খাদ্যমন্ত্রীর নব আবিষ্কার
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লকান্তি ঘোষ র্যাশনে চিনি দিতে না পারায় চিনির বিকল্প হিসাবে ‘ডিউ স্লিপ’ দেবার প্রথা চালু করে খাদ্যবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর এই অপূর্ব আবিষ্কার বিশ্বের খাদ্যবিজ্ঞানী মহলে নিদারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ব সংস্থার খাদ্য ও কৃষি দফতরের ডিরেকটার-জেনারেল এক ব্যক্তিগত অভিনন্দন-বাৰ্তায় পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রীকে জানান, চিনির বিকল্প হিসাবে ডিউ স্লিপের আবিষ্কার এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। ‘ডিউ স্লিপ’ ব্যাপকভাবে চালু হলে পৃথিবী থেকে চিনির ব্যবহার ক্রমে লুপ্ত হয়ে যাবে। খাদ্য-রসায়নে আপনাকে যাতে আগামীবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তার জন্য আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাব।
সোভিয়েত শর্করা বিশেষজ্ঞ কমরেড সুগারভ এই আবিষ্কারকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার একচেটিয়া প্রাধান্যের উপর চরমতম আঘাত বলে বর্ণনা করেন। ‘ডিউ স্লিপ’কে তিনি জনগণের চিনি বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, কলকাতা শহরের সঙ্গে সোভিয়েত রুশিয়ার এই খানে বড় মিল যে, সেখানেও র্যাশন ব্যবস্থা কলকাতার মতই চালু। এবং চিনির সরবরাহ সেখানেও পর্যাপ্ত নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা চিনির বিকল্প দীর্ঘদিন ধরেই অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন, কিন্তু আজও তাঁরা কোনও ভালো বিকল্প বের করতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রীর আশ্চর্য আবিষ্কার এই ‘ডিউ স্লিপ’ বা জনগণের চিনি আমাদের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার একটা বড় অভাব মোচন করবে। তিনি রুশ-ভারত সহযোগিতা চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত রুশিয়াতেও ‘ডিউ স্লিপ’ আমদানী করার জন্য আগ্রহ দেখান।
মেডিকেল এসোসিয়েশন এবং ডায়েটিকস এসোসিয়েশনের যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি ‘ডিউ স্লিপে’র কার্যকারিতা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হন। তাঁদের মতে, ‘ডিউ স্লিপে’র ক্যালরি-মূল্য চিনির থেকে অনেক বেশী। এবং ডায়েবিটিসের রোগীদের কাছে ‘ডিউ স্লিপ’ ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তাঁরা সুস্থ ও অসুস্থ, পুরুষ ও নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, সকল জাতীয় মানুষের উপর ‘ডিউ স্লিপে’র গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখেছেন। ফল সর্বত্রই ইতিবাচক হয়েছে। ‘ডিউ স্লিপে’র মধ্যে সেলুলোজের পরিমাণ বেশি থাকলেও ফ্রুকটোজ, ল্যাকটোজ এবং গ্লুকোজের মাত্রাও এমন আন্দাজে যুক্ত হয়ে আছে যে সহজেই তা শরীরের শোণিতরসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। ফলে আসল চিনির চেয়ে চিনির বিকল্প ‘ডিউ স্লিপ’ শরীরে অনেক বেশি তাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য দফতরের জনৈক মুখপাত্র আমাকে বলেন, এই ‘ডিউ স্লিপ’ আমাদের মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী মহোদয়েরই ‘ব্রেন চাইল্ড্’ বা মগজ-পুত্র। অতএব এর যাবতীয় কৃতিত্ব ওঁরই প্রাপ্য। ‘ডিউ স্লিপ’ আবিষ্কৃত হবার পর থেকে চিনি সংকটের সমাধান আমরা করে ফেলেছি। পশ্চিমবঙ্গে এরপর আর কারোর পক্ষে চিনি নিয়ে মজুতদারি বা কালোবাজারি করা সম্ভব হবে না। র্যাশন থেকে চিনির পাট আমরা তুলেই দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু জানেন তো, মানুষের খাদ্যাভ্যাস রাতারাতি বদল করা যায় না। তাই আমরা সইয়ে সইয়ে ‘ডিউ স্লিপ’ ছাড়ছি।
উক্ত মুখপাত্র আরও বলেন, প্রথমদিকে জনসাধারণ ডিউ স্লিপের ব্যাপারটা ভালো মনে গ্রহণ করেননি। তবে ক্রমে ক্রমে তাঁরা ‘ডিউ স্লিপে’ অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। এরপর এমন দিনও আসবে, যখন লোকে আর চিনি ছোঁবে না, ‘ডিউ স্লিপ’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।
কয়েকজন র্যাশন-দোকানী জানালেন যে, বাগবাজার অঞ্চলের র্যাশনের দোকান থেকে কেউ আর চিনি নিচ্ছেনই না। সকলেই ‘ডিউ স্লিপ’ চাইছেন। খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ‘ডিউ স্লিপে’র চাহিদা এত বেড়ে যায় যে সরবরাহ বজায় রাখতে খাদ্য দফতরকে রীতিমত হিমসিম খেয়ে যেতে হয়।
খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ ‘ডিউ স্লিপ’-এর চাহিদা বেড়ে গেল কেন, খাদ্য দফতর থেকে সে সম্পর্কে যে সমীক্ষা চালানো হয় তাতে প্রকাশ, একে খৃষ্ট-উৎসব, তার উপর আবার পৌষ মাস পিঠের মাস, এই দুই পরবের জন্যই ‘ডিউ স্লিপে’র চাহিদা বেড়েছে। নিউ মার্কেটের কয়েকটা বেকারীর কারিগরও জানালেন, তাঁরা এবার ‘ডিউ স্লিপের সাহায্য যে-সব কেক ও প্যাসট্রি বানিয়েছেন, তার খুবই কদর বেড়েছে।
বাগবাজারের জনৈক মোদক ‘ডিউ স্লিপ’ দিয়ে এবার যে মালপোয়া প্রস্তুত করেছেন, তা মালপোয়া শিল্পে একেবারে যুগান্তর এনে দিয়েছে। গৌরভক্তি-প্রদায়িনী-সভা খাদ্যমন্ত্রীকে শুধু প্রাণঢালা আশীর্বাদ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে খাদ্যকান্তি উপাধিতেও ভূষিত করেছেন।
খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যায়, চারিদিক থেকে প্রাপ্ত এই রকম অপ্রত্যাশিত সব অভিনন্দন খাদ্যমন্ত্রীর উৎসাহ ও কর্মপ্রেরণা শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি এখন নাকি ভাবছেন, শুধু চিনির ব্যাপারেই নয়, ক্রমে ক্রমে চাল এবং গমের বিকল্প হিসাবেও তিনি ‘ডিউ স্লিপ’ চালু করবেন। কারণ, প্রোকিওরমেটের উপর তিনি এবং তাঁর চিহ্ন নাকি তেমন ভরসা রাখতে পারছেন না। তবে এই সব ‘ডিউ স্লিপে’র কোয়ালিটি যাতে উচ্চশ্রেণীর হয়, সেদিকে খাদ্যমন্ত্রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।
পিঠে-পুলি তৈরিতে নিপুণা কংগ্রেসী মহিলা সংসদের সভানেত্রী এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন, একখানা ‘ডিউ স্লিপ’ পাঁচ কিলো চিনির কাজ করে। চিনির একটা প্রধান অসুবিধা হচ্ছে এই যে, তা খরচ হয়ে যায়, ‘ডিউ স্লিপ’ খরচ হয় না। আর রান্নার ব্যাপারেও মস্ত সুবিধে হচ্ছে এই যে, পায়েস বলুন, পিঠে বলুন বা যে জিনিসে মিষ্টি দিতে চাই তার উপরে দুই থেকে পাঁচ মিনিট ‘ডিউ স্লিপ’ খানা ঝুলিয়ে রাখলেই সেটা প্রয়োজন মতো মিষ্টি হয়ে যায়।
খাদ্য দফতর শুধুমাত্র বিধিবদ্ধ র্যাশন এলাকায় চিনির বিকল্প হিসাবে ‘ডিউ স্লিপ’ চালু করায় র্যাশন বহির্ভূত অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে নিদারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায়, তাদেরও ‘ডিউ স্লিপ’ দেওয়া হবে বলে খাদ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩