয়েন্দাকে ইশারা করল তার অফিসের দিকে যেতে। সে এগোল সেদিকে। লারসেন গেলেন না। ডনকে বললেন, ট্রেটা রেখেই যাতে চলে আসে। কাজ আছে।
ডনের অফিসে ঢুকল কিশোর আর মুসা। স্টেইনলেস স্টীল আর কাচের তৈরি সুদৃশ্য আধুনিক টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল ডন। স্যান্ডউইচের মত দেখতে চমক্কার খাবার। গরম। ধোয়া উড়ছে। দেখতে তো খুবই ভাল, কিশোর বলল।
পাগল হয়ে গেলে নাকি? মুসা বলল, ওগুলো বিষাক্ত! খাওয়া একদম উচিত হবে না। এক কাজ করি, পকেটে ভরে ফেলি।
নিজের প্যান্টের দিকে তাকাল কিশোর। আঁটো জিনস। পকেটে ঢোকানো যাবে না, আর জোরজার করে কোনমতে ঢোকালেও উঁচু হয়ে থাকবে। স্পষ্ট বোঝা যাবে। মাথা নাড়ল, হবে না।
তাহলে? ওয়েস্টবাস্কেটেও তো ফেলতে পারব না। দেখে ফেলবে।
উঁচু হয়ে থাকলেও পকেটেই ঢোকাতে হবে। আর কোন উপায় নেই। আমি পরেছি জগিং স্যুট, পকেটই নেই।
কাউচের নিচে ফেলে দিলে কেমন হয়?
তাতেও লাভ হবে না। যে হারে গন্ধ বেরোচ্ছে, ওরা গন্ধ পেয়ে যাবে। বের করে ফেলবে। পকেটেই রাখতে হবে। ঢোকাও। জলদি!
আর কোন উপায় না দেখে পকেটেই ঢোকাতে বাধ্য হলো কিশোর। আঠাল ঝোলের মত জিনিস পকেটের কাপড় ভেদ করে পা বেয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করল। আমি দরজায় চোখ রাখছি, মুসা বলল। তুমি খোঁজ। দেখো, কিছু বেরোয় কিনা।
খুঁজতে লাগল কিশোর। জুনের ব্রিফকেসটা। ডেস্কের পেছনে, নিচে, ড্রয়ারে, কোথাও পাওয়া গেল না। ফাইল কেবিনেটে তালা দেয়া। ওর ভেতরে দেখা গেল না।
ব্রিফকেস খোঁজা বাদ দিয়ে অন্য সূত্র মেলে কিনা দেখতে শুরু করল সে। ডনের ডেঙ্ক ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখল একটা পাতা নেই, ছয় দিন আগের তারিখের।
মুসা শুনে বলল, সেদিন শুক্রবার। জুন যে দিনের কথা মনে করতে পারছে, যে দিন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। যোগাযোগ আছে কিনা বের করা দরকার, এই সময় পায়ের শব্দ শুনতে পেল। এগিয়ে আসছে।
ঠোঁটে আঙুল রেখে কিশোরকে চুপ করতে ইশারা করল মুসা।
একটু পরেই ঘরে ঢুকল ডন। প্রথমেই তাকাল ট্রের দিকে। শূন্য। বেশ বেশ, খেয়েছ তাহলে? কেমন লাগল আমাদের ড্রিপিং চিকেন?
ওই জিনিস জীবনে খাইনি, সত্যি কথাটাই বলল কিশোর।
আমাদের জেনারেল শুনে খুব খুশি হবেন, লারসেনের কথা বলল ডন। একটা জরুরী কাজে চলে গেছেন। তোমাদেরকে বলতে বলেছেন। ড্রিপিং চিকেন কার আবিষ্কার? আপনার?
না, মাথা নাড়ল ডন। ডেস্কের ওপাশে গিয়ে বসল। এই একটা আইটেমের জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন জেনারেল। যেতে অনেক মানা করেছিলাম, শুনলেন না। বলেছি, চেষ্টা করলে এখানেই বানাতে পারব আমরা। সোজা আমাকে বলে দিলেন, তিনি বস, যা করার তিনিই করবেন। গেলেন ফেলিক্স আরোলার কাছে, মিরাকল টেস্টের মালিক। অথচ আমরা দুজনে, চিকেন কিং আর কেমিক্যাল কিং মিলেই বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
তার মানে কি আছে এতে আপনি জানেন না? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নিশ্চয় জানি। গবেষণা করাই তো আমার কাজ। পরীক্ষা করে বের করে ফেললাম কি কি মেশানো হয়েছে। সে কথা জানালাম জেনারেলকে। খুশি হয়ে আরেকটা মোরগ আমাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন জেনারেল, পকেটে ঝোলানো দশ নম্বর রুপার মুরগীটা দেখাল ডন। তবে স্বীকার করতেই হবে, যা আছে সব ক্লাসিক জিনিস। তোমাদেরকে অবশ্যই বলব না। বিজনেস সিক্রেট।।
আমরা শুনতে চাইও না, কিশোর বলল। যা দেখলাম তাতেই খুশি আমরা। চিকেন লারসেনের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই তো একটা সৌভাগ্য। কি বলো, মুসা? আট দিন আগেও তো আমরা চিনতাম না, তাই না?
শূন্য দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। দেখল, কিশোরের নজর ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে। ভুল করলে। আট নয়, ছয় দিন আগে, হাসল সহকারী গোয়েন্দা।
আট দিন, জোর দিয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
ভুল, ডনের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ক্যালেন্ডার উল্টে যে পাতাটা নেই সেখানটায় এসে থামল। ছয়দিন। গত শুক্রবার। আমি শিওর… আরে, পাতাটা কোথায়?
নেই, এমন ভঙ্গিতে বলল ডন, যেন জানাই আছে নেই যে। মুদী দোকান থেকে আনা জিনিসের লিস্ট লিখে রাখি ক্যালেন্ডারে। মাঝে মাঝে পাতা ছিড়ে সাথে করে নিয়ে যাই।
ঠিক আছে, যা দেখার দেখলাম, কিশোর বলল। চলি। বাড়ি গিয়ে কাপড় বদলানো দরকার।
হাসি চাপতে গিয়ে কেশে ফেলল মুসা। নিশ্চয় কিশোরের কাপড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রস, আঠা লাগছে চামড়ায়, ভীষণ অস্বস্তিকর। রসের রঙ এখন বাইরে থেকে দেখা না গেলেই হয়। পকেটের উঁচু জায়গাটা চেপে ধরে রেখেছে কিশোর।
বেরিয়ে এল দুজনে। প্রথমেই ময়লা ফেলার যে ড্রামটা পেল তাতে ফেলে দিল ড্রিপিং চিকেন। তারপর বাড়ি রওনা হলো।
সেই বিকেলে ছয় বাক্স চীনা খাবার নিয়ে আসা হলো। চীনের দেয়ালের মতই যেন সাজিয়ে রাখা হলো কিশোরের ওয়ার্কশপে বাক্সগুলো। তিন গোয়েন্দাই হাজির। চিকেন লারসেনের অফিসে গিয়ে কি কি করে এসেছে রবিনকে বলছে মুসা, মাঝে মাঝে কথা জুগিয়ে দিচ্ছে কিশোর।
তারপর চলল খাবারে বিষ মেশানো নিয়ে আলোচনা।
ড্রিপিং চিকেনে বিষ মেশানোর উদ্দেশ্যটা মোটামুটি আঁচ করা যায়, রবিন বলল। তার পরেও চারটে প্রশ্ন থেকে যায়। কে মেশাল, কোথায় মেশাল, কখন মেশাল, কেন মেশাল? আরেকটা সম্ভাবনাও থেকেই যায়। হেনরি অগাসটাস এতে জড়িত এবং খারাপ কিছু করছে।
জুনের ব্রিফকেসটা পেলে হত, কিশোর বলল। কিছু না কিছু পাওয়া যেতই ওতে।
গত শুক্রবারে জুনকে কেউ দেখেছে বলেও বলল না, মুসা বলল। একজন বুড়ো লোক বাদে। তবে তার কথাও বিশ্বাস করা যায় না। কথাবার্তা কেমন অগোছাল। ভুল করে একদিনের কথা আরেকদিন বলে দিয়েছে কিনা তাই বা কে জানে।
এই খাবার এনেছ কেন? আচমকা প্রশ্ন করল রবিন। কেন, খেতে ইচ্ছে করে না বুঝি? প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়েই সারল মুসা। কোন রেস্টুরেন্ট থেকে? যেটা থেকে সব সময় আনি। ডেই ডং। তাহলে আর বসে আছি কেন? খেয়ে ফেলি।
একটা বাক্স টেনে নিয়ে খুলল। খুলে একটা প্যাকেট হাতে নিয়েই স্থির হয়ে গেল। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? জানতে চাইল মুসা। ফরচুন কুকির বিজ্ঞাপন করেছে নাকি বড় বড় কথা বলে?
মোড়কের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। নীরবে বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে। হাতে লেখা একটা নোট। দেখার জন্যে কিশোরও বুকে এল। লেখা রয়েছেঃ
এইমাত্র যে খাবার খেলে, তাতে বিষ মেশানো থাকতে পারত। এবার নেই। পরের বার থাকতেও পারে। কাজেই সাবধান! অন্তত চিকেন কিঙের খাবার থেকে দূরে থাকবে!
৮
পড়ার পরেও অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না। তাকিয়েই রয়েছে কাগজটার দিকে। তারপর হঠাৎ নড়ে উঠল কিশোর। প্রায় খাবলা দিয়ে তুলে নিয়েছে বাক্সের বাকি দুটো ফরচুন কুকি। দুটোর মোড়কেই একই হুঁশিয়ারি লেখা রয়েছে।
চিংড়ি মেশানো ফ্রাইড রাইসের বাক্সটা টেনে নিয়েছিল রবিন, এই হুঁশিয়ারি পড়ার পর ঠেলে সরিয়ে দিল টেবিলের কোণে। খিদে গেছে! বিষ খেয়ে মরার চেয়ে না খেয়ে থাকা ভাল!
টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল মুসা।
কাকে করবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ডেই ডং রেস্টুরেন্ট। কার কাজ জানা দরকার।
করা উচিত, রবিন বলল।
না, নিষেধ করল কিশোর। দরকার নেই।
কেন? মুসার প্রশ্ন।
কারণ আমি জানি কি ঘটেছে।
কী?
চুপ করে আছ কেন? অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন।
রেস্টুরেন্টের কোন একজন ওয়েইটার ওই কাগজ দিয়ে কুকি মুড়ে দিয়েছে। এবং সেটা করেছে, কেউ একজন এসে তাকে পাঁচটা ডলার হাতে গুঁজে দিয়ে করতে বলেছে বলে। ওয়েইটারকে বলেছে, এটা একটা রসিকতা। ওয়েইটারও কিছু বুঝতে পারেনি। করে দিয়েছে কাজটা।
তুমি কি করে জানলে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানি, ব্যস। বিশ্বাস করতে পারো আমার কথা।
নিশ্চয় করি… রবিন শুরু করল।
মুসা শেষ করল, কারণ তোমার অনুমান সাধারণত ভুল হয় না। আরও একটা ব্যাপার জানি, কথা লুকাতে তুমি ওস্তাদ।
বেশ, দোষই যখন দিলে, বলেই ফেলি, কিশোর বলল। আমি জানলাম, অর্থাৎ বুঝতে পারলাম, তার কারণ এ রকম রসিকতা আমিও করেছি। ফরচুন কুকিতে।
কি লিখেছিলে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
ভাল কথাই লিখেছিলাম। লোককে হাসানোর জন্যে। এটার মত হুশিয়ারি নয়। বিষ খাওয়ানোর ভয় দেখাইনি লোককে। একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল কিশোর। ভাবছি, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সাবধান করা হলো আমাদেরকে। প্রথমবার করল মুসার গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে। আর এবার তো লিখেই হুমকি দিল। প্রথমে মনে করেছিলাম, ব্রেক নষ্ট করার ব্যাপারটার সঙ্গে খাবারে বিষ মেশানোর যোগাযোগ নেই। এখন মনে হচ্ছে, আছে। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে, বিশ্বাস না করে আর পারা যাচ্ছে না। আরও সতর্ক থাকতে হবে। নজর রাখা হচ্ছে আমাদের ওপর।
যে-লোক এই কাজ করছে, মুসা অনুমান করল। সে আর্মি ক্যামমাফ্লেজ জ্যাকেট পরে, পোরশে কনভারটিবল গাড়ি চালায়। ঠিক?
হলে অবাক হব না। আমাদের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখে সে।
কিশোরের কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠল। চমকে দিল তিনজনকেই। রিসিভার তুলে নিল কিশোর। কানে ঠেকিয়ে বলল, তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশা বলছি।
তোমাকেই খুঁজছি! অন্য প্রান্তে গমগম করে উঠল একটা কণ্ঠ। চিকেন হার্বার্ট লারসেনের সঙ্গে কথা বলছ তুমি, পুত্র।
রিসিভারের মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে দুই সহকারীকে ফিসফিস করে জানাল গোয়েন্দাপ্রধান, চিকেন!
কি জন্যে করেছে জিজ্ঞেস কর, মুসা বলল। কুকির মোড়কের লেখাটার কথাটা জানে কিনা তা-ও জিজ্ঞেস কর।
মাথা নেড়ে মুসাকে চুপ থাকতে বলল কিশোর।
শোননা, লারসেন বললেন। একটা সুখবর আছে তোমাদের জন্যে। কাল ড্রিপিং চিকেনের বিজ্ঞাপন তৈরি হবে। টিভিতে যাবে। চিকেন হিস্টরি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। হলে তোমাকে ছাড়া পারব না।
নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর। ঠিক এ রকম সুযোগই চাইছিল সে। চিকেন লারসেনের কাছাকাছি থেকে তাঁর ওপর নজর রাখতে পারে এমন কিছু।
কখন? কোথায়? জিজ্ঞেস করল সে।
আল্টা ভিস্টা ড্রাইভের মালটিন মিক্স স্টুডিওতে। একটায়। সময়মত হাজির হয়ে যাবে আমার টিম।
কেটে দেয়া হলো লাইন।
সেদিন অনেক রাতে, মুসা আর রবিন চলে যাওয়ার পর চিকেন লারসেনের বিজ্ঞাপনগুলো রেকর্ড করে রাখা একটা ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে দেখতে বসল কিশোর। বড় একটা ডেস্কে বসেন তিনি। ওপরে জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো, খুবই অগোছাল। যেন একাধারে ওটা একটা অফিস, লাইব্রেরি আর গেম রুমের মিশ্রণ। নানা ধরনের বেশ কিছু বিজ্ঞাপন আছে। কিশোরের পছন্দ হেট আ হ্যাঁমবারগার উইক নামের বিজ্ঞাপনটা, যেটাতে একটা গরুর মুখে গলিত মাখন ছিটিয়ে দেন লারসেন। আরেকটা ভাল বিজ্ঞাপন আছে। সেটাতে ক্যামেরার দিকে, সারাক্ষণ পিঠ দিয়ে থাকেন, কারণ তিনি বোঝাতে চান রেগে গেছেন, জন্মদিনের তারিখ ভুল করে ফেলেছেন বলে।
তবে তার সব চেয়ে পছন্দ, যেটাতে লারসেন দুটো নতুন ধরনের খাবার পরিবেশন করেন। একটার নাম ক্র্যাকলিন ক্রাঞ্চি, আরেকটা বার্নিং বারবে। লাস ভেগাস-এর এক মন্ত্রীর বিবাহবার্ষিকীতে ভোজ দেয়া হয়। তাতে আস্ত দুটো মুরগীকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়া হয়। একটাকে পরানো থাকে বরের পোশাক, আরেকটাকে কনের। কাপড় দিয়ে নয়। মাখন আর খাবার উপযোগী অন্যান্য মালমশলা দিয়ে। সেখানে উপস্থিত থাকেন চিকেন লারসেন। নানা রকম মজার মজার কথা বলেন।
টেপটা শেষ হয়ে গেলে ভিসিআর বন্ধ করে শুতে গেল কিশোর। কিন্তু অস্থির একটা রাত কাটাতে হলো। ভাবনার মধ্যে কেবলই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল জুনের কথা। ঘোরের মাঝে কি বাবার কথাই বলেছিল সে? লারসেনই খাবারে বিষ মেশানোর পরিকল্পনা করেছেন? তিনিই যদি করে থাকেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার সিদ্ধান্ত তিনি কেন নিয়েছেন?
পরদিন কাঁটায় কাঁটায় একটায় বেভারলি হিলের কাছে মালটিন মিক্স স্টুডিওতে হাজির হলো রবিন আর কিশোর। দুই মিনিট পরে মায়ের গাড়িটাতে করে এল মুসা আর ফারিহা।
এই দেখ, কিশোরকে বলল রবিন। গাড়ি নেই দেখে তোমার কত অস্থিরতা। মুসারটা যে থেকেও নেই? খালি খালি তো গজগজ করো..
ও তো ওর মায়েরটা নিয়ে এসেছে।
তুমিও ইয়ার্ডেরটা নিয়ে আসতে পারো।
ওই ভাঙা পিকআপ কে চালাতে যায়, এক মুহূর্ত চুপ থাকল কিশোর। বেশ, মুসার গাড়িটা যতদিন ঠিক না হয়, চুপ থাকব। হলেই আবার শুরু করব।
তোমাকে কে কিনে নিতে মানা করেছে?
এই প্রশ্নটা করলেই চুপ হয়ে যায় কিশোর। কারণ সে যেভাবে যে জিনিস চায়, সেটা অল্প পয়সায় জোগাড় করা কঠিন। ও চায়, এমন একটা গাড়ি, যাতে অনেক ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি সাজানো থাকবে। গোয়েন্দাগিরির অনেক সুবিধে হবে। অর্ডার দিয়ে বানাতে হবে সে সব। অত টাকাও নেই, আপাতত কিনতেও পারছে না। কিন্তু ক্ষোভটা ঠিকই প্রকাশ করতে থাকে। কিংবা হয়তো ক্ষোভের মাধ্যমেই অটো সাজেশন দেয় নিজেকে, আর কিছুদিন ধৈর্য ধর, কিনব, কিনব!
স্টুডিয়োয় ঢোকার মুখে দেখা হয়ে গেল জুনের সঙ্গে। মাথায় একটা রূপার মুকুট পরেছে। আর মুকুটের ওপর অবশ্যই বসে আছে একটা রূপার মুরগী।
এসেছ, কিশোরকে দেখে হেসে বলল জুন। বাবা তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। নতুন কোন খবর আছে?
না। তবে কাল রাতে কিছু ফরচুন কুকি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে বুঝেছি, ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা।
গুড। আমার ব্রিফকেসটা যত তাড়াতাড়ি পারো বের করে দাও। ভেতরে কি ছিল এখনও মনে করতে পারছি না। তবে ওটা আমার চাই। মনে হচ্ছে ওটাতে জরুরী কিছু আছে।
তারপর তিন গোয়েন্দা আর ফারিহাকে নিয়ে চলল স্টুডিওর কাচে ঘেরা একটা অংশে, প্রোডাকশন বুদে। চিকেন লারসেনের অফিসের অনেকেই আছে ওখানে, ডন বারোজ সহ।
বিজ্ঞাপনের জন্যে সেট সাজানো হয়েছে। টেবিলে চিঠির স্তূপ, শূন্য কফির কাপ, রবারের মুরগী, রোস্ট করা মুরগীর ছবি–তৃতীয় শ্রেণীর আর্টিস্ট দিয়ে। আঁকানো হয়েছে ইচ্ছে করেই, আর হ্যালোউইন চিকেন কস্টিউম পোশাক পরা জুনের শিশুকালের একটা ছবি।
অবশেষে মাইক্রোফোনে পার্সোন্যাল অ্যাসিসটেন্টকে ডাকলেন পরিচালক, আমরা রেডি। চিকেন লারসেনকে ডেকে আনাও। দেখো, মেকআপ হয়েছে কিনা।
মিনিটখানেক পরে ঢুকলেন লারসেন। পরনে লাল জগিং স্যুট, সাদা এবং নীল স্ট্রাইপ দেয়া। ওপরের ঠোঁট আর নাক জুড়ে আটকানো রয়েছে রবারের তৈরি একটা মুরগীর ঠোঁট। হাতে রূপার তৈরি বড় একটা অ্যানটিকের ট্রে, রূপার ঢাকনা দেয়া। তীব্র আলোয় এসে সামান্য কুঁকড়ে গিয়ে বুদের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন।
আমার লোক আছে? ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আছে, মিস্টার লারসেন, পরিচালক বললেন। সুইভেল চেয়ারে বসেই ঘুরে তাকালেন কিশোরের দিকে। চিকেন লারসেনের অফিশিয়াল টেন ইয়ার অ্যানিভারসারি টি-শার্ট গায়ে দেয়ানো হয়েছে তাকে। শার্টে একটা মুরগীর ছবি আঁকা, মাথার জায়গায় মুরগীর মাথার পরিবর্তে আঁকা হয়েছে লারসেনের মুখ।
ডন বলেছে, কিশোরকে বললেন লারসেন। ড্রিপিং চিকেনের স্যাম্পল খেয়ে খুব খুশি হয়েছে। আজ সবার জন্যেই প্রচুর পরিমাণে নিয়ে আসা হয়েছে।
ফিসফিস করে মুসা বলল কিশোরের কানে, অত ভাল প্যান্টটা পরে আসা উচিত হয়নি আজ।
আরাম করে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিলেন লারসেন।
পরিচালক ঘোষণা করলেন, দয়া করে চুপ করুন সবাই। ড্রিপিং চিকেন। টেক ওয়ান!
ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন টিভি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন লারসেন।
বন্ধুরা, বলছেন তিনি। আমি, আপনাদের প্রিয় চিকেন লারসেন বলছি। আপনারা জানেন, অহেতুক আপনাদের সামনে হাজির হই না আমি। হই তখনই, এখন আপনাদের পকেট খালি করে আমার পকেট ভরানোর কোন একটা উপায় বের করে ফেলি। বিশ্বাস করুন, এই বার আগের চেয়ে অনেক বেশি খসাব আমি, কিছুতেই ধরে রাখতে পারবেন না। চাকা আবিষ্কারের সময় আমি সেখানে হাজির ছিলাম না। পেনিসিলিন আবিষ্কারের সময় ছিলাম না। এমনকি পেপার ক্লিপ জাতীয় জিনিসগুলো যখন আবিষ্কার হয়, তখনও সেখানে হাজির ছিলাম না। ইতিহাসের অইসব বিস্ময়কর মুহূর্তগুলোতে আমার কোন প্রয়োজন পড়েনি কিংবা হয়তো প্রয়োজন হয়েছিল, খবরও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই খবর আমাকে বলতে ভুলে গেছে আমার সেক্রেটারি। আর এই সন্দেহেই আমি তাকে চাকরি থেকে বিদেয় করে দিয়েছি। হাহ হাহ হা! তবে আজকে আমি আর শুধু ইতিহাস তৈরি করতেই যাচ্ছি না, ইতিহাসকে খেয়ে ফেলতে চলেছি।
রূপার ট্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরালেন লারসেন। ধোঁয়া উঠতে লাগল স্তূপ করে রাখা ড্রিপিং চিকেন থেকে। খাবারের চেহারা দেখেই উহ আহ শুরু করে দিন প্রোডাকশন বুদের লোকেরা।
একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে গেলেন লারসেন। এগিয়ে গেল ক্যামেরা, কাছে থেকে ছবি তোলার জন্যে। ঢোক গিলল তিন গোয়েন্দা সত্যিই কি তিনি খাবেন?
সেই সভ্যতার গোড়া থেকেই যে কাজ করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ পারেনি, সেটাই সফল করেছি আমি। সৃষ্টি করেছি ড্রিপিং চিকেন। প্রতি কামড় খাবার রসময় করে তুলবে রসনাকে। আরও ব্যাপার আছে। প্রতিটি স্যান্ডউইচে ভেতরে একটা বিশেষ জিনিস ভরে দিতে বলেছি আমার রাঁধুনিকে। এমন কিছু, যা লোকে কল্পনাই করতে পারবে না। দেয়া হয়েছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, দেখতে চাইছি, এখনই দোকানে ছুটছেন কেনার জন্যে। কিনে গপগপ করে গিলতে থাকুন। এই ভাবে…
বলেই হাঁ করে বিরাট এক কামড় বসালেন লারসেন। বড় একটুকরো স্যান্ডউইচ কেটে নিয়ে চিবাতে লাগলেন। রঙিন রস গড়াতে শুরু করল ঠোঁটের দু কোণ থেকে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দরাজ হাসি হাসলেন।
কাট! চিৎকার করে আদেশ দিলেন পরিচালক। দারুণ হয়েছে!
কয়েকটা আলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেয়া হলো। উত্তেজনা কমে গেল বুদের লোকের। ফারিহা বলল গোয়েন্দাদেরকে, ঐতিহাসিক একটা লেকচার দিলে লারসেন!
কিন্তু ওর কথায় কান নেই তিন গোয়েন্দার। স্টুডিওর কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে লারসেনের দিকে। চিবানো ড্রিপিং চিকেন গেলেননি তিনি মুখ থেকে বের করে ফেলে দিলেন ওয়েস্ট বাস্কেটে।
মনে হলো, যেন তিনি জানেন বিষ রয়েছে ওই খাবারে। মানুষের শরীরে জন্যে ক্ষতিকর, মারাত্মক বিষ।
৯
টেলিভিশনের ব্যাপারে ভালই জ্ঞান আছে কিশোরের। বুঝতে পারছে, ডিপি চিকেনের শুটিং শেষ হয়নি। তাই বলে এটাও ভাবেনি, আরও পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলবে। আরও বিশবার অভিনয় করলেন লারসেন। প্রতিবারেই বড় করে কামড় বসালেন স্যান্ডউইচে, প্রতিবারেই পরিচালক কাট বলার পর মুখ থেকে বের করে ফেলে দিলেন।
সব শেষ হওয়ার পর লারসেন চিৎকার করে বললেন, এসো, এবার পার্টি হোক! উপস্থিত সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন ড্রিপিং চিকেন চেখে দেখার জন্যে। একপাশে একটা মাইক্রোওয়েভ রাখা আছে। খাবার গরম করে নেয়ার জন্যে। টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে বুদে যত ধরনের লোক আছে সবাই ছুটে এল ওই খাবার খাওয়ার জন্যে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
কেউ মারা গেল না। কারও পেট ব্যথা করল না, পেট চেপে ধরল না কেউ। বিষক্রিয়ার কোন লক্ষণই দেখল না। এক ধরনের গোঙানিই শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে, আহ উহ করছে লোকে, সেটা খাবারের স্বাদের কারণে।
ধীরে ধীরে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল কিশোর, যেখানে রূপার ট্রেতে রাখা আছে ড্রিপিং চিকেন। আর মাত্র দুটো স্যান্ডউইচ বাকি। একটা নেয়ার জন্যে সবে হাত বাড়িয়েছে, কাঁধের ওপর দিয়ে রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, কে কে স্যান্ডউইচ নেয়নি, লক্ষ্য করেছ?
ঘুরে তাকাল কিশোর। ডন বারোজ আর চিকেন লারসেন, রবিন বলল। কেন খাচ্ছে না? দ্বিধা করতে গিয়েই সুযোগটা হারাল কিশোর। অল্প বয়েসী এক মহিলা এগিয়ে এসে এক্সকিউজ মী বলে সরিয়ে দিল তাকে প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে নিল প্লেটের অবশিষ্ট দুটো স্যান্ডউইচ। ভাবছিলাম, একটা নিয়ে যাব, আমার এক বন্ধুর জন্যে। কিন্তু এতই মজা, নিতে ইচ্ছে করছে না, বলে কিশোরের মুখের ওপরই কামড় বসাল একটাতে। আরেকটাও খাবে, বোঝা যাচ্ছে।
পরস্পরের দিকে তাকাল রবিন আর কিশোর। নিরাশার দৃষ্টিতে।
কোনমতে কণ্ঠস্বর শান্ত রেখে বলল, থাক, অত ভাবনা নেই। খেতে ইচ্ছে করলে যখন তখন গিয়ে লারসেনের রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে আসতে পারব।
শেষ হয়ে আসছে পার্টি। বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। বদ্ধ জায়গায় থেকে দম আটকে আসছিল, খোলা বাতাসে বেরিয়ে যেন বাঁচল। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে ফারিহা আর জুনের জন্যে।
বেরিয়ে এল দুজনে। কথা বলতে বলতে আসছে। কিশোরদের কাছে এসে ফারিহা তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি জুনদের বাড়িতে যাচ্ছি। কাপড়গুলোর জন্যে।
এটা ভাল লাগল না কিশোরের। সে চায়, কোন একটা ছুতে রেখে দিক ফারিহা, যাতে দরকার পড়লেই জুনের ওখানে যেতে পারে। জুন আরেক দিকে ফিরতেই মাথা নেড়ে ফারিহাকে ইশারা করল সে। বুঝল মনে হলো ফারিহা। কারণ কিশোরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকাল। তারপর গিয়ে উঠল জুনের গাড়িতে। গাড়ি বটে একখান, মুসা বলল। চিকেনমাোবাইল নাম রেখে দেয়া যায়। অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ক্যাডিলাক কনভারটিবলটা। হলুদ আর কমলা রঙের বডি। হুডের ওপর বড় করে আঁকা রয়েছে মুরগীর ছবি আর চিকেন লারসেন রেস্টুরেন্টের নাম। সামনের গাড়িকে সরার জন্যে হর্ন টিপলেন লারসেন। কুকুরুককুক করে মোরগের ডাক দিয়ে উঠল বাঁশিটা।
যাচ্ছেন কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।
হয়তো ডিনার খেতে, জবাব দিল মুসা।
মুসা, পিছু নেয়া দরকার, গাড়িটার দিকে তাকিয়েই রয়েছে কিশোর। তুমি যাও। আমি আর রবিন ডন বারোজের পিছু নেব। দেখি কে কোথায় যায়? মুসা রওনা হয়ে গেল। রবিনের ফোক্সওয়াগনে উঠল কিশোর। ডন গাড়ি নিয়ে রওনা হতেই তার পিছু নিল। ওর গাড়িটাও বিচিত্র। লম্বা শরীরের একটা লিঙ্কন টাউন কার। দুই পাশে আঁকা লারসেন রেস্টুরেন্টের মনোগ্রাম।
কয়েক ঘণ্টা ধরে তার পেছনে লেগেই রইল রবিন আর কিশোর। প্রথমে সাগরের ধারের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার খেলো ডন। একা। তারপর গেল শুগারলোফ ক্যানিয়নে পাহাড়ের কোলে তৈরি একটা ছোট বাড়িতে। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। আরও বাড়িঘর আছে ওখানে। কিন্তু এত দূরে দূরে, দেখে মনে হয় ওখানে যারা বাস করে তারা পড়শীদের এড়িয়ে চলে। কিংবা নিঃসঙ্গ থাকতে ভালবাসে। ডনের বাড়ির নিচে পাহাড়ের উপত্যকায় গাড়ি রাখল রবিন। দুজনেই ভাবছে, এরপর কি করবে?
ভেতরে তো ঢুকছে না, রবিন বলল। দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে একটা ঘন ঝোপে ঢুকে নজর রাখছে। পেছনে চলে যাচ্ছে কেন?
চলো, দেখি, উঠে দাড়াল কিশোর।
আরেকটা মিনিট সময় দিল ওরা ডনকে। তারপর এগোল। লম্বা ড্রাইভওয়ে। পেরিয়ে বাড়ির পাশ ঘুরে সরু একটা পথ ধরে চলল ডন যেদিকে গেছে। বাড়ির ভেতর অন্ধকার। পেছন দিকে এসে দেখল, বাইরেটা আলোকিত করার ব্যবস্থা রয়েছে গাছের ডালে বাল্ব ঝুলিয়ে।
বেড়া, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। আকার-আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে। ওপাশে সুইমিং পুল আছে।
তার কথা শেষও হলো না, ঝপাং করে শব্দ হলো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
আয়, জলদি আয়, ডনের গলা শোনা গেল। ওরকম করছিস কেন?.. ওয়ান-টু-থ্রী..নাম!
আরেকবার ঝপাং শোনা গেল। ওর সঙ্গে কারা আছে? রবিনের প্রশ্ন। তাকাল কিশোরের দিকে। চলো, দেখি।
মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল রবিন। এগোল দুজনে। আস্তে করে গেট খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। একটা আউটডোর শাওয়ার আর স্নানের উপযোগী ছোট্ট একটা ঘর আড়াল করে রেখেছে পুলের গভীরতম অংশটা। পা টিপে টিপে ঘরটা দিকে এগোল দুজনে। পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখার ইচ্ছে।
হঠাৎ প্লাস্টিকের একটা হোস পাইপে পা বেধে গেল কিশোরের। হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চোখের পলকে আবিষ্কার করে ফেলল দুই গোয়েন্দা, কাদেরকে গোসল করাচ্ছিল ডন। প্রচন্ড ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। পানিতে দাপাদাপি করে দ্রুত সাঁতরে উঠে এল কুকুরদুটো। যা তা কুকুর নয়। ডোবারম্যান পিনশার!
ধর! ধর! চিৎকার করে আদেশ দিল ডন। নিশ্চয় চোর!
হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে গেটের দিকে ছুটল কিশোর। কনুই যে ছড়ে গেছে খেয়ালই করল না। ওর আগেই ছুটতে শুরু করেছে রবিন। ছুটছে আর চিৎকার করছে সাহায্যের জন্যে। কিন্তু কে শুনবে ওদের চিৎকার? সব চেয়ে কাছের পড়শী রয়েছে মাইলখানেক দূরে।
বাড়ছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। গেটটা কোথায়? সরিয়ে ফেলল নাকি কেউ? আসলে, এতই ভয় পেয়েছে ওরা, সামনে কয়েক ফুট দূরের গেটটাও যেন চোখে পড়ছে না। ওদের মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে কেবল দৌড়েই চলেছে, পথের শেষ আর মিলছে না।
অবশেষে গেটের কাছে পৌঁছল রবিন। কিশোর বেরোতেই ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিল ওটা। ভেতরে আটকা পড়ল কুকুরগুলো। একটা মুহূর্ত নষ্ট করল না ওরা। গাড়ির দিকে ছুটল।
এবারও আগে পৌঁছল রবিন। ড্রাইভিং সীটে বসেই ঠেলে খুলে দিল প্যাসেঞ্জার সীটের দরজা। কিশোর উঠে দরজা লাগানোর আগেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করে দিল।
চলতে শুরু করল গাড়ি। ওফ, বড় বাঁচা বাঁচলাম! এখনও হাঁপাচ্ছে রবিন।
কথা বলতে পারছে না কিশোর, এতই হাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়বে হৃৎপিন্ডটা।
পুরোপুরি শান্ত হতে হতে গাড়িটা সরে চলে এল কয়েক মাইল দূরে। বলল, লাভ হলো না। দেখতে পারলাম না কিছু। একটা কথাই জেনে এলাম, ডনের বাড়িতে সিকিউরিটি খুব কড়া। কেন? চলো, হেডকোয়ার্টারে। ওখানে বসেই আলোচনা করব।
অনেকক্ষণ পর ওয়ার্কশপে বসে ডনের বাড়িতে ঢোকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা মুসা এবং ফারিহাকে জানাল কিশোর আর রবিন।
এরপর মুসার রিপোর্ট করার পালা এল। সে বলল, চিকেন লারসেনকে অনুসরণ করে তো গেলাম। ভেগ আউট রেস্টুরেন্টটা চেনো তো? ওখানে ঢুকল। একটা শেফস সালাদ কিনে নিয়ে সোজা গেল ফেলিক্স আরোলার অফিসে।
মিরাকল টেস্টে? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
হ্যাঁ। আরোলার অফিসটা লং বীচে। ল্যাবরেটরি আছে, একটা গুদামঘর আছে।
নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেমন?
দারোয়ানগুলোকে তো তেমন কড়া মনে হলো না। নিরীহ, গোবেচারা চেহারা। তবে ঢোকার মুখে সিকিউরিটি সিসটেম ভীষণ কড়া। অনেকগুলো অ্যালার্ম আর একটা কম্পিউটার কীপ্যাড পেরিয়ে যেতে হয়।
ফারিহার দিকে তাকাল কিশোর। কিছু জিজ্ঞেস করল না, তবে ভঙ্গিটা তোমার-কি-খবর?
ব্যবস্থা করে এসেছি, মাথা কাত করে হাসল ফারিহা। কাপড়গুলো আমাকে ফিরিয়ে দিল জুন। কি করি ভাবতে লাগলাম। শেষে কায়দা করে ওগুলোতে কফি ফেলে দিলাম। যেন হঠাৎ করে হাত ফসকে পড়ে গেছে এমন ভাব করলাম। ও কিছু বোঝেনি। আহা উহু করল খানিক। শেষে বলল, ধুয়ে দেবে। কিছুতেই আমাকে আনতে দিল না। কাল আবার যাব আনার জন্যে।
পরের দিন গেলেও পারো, কিশোর বলল। কিংবা তার পরের দিন। যাক, ভাল কাজই করে এসেছ, হঠাৎ ওয়ার্কশপের দরজার দিকে ঘুরে তাকাল সে। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করল মুসাকে। তার সঙ্গে যেতে বলল। দ্রুত এগিয়ে গেল দুজনে। দুপাশের দরজার কাছে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। তারপর হ্যাঁচকা টানে তার কাছের দরজাটা খুলে ফেলল কিশোর।
বাইরে অন্ধকার। কেউ নেই। জুতোর বাক্সের চেয়ে বড় একটা বাক্স পড়ে আছে। বাদামী কাগজে মোড়া। লাল সুতো দিয়ে বাঁধা। হাতে লেখা একটুকরো কাগজ লাগানো রয়েছে; কিশোর পাশার জন্যে।
পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। জুতোর ডগা দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। তারপর ঠেলে সরিয়ে দিল।
বেশ ভারি।
ঝুঁকে তুলে নিল বাক্সটা কিশোর। হ্যাঁ, ভারিই।
খুলবে নাকি? কিশোরকে ওটা বয়ে আনতে দেখে জিজ্ঞেস করল রবিন।
না, খুলো না! বাধা দিল ফারিহা। বোমাটোমা থাকতে পারে! একটা মিনিট চুপ করে রইল কিশোর। কান পেতে শুনছে বাইরে কোন শব্দ শোনা যায় কিনা। অনুমান করার চেষ্টা করছে বাক্সের ভেতর কি আছে। বাইরে কি কেউ অপেক্ষা করছে এখনও? সতর্ক রয়েছে মুসা আর রবিন। টান টান হয়ে আছে স্নায়ু। বিপদ দেখলেই প্রতিরোধ করার জন্যে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। সুতোটা খুলল। হাতের তালুতে রেখে আরেকবার আন্দাজ করার চেষ্টা করল। যা-ই আছে, বাক্সটা কাত করলেই নড়ছে ভেতরে। আস্তে আস্তে বাদামী কাগজের মোড়ক খুলল সে। বুঝতে পারেনি, মুখের দিকটা কাত করে রেখেছিল। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ পড়ল পায়ের ওপর।
চিৎকার করে উঠল ফারিহা।
কিশোরের মুখ সাদা হয়ে গেল।
কিশোরের জুতোয় পড়েছে কালচে লাল রক্তের ফোটা। বাক্সের ভেতর থেকে বেরোল একটা মরা মুরগী, সদ্য গলা কেটে খুন করা হয়েছে। ভেতরে একটুকরো কাগজ পাওয়া গেল, রক্তের ছোপ লেগে আছে।
কাগজটার ভাঁজ খুলল কিশোর। লেখা রয়েছেঃ
কিশোর পাশা-
তোমার স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল। বেশ মোটাতাজাও হয়েছ, জবাই করার উপযুক্ত। মুরগী মোটাতাজা হলেই তো জবাই করে লোকে।
খাঁচার বাইরে আছ, বাইরেই থাকো। ঢোকার চেষ্টা কোরো না।
অন্যের ব্যাপারে নাক গলিও না। শেষবারের মত সতর্ক করলাম!
১০
থ্রপ! থ্রপ! থ্রপ! গ্যারেজের দরজায় বার বার বলটা ছুঁড়ে মারছে মুসা। সুন্দর সকাল। উজ্জ্বল রোদ। কয়েকবার ওরকম করে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠে জালের ভেতর দিয়ে বলটাকে গড়িয়ে দিল সে। ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। অ্যাই, কিশোর, কি ভাবছ? খেলবে?
আমি ভাবছি কাল রাতের কথা। গলাকাটা মুরগীর কথা।
জানি আমি। হপ্তাখানেক দুঃস্বপ্ন দেখার জন্যে যথেষ্ট। সে জন্যেই তো খানিকটা ব্যায়াম করছি। ব্যায়াম দুশ্চিন্তা দূর করে। তোমার জুতো থেকে রক্ত মুছেছ?
বীভৎস দৃশ্যটার কথা মনে পড়ল আবার কিশোরের। কাটা গলা থেকে টপ টপ ঝরছে রক্তের ফোটা। মানুষের গলা কাটলেও ওরকম করেই ঝরবে। যেমন ধরা যাক, তার…।
আরেকবার বলটা নিয়ে নেটের দিকে দৌড়ে গেল মুসা।
দুশ্চিন্তাটা আপাতত থাক না, কিশোর বলল। ব্যায়াম না হয় না-ই করলাম। ভাবছি, কে পাঠাল ওটা? চিকেন লারসেনের কাছ থেকে দূরে থাকতে কে বলছে আমাকে? লারসেন নিজে এই কাজ করেছে এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। তিনি বরং আমাদেরকে কাছে ঘেঁষতেই বলেন। আমাকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করানোরও ইচ্ছে আছে।
কিশোর, জবাবগুলো কি আমার কাছে চাইছ? মাথা নাড়ল, আমাকে মাপ করে দাও। ওকাজগুলো তুমিই সার। ধাঁধা সমাধানের ব্যাপারে যে আমি কত বড় এক্সপার্ট, ভাল করেই তো জানো।
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলটা নিল মুসার হাত থেকে। তারপর ছুঁড়ে মারল জাল সই করে। নেটের ধারেকাছে গেল না বল।
হচ্ছে, ভরসা দিল মুসা। একটু প্র্যাকটিস করলেই পারবে…
এক মাইল দূর দিয়ে গেল, আর তুমি বলছ পারব…
ড্রাইভওয়েতে ঢুকল রবিনের ফোক্সওয়াগন। ভটভট ভটভট করছে ইঞ্জিন। হর্ন বাজাল একবার সে। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল।
অ্যাই, কেমন আছ তোমরা? এগিয়ে এসে বলল সে। সকালের কাগজ দেখেছ? ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, পয়লা পাতার বিজনেস সেকশনটা দেখো।
বল নিয়ে ব্যস্ত হলো মুসা। বার বার জালের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগল।
কিশোর পড়তে লাগল লেখাটা।
চমৎকার, কয়েক মিনিট পর মুখ তুলে বলল সে। একেবারে সময়মত দিয়েছে। তাহলে এই ব্যাপার। লারসেনের রেস্টুরেন্ট কেনার জন্যে খেপেই গেছে মনে হচ্ছে হেনরি অগাসটাস। হমম…একটা ফোন করা দরকার।
পাঁচ মিনিট পর মুসাদের বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। মুখে বিচিত্র হাসি।
কাকে করেছিলে? জানতে চাইল মুসা।
হেনরি অগাসটাসকে। মনে হলো, ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার সময় হয়েছে। চিকেন লারসেনের রেস্টুরেন্ট কিনে নিতে না পারলে খাবারে বিষ মিশিয়ে সে তার ব্যবসা নষ্ট করার চেষ্টা করতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
সে কি বলল?
তার সঙ্গে কথা হয়নি। নেই অফিসে। সেক্রেটারি বলল, শহরের বাইরে গেছে। কোথায়, জানো?
আমি জানব কি করে? আমি তো এখানে বল খেলছিলাম।
পিটালুমায়, ঘোষণা করল যেন কিশোর। স্যান ফ্রান্সিসকোর উত্তরে। ওখানেই চিকেন লারসেনের মুরগীর খামার।
ঘণ্টাখানেক পরেই স্যান ফ্রান্সিসকো যাওয়ার প্লেনে চাপল কিশোর আর মুসা। জুনকে ফোন করেছে রওনা হওয়ার আগে। তদন্ত করতে যা খরচ হবে, দিতে রাজি হয়েছে জুন। ও কল্পনাও করতে পারেনি, ওর বাবার ব্যাপারেও খোঁজ নিচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
রবিন সঙ্গে আসতে পারেনি। সেই একই কারণ। অফিসে কাজ বেশি, ঝামেলা। দুটো বিবাহ উৎসবে একই ব্যান্ডের বাজনা বাজানোর কথা একই দিনে, ব্যবস্থা করাটা বেশ কঠিন। সময়ের একটু হেরফের হলেই সব পন্ড হয়ে যাবে। আর ব্যর্থতার দোষটা তখন এসে পড়বে ওর ঘাড়ে। এসব চাপ যখন পড়ে, তখনই ভাবতে আরম্ভ করে সে, ট্যালেন্ট এজেন্সির চাকরিটা ছেড়েই দেবে।
স্যান ফ্রান্সিসকো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল কিশোর। মুসাকে নিয়ে চেপে বসল। ওখান থেকে উত্তরে ঘণ্টাখানেকের পথ পিটালুমা। চিকেন লারসেনের খামার খুঁজে বের করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হলো। বিরাট এক র্যাঞ্চ ছিল একসময়ে ওটা। ওই এলাকার সবাই চেনে।
দেখতে মোটেও মুরগীর খামারের মত লাগল না। বরং মোটরগাড়ির কারখানা বললেই বেশি মানায়। বড় বড় দুটো বাড়ি আছে, দুটোই দোতলা, আর অনেক বড়। ঘিরে রেখেছে তারের বেড়া।
বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। শনিবার বলেই বোধহয় কাউকে দেখা গেল না। গেটে পাহারা নেই। নিজেরাই গেটের পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকল। প্রথম বাড়িটার দিকে এগোল পঞ্চাশ গজ মত। চট করে তাকিয়ে দেখে নিল এদিক ওদিক, কেউ দেখছে কিনা। তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না ওরা। কিংবা বলা যায় নিজের কানকে। ভেতরে অনেক মুরগী থাকবে জানত। কিন্তু এত বেশি থাকবে, আর ওগুলোর মিলিত কক কক এত জোরাল হবে, কল্পনাই করতে পারেনি। কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। গ্রীন হাউসের মত কাচের ছাত দিয়ে আলো আসছে। পুরো এয়ারকন্ডিশন করা। ফলে তাপমাত্রার কোন হেরফের হচ্ছে না।
দরজার কাছে দেয়ালে অনেকগুলো হুক লাগানো। তাতে ঝুলছে লারসেন কোম্পানির পোশাক। যারা মুরগীর সেবা-যত্ন করে তাদের ইউনিফর্ম। দুটো নামিয়ে নিয়ে পরে ফেলল দুজনে। কোম্পানির কর্মচারীর ছদ্মবেশে শুরু হয়ে গেল খোঁজাখুঁজি।
প্রথমেই যেটা বুঝতে পারল, তা হলো, এই বিল্ডিঙে মানুষের চলাফেরার বড়ই অসুবিধে। মুরগীর পাল তো আছেই, তার চেয়ে বেশি অসুবিধে করছে মেঝেতে বসানো লাল প্লাস্টিকের পাইপ। কয়েক ইঞ্চি পর পরই। যেন লাল খুঁটির মত বেরিয়ে আছে, কিংবা গজিয়ে আছে। হাঁটার সময় ওগুলো ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে যেতে হয়। খাবার সরবরাহ করা হয় ওসব পাইপ দিয়ে। প্রতিটি পাইপের মুখের কাছে কায়দা করে লাগানো রয়েছে লাল প্লাস্টিকের পাত্র, আঠারো ইঞ্চি পর পর। পানির ব্যবস্থাও করা হয়েছে পাইপের সাহায্যে। পানি খেতে অসুবিধে হয় না মুরগীগুলোর। পুরো ব্যবস্থাটাই এমন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা মুরগীগুলো নিজেই সারতে পারে, বাইরের কারও সাহায্য প্রয়োজন হয় না। সে জন্যেই কোন লোককে দেখা গেল না আশপাশে।
অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে ঘরটাকে। একেক ভাগে রয়েছে একেক বয়েসের আর আকারের মুরগী। এক জাতের সঙ্গে আরেক জাত মিশতে পারছে না কোনমতেই। এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে ঘুরে বেড়াতে লাগল দুজনে।
কিছু কিছু মুরগী খুব অদ্ভুত, তাই না? মুসা বলল। ওই যে ওটাকে দেখো। ডানা কি রকম ছোট। এত ছোট ডানার মুরগী আর দেখিনি।
একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় এটা করা হয়, কিশোর বলল। একে বলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এক জাতের সঙ্গে আরেক জাতের প্রজনন ঘটিয়ে, খাবারের পরিবর্তন করে ওরকম করা হয়। এতে ডানা ছোট হয়ে যায়, বুকের মাংস যায় বেড়ে। অনেক বেশি মাংস পাওয়া যায় ওগুলো থেকে।
এমন ভারি করা করেছে, নড়তেই তো পারছে না…
এই সময় তিনজন লোক ঢুকল ঘরে। চার পাশে তাকাতে শুরু করল। খানিক আগে যে ছোট জাতের মুরগীগুলোর কাছে ছিল কিশোর আর মুসা, সেখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা।
কুইক, কিশোর বলল। কাজ করার ভান কর!
কিছুই তো করার নেই। মেশিনেই করছে।
তাহলে লুকিয়ে পড়!।
বেড়া দিয়ে আলাদা করা এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগকে। একটা বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দুজনে। বেড়াটা নিচু। ইচ্ছে করলে মাথা তুলে দেখতে পারে লোকগুলো কি করছে। বিরক্ত করতে লাগল মুরগীগুলো। কেবলই পায়ের ওপর এসে পড়ছে। অযথাই ঠোকর মারছে, খাবার আছে মনে করে।
বেরোতে হবে এখান থেকে, আচমকা বলে উঠল। যতবার সাদা মুরগীগুলো দেখছি, কাল রাতের ওটার কথা মনে হয়ে যাচ্ছে আমার।
এগিয়ে আসছে লোকগুলো। একজনের গায়ে লাল শার্ট, খাকি প্যান্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ, তাতে লারসেন মনোগ্রাম আর সুতো দিয়ে তোলা লাল অক্ষরে নাম লেখা রয়েছে ডরি। অন্য দুজনকে এই পরিবেশে একেবারেই মানাচ্ছে না। গাঢ় নীল স্যুট পরনে, একজনের চোখে বৈমানিকের সানগ্লাস। এই লোকটার বয়েস কম। খাটো করে ছাঁটা কালো চুল। সানগ্লাসটা খুললে দেখা গেল নীল চোখ যেন জ্বলছে।
ডরি বলল, মিস্টার অগাসটাস, আর কিছু দেখার প্রয়োজন আছে আপনার?
হেনরি অগাসটাস? কান খাড়া করল কিশোর। একটা কথাও এড়াতে চায় না।
ডরির দিকে তাকাল হেনরি। তারপর অন্য লোকটার দিকে। না, অনেক দেখেছি, কণ্ঠস্বরেই বোঝা যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। নোট লেখ। অনেক কিছু বদলাতে হবে এখানকার। দেখতেই পাচ্ছি।
লিখছি, বলে তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে নোটবুক আর কলম বের করল নীল স্যুট পরা অন্য লোকটা।
আবার সানগ্লাসটা নাকের ওপর বসাল হেনরি। ডরিকে জিজ্ঞেস করল, প্রোডাকশন কেমন তোমাদের?
হপ্তায় পঞ্চাশ হাজার করে জবাই করার উপযোগী পাওয়া যায়।
নাহ, যথেষ্ট নয়, হেনরি বলল। দ্বিগুণ করা দরকার।
কথাটা লিখে নিল তার সহকারী।
মিস্টার লারসেন বলেন ভিড় বাড়িয়ে ফেললে মুরগীর অসুবিধে হবে, ডরি বলল।
এটা মুরগীদের রেস্ট হাউস নয়, হাসল হেনরি। কুৎসিত লাগল হাসিটা। এটা কারখানা। যত বেশি প্রোডাকশন দেয়া যাবে, তত বেশি টাকা আসবে।
আরেকবার ঘরটায় চোখ বোলাল হেনরি। মাথা নাড়ল। তারপর নিচু হয়ে খাবারের পাত্র থেকে একমুঠো দানা তুলে নিয়ে দেখল। ডরির দিকে তাকাল আবার। খাবারও বদলাতে হবে। আমি নিজে দেখব সেদিকটা। কি দেব ভেবেই রেখেছি।
লেখা শেষ করে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তার সহকারী। দরজা খুলে ধরল। লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে গিয়ে বাইরে দাঁড়ানো একটা মার্সিডিজ গাড়িতে উঠল হেনরি। গাড়িটা ঘুরে চলে যাওয়ার সময় ওটার লাইসেন্স প্লেটের দিকে তাকাল কিশোর।
লেখা রয়েছেঃ প্লাকার-১।
১১
লোকটার মধ্যে মানবিকতার ছিটেফোঁটাও নেই, কিশোর বলল। দক্ষিণে স্যান কাউন্টারের ফ্র্যান্সিসকোর দিকে চলেছে ওরা। প্রচন্ড স্বার্থপর।
যা বলেছ। তবে সঙ্গে জানোয়ার শব্দটা যোগ করতে পারতে।
আর তেমন কোন কথা হলো না। নীরবে গাড়ি চালাল মুসা। সাতটা বাজে। শহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে রয়েছে। আচমকা চিৎকার করে উঠল কিশোর, রাখ! রাখ!
কি হয়েছে? পথের পাশে গাড়ি নামিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল মুসা। তারপর চোখে পড়ল নির্দেশকটা। একটা বাড়ির লাল রঙ করা ছাতে বসানো একটা মুরগী। ভেতরে জ্বলছে নিয়ন আলো। চিকেন লারসেন রেস্টুরেন্টের চিহ্ন।
সেদিকে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গেল মুসা। সে পার্ক করে বেরোতে বেরোতে রওনা হয়ে গেছে কিশোর। একটা সেকেন্ড দেরি করেনি।
দরজায় দাঁড়িয়ে লম্বা দম নিল। খাবারের সুগন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস।
আরে সর না, মুসা বলল। জায়গা দাও। লোকে ঢুকবে তো।
কাউন্টারের কাছে এগিয়ে গেল দুজনে। সতেরো-আঠারো বছরের একটা মেয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল। গায়ে লাল শার্ট। পরনে খাকি প্যান্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ। সামনের দিকের বাড়তি অংশটা মুরগীর ঠোঁটের মত। ক্যাপে লাল সুতোয় তোলা লেখা পড়ে বোঝা গেল ওর নাম নেলি।
মোলায়েম ভদ্র গলায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, কি দেব?
বিষাক্ত খাবার, বিড়বিড় করল মুসা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে।
কী?
আঁ! ও, মুরগী। আর কি। এখানে তো ওটাই স্পেশাল। কিশোরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল মুসা, খাবে তো? তোমার পেট…
চুলোয় যাক পেট। অনেক সয়েছি। আর না। এত সুগন্ধ, না খেয়ে আর পারব না।
জানালার কাছে একটা টেবিল বেছে নিল দুজনে। খাবার এল। কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গে যার ঝাপিয়ে পড়ার কথা সে-ই ছুঁল না। হাত গুটিয়ে বসে রইল মুসা।
কি ব্যাপার? ভুরু নাচাল কিশোর।
বলা যায় না। এখানকার খাবারেই হয়তো বিষ মিশিয়েছে। যদি থাকে?
তা থাকতেই পারে। তবে জীবনটাই ঝুঁকিপূর্ণ। রিস্ক তো নিতেই হবে, বলে আর কথা না বাড়িয়ে মুরগীর মাংসে কামড় বসাল কিশোর।
শ্রাগ করল মুসা। তারপর সে-ও আর দ্বিধা করল না।
এই কেসের সমস্ত রহস্যের সূত্র লুকানো রয়েছে জুনের ব্রিফকেসে, চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর। আমার বিশ্বাস। কি ছিল জানতে পারছি না। ওর অ্যামনেশিয়া না কাটলে বলতে পারবে না। যে লোকটা বিষ মেলাতে চায় সে জানে আমরা এ কেসের তদন্ত করছি। আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে সরাতে না পারলে তার পরিকল্পনা বদল করবে। সময়টা এগিয়ে নিয়ে আসবে।
তো?
তো, আমাদেরকেও তাড়াতাড়ি রহস্যটা ভেদ করতে হবে। তিনজনকে সন্দেহ করি আমরা আপাতত। ওদের নিয়েই আলোচনা করা যাক।
করো। মুসা জানে, আলোচনা এবং বিশ্লেষণ দুটোই কিশোর করবে, সে শ্রোতা মাত্র।
প্রথমেই ধরা যাক, কেন অপরাধ করে লোকে। কোন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। ধরলাম, এ ক্ষেত্রে চিকেন লারসেন কাজটা করতে চাইছেন। তার পক্ষে বিষ মেশানো খুব সহজ। মুরগীর খাবারে কিছু মিশিয়ে দিতে পারেন। কিংবা মুরগী দিয়ে খাবার তৈরি করার সময় মাংসে মেশাতে পারেন।
মাংস মুখে পুরতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেল মুসা। তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। তারপর রেখে দিল প্লেটে।
কিন্তু চিকেন লারসেনের উদ্দেশ্য কি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। মোটিভ?
কি আর? পাগল!
এতটাই পাগল, যে লাখ লাখ মানুষকে মারবেন? নিজের মেয়েকে অ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলতে চাইবেন?
আমি কি করে জানব? কিন্তু গলা কেটে আর কে মুরগী পাঠাতে যাবে আমাদের কাছে?
যে কেউ পারে। বাজার থেকে কিনে নিলেই হলো। হেনরি অগাসটাসের কথা ধরতে পারি আমরা। তার মোটিভ খুব জোরাল। লারসেনের বদনাম করে দিয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। নিজের ব্যবসা বাড়ানোর জন্যে। পিটালুমায় মুরগীর ঘরে ঢুকে আজ একটা কথা বলেছিল, খেয়াল করেছ? মুরগীর খাবারের ব্যাপারটা সে নিজে দেখবে। হতে পারে, খাবারে বিষ মেশানোর কথাই বলেছে। এমন কিছু, যেটা মুরগীর তেমন ক্ষতি না করলেও মানুষের করবে। খামারটা না কিনেও যে কেউ করতে পারে কাজটা। যে কেউ ঢুকতে পারে। ইচ্ছে করলে আমরাও মিশিয়ে দিতে পারতাম। কেউ বাধা দেয়ার ছিল না।
বেশ, দুজন গেল। আরেকজন কে?
মিস্টর এক্স। যাকে আমরা চিনিই না এখনও।
সন্দেহভাজনদের নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করল ওরা। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল। গাড়ির দিকে এগোল।
স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। জায়গাটা কুয়াশার জন্যে বিখ্যাত। ইতিমধ্যেই নামতে আরম্ভ করেছে। ঘিরে ফেলেছে গোল্ডেন গেট ব্রিজকে। চোখে পড়ছে কেবল ব্রিজের দুটো টাওয়ারের ওপরের অংশ আর একেবারে নিচে চলমান যানবাহন। মাঝখানটা ফাঁকা, কুয়াশার জন্যে চোখে পড়ে না, যেন কিছুই নেই ওখানটায়।
স্যান ফ্রান্সিসকোর সাতটা পাহাড়েরও একই অবস্থা। চূড়া আর গোড়ার উপত্যকা চোখে পড়ে, মাঝখানটা অদৃশ্য। আরও অনেকবার দেখেছে মুসা। তার কাছে ব্যাপারটা একটা বিরাট রহস্য। এরকম কেন হয়? মধ্যগ্রীষ্মের প্রতি রাতেই ঘটে এই একই কান্ড।
রেডিও অন করে দিল সে। রক মিউজিক বাজছে একটা স্টেশনে।
বিমান বন্দর থেকে মাইল পনেরো দূরে থাকতে অস্বস্তিতে পড়ল। বার বার রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাচ্ছে। বলল, পেছনে দেখো। একটা লাল রঙের ক্যাভেলিয়ার।
তাতে কি? কিশোরের প্রশ্ন।
মনে হয় আমাদের অনুসরণ করছে।
কে করবে? ভাবতে লাগল কিশোর। ওরা যে স্যান ফ্রান্সিসকোয় এসেছে একথা কেউ জানে না। কিন্তু মুসার সন্দেহ গেল না কিছুতেই। অবশেষে কিশোর বলল, রাখ তো। দেখি।
গতি কমাল মুসা। দ্রুত এগিয়ে এল লাল গাড়িটা। আরেকটু হলেই বাম্পারে বাম্পারে লেগে যাবে। ভেতরে কে আছে দেখার চেষ্টা করল কিশোর। পারল না। হেডলাইটের আলো এসে পড়ে চোখে। ডানে কাটছে গাড়িটা। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। জানালা নামিয়ে দিল কিশোর। ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা। একেবারে মুখোমুখি।
অস্ফুট একটা শব্দ করে প্রায় ছিটকে জানালার কাছ থেকে সরে এল কিশোর। মিস্টার এক্স! সেই আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। মুখে গর্ত গর্ত দাগ। গুটি বসন্ত হলে কিংবা ব্রণের ক্ষত হলে যেমন হয় অনেকটা সে রকম। শীতল একটা হাসি যেন জমাট বেঁধে রয়েছে ঠোঁটে। সাপের চোখের মত ঠান্ডা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, খুনীর চোখের দিকে চেয়ে আছে।
চলো! পালাও! চিৎকার করে মুসাকে বলল কিশোর।
কেন চিৎকার করল কিশোর, দেখার জন্যে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে দেখতে চাইল মুসা। হেসে উঠল মিস্টার এক্স। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গুঁতো মারতে এল ওদের গাড়িকে।
কিন্তু ততক্ষণে গ্যাস প্যাডালে চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে মুসা। খেপা ঘোড়ার মত, লাফিয়ে আগে বাড়ল ওদের গাড়ি।
অনুসরণ নয়, রিয়ারভিউ মিররে চট করে একবার দেখে নিয়ে বলল সে, আমাদেরকে রাস্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে এসেছে ব্যাটা!
ঠিক পেছনে লেগে রইল মিস্টার এক্স। সামনে গাড়িটাড়ি কিছু পড়লে, কিংবা অন্য কোন কারণে মুসা গতি কমাতে বাধ্য হলে শাঁ করে পাশের লেনে সরে যায় লাল গাড়িটা, ধেয়ে এসে ভ্রাম করে বাড়ি লাগিয়ে দেয়। তবে এখনও বডিতে লাগাতে পারেনি, কেবল বাম্পারে লাগিয়েছে।
বেরোও, কিশোর বলল। ওকে আটকে রেখে বেরিয়ে যাও কোনখান দিয়ে। খসাতেই হবে!
দ্রুত মহাসড়ক থেকে নেমে পড়ল মুসা। লাল গাড়িটাও নামল। মুসা যত জোরেই চালাক না কেন, ঠিক পেছনে লেগে থাকে। আর সুযোগ পেলেই এসে গুতো মারে। কিছুই করার নেই আর, চালানো ছাড়া। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ?
এই অন্ধকারে কি করবে?
মুসার একবার মনে হলো, রুখে দাঁড়ায়। সে-ও ধাক্কা মারে। কিন্তু ওই গাড়িটা অনেক বেশি শক্ত, ওটার সঙ্গে পারবে না। পালিয়ে বাঁচা ছাড়া আর কোন পথ নেই।
পাহাড়ের কোলে একটা আবাসিক এলাকায় চলে এল ওরা। নামেই আবাসিক, বাড়িঘরগুলো এত দূরে দূরে, জনবসতিশূন্যই মনে হয়। হঠাৎ তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে উঠতে শুরু করল মুসা। ভ্রাম করে গুঁতো লাগল পেছনে। একটা নির্দেশকে দেখা গেল স্যান ফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট টুইন পিকসের দিকে চলেছে ওরা। পর্বতের চূড়াদুটোর ওপরে দাঁড়িয়ে নিচের চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। সুন্দর উপত্যকা, জলরাশি, শহরের আলো, সব দেখা যায়।
মোড় নিয়ে উঠে গেছে পথটা। আরেকটু উঠতেই খেয়াল হলো মুসার, সামনের কুয়াশার ভেতরে ঢুকতে হবে। ভ্রাম করে বাড়ি লাগল আবার।
বাপরে বাপ, এমন কুয়াশা জিন্দেগিতে দেখিনি, গাড়ির গতি কমিয়ে ফেলল সে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। এতই ঘন কুয়াশা হেডলাইটের তীব্র আলোও সামনে ফুটখানেকের বেশি ভেদ করতে পারে না। একবার ভাবল, গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যায় আবার যে পথে এসেছে। কিন্তু ঘোরানোর জায়গা নেই। আর মিস্টার এক্সও ওদেরকে সে সুযোগ দেবে না।
ধ্রাম!
পেছনে তাকাল কিশোর। কুয়াশার জন্যে দেখাই যাচ্ছে না ক্যাভেলিয়ারটাকে। এমনকি হেডলাইটও দেখতে পাচ্ছে না। গুতো মারছে বলেই বুঝতে পারছে, ওদের পেছনে রয়েছে মিস্টার এক্স।
তারপর একসময় থেমে গেল গুতো মারা। কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেল, একটিবারও আর তো লাগল না।
কি ব্যাপার? ফিসফিস করে বলল মুসা।
বুঝতে পারছি না। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না পেছনে। চালাতে থাকো।
আরও শক্ত করে স্টিয়ারিং চেপে ধরল মুসা। একটা মোড় এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছে না সে। কিছুই দেখার জো নেই। পথের কিনারে হঠাৎ করে কোনখান থেকে খাড়া নেমে গেছে ঢাল, তা-ও জানে না।
মোড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে সে…মোড় পেরোচ্ছে… এই সময় কুয়াশার ভেতর থেকে উদয় হলো আবার লাল কনভারটিবলটা, বাঁ দিক থেকে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল ওদের গাড়িটাকে।
চিৎকার করে উঠল কিশোর।
বাঁয়ে কাটল মুসা। টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে সরে এল গাড়ি। মোড়টা পেরিয়ে এসেছে। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও, কাজেই ঝুঁকিটা নিতে আর বাধল না ওর। তীব্র গতিতে কুয়াশার ভেতরে অন্ধের মত চালিয়ে দিল গাড়ি।
পাহাড়ের ওপরে উঠতেই নেমে গেল কুয়াশা। আসলে বেরিয়ে এসেছে কুয়াশার ভেতর থেকে।
ধড়াস ধড়াস করছে বুক। সামনে একটা পার্কিং লট। ওখানে গাড়ি রেখে নিচের দৃশ্য দেখে দর্শকরা। সোজা সেখানে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল সে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছল কপালের।
এইবার আসুক দেখি ব্যাটা! সমস্ত ক্ষোভ ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে। বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেব!
হ্যাঁ, কিশোরের কণ্ঠও কাঁপছে, যদি পিস্তল না থাকে!
১২
চুপ করে বসে আছে দুই গোয়েন্দা। গাড়ির ইঞ্জিন চলছে। বেশ কিছু দর্শক রয়েছে। ওখানে। কিছু করার সাহস পাবে না মিস্টার এক্স। ভয় চলে যেতেই রাগে ফুটতে আরম্ভ করেছে মুসা।
সাহস আছে হারামজাদার, দাঁতে দাঁত চাপল সে। কুয়াশার মধ্যে ঠিকই গুতোগুতি করল। গাড়ি নিয়ে শয়তানী করেছে বলে পার পেয়ে গেছে। এখন আসুক…আসে না কেন? এত দেরি? করছেটা কি?
জানি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। অনেক কারণ থাকতে পারে…
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। ক্যাভেলিয়ারের দেখা নেই।
হঠাৎ ড্যাশবোর্ডে চাপড় মারল কিশোর। এখুনি এয়ারপোর্টে যেতে হবে আমাদের, প্লেন ধরতে হলে!
কিন্তু মিস্টার এক্স?
ও আসবে না। বুঝতে পেরেছে, এখানে আমাদের কিছু করতে পারবে না। কাজেই ফিরে চলে গেছে।
হতাশ হলো মুসা। সমস্ত রাগ যেন গিয়ে পড়ল স্টিয়ারিঙের ওপর। ওটাকেই কিল মারল। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বের করে আনল পার্কিং লট থেকে।
সাবধানে থাকবে, কিশোর বলল। বলা যায় না, ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। কোথাও। মহা পাজি লোক।
তবে পথে আর বিপদ হলো না। নিরাপদেই বিমান বন্দরে পৌঁছল ওরা। যেখান থেকে গাড়িটা ভাড়া করেছে সেখানে ফিরিয়ে দিতে গেল। গাড়িতেই চাবি রেখে অফিসের দিকে পা বাড়াল দুজনে। ভাড়া মিটিয়ে দেবে। কিন্তু ঢোকার আগেও মুহূর্তে কিশোরের হাত ধরে টান মেরে ঘুরিয়ে ফেলল মুসা। ওই যে! লাল ক্যাভেলিয়ার!
কিশোরও দেখল। কিন্তু ওটাই কি আমাদের পিছে লেগেছিল? চলো, দেখি।
গাড়িটার কাছে এল ওরা। শূন্য। ভেতরে কেউ নেই। চারপাশে ঘুরে দেখল। লাইসেন্স প্লেট দেখে কিশোর বলল, এটাই! জলদি অফিসে যাও! এখনও থাকতে পারে ব্যাটা! না পেলে ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করবে, লাল কনভারটিবলটা যে ভাড়া করেছিল তার নাম কি। যাও, আমি আসছি।
চলে গেল মুসা। লাল গাড়িটার দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। ভেতরে এমন কিছু কি আছে যেটা সূত্র হতে পারে? খুঁজতে লাগল সে। কার্পেটের পেছনে দেখল, উল্টে নিচে দেখল, সামনের সীটের নিচে ওপরে সবখানে দেখল। অ্যাশট্রে, গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট কিছু বাদ দিল না। এমনকি আঙুল আর হাত ঢোকে ওরকম কোন ফাঁকফোকরই বাদ রাখল না।
তবে কষ্ট বিফলে গেল না। মিস্টার এক্স কে, তা জানা যাচ্ছে না, তবে কোথায় পাওয়া যাবে একথা জানা গেল। অফিসের দিকে দৌড় দিল কিশোর। বেরিয়ে আসছে তখন মুসা।
ক্লার্ক কি বলল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাভ আ নাইস ডে, জবাব দিল মুসা। বাংলা করে বলল-ভাল বাংলা বলতে পারে আজকাল, দিনটা ভাল কাটুক।
লাল গাড়িটার কথা কি বলল? অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর।
হ্যাভ আ নাইস ডে। মানুষ নয়। একটা কম্পিউটার।
দেখো, আমি কি পেয়েছি। এক টুকরো দোমড়ানো কাগজ বের করে দেখাল কিশোর। একপাশ চকচকে প্লাস্টিকের মত, আরেক পাশ সাদা, সাধারণ কাগজ।
ক্যানডির মোড়ক। হাতে ডলে কাগজটা সমান করল মুসা। লেখাগুলো যাতে পড়া যায়। রূপালি রঙে লেখা রয়েছে, পড়ল, মিরাকল টেস্ট! আরে ওই রকম ক্যানডির মোড়ক, চিকেন লারসেনের পার্টিতে যে জিনিস বিতরণ করেছিল। ফেলিক্স আরোলা!
ঠিক। ফ্রী স্যাম্পল। মার্কেটে ছাড়েনি এখনও। দুটো সম্ভাবনা ধরা যায়। এক, পার্টিতে উপস্থিত ছিল মিস্টার এক্স, আমাদের মতই ফ্রী স্যাম্পল পেয়েছিল। নয় তো, একসঙ্গে কাজ করছে আরোলা আর মিস্টার এক্স।
করুকগে, মুসা বলল। সেটা পরেও আলোচনা করা যাবে। প্লেন ধরতে হবে আমাদের, বাড়ি যেতে হবে, ভুলে গেছ?
জাংক ইয়ার্ডে ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত হয়ে গেল। বাইরে গিয়ে তদন্ত করার সময় নেই আর তখন। মুসা চলে গেল ওদের বাড়িতে। এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না কিশোরের। তাই লক কমবিনেশন ডিকোডার নিয়ে কাজে বসল সে। অনেকক্ষণ পর, ক্লান্ত হয়ে উঠে বাতি নিভিয়ে ওঅর্কশপ বন্ধ করতে যাবে, এই সময় বাজল টেলিফোন।
অন্ধকারেই রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল সে, হ্যালো?
কিশোর, মুসার কণ্ঠ। ফারিহা কথা বলতে চায়।
আবার আলো জ্বালল কিশোর।
হাই, কিশোর, এত রাতেও ফারিহার গলার জোর শুনে অবাক হলো কিশোর, বিন্দুমাত্র ক্লান্তির ছাপ নেই। শোননা, কি হয়েছে। জুন লারসেন আজ লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে…
কল্পনায় পরিষ্কার দেখতে পেল কিশোর, ফারিহা এখন কি করছে। লম্বা চুলের একটা গোছা আঙুলে পেঁচাচ্ছে আর কথা বলছে। বকবক করে যাবে, করেই যাবে এক গল্প শেষ করতেই রাত কাবার। কম কথায় আর শেষ করতে পারে না। অতক্ষণ কানে রিসিভার ঠেকিয়ে রাখার ধৈর্য নেই কিশোরের। তাই স্পীকারের লাইন অন করে দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। যাতে প্রয়োজনে শুনতে শুনতে পায়চারিও করতে পারে।
… অনেক কথাই বলেছে, জুন বলে যাচ্ছে। তবে এখনও মনে করতে পারছে না অ্যাক্সিডেন্টের দিন কোথায় গিয়েছিল আর ব্রিফকেসটা কোথায় রেখেছিল। একটা কথা অবশ্য আবছাভাবে মনে করতে পারছে, সেদিন একটা গাড়ি পিছু নিয়েছিল ওর।… যাই হোক, লাঞ্চের পর আমাকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌছে দিয়েছে সে। দারুণ একটা গাড়ি। নতুন একটা মাসট্যাং কনভারটিবল কিনে দিয়েছেন তাকে চিকেন লারসেন।
আর জানো কি ইঞ্জিন? পেছন থেকে বলে উঠল মুসা, ফাইভ-লিটার ভি এইট ইঞ্জিন…
মুসা, প্লীজ, ওকে থামতে অনুরোধ করল ফারিহা। কিশোর আমার গল্পটা শুনতে চাইছে। এক কথার মাঝে আরেক কথা ঢুকিয়ে দিও না। হ্যাঁ, কিশোর, কি যেন বলছিলাম? ও, মনে পড়েছে। গাড়িতে ওঠার আগে ট্রাঙ্ক খুলে পার্সটা ভেতরে ছুঁড়ে দিল সে। অদ্ভুতই লাগল আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ওরকম করল কেন? লোকে পার্স রাখে হাতে। গাড়ি চালানোর সময় পাশের সীটে রাখে, কিংবা কোলের ওপর রাখে। জবাব দিল ওটা ওর স্বভাব। ভাবলাম, এখন যদি ওর গাড়িটাকে পাহাড় থেকে উল্টে ফেলে দেয় কেউ, তাহলে সহজেই ট্রাঙ্ক থেকে পার্সটা বের করে নিতে পারে। নেয়ার ইচ্ছে থাকলে। কি বললাম, বুঝতে পেরেছ?
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কিশোরের চোখ। ট্রাঙ্ক! ব্রিফকেসটা ট্রাঙ্কে থাকতে পারে!
হ্যাঁ, বুঝেছি, জবাব দিল সে। বুদ্ধি আছে তোমার। শিখতে আরম্ভ করেছ।
হেসে উঠল ফারিহা।
দেখি, লাইনটা মুসাকে দাও। মুসা ধরলে কিশোর বলল, শোননা, কাল সকালে উঠেই চলে আসবে। অটো স্যালভিজ ইয়ার্ডে যাব। জুনের গাড়ির ট্রাঙ্কটা দেখার জন্যে।
জানতাম, একথাই বলবে। ঠিক আছে, আসব।
পরদিন সকাল নটায় রবিনের ফোক্সওয়াগনে করে হাজির হলো রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর তখনও তৈরি হতে পারেনি। রিসিভার তুলে ডায়াল করল থানায়। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে চাইল। তিনি ধরলে জানাল, জুনের ব্রিফকেস খুঁজতে যাচ্ছে।
ব্রিফকেসের কথা তো নতুন শুনলাম, চীফ বললেন।
হ্যাঁ। অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় নিশ্চয় পাননি। খোজাখুঁজি তো করেছেন। গাড়ির ভেতর থেকে কিছু পড়ে গেল কিনা দেখেছেন।
নিশ্চয়, অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন চীফ।
গাড়ির ভেতরে খুঁজেছেন?
কিশোর, আমার পুলিশে চাকরির বয়েসই তোমার বয়েসের চেয়ে বেশি। আমি আমার কাজ জানি। যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম তারাও জানে। রিপোর্ট করেছে, গাড়ির ভেতরটা খালি ছিল।
আসলে শিওর হতে চাইছি আমি, কোথাও কিছু বাদ পড়ে গেল কিনা।
বাদ পড়েনি। এই একটা কেসে তুমি সুবিধে করতে পারবে না, হাসলেন চীফ।
না পারলে, রহস্যময় কণ্ঠে কিশোর জবাব দিল, কোন দিন আর চিকেন লারসেনের মুরগী আপনি খেতে চাইবেন না। পরে সব বলব, লাইন কেটে দিল সে।
গাড়িতে এসে উঠল কিশোর। দুই সহকারীর সঙ্গে রওনা হলো মিলার অটো রেকেজ ইয়ার্ডে।
বিশাল এলাকা নিয়ে ইয়ার্ড। কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। একধারে স্তূপ করে রাখা হয়েছে নতুন নষ্ট হওয়া গাড়িগুলো। টুকরো টুকরো হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে যেন। সবখানে ছড়িয়ে রয়েছে গাড়ির নানা জিনিস। কোথাও টায়ারের স্তূপ, কোথাও ফেনডার, কোথাও বা বডির অন্যান্য অংশ। ইয়ার্ডের পেছনে বাঁ দিকে রয়েছে বিশাল এক কমপ্যাক্টর মেশিন আর দুশো ফুটের ক্রেন।
একেবারে গল্পের মত ঘটে গেল ঘটনা। টেলিভিশনের থ্রিলারের গল্পে যে রকম হয়।-তিন গোয়েন্দা ইয়ার্ডে ঢুকতেই কাকতালীয় ভাবে জুনের ছোট নীল মাসট্যাংটা তুলে নিল ক্রেন।
ম্যাশারে নিয়ে গিয়ে ফেলবে! চিৎকার করে উঠল মুসা। চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলবে!
ট্রাঙ্কের চিহ্নই আর থাকবে না! দৌড় দিল রবিন। কিচ্ছু বের করতে পারব না!
ক্রেনের দিকে দৌড়াচ্ছে তিনজনে। চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে ক্রেন অপারেটরের। কাছে গিয়ে দেখল ক্রেন চালাচ্ছে পল মিলার। ইয়ার্ডের মালিকের ছেলে। বছরখানেক আগে রকি বীচ হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে।
মোটর বন্ধ করে দিয়ে, অপারেটরের খাচার চারপাশে ছড়ানো হলুদ রং করা প্লাটফর্মে বেরিয়ে এল পল। নিচে তাকিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে।
গাড়িটা জুন মিলারের? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ। কেন?
একটু দেখতে চাই।
লাভ হবে না। একটা স্পেয়ারও পাবে না। সব গেছে।
তবু। বেশিক্ষণ লাগবে না।
বেশ, ওদিকটায় যাও, নামিয়ে দিচ্ছি, পড়ে থাকা অনেকগুলো বাতিল ট্রাকের পাশের খালি জায়গা দেখাল পল।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে সেদিকে এগোল কিশোর। পিছে পিছে চলল রবিন আর মুসা।
আবার চালু হলো ক্রেনের ইঞ্জিন। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখল কিশোর, এপাশ ওপাশ দুলছে গাড়িটা। তারপর বিরাট একটা চক্র সৃষ্টি করে যেন এগোতে শুরু করল।
অত ওপর থেকে যদি কোনভাবে মাটিতে খসে পড়ে, মুসা বলল। ভর্তা হয়ে যাবে।
প্রায় মাথার ওপর চলে এসেছে গাড়িটা। সরে গেল ওরা। কিন্তু গাড়িটা চলল ওদের সঙ্গে, ওপরে ওপরে, যেন অনুসরণ করতে চাইছে। বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দুলছে।
মজা করছে নাকি? ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।
না, মজা নয়! আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ওই দেখো!
ক্রেনের গোড়ায় পড়ে থাকতে দেখা গেল পলকে। পেট চেপে ধরেছে, বাঁকা হয়ে গেছে ব্যথায়। ক্রেন অপারেটরের বুদে ঢুকে পড়েছে অন্য কেউ, সে-ই চালাচ্ছে। তিন গোয়েন্দার মাথার ওপরে চলে এসেছে গাড়িটা।
কে চালাচ্ছে? কিশোরের প্রশ্ন।
কিন্তু জবাব পেল না। দেবেই বা কে? গোল, চ্যাপ্টা একটা বড় চুম্বকের সাহায্যে তোলা হয় গাড়ি। ইলেকট্রোম্যাগনেট। অফ করে দেয়া হলো সুইচ।
কিন্তু জবাব খোঁজার সময় নেই। গাড়িটা এখন একেবারে মাথার ওপর। আচমকা ছেড়ে দিল ওটাকে ক্রেন। পড়তে আরম্ভ করল তিন হাজার পাউন্ড ওজনের গাড়িটা।
১৩
তিন দিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বিকট শব্দে মাটিতে পড়ল গাড়ি।
ভাঙা কতগুলো গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। দেখছে, শূন্যে দুলছে ভারি ইলেকট্রোম্যাগনেট, যে চুম্বকটার সাহায্যে গাড়ি তোলা হয়। ওটার এক বাড়ি খেলেই মরে যাবে মানুষ। বোঝাই গেছে, অপারেটরের বুদে যে রয়েছে এখন সে ওরকম কিছু ঘটানোরই চেষ্টায় আছে।
বিশাল চুম্বকটার দুলুনি বন্ধ হলে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ক্রেনের বুদে কে আছে।
আগেই বোঝা উচিত ছিল, ফিসফিস করে বলল সে। আমাদের মিস্টার এক্স!
পুরানো গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে। দেখল, ক্রেনের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে লোকটা। গায়ে আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। লাফিয়ে নামল পলের কাছে। তার ঘাড়ে এক রদ্দা মেরে তাকে চিৎ করে দিল আবার, যাতে কিছুক্ষণ আর না উঠতে পারে।
এদিকেই আসছে, দুই সহকারীকে পিছিয়ে যেতে ইশারা করল মুসা। আবার গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তিনজনে। এমনভাবে থাকার চেষ্টা করল, লোকটা দেখতে না পায়।
জুনের গাড়িটা দেখতেই এসেছে হয়তো, কিশোর বলল। আমাদের মত।
কানে এল কাচ ভাঙার শব্দ। ধোঁয়ার গন্ধ নাকে এলো আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না মুসা। মুখ বের করে তাকাল। দেখল, দ্বিতীয় মলোটভ ককটেলটা ছুঁড়ছে মিস্টার এক্স। বোতল ভাঙার শব্দই তখন কানে এসেছে।
সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে ফেলছে! হতাশ কণ্ঠে বলল মুসা।
তাহলে এই ব্যাপার, কিশোর বলল। লোকটা চায় না, গাড়িতে যা আছে আমরা দেখি।
পেট্রল আছে কিনা কে জানে! তাহলে বোমার মত ফাটবে!
আগুন ধরে যেতেই দৌড় দিল মিস্টার এক্স। ইয়ার্ডের গেটের কাছে রাখা তার পোরশেতে গিয়ে উঠল। পিছু নিতে চাইল মুসা। হাত ধরে তাকে টেনে আটকাল কিশোর আর রবিন।
ওকে ধরার দরকার নেই, রবিন বলল। গাড়ির ট্রাঙ্ক দেখতে হবে! যে কাজে এসেছি!
কুইক! তাড়া দিল কিশোর। গাড়িটা পুড়ে যাওয়ার আগেই… পুড়বে তো না, ফাটবে!
গাড়িটার দিকে আরেকবার তাকাল মুসা। তারপর দিল দৌড়। পুরানো জঞ্জালের মধ্যে খুঁজতে আরম্ভ করল। জিনিসটা খুঁজে বের করতে বেশিক্ষণ লাগল না। একটা শাবল। তারপর ছুটল জুনের তোবড়ানো মাসট্যাঙের দিকে। ভেতরের গদিটদি অনেকখানিই পুড়ে গেছে ইতিমধ্যে। পেছনের দিকে এগোচ্ছে আগুন, যেখানে পেট্রল ট্যাংকটা রয়েছে।
শাবল দিয়ে ট্রাঙ্ক খোলার চেষ্টা শুরু করল মুসা। ঘামে ভিজে গেছে কপাল। একটা চোখ সারাক্ষণ রেখেছে আগুনের ওপর। অবশেষ খুলে গেল ট্রাঙ্ক।
পেয়েছি! আনন্দে চিৎকার করে উঠল সে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল চামড়ার ব্রিফকেসটা। হাতে তুলে নেড়ে দেখাল কিশোর আর রবিনকে। জলদি ভাগ! ফাটবে এখুনি! ট্যাংকের কাছে পৌঁছে গেছে আগুন।
কিন্তু নড়ল না কিশোর। হাসছে। বলল, গাড়ি ভাঙার আগে পেট্রল বের করে নেয়া হয়, যাতে কোনরকম দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। জ্বলবে গাড়িটা, কিন্তু ফাটবে না।
আগে অকথা বলেনি কেন? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। তাহলে অত তাড়াহুড়া করতাম না…।
সে জন্যেই বলিনি। ওই তাড়াহুড়াটা না করলে হয়তো সময়মত খুলতে পারতে না ট্রাঙ্কটা। ঠেকায় পড়লেই কেবল মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে।
তুমি যে একটা কি…! জ্বলন্ত চোখে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকাল মুসা।
ফোন করে অ্যামবুলেন্স ডাকা হলো। তারপর পলকে দেখতে চলল তিন গোয়েন্দা, ওর অবস্থা কতটা খারাপ।
তোমরা গোয়েন্দা, শুনেছি, পল বলল। কিন্তু জানতাম না সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও লাগতে যাও।
সব সময় লাগি না, কৈফিয়তের সুরে বলল কিশোর।
পলের ব্যবস্থা করে চিকেন লারসেনের বাড়ি রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। ওখানে ওদের অপেক্ষায় আছে জুন আর ফারিহা। লারসেন বাড়ি নেই। ফিরতে দেরি হতে পারে।
সদর দরজায় বেল শুনে খুলেই তিন গোয়েন্দাকে দেখে একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে, পেয়েছ?।
নীরবে ব্রিফকেসটা তুলে ধরল কিশোর। কি করে এসেছে, তার প্রমাণ দিতে চাইল যেন।
হাসল জুন। ওদেরকে নিয়ে এল বসার ঘরে।
কাচের কফি টেবিলে ব্রিফকেসটা রাখল কিশোর।
অস্থির হাতে সামনের খোপের চেনটা তুলে ভেতর থেকে মরক্কো লেদারে বাঁধাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকটা বের করল জুন। কাঁপা হাতে খুলল শুক্রবারের সেই পাতাটা, যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। যেদিনকার ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে গেছে।
এই যে, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে ওর।
পুরো একটা মিনিট পাতাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, কিছুই নেই। কেবল আর অ্যান্ড ডি।
রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, কিশোর বলল। ডন বারোজের ডিপার্টমেন্ট, তাই না? ওর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলে কেন? কি আলোচনা করেছিলে?
কাজ শেখার চেষ্টা করছি আমি। সব বিভাগেই কাটিয়েছি একদিন করে। এর বেশি আর কিছু মনে করতে পারছি না।
ব্রিফকেসের ভেতরে কি আছে দেখলে হয়তো মনে করতে পারবে, আশা করল কিশোর।
ভেতর থেকে একটা তিন রিঙের বাইন্ডার বের করল। প্রায় দুশো ফটোকপি করা কাগজ রয়েছে তাতে। কয়েক মিনিট কাগজগুলো ওল্টাল, তারপর রেখে দিল টেবিলে। চিনতেই পারছি না! ওগুলো দেখে স্মৃতি ফেরত আনার চেষ্টা করছিল সে, ব্যর্থ হয়েছে। ভীষণ হতাশ হয়েছে।
আমি দেখি? অসুবিধে আছে? নোটবুকটার দিকে হাত বাড়াল কিশোর। পয়লা পাতাতেই ডন বারোজের নাম। দ্রুত রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল সে। কয়েক মিনিট নীরবে পড়ার পর মুখ তুলল। বলল, সেই শুক্রবারে কি ঘটেছিল বোধহয় বুঝতে পারছি। ডন বারোজের লেখা একটা রিপোর্টের কপি এটা। মালটিসরবিটেন নামে খাবারে মেশানোর একটা উপাদান সম্পর্কে। কয়েক বছর আগে জিনিসটা আবিষ্কার করেছিল ডন। বলছে, মালটিসরবিটেন মেশালে খাবারের স্বাদ অনেক বেড়ে যায়, তবে একটা অসুবিধেও করে। এতই সুস্বাদু হয় খাবার, নেশাগ্রস্ত করে ফেলে মানুষকে।
ভাল খাবার তো লোভী করবেই মানুষকে, রবিন বলল। তাতে অসুবিধেটা কোথায়?
অসুবিধেটা? মালটিসরবিটেনের বেলায় আছে। এফ ডি এ, অর্থাৎ ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই উপাদানটা পরীক্ষা করেছিল। নতুন যে কোন খাবার আর ড্রাগ পরীক্ষা করে দেখা ওদের দায়িত্ব। উনাকে মালটিসরবিটেন বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়নি ওরা। কারণ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ক্যারসিনোজেন হতে পারে ওই জিনিসে।
কি জেন? মুখ বাঁকাল মুসা।
ক্যারসিনোজেন। বুঝিয়ে দিল রবিন, ক্যানসার হয় ওতে।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। বলতে থাকল, দুর্ঘটনার দিন শুক্রবারে তুমি ডনের সঙ্গে দেখা করেছ। ওই রিপোর্টের কপি পেয়ে গেছ, কাগজটায় টোকা দিল সে। সে দেয়নি। আমার বিশ্বাস, ওর অফিসে ঢুকে কোনভাবে দেখে ফেলেছিলে কাগজটা। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে রাতের বেলা। কাজেই অনুমান করছি, বিকেলের দিকে পেয়েছ তুমি। পড়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিলে।
জুনের দিকে তাকাল কিশোর। সবকথা মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে যেন। বলল, এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলে, কাগজটা নিয়েই ছুটে বেরোলে ডনের অফিস থেকে দেখে ফেলেছিল সে। তাড়া করেছিল তোমাকে। তোমার গাড়িতে গিয়ে উঠলে। নিজের গাড়িতে করে তোমাকে অনুসরণ করল সে। দুর্ঘটনার জায়গায় আরেক সেট চাকার দাগ যে পাওয়া গেছে সেটা ওরই গাড়ির।
মুসা প্রশ্ন করল, ওই একটা রিপোর্ট অতটা উত্তেজিত করবে কেন জুনকে?
করবেই তো, হাসল কিশোর। জুন হয়তো বুঝে ফেলেছিল, চিকেন লারসেনের নতুন খাবার ড্রিপিং চিকেনে ওই মালটিসরবিটেন মিশিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডন।
কথাটা সবাইকে হজম করার সুযোগ দিল গোয়েন্দাপ্রধান। তারপর জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বুঝে ফেলেছিলে, ডন, কিংবা আরোলা, কিংবা তোমার বাবা ইচ্ছে করেই জেনেশুনে ওই বিষ মেশাতে চলেছেন খাবারে। ড্রিপিং চিকেনে। ওই বিষের ক্রিয়া টের পেতে পেতে রোগীর কয়েক বছর লেগে যাবে। কাজেই সহজে ধরা পড়বে না যে মেশাবে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ লোক নিয়মিত খেয়ে যাবে মালটিসরবিটেন, বুঝতেই পারবে না ক্যানসারে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে ওরা। যখন বুঝবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। হয়তো তখনও বুঝবে না কিসের কারণে হয়েছে তাদের ওই মরণ ব্যাধি।
ঠোঁট কাঁপছে জুনের। প্রায় চিৎকার করে বলল, অসম্ভব! আমার বাবা ওরকম পাষন্ড হতেই পারে না!
আমরা এখনও জানি না সেটা। প্রমাণ করতে হবে যে তিনি এতে জড়িত নেই। আর সেটা করায় আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে তোমাকে।
মনে মনে ইতিমধ্যেই কিছু একটা করার পরিকল্পনা করে ফেলেছে কিশোর, বুঝতে পারল তার দুই সহকারী। রবিন জিজ্ঞেস করল, কি করতে চাইছ তুমি?
জানতে চাই, ড্রিপিং চিকেনে মালটিসরবিটেন মেশানোর ব্যাপারটা জানেন কিনা মিস্টার লারসেন। কি করে জানব, কেউ কোন পরামর্শ দিতে পারো?
পারি, জুন বলল। বাবা তার সমস্ত কাজের ফিরিস্তি কাগজে লিখে অফিসের আলমারিতে রেখে দেয়।
আঙুল মটকাল কিশোর। আমিও তাই আশা করেছি। বের করে আনতে পারবে?
তালার কম্বিনেশন জানি না।
ও। তাকে না জানিয়ে কাগজগুলো বের করতে হবে। সন্দেহ করলেই সরিয়ে কিংবা নষ্ট করে ফেলতে পারেন।
এক মুহূর্ত ভাবল জুন। তারপর হাসল। বাবার সেক্রেটারির সাহায্য নিলে কেমন হয়? অনেক কিছুই হয়তো জানে ও। কম্বিনেশন জানলেও অবাক হব না। বসের অনেক গোপন খবরই রাখে তার সেক্রেটারি। এটা নতুন কিছু না।
চলো, তখুনি যেতে চাইল মুসা।
না, বাধা দিল জুন। আমি একা যাব। তোমাদেরকে দেখলে মুখ খুলবে না। বাবার বিরুদ্ধে একাজ করছি, ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না…
হচ্ছে, দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল যেন কিশোর। লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাঁচানোর জন্যে কাজটা করছি আমরা। একে অন্যায় বলা যাবে না। কতক্ষণ লাগবে। তোমার?
এই ঘণ্টা দুয়েক।
দুই ঘণ্টা কেটে গেল। ওদেরকে যা যা করতে বলে গেছে জুন, তাই করল। ওর বাড়িতে বসে ওদের ফ্রিজের খাবার খেল, টিভি দেখল, কথা বলল। বিশ্রাম নিল, কিশোর বাদে। এই কাজটা সে কিছুতেই করতে পারল না। ঢিল দিতে পারল না শরীর।
আরেক ঘণ্টা পেরোল।
অবশেষে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল জুন। হাতের কাগজ দেখিয়ে সবার দিকে চেয়ে হাসল।
পেয়েছি, ফিসফিস করে জানাল সে। চারপাশে তাকাল, যেন দেখে নিতে চাইছে ওর বাবা শুনে ফেলছেন কিনা। আলমারি খুলে সব কাগজ দেখেছি। কোথাও লেখা নেই মালটিসরবিটেনের কথা। দেখলে তো? আমার বাবা খুনী নয়।
জুনের কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগল কিশোর।
মনে হচ্ছে, মুসা বলল। লোকটাকে আর ধরতেই পারলাম না। কেসের এখানেই ইতি।
কাগজটা ভাজ করে পকেটে রেখে দিল কিশোর। মুখ তুলে তাকাল জুনের দিকে। কেউ যদি খাবারে বিষ না-ই মিশিয়ে থাকে, ঘোরের মধ্যে বললে কেন একথা? ব্রিফকেসটার জন্যেই এত অস্থির হয়ে গিয়েছিলে কেন? আর ডন বারোজের নাম ছাপা এই মালটিসরবিটেনের রিপোর্টই বা তোমার কাছে কেন?
জানি না, মাথা নাড়ল জুন।
আমরাও জানি না, কিশোরও মাথা নাড়ল। তবে কয়েকটা ব্যাপার জানি। আমাদের সন্দেহের তালিকা দ্রুত ছোট হয়ে আসছে। তোমার বাবাকে বাদ দেয়া যায়। হেনরি অগাসটাসও বাদ, কারণ তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই তোমার। যোগাযোগও নেই। মালটিসরবিটেনের সঙ্গে তাকে জড়াতে পারছি না কোনভাবে। বাকি থাকল ডন বারোজ। সে সহজেই ওই খাবারে বিষ মেশাতে পারে। তবে সে নির্দোষও হতে পারে। অন্য কেউও করে থাকতে পারে কাজটা। যে লোকটাকে বেশি সন্দেহ করছি, যার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ আমার এখন, যে রিপোর্টটা আমাদের হাতে পড়তে দিতে চায়নি, সে হলো রহস্যময় মিস্টার এক্স। যে আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
ওই লোকটা কে?, মুসা জিজ্ঞেস করল। বুঝতে পারছ?
আন্দাজ করতে পারছি। ফেলিক্স আরোলা।
তাহলে? ভুরু কোঁচকাল ফারিহা। পুলিশকে ফোন করব?
না। প্রমাণ দরকার। মিরাকল টেস্টে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে আমাদের। কি গোপন করার চেষ্টা করছে আরোলা, জানতে হবে।
কিশোর, হুঁশিয়ার করল মুসা। জায়গাটা একটা দুঃস্বপ্ন! সিকিউরিটি ভীষণ কড়া!
বেশ, তাহলে রাতের বেলা যাব। যখন গার্ডেরা সতর্ক থাকবে না। ঘুম থাকবে চোখে।
তাহলে আজ রাতেই করতে হবে কাজটা, জুন বলল। বাবার সেক্রেটারি আরেকটা কথা বলেছে আমাকে, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আজ সন্ধ্যায় বিরাট এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ড্রিপিং চিকেনের খবর দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দিতে চায় বাবা। বাজারে ছাড়তে যাচ্ছে।
তাই নাকি! সর্বনাশ! বলে উঠল ফারিহা।
চিকেন লারসেনের কথা মনে পড়ল কিশোরের। তিনি বলেছেনঃ লোকে জানতেও পারবে না কিসে আঘাত করেছে ওদেরকে!
১৪
বিকেল পাঁচটা। রবিনের গাড়িতে বসে আছে গোয়েন্দারা। লং বীচে মিরাকল টেস্টের অফিস আর গুদাম থেকে কিছু দূরে। জুনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যার যার বাড়ি গিয়েছিল। কালো শার্ট প্যান্ট পরে এসেছে। কিশোরের হাতে কালো চামড়ার একটা হাতব্যাগ। কোলের ওপর রেখেছে। জিনিসটা নতুন দেখছে রবিন আর মুসা।
আরোলা বেরোলেই আমরা ঢুকব, ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বলল কিশোর।
ও আছে কি করে জানলে? রবিনের প্রশ্ন।
আছে, জবাবটা মুসাই দিয়ে দিল। ওর গাড়ি দেখছ না? ওই যে। চিনি।
তুমি চিনলে কি করে? রবিন অবাকই হলো।
সেদিন চিকেন লারসেনের বাড়িতে পার্টির পর ওকে অনুসরণ করেছিলাম। ওই গাড়িতে করে মিরাকল টেস্টে এসেছিল সে।
আস্তে আস্তে মিরাকল টেস্টের পার্কিং লট খালি হয়ে যেতে লাগল। ছটার সময় বেরোল আরোলার ধূসর রঙের ক্যাডিলাক অ্যালানটে গাড়িটা। চলে গেল লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে।
চিকেন লারসেনের সাংবাদিক সম্মেলনে গেল হয়তো, অনুমানে বলল মুসা।
গাড়ি থেকে নামল তিনজনে। প্রায় দৌড়ে চলে এল মিরাকল টেস্টের পার্কিং লটে। ঢোকার মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল রবিন। পাহারায় রইল। দরজাটা পরীক্ষা করতে গেল মুসা আর কিশোর।
সিকিউরিটি দেখেছ? গুঙিয়ে উঠল মুসা।
দেখছে। তিনজনেই তাকিয়ে রয়েছে ছোট একটা ইলেকট্রনিক প্যানেলের দিকে। আলোকিত একটা কীপ্যাড রয়েছে সেখানে। কাচের দরজার পাশে ক্রোমের দেয়ালের মাঝে। দরজার ওপাশে গার্ডের ঘর। কাউকে চোখে পড়ছে না।
টহল দিতে গেছে হয়তো, রবিন বলল। এইই সুযোগ। ঢুকে পড়া দরকার।
কীপ্যাডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। নিশ্চয় ওর মধ্যে কোন বিশেষ কোড ঢোকাতে হয়। তাহলেই খুলবে। কিন্তু ভুল কোড যদি ঢোকে, কি আচরণ করবে? দারোয়ানকে সতর্ক করার জন্যে সিগন্যাল দিতে আরম্ভ করবে না তো?
কোড না দিলে বোঝা যাবে না। ঝুঁকি নিতেই হবে। চামড়ার ব্যাগটা খুলতে লাগল কিশোর। বলল, একটা ইলেকট্রনিক লক কম্বিনেশন ডিকোডার নিয়ে এসেছি। কীবোর্ডে লাগিয়ে দিলেই কম্বিনেশন পড়ে ফেলতে পারবে। কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়, তাই না? সার্কিট ডায়াগ্রাম দেখে দেখে বানিয়ে ওঅর্কশপে পরীক্ষা করে দেখেছি। কাজ করেছে। এখানে কি করবে কে জানে!
স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে দ্রুত কীপ্যাডের কভার প্লেট খুলে ফেলল সে। ডিকোডারের দুটো অ্যালিগেটর ক্লিপ লাগিয়ে দিল দুটো বিশেষ তারের সঙ্গে। উত্তেজনায় দুরুদুরু করছে ওর বুক। কাজ করবে তো? সুইচ টিপল। বেশ কিছু টিপটিপ শব্দ আর আলোর ঝলকানির পর যন্ত্রটা কতগুলো নম্বর দিল ওকে।
হয়েছে? দরজার দিকে পা বাড়াল মুসা। চলো, দেখি…
ওর কাঁধ খামচে ধরল কিশোর। দাঁড়াও। কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে! কালো যন্ত্রটায় হাত বোলাল সে। ঠিকমত কাজ করছে না। যে নম্বরটা দিয়েছে ওটা এখানকার কমবিনেশন নয়। ওঅর্কশপে যে রিডিং দিয়েছিল, সেটা।
ইলেক্ট্রনিক এই যন্ত্রপাতি এ জন্যেই দেখতে পারি না আমি, বিরক্ত হয়ে বলল রবিন। কখন যে বিগড়ে যাবে ঠিকঠিকানা নেই!
সব যন্ত্রই বিগড়ায়, এগুলোর আর দোষ কি? ইলেকট্রনিকস যতটা সুবিধে করে দিয়েছে তার তুলনায় ছোটখাট এসব গোলমাল কিছুই না। হয়তো কোন ক্যাপাসিটর খারাপ পড়েছে, গেছে বাতিল হয়ে, বদলে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো আর সময় নেই…
না, নেই। ওই যে, গার্ডও চলে আসছে।
তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা ব্যাগে ভরে শার্টের ভেতরে লুকিয়ে ফেলল কিশোর। গোবেচারা মুখ করে রইল। তার ডেস্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দারোয়ান, এই সময় গিয়ে বেল বাজাল রবিন।
দরজা সামান্য ফাঁক করে তিনজনেরই পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বোলাল দারোয়ান। তারপর জিজ্ঞেস করল, কি চাই?
কিশোর বলল, আমরা ব্ল্যাক মেসেঞ্জার সার্ভিস থেকে এসেছি। নিজেদের কালো পোশাকের ব্যাখ্যাও দিয়ে ফেলল এক কথাতেই। মিস্টার আরোলার অফিস থেকে কিছু একটা বের করে নিতে হবে আমাদেরকে। তিনি বলেছেন, খুবই নাকি জরুরী।
একটা জিনিস নিতে তিনজন দরকার? দারোয়ানের সন্দেহ গেল না।
আমি কি জানি? হাত ওন্টাল কিশোর। আসতে বললেন, এসেছি। আমাকে তার প্রয়োজন।
ওর গাড়ি নেই, কিশোরকে দেখাল রবিন। তাই আমাকেও আসতে হলো।
আর ওরা কেউ অফিসটা চেনে না, রবিন আর কিশোরের কথা বলল মুসা। আমি চিনি। না এসে আর কি করব?
তাই তো, না এসে কি করবে! অকাট্য যুক্তি! আমি তো জানতাম থ্রী স্টুজেসরা মরে ভূত হয়ে গেছে, বিড়বিড় করল দারোয়ান। তবে আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে দিল। যাও। কি নেবে নিয়ে জলদি বিদেয় হও, হলের দিকে দেখিয়ে অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল সে।
দারোয়ানের নির্দেশিত দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। সমস্ত পথটায় কার্পেট বিছানো রয়েছে। বাঁয়ের পথ ধরল ওরা। ওদিকেই অফিসটা, বলেছে দারোয়ান। ডান দিকে চলে গেছে আরেকটা পথ। পথের শেষ মাথায় ওয়াল নাট কাঠের তৈরি একটা দরজার সামনে এসে থামল ওরা। দরজায় লেখা রয়েছেঃ একজিকিউটিভ সুট।
বেশ বড় সাজানো গোছানো ঘর আরোলার। দুধারে বিশাল জানালা, একেবারে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত। বাতাসে তাজা ফুলের সুবাস, যদিও একটাও ফুল চোখে পড়ছে না কোথাও। ঘরের মাঝখানে রোজউড কাঠের মস্ত টেবিল। তাতে রয়েছে বিল্ট-ইন টেলিফোন আর কম্পিউটার। এককোণে গোছানো রয়েছে নটিলাস কোম্পানির ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি। দেয়ালে ঝোলানো আর তাকে সাজানো রয়েছে অসংখ্য স্মারকচিহ্ন আর পুরস্কার। সুগন্ধ বিশারদ সে। অতীতে কাজের জন্য ওগুলো পেয়েছে। নানা রকম ক্যানডির মোড়ক, আর অন্যান্য খাবারের মোড়ক সুন্দর করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালে। বোঝা যায়, ওগুলো সব তার নিজের আবিষ্কার।
ওসব জিনিস কোনটাই চমকৃত করতে পারল না কিশোরকে, করল কেবল আরোলার ফাইলিং সিসটেম।
কি খুঁজতে এসেছি আমরা? টেবিল টেনিস খেলা যায় এতবড় ডেস্কের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মালটিসরবিটেনের একটা জার হলেই চলবে, কিশোর বলল। ফাইলিং কেবিনেট খুলতে লাগল সে। ড্রিপিং চিকেনে মেশানো হয়েছে, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, এ রকম যে কোন জিনিস হলেও চলবে। যে যে উপাদান মেশানো, নিশ্চয় লিখে রেখেছে কাগজে, ফোল্ডারগুলোর পাতা ওল্টাতে শুরু করল সে।
এখানেও একটা কম্পিউটারের টার্মিনাল রয়েছে, বাথরুম থেকে জানাল রবিন। দামী একটা কোলোনের শিশি খুলে বলল। বাহ, চমক্কার গন্ধ!
কি চমৎকার? জানতে চাইল মুসা।
আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেট!
কি বললে? বাথরুমের দরজায় উঁকি দিল রবিন। ইদানীং আরও জটিল হয়ে গেছে তোমার কথাবার্তা!
সহজ কথাটা বুঝতে না পারলে আমি কি করব? বলছি, ড্রিপিং চিকেনে ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেট মেশানো হয়েছে। কাগজপত্রে তা-ই লেখা রয়েছে। জুন আমাকে যেসব কাগজপত্র এনে দিয়েছে ওগুলোতে।
মুসাও আজকাল ওরকম করে কথা বলে, মুখ বাঁকাল রবিন। গাড়ির ইঞ্জিনের ব্যাপারে ও যে কি বলে, কিচ্ছু বুঝতে পারি না! এই তো, গত হপ্তায় মেরামত করে দেয়ার সময় কি জানি কি হয়েছিল, বলল!
ঠেলে ফাইল কেবিনেটটা লাগিয়ে দিল কিশোর। গত দুই বছরের পারচেজ অর্ডার, ইনভয়েস আর ইনভেনটরি লিস্ট ঘাটলাম। তাতে মিরাকল টেস্ট কোম্পানি কোন উপাদান কিনেছে বা তৈরি করেছে, এ রকম কথা লেখা নেই। গুদামে গিয়ে খুঁজতে হবে। এখনই!
কার্পেট বিছানো পথ ধরে প্রায় ছুটতে ছুটতে হলঘরে ফিরে এল ওরা। দারোয়ান বসে বসে ঢুলছে। ওদের সাড়া পেয়ে চমকে জেগে গেল, পেয়েছ। তোমাদের জিনিস? জিজ্ঞেস করল সে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন আর মুসা। জবাব দেয়ার ভারটা ওর ওপরই ছেড়ে দিতে চায়।
না, কিশোর বলল। বললেন তো এখানেই আছে, কিন্তু পেলাম না। গুদামঘরের অফিসে বললেন।
গুদামঘর? দূর, মাথা খারাপ এগুলোর! এই, ওটাকে কি গুদামের অফিস মনে, হয়েছে? তোমাদের কি কমনসেন্স বলেও কিছু নেই!
কমন সেন্স আছে আমাদের দলের চার নম্বর লোকটার, নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল রবিন। কিন্তু সে আজকে আসেনি।
যাও। ডানের পথটা ধরে যাও, যেটাতে কার্পেট বিছানো নেই। তিনটে লাল দরজা পেরিয়ে যাবে। তারপরেই পাবে গুদামঘর। যত্তোসব! ওদের দিকে তাকাল দারোয়ান। দরজা দেখতে কেমন সেটা জানো তো?
ও জানে, কিশোরকে দেখাল মুসা।
হলঘর থেকে বেরিয়ে কার্পেট ছাড়া পথটা ধরল ওরা। একে একে পেরিয়ে এল তিনটে লাল রঙ করা দরজা। ঢুকল বিরাট এক ঘরে। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল যেন। একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে অসংখ্য কেমিক্যালের ড্রাম।
লেবেল পড়ে দেখ, নির্দেশ দিল কিশোর। জলদি।
কটা বাজে? ভুরু নাচাল রবিন।
প্রায় সাতটা।
নটায় সম্মেলন শুরু হবে, ভুলে গেলে চলবে না। তাড়াতাড়ি সারতে হবে আমাদের।
ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে শুরু করল তিনজনে। একটু পরেই চিৎকার করে ডাকল রবিন, অ্যাই, দেখে যাও!
ড্রামের সারির ফাঁক দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। কংক্রীটের মেঝেতে মচমচ করছে জুতো, চেষ্টা করেও শব্দ না করে পারছে না ওরা। একগাদা টিন আর কাঠের পিপার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। প্রতিটির গায়ে লেবেল লাগানোঃ ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেটস।
পেয়ে গেলাম, যা খুঁজছিলে, রবিন বলল কিশোরকে। এতে কি প্রমাণ হলো?
জবাব না দিয়ে লেবেলে লেখা তারিখ দেখল কিশোর। তারপর বলল, দেখ, কবে এসেছে?
পড়ে মুসা বলল, দুই মাস আগে।
কি ভাবে এল? কিশোরের প্রশ্ন। ভাল করে ইনভয়েসগুলো দেখেছি আমি। দুমাস তো দূরের কথা, গত দুই বছরেও কেনা হয়নি ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেট। এক আউন্সও না।… ছোট টিনও আছে। নিয়ে যাব একটা। ভেতরে আসলে কি আছে দেখা দরকার।
দেখার আর দরকার কি? বলে উঠল একটা কণ্ঠ, আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতে পারি।
পাই করে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। দাঁড়িয়ে আছে ফেলিক্স আরোলা।
এভাবে মুখখামুখি হয়ে যাব, ভাবতে পারিনি, বলল সে। ভেবেছিলাম, তদন্তটা বাদই দিয়ে দেবে তোমরা। ভুল করেছি। শেষে আমার পেছনেই লাগলে।
পাথর হয়ে গেছে যেন গোয়েন্দারা।
সরি, পিস্তলটা আরেকটু সোজা করে ধরল আরোলা। খরচের খাতায় তোমাদের নাম লিখে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার।
১৫
পিস্তল উদ্যত রেখেই চট করে হাতঘড়ি দেখল আরোলা। আর বেশি সময় নেই। একটু পরেই বেভারলি হিলটনে লারসনের সম্মেলন শুরু হবে, জ্যাকেটের অন্য পকেটে হাত ঢোকাল সে।
কি করবে এখন লোকটা? ভাবছে কিশোর।
জ্যাকেটের পকেট থেকে হাতটা বের করল আরোলা। মুঠো বন্ধ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই যা করার করে ফেলব। মরার আগে খানিকটা মার্কেট রিসার্চ করতে চাও?
মানে? তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
মুঠো খুলল আরোলা। মোড়কে মোড়া ক্যানডি। খেয়ে দেখবে একটা?
না, কিশোর, খেয়ো না! হুঁশিয়ার করল মুসা, বিষ!
আরোলার দিকে তাকাল কিশোর। তারপর তার পিস্তলের দিকে, তারপর ক্যানডির দিকে এবং সবশেষে ঘড়ির দিকে। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও। খেয়ে দেখলে ক্ষতি কি? পুলিশকে জানিয়ে আসেনি। কেউ উদ্ধার করতে আসবে না ওদের।
তোমার কথার দাম দিই আমি, আরোলা বলল। বুদ্ধিমান ছেলে। অনেক কিছুই বোঝ। সেদিন পার্টিতেই বুঝেছি। তোমাকে মেরে ফেলতে হচ্ছে বলে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে আমার। খেয়ে বলো, কেমন লাগে। বলবে?
দিন। কি আর করা? এত করে যখন বলছেন…
এই তো। বলেছিলাম না, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। জীবনে যদি একটা কাজ করে যেতে না পারলে, তো জন্মই বৃথা। ওই পচা বিজ্ঞানীগুলোর মত। কেবল আবিষ্কারই করতে পারে, জিনিসের মার্কেট ভ্যালু আর বুঝতে পারে না কোনদিন।
মনে হচ্ছে আপনি খুব বোঝেন, লোকটার কথা সহ্য করতে পারছে না রবিন। ওকে এত চাপাচাপি করছেন কেন? আপনি খেয়ে টেস্ট করে নিলেই পারেন…
দেখ ছেলে, বেশি ফরফর করবে না! হঠাৎ রেগে গেল আরোলা। তোমার কপাল ভাল যে তোমার বন্ধুর স্বাদ যাচাই করার ক্ষমতা আছে। বাঁচিয়ে রেখেছি সে কারণেই, সকলকে, নইলে এতক্ষণে লাশ হয়ে যেতে, নিজেকে শান্ত করার জন্যে জোরে জোরে দুবার শ্বাস টানল সে। বিড়বিড় করল, লাশের গন্ধও আমার ভাল লাগে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মনে হচ্ছে, আরোলার মাথায় গোলমাল আছে। কি জানি, গত কয়েক বছরে হয়তো অনেক মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে সে, খাবারে মালটিসরবিটেন মিশিয়ে। আর অপরাধ বোধের কারণেই চাপ পড়েছে মাথায়, গেছে গড়বড় হয়ে।
দিন, একটা ক্যানডি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। খেয়ে দেখি। তবে এক শর্তে। আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল আরোলা। একটা ক্যানডি দিল কিশোরের হাতে।
মুখে ফেলল কিশোর। তিনটে স্বাদ। লেবু-আসল লেবুর গন্ধ পাচ্ছি, নকল। আর রয়েছে ম্যারাং এবং গ্রাহাম ক্র্যাকারের সর। তিনটে মিলিয়ে লেমন ম্যারাং পাই।
চমকার।
এবার আমার পালা, কিশোর বলল। ওই যে ব্রোমিনেটেড সিউডোেফসফেটস লেখা রয়েছে, ওই টিমগুলোতে আসলে রয়েছে মালটিসরবিটেন, তাই না?
হ্যাঁ। তাতে কি?
কিসে ব্যবহার করতে এনেছেন। আমার বিশ্বাস, আপনি নিশ্চয় জানেন ওই জিনিস খাবারে মেশানোর অনুমতি দেয়নি এফ ডি এ।
আরেকটা প্রশ্নের জবাব চাও তো? তাহলে আরেকটা ক্যানডি খেতে হবে। যে কোন একটা তুলে নাও, শয়তানী হাসি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল আরোলা।
খেয়ো না, কিশোর, আরেকবার বাধা দিল মুসা। কায়দা করে খাইয়ে নিচ্ছে।
কিশোরের ধারণা হলো, ক্যানডিগুলোতে অন্য বিষ না থাকলেও মালটিসরবিটেন থাকতে পারে। দুএকটা ক্যানডি খেলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না। আর হলেই বা কি? কিছু তো আর করতে পারছে না। বরং যতক্ষণ খেয়ে যাবে ততক্ষণ মারবে না আরোলা। আর ওর কাছ থেকে কথা আদায় করারও সুযোগ মিলবে। আরেকটা ক্যানডি নিয়ে মোড়ক খুলে মুখের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল।
চেরি জেল-ও। সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যানানা ফ্লোটার আর মাখন, চুষতে চুষতে জানাল কিশোর। আপনার জবাব পেয়েছেন। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন। মালটিসরবিটেনগুলো দিয়ে কি করবেন?
জবাব দিতে সময় নিল আরোলা। দ্বিধা করছে মনে হলো। অবশেষে বলল, বেশ, বলছি। তোমরা তো আর বেঁচে থাকবে না, বেরিয়ে গিয়ে সব বলতেও পারবে না। গোড়া থেকেই বলি, নইলে পরিষ্কার হবে না। বছরখানেক আগে চিকেন লারসেন এসেছিল আমার কাছে। নতুন একটা খাবার তৈরি করতে আমার সাহায্য চাইল। এমন কিছু, যেটার মত সুস্বাদু জিনিস আর কেউ কখনও খায়নি। শুধু খায়নি তা নয়, ভাবতেই পারেনি কেউ, বিশেষ করে হেনরি অগাসটাসের মত লোকে। বলল, লাভের টাকা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে রাজি আছে। তবে, যে কোন খাবার হলে চলবে না। মুরগীর মাংস দিয়ে তৈরি হতে হবে।
সুস্বাদু করে দিতে বলেছেন, ফোড়ন কাটল রবিন। কিন্তু মিস্টার লারসেন নিশ্চয় বিষ মিশিয়ে দিতে বলেননি।
তুমি চুপ করো! ধমকে উঠল আরোলা। ভেঁপো ছোকরা!, আবার জোরে জোরে দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করল সে। মুরগী দিয়ে খাবার তৈরি করা সহজ। সেটা অনেকেই পারে। কিন্তু লোকে বার বার খেতে চাইবে, অর্থাৎ, নেশা হয়ে যাবে, এ রকম কি উপাদান মেশানো যায়? ভাবতে লাগলাম। ফ্লেভার মিশিয়ে যতভাবে সম্ভব সুস্বাদু করার চেষ্টা করলাম। হলো-ও। কিন্তু লারসেন যা চেয়েছে। তা হলো না।
তারপর দিলেন মালটিসরবিটেন মিশিয়ে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তৃতীয় আরেকটা ক্যানডি খেতে বলল আরোলা। ঘড়ি দেখে বলল, সময় শেষ হয়ে আসছে।… কি মেশালে যে তেমন সুস্বাদু হবে ভেবেই পেলাম না। আমার সাধ্যমত… ও-কি, খাচ্ছ না?
খাব। পরে। বলুন আগে।
কিশোর, সাবধান করল রবিন। খেয়ো না। ড্রিপিং চিকেনে যেমন ক্যারসিনোজেন মিশিয়েছে, ওই ক্যানডিতেও মিশিয়ে থাকতে পারে।
মেশালেই বা কি? ও তো এখনই মরবে এমনিতেই, আরোলা বলল। দশ বিশ বছরের মধ্যে টের পাবে না লোকে, ক্ষতি হবে না। অনেক লম্বা সময়। অনেকে অতদিন বাঁচবে না এমনিতেই। যাই হোক, খাবার যে বিষাক্ত, এটা কোনদিনই টের পাবে না লোকে। ভেবে দেখলাম, ক্যান্সার হয়ে মারা গেলে ধরা পড়ারও কোন আশঙ্কা নেই। ওই রোগ তো আজকাল হরদম হচ্ছে। আমার বানানো খাবার খেয়ে যে হয়েছে, সেটা বোঝার সাধ্য ডাক্তারেরও হবে না। তাই ঠিক করলাম, দেব মিশিয়ে। লারসেনও কিছু জানতে পারবে না। কারণ, তৈরি করা অবস্থায় খাবার আমার কাছ থেকে নিতে হবে তাকে, আগেই বলে দিয়েছি। প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেব তার রেস্টুরেন্টে।
ঘড়ির দিকে তাকাল কিশোর। আটটা বাজতে দেরি নেই। সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। সেই সঙ্গে ফুরিয়ে আসছে ওদের আয়ু।
আরেকটা প্রশ্ন, বলল সে। আজ রাতে এখানে ফিরে এলেন কেন হঠাৎ করে?
দারোয়ানদেরকে ভাল বেতন দিই আমি। তোমরা ওর সঙ্গে কথা বলে অফিসে ঢোকার পর পরই ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে সে। আমার গাড়িতে ফোন আছে, কিশোরের হাতের ক্যানডিটার দিকে তাকাল সে। খেয়ে ফেল। দেরি করলে আর কোনদিনই খেতে পারবে না। স্বাদটা বলে যাও মরার আগে।
মোড়ক খুলল কিশোর। এটা অন্য দুটোর চেয়ে আলাদা। ভারিও বেশি। মিস্টার এক্স আপনার দলের লোক, তাই না? ওই যে, সারাক্ষণ আর্মি ক্যামমাফ্লেজ জ্যাকেট পরে থাকে?
মিস্টার এক্স? হেসে উঠল আরোলা। নামটা তো ভালই দিয়েছ। অবশ্য তোমার সব কিছুই অন্য রকম। ওর নাম জেনার। আমার পাশের বাড়িতেই থাকে। সেনাবাহিনীতে ছিল, বদ স্বভাবের জন্যে বের করে দিয়েছে। মেজাজও খুব খারাপ। অযথাই লোকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ওকে দলে নেয়া বিপজ্জনক। তবে তার সাহায্য নিই মাঝে মাঝে। টাকার বিনিময়ে। যে মুহূর্তে শুনলাম জুনের কাছে তোমরা ডিটেকটিভ, লারসেনের পার্টিতে, মনে হলো, ওই লোককে দিয়ে তোমাদের ভয় দেখাতে পারি, যাতে আমার ব্যাপারে আর নাক না গলাও। ওকে বললাম। সে প্রথমে টেপ করল তোমাদের টেলিফোন।
হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। এ ভাবেই জেনেছে, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমরা খাবার কিনতে যাচ্ছি। পিটালুসে যাচ্ছি।
হ্যাঁ। কাজের লোক। খুব চালাক। তবে তোমরা ওর চেয়ে বেশি। তোমাদের সঙ্গে চালাকি করে সুবিধে করতে পারেনি, কিশোরের দিকে পিস্তল নাড়ল। আরোলা। ক্যানডিটা খাও!
খেয়ো না, কিশোর, মুসা বলল।
শুনল না কিশোর। মুখে পুরে দিয়ে চুষতে লাগল। বলল, ক্যারামেল।
অত তাড়াহুড়া কোরো না, আরোলা বলল। আরেকটু খাও। ভাল করে বোঝ। তারপর বলো, হাসছে সে।
আরও কিছুক্ষণ চুষল কিশোর। বলল, আরি, তাই তো! বেশ চালাকি করা হয়েছে! ক্যারামেল আপেল। এখন মনে হচ্ছে আপেলের রসই খাচ্ছি।
তোমার কথা মনে রাখব আমি, আরোলা বলল। তোমার সম্মানেই এই ক্যানডির নাম দেব মিস্টার এক্স। ওরকম গালভরা একটা নামই খুঁজছিলাম। দিয়ে সাহায্য করলে আমাকে। থ্যাংক ইউ।
আপনি একজন ব্রিলিয়ান্ট সাইনটিস্ট, বুদ্ধিমান মার্কেটিং ম্যান, কিশোর বলল। কিন্তু ভয়ঙ্কর খুনী।
যা দিনকাল পড়েছে। কাকে যে কখন কি হয়ে যেতে হবে, ঠিকঠিকানা নেই। যাই হোক, আসল কথা হলো, তোমাদেরকে এখন শেষ করে দিতে হবে। কষ্ট লাগছে আমার।
পিস্তলের সেফটি ক্যাচ তো লক করা, কিশোর বলল। অন করে নিন আগে।
তাই নাকি? ওটার দিকে তাকাল আরোলা।
একটা মুহূর্ত দেরি করল না মুসা। সুযোগটা কাজে লাগাল। চোখের পলকে পাশ থেকে এক লাথি ঝেড়ে দিল, কারাতের ভাষায় একে বলে ইওকো-টোবিগেরি। আরোলার হাতে লাগল। উড়ে গিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল ওর হাতের পিস্তল।
কিশোর আর রবিনও আক্রমণ করে বসল। কিন্তু লোকটার গায়ে বেজায় শক্তি। কিছু কারাতে-টারাতেও জানে মনে হলো। রবিনের হাঁটুতে লাথি মেরে তাকে বসিয়ে দিল। ঝট করে ঘুরে মুসাকে ঠেকানোর চেষ্টা করল। পারল না। আঘাতটা আটকে ফেলে গন্ধ-বিজ্ঞানীর বুকে প্রচন্ড এক ঘুসি মারল মুসা। নাক কুঁচকে গেল আরোলার। পিছিয়ে গেল।
সময় দিল না মুসা। শূন্যে লাফিয়ে উঠল। মোচড় দিয়ে ওপরে তুলে ফেলেছে ডান পা, একেবারে সোজা। আইইআহ করে কারাতের বিকট চিৎকার করে প্রচন্ড লাথি লাগাল আরোলার বুকে, একই জায়গায়, যেখানে ঘুসি মেরেছিল।
পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়াল আবার আরোলা। পাগলের মত চারপাশে তাকাচ্ছে। কিশোরের এক সেকেন্ড আগে পিস্তলটা চোখে পড়ল তার। দৌড় দিল তুলে নেয়ার জন্যে।
১৬
ডাইভ দিয়ে পড়ল আরোলা। একই সঙ্গে কিশোরও ঝাপ দিল। দুজনেই হাত বাড়াল পিস্তলটা তোলার জন্যে। আগে ধরল আরোলা। তুলে নিয়ে হাসতে আরম্ভ করল হা হা করে। তিন গোয়েন্দার মুখোমুখি হওয়ার জন্যে ঘুরল।
এতক্ষণে লক্ষ্য করল আরোলা, পিস্তলের দিকেই নজর ছিল তার বেশি, যাদের সঙ্গে লড়াই করছে তারা কি করছে খেয়াল করেনি। করার সময়ও ছিল না অবশ্য। ব্রোমিনেটেড সিউডোেফসফেটের একটা ভারি পিপা উড়ে এল তার দিকে।
মুসা আর রবিন দুজনে মিলে তুলে ছুঁড়ে মেরেছে। দড়াম করে আরোলার গায়ে লাগল ওটা, পড়ে গেল সে। মেঝেতে পড়ে ফেটে ভেঙে গেল পিপাটা। ভেতরের শত শত পাউন্ড মালটিসরবিটেন ছড়িয়ে গেল মেঝেতে, কিছু পড়ল আরোলার ওপরও।
নিন শিস দিয়ে উঠল রবিন। নিজের ওষুধ নিজেই খানিকটা খেয়ে চাঙা হোন।
ওর কথা শুনতে পায়নি আরোলা। বেঁহুশ হয়ে গেছে মাথায় বাড়ি খেয়ে। ইলেকট্রিকের এক্সটেনশন কর্ড ছিড়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলল মুসা আর কিশোর মিলে।
হুঁশ ফিরল আরোলার। গোঁ গোঁ করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
তেমন কিছু না, কিশোর বলল। আমাদেরকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছিলেন খানিকক্ষণ। তারপর সামান্য মারপিট হলো। চিত হয়ে গেলেন আপনি। এখন বাঁধা আছেন।
পুলিশকে ডাকার সময় নেই এখন, রবিন বলল। পরে ওদের সঙ্গে দেখা হবে আপনার।
পুলিশ? প্রতিধ্বনি তুলল যেন আরোলা।
হ্যাঁ, কিশোর বলল। আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করব আমরা। আমাদের পেছনে ভাড়াটে গুন্ডা লাগানো, খাবারে অবৈধভাবে বিষাক্ত উপাদান মেশানো এবং অবশ্যই আমাদেরকে খুন করতে চাওয়ার কথা রিপোর্ট করব। এর যে কোন একটা অভিযোগই আপনাকে জেলে ঢোকানোর জন্যে যথেষ্ট। যাক, সেটা পরে করব, যেন বক্তৃতা দিচ্ছে, এই ভঙ্গিতে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। এখন তাড়াতাড়ি আমাদেরকে বেভারলি হিলটন হোটেলে যেতে হবে। বন্ধ করতে হবে সম্মেলনটা। এই, এসো তোমরা।
আধ ঘণ্টা লাগল। মুসা চালিয়েছে বলেই, রবিন চালালে আরও বেশি লাগত। সে মুসার মত বেপরোয়া চালাতে পারে না। হোটেলের সামনে গাড়ি রেখে দৌড়ে ঢুকল ওরা। কোথায় কি হচ্ছে নির্দেশ রয়েছে নিচের লবিতে। পড়ে জানা গেল এমপায়ার বলরুমে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন চলছে।
প্রথমেই টেলিফোন করে পুলিশ প্রধানকে খবর দিল কিশোর, জানাল ফেলিক্স আরোলার অবস্থা। তারপর ছুট দিল।
বলরুমে ঢুকল না গোয়েন্দারা। দরজার পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। সেখানে দেখতে পেল চিকেন লারসেনকে। পরনে হলুদ জগিং স্যুট। বুকের কাছে লাল আর কমলা পালক আঁকা। অবশ্যই মুরগীর। পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুন আর ডন বারোজ। রান্নাঘরের প্রতিটি কাউন্টারে ট্রেতে স্তূপ করে রাখা ধূমায়িত ড্রিপিং চিকেন।
অ্যাই যে, এসে গেছ, ভালুকের মত বিশাল থাবা তুলে এগিয়ে এলেন লারসেন। বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলেন কিশোরের গলা। সত্যি কথাটা বলবে এর জন্যে জীবনে যদি আর তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে না হয়, কথা বলতে ইচ্ছে না করে আমার, যদি ধ্বংস হয়ে যাই, যাব। তবু, সত্যি কথাটা জানতে হবে।
আপাতত এই সম্মেলনের কথা ভুলে যান, কিশোর বলল। মারাত্মক বিষ মেশানো রয়েছে ড্রিপিং চিকেনে। ভয়াবহ ক্যারসিনোজেন ভরে দেয়া হয়েছে। পার্টি ক্যানসেল করুন। বাজারে ছেড়ে থাকলে এখুনি সেগুলো ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। নইলে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে।
হাঁ করে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে লারসেন। রান্নাঘরের সমস্ত খুটুরখাটুর বন্ধ হয়ে গেছে, একেবারে চুপ। তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি, হাহ হাহ হাহ হা! বলেছিলাম না! ওকে আমি পালকপুত্র করে নেবই! আমাকে কেমন বাঁচিয়ে দিল, দেখলে তো ডন…
ডন পালাচ্ছে! চিৎকার করে উঠল রবিন।
সবাই ফিরে তাকাল। লাফাতে লাফাতে দরজার দিকে ছুটেছে ডন বারোজ।
প্রথমেই যে জিনিসটা চোখে পড়ল সেটা তুলে নিল কিশোর আর মুসা মিলে। লম্বা বড় একটা ট্রে। ড্রিপিং চিকেনে বোঝাই। এক দুলুনি দিয়েই ছুঁড়ে মারল ডনকে সই করে। থ্যাপাত করে তার পিঠে গিয়ে লাগল ট্রেটা। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল ড্রিপিং চিকেন।
ট্রেটা ছুড়েই ডাইভ দিল মুসা। কাঁধ খামচে ধরল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া লোকটার। এক হ্যাঁচকা টানে চিত করে ফেলল মেঝেতে। যেখানে ড্রিপিং চিকেন আর ওগুলোর রস গড়াচ্ছে। মাখামাখি হয়ে গেল ডনের শরীরে।
ভয়াবহ অবাধ্যতা! চেঁচিয়ে উঠল ডন, মুসার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে। এর জন্যে কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত তোমার!
কোর্টে তো আপনি যাবেন, বারোজ সাহেব, হেসে বলল কিশোর। ড্রিপিং চিকেনে বিষ মেশানোর অপরাধে।
যা খুশি করতে পারো আমাকে নিয়ে। টরচার করতে পারো। নাম, র্যাংক, সিরিয়াল নাম্বার সব ছিনিয়ে নিতে পারো। কিন্তু মুখ খোলাতে পারবে না, বেশ গর্বের সঙ্গেই বলল ডন। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
আপনার মুখ খোলানোর দরকারও নেই। যা বলার আরোলাই বলে দিয়েছে আমাদেরকে। পুলিশ চেপে ধরলে আবারও বলবে। চিকেন লারসেনের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়ার জন্যে যে আপনি ওকে টাকা খাইয়েছেন, সে কথাও বলবে।
মিথুক! বিশ্বাসঘাতক! গলা ফাটিয়ে চিষ্কার করে উঠল ডন। আমি নাকি! সে-ই তো আমাকে টাকা দিল!
হাসি বাড়ল কিশোরের। তাই নাকি? তাহলে আমি ভুল বলেছি। মানে, ভুল আন্দাজ করেছি।
বলে কি? চোখ বড় বড় হয়ে গেছে লারসেনের। বিশ্বাস করতে পারছেন না। অ্যাই, ভাল চাইলে স্বীকার করো সব কথা! ডনকে আদেশ দিলেন তিনি।
জেনারেল, ডন বলল। আপনার ড্রিপিং চিকেনে এমন এক উপাদান মেশানো আছে, কয়েক বছর আগে যা বিষাক্ত বলে ঘোষণা করে দিয়েছে এফ ডি এ। কেমন লাগছে শুনতে?
তুমি আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছ! গর্জে উঠলেন লারসেন।
করবই তো। আপনি তো আর আমাকে দশ লাখ ডলার দেননি, ডনও জবাব দিল সমান তেজে। কিন্তু ফেলিক্স আরোলা দিয়েছে।
আর সেই টাকা খেয়ে আপনি খাবারে বিষ মিশিয়েছেন, কিশোর যোগ করল।
দশ লাখ অনেক টাকা। বিশ্বাসী সৈনিককেও বেঈমান বানিয়ে দেয়। আসলে, এসব করতে না এসে অনেক আগেই মারসেনারিতে যোগ দেয়া উচিত ছিল আমার।
আর সহ্য করতে পারলেন না লারসেন। ছুটে গেলেন ডনের কাছে। টান দিয়ে দিয়ে ছিড়ে ফেলতে লাগলেন পকেটে লাগানো মেডেলগুলো, যেগুলো তিনি দিয়েছিলেন কাজের পুরস্কার হিসেবে। তোমার ঘাড়টা মুরগীর ঘাড়ের মত মুচড়ে ভাঙতে পারলে এখন আমি খুশি হতাম! চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
এগিয়ে এল কিশোর। আর একটা প্রশ্ন। সে রাতে জুনকে আপনিই তাড়া করেছিলেন, তাই না?
করেছিলাম, স্বীকার করল ডন।
কেন করেছিলেন? বাবার হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে জুন। নইলে যেন পড়ে যাবে।
রিপোর্টটা ছিল আমার ডেস্কের ওপর। ড্রিপিং চিকেনে মেশানোর উপাদানের লিস্ট সহ। অফিস ছুটি হওয়ার পরই সেদিন থেকে গিয়েছিলে তুমি। আমার ঘরে ঢুকে টেবিলে দেখে ফেলেছিলে কাগজগুলো। চেঁচামেচি শুরু করেছিলে। কাগজগুলোতে টপ সিক্রেট লেখা ছিল। অন্যায় ভাবে অনুমতি না নিয়ে পড়ার অপরাধে গুলি করে মারা উচিত ছিল তোমাকে। এ তো রীতিমত গুপ্তচরগিরি।
রিপোর্টটা নিয়ে পালাতে চেয়েছিল জুন, কিশোর বলল। আর আপনি ওকে তাড়া করলেন?
করলাম। তবে ওর ক্ষতি করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না, জুনের দিকে তাকাল ডন। বৃষ্টির মধ্যে তোমার গাড়িটা ঢাল বেয়ে পিছলে পড়ে গেল। ওটা নিছকই দুর্ঘটনা। আমার ব্যাংকের কসম খেয়ে বলছি।
ওকে সাহায্য করলে না কেন তুমি? জিজ্ঞেস করলেন লারসেন।
থেমেছিলাম…সাহায্য করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সবার আগে আমার আইডেনটিটি। ওটা তো বাঁচাতে হবে। কাজেই নিজে কিছু না করে পুলিশকে ফোন করলাম। দুর্ঘটনার পুরো বিবরণ জানালাম। নামটা অবশ্যই গোপন রেখে।
বাবা, হাঁপাচ্ছে জুন। এখন আমার মনে পড়ছে। অ্যাক্সিডেন্ট…ভয়ঙ্কর…! কাঁদতে শুরু করল সে। সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে একহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন লারসেন।
একটা সময় তো আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, কিশোর বলল। এ সবের পেছনে হেনরি অগাসটাসের হাত রয়েছে। তাকে অনুসরণ করে আপনার মুরগীর খামারে চলে গিয়েছিলাম আমরা। ওখানে তাকে বলতে শুনলাম, খামারটা সে কিনে নেবে, মুরগীর খাবার বদলে দেবে।
ওই দুষ্ট মুরগীর ছানাটা কিছু বোঝে না। কোনটা চিকেন ফিড আর কোনটা চিকেন স্যালাড বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। নিজের খামারের মুরগীদের খাবার কিছুদিন পর পরই বদলাতে থাকে। কতটা ক্ষতি যে করে, বুঝতেই পারে না, লারসেন বললেন। বাজারে গুজব ছড়ায়, আমার ফার্ম সে কিনে নেবে। এসব বলে বলে বোঝাতে চায়, আমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। ও ভাল করেই জানে, খাবার বানিয়ে আমার সঙ্গে পারবে না। আর আমার ব্যবসা কিনে নেয়ার মত অত টাকাও তার নেই। শুধু শুধু শয়তানী করা আরকি।
কিশোর, জুন বলল। এখন তো বুঝতে পারলে, আমার বাবা নির্দোষ। বলো?
হ্যাঁ, অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর। লারসেনকে সন্দেহ করেছিল এবং সে কথা বলেছিল বলে। একটা কথা বলবেন? সেদিন স্টুডিওতে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, ড্রিপিং চিকেন কামড়ে নিয়েও সেটা বার বার ফেলে দিচ্ছিলেন কেন? আমি ভেবেছি, বিষ মেশানো আছে সেটা বুঝতে পেরেই আপনি খাচ্ছেন না।
খাবারের বিজ্ঞাপনের শুটিঙে সবাই ওরকম করে, লারসেন বললেন। ধর তিরিশ বার তোলা হলো এক ছবি। তিরিশবারই যদি তুমি এক কামড় করে খাও, তাহলে তো গলা পর্যন্ত উঠে আসবে খাবার। একতিরিশ নম্বর কামড়টা বসাতেই ইচ্ছে করবে না আর।
বাবার দিকে ফিরল জুন। বাবা, ওদিকে তো লোক বসে আছে। একশোজন সাংবাদিক নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠেছে ড্রিপিং চিকেনের আশায়। কি করা যায়?
বুকের কাছে আঁকা পালকে হাত বোলালেন লারসেন। উপায় খুঁজছেন মনে মনে। হাসলেন। ব্যবস্থা একটা করেই ফেলব।
ছুটে গেলেন তিনি বলরুমে। দাঁড়ালেন গিয়ে স্পটলাইটের নিচে মাইক্রোফোনের সামনে। গুড ইভনিং, লেডিজ অ্যাও জেন্টেলম্যান, বলতে লাগলেন তিনি। আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন, আজ রাতে কেন আপনাদেরকে দাওয়াত করে এনেছি আমি। আপনারা জানেন, আপনাদের মধ্যে অনেকেই ভাবেন আমি দ্রুত টাকা কামানোের তালে থাকি, আর খবরের হেডলাইন হতে চাই। হাহ হাহ হা!
তার হাসিতে যোগ দিল পুরো কক্ষ। চিকেন লারসেনের স্বভাব আর কথাবার্তার ধরন জানা আছে তাদের। কেউ কিছু মনে করল না।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আজকে আপনাদের দাওয়াত করেছি আমার বিখ্যাত ফ্রাইড চিকেন খাওয়ানোর জন্যে। আর আমি যে ধোকা দিইনি, সেটা প্রমাণ করার জন্যেই কিছুক্ষণের মধ্যে আসছে… পরের শব্দটা বলতে সময় নিলেন তিনি, ভাবতে হয়েছে বোধহয়, পিজা! ঠিক। পিজা! আর শুনে নিশ্চয় আমার মতই আপনারাও অবাক হয়েছেন। কি খাওয়াতে এনে কি খাওয়াচ্ছি ভেবে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন লারসেন। তবে কদ্রমহোদয়গণ, নতুন কিছুর ঘোষণা দিতে পারব বলে গর্ব হচ্ছে আমার। আজ রাতে আমি ঘোষণা করছি চিকেন লারসেন সিটি স্নিকার অ্যাওয়ার্ড। প্রতি বছরই কোন না কোন পুরস্কার ঘোষণা করি, জানা আছে আপনাদের। এবারও করছি। আমাদের আজকের বিজেতারা হলো কিশোর পাশা, মুসা আমান, আর রবিন মিলফোর্ড। রকি বীচের অনেকেই চেনেন তাদের, অন্তত নাম শুনে থাকবেন। ওরা তিন গোয়েন্দা বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। ওদের সম্মানেই আজকের আমার এই পার্টির আয়োজন। কেন পুরস্কারটা দিলাম ওদের, তা নাহয় গোপনই থাক। আড়ালে আড়ালে অনেক বড় কাজ করে ফেলেছে ওরা, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষকে অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওদের প্রতি আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ, সেই মানুষদেরও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, যদিও ওরা জানেই না কেন থাকতে হবে। ঘুরে তাকালেন তিনি। দরজার কাছে দাঁড়ানো বিস্মিত তিন গোয়েন্দাকে হাত নেড়ে ডাকলেন।
এক এক করে মঞ্চে উঠে এল কিশোর, মুসা, রবিন। স্পটলাইটের নিচে এসে দাঁড়াল। আলোর নিচে থাকার জন্যে গাদাগাদি করে দাঁড়াতে হলো ওদের, কারণ বেশির ভাগটাই জুড়ে রয়েছেন চিকেন লারসেন।
বার বার হাত মেলালেন ওদের সঙ্গে। অনেকগুলো ফ্রী কুপন বিতরণ করলেন, যাতে বিনে পয়সায় গিয়ে লারসেন রেস্টুরেন্টে খেতে পারে। টেলিভিশন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, হাত নাড়লেন।
শোন, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি, বিরাট বিজ্ঞাপন হলো। কয়েক মাস ধরে চলবে এটা টিভিতে।
আপনি খুশি থাকলেই আমরা খুশি, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
হ্যাঁ, আমরা ধন্য, বিড়বিড় করল রবিন। ঠিক, বলল মুসা।
অমন পেঁচার মত মুখ করে রেখেছ কেন? লারসেন বুললেন। প্রতিদিন আমার সঙ্গে তোমাদেরকেও দেখানো হবে টিভিতে। লোকে চিনে ফেলবে। ভাল হলো না?
না, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর হলো না। চেনা হয়ে গেলে গোয়েন্দাগিরিতে খুব অসুবিধে হয়। সুবিধেও হয় অবশ্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, তবে সেটা কম। এনিওয়ে, মেনি মেনি থ্যাংকস! যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
***