খাদ্য সমস্যা
খাদ্য সমস্যা নিয়ে নিবন্ধ রচনার অনুরোধ আমার কাছে আসতে পারে একথা আমি কখনও ভাবিনি।
দেশ ও সমাজের খাদ্যের সমস্যা, সে অতিশয় গুরুতর ব্যাপার। নাবালক বয়সে পঞ্চাশের মহামন্বন্তর দেখেছি, ষাট বছরের জীবনের পঞ্চান্ন বছর রেশনের তণ্ডুল খেয়ে জীবন ধারণ করছি। খাদ্য সমস্যা কাকে বলে সেটা আমি প্রত্যক্ষভাবে জানি। কিন্তু তা নিয়ে নিবন্ধ রচনার যোগ্যতা আমার নেই। মাস মাইনের ‘নুন-আনতে-পান্তা ফুরোয়’ সংসারের খাদ্য সংগ্রহ করতে উচাটন হয়ে আছি সারা জীবন। আমাকে কি না খাদ্য সমস্যা নিয়ে লিখতে বলা!
কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। টেলিফোনের অপর প্রান্তে অনুরোধকারিণী তাঁর সুললিত কণ্ঠে বললেন, ‘না। না৷ খাদ্য সমস্যার মতো জটিল ব্যাপার নিয়ে আপনাকে আমরা মাথা ঘামাতে বলছি না। সে জন্য ভাল ভাল লোক আছে। আপনি বরং হালকা করে লিখুন দেশে, বিদেশে, ঘরে, বাইরে খাদ্য নিয়ে আপনার নিজের কখনও কোনও সমস্যা হয়েছে কি না?’
আমি বললাম, ‘তা বহুবার হয়েছে। পয়সার অভাবে সুখাদ্য কিনতে পারিনি। সে অসুবিধে এখনও নিয়মিত হয়।’
অনুরোধকারিণী তরল হাসিতে আমার অক্ষমতা ভাসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্যাঁচালো কথা মোটেই নয়। আমি জানি আপনি বেশ ভালই বুঝতে পেরেছেন আমরা কী বিষয়ে কী ধরনের লেখা আপনার কাছে চাইছি।’
***
অগত্যা আমি যেমন বুঝেছি তেমনই লিখছি।
কলকাতা দিয়েই শুরু করি। বড় হোটেলের পশ রেস্তোরাঁগুলো বাদ দিলে উত্তরে শ্যামবাজার পাঁচমাথার গোল বাড়ি থেকে শুরু করে দক্ষিণে সুতৃপ্তি, পানীয়ন পর্যন্ত এমন কোনও উল্লেখযোগ্য রেস্তোরাঁ নেই যেখানে আমি আমার এই মহামূল্য জীবনের অমূল্য দু’দশ ঘণ্টা ব্যয় করিনি।
আমার পাইস হোটেলের অভিজ্ঞতা কিছু কম নয়।
একক অবিবাহিত জীবনে আমাদের সাবেক কালীঘাটের বাড়িতে আমাদের রাঁধুনি রাধাদিদি পাগল হয়ে যান। তাঁর ধারণা হয়েছিল তিনি ধোবানি। রান্না-বান্না ছেড়ে সেই রাধাদিদি সকাল-সন্ধ্যা কাপড় কাচতেন। সকালবেলা উঠে কর্পোরেশনের গঙ্গাজলে আলনার সমস্ত জামাকাপড়, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, এমনকী শতরঞ্চি, পাপোশ পর্যন্ত যা কিছু হাতের কাছে পেতেন সব কাচতেন। দুপুরে ছাদে সেগুলো শুকোত। আবার সন্ধ্যাবেলা সেগুলো কাচা হত। জামাকাপড় ছাড়লেই সঙ্গে সঙ্গে কাচা হয়ে যেত। তখন আমি বহুদিন এক বস্ত্রে এবং পাইস হোটেলে খেয়ে কাটিয়েছি।
রাধাদিদি, তিনি আবার নিজের নাম বলতেন আধা আনি (রাধারানী), বহুকাল গত হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লিখব। আপাতত ফরমায়েসি খাদ্যের গল্প।
কলকাতার আর হাওড়ার রেস্তোরাঁর দুটি স্মরণীয় ঘটনা, পুরনো ব্যক্তিগত কাহিনী, তবু আরেকবার বলি।
ধর্মতলায় একটা প্রাচীন চায়ের দোকানে, (অধুনা অবলুপ্ত) একবার চা খেতে গিয়েছিলাম। স্রেফ চা। কিন্তু মাংসের ঝোল আর হলুদের দাগ লাগা ময়লা অ্যাপ্রন পরা বেয়ারা নাছোড়বান্দা। ঘর্ম মলিন, জীর্ণ প্রায় একটা মেনু এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, কিছু খাবেন না।’
মেনুটা তার হাতের থেকে নিতে গিয়ে লক্ষ করলাম, বেয়ারাটির হাতের আঙুলে কেমন চাকা-চাকা দাগ। ঘায়ের মতো। সভয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কি একজিমা আছে?’
লোকটি লজ্জিত হয়ে জবাব দিল, ‘না স্যার। একজিমা হবে না। ফিশ ফ্রাই হবে, কাটলেট হবে।’
কাটলেটের প্রসঙ্গে অন্য অভিজ্ঞতার কাহিনীটি বলি।
ঘটনাটা বহুকাল আগের, ঘটেছিল হাওড়ার রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমে। একটা কাটলেটের অর্ডার দিয়েছিলাম। যথারীতি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে সেই কাটলেটটি এল, বেশ বড় সাইজের।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, হাজার রকম চেষ্টা করেও, শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেও কাটলেটটি ছুরি-কাঁটা দিয়ে কাটতে পারলাম না। তখন বাধ্য হয়ে বেয়ারাকে ডাকলাম। সে এলে অবিভক্ত কাটলেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম এর দ্বারা হবে না।
তখন বললাম, ‘যাও ম্যানেজারবাবুকে ডেকে নিয়ে এসো।’
অম্লান বদনে বেয়ারাটি জবাব দিল, ‘ম্যানেজারবাবুও এ কাটলেট খেতে পারবেন না।’
খেপে গিয়ে বললাম, ‘তুমি ওই কাটলেট ফেরত নিয়ে যাও।’
লোকটি অনেকক্ষণ ধরে উলটিয়ে-পালটিয়ে, খুব অভিনিবেশ সহকারে কাটলেটটি পর্যবেক্ষণ করল, তারপর বলল, ‘এটা ফেরত হবে না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
লোকটি বলল, ‘আপনি এটা বেঁকিয়ে ফেলেছেন।’
হাসির গল্প নয়। অন্য দশজনের মতোই আমার এই জীবনে উলটোপালটা খাবারের মুখোমুখি হতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
অবশ্য উলটো-পালটাই বা বলি কী করে? ইলিশ মাছের কাঁটা দিয়ে কচুশাক আমার কাছে পরম উপাদেয় খাদ্য। কিন্তু কোনও শ্বেতাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গিনীকে এ জিনিস দিলে স্পর্শ করতেও সাহস পাবে না। ছোটবেলায় দেশের বাড়িতে ঢ্যাপের মোয়া খেয়েছি। অসামান্য সুখাদ্য। ঢ্যাপ হল, শালুকের বিচির খই। পদ্মবিচির খইয়েও মোয়া হয়। তাকে বলে এইচার মোয়া। জলের জায়গায়, শালুক-পদ্মের পৃথিবীতে এই খাদ্য সম্ভব। অন্যত্র কল্পনা করা কঠিন।
ব্যাংককে টুরিস্ট এলাকা খাউলান রোডের আশপাশের গলিতে পাইস হোটেলের ছড়াছড়ি। এক প্লেট গরম ভাত তার সঙ্গে কোনও কিছুর ঝোল। নাম শুনে বোঝার উপায় নেই কীসের ঝোল। সেখানে চিকেন ভেবে যে ঝোলটা কয়েকদিন খেয়েছি, অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন সেটা সাপ-ব্যাঙ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিলেতে এক পাবে এক সন্ধ্যায় কালো বিয়ারের সঙ্গে আইরিশ সসেজ খেয়েছিলাম। এই সসেজও কালো ঝোলের মধ্যে চোবানো। সে যে কী ভয়ংকর ঝাল। ব্রহ্মতালু পর্যন্ত আগুন লেগে গিয়েছিল। সাতদিন মুখে জ্বালা, পেটে চিনচিনানি।
তালিকা দীর্ঘ করব না। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনী দিয়ে শেষ করি।
এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় কয়েকদিন ছিলাম। অতিথিশালার ডাইনিং রুমের দেওয়ালে নোটিশ বোর্ডে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দাম নির্দিষ্ট করা আছে।
বোধহয় বছর দশ-পনেরো আগের মূল্য তালিকা। এর মধ্যে সেই দাম আর বাড়ানো হয়নি। অর্ডার দিলে বিরিয়ানি পাওয়া যাবে, আট টাকা প্লেট। চিকেন কাটলেট তিন টাকা। চা তিরিশ পয়সা, কফি চল্লিশ পয়সা, ভাত-মাছ সাড়ে চার টাকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম দিনই কৌতূহলভরে আমি ক্যান্টিনের ম্যানেজারবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এসব খাবার পাওয়া যাবে?’
ম্যানেজারবাবু গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যাবে, কিন্তু খাওয়া যাবে না।’
আমি বললাম, ‘তা হলে কী খাব?’
ম্যানেজারবাবু বললেন, ‘আপনি চাইলে আমি বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে দেব।’
আমার কিন্তু জেদ হল, আমি বললাম, ‘আমি সরকারি দামেই খাব। ওই যে দেখছি পরোটা পঁচিশ পয়সা করে ওই দুটো আর এক টাকার সবজি দেবেন।’
ম্যানেজারবাবু বললেন, ‘খেতে পারবেন না। সরকারি গমের পরোটা। খাওয়া অসম্ভব।’
আমি বললাম, ‘দিন না খেয়ে দেখি। রাত ন’টার সময় ঘরে পাঠিয়ে দেবেন।’
মফস্বলের ফাঁকা অতিথিশালা। ডাইনিং হলেও সাড়ে আটটা-ন’টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ। রাত ন’টার একটু পরে আমার ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে ম্যানেজার চলে গেলেন।
খিদে লেগেছে। আমিও খেতে বসলাম। সবজি বলতে এক টুকরো আলুসেদ্ধ, তেল ছাড়া শুধু নুন আর লঙ্কা দিয়ে মাখা। সঙ্গে সন্দেহজনক চেহারার দুটো পরোটা।
একটা পরোটা ছিঁড়ে এক টুকরো টেস্ট করতে যাচ্ছিলাম। ছিঁড়তে পারলাম না। দাঁত দিয়ে কামড়ালাম, দন্তস্ফুট করতে পারলাম না। তখন আমার রোখ চেপে গেছে। টেনে টেনে দু’হাতের বুড়ো আঙুল টনটন করছে। পায়ের জুতো দিয়ে চেপে ধরে, দরজার কপাটের ভঁজে চিপে ধরে, জলে ভিজিয়ে বহুরকম চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই সেই সরকারি গমের পঁচিশ পয়সার অসূচীভেদ্য পরোটার গতি করতে পারলাম না।
শীতের রাতে দরদর করে ঘামছিলাম। আলুসেদ্ধটুকু মুখে দিয়ে দু’গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার আগে জানলা দিয়ে পরোটা দুটো উঠোনে ছুড়ে দিলাম। উঠোনের একপাশে বেশ কয়েকটা নেড়ি কুকুর ছিল, তারা সমবেতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই পরোটার উপরে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে প্রবল বাদ-বিতণ্ডা মারামারি চলল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, সেই পরোটা দুটো উঠোনের মধ্যখানে অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। আত্মকলহে ক্লান্ত কুকুরগুলি উঠোনের একপাশে শুয়ে আছে।