খানিকটা তামার তার :: হেমেন্দ্রকুমার রায়

খানিকটা তামার তার – হেমেন্দ্রকুমার রায়

মানিক চেঁচিয়ে পড়ছিল খবরের কাগজ শ্রোতা হচ্ছে জয়ন্ত। সে চোখ বুজে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। তার মুখে বিরক্তির লক্ষণ। কোন খবরে নূতনত্ব নেই। খুনীরা খুন করছে সেই পুরাতন উপায়ে। চোররাও চুরি করবার নূতন পথ আবিষ্কার করতে পারছে না। সাধু এবং অসাধু সব মানুষই হচ্ছে একই বাঁধা পথের পথিক।

মানিক একটা নূতন খবর পড়ছে:

‘অদ্ভূত দৈব দুর্ঘটনা!’

গত সপ্তাহে শালিখার একটা বাড়িতে অজিতকুমার বসু নামক জনৈক যুবক বজ্রাঘাতে মারা পড়িয়াছিল, এই সংবাদ আমরা যথাসময়ে পত্রস্থ করিয়াছি। গত পরশু রাতে আবার সেই বাড়িতেই অজিতকুমারের দ্বিতীয় ভ্রাতা অসীমকুমারের মৃত্যু হইয়াছে ঐ বজ্রাঘাতের ফলেই। ইংরেজী প্রবাদে বলে, দুর্ভাগ্য কখনো একা আসে না। কিন্তু উপর-উপরি দুইবারই একই পরিবারে একই দুর্ভাগ্যের এমন আশ্চর্য আবির্ভাবের কাহিনী আমরা আর কখনই শ্রবণ করি নাই।’

জয়ন্ত চোখ মেলে সোজা হয়ে উঠে বসে বললে, ‘থামো মানিক। আপাতত আর কোনও খবর পড়ে শোনাতে হবে না।’

মানিক হেসে বললে, ‘বুঝেছি।’

‘কি বুঝেছ?’

‘এই খবরটার ভিতরে তুমি চিন্তার খোরাক পেয়েছ।’

‘তা পেয়েছি বৈকি। আমার পাপী মন একরকম অসম্ভব দৈব দুর্ঘটনাকে সহজে স্বীকার করতে রাজী নয়। ভগবানের হাতের আড়ালে আমি দেখছি মানুষের হাত।’

মানিক জবাব না দিয়ে কাগজখানা সামনের টেবিলের উপর রেখে দিলে।

জয়ন্ত খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর বললে, ‘টেলিফোনের রিসিভারটা এগিয়ে দাও তো।’

‘কাকে ফোন করবে?’

‘আমাদের বন্ধু গিরীন্দ্র চৌধুরীকে।’

‘ইন্সপেকটর গিরীন্দ্র চৌধুরী?’

‘হ্যাঁ। তার কার্যক্ষেত্র তো ঐ অঞ্চলেই; হয়ত সে আমাদের অন্ধকার মনকে কিঞ্চিত্ আলোকিত করতে পারবে।’

যথাসময়ে ফোনের মধ্যে জাগ্রত হল গিরীন্দ্র চৌধুরীর কণ্ঠস্বর।

‘গিরীন্দ্র, আমি জয়ন্ত।’

‘একই বাড়ীতে বজ্রাঘাতে দুই ব্যক্তির মৃত্যু। ঘটনা কি তোমারই এলাকায় ঘটেছে?’

‘ও হো হো, বুঝেছি। মনসা পেয়েছে ধুনোর গন্ধ! তা, ঠিক আন্দাজ করেছ ভাই? ঘটনাস্থলে আমাকেও হাজির হতে হয়েছে বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্ত।’

‘মানে?’

‘মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারছে সন্দেহ! কিন্তু সে সন্দেহ প্রকাশ বা পোষণ করবার উপায় নেই।’

‘কেন?’

‘লোক-দুটো সত্য-সত্যই বজ্র বা বিদ্যুতের আক্রমণে মারা পড়েছে।’

‘তবে আবার সন্দেহ কিসের?’

‘না, ঠিক সন্দেহও নয়। তবে মাঝে মাঝে পাচ্ছি যেন বিপরীত ইঙ্গিত।

একবার বেড়াতে বেড়াতে আমার এখানে আসবে নাকি?’

‘নারাজ নই।’

জয়ন্ত ও মানিককে দেখে গিরীন্দ্র বললে, ‘প্রথমেই তোমরা কি এক-এক পেয়ালা কফি পান করতে চাও। জান তো, আমি চায়ের ভক্ত নই।’

জয়ন্ত বললো ‘কফি বা চা কিছুই চাই না। আমরা আজ গল্প শুনতে এসেছি।’

‘তাহলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করি।’

‘হ্যাঁ, গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে।’

‘শোন। আজ এক বছর হল, অমরনাথ বসু মারা গিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন বড় জমিদার, যথেষ্ট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক। অজিতকুমার, অসীমকুমার আর অমলকুমার হচ্ছে তাঁর তিন ছেলে। ছোট অমল নাবালক, সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্র। অমরবাবুর একটি মাত্র মেয়ে সুষমা, তার বিবাহ হয়েছে, স্বামীর নাম সুরেন্দ্রনাথ মিত্র। সুষমার শ্বশুরবাড়ি বিদেশে কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর ভাইদের অনুরোধে স্বামীর

সঙ্গে বাপের বাড়িতেই বাস করে। এই হচ্ছে গত আর বর্তমান পাত্রপাত্রীদের পরিচয়।

‘প্রথমে অজিত যখন বজ্রাঘাতে মারা পড়ে, ঘটনাটা আমার মনে স্থায়ী রেখাপাত করেনি। ডাক্তার বললে মৃত্যুর কারণ বিদ্যুতের আঘাত।

কিন্তু গেল পরশু অসীমও ঐ ভাবে মারা পড়তে আমরা রীতিমত চমকে গিয়েছি; এবারেও ডাক্তারের মুখে মৃত্যুর কারণ শুনলুম বটে, কিন্তু দুই সপ্তাহের মধ্যে একই পরিবারের উপর বজ্রের এমন পক্ষপাতিত্ব বিস্ময়কর। অবশ্য দুটি ঘটনার রাত্রেই মেঘাচ্ছন্ন সজল আকাশ থেকে বজ্রের হুঙ্কার আমরা সকলেই শুনেছি।’

‘তবে তুমি সন্দিগ্ধ হয়েছ কেন?’

‘দু-দিনই ঘটনাস্থলে গিয়ে দুটো মৃতদেহ ছাড়া বজ্রাঘাতের আর কোনও চিহ্ণই দেখতে পাইনি।’

‘এ ছাড়া আর কিছু লক্ষ্য করেছ?’

‘করেছি। দু-দিনই লাস পাওয়া গিয়েছে পূর্বদিকের জানালার নীচে মেঝের উপর। এও লক্ষ্য করেছি মৃত্যুর রাত্রে অজিত আর অসীম যে বিছানায় ঘুমিয়েছিল, খাটের শয্যার উপরে সে প্রমাণের অভাব নেই। কিন্তু দুর্যোগময় রাত্রে তারা শয্যা ত্যাগ করে জানালার ধারে এসেছিল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি।’

‘তাহলে তোমরা কোন মামলা খাড়া করতে পারনি।’

‘উঁহু! মামলা দাঁড়াবে কিসের উপরে। প্রমাণ কই। সন্দেহ তো প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হবে না!’

‘আমাকে একবার ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে পার?’

‘অনায়াসে। সেখানে গিয়ে পৌঁছতে পাঁচ-ছয় মিনিটের বেশি লাগবে না। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি কি দেখবে?’

‘যা দেখবার তাই।’

গিরীন্দ্র হেসে উঠে বললে, ‘কিন্তু আমি ভবিষ্যত্বাণী করছি সেখানে গিয়ে আমরা যা দেখেছি, তার চেয়ে বেশি কিছুই তুমি দেখতে পাবে না? এটা মামলাই নয়, আশ্চর্যভাবে দৈব দুর্ঘটনায় দুটো লোক মরেছে এইমাত্র।’

‘আশা করি তোমার কথাই সত্য হবে। এখন চল।’

অমরবাবুর বাড়িখানি মাঝারি। তার পূর্বদিকে ট্রাম লাইনের পাতা রাস্তা, পশ্চিম দিকে খিড়কির পুকুর ও বাগান এবং দক্ষিণদিকে প্রতিবেশীদের বাড়ির সারি।

গিরীন্দ্রের সঙ্গে জয়ন্ত ও মানিক রাস্তার দিকের দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

গিরীন্দ্র সব দেখাতে দেখাতে বললে, ‘বারান্দার কোণে এই যে তিনখানা ঘর দেখছ এর প্রথমখানা হচ্ছে অজিতের ঘর। দ্বিতীয়খানা অসীমের আর তৃতীয়খানা অমলের। প্রথম ঘরের এই জানালার তলায় অজিতের আর দ্বিতীয় ঘরের ঐ জানালার তলায় পাওয়া গেছে অসীমের মৃতদেহ। এ দুটো ঘর এখন খালি পড়ে আছে।’

জয়ন্ত দু’খানা ঘরে ঢুকেই চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল।

প্রত্যেক জানালা, এমনকি দেওয়ালের লোহার গরাদে পর্যন্ত ভাল করে পরীক্ষা করলে। উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া গেল না।

তারপর তারা তৃতীয় ঘরের একটা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহির থেকেই দেখা গেল, ঘরের ভিতরে চেয়ারের উপরে বসে রয়েছে দুটি লোক। একজনের বয়স হবে আঠারো ঊনিশ আর এক জনের চল্লিশের কাছাকাছি।

জয়ন্তের দিকে ফিরে গিরীন্দ্র চুপি চুপি বললে, ‘অমল আর তার ভগ্নিপতি সুরেনবাবু।’ তারপর ঘরের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বললে, ‘কী হয়েছে সুরেনবাবু, অমলের মুখের ভাব অমনধারা কেন।’

অমলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলোতে বুলোতে সুরেন বললে, ‘বাড়িতে আবার পুলিশ দেখে অমল ভয় পেয়েছে। তাই আমি একে বোঝাবার চেষ্টা করছি।’

‘বেশ করেছেন। আমরা বাঘ নই, তেড়ে গিয়ে অমলকে কামড়ে দেব না। আজ একেবারে শেষ তদন্ত করতে এসেছি, আর আসব না।’

সুরেন বললে, ‘আর তদন্ত! এ হচ্ছে ভগবানের মার, পুলিশ তদন্তের ধার ধারে না!’

সেদিক থেকে ফিরে আসতে আসতে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘অমল কি এখনো এই ঘরেই থাকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘একলা?’

‘হ্যাঁ।’

‘সুরেনবাবুর ঘর কোথায়?’

‘বাড়ির পশ্চিম দিকে।’

বারান্দার রেলিঙের উপরে হাত রেখে ট্রামের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে যে কী ভাবছে, তার মুখ দেখে কিছুই বোঝবার জো নেই।

মানিক বললে, ‘কী হে, ধ্যান সাগরে তলিয়ে গেলে নাকি?’

‘আমি তলাবার চেষ্টা করছি না মানিক, আমি ভাসবার চেষ্টা করছি।’

গিরীন্দ্র ঠাট্টার সুরে বললে, ‘কী আবিষ্কার করলে শুনি?’

‘শুনবেন? এই বাড়িতে চোর আসতে পারে সহজেই।’

‘তাই নাকি?’

‘নিচের ঐ গ্যাস-পোস্টটার দিকে তাকিয়ে দেখ। ওর উপরে উঠলেই এই বারান্দার নাগাল পাওয়া যায়।’

‘উঃ, অভাবিত আবিষ্কার!’

‘আর একটা আবিষ্কার করেছি রাস্তার ওধারকার ঐ বাড়িখানার গায়ে ভাড়া- পত্র টাঙানো রয়েছে। ঐ বাড়িখানা ভাড়া দেওয়া হবে।’

‘তাতে তোমারই বা কী, আমারই বা কী?’

‘মনে করছি বাড়িখানা আমিই ভাড়া নেব। জায়গাটি আমার বেশ লাগছে।

কিছুদিন এখানে বাস করব।’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নেই। এ হচ্ছে আমার খেয়াল। আর খেয়াল হচ্ছে অর্থহীন। অতঃপর আমরা প্রস্থান করতে পারি।’

জয়ন্ত ঠাট্টা করেনি, আজ কদিন হল সত্যসত্যই শালিখার সেই বাড়িখানায় উঠে এসেছে।

মানিকের কৌতুহলের সীমা নেই। সে বিলক্ষণ জানে, জয়ন্তর খেয়াল হয় না অকারণে। ঐ দুই মৃত্যুর ভিতর থেকে সে কোন সূত্র আবিষ্কার করেছে নিশ্চয়ই। নইলে ঘটনাস্থলের সামনা-সামনি থাকবার জন্য তার এতখানি আগ্রহ কেন?

জয়ন্তের মনের ভিতর প্রবেশ করবার জন্যে গিরীন্দ্রও কম ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সে রোজই আসে আর একই প্রশ্ন করে, ‘কেন তুমি এ বাড়িখানা ভাড়া নিলে। এখানে থাকলে তোমার কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?’

জযন্ত বোবা। শুধু মুখ টিপে হাসে আর নস্য নেয়।

হপ্তা-দুই কেটে গেল। দুপুরবেলায় জয়ন্ত বাইরে বেরিয়েছিল একটা ছোট ব্যাগ হাতে করে ফিরে এল সন্ধ্যার সময়ে।

মানিক বললে, ‘ব্যাগটি নূতন দেখছি, ভিতরে কি আছে?’

ব্যাগটা সযত্নে আলমারির ভিতর পুরে রহস্যময় হাসি হেসে জয়ন্ত বললে, ‘যথাসময়েই বুঝতে পারবে।’

মানিক রাগ করে বললে, ‘এত লুকোচুরি কেন?’

‘প্রথম পরিচ্ছেদেই পরিশিষ্টের কথা বলে দিলে উপন্যাস পড়তে কারুর ভাল লাগে

না। গোয়েন্দা-কাহিনীর আর্ট প্রকাশ পায় লুকোচুরির ভিতর দিয়ে।’

রাত এগারোটা বেজে গেল। এই সময়ে নৈশ আহার শেষ করে জয়ন্ত শয্যায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু আজ সে খেয়ে দেয়ে রাস্তার ধারের জানালার সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসে পড়ল।

মানিক সুধোলে, ‘ঘুমোতে যাবে না?’

‘না।’

‘কেন হে?’

‘আমি দেখতে চাই আজ গভীর রাত্রে চাঁদের মুখে কালি ঢেলে গোটা আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় কি না। তারপর হয়ত জাগবে হু-হু ঝোড়ো বাতাস, হয়ত ঝরবে ঝরো-ঝরো বাদলধারা, হয়ত বাজবে ডিমি ডিমি বজ্র ডমরু।’

‘হঠাত্ উদ্ভট কবিত্বের কারণ কী?’

‘কবি হতে চায় না কে বল।’

‘আকাশে তো দেখি প্রতিপদের চাঁদের প্রতাপ। কেমন করে আজ ঝড়বৃষ্টি নামবে।’

‘গণত্কার জানিয়ে দিলে।’

‘সে আবার কে?’

‘আবহবিদ্যা নিয়ে যাদের কারবার। জান তো আবহবিদ্যা জাহির করবার জন্য সরকারি অফিস আছে। আজ আমি সেখানে গিয়েছিলাম। খবর পেলুম, আজ শেষ রাতের দিকে রীতিমত ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।’

‘তুমি ক্রমেই অন্যায় রকমের দুর্বোধ্য হয়ে উঠছ। আর তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করব না। আমি এখন ঘুমোতে যাই।’

‘তথাস্তু।’

অনেক রাতে কিসের শব্দে হঠাত্ মানিকের ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের ভিতর হু হু করে জোর হাওয়া। ঘরের দরজাটা খোলা। জানালার সামনে চেয়ারের উপর জয়ন্ত নেই। তার বিছানাও শূণ্য।

বজ্রের হুঙ্কারে চমকে মানিক বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলে চাঁদের আলোর বদলে সেখানে দেখা যাচ্ছে কেবল অন্ধকারকে। বৃষ্টি নামার শব্দও শোনা গেল।

তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মানিকের চোখে পড়ল আর এক দৃশ্য। অমরবাবুর বাড়ির সামনে গ্যাস-পোস্টের উপরে একটা মূর্তি। পরমুহূর্তে মূর্তিটি ঝাঁপ খেল মাটির উপরে। গ্যাসের আলোকে চিনতে বিলম্ব হল না। জয়ন্ত।

মানিক হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে, জয়ন্ত আবার এসে দাঁড়ালো ঘরের ভিতরে। তার হাসি-হাসি মুখ।

‘এসব কী জয়ন্ত, তুমি চোরের মত অমরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলে?’

‘গিয়েছিলাম।’

‘তোমার পায়ে রবারের জুতো, হাতে রবারের দস্তানা!’

‘হাঁ, এ হচ্ছে ভালকানাইজড্(vulcanised) রবার।’

‘আশ্চর্য!’

‘এর চেয়ে বেশি আশ্চর্য যদি হতে চাও তাহলে ছুটে যাও টেলিফোনের কাছে।’

‘তারপর?’

‘গিরীন্দ্রকে ফোন কর। বল, এখনি সদলবলে ছুটে আসতে।’

‘সেকি, এই রাতে! এই ঝড়-জলে?’

‘হাঁ, হাঁ, হাঁ! বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো না। গিরীন্দ্রকে বল এখনি সদলবলে অমরবাবুর বাড়িতে না গেলে এ মামলার কিনারা হবে না। ততক্ষণে আমি একটু বিশ্রাম করে নি।’

অল্পক্ষণ পরেই একদল পাহারাওয়ালা নিয়ে গিরীন্দ্র এসে হাজির হলেন হন্তদন্তের মত।

সে কোনও প্রশ্ন করার আগেই জয়ন্ত বললে, ‘এখন কোনও কথা নয়। এখনই আমাদের যেতে হবে অমরবাবুর বাড়ির ভিতরে।’

দ্বারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে এই অসময়ে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেল। জয়ন্ত সকলকে নিয়ে উঠে গেল একেবারে উপরে। রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে সে টর্চের আলো ফেললে। সেখানে পড়ে আছে একটা নিশ্চেষ্ট মূর্তি।

গিরীন্দ্র সভয়ে বললে, ‘বাবা! আবার বজ্রাঘাতে মৃত্যু নাকি?’

জয়ন্ত বললে, ‘আরো এগিয়ে দেখ।’

গিরীন্দ্র কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে ভাল করে দেখে মহা বিস্ময়ে বলে উঠল, ‘একি, সুরেনবাবু! এঁর হাত পা মুখ বাঁধলে কে!’

জয়ন্ত বললে, ‘আমি।’

‘কেন?’

‘সুরেন হচ্ছে খুনী।’

‘খুনী! সুরেনবাবু আবার কাকে খুন করেছেন?’

‘অজিত আর অসীমকে।’

এমন সময় বারান্দার তৃতীয় ঘরের একটা জানালা খুলে গেল। ভিতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল অমলের ভীত মুখ।

জয়ন্ত বললে, ‘সুরেন আজ আবার বধ করতে চেয়েছিল ঐ বেচারা অমলকে।’

গিরীন্দ্র বললে, ‘কিন্তু অজিত আর অসীমের মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে! বজ্র তো সুরেনবাবুর হাতে ধরা নয়।’

‘অসীম আর অজিত বজ্রাঘাতে মারা যায়নি। তাদের মৃত্যু হয়েছে মানুষের হাতে বন্দী বিদ্যুত্-প্রবাহের দ্বারা।’

‘প্রমাণ।’

‘ঐ জানালার দিকে তাকিয়ে দেখ?’

জানালার ছয়টা গরাদের গায়ে জড়ানো রয়েছে খানিকটা তামার তার।

গিরীন্দ্র মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, ‘আমি বুঝতে পারছি না।’

‘বিদ্যুত্-প্রবাহ সবচেয়ে বেশি জোরে চলে রুপোর ভিতর দিয়ে। তারপর তামার স্থান।

তারপর সোনা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি।’

‘বুঝলুম। কিন্তু এই তামার তারের ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হবে কেমন করে?’

‘সামনেই ট্রামের লাইন। মাথার উপরকার যে মোটা তারের সাহায্যে বৈদ্যুতিক ট্রাম চলে, জানালার এই তামার তারের অন্য প্রান্তে এখনো ঝুল্ছে তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে। মাঝখান থেকে তার কেটে দিয়েছি আমি নইলে এতক্ষণে আমাকেও কেউ জীবিত অবস্থায় দেখতে পেতে না।’

‘কী ভয়ানক, কী ভয়ানক! কিন্তু -‘

‘এখনো তোমার মনে “কিন্তু” আছে। তাহলে আরো একটু পরিষ্কার করে বলছি শোন।’

জয়ন্ত বলতে লাগল, ‘সুরেন হচ্ছে একটি প্রথম শ্রেণীর অতি চালাক শয়তান। মাথা খাটিয়ে নরহত্যার বেশ একটি নূতন উপায় আবিষ্কার করেছিল। কাজ করত এমন একটি রাতে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র যেদিন তাকে সাহায্য করবে। কী করে সে মনের মত রাত্রি নির্বাচন করত; এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে! আমি মনে করি, আমার মতন সেও কোন সরকারি আবহ-বিদ্যাবিদদের কাছে আনাগোনা করত।

‘এরূপ অবস্থায় মানুষের পক্ষে কী করা স্বাভাবিক, এ নিয়ে সে মনে মনে আলোচনা করেছিল। এই বর্ষাকালেও গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ আমরা, শয়নগৃহের জানালার পাশেই শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করি। রাত্রে যদি হঠাত্ বৃষ্টি আসে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর বৃষ্টির ছাট থেকে আত্মরক্ষার জন্যে নিদ্রাজড়িত চক্ষে তাড়াতাড়ি সর্বাগ্রে খোলা জানালাগুলো দুমদাম শব্দে বন্ধ করে দিই।

‘আমাদের এই অভ্যাসের উপরেই নির্ভর করে সুরেন পাতত চমত্কার ফাঁদ। খানিকটা তামার তার সে এমনভাবে জানালার গরাদগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রাখত যে জানালা বন্ধ করতে গেলেই সেই তার স্পর্শ করা ছাড়া উপায় নেই। তামার তারের অপর প্রান্ত সে নিক্ষেপ করত বৈদ্যুতিক শক্তিতে জীবন্ত ট্রামের তারের উপরে। জলে জানালার তার আরও জীবন্ত হয়ে উঠত, তখন তাকে ছুঁলেই মৃত্যু অনিবার্য।

‘তারপর যথাসময়ে সুরেন আবার এসে নিজের অপকীর্তির গুপ্ত চিহ্ণগুলি বিলুপ্ত করে দিত। আমার বিশ্বাস বিপজ্জনক মৃত্যুকে এমন ভাবে খেলা করার সময়ে আমার মত সুরেনও ব্যবহার করত ভালকানাইজড্ রবারের জুতো ও দস্তানা। ফলে বৈদ্যুতিক শক্তিতাকে আক্রমণ করতে পারত না।

‘সুরেন এটাও হয়ত অনুমান করেছিল যে, একই বাড়িতে একেকভাবে উপর-উপরি তিন জন লোকের মৃত্যু হলে পুলিশের সন্দেহের সীমা থাকবে না। কিন্তু এটাও তার অজানা ছিলনা যে, আসল রহস্য আবিষ্কার করতে না পারলে যে কোনও সন্দেহই পঙ্গু হয়ে থাকবে কারণ সন্দেহ ও প্রমাণ এক কথা নয়। কিন্তু সুরেন অতি চালাক কিনা, তার চক্রান্ত বুঝবার মতন লোকও যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, এটা সে ধারণায় আনতে পারেনি। এ হচ্ছে অতি চালাকের দুর্বলতা।

‘একই বাড়িতে উপর-উপরি দুই ব্যক্তির বজ্রাঘাতে মৃত্যু, অথচ ঘরে বজ্রাঘাতের চিহ্ণ নেই এবং মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া যায় ঠিক জানালার ধারেই! এইসব অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখেই আমি পেয়েছিলুম এর মধ্যে হত্যাকারীর হাতের সন্ধান! টারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবন্ত তারের দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমার মনে ফুটে উঠল সন্দেহের ভীষণ ইঙ্গিত।

‘তারপর হত্যার উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে বিলম্ব হল না। অমরবাবুর তিন পুত্রের অবর্তমান সম্পত্তির মালিক হবেন তাঁর কন্যা এবং সুরেন হচ্ছে সেই কন্যার স্বামী?

‘ঘটনাস্থলের উপর পাহারা দেবার জন্যই আমি সামনের বাড়ী খানা ভাড়া নিয়েছিলুম। আবহ-বিদ্যাবিদ বললেন, আজ গভীর রাত্রে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা।

আমিও অবিজাগ্রত হয়ে উঠলুম বারান্দার উপরে চোরের মতন সুরেনের আবির্ভাব দেখে। চুপি চুপি গ্যাসপোস্টের সাহায্যে বারান্দায় উঠে অন্ধকারে লুকিয়ে রইলুম। তারপর সুরেনের মৃত্যু-ফাঁদ পাতা যেই শেষ হল, আমিও অমনি বাঘের মতন তার ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়লুম- আমি চেয়েছিলুম তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতে। সে ট্মু শব্দটি করবার আগেই আমি তাকে বন্দী করে ফেললুম এবং তখনই কেটে দিলুম

বৈদ্যুতিক শক্তিতে জীবন্ত মৃত্যু-ফাঁদের তার।’

হেমেন্দ্রকুমার রায় (জন্ম: ১৮৮৮ – মৃত্যূ: ১৮ এপ্রিল ১৯৬৩) একজন বাঙালি সাহিত্যিক এবং গীতিকার। তিনি ছোটদের জন্য রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা গল্প লেখার জন্য বিখ্যাত। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্মস্থান কলকাতা। তাঁর পিতার নাম রাধিকাপ্রসাদ। হেমেন্দ্রকুমার রায় মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বসুধা পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প আমার কাহিনী প্রকাশিত হয়। ১৩২২ বঙ্গাব্দে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এবং মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ভারতী পত্রিকা নতুনরূপে প্রকাশিত হলে হেমেন্দ্রকুমার এর লেখকগোষ্ঠীতে যোগদান করেন। সাপ্তাহিক নাচঘর (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) পত্রিকাটি তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। এছাড়া মাসিকপত্র রংমশাল প্রভৃতি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

ছোটদের জন্য তিনি ৮০টিরও বেশি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে কবিতা, নাটক, হাসি ও ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, ও গোয়েন্দা কাহিনী, ঐতিহাসিক উপন্যাস সবকিছুই ছিল। তাঁর সৃষ্ট বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু বাংলা কিশোর সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্র।

হেমেন্দ্রকুমার রায় বড়দের জন্যও বেশ কিছু বই লিখেছিলেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: জলের আলপনা, বেনোজল, পদ্মকাঁটা, ঝড়ের যাত্রী, যাঁদের দেখেছি, বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার, ওমর খৈয়ামের রুবায়ত প্রভৃতি। তাঁর সিঁদুর চুপড়ি গল্পটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে একটি সঙ্কলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।

তিনি সফল গীতিকারও ছিলেন। সেই সময়ের বাংলা থিয়েটার এবং গ্রামাফোনে গাওয়া গানের প্রচলিত রীতি এবং রুচির মোড় তিনি ফিরিয়েছিলেন। তাঁর রচিত অনেক গান সেই সময়ে জনপ্রিয় ছিল। অন্ধকারের অন্তরেতে গানটি এর মধ্যে অন্যতম।

তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ির সীতা নাটকের নৃত্য পরিচালক ছিলেন। তিনি ভাল ছবি আঁকতে পারতেন। বাংলায় শিল্প সমালোচনার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *