খাদ্য-সঙ্কট : বিশ্বসমস্যা

খাদ্য-সঙ্কট : বিশ্বসমস্যা

০১.

মানুষের জীবন নির্ঘ কিংবা নির্বিঘ্ন হবে এমন আশা কেউ করে না। কেননা নিজের জীবনের উপর সর্বাত্মক অধিকার মানুষের নেই। প্রকৃতির দেয়া রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু ছাড়াও সীমিত শক্তিতে মানুষ প্রাকৃতিক রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বন্যা প্রভৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে সব সময় পেরে উঠে না। তাছাড়া জীবিকার জন্যে সম্পদ প্রয়োজন এবং সম্পদ অর্জনে ও রক্ষণে রয়েছে নানা সমস্যা। আর সমস্যা মাত্রেই কমবেশি যন্ত্রণা। কাজেই নির্বিঘ্ন আনন্দও বাস্তবাতীত।

অতএব জীবনে কেবল সম্পদ ও আনন্দই কাম্য হলেও সমস্যা ও যন্ত্রণাকে এড়িয়ে তা পাওয়া সম্ভব নয়। অভাবিত নয় বলে এর জন্যে মানুষমাত্রেরই মানস-প্রস্ততি থাকে। অবশ্য এক্ষেত্রেও মানুষ কখনো স্বেচ্ছায় ও সহজে আত্মসমর্পণ করতে চায়নি। তাই ক্রমে এই প্রাকৃত শক্তিকেও সে জয় করেছে, বশ করেছে এবং দাসও করেছে। এক্ষেত্রে তার সাফল্য গর্বের ও গৌরবের, বিস্ময়কর ও মহিমময়।

কিন্তু আজ অবধি মানুষ যা করতে পারেনি, তা হচ্ছে তার প্রবৃত্তি-বশ্যতা থেকে বিবেকের মুক্তিসাধন। তাই অধিকাংশ মানুষ আজো জৈব প্রয়োজনের অনুগত জীবই রয়ে গেছে, প্রাণ-ধর্মের বশ্যতায় প্রাণী হয়েই আছে, বিবেক-চালিত বুদ্ধির আনুগত্যে মানুষ হয়ে উঠেনি। মানুষের বারো আনা দুঃখের উৎস এখানেই। মনুষ্য জীবনের যন্ত্রণার ও Tragedyর কারণ এ-ই। প্রকৃতির কোলে লালিত পিঁপড়ে থেকে হাতি অবধি কোনো প্রাণীকেই সম্ভবত খাদ্যাভাবে প্রাণ হারাতে হয় না। কেবল সমাজ-লালিত মানুষকেই হয়তো আদমের আমল থেকেই অনাহারে মরতে হয়েছে। অজন্মার ফলে যে খাদ্যাভাব তাতে হয়তো খুব কম মানুষই প্রাণ হারিয়েছে। চিরকাল প্রবল দুরাত্মার হাতে বঞ্চিত বুভুক্ষু মানুষই মরেছে লাখে লাখে। বেঁচে থাকার বিড়ম্বনা ও মৃত্যুর নিশ্চয়তাই তাদের হয়েছে ললাটলিপি।

সব মানুষের বুদ্ধি থাকে না, বিদ্যে হয় না, দৈহিক সামর্থ্য থাকে না, মানসিক যোগ্যতা থাকে না, চরিত্রও গড়ে উঠে না। তাই বলে তাকে বাঁচার অধিকার থেকে প্রাণের দাবি থেকে বঞ্চিত করবার বা রাখবার কারণ হতে পারে না এসব। মানুষকে জীব হিসেবে প্রাণী হিসেবেই বাঁচতে দেওয়া মানুষের নৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানের শর্তে সমাজ গড়েছে মানুষ। কিন্তু তার পরিবর্তে প্রবল মানুষ চিরকাল দুর্বল মানুষকে শোষণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে হত্যা করেছে। এই সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানের সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের আশায় মানুষ গোষ্ঠী-চেতনা, গোত্রীয়। ঐক্য, দৈশিক সংহতি, জাতীয়-মৈত্রী ও রাষ্ট্রিক কর্তব্য প্রভৃতির বোধ-বুদ্ধি জাগানোর সাধনা করেছে চিরকাল।

কিন্তু লক্ষ্য মহৎ হলেও উপায় শুভকর ছিল না। তাই জীবন-প্রতিবেশ সরল ও সুন্দর করতে গিয়ে বার বার জটিল ও বীভৎস করেছে। এজন্যে মানুষের ইতিহাস মুখ্যত প্রবলের পীড়ন-শোষণ ও হননের ইতিকথা–শোণিত-শোষণ ও রক্তপাতের করুণ কান্না। আজো এই ভুল পথের মরীচিকাই তাদের টানছে। স্বাধৰ্ম, স্বাজাত্য ও স্বারাষ্ট্র চেতনা ও মমতা নিয়ে আজো মানুষ জীবন সাধনায় ও স্বাচ্ছন্দ্য-সন্ধানে নিরত।

আজকের পৃথিবীই ধরা যাক। যেসব রাষ্ট্র শিল্পে-বাণিজ্যে-বিজ্ঞানে ও সামরিক শক্তিতে প্রবল, সেগুলো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বর্বর উল্লাসে মত্ত। অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারে ও রক্ষণে তারা সদাব্যস্ত। মাকড়সার জালবদ্ধ পতঙ্গের মতো, অক্টোপাস কবলিত প্রাণীর মতো বিশ্বের অনুন্নত ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো অনুপম ও অননুভূত মৃত্যু যন্ত্রণায় ধুকছে। যন্ত্রও যে এ যন্ত্রণার উপশমে সমর্থ নয়, তা তারা আজো উপলব্ধি করেনি। তাই যন্ত্রযোগে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারেই তারা মুক্তি খোঁজে। কিন্তু বিশ্বের সব দেশগুলো যদি শিল্পায়িত হয়, তাহলে বানিজ্য করবে কার সঙ্গে? তখন তো কারো পুকুরের পানি কেহ নাহি খায় অবস্থা হবে। তখন পণ্য বিনিময়ে সমস্যা দেখা দেবেই। কেননা তখন পারস্পরিক প্রয়োজনে সঙ্গতি থাকবে না। শিল্পায়িত য়ুরোপ আজ সে মহাসমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এবং আফ্রো-এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করে আত্মরক্ষার প্রয়াসে হয়েছে উদ্যোগী–এরই নাম য়ুরোপীয়ান কমনমার্কেট।

কিন্তু এভাবে কয়দিন চলবে! জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এমনি জনসংখ্যার চাপে ষোলো শতকে য়ুরোপীয়রা রাক্ষসের ক্ষুধা, দস্যুর প্রবৃত্তি ও অক্টোপাসের কৌশল নিয়ে ছুটে বেরিয়েছিল বাঁচবার তাগিদে, আরো আগে যেমনটি করত মধ্য-এশিয়ার শক-হুঁন-ইউচিরা, তাতার-মোঙ্গলেরা। তখন তাদের ভাগ্য ভালোই ছিল। এশিয়া-য়ুরোপ তখনো ছিল বসতিবিরল। তাই মধ্য-এশিয়ার জনগোষ্ঠী ঠাই করে নিতে পেরেছিল সহজেই। ষোলো-শতকের য়ুরোপীয়দের ভাগ্যও ছিল প্রসন্ন। বসতি-বিরল তিন-তিনটে মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়ে তাদের বাঁচার পথ করে দিল। বিগত পাঁচশ বছর ধরে তারা বাঁচল সম্পদে, গৌরবে ও ঐশ্বর্যে স্ফীত হয়ে।

কিন্তু এবার সে-সুযোগ কল্পনাতীত। অবশ্য গ্রহ-লোলাকে যদি কোনো ব্যবস্থা হয়ে যায়, তবে, তো কথাই নেই। এশিয়া-য়ুরোপে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণে তার সমাধান নেই। সমাধান নেই কেবল কম্যুনিজমেও। কেননা জনসংখ্যার সঙ্গে ক্ষেত-খামারের আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষা করা কোনো মতেই সম্ভব হচ্ছে না। যদিও রাষ্ট্রগুলো বাহুবলে ও বুদ্ধিবলে–অস্ত্রের ও অর্থের জোরে, যান্ত্রিক যোগ্যতায় ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনায় বেঁচে থাকার সাধনা করছে; তবু এতে শেষ রক্ষা হবে না। এখনকার জীবন ও জীবিকার আদর্শ হচ্ছে : সেই পুরোনোজোর যার মুলুক তার কিংবা যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন-নীতি। কিন্তু এ-সব নীতি এ যুগে স্থায়ী ফলপ্রসূ হবে না। কেননা অজ্ঞতা ও নিয়তিবাদের যুগ অপগত। এ যুগের সচেতন মানুষ বাঁচার তাগিদেই নাস্তিক ও নির্ভীক, উদ্ধত ও উচ্ছৃঙ্খল।

বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল-বিরল সামন্ত-যুগে সম্পদগত যে-স্থিতিশীলতা সম্ভব ছিল, ভূমি-নির্ভর জীবনে ও জীবিকায় নিয়তির মতো যে অমোঘতা ছিল, যে অবিচলিত সংস্কারাচ্ছন্নতা ও বিশ্বাসপ্রবণতা ছিল, তা আজ অবসিত। বিশ্বাস-সংস্কার আজ দেউলে–কোনো প্রবোধ, কোনো ভরসা, কোনো ভীতি, কোনো আশ্বাসই তা আজ দান করতে পারে না।

অতএব এ যুগে আনুগত্য নেই, নেই দাসত্ব। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আশঙ্কাহীন কোনো শোষণ-পীড়ন এ যুগে অসম্ভব। এ যুগে শুধু মার, শুধু হনন, শুধু কাড়ার সুযোগ তিরোহিত। এ যুগে কেবল দ্বিপক্ষীয় মারামারি, কাড়াকাড়ি ও হানাহানি চলতে পারে ও চলে। কিন্তু এতে কোনো পক্ষেরই কল্যাণ নেই। কারণ দুর্বলকে যারা কাড়ে, যারা মারবার যোগ্যতা রাখে, যারা হত্যা করেই নিশ্চিন্ত ও নির্দ্বন্দ্ব-নির্বিঘ্ন হতে চায়, তারা নিজেদের মধ্যেই লুণ্ঠিত সম্পদ ও শোষিত শোণিত নিয়ে কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে সুন্দ-উপসুন্দের পরিণাম পায়।

একটি অনূদিত কোরিয়ো কবিতা আজ বড় ভাল লাগল, যদিও অনুবাদ ভাষার দৈন্যে সুষ্ঠু ও সুন্দর নয়, কল্পনায় মূল্যের সৌন্দর্য আস্বাদন করে তৃপ্ত হয়েছি। কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি :

এসো আমার কাছে, বলছি এসো তাড়াতাড়ি, আগুন লেগেছে ঘরে, সোনার বাড়িতে আগুন, সবুজ পাহাড়ে আগুন, গোলাপী ফুলের বাগান জ্বলছে, আর আমাদের প্রতিবেশীরা, বন্ধু প্রতিবেশীরা কেঁদে কেঁদে প্রাণভয়ে চলে যায়, ঘরগুলি খালি করে যায়।

নেকড়ে বাঘেরা গর্জন করছে, মেষের দল কাঁপছে, আর নেকড়ের দল গর্জায় আর হুঙ্কার দেয় আর একে অন্যের মাংস ছিঁড়ে নেয়, রক্ত ঝরে যায়। তারা হত্যা করে আর নিহত হয়। নিশ্চয় নেকড়ের দল নিজেরা ঝগড়া করে ধ্বংস হয়ে যাবে। রক্তাক্ত এ রাত্রি, কিন্তু আকাশে জ্বলছে তারা। তারাদল রয়ে যাবে, আর এখানা উঠছে। তাই বলি, এসো তাড়াতাড়ি.–দুজনে যাব মাঠে, পোড়ামাটি আবার চষবো তুমি আর আমি; আর আমরা বুনব ফসল। পাহাড় আবার সবুজ হবে, আর সাজাব আবার গোলাপী ফুলের বাগান।… ইত্যাদি। [নীল আকাশের নিচে : পাক দ্যু-জিন, অনুবাদ : জাহাঙ্গীর চৌধুরী, কোরিয়ার কবিতা, পৃ. ৪১]

অর্থ-গৌরবে, বাস্তব চিত্রে, আশাবাদে ও আত্মপ্রত্যয়ে এ কবিতা ঋদ্ধ। কিন্তু এই আশা ও আত্মপ্রত্যয় খণ্ডদৃষ্টি প্রসূত। কেননা আজ মানবিক সমস্যার সমাধান দেশগত বা রাষ্ট্রায়ত্ত নয়। নেকড়েরা আত্মকলহেই মরবে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আহতরাও আর কখনো দগ্ধ মাটিতে ফসল ফলিয়ে প্রাচুর্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে না। এককভাবে য়ুরেশিয়ার কোনো রাষ্ট্রই আর স্বনির্ভরতায় বাঁচতে পারবে না। কেননা এখানে খাদ্যাভাব অনিবার্য। Common market বা ক্যুনিজম আজো সাময়িক সমাধান দিতে পারে বটে, কিন্তু বিশ্বের মানুষকে জীবনের অপরিহার্য অভাব মিটিয়ে শান্তিতে ও স্বচ্ছন্দে বাঁচতে হলে যৌথ প্রচেষ্টায় অন্য উপায় বের করতেই হবে। মানববাদকে মুখ্য করে সংহত ও সংযত জীবনে দীক্ষা নিতে হবে। Equitable-distribution of population & Food–পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যার ও খাদ্যবস্তুর সমবন্টনেই আপাতত এ সমস্যার দৃষ্টিগ্রাহ্য সমাধান নিহিত। গোত্র-বর্ণ-জাত-ধর্ম চেতনার উর্ধ্বে উঠে এশিয়া-য়ুরোপের বাড়তি মানুষকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকা ও আমেরিকায় ঠাই করে দিতে হবে। সর্বপ্রকার স্বাতন্ত্র ও বিদ্বেষ অতিক্রম করে কেবল মানববাদকে আদর্শ করে এগিয়ে আসতে হবে সমাধানের সন্ধানে। তা হলেই কেবল মানুষকে অপঘাত, অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করা যাবে।

অবশ্য বর্তমানে এ সমাধান মানব-প্রবৃত্তি বিরোধী ও অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই একমাত্র উপায়, যা করলে মানুষ আরো কয়েক শতাব্দী নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে। নইলে বাঁচবার প্রেরণায় মানুষ পরাক্রান্ত হয়ে বন্যার বেগে দিগ্বিদিকে ছুটে বের হবে আর হানাহানি করে যাদবকুলের মতো, শাক্যগোত্রের মতো ধ্বংস হবে।

আত্মঘাতী এ সংগ্রামে আত্মনাশ অনিবার্য। আত্মসংহারে এ আত্মনিবাশ আসলে বাঁচার সংগ্রামের ছদ্মবেশে। আজ তার লক্ষণ সর্বত্র দৃশ্যমান। বাঁচবার জন্যেই মারবার ও মরবার এ প্রবৃত্তি জৈবিক-পাশবিক বটে, কিন্তু অমানবিক। কেবল জীবের মতোই যদি আচরণ করবে, তা হলে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র সাধনার, প্রেম-প্রীতি-ন্যায়-নীতি অনুশীলনের কী প্রয়োজন ছিল! আজই বা এত ভাব-ভাবনার ও এত মহৎ বুলি কপচানোর সার্থকতা কী!

.

০২.

জন্মনিয়ন্ত্রণের মূলে রয়েছে দেশগত সমাধান প্রয়াস। কিন্তু এভাবে সমস্যা এড়ানোর প্রত্যাশা আপাতত বিজ্ঞতার পরিচায়ক হলেও জনসংখ্যায় স্থিতিশীলতা রক্ষা করা কঠোর আইন প্রয়োগ সাপেক্ষ। এবং এ আইন যে নীরবে সবাই মেনে নেবে, তাও মনে করার কারণ নেই। এক্ষেত্রেও বিদ্রোহ সম্ভব। আকাক্ষার কথা বাদ দিলেও এর সঙ্গে নৈতিক ও মানবিক প্রশ্ন জড়িত। সেদিন এক বন্ধু বলছিলেন : জন্ম নিয়ন্ত্রণে আস্তিক মানুষের স্রষ্টা-দ্রোহিতাই প্রকাশ পায়। কেননা, স্রষ্টাকে পালনকর্তা হিসেবে সে কার্যত অস্বীকার করে। তাঁর মঙ্গলময়ত্বে সে আস্থা হারায়। তার চোখে তিনি রাজ্জাক নন।

তাছাড়া এর মধ্যে একটা হীন আত্মসর্বস্বতা আছে। নিজের সুবিধের জন্যে অন্যের অস্তিত্ব প্রাপ্তির স্বাভাবিক অধিকার হরণ করা অমানবিক। আমরা ভাবছি, নিয়ন্ত্রণাভাবে অসংখ্য উদর-সর্বস্ব প্রাণী আমাদের মুখের গ্রাসে ভাগ বসাবে। তাতে আমরাও মরব, তারাও বাঁচতে পরবে না। কিন্তু এ সঙ্গে আমরা ভাবীকালের সক্রেটিস-এ্যারিস্টটল-প্লেটো, ফ্রয়েড-ডারুইন-আইনস্টাইন, কান্ট হেগেল-নীৎসে, মার্কস-লেনিন-মাওকেও তো হারাচ্ছি। যারা হয়তো এ সমস্যার অভাবিত সমাধান দিতে পারত!

এ ধারণার বিরুদ্ধে অবশ্য দুটো প্রবল যুক্তি রয়েছে।

এক, মানুষ মুখে যা-ই বলুক, জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে সে কখনো ঈশ্বরের ইচ্ছার অনুগত থাকেনি। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সে সবসময় বিধাতার দেয়া রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করেছে। সবকিছু অমোঘ জেনেও সে অনমনীয় রয়েছে–আত্মসমর্পণের আত্ম-স্বাতন্ত্র হারায়নি; এদিক দিয়ে সে চিরকাল প্রতিবাদী ও প্রতিরোধ প্রয়াসী–এভাবেই সে নিজের জন্যে কৃত্রিম জীবন ও জীবন প্রতিবেশ রচনা করেছে। এরই নাম সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মনুষ্যত্ব। কাজেই জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রয়াসে নতুন কোনো বিদ্রোহ নেই।

দুই. জীবনের অন্য অনেক প্রাণীর মতো মানুষও আত্মরক্ষার ও আত্মবিস্তারের গরজে চিরকাল জিঘাংসু। অন্য প্রাণীকে তো নয়ই, স্বজাতি মানুষকেও সে কখনো কৃপা করেনি। কাজেই সহচর মানুষকে যে হত্যা করতে পারে, অভব-অদৃশ্য সম্ভাব্য মানুষের সৃষ্টি-রোধ করার মধ্যে তার কোনো নিষ্ঠুরতা নেই। হীন-স্বার্থপরতা যা রয়েছে তাও তুলনায় অতি তুচ্ছ। আর মহৎ মানুষ প্রাপ্তির আশায় সৃষ্টির দ্বার অবারিত রাখা জুয়াকে জীবিকা করার মতোই বিড়ম্বনাকে বরণ করা মাত্র।

অবশ্য এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় : জাত হিসেবে মানুষ কী আরো মহৎ হতে পারে না? তবে Destructive-এর চেয়ে Preventive measure-ধ্বংসাত্মক উপায়ের চেয়ে বারণাত্মক বা নিরোধাত্মক পদ্ধতিই কাম্য।

আপাতত, জন্মনিয়ন্ত্রণে, সমাজতন্ত্রে ও সাম্যবাদে জীয়নকাঠির সন্ধান চলবে বটে, কিন্তু এই দেশগত বা রাষ্ট্রগত খণ্ড প্রয়াসে স্থায়ী সমাধান নেই। একক বিশ্বে সহযোগিতা, সহঅবস্থান ও বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও খাদকের সমবণ্টনের মধ্যেই স্থায়ী কল্যাণ ও ভাবী মানব-ভাগ্য নিহিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *