খাঁটি ভারতীয় রান্না

খাঁটি ভারতীয় রান্না

খিচুড়িবিলাস

শুঁটির খিচুড়ি করে খেয়েছে যে জন।
ভুলিতে না পারে আর তার আস্বাদন।।
এই শীতে মুগের খিচুড়ি যেই খায়।
সে জন ভোজনে আর কিছুই না চায়।।

লিখেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। বর্ষাকাল এলেই বাঙালির নোলা খিচুড়ির জন্য সকসক করে উঠবেই। ঠিক এই জায়গায় আর-একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। না দিলে কাব্যলক্ষ্মী পাপ দেবেন। বাঙালির বাদলদিনকে এত ভালোভাবে রবি ঠাকুরের পরে আর কেউ ফুটিয়ে তুলেছেন কি না জানি না, আর তাতেও খিচুড়ি এসেছে অনিবার্যভাবেই।

বাদরিয়া ঘেরি আয়ি চারহু ঔর কারি
দোদুল ঘরের মাঝে সঘন মশারি
দোদুল গঙ্গামধ্যে ইলিশের নাও
খিচুড়ি চাপাও বঁধু খিচুড়ি চাপাও
দোদুল কদম্বশাখে ঝুলা শ্যামরাই
বস্তির পিছনমাঠে কয়েক লখাই
কয়েক বিন্তির সাথে খেলা করে, গায়
এমন বাদলবাটে কে ঝুলিবি আয়
দোলে পথ শূন্য আড্ডা আন্ডাবাচ্ছা নিয়ে
রোয়াকে উঠেছে নেড়ি। ঝাঁপ ফেলে দিয়ে
দোকানি ঘরের পথে। দোলে নৌকাটিতে
কুমোরটুলির ঘাটে মা দুগ্গা মাটিতে
ওপরে নিভন্ত চুল্লি চিমনি সারি সারি
ঘেরি আয়ি বাদরিয়া চারহু ঔর কারি
(প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়)

কবিতা থেকে একটু বাস্তবে আসি। যতই নাচানাচি করি, খিচুড়ি কিন্তু বাঙালির একচেটিয়া না। গোটা এশিয়ায় এর প্রচলন ভালোই আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে এ প্রিয় খাদ্যবস্তুটির প্রচলন সেই প্রাচীন যুগ থেকে। এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বেদে, ক্ষীরিকা নামে, যা হল চাল ও ডালের একটা সহজপক্ব খাদ্য। সংস্কৃতে খিচুড়ির আরও একটা নাম হল খিচ্ছা, যার অর্থ হল চাল আর ডাল দিয়ে বানানো খাবার। আবার প্রাচীন গ্রন্থগুলোয় এর উল্লেখ থাকে কখনও কৃসারান্ন নামে; অর্থাৎ চালের সঙ্গে মুগ ডাল, দই, আর তিল মিশিয়ে ঘিতে রান্না করা অন্ন। মহাভারতের গল্পে আমরা পাই যে এককণা অন্ন ভক্ষণ করে কৃষ্ণ উদ্গার করেছিলেন— যা দ্বারা ঋষি দুর্বাসার উদর পূর্ণ হয়ে যায় এবং দ্রৌপদী তাঁর ক্রোধ থেকে উদ্ধার পান, তা কিন্তু ছিল চাল আর ডালের মিশ্রিত অন্ন— অর্থাৎ খিচুড়ি। কৃষ্ণ-সুদামার উপাখ্যানে আমরা দেখি যে কৃষ্ণর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় সুদামা সঙ্গে নিয়েছিলেন দুটো হাঁড়ি, যার একটাতে ছিল খিচুড়ি (যেটা রাস্তায় বাঁদরে কেড়ে নেয়) আর অন্যটায় ছিল ভাজা ছোলা (যেটা কৃষ্ণ উপহারস্বরূপ পান তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে)। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতানুযায়ী, ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের উপমহাদেশে চাল ও ডাল (ছোলার ডাল, মটর ডাল, মটরশুঁটি ও মুসুর ডাল) একসঙ্গে খাওয়ার রীতি ছিল; আবার চাল আর ডাল আলাদা করে খাওয়ারও প্রচলন ছিল সেসময়। ২০১৫ সালে মহারাষ্ট্রের ‘তের’ গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় পাওয়া যায় দুটো হাঁড়িভর্তি পোড়া চালের সঙ্গে মুগ ডাল মেশানো খিচুড়ি, যা রান্না হয়েছিল প্রথম খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ সামনে হাজির ২০০০ বছরের পুরোনো খিচুড়ি, অবশ্য যিনি রান্না করেছিলেন, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সেটা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে (৩২১-২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) চাল-ডালের মিশ্রণে খিচুড়ি খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় চাণক্যের লেখায়। সেখানে একটা বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে একদিন রাজা শিকার শেষে আশ্রয় নেন এক গরিবের বাড়িতে এবং সেখানে গৃহকর্ত্রী গরম খিচুড়ির থালা সামনে পরিবেশন করামাত্র বাড়ির ছোটো ছেলেটি তাতে তড়িঘড়ি আঙুল ডুবিয়ে আঙুলটি পুড়িয়ে ফ্যালে। আহারের বর্ণনায় চাণক্য লিখেছেন যে এক প্রস্থ চাল, সিকি প্রস্থ ডাল, ১/৬২ প্রস্থ নুন ও ১/১৬ প্রস্থ ঘি দিয়ে তৈরি অন্ন হল গৃহস্থ বাড়ির সবচেয়ে সুষম আহার। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখায়ও আমরা পাই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর রাজবাড়ির রান্নাঘরে চাল আর ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি রান্নার বর্ণনা। ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে পারস্য দেশের পণ্ডিত ও পরিব্রাজক আলবিরুনির লেখায়ও আমরা ভারতে খিচুড়ির প্রচলনের উল্লেখ পাই। আবার চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি মরক্কোর পরিব্রাজক ইবন বতুতা তাঁর লেখায় বলেছেন, ভারতের অন্যতম প্রিয় সকালের জলখাবার হল খিচুড়ি; বিশেষ করে গরিবদের মধ্যে চাল আর মুগের ডাল ঘি দিয়ে রান্না করার খুব চল ছিল সেই সময়। পঞ্চদশ শতাব্দীর রুশ পরিব্রাজক নিকিতিনের লেখা পড়ে আমরা জানতে পারি যে দক্ষিণ ভারতেও সেসময় চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার প্রচলন ছিল। এর দুশো বছর বাদে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের জানিয়েছিলেন যে তখন ভারতে সন্ধ্যার খাবার হিসেবে খিচুড়ি (সবুজ মুসুরির ডাল দিয়ে রান্না করা) খাওয়ার রীতি প্রায় সব বাড়িতেই ছিল।

ধনাঢ্য মোগল সম্রাটরাও কিন্তু এ খিচুড়িকে অবহেলা করেননি। এ সামান্য খাদ্যবস্তুটি ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম। বিশেষত তিনি ভালোবাসতেন প্রচুর মশলা, পেস্তা আর কিশমিশ মেশানো গুজরাটি খিচুড়ি। জাহাঙ্গীর এতটাই ভালোবাসতেন খিচুড়ি খেতে যে তিনি এর নতুন নামকরণ করেন লাজেইজান, অর্থাৎ পরম উপাদেয়। তাঁর পিতা সম্রাট আকবরও খিচুড়ি খেতে ভালোবাসতেন। আওরঙ্গজেবের প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’-তে আবার চাল আর ডালের সঙ্গে মেশানো হত নানা ধরনের ডিম আর মাছ। মোগলদের সময় নানাধরনের খিচুড়ির চল শুরু হয়ে গিয়েছিল সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতেও। যেমন চালের বদলে অনেকসময়ই বাজরা ব্যবহার হত, আর ডালের বদলে মটরশুঁটি। মোগলদের রাজবাড়ির রান্নাঘরে নানা খিচুড়ির কথা বলেছেন ঐতিহাসিক আবুল ফজল এবং আইন-ই-আকবরীতে কিছু কিছু খিচুড়ির রন্ধনপ্রণালীও বর্ণনা করেছেন। গাছের মগডালে হাঁড়ি ঝুলিয়ে নিচে খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে আকবর বাদশাহকে জব্দ করার সেই গল্পে হাঁড়ির ভেতর তো খিচুড়িই ছিল! একই গল্প অবশ্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়ের সংস্করণেও প্রচলিত। গল্পের মানুষেরা বদলে গেলেও হাঁড়ির খিচুড়ি কিন্তু বদলায়নি!

হায়দরাবাদ নিজামরাও পিছিয়ে থাকেননি। তাঁদের হেঁশেলেও খিচুড়ি দখল করে নিয়েছিল উচ্চস্থান। আবার উনিশ শতকে ভারতের এ অতিপ্রচলিত খাদ্যবস্তুটি ইংল্যান্ডে হাজির করেছিল ব্রিটিশরা। ডিম আর কড মাছ মিশিয়ে ইংল্যান্ডেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খিচুড়ি, তবে প্রাতরাশ হিসেবে কেজেরি নাম নিয়ে।

ভারতের নানা প্রদেশে নানা ধরনের খিচুড়ি রান্না হয়; যেমন জম্মু ও কাশ্মীরের খিচুড়ি তৈরি হয় চাল, ডাল, গরম মশলা আর আচার দিয়ে। এ খিচুড়ি ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় আরাধ্য দেবতাকে, ‘খেতসিমহাভাস’ উৎসবের সময়, যা ডিসেম্বরে পালন হয় আর খাওয়া হয় ওলকপির আচার দিয়ে। হিমাচলপ্রদেশের খিচুড়ির নাম হল বালাই— রান্না হয় চাল, ছোলা, ঘোল, ধনে, জিরা, আর মেথি দিয়ে। উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়ালি খিচুড়ি হয় চাল, কলাইয়ের ডাল, তিল, আর গরম মশলা দিয়ে। দক্ষিণ ভারতে হায়দরাবাদের নিজামরা নিয়ে আসেন কিমার খিচুড়ি, যাতে থাকত চাল, ডাল, মাংসের কিমা আর সঙ্গে দেওয়া হত টক ঝোলের মতো ‘খাট্টা।’ মহীশূরের ‘ওডেয়ার’ রাজবংশ কর্নাটকে শুরু করে ‘বিসিবেলে-ভাত’, যাতে থাকে ভাত, ডাল, সবজি, এলাচ, লবঙ্গ, ধনে, জিরে, মেথি ও শুকনো নারকেলের টুকরো। তামিলনাড়ুতে তিন রকমের খিচুড়ি হয়: ‘খাড়া পোঙ্গল’, ঝাল দেওয়া ‘মিলাগু পোঙ্গল’ ও গুড় মেশানো মিষ্টি ‘সাক্কারাই পোঙ্গল।’ কেরালার খিচুড়িতে থাকে ভাত, মুগ ডাল, নারকেল আর বাদাম। পশ্চিম ভারতের দিকে দেখলে দেখা যাবে, গুজরাটের ঝাল খিচুড়িতে থাকে চাল আর ডালের সঙ্গে অনেক রকমের সবজি (রাম খিচুড়ি), যা খেতে হয় দইয়ের কারহি দিয়ে। গুজরাটে একসময় একটা হালকা খিচুড়ি পাওয়া যেত, যার নাম ছিল ‘সোলা খিচুড়ি’ আর তাতে থাকত কিমা আর ঘন ক্রিম। মহারাষ্ট্রের টক-টক খিচুড়িতে থাকে ভাত আর মটরশুঁটির সঙ্গে চিনাবাদাম, কাজুবাদাম আর নারকেলকোরা। রাজস্থানের খিচুড়ি অনেকটা গুজরাটি খিচুড়ির মতো— ঝাল সামান্য কম ও চালের বদলে থাকে বাজরা অথবা গম। আবার মকরসংক্রান্তির সময় গুজরাট আর রাজস্থান উভয়ের খিচুড়িতেই থাকে বিউলির ডাল। উত্তরপ্রদেশের খিচুড়ি রান্না হয় চাল ও কালো ছোলা দিয়ে আর তাতে থাকে আমলা ফল; এটা মকরসংক্রান্তির সময় ওখানকার প্রধান খাবার।

বাঙালিরও অন্যতম প্রিয় খাদ্য হল খিচুড়ি। সবচেয়ে সোজা বানানো, দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে শুধু একমুঠো চাল আর একমুঠো ডাল— সঙ্গে নুন, হলুদ, লংকা, ধনে, জিরে আর অল্প চিনি দিয়ে হাঁড়িতে বা প্রেশার কুকারে চাপালেই হয়ে যায় খিচুড়ি। বাঙালিদের অবশ্য শুধু খিচুড়িতে হয় না, তার সঙ্গে থাকে মাছভাজা (ইলিশ মাছ হলে তো আর কথাই নেই) বা ডিমভাজা। আর থাকে নানারকমের সবজি ভাজা, যেমন— বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, আলু ভাজা কিংবা বেসন দিয়ে ভাজা বেগুন (বেগুনি), কুমড়ো (কুমড়ি) বা ফুলকপি (ফুলুরি)। বাংলার রান্নায় নানা ধরনের খিচুড়ি দেখা যায়— তিলের খিচুড়ি থেকে শুরু করে মুগের খিচুড়ি, মসুরের খিচুড়ি, মটর ডালের খিচুড়ি, ভাজা মুগের খিচুড়ি, অড়হর ডালের খিচুড়ি, কড়াইশুঁটির খিচুড়ি, পাঁচমিশালি খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি, ছোলার ডালের খিচুড়ি, মাছের মাথা দেয়া খিচুড়ি, চিংড়ি দেয়া খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি আর ক্রিম দেওয়া মিষ্টি খেজুরের খিচুড়ি। বাঙালির খিচুড়িপ্রীতি মাথায় রেখে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর বিখ্যাত রান্নার বইয়ে লিখেছিলেন, ‘সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেই রূপ আনুষঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে।’ খিচুড়ির এ আনুষঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনও প্রধান হল ইলিশ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়ই বাঙালির অন্যতম প্রিয়।

খিচুড়ি

শেষে শুধু বলে রাখি খিচুড়ির সঙ্গে যে পাঁপড় ভাজা, তাকে ইংরাজিতে বলে পোপাডম। ১৯০৩ সালে ইংরাজি ভাষায় আসা এই শব্দটার মূলে কিন্তু আছে সংস্কৃত পর্পট, যার মানে চ্যাটালো থালার মতো। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন তামিল শব্দ পোরুপ্পু বা ডাল থেকে নাকি এই পোপাডম এসেছে। বিতর্ক চলুক, আমরা বরং টাং টুইস্টার খেলি, ‘কাচ্চা পাঁপড়, পাক্কা পাঁপড়… কাচ্চা পাঁপড়, পাক্কা পাঁপড়… কাচ্চা পাঁপড়, পাক্কা পাঁপড়…’

ডালে ডালে

সিন্ধু সভ্যতায়ও নাগরিকরা ডাল খেতেন, সেই প্রমাণ মিলেছে। ফারমানায় বিস্তৃত হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে মটর ডাল, ছোলার ডাল, তুরের ডাল মিলেছে। ওই অংশটি হরিয়ানার ঘাগ্গার উপত্যকায় অবস্থিত। তারপর ধীরে ধীরে প্রাচীন ভারতে বিত্তশালীরা বৈভব প্রদর্শনের জন্য ডাল খেতেন এবং খাওয়াতেন। তখন কিন্তু আজকের মতো ঘরে ঘরে রোজ ডাল খাওয়া হত না। সময়টা খ্রিস্টজন্মের ৩০৩ বছর আগে। ভারতে তখন শাসন করছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। নিজের বিয়েতে অতিথিদের জন্য খাবারের ঢালাও আয়োজন করেছিলেন। সেই ভোজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঘুগনি। হ্যাঁ, আজও পূর্ব ভারতে দারুণ জনপ্রিয় সেই ঘুগনি। মধ্যযুগে আমদানি হল দমে রান্নার শৈলী। যাকে বলে দমপুখত। ঢিমে আঁচে রান্না করা সেই ডালের স্বাদে মজলেন মোঘল বাদশাহরাও। সব ডালের মধ্যে চানার ডাল ছিল তাঁদের অত্যন্ত প্রিয়। শোনা যায়, রোজ দু-বেলা চানা ডাল না পেলে রাঁধুনির গলা কাটতে যেতেন তাঁরা। আকবরের মহারানি যোধাবাই নাকি এমন ‘পাঁচমেল ডাল’ রাঁধতেন যে তার সুগন্ধ গোটা প্রাসাদে ছড়িয়ে পড়ত। শাহজাহানের আমলে সেই পাঁচমেল ডালে আরও কিছু উপকরণ যোগ হয়। নাম হয় শাহি পাঁচমেল ডাল। শাহজাহানের তৃতীয় ছেলে মোরাদ রান্না নিয়ে নিত্যনতুন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। এভাবেই মুগ ডালের অনবদ্য এক পদ রেঁধে ফেলেন তিনি, যা আজও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঢিমে আঁচে বসিয়ে রান্না করেন মুগ ডাল। সঙ্গে মেশান পেঁয়াজ, আমচুর এবং কাঁচালংকা। তাঁর নামে ডালের নাম হয় মোরাদাবাদি ডাল।

এক এক অঞ্চলে এই ডাল ধীরে ধীরে নিজের ভোল পালটাতে থাকে। গুজরাটে এই ডাল বেটে নিত্যনতুন পদ তৈরি করা হতে থাকে। যেমন বড়া, পাকোড়া, খাণ্ডভি। বাংলায় আবার এই ডালে পড়ে ফোড়ন। কখনও পাঁচফোড়ন, কখনও কালো জিরে, কখনও রাঁধুনি। হায়দরাবাদিরা এই ডালের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে বানিয়ে ফেলেছেন ডাল গোস্ত। ঐতিহাসিকদের মতে, বিভিন্ন যুগে সম্রাট-বাদশাহদের জিভকে তুষ্ট করতেই ডাল রান্নার পদ্ধতিতে হেরফের করা হয়েছে। তার জেরে বদলে গেছে স্বাদ। শোনা যায় আটাতে উটের দুধ আর ঘি মিশিয়ে ছোটো ছোটো মণ্ড তৈরি করতেন রাজস্থানের রাজপুত বাপ্পাদিত্যের সৈন্যরা। সারাদিন গরম বালিতে রেখে তাপ দেওয়া হত। সেগুলো শক্ত খটখটে হয়ে গেলে তাতে পাঁচমেল ডাল মিশিয়ে বা ঘি দিয়ে ডুবিয়ে খেত তারা। নাম ছিল ডাল বাটি। একবার এক রাঁধুনি অসাবধানে তাতে চিনির রস ফেলে দিলে তৈরি হয়ে গেল এখন বিশ্বখ্যাত ডাল বাটি চুরমা।

ছবি- পূর্ণেন্দু পত্রী
ছবি- পূর্ণেন্দু পত্রী

‘খানাতল্লাশি’ বইতে ডাল নিয়ে দারুণ এক গল্প আছে। সেটা বলেই শেষ করব। ওস্তাদ কারিগরেরা নাকি এই ডাল একশোরও বেশি স্বাদে রান্না করতে পারতেন। তাই ডালের নামী শেফদের দাম আর মেজাজ ছিল আকাশছোঁয়া। নবাব আসফউদ্দৌলা সেই সময় পাঁচশো টাকা মাসমাইনেতে এক ডালের রাঁধুনিকে নিয়োগ করেন! রাঁধুনি আবার শর্ত দিয়েছিল, নবাবের ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে আগের দিন জানাতে হবে, আর ডাল তৈরি হয়েছে খবর পাওয়া মাত্র নবাব এসে দস্তরখানে বসবেন। একদিন আসফউদ্দৌলা ডাল খেতে চাইলেন, এবং পরের দিন শেফ গিয়ে যথাসময়ে খবর দিল— খানা তৈরি। নবাব তখন সভায় ভারী ব্যস্ত, তাই তিনবার খবর দেওয়াতেও এলেন না। অবশেষে যখন এলেন, সেই শেফ রান্না করা সমস্ত ডাল নিয়ে হুড়হুড় করে একটা শুকনো গাছের তলায় ঢেলে দিল, আর তক্ষুনি কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেল।

ইডলির ইতিকথা

তামিলনাডু না, আরব দেশে ইডলির জন্ম। মিশরে আরব বণিকরা যখন পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করলেন, তখনই ইডলি ঢুকে পড়ে নীল নদের দেশে। হজরত মহম্মদ বেঁচে থাকতেই সদ্য ইসলাম ধর্ম নেওয়া আরব বণিকরা মিশরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন— সেখান থেকেই এ দেশেও এসে পৌঁছোন। এই নব্য ইসলামধর্মী বণিকেরা খাবারের ব্যাপারে খুবই গোঁড়া ছিলেন। হালাল করা ছাড়া মাংস ছুঁতেনই না। তার ওপর এ দেশের খাবার তাঁদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। তাই ভেজ খাওয়া বেছে নিয়েছিলেন। দুইবেলা ভাতের মণ্ড বানাতেন, আর তা কিছুটা চ্যাপটা করে নারকেলের চাটনি দিয়ে খেয়ে পেট ভরাতেন। সেখান থেকেই ইডলির উৎপত্তি। তবে অনেকের মতে ইডলির জন্ম ইন্দোনেশিয়ায়। সপক্ষে প্রমাণ আছে। একমাত্র সেখানেই নাকি চালের গুঁড়ো গেঁজিয়ে রান্নার প্রচলন একেবারে শুরু থেকে ছিল। হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণকথায় লিখেছিলেন, ভারতীয়রা ভাপে সেদ্ধ করে রাঁধতে জানত না। এদিকে এখনও ইন্দোনেশিয়ায় সয়াবিন, বাদাম, মাছ গেঁজিয়ে তৈরি হয় জনপ্রিয় খাবারের নাম কেডলি। অতএব বুঝে নিন। পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানতে পারলাম ‘ইডলির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৯২০ খ্রিস্টাব্দে কন্নড় ভাষায় শিবাকোটিআচার্যের লেখা ‘ভাদ্দারাদ্ধান’ পুথিতে। সেখানে আছে, কোনও মহিলার ঘরে ব্রহ্মচারী এলে ‘অষ্টাদশ দান-দ্রব্য’-এর যে নিয়ম ছিল, তাতে ইডলি-ও থাকত। দ্বিতীয় চাভুন্দার্য ১০২৫ সালে ইডলি তৈরির রেসিপিটা জানিয়েছিলেন। কলাইয়ের ডাল ঘোলে ভিজিয়ে মিহি করে বাটতে হবে। তাতে দইয়ের জল মিশিয়ে ধনে, জিরে, মরিচ আর হিং দিয়ে গোল গোল করে নিলেই ইডলি রেডি। ১১২৯ সালে লেখা সংস্কৃত পুথি ‘মানসোল্লাশ’-এ ইদ্দারিকা-র কথা আছে। বানানো হত কলাইয়ের ডালের ছোটো মণ্ডের সঙ্গে মরিচ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো আর হিং মিশিয়ে। তামিল দেশে ইডলিকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় অনেক পরে। আঠেরো শতকে লেখা ‘মাক্কাপুরাণম’-এ।’ সুতরাং উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন, ভারতীয়রা একে নিজেদের মতো করে খাঁটি ভারতীয় রান্না বানিয়ে ছেড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *