গৌড়ানন্দ কবি ভনে

খাদ্যমন্ত্রীর দুঃসাহসিক অভিযান

খাদ্যমন্ত্রীর দুঃসাহসিক অভিযান

পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী সিদ্ধ চাল নামক রহস্যময় এক বস্তুর সন্ধানে হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং মধ্যপ্রদেশের দুর্গম অঞ্চলে শীঘ্রই অভিযান চালাবেন, এই রোমহর্ষক সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্র এই রাজ্যের সর্বত্র বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সিদ্ধ চাল নামক বস্তুটির অস্তিত্ব সত্যই আছে, না ওটা নিছক কিংবদন্তী, খাদ্যমন্ত্রীর এই দুঃসাহসিক অভিযান এই রহস্যের মীমাংসা করে দিতে পারবে বলেই পণ্ডিতগণ আশা প্রকাশ করেন।

অভিজ্ঞ জাপানী পর্যটক, ফটোগ্রাফার এবং বহুরকম অভিযানের নায়ক মি: সুকেগী খোঁজাখুঁজি, নাচানাচি শিমবুন পত্রিকার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, কয়েক বছর আগে তিনি একবার যখন জাপানী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে ইয়েতি অর্থাৎ তুষার মানবের ছবি, তোলবার জন্য কাঠমাণ্ডু যান, তখন ফিরতি পথে তাঁকে কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের বিধিবদ্ধ রেশন এলাকার বিভিন্ন স্থানে কাটাতে হয়। সেই সময় পর পর কয়েকজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার মুখে সিদ্ধ চাল নামক বস্তুটির কথা শুনে ওই বস্তুটি সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল জাগ্রত হয়। এবং ওই ব্যাপারে কিছুটা খোঁজাখুঁজিও তিনি করেন।

এই বিষয়ে নাচানাচি শিমবুন ও মি: খোঁজাখুঁজির মধ্যে যে-সব কথাবার্তা হয় তার কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত হল :

নাচানাচি শিমবুন : মি: খোঁজাখুঁজি! হঠাৎ সিদ্ধ চাল সম্পর্কে আপনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন কেন?

মি: খোঁজাখুঁজি : যে-কারণে ইয়েতি সম্পর্কে আমার কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে, ঠিক সেই কারণে। যদিও এই দুটো ব্যাপার এক নয় জানি। ইয়েতির বেলায় যেমন কথাটা শোনা যায় অথচ জিনিসটা দেখা যায় না। সিদ্ধ চালের বেলাতেও অবিকল একই ব্যাপার, নামটা খুবই শোনা যায়, কিন্তু জিনিসটা দেখা যায় না।

নাচানাচি শিমবুন : এমনও তো হতে পারে, জিনিসটার হয়তো আদপেই কোন অস্তিত্ব নেই। হয়তো নিছক কিংবদন্তীই।

মি: খোঁজাখুঁজি : কিংবদন্তীই যদি হয়, তবু আমরা পর্যটকরা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একথা বলতে পারি, বিনা কারণে কিংবদন্তীও সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া আমি যেমন ইয়েতির পায়ের ছাপ এবং নাদ ইত্যাদি দেখেছি, তেমনি সিদ্ধ চালের একটা বহু প্রাচীন খালি বস্তাও দেখেছি। ওই বস্তার গায়ে এমন এক ধরনের গন্ধ লেগে ছিল যার সঙ্গে আমাদের পরিচিত কোনও জিনিসের গন্ধেরই মিল নেই। স্থানীয় লোকেদের দৃঢ় বিশ্বাস ওটা সিদ্ধ চালের গন্ধ। এ প্রমাণটা নিতান্ত উপেক্ষা করার মত নয়। ওই বস্তার ফটোও আমি তুলে এনেছি। কাজেই ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নাচানাচি শিমবুন : তাহলে আপনার বক্তব্য কী?

মি: খোঁজাখুঁজি : সিদ্ধ চাল নামক বস্তুটি ইয়েতির মতোই রহস্যময়, আপাতত এইটুকুই আমি বলতে পারি। আমার বিশ্বাস ইয়েতির মতো সিদ্ধ চালের অস্তিত্বও থাকা সম্ভব।

পশ্চিমবঙ্গের বিধিবদ্ধ রেশন এলাকায় যাঁদের জন্ম, তাঁদের শতকরা আশী ভাগের ধারণা, প্রাগৈতিহাসিক যুগে সিদ্ধ চাল বলে হয়তো কোনও বস্তু ছিল কিন্তু বর্তমানে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। অনেকেই জানালেন, তাঁরা শিশুকাল থেকেই শুনে আসছেন, অমুক দোকানে সিদ্ধ চাল দেওয়া হচ্ছে, শুনেই তাঁরা ছুটেছেন, তারপর দোকানে গিয়ে শোনেন বাজে গুজব।

বাগবাজারের খাদ্যরসিক শ্রীভোজনচণ্ডী এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, জন্মাবধি তিনি বিধিবদ্ধ রেশন এলাকায় আছেন। তিনি রেশন দোকান থেকে এ পর্যন্ত সরু আতপ, মোটা আতপ, বেঁটে আতপ, আস্ত আতপ, ভাঙা আতপ, ক্ষুদে আতপ, পোকড়া আতপ, বোকড়া আতপ, ঢেলা আতপ, বেলে আতপ এমনকি পাথুরে আতপও পেয়েছেন, কিন্তু সিদ্ধ বলে কোনও চাল পাননি। তাঁর প্রশ্ন, সিদ্ধ চাল বলে কোনও বস্তু যদি সত্যই থাকত, তাহলে তা কি রেশনে একবারও পাওয়া যেত না? তবে হ্যাঁ, তাঁর ত্রয়োদশ পুরুষের কত্তামশায়ের একটা জমা খরচের খাতার সিদ্ধ চালের উল্লেখ আছে। তবে তিনি আফিঙ খেতেন বলে, তাঁদের বংশের কেউ কোনোদিন ঐ খাতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেননি।

খাদ্যমন্ত্রীর অন্তরঙ্গ মহল কিন্তু মনে করেন, সিদ্ধ চাল নিতান্ত প্রাগৈতিহাসিক যুগের বস্তু হলেও, এ যুগেও সেই লুপ্তপ্রায় বস্তুটির সাক্ষাৎ পাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বিধিবদ্ধ রেশন এলাকায় এই বস্তুটি দীর্ঘকাল আগে লুপ্ত হয়ে গেলেও, সিদ্ধ চাল নামক বস্তুটির অস্তিত্ব যে প্রাক্-রেশন যুগেও এতদঞ্চলে ছিল, সম্প্রতি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রায় দৈবক্রমেই আবিষ্কৃত হয়।

কিছুকাল পূর্বে কাশীপুরের খাদ্যগুদামে কিছু চিনির বস্তা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লবেঞ্চুস প্রস্তুতকারকদের ব্যবসায়ে উৎসাহ সঞ্চারের নিমিত্ত ঘন রসে পরিবর্তিত হয়েছে, এইরূপ এক সংবাদ পেয়ে খাদ্যমন্ত্রী সদলবলে এই অপরূপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে যান। ওই রসায়িত বস্তাগুলি সরাবার কালে আরেকটি অদ্ভুত ধরনের বস্তা দৈবক্রমেই নাকি আবিষ্কৃত হয়। ওই বস্তার ভিতরে শিলীভূত সিদ্ধ চাল পাওয়া যায়।

গামা রশ্মি এবং গামা ধানি গা রে প্রয়োগ করে বিশ্লেষণের যে ফল পাওয়া যায় তার দ্বারা খাদ্য দফতরের বিশেষজ্ঞগণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সমর্থ হন যে ওই শিলীভূত ডেলাগুলি সিদ্ধ চালেরই ডেলা। সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীকে সংবাদ দেওয়া হয় এবং সমগ্র দফতরে এই রকম এক আবিষ্কারের আনন্দে অভূতপূর্ব উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

খাদ্যমন্ত্রীর প্রচার সচিব সাংবাদিকদের জানান, খাদ্যমন্ত্রী এবার সিদ্ধ চালের উৎস সন্ধানে শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, যমুনা ও নর্মদা নদীর অববাহিকার দুর্গম অঞ্চলে দুঃসাহসিক অভিযান চালাবেন।

খাদ্যমন্ত্রী পরে নিজেও সে-কথার সমর্থন করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এজন্য তিনি পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশে অভিযান চালাবেন। ফলাফল সম্পর্কে তিনি আশাবাদী।

সিদ্ধ চাল সন্ধানী অভিযানের দলনেতা খাদ্যমন্ত্রী ক্যাপটেন প্রফুল্লকান্তি আরও জানান, এই অভিযানে দোভাষীর কাজ করতে তাঁর সুহৃদ এবং কেবিনেট সতীর্থ পরিবহণ মন্ত্রী শ্রীজ্ঞান সিং সোহনপাল স্বেচ্ছায় রাজি হওয়ায় তিনি আনন্দিত। পানজাব এবং হরিয়ানার দুর্গম অঞ্চলে জ্ঞান সিংজীর পরামর্শ এবং সাহায্য অভিযাত্রীদের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে উঠবে।

বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেল যে, দার্জিলিং-এর মাউনটেনীয়ারিং ইনসটিটিউট অভিযাত্রীদের সুবিধার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত তাঁবু, নানাপ্রকার সরঞ্জাম এবং কিছু অভিজ্ঞ গাইড দিয়ে সাহায্য করবেন। দিল্লির মাউনটেনীয়ারিং ফাউনডেশন, এক্সপ্লোরারস ক্লাব, স্থলসেনা, বিমান ও নৌবাহিনী ইত্যাদিও ও ম্যাপ, চারট, রসদ ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করবেন।

যাত্রাকালে মুখ্যমন্ত্রী দলনেতার হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিতে স্বীকৃত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে ডেট পাওয়া যাচ্ছে না বলে যাত্রার দিন ধার্য করা যাচ্ছে না।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *