খাগায় নমঃ
ছোটবেলায় এই দোল-টোলের সময়, দেশে যেতাম, আমার ছোটঠাকুরদা আমাদের যত রাজার গাঁজাখুরি গল্প বলতেন, সে-সব একবার শুনলে আর ভোলা যায় না। একদিন বললেন, “দেখ, এই যে আমাদের গুষ্টির ধন-দৌলত দেখে গাঁ সুদ্ধ লোকের চোখ টাটায়, এ কি আর অমনি অমনি হয়েছিল ভেবেছিস, না কি চিরকাল এমনটি ছিল? বুঝলি এ সব লেখাপড়া শিখে সারা জীবন খেটেখুটেও কেউ করে দিয়ে যায়নি, বা লটারিতেও জেতেনি। কি শ্বশুরের কাছ থেকেও পায়নি। মাটি খুঁড়তে-খুঁড়তেও কেউ ঘড়া-ঘড়া সোনা পায়নি, চুরিও করেনি, ডাকাতিও করেনি। তবে হল কী করে? আরে, ও-সব করে কি আর সত্যি-সত্যি ভাগ্য ফেরে? এই আমাকেই দেখ না, তিন-তিনটি বার ম্যাট্রিক ফেল করে সেই নাগাদ দিব্যি বাড়িতে বসে আছি। কিন্তু তাই বলে কি আর আমি তাদের কারু চাইতে মন্দ, না কি তাদের চাইতে কম খাই? তোরাই বল না। এই দেখ, এরকম হীরের আংটি দেখেছিস কখনো? এটার দাম কম-সে-কম একটি হাজার টাকা। কখনো ভেবেছিস এত সব হল কোত্থেকে? এই যে দু-বেলা তাল তাল মাছ মাংস দই ক্ষীর তোরা পাঁচজনা ওড়াচ্ছিস, তাই বা আসে কোত্থেকে? জানিস, এ-সমস্তরই একমাত্র কারণ হল গিয়ে একটা এই এত বড় কালো পালক।”
শুনে আমরা তো হাঁ। ছোটঠাকুরদা আরো বললেন—
“হ্যাঁ, একটা কালো পালক ছাড়া আর কিছুই নয়। ওটিকে তোরা না-দেখে থাকতে পারিস, কীই-বা দেখেছিস দুনিয়াতে, ভূত পর্যন্ত দেখিসনি। তবে ওটি কপ্পুর-টপ্পুর দিয়ে লাল সালুতে মোড়া হয়ে, একটা চন্দন কাঠের বাক্স করে আমার ঠাকুমার লোহার সিন্দুকে পোরা আছে।
“তোদের মতো আকাট মুখ্যদের কীই-বা বলব, তবে শোন ব্যাপারটা গোড়া থেকে। আমার ঠাকুরদা ভারী চালাক-চতুর কায়দা-দুরস্ত মানুষ ছিলেন। ক্যায়সা তার চুলের টেরি বাগাবার টঙ, ক্যায়সা কোঁচানো মলমলি ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, কানের পিছনে তুলোর পুঁটলি করে আতর গোঁজা। সে-সব একবার দেখলেই লোকের তাক লেগে যেত। তার উপর আবার লোককে খুশি করতে তাঁর জোড়া খুঁজে পাওয়া দায় ছিল। বুঝতেই পারছিস এইসব কারণে এখানকার যিনি রাজা ছিলেন তাঁর সঙ্গে ঠাকুরদার ভারী দহরম-মহরম ছিল। সেইজন্য রাজসভাতেও তাঁর বেজায় খাতির, আর তাই দেখে পাঁচজনার হিংসে!
“এক-এক দিন সকালে স্নান সেরে সেজে-গুজে ঠাকুরদা রান্নাঘরের পাশের ঐ গন্ধরাজ গাছটি—ওটির কি কম বয়স ভেবেছিস?—ঐ গাছটা থেকে দুটো ফুল পেড়ে নিয়ে রাজসভায় গিয়ে হাজির হতেন, আর সটাং গিয়ে রাজার কানে-কানে কী যে না বলতেন তার ঠিকানা নেই। ব্যস, রাজাও আহ্লাদে আটখানা হয়ে হাতের কাছে যা পেতেন, শাল-দোশালা-শিরোপা, জামাজুতো, সব তাঁকে উপহার দিয়ে বসে থাকতেন!
“এমন-কী, শেষটা এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, দূর থেকে তাঁকে সভায় ঢুকতে দেখেই সভাসদ যত উজির-নাজিররা যে-যার গয়নাগাটি, জুতো, পাগড়ি লুকিয়ে ফেলতেন। এমনি সব ছোট মন ছিল। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস যে এঁরা কেউই ঠাকুরদা বেচারিকে সুনজরে দেখতেন না। সত্যি কথা বলতে কী সব্বাই তাঁর উপর হাড়ে হাড়ে চটা ছিলেন, এমন-কী, একা পেলে তাঁকে খোসামুদে বলে অপমান করতেও ছাড়তেন না। অবিশ্যি তাতে আমার ঠাকুরদার কাঁচকলাও এসে যেত না, তিনি দিব্যি আদরে-গোবরে রাজার কাছে দিন কাটাতেন।
“এখন মুশকিল হল যে মানুষের কখনো চিরদিন একভাবে যায় না। তোরাই কি আর সারাটা জীবন ঐরকম কাজকম্ম না করে পরের ঘাড়ে দিব্যি চেপে কাটাতে পারবি ভেবেছিস? ঠাকুরদা বেচারি খাসা নিশ্চিন্তে রাজসভায় মৌরসি পাট্টা গেড়ে জেঁকে বসেছেন। রাজবাড়ি থেকে রোজ তাঁর জন্য কলসি-কলসি দুধ, ঘি, ভাঁড়-ভাঁড় দই ক্ষীর, ধামা-ধামা চাল-কলা, থোক থোক নতুন গরদ, তোড়া-তোড়া মোহর যায়। তাঁর আবার ভাবনা কীসের?
“এমনি সময় হঠাৎ একদিন কোত্থেকে এক ছোকরা কবি, বলা নেই কওয়া নেই, একেবারে রাজসভায় এসে হাজির! কেউ তাকে কস্মিনকালেও চোখে তো দেখেনি, নাম পর্যন্ত শোনেনি। কিন্তু যেমনি তার রূপ, তেমনি তার খোসামুদে স্বভাব; দুদিনের মধ্যে রাজ্যসুদ্ধ রাজসভাকে একেবারে হাতের মুঠোর মধ্যে এনে ফেলল।
“কী আর বলব তোদের! তার উপর তার খাসা গানের গলা ছিল, আর কত যে ছলচাতুরি জানত! যখন-তখন তেমন-তেমন করে দুটো ছড়া গেঁথে নিয়ে গুবগুবাগুব বাজিয়ে, বাউলদের মতো করে এমনি নেচে-কুঁদে দিত যে সভাসুদ্ধ সব্বাই একেবারে গলে জল।
“ওদিকে ঠাকুরদা পড়ে গেলেন মুশকিলে। রাজা আর তাঁর দিকে ফিরেও তাকান না। রাজবাড়ি থেকে রসদের লাইনও বন্ধ। এমনিতেই রাজ্যের লোককে চটিয়ে রেখেছেন। আর বছরের পর বছর বসে-বসে এটা-ওটা খেয়ে দারুণ কুঁড়েও হয়ে গেছেন, তায় আবার দিব্যি টইটম্বুর একটি নাহাপাতিয়াও বাগিয়েছেন। অন্য জায়গায় কাজকর্মের জন্য যে একটু চেষ্টাচরিত্তির করবেন তারও জো নেই। অথচ মনে-মনে বেশ বুঝছেন যে এবার এখানকার পাট উঠল, ঐ ছোকরার সঙ্গে পেরে ওঠা, শুধু তাঁর কেন, তাঁর চোদ্দো-পুরুষের কারো কম্ম নয়!
“আস্তে আস্তে ঠাকুরদার জীবন থেকে সুখ-শান্তি বিদায় নিল।—এই, তোরা যে বড় হাসছিস? নিজের অতিবৃদ্ধ-ঠাকুরদার দুর্গতির কথা শুনলে তোদের হাসি পায়? আরো শোন তবে।—মানুষের অবস্থা মন্দ হলে যেমন হয়, ভোর না-হতেই—গয়লা রে, মুদি রে, তাঁতি রে, নাপিত রে, ধোপা রে, যে যেখানে ছিল সব টাকা দাও টাকা দাও করে সারি সরি হাত পেতে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল।
“ওদিকে দিনে-দিনে অভাবে অনটনে ঠাকুমার মেজাজও এমনি খিঁচড়ে যেতে লাগল যে বাড়িতে টেকাও দায় হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত একদিন গভীর রাতে ঠাকুরদা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন। গভীর রাতে পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একেবারে সটাং গিয়ে এই গ্রামের বাইরে মাঠের মাঝখানে যে বিখ্যাত ভুতুড়ে বটগাছ ছিল, দিনের বেলাতেও যার ছায়া মাড়াতে লোকে ভয় পেত—ইদিক-উদিক কী তাকাচ্ছিস বল দিকিনি? সে গাছ কোনকালে মরে-ঝরে চ্যালাকাঠ হয়ে গেছে। এখন চুপ করে শোন তো। —সেই গাছতলাতে না গিয়ে এক হাঁড়ি শুঁটকিমাছ নিবেদন করে দিয়ে ঠাকুরদা ধর্না দিয়ে পড়ে থাকলেন। একটা যা-হয় ব্যবস্থা না-হওয়া পর্যন্ত উঠবেন না।
“পড়ে আছে তো পড়েই আছেন। প্যাঁচা-ট্যাঁচা ডাকছে কীসের একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে কী সব সড়্সড়্ খড়্খড়্ করে পায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, কারা জানি চাপা গলায় ফিস্-ফিস্ করছে কিন্তু ঠাকুরদা নড়েনও না চড়েনও না।
“হয়তো-বা একটু তন্দ্রামতো এসে থাকবে, হঠাৎ মনে হল কে যেন বলছে ‘ওঠ ব্যাটা, বাড়ি যা। যা যা বাড়ি যা, আর তোর কোনও চিন্তা নেই। ওঠ বলছি। কেটে পড় দিকিনি। কী জ্বালা! ভাগ বলছি!’
“ঠাকুরদাও তখনই আর কালবিলম্ব না করে, উঠে পড়ে বাড়িমুখো হাঁটা দিলেন। আর কী আশ্চর্য ব্যাপার! একেবারে দোরগোড়ায় এসে দেখেন পায়ের কাছে কী একটা লম্বাটে জিনিস চাঁদের আলোতে চকচক করছে। তুলে নিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে দেখেন কুচকুচে কালো একটি পালক। তার মাঝখানে একটা চওড়া সাদা ডোরা কাটা মুখের দিকটা একটু ছুঁচলো মতন একটু ছেঁটে নিলেই খাসা এক খাগের কলম।
“কলমটা হাতে নিতেই হাতের আঙুলগুলো কেমন চিড়চিড় করে উঠল। ঠাকুরদা আর থাকতে না পেরে ঠাকুমার আলতার শিশি আর ধাপার হিসেবের খাতা নিয়ে বসে পড়লেন। আর সেই অদ্ভুত কলমটি, বিশ্বাস করিস আর নাই করিস, অনবরত কী যে মাথামুন্ডু লিখে যেতে লাগল, পড়ে তো ঠাকুরদার নিজেরই চুল-দাড়ি খাড়া হয়ে উঠল।”
এই অবধি শুনে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে বললাম, “কেন? চুল-দাড়ি খাড়া হবে কেন?”
“আরে, সে যে দাঁড়াল গিয়ে একটা ভূতের গল্প, যা পড়লে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়! আমার ঠাকুরদা নিজের লেখা নিজে পড়ে প্রথমটা থ মেরে গেলেন। পরে বুঝলেন ধর্না দেওয়ার ফল ধরেছে। সারাদিন ঘরে বসে গল্পটা মুখস্থ করে ফেললেন, তার পর সন্ধ্যা লাগতে সেজেগুজে রাজসভায় গিয়ে হাজির হলেন।
“দেখেন গিয়ে, সেই ব্যাটা হাত-পা নেড়ে দাঁত বের করে গান ধরেছে, আর লোকগুলো সব হাঁ করে তাই শুনছে আর বাহবা দিচ্ছে।
“ঠাকুরদা সভায় ঢুকতেই সঙ্গে-সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া এসে ঝাড়লণ্ঠনটার অনেকগুলো আলো নিবিয়ে দিল। গানও তক্ষুনি থেমে গেল, সভাও থমথমে চুপচাপ হয়ে গেল। আর ঠাকুরদা রাজার সামনে এসে সিংহাসনের সিঁড়ির ধাপে বসে নিচু গলায় ভূতের গল্প শুরু করলেন। দেখতে-দেখতে সভাসদরা যে-যার আসন ছেড়ে ঠাকুরদাকে ঘিরে বসল। কবি ছোকরা তো পাঁচজনকে সরিয়ে দিয়ে সবচেয়ে কাছে এসে ঘেঁষে বসল। ঠাকুরদা অর্ধেকটা বলে থেমে গেলেন। কবি ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘তার পর?’ রাজা বললেন, ‘তার পর?’ সভাসুদ্ধ সকলে বলল, ‘তার পর?’
“গল্প শেষ করে ঠাকুরদা হাত জোড় করে বললেন, “মহারাজ, এবার আমায় বিদায় দিন। এখানে খেতে পাই নে, ভিনগাঁয়ে দেখি গিয়ে চেষ্টা করে।’ রাজা কিছু বলবার আগেই কবি বললে, ‘না, না, সেকী! তা হলে আমাদের ভূতের গল্প কে বলবে? এই নাও আমার মনিব্যাগটা নাও’, দেখতে-দেখতে সভার লোকরা ভিড় করে যে-যা পারে ঠাকুরদার হাতে গুঁজে দিতে লাগল। ঠাকুরদা সে-সব চাদরে বেঁধে বাড়ি গিয়ে সকাল-বেলায় সব ধার-টার শোধ করে দিলেন।
“তার পর আবার সেই খাগের কলমে হাত দিয়েছেন কী, আবার আঙুল চিড়বিড় করে আবার সেইরকম লেখা বেরুতে লাগল। এমনি করে ঠাকুরদা এক বছর ধরে তিনশো পঁয়ষট্টিটা ভূতের গল্প লিখে ফেলেছিলেন। আর ঘরের মধ্যে টাকার পাহাড় জমিয়ে ফেলেছিলেন। তাই দিয়েই তো বাড়ি-ঘর, জমি-জমা, গোরু-বাছুর, ক্ষেত-খামার সব হয়েছিল। তাই থেকেই তো তোরা সব দিব্যি মজা লুটছিস।”
আমরা বললাম, “তার পর উনি থেমে গেলেন কেন? মরে গেলেন বুঝি?”
ছোটঠাকুরদা বিরক্ত হয়ে বললেন, “মোটেই মরেননি! তোরা বললেই ওঁকে মরে যেতে হবে নাকি? মরেন-টরেননি। তবে এক বছর বাদে একদিন পুরনো পুকুরে স্নান করতে গিয়ে দেখেন এই মোটা একটা কালো পাতিহাঁস চান সেরে পাড়ে উঠে পালক সাফ করছে, আর ঠোঁটের খোঁচা খেয়ে এত বড়-বড় কালো পালক এদিক-ওদিকে পড়ে যাচ্ছে, তার প্রত্যেকটাতে একটা করে চওড়া সাদা দাগ আর মুখটা কেমন ছুঁচলো ধরনের, একটু ছেঁটে নিলেই খাসা কাগের কলম।
“তাই দেখে ঠাকুরদা ঘরে গিয়ে সিন্দুক থেকে নিজের খাগের কলমটা নিয়ে এসে মিলিয়ে দেখলেন হুবহু এক, একেবারে বেমালুম মিলে গেল! এমনি মিলে গেল যে কোনটা নিজের পালক তা একদম আর চেনাই গেল না! এক ফোঁটা লাল আলতাও তাতে লেগেছিল না। রোজ তাকে এত যত্ন করে পরিষ্কার করা হত।
“ব্যস গল্প লেখা বন্ধ হল, ঠাকুরদাও পেনসিল নিলেন। কিন্তু তদ্দিনে তাঁর অবস্থাও ফিরে গেছে, চিন্তাও ঘুচে গেছে। শেষ বয়সটা দিব্যি আরামেই কাটল। ঐ গল্পগুলোর কতক-কতক হারিয়ে গেছে, কিন্তু ধোপার খাতায় লেখা প্রথম পঞ্চাশটি আমার কাছে আছে। আমার কথা মতো চলিস যদি, মাঝে মাঝে এক-আধটা শোনাতে পারি।
“ছোটঠাকুরদা মারা যাবার আগে আমার উপর খুশি হয়ে ঐ খাতাটা আমাকে দিয়ে গেছেন। এখন ওটি আমার কাছে আছে। তোমরাও যদি আমার কথা মতো চলো তো মাঝে-মাঝে এক-আধটা শোনাতে পারি।”