খাদ
১
২রা এপ্রিল ২০১৯
পর্বতের কাছে এসে দাঁড়ালে অন্ধকারকেও জীবন্ত বলে মনে হয়!
গগনচুম্বী শৈলশ্রেণি যখন জমাট আঁধারের মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয়, হয়তো বা কোনও প্রাগৈতিহাসিক দানব বিরাট দেহটাকে এলিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ তার খসখসে কালো চামড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ছে অতিলৌকিক আঁধার! সে অন্ধকার নির্জীব নয়৷ একটু একটু করে অতৃপ্ত অশরীরীর মতো সেও যেন কোনও এক নির্দিষ্ট রূপ ধরার চেষ্টা করছে৷ তার কালো কুচকুচে লম্বা আঙুলগুলো বুঝি ইশারায় কিছু নির্দেশ করে বলতে চায়, ওদিকে! ওখানে!
আকাশে হাল্কা মেঘের মধ্যে রুপোলি একফালি চাঁদ তীব্র, শানিত ফলার মতো নিষ্ঠুর বাঁকা হাসি হাসছে৷ তার আলো চুঁইয়ে পড়ছে এক বিষণ্ণ সর্বগ্রাসী গহ্বরে! সেই গহ্বর; যার তৃষ্ণা যুগযুগ ধরে সহস্র যৌবনোচ্ছল পাহাড়ি নদী, চঞ্চল ঝোরাও মেটাতে পারেনি! সে গহ্বর সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছে৷ এক প্রবীণ, প্রাজ্ঞ মানুষের মতো হৃদয়ে বরফশীতল নির্লিপ্তি মেখে দেখে গিয়েছে জীবনের অলিখিত অধ্যায়গুলো! সে পৃথিবীর আদিমতম সাক্ষী! আর তার নাম—!
খাদ!
খাদের অন্ধকার বুক থেকে উঠে আসছে হাল্কা ধোঁয়াশা৷ আর কিছু নেই! শুধু অন্ধকার! শুধু খাঁ খাঁ করা শূন্যতা! আর কিছু নয়!
‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!—এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!’
আচমকা রাত্রির শান্ত নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে একটা অত্যন্ত মৃদু স্বর ফিসফিস করে বলে উঠল কথাগুলো৷ আবছা কুয়াশায় সেই কণ্ঠস্বরের মালিককে স্পষ্ট দেখা যায় না৷ শুধু একটা ছায়াদেহ কোনওমতে টলতে টলতে এসে দাঁড়াল খাদের ধারে৷ তার নেশাগ্রস্ত নড়বড়ে পা ফেলা দেখলেই ভয় হয় যে, এই বুঝি পড়ে যাবে খাদের অতলে! যেরকম বিপজ্জনকভাবে টলছে মানুষটা তাতে যে কোনও মুহূর্তে অতলান্তিক খাদ গ্রাস করতে পারে তাকে৷
কিন্তু লোকটার কোনও ভয় নেই! সে নির্ভয়ে টলতে টলতে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে ছুড়ে দিল সেই বাক্যটাই!
‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!’
খাদ নিশ্চুপ! শুধু কুয়াশা আর অন্ধকার ছাড়া তার আর কিছুই দেওয়ার নেই! আপাতত শুধু এক অদ্ভুত প্রতীক্ষায় সে দু-হাত বাড়িয়ে আছে৷ হয়তো সেটাই একমাত্র উত্তর!
২
২রা এপ্রিল, ২০১০
একটি বৃষ্টিস্নাত সকাল৷
দূরে হিমালয়ের সাদা শৃঙ্গ সূর্যের নরম সোনালি আলোয় ঝকমক করছে! দু-পাশের সদ্যস্নাত সবুজ পাহাড় লাস্যের ঢল নামিয়েছে৷ যেন নগাধিরাজ সোনার মুকুট পরেছেন৷ ধবধবে সাদা রাজবেশে কখনও সোনালি, কখনও রুপোলি জরির কারুকার্য৷ দু-কাঁধের রেশমি পান্নাসবুজ স্কন্ধাবরণ তাঁর পেশল দেহ স্পর্শ করে লুটিয়ে পড়েছে দু-দিকে৷
এই দৃশ্যকে পেছনে রেখে লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝকঝকে কাঠের বাংলো৷ তার লাল টুকটুকে টালির ওপরে এসে পিছলে পড়ছে সূর্যরশ্মি৷ বাংলোর চারপাশে কিছু আপেল ও পাইনগাছের ভিড়৷ আপেলগাছগুলো এই মুহূর্তে ফুলে ফুলে ভরা৷ সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে সাদা ফুলগুলো ভারী লাজুক ভঙ্গিতে উঁকি মারছে৷ সাদার সঙ্গে ঈষৎ গোলাপি রঙের আভা যেন তাদের লজ্জারই প্রকাশ! বাংলোর সামনে যতদূর চোখ যায়, লাল রঙের আগুন! কামনা-বাসনায় লেলিহান উদগ্র লাল টিউলিপের বাগান সৌন্দর্যের চরমে প্রস্ফুটিত!
তার অনতিদূরেই খাদ! অতলান্তিক রহস্য আর নীরবতা নিয়ে সকালের রোদ মাখছে৷ সাদা মেঘের পাতলা আস্তরণে ঢাকা থাকার দরুন প্রায় কিছুই দেখা যায় না৷ সূর্যরশ্মিও সে জমাট কুয়াশাকে ভেদ করে উঠতে পারেনি৷
মিসেস নীলম শেরাওয়াত সেই খাদের দিকে অনিমেষে তাকিয়েছিলেন৷ একহাতে ধরা বর্ষাস্নাত সিক্ত লাল টিউলিপের গুচ্ছ৷ অন্যহাতটা কোনও অজানা কারণে মুষ্টিবদ্ধ৷ তাঁর লম্বাটে নিখুঁত মুখমণ্ডলে এই মুহূর্তে কোনওরকম চাঞ্চল্য নেই৷ ঈষৎ ধূসর চোখদুটো খাদের দিকেই নিবদ্ধ৷ কিন্তু সে চোখে কোনও দৃষ্টি নেই! খাদের মতোই শূন্য এবং অভিব্যক্তিহীন৷ সব মিলিয়ে তাঁকে অদ্ভুত একটা ভাবলেশহীন অন্ধ পুতুলের মতো দেখাচ্ছে৷
‘মাম্মাখমা-ম্মাখ!’
একটি কচি মিষ্টি স্বরে তাঁর নিস্তরঙ্গ দৃষ্টিতে আলোড়ন উঠল৷ মুহূর্তের মধ্যে শূন্যতা সরে গিয়ে দু-চোখে উপচে পড়েছে মমতা ও স্নেহ৷ তিনি হাসিমুখে পেছন দিকে তাকালেন৷ একটি বছর তিনেকের শিশু ছোট্ট ছোট্ট হাত বাড়িয়ে এদিকেই ছুটে আসছে৷ খণ্ডমুহূর্তের মধ্যেই নীলমের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গম্ভীর মুখে বলল সে, ‘ম্যায়নে পাপা কো হারা দিয়া৷’
অপত্যস্নেহের সঙ্গে কিছুটা কৌতুক নেচে উঠল মিসেস শেরাওয়াতের চোখে৷ হাসি চেপে ছদ্ম কৌতূহলে বললেন, ‘আচ্ছা?’
তিন বছরের বালক সজোরে মাথা ঝাঁকায়৷ এতক্ষণ সে তার বাবার সঙ্গে ছোট্ট প্লাস্টিকের কামান নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল৷ দুশমনের ফৌজ, তথা কয়েকটা কাঠবিড়ালি একখানা পাইনগাছকে দখল করে, ঘাঁটি বানিয়ে বসেছিল৷ তাদের সবাইকে পরাস্ত করে শেষ পর্যন্ত ফৌজিসাহেব নিজের বাবাকে হারিয়েছেন! বলাই বাহুল্য, বড়ই পরিশ্রম হয়েছে তাঁর!
‘হে; ই, জওয়ান! অ্যা-টে-ন-শ-ন!’
পেছন থেকে এবার পুরুষালি ভারী কণ্ঠ ভেসে এল৷ বছর পঁয়ত্রিশের এক দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ মানুষ বাংলো থেকে বেরিয়ে এদিকেই এলেন৷ শিশুটির কাছে এসে বললেন, ‘তুমি দ্রাস সেক্টর অরক্ষিত রেখে এসেছ! আর সেটা আপাতত আমার দখলে!’
এতক্ষণের বিজয়ী হাস্যমুখ শিশুটি এবার হাপুস নয়নে কান্না জুড়ে দিল৷ একটু আগেই অনেক কষ্ট করে সে শত্রুসেনা নিধন করে ভারতমাতাকে মুক্তি দিয়ে এসেছে৷ কিন্তু কে জানত যে শত্রু আবার ফিরে আসবে! বেচারি কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ‘আপনে চিটিং কিয়া!’
নীলম শেরাওয়াত ক্রন্দনরত বালকটির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে পুরুষটির দিকে ছদ্মরাগে তাকালেন৷ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘দিস ইজ আনফেয়ার মেজর ধীমন্ত শেরাওয়াত!’
মেজর ধীমন্ত শেরাওয়াত ফিক করে হেসে ফেলেন৷ হাসলে তাঁর গালে ভারী চমৎকার একটা টোল পড়ে৷ হাসতে হাসতেই উষ্ণ স্বরে জবাব দিলেন, ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!’
নীলমের ভুরু ধনুকের মতো বেঁকে গেছে৷ নীচুস্বরে বললেন, ‘তোমায় কতবার বলেছি, ওইটুকু বাচ্চাকে যুদ্ধ-মারদাঙ্গা শিখিও না৷ দুনিয়ায় আর কোনও খেলা নেই?’
ধীমন্ত শান্ত হাসলেন৷ নীলমকে বুঝিয়ে লাভ নেই৷ সম্পর্কে স্ত্রী হলেও নীলম তাঁর থেকে অনেকটাই ছোট৷ দুজনের বয়েসের মধ্যে প্রায় দশ বছরের ফারাক৷ তাই নীলমের মধ্যে এখনও কিছুটা ছেলেমানুষি রয়েই গিয়েছে৷ তিনি যুদ্ধ, বন্দুক, তোপ-গোলা থেকে দূরেই থাকতে চান৷ আসলে কার্গিলের যুদ্ধ নীলমকে অল্পবয়েসেই একদম অনাথ করে দিয়েছিল৷ তাই ‘যুদ্ধ’ শব্দটাকেই আন্তরিক ঘৃণা করেন তিনি৷
জীবনের প্রারম্ভে নীলম কার্গিল সীমান্তের কাছাকাছি একটি প্রান্তিক গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন৷ সংসারে দরিদ্র মেষপালক বাবা এবং একটি মূক ও বধির জড়ভরত ভাই ছাড়া তাঁর আর কেউ ছিল না৷ নীলমের মা ছেলেটিকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা যান৷ তখন নীলমও মাত্র সাত বছরের শিশুকন্যা৷ কিন্তু গরিবের সংসারে মেয়েরা অল্পবয়েসেই বড় হয়ে যায়৷ তাই সদ্যোজাত মাতৃহারা শিশুটির জননীর স্থান দখল করে নিতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি নীলমের৷ ছোট ভাইটি জন্ম থেকেই জড়বুদ্ধি এবং মূক-বধির! তাই তার দিদি হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিল তাকে৷
কিন্তু কার্গিলের ভয়াবহ যুদ্ধ নীলম আর তার ভাইয়ের একমাত্র অবলম্বনটুকুও কেড়ে নিল৷ জঙ্গিদের অবিরাম গোলাবর্ষণের শিকার হলেন তার বাবা! অনাথ ভাই-বোনকে ভারতীয় সেনারা উদ্ধার করল ঠিকই, তবে নীলমের কপালে আরও যন্ত্রণা লেখা ছিল৷ এর কিছুদিন পরেই এক তুষারঝড়ের রাতে তার আট বছরের সন্তানসম ভাইও চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে গেল৷ জড়মস্তিষ্ক বালক প্রায়ই এদিক-ওদিকে চলে যেত৷ আবার কয়েকদিন পরে ফিরেও আসত৷ সেবার আর ফিরল না!
এই গোটা ইতিহাসটাই স্বয়ং নীলম বলেছেন মেজর শেরাওয়াতকে৷ জীবনের কোনও অধ্যায়ই গোপন রাখেননি তিনি৷ ওঁদের প্রেম-পর্বের শুরুতেই নিজের সম্পর্কে সব বলে দিয়েছিলেন নীলম৷ আজ থেকে দশ বছর আগে সেই পনেরো বছরের উদভ্রান্ত ও ক্লান্ত অনাথা কীভাবে এক বৌদ্ধ শ্রমণের কাছে আশ্রয় পেয়েছিল, মনাস্ট্রিতে তার ধর্মীয় শিক্ষা, স্কুলিং থেকে শুরু করে পরবর্তী উচ্চশিক্ষার ইতিহাস; সবই বলেছিলেন নীলম৷ শুনতে শুনতে অন্তরে এক গভীর বেদনাবোধ টের পেয়েছিলেন ধীমন্ত৷ একমুহূর্তের জন্য মনেও হয়েছিল, পৃথিবীতে যুদ্ধ নামক জিনিসটা না থাকলেই বোধহয় ভালো হত! কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে গিয়েছিলেন তাঁদের চিরাচরিত আর্মির শিক্ষায়, ‘নো অ্যাগোনি, নো পেইন, শ্যাল মেক মি ক্রাইখ’!
একজন প্রফেশনাল যোদ্ধার মনে দুর্বলতার কোনও স্থান নেই! আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে কোনও গেমই আনফেয়ার নয়! এমনকি সাধারণ মানুষের অসহায় মৃত্যুও ‘পার্ট অফ দ্য গেম’! ‘প্যাথেটিক’; কিন্তু ‘আনফেয়ার’ বলা যায় না৷ কারণ, ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!’
‘মাম্মা, খিদে পেয়েছে৷’
শিশুপুত্রের আবদেরে কণ্ঠস্বরে সংবিৎ ফিরল ধীমন্তের৷ সে কান্না থামিয়ে এখন ব্রেকফাস্টের দাবি করছে৷ তিনি হাসিমুখে তাকালেন নীলমের দিকে৷
‘আমাদের বীর ক্যাপ্টেন এখন ব্রেকফাস্টের ওপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে চান৷ কোই শক?’
মেজরের হাসি ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়লেন নীলম৷ তারপর ভারী রহস্যময় হাসি হেসে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন সদ্য তুলে আনা রেড টিউলিপের গুচ্ছ৷ মৃদু হেসে বললেন :
‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মেজর শেরাওয়াত! সারপ্রাইজ গিফ্টটা রাতের জন্য তোলা রইল৷’
বলতে বলতেই ফের তাকালেন খাদের দিকে৷ খাদ থেকে তখনও উঠে আসছে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ৷ তার ধূসর চোখের মতোই রহস্যময় কুয়াশা ঢেকে রেখেছে সেই মৃত্যুগহ্বরকে!
৩
‘লেটস কল আ স্পেড, আ স্পেড!’
কর্নেল মনোজ গুপ্তা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সামান্য নেশাজড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘আ স্পাই, ইজ আ স্পাই৷ তার কোনও জাত নেই, নাম নেই, সম্পর্ক নেই৷ সে শুধু বিশ্বাসঘাতক৷’
নীলম তাঁর দিকে কাবাবের প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে হেসে বললেন, ‘যে আপনার চোখে বিশ্বাসঘাতক, সে অন্যদের চোখে দেশপ্রেমিকও হতে পারে৷’
কর্নেল ঠক করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন নীলমের দিকে৷ একটু রুক্ষ কণ্ঠে জানালেন, ‘ইউ নো মিসেস শেরাওয়াত, আমার তো কখনও কখনও সন্দেহ হয়, যে আপনি নিজেই স্পাই নন তো?’
ধীমন্ত সজোরে হেসে ওঠেন৷ তাঁর শিশুপুত্রও কিছু না বুঝেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল৷ কর্নেল গুপ্তা পারলে গোটা দেশের লোককেই স্পাই হিসাবে চিহ্নিত করেন! অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের যোদ্ধা মনোজ প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সন্দিগ্ধহৃদয়৷ এবং কয়েক পেগ পেটে পড়লে সন্দেহের মাত্রা কিছুটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়৷
‘ধীমন্ত, মৎ হাসিও বেটা৷’ কর্নেল গুপ্তা তখনও নীলমের দিকে তাকিয়ে আছেন, ‘লুক অ্যাট হার! এরকম সুন্দরী তরুণী তোমার মতো একটা আধবুড়ো লোকের প্রেমে কীভাবে পড়ে? তোমার মতো একটা অপদার্থর সঙ্গে চার বছর সংসারই বা কীজন্য করছে ভাইয়া? কুছ তো গড়বড় হ্যায়!’
ধীমন্ত এবার গর্বের হাসি হাসলেন৷ সত্যিই তো! নীলম স্নেহে, প্রেমে এবং ভালোবাসায় তাঁর সংসারটাকে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছেন৷ এমনকি দেবশিশুর মতো এক সন্তানের সুখও পেয়েছেন তিনি৷ জীবনে আর কী চাই? নীলমের জন্যই তিনি আজ সুখী; পরিপূর্ণ! সেজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞও বটে৷
নীলম কিন্তু আদৌ কর্নেলের কথায় ব্যথিত হননি৷ বরং উলটে মুচকি হেসে বললেন, ‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট৷’
কর্নেল গুপ্তা লম্বাটে মুখ করে ফের পানপাত্র তুলে নেন৷ সঙ্গে কাবাবও৷ মিসেস রজনী গুপ্তা তাঁর পাশেই বসেছিলেন৷ স্বামীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘আর্মিতে থেকে তোমরা সবাই মাথামোটা হয়ে গিয়েছ! বছরে তো ক’টা দিন মাত্র ছুটি! তার ওপর আজ আবার ওদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি! এখনও স্পাই, যুদ্ধ, গোলা-গুলি তোমাদের পেছন ছাড়ছে না! ওসব কোস্তা-কুস্তি বর্ডারে গিয়ে কোরো৷ নাউ, জাস্ট এনজয় দ্য ফুড৷’
‘ফুড গয়া তেল লেনে!’ বৌয়ের ধমক খেয়েও বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হলেন না কর্নেল গুপ্তা৷ উলটে বললেন, ‘তোমাদের কোনও ধারণাই নেই যে বর্ডারে কী হচ্ছে! ডেইলি কিছু না কিছু ‘লফড়া’ ঘটছেই! কত স্পাইয়ের সঙ্গে আমাদের রোজ লড়তে হয় জানো? ও ব্যাটারা সবসময় ফাঁক খোঁজে৷ জঙ্গিদের থেকেও মারাত্মক হচ্ছে ওদের গুপ্তচরেরা!’
উপস্থিত বাকি তিনজনই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন৷ এমনকি মেজরের শিশুপুত্রও মুখ তুলে তাকাল৷ মনোজ এখন কী বলবেন তা ওঁরা প্রত্যেকেই জানেন! আজ পর্যন্ত মেজর শেরাওয়াতের এই বাংলোয় যত অনুষ্ঠান হয়েছে, প্রত্যেকবারই কর্নেল গুপ্তা ও রজনী আমন্ত্রিত হয়েছেন৷ ধীমন্তের বাবা-মা বহুদিন হল গত হয়েছেন৷ ভাই-বোনের সঙ্গেও তেমন সম্পর্ক নেই৷ বন্ধু বলতে এই একজনই৷ ধীমন্ত ও নীলমের বিয়ে থেকে শুরু করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া, জন্মদিন পালন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি; সবকিছুরই সাক্ষী শুধু এই গুপ্তা পরিবার৷ আর যতবারই এই চারজন আনন্দোৎসবে মিলিত হয়েছেন, ততবারই এই বিশেষ এক গুপ্তচরের গল্প বাধ্যতামূলকভাবে শুনতে হয়েছে সবাইকে! মিসেস গুপ্তা বিড়বিড় করে বললেন :
‘ওঃ গড! মনোজ, নট এগেইন!’
তাঁর বিরক্তিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বহুবার বলা সেই গল্পটাই আবার বলতে শুরু করলেন কর্নেল গুপ্তা! এক বিপজ্জনক গুপ্তচরের কাহিনি!
৪
কার্গিল যুদ্ধের পর প্রায় একবছর পরের ঘটনা৷
যুদ্ধ শেষ হয়েছে৷ কিন্তু যুদ্ধের সেই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে তখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি ভারতীয় সেনাবাহিনী৷ কার্গিলের ভয়ংকর ব্লান্ডারটা হজম করতে পারেননি ব্রিগেডিয়ার, লেফটেন্যান্ট জেনারাল এবং সুবেদাররা৷ তাই সীমান্তরক্ষীদের ওপর কড়া হুকুম ছিল, সবসময়ই সতর্ক থাকতে হবে৷ কোনও-রকম ঝুঁকি আর নেওয়া যাবে না৷ তার ওপর থেকে থেকেই ‘ক্রস-বর্ডার শেলিঙে’র ফলে প্রায়ই আহত বা নিহত হতে থাকল ভারতীয় জওয়ানরা! আর্মির ওপরওয়ালারা সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে ভারতীয় সেনাদের খবর নিশ্চয়ই কোনও না কোনওভাবে শত্রুপক্ষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে৷ নয়তো এত নিখুঁতভাবে জওয়ানদের গতিবিধি জানতে পারছে কী করে প্রতিপক্ষ! বলাই বাহুল্য, তারপর থেকেই বাচ্চা-বুড়ো নির্বিশেষে সমস্ত সাধারণ মানুষকেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল ইন্ডিয়ান আর্মি৷
এরমধ্যেই ঘটে গেল আরও একটা মর্মান্তিক ঘটনা৷ ধীমন্ত ও মনোজের এক সঙ্গী, অভিজিৎ পান্ডে যখন আরও কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে নাইট ডিউটিতে ছিলেন, তখন খুব কাছ থেকেই আচমকা একটা গ্রেনেড তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়ল! অভিজিৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারাত্মক একটা বিস্ফোরণ! মুহূর্তের মধ্যে মানুষটা ধোঁয়া হয়ে গেল৷ পড়ে রইল শুধু কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ!
নিজের বন্ধুর এই মর্মান্তিক পরিণতি মেনে নিতে পারেননি ধীমন্ত শেরাওয়াত ও মনোজ গুপ্তা৷ মনোজ গুপ্তা দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিলেন, ‘মা কসম, ইস্কা বদলা জরুর লুঙ্গা! আঁখকে বদলে আঁখ! সা-লে!’
ধীমন্ত মুখে কিছু বলেননি৷ কিন্তু তাঁর মনোভাবও এমনই ছিল৷ যোদ্ধারা কখনও শান্তির ধ্বজা তোলে না৷ তাদের একটাই আপ্তবাক্য৷ আ টুথ ফর আ টুথ অ্যান্ড অ্যান আই ফর অ্যান আই! আর্মির অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসার আগুন এমনিতেই কার্গিলের যুদ্ধের পর কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল৷ এবার তাতে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল৷ তাদের সন্দেহ এবার বিশ্বাসে পর্যবসিত হল৷ গুপ্তশত্রু আশেপাশেই আছে এবং কড়া নজর রাখছে! সে যে কেউ হতে পারে, যে কোনও বেশে থাকতে পারে৷
ইতিমধ্যেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল মনোজের৷ যাকে বলে ‘আনক্যানি ফিলিং’৷ বারবার তাঁর মনে হচ্ছিল, কেউ আড়াল থেকে তাঁদের দেখছে! একজোড়া অনভিপ্রেত চোখের উপস্থিতি মুহুর্মুহু টের পাচ্ছিলেন তিনি৷ প্রতি পদক্ষেপেই অনুভব করছিলেন যে কেউ তাঁদের লুকিয়ে জরিপ করছে, তাঁদের গতিবিধি মাপছে! শকুনের মতো একটা তীব্র, তীক্ষ্ণ শিকারি দৃষ্টি প্রতিপক্ষের প্রত্যেকটা চাল গোপনে বুঝে নিচ্ছে! কিন্তু হাতে কোনও প্রমাণ ছিল না৷
মনোজ তার এই অনুভূতির কথা কাউকে বলেননি৷ কিন্তু অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন, যার ফল মিলল হাতেনাতেই৷
একরাতে প্রহরারত অবস্থাতেই আবার সেই অস্বস্তি তাঁকে ঘিরে ধরল৷ সীমান্তের হিমেল হাওয়ার কামড়, প্রহরীর সহজাত সতর্কতা, রাত জাগার ক্লান্তিকেও ছাপিয়ে প্রখর হয়ে উঠল সেই অদ্ভুত অনুভব! কেউ দেখছে! কেউ আছে তাঁর আশেপাশে! আছেই!
তিনি বিদ্যুৎবেগে ফিরলেন পেছনদিকে! স্পষ্ট দেখলেন বরফে চাপা পড়া একটা পাথরের পেছনে একটা ছায়ামূর্তি! লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে তাঁর ওপর! স্পাই! শত্রুপক্ষের চর!
‘এ-ই! কৌন বে?’
চেঁচিয়ে উঠলেন মনোজ গুপ্তা৷ তাঁর আশেপাশের রক্ষীরাও ছুটে এল৷ ছুটে এলেন নাইটডিউটিতে থাকা ধীমন্ত৷ গুপ্তচরটি পালাবার বিন্দুমাত্রও সুযোগ পায়নি৷ তার আগেই তাকে ঘিরে ধরে সশস্ত্র সেনাবাহিনী৷ অনেকগুলো জোরালো টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল তার অবয়ব! ধূসর চাদরে মোড়া একটা মানুষ৷ মুখ ঢাকা থাকলেও চোখদুটো আলোয় ঝিকিয়ে উঠল৷
কিন্তু কী অদ্ভুত সে চাউনি! তার চোখে চোখ পড়তেই রক্তহিম হয়ে গেল ধীমন্তের৷ এমন চোখ কি কোনও মানুষের হয়? হতে পারে? অসম্ভব কঠিন অথচ বরফের মতো শীতল সে দৃষ্টি! তার কোনও ভাষা নেই৷ এক অদ্ভুত ঔদ্ধত্যে মানুষটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে৷ কোনও ভয় নেই তার!
‘সা-লা সুয়ার কি ঔ-লা-দ! হা-রা-ম-জা-দা!’
হাতের বেয়নেটটার বাঁট তার মুখে ঘুরিয়ে সপাটে মারলেন মনোজ৷ লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল৷ সজোর আঘাতে তার নাক বেয়ে গলগলিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত৷ সাদা বরফের ওপরে যেন কেউ বিছিয়ে দিল লাল কার্পেট!
কিন্তু আশ্চর্য! তারপরেও লোকটা একটুও ভয় পেল না৷ যন্ত্রণাসূচক একটা শব্দও বেরোল না তার মুখ থেকে৷ বরং সে ফিরে তাকাল ওদের দিকে৷ চোখে সেই বরফশীতল দৃষ্টি৷ অদ্ভুত এক বেপরোয়া ভাব৷ মনোজের মনে হল, লোকটা মনে মনে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে, আর বলছে, ‘যা খুশি কর! পরোয়া করি না!’
‘তেরি তোখ!’
বেয়নেটটা তাক করে গুপ্তচরের দিকে মার মার করে তেড়ে গেলেন মনোজ৷ কিন্তু লোকটার চোখের পলকও পড়ল না৷ সাপের মতো ভীষণ শীতলতা নিয়ে তাকিয়ে আছে সে৷ কোনও বিকার নেই!
ধীমন্ত মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, লোকটার কলজে আছে! চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে সশস্ত্র ভারতীয় সেনা৷ সামনে উদ্যত বেয়নেটের ফলা৷ তা সত্ত্বেও সে একটুও ভয় পাচ্ছে না! একটুও না! অমন অনমনীয় শত্রুর সামনে থমকে গেলেন মনোজ গুপ্তাও৷ খণ্ডমুহূর্তের জন্য হয়তো বা বিচলিতও হলেন৷ উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুকে কুপিয়ে মারা৷ কিন্তু প্রতিপক্ষের তেজ দেখে পরিকল্পনা পাল্টালেন তিনি৷ বেয়নেটটাকে তার বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘কে তুই? কোথা থেকে এসেছিস?’
লোকটা তার দিকে সাপের দৃষ্টিতে তাকাল৷ তার মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ তবুও একটি কথাও বলল না৷ বরং নিঃশব্দে হাসল! শয়তানের হাসি! ইঙ্গিত স্পষ্ট; মেরে ফেললেও সে মুখ খুলবে না!
‘এভাবে হবে না! টর্চার না করলে এ সা-লা চুতিয়া কিচ্ছু বলবে না৷ চ-ল!’
লোকটার কামিজ ধরে তাকে টেনে তুললেন মনোজ গুপ্তা৷ হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললেন বাঙ্কারের দিকে৷ তাঁর পেছন পেছন ধীমন্ত সহ বাকি সঙ্গীরাও৷
এরপরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত৷ কিন্তু ভয়াবহ! সারা রাত লোকটার ওপর অত্যাচার করে গেল সেনাবাহিনী৷ তাদের বুঝতে বাকি ছিল না যে এই শত্রুপক্ষের খবরের দৌলতেই বারবার জওয়ানদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে! এই লোকটার জন্যই আজ অভিজিৎ পান্ডে বিস্ফোরণের শিকার! এই শয়তানদের জন্যই প্রত্যেকবার ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত হয় দেশের মাটি! কিন্তু ও একা নয়৷ নির্ঘাৎ ওর পেছনে পুরো একটা গোষ্ঠীই রয়েছে৷ প্রতিহিংসায় উন্মত্ত জওয়ানরা ভীষণ আক্রোশে পেটাতে শুরু করল তাকে৷ মারতে মারতে বোধহয় দেহের সব হাড়ই গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল৷ আর লাগাতার প্রশ্ন করে গেল, ‘আর কে আছে তোর সঙ্গে? কে পাঠিয়েছে তোকে?…কাদের হয়ে কাজ করিস তুই?…তোর বাকি সঙ্গীরা কোথায়?…ব-ল!’
কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই কোনও উত্তর নেই! জওয়ানরা মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেল৷ হাঁফিয়ে গেলেন স্বয়ং মনোজ গুপ্তাও৷ মারের চোটে লোকটার কপাল, মুখ ফেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে! সারা গায়ে কালশিটে! উঠে বসার শক্তিটুকুও নেই৷ তার শ্বাস টানার শব্দেই স্পষ্ট যে কষ্ট হচ্ছে৷ কিন্তু তারপরও—!
লোকটা হাসল! হয় সে উন্মাদের হাসি; নয়তো পিশাচের! তার বরফকঠিন দৃষ্টি মুখর হয়ে বলে দিল, ‘যত টর্চার করার করে নাও সা-লোঁ! কিন্তু একটা শব্দও করব না!’
‘আচ্ছা? এত হিম্মৎ! হ-ড়া-মি!’
মনোজ গুপ্তার মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে৷ তিনি হিংসাকুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে! এদের জন্যই শত্রুপক্ষ আক্রমণ করার সাহস পায়! এদের জন্যই অভিজিৎ মর্মান্তিকভাবে শেষ হয়ে গিয়েছেন! ক্ষমা নেই! কোনও ক্ষমা নেই!
‘ধীমন্ত৷’ তিনি ধীমন্তের দিকে ফিরলেন, ‘নমক, মির্চি আর ছুরি নিয়ে এসো তো৷ আমিও আজ এর শেষ দেখে ছাড়ব!’
সত্যিই শেষ অবধি দেখেছিল আর্মি! নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল তাদের অত্যাচার৷ ধীমন্ত আর মনোজ লোকটির এক একটি নখ ধরে ধরে গোড়া সুদ্ধু উপড়ে ফেললেন! তবু সে টুঁ শব্দটিও করল না৷ তার দেহ চিরে চিরে নুন আর লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হল! আর্মিবুটের নিষ্ঠুর আঘাতে তার দেহে কালশিটে পড়ল৷ কিন্তু তারপরও লোকটার কোনও বিকার নেই! সে গুম হয়ে আছে, রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে৷ কষ্টে চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জলও পড়ছে৷ তবু একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না! এমনকি একটি কাতরোক্তিও নয়! মনোজ আর ধীমন্ত সবিস্ময়ে দেখলেন, আর্মির অত্যাচারেরও সীমা আছে; কিন্তু এই মানুষটির নৈঃশব্দ্যের বোধহয় কোনও সীমা-পরিসীমা নেই৷ বরং এখনও সে হাসছে! একটি গুপ্তচরের কাছে হেরে যাচ্ছে ভারতীয় সেনা! এ কী ধরনের মানুষ!
মনোজের চোখে রক্ত জমল, ‘ফাইন! হি ইজ ইউজলেস! যখন ও কিছু বলবেই না; তখন ওকে আর বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই! ওর সেই হালই করব, যা একজন স্পাইয়ের হওয়া উচিত!’
তখনও সীমান্তে সূর্যোদয় হয়নি৷ সবে অন্ধকার একটু একটু করে ফ্যাকাশে হচ্ছে৷ তার মধ্যেই টেনে-হিঁচড়ে রক্তাক্ত মানুষটিকে নিয়ে যাওয়া হল বধ্যভূমিতে৷ শেষবারের মতো ধীমন্ত জানতে চাইলেন, ‘কিছু বলবি?’
উত্তরে সেই আদি ও অকৃত্রিম একরাশ নীরবতা! সেই নির্ভীক, বেপরোয়া চাউনি৷ সেনারা আর অপেক্ষা করল না!
একমুহূর্ত স্তব্ধতা! পরক্ষণেই সীমান্তের নৈঃশব্দ্য খান খান করে গর্জন করে উঠল একাধিক এ কে ফর্টিসেভেন!
৫
গল্পটা একনিঃশ্বাসে শেষ করে ফের পানীয়ের গ্লাস তুলে নিলেন মনোজ গুপ্তা৷ হতাশভাবে বললেন, ‘আমরা শালাকে কুত্তার মতো গুলি করে মেরেছিলাম! কিন্তু একটাই আফসোস রয়ে গেল! লোকটাকে কিছুতেই ভাঙতে পারিনি আমরা৷ শালা হারামখোর মরে গেল, অথচ একটা কথাও বলল না! এটা আমাদের পরাজয়৷’
ধীমন্ত যোগ করলেন, ‘যখন ওকে গুলি করে মারা হচ্ছিল তখন ওর চোখ দেখেছি আমি! সেম এক্সপ্রেশন! ভয় নেই, দুঃখ নেই, কান্না নেই! ইনফ্যাক্ট কিচ্ছু নেই! রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়েও ও হাসছিল!’
‘ড্যাম ইট!’ চূড়ান্ত ফ্রাস্ট্রেশনে মদের গ্লাসটা টেবিলের ওপর সশব্দে রাখলেন কর্নেল গুপ্তা, ‘সেই হাসিটা আজও আমি ভুলিনি৷ আজও সেই হাসিটা আমায় মক করে! হন্ট করে!’
নীলম এতক্ষণ মুখ নীচু করে গোটা ঘটনাটা শুনছিলেন৷ এবার মুখ তুলে ঠান্ডাভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কর্নেল গুপ্তা, বহুবার আপনি এই ঘটনাটা বলেছেন৷ কিন্তু একটা তথ্য দিতে বোধহয় ভুলে গিয়েছেন!’
কর্নেল গুপ্তা একটু অতিরিক্তই মদ্যপান করে ফেলেছিলেন৷ নেশাজড়িত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কোন তথ্য?’
তিরবেগে প্রশ্ন এল, ‘সেই স্পাই তথা ‘লোকটা’র বয়েস কত ছিল?’
‘আ স্পাই ইজ আ স্পাই!’ তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘তার আবার বয়েস কী?’
নীলম শেরাওয়াত একটু থেমে বললেন, ‘তার বয়েস বোধহয় আট বছর ছিল৷ তাই না? ‘লোক’ নয়, আট বছরের বাচ্চা ছেলে ছিল! নো?’
ধীমন্তের মাথায় যেন বাজ পড়ল! তড়িদাহতের মতো কেঁপে উঠলেন তিনি৷
‘নীলম! তুমি—!’
কিন্তু মেজরকে বাক্যটা শেষ করতে না দিয়েই নীলম আপনমনেই বলতে থাকলেন, ‘সে আপনাদের কোনও কথার জবাব দেয়নি কারণ সে কথা বলতে পারত না! আপনাদের কোনও হুমকিই তার কানে যায়নি; কারণ সে কানে শুনতে পেত না! সে আপনাদের শত অত্যাচারেও টুঁ শব্দটিও করেনি, কারণ ঈশ্বর তার মুখে প্রয়োজনীয় ভাষাটুকুও দেননি! এমনকি যন্ত্রণাপ্রকাশের অভিব্যক্তিও তার ছিল না! যে দৃষ্টিকে আপনারা শয়তানের দৃষ্টি ভেবেছিলেন, আসলে তা একজন জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভাষাহীন দৃষ্টি ছিল! সে বেচারি তো এটুকুও ঠিকমতো বোঝেনি যে তাকে নিয়ে ঠিক কী করা হচ্ছে! যে হাসিকে আপনারা ব্যঙ্গাত্মক ভাবছেন, আসলে তা হাসি নয়; এক অসহায় মানুষের কান্না, যার ভাষা বোঝার ক্ষমতা একমাত্র তার দিদিরই ছিল৷ সে কোনও স্পাই ছিল না!’
কর্নেল গুপ্তা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন৷ ধীমন্ত বাক্শক্তিরহিত!
‘প্রথমে ঘটনাটা বুঝতে পারিনি৷ কিন্তু কর্নেলের মুখে বারবার শুনতে শুনতে আমি মর্মান্তিক সত্যিটা উপলব্ধি করেছি৷’ নীলমের চোখদুটি রক্তাভ হয়ে উঠেছে, ‘সেই ধূসর রঙের চাদর পরেই সে নিখোঁজ হয়েছিল৷ সেই ভাষাহীন শীতল দৃষ্টি একমাত্র তারই ছিল! সেই অদ্ভুত বোকাটে হাসির মতো কান্না, সেই নীরবতা; সব কিছু মিলে গেল! আমি ভেবেছিলাম, হয়তো তুষারঝড়ের মধ্যেই সে ভুল করে বর্ডার ক্রস করে চলে গিয়েছে৷ হয়তো তাকে শত্রুরা মেরে ফেলেছে! কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম!’
প্রচণ্ড একটা কান্না এসে তার কণ্ঠরোধ করে দিল৷ অনেক কষ্টে অদম্য কান্নার বেগ সামলে নিয়েছেন নীলম৷ একটা গভীর শ্বাস টেনে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে ফের বললেন, ‘বেশ কিছুদিন আগেই আমি আসল ঘটনাটা বুঝতে পেরেছি৷ শুধু অপেক্ষায় ছিলাম, এই গল্পটা আপনি আবার কবে বলবেন—!’
বলতে বলতেই স্তম্ভিত, বিহ্বল ধীমন্তের দিকে তাকালেন তিনি, ‘কর্নেল গুপ্তা বা গোটা আর্মিকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার আমার নেই মেজর শেরাওয়াত৷ কিন্তু তোমার অন্তত একটা শাস্তি প্রাপ্য! সেই দিদি, যে তার একমাত্র ভাইকে মায়ের মতো বুকে করে আগলে রেখেছিল; সে তোমাকে শুধুমাত্র একটাই শাস্তি দিতে পারে৷ তোমাকে আমি সব সুখ দিয়েছি৷ এবার আমার যন্ত্রণাটাও নাও৷’
ধীমন্ত কিছু বোঝার আগেই বিদ্যুৎবেগে তিনি প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কোলে তুলে নিলেন তিন বছরের শিশুপুত্রকে৷ স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ ধীমন্তের মনে হল, এই হাসি অবিকল সেই আট বছরের ‘স্পাইয়ের’ হাসির মতো! হাসি নয়, কান্না!
‘সরি ধীমন্ত, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার৷’
কথাটা ছুড়ে দিয়েই তিরবেগে তিনি ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে৷ পাগলের মতো তাঁর পিছন পিছন ছুটলেন ধীমন্ত! মেজর গুপ্তাও দৌড়লেন তাঁর পেছনে৷ রজনী স্থবির, মূক হয়ে বসে আছেন৷ তখনও হয়তো গোটা ব্যাপারটা উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি৷
মদ্যপানের শিথিলতার দরুন দুজন পুরুষের পায়ের পেশি সঙ্গ দিচ্ছিল না৷ জোরে দৌড়তে দৌড়তেই আচমকা মুখ থুবড়ে পড়লেন ধীমন্ত শেরাওয়াত! ভয়ার্ত, বিহ্বল চোখে দেখলেন, নীলম টিউলিপের বাগানকে দলিত মথিত করে দিয়ে সোজা এগিয়ে যাচ্ছেন খাদের দিকে! সেই ভয়ংকর খাদ! নীলমের কোলে তাঁর আত্মজ! তাঁর একমাত্র শিশুপুত্র!
সামনে খাদ!
৬
২রা এপ্রিল, ২০১৯
খাদের শূন্য বুক থেকে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মানুষটার গায়ে! অন্ধকারের মধ্যেই সে উচ্চারণ করল, ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!…এভরিথিং ইজ ফেয়ার—?’
শেষ বাক্যটার শেষে যেন এক অন্তহীন জিজ্ঞাসা! খাদ নিরুত্তর! সে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না! যেন নির্বাক এক দর্শকমাত্র৷ শুধু দু-হাত বাড়িয়ে রোজই অপেক্ষা করে এই প্রশ্নকর্তাকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য! প্রতিরাতে সে উন্মুখ হয়ে থাকে এই মানুষটির জন্য!
হয়তো সেটাই তার একমাত্র উত্তর!
—