4 of 8

খাওয়া-দাওয়া

খাওয়া-দাওয়া

সুহৃদপ্রতিম শ্রীযুক্ত সমর নাগ আমাকে একটি বিজয়ার শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন, যেমন পাঠিয়ে থাকেন প্রতি বছর। শ্রীযুক্ত নাগ খ্যাতনামা শিল্পোদ্যোগী এবং বাস্তুকার। আমার ভিটেবাড়িটি তাঁরই রচনা।

তিনি তাঁর শুভেচ্ছাবার্তায় লিখেছেন, ‘আশা করি বহুকাঙিক্ষত শারদাবকাশের দিনগুলি বাংলা গান/সাহিত্য, বেহিসেবি-খাওয়া-দাওয়া…ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে রম্য হয়ে উঠেছিল।’…

পুজোর সময় একটু বেহিসেবি খাওয়া-দাওয়া হয়েই থাকে। বৎসরান্তে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, গল্পগুজব আড্ডা হয়।

যে কোনও সরেস আড্ডা মানেই অনেকটা পান-ভোজন। যাঁরা সারা বছর পান করেন না, অথবা নিয়মিত পান করেন না, এই পুজোর কয়দিন আড্ডার মৌতাতে তাঁরাও কেউ কেউ পান করেন, ভালই পান করেন। অনেক গৃহিণী তথা অভিভাবক পুজোর কয়দিন এহেন কাজে কোনও দোষ ধরেন না।

কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ে, অনেকটা অনুরোধে এবং প্রধানত সঙ্গদোষে, দলে পড়ে পুজোর সময়টায় খাওয়া-দাওয়ার অনাচার ঘটে।

এর মধ্যে স্মৃতিদেবীরও অনেকটা দায়িত্ব আছে। সাদা মেঘের সঙ্গে মনে ফিরে আসে বাল্য ও কৈশোরের দিন।

উঠোনের একপাশে বড় মাটির উনুন করে দিনরাত মুড়ি ভাজা হচ্ছে, খই ভাজা হচ্ছে। ঢেঁকিতে চিড়ে কোটা হচ্ছে। চাল কোটা হচ্ছে। গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। মোয়া তৈরি হবে। কতরকমের মোয়া। মুড়ির মোয়া, চিড়ের মোয়া, খইয়ের মোয়া। মুড়কি।

কারও কি এখনও মনে আছে ঢ্যাপের মোয়া। ঢ্যাপ আর এইচা হল শালক ও পদ্মের বিচি। সেই বিচি কচিয়ে খই ভাজা হত। গোল গোল সাদা খই, হোমিওপ্যাথিক বড়ির থেকে সামান্য বড় আকারের। ঢ্যাপের থেকে এইচার খই একটু বড়।

আর নাড়ু? তিলের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, ডালের গুঁড়োর নাড়ু, এমনকী মুড়িগুঁড়োর নাড়ু।

এ ছাড়া রয়েছে দই, সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতুয়া, চমচম ইত্যাদির সমারোহ। ক্ষীর, পায়েস।

মাছের কথা বলে শেষ করা যাবে না। পুঁটি থেকে রুই, আড়, চিতল, কই-মাগুর, বিজয়া দশমীর জোড়া ইলিশ। কোনওটা লঙ্কাপোড়া ঝোল, কোনওটা সরষে বাটা কিংবা ভাপা। ঝাল-ঝোল বা চচ্চড়ি।

সেসব খাবার তো এখন আর সহজলভ্য নয়। খাওয়াই হয় না।

তখনকার অতিভোজন খাদ্যগুণে খুব একটা অস্বাস্থ্যকর ছিল না। কিন্তু এখন তো সেই প্যাকেটের বিরিয়ানি, মাংসের কোর্মা বা কালিয়া। তেল ঝাল, মশলার কাই।

এখন আবার হয়েছে ফাস্ট ফুড। এগ রোল, চিকেন চওমিন। সস্তার সস দিয়ে মুখরোচক চটজলদি খাবার। বড়জোর অতীত দিনের মোগলাই পরোটা ও কষামাংস কিংবা ঢাকাই পরোটা ও ছোলার ডাল। স্বাদে গন্ধে এ সবেরও যথেষ্ট অবনতি হয়েছে।

কিন্তু এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। এই রকমই হয়।

তার থেকে দুটো পুরনো দিনের ভোজনবীরের কাহিনী বলি।

তবে তার আগে একটু তত্ত্বকথা। খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারটা কী সেটা একটু আলোচনা করি।

যেমন খেলাধুলা, তেমনই খাওয়া-দাওয়া।

খেলতে গেলে যেমন গায়ে একটু ধুলো লাগবেই। সেই রকমই তেমন তেমন খাওয়া হলে দাওয়াতেই পড়ে থাকতে হবে, উঠে দাঁড়ানোর সাধ্য হবে না।

আমার এক প্রতিবেশী বললেন, ‘আগে লোকে দাওয়ায়, মানে বাড়ির উঠোনে ভোজের আয়োজন করত, অনেক সংসারে আবার দাওয়াতেই খাওয়া হত। সেই থেকে খাওয়া-দাওয়া শব্দটি তৈরি হয়েছে।

সে যা হোক আমরা এত কচকচিতে যাব না।

সুকুমার রায় ‘খাই খাই’ লিখেছিলেন। তাতে দীর্ঘ ভোজনতালিকা দেওয়া আছে। তার থেকে আলাদা আমার নিজস্ব পছন্দের কথাগুলি লিখে রাখি।

সজনে ডাঁটা চচ্চড়ি, লাউ চিংড়ি, মুড়িঘন্ট, সরষে বাটা ইলিশ মাছের ঝোল, ঘি-গরম মশলা দেওয়া পেঁয়াজ ও রসুন ছাড়া কালীপুজোর রান্নার মতো মাংসের হালকা ঝোল, পুঁটি মাছের টক, টক দই।

খুব ভালবাসি মাছের তেলের বড়া, পাঁপড় ভাজা, মৌরলা মাছের ঝাল চচ্চড়ি, প্রন বল। আড় মাছ, মাগুর মাছ ভালবাসি।

কেউ যদি নিমন্ত্রণ করতে চান এসব মনে রাখবেন।

আর কী লিখব?

পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবার দুই ভোজনরসিকের গল্প বলি। অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এই দুটি সুপ্রাচীন গল্প না বললে এ রচনা সম্পূর্ণ হবে না।

অতুলনীয় সুনির্মল বসু তাঁর কবিতায় একটি গল্প নবীন পাঠক-পাঠিকাদের চমৎকার উপহার দিয়ে গেছেন।

গল্পটি অসামান্য। একটু আমার মতো করে বলি।

সেই এক পুরনো দিনের ভোজবাড়ি। নিমন্ত্রিতেরা সারি বেঁধে পাত পেড়ে খাচ্ছে। অবাধ খাওয়া-দাওয়া। মাছ-মাংস, লুচি-পোলাও, দই-মিষ্টি।

জনৈক ভোক্তা সেই সুক্তো, চচ্চড়ি, ছ্যাঁচড়া থেকে অবিরাম খেয়ে যাচ্ছেন। মাছ-মাংস তরকারি-মুড়িঘণ্ট দু’-এক কিস্তিতে তাঁর পোষাচ্ছে না। সেই সঙ্গে অনুরূপ সাদা ভাত, লুচি কিংবা পোলাও।

এর পরেও আছে দই ও মিষ্টি। এক হাঁড়ি দই, মনে রাখতে হবে আড়াই সেরের হাঁড়ি সেই সঙ্গে প্রমাণ সাইজের দশটি রসগোল্লা আর আটটি পানতুয়া খেয়ে ধুতির কষি ঢিলে দিতে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে নিজের পাতের ওপরে গড়িয়ে পড়লেন।

দশজন লোক ধরাধরি করে তাকে নিয়ে বারান্দায় চিত করে শুইয়ে দিল, শালপাতার পাখা দিয়ে তার মুখে মাথায় এবং স্ফীতোদরে দু’জন ব্যক্তি হাওয়া করতে লাগল, মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হল, ডাক্তার-বৈদ্যকে তলব করা হল কিন্তু সংজ্ঞাহীন ওই ভোজন রসিকের জ্ঞান আর ফেরে না।

অবশেষে তিনি পাশ ফিরে শোয়াতে একটু আশার সঞ্চার হল। ডাক্তারবাবু তাঁর কানের কাছে গিয়ে ‘এখন কেমন বোধ করছেন?’ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি ‘হুঁ হঁ’ করলেন।

তখন ডাক্তারবাবু তাঁর ব্যাগ খুলে দুটো হজমি গুলি বার করে তাঁকে বললেন, ‘একটু হাঁ করুন, এই ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নিন, আরাম হবে।’

ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না’। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘যদি দুটো ট্যাবলেটের জায়গা পেটে থাকত তা হলে আরও একটা পানতুয়া খেতাম।’

দ্বিতীয় কাহিনীটি প্রায় এই রকমই।

এখানেও সেই ভোজের আসর। সেই ভোজনবীরের গল্প।

ভোজনবীর একটু দেরি করে ভোজবাড়িতে এসেছিলেন। তাঁর আসার আগেই প্রথম ব্যাচ বসে গেছে। যেমন হয়, ইনি ভাবলেন যা কিছু ভাল খাবার বোধ হয় প্রথম ব্যাচের লোকেরাই খেয়ে ফেলল।

পরের ব্যাচে খেতে বসে তিনি কিছু কম খেলেন না। খেতে খেতে পেট ফুলে জয়ঢ়াক, আগের গল্পের লোকটির মতোই ইনি সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

কাছেই এক নদী ছিল। পাড়ার কোবরেজ মশায় বললেন, ‘নদীর চড়ায় নিয়ে চিত করে শুইয়ে দিন। খোলা বাতাসে একটু আরাম হবে। কোনও ভয় নেই, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উপশম হয়ে যাবে।’

নদীর ধারে বালির ওপরে ভোজনবীরকে শুইয়ে দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরলেন। কিছুক্ষণ পর নদীর স্নিগ্ধ বাতাসে তাঁর অল্প জ্ঞান ফিরল।

এর মধ্যে হয়েছে কী, নদীর স্রোতে একটা পেট-ফোলা মরা গোরু ভাসতে ভাসতে ভোজনবীরের পাশে এসে উঠেছে। জ্ঞান ফিরতে হাত ছড়াতে গিয়ে ভোজনবীরের হাত পড়ল মরা গোরুর ফোলা পেটে। একটু হাত বুলিয়ে ফোলা পেটের বিশাল উচ্চতা অনুভব করে ভোজনবীর স্বগতোক্তি করলেন, ‘ইনি নিশ্চয় আমার আগের ব্যাচে বসেছিলেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *