খাঁটির মর্যাদা

খাঁটির মর্যাদা

বঙ্কু আসিয়া উপস্থিত হইল। একটু যেন বেশি রকম প্রফুল্ল ভাব। এমনই কুকুর বেড়াল দুই চক্ষে দেখিতে পারে না, আজ অসিয়াই আমার জিমিটাকে টুসকি দিয়া শিস দেওয়ার চেষ্টা করিয়া নাচাইতে লাগিল। বলিল, জাতটা বড্ড নোংরা, নইলে মন্দ নয়, যদি কামড়াবার আর পাগল হওয়ার ভয় না থাকত; আর এই ঘাড়ে-ওঠা আর হাত-চাটা রোগ! যা যা, গেট অ্যাওয়ে।

বলিলাম, ব’স্; কি খবর বঙ্কু? আজ সকালে ছিলি কোথায় রে? তোর জন্যে আমরা সব ব’সেব’সে—ব’সে—

বঙ্কু বলিল, তোমাদের কি ভাই? দিব্যি খাচ্ছ-দাচ্ছ আর রাজা-উজির মেরে বেড়াচ্ছ, আগে পড় আমার মত ইয়ের পাল্লায়—। বলিয়া ছোট করিয়া একটু হাসিল।

এটা বঙ্কুর পেটেন্ট বুলি, সরল অর্থ হইতেছে—বিয়ে না করিয়া ভ্যাগাবন্ডের মত ঘুরিয়া বেড়াও তোমরা, আমার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা আর কি বুঝিবে বল?

ইহার পর সামান্য একটা সূত্র ধরিয়া টান দিলে বউয়ের কথা আসিয়া পড়ে। সেসব কায়দা-কানুন আমাদের সব জানা আছে। যখন বঙ্কুর মনটা বেশি রকম হৃষ্ট থাকে আমাদের কিছুই করিতে হয় না, নিজেই সূত্রটা ধরাইয়া দেয়।

সে-ই প্রশ্ন করিল, কই, চশমার কথা জিজ্ঞাসা করলি নি?

বলিলাম, হ্যাঁ, তাই তো জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম; কি হ’ল তোর চশমা বঙ্কু?

বউ ভেঙে দিয়েছে।—কথাটা বলিয়া এমন ভাবে ফিক করিয়া একটু হাসিল যে, বেশ বুঝা গেল, ব্যাপারটিতে বঙ্কু বেশ আনন্দ পাইয়াছে। শ্রোতার তরফ হইতে কোন রকম ঔৎসুক্য প্রকাশ না করিলেও চলিত, তবুও প্রশ্ন করিলাম, সত্যি নাকি? চোখে কোন রকম আঘাত লাগে নি তো?

বঙ্কু আবার হাসিল; বলিল, যদি লাগতই আঘাত, ধর যদি নেহাত চোখ দুটো যেতই তো কোর্টে তো আর নালিশ করতে যাওয়া যেত না। ভায়া, এ যে কি হ্যাঙ্গাম, তা তোমরা কি বুঝবে বল? নির্ঝঞ্ঝাট আছ, দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছ, হুঁঃ।

বলিতে লাগিল, পরশু বলে, আজ সিনেমা দেখতে চল। আমি সোজা ব’লে দিলাম, না। ও অভিনয় দেখা আমার ধাতে সয় না—থিয়েটারই হোক, সিনেমাই হোক আর মিলিটারি প্যারেডই হোক। যে যা নয়, সে তাই সেজে ন্যাকামি করবে, কিংবা ছোট হাজরি খেয়ে এসে গড়ের মাঠে নিরীহ বাঙালিদের দেখিয়ে দেখিয়ে ফাঁকা আওয়াজ দাগতে থাকবে, এসব তঞ্চকতায় যার মন ওঠে উঠুক, বঙ্কার ওঠে না। এর ওপর কোনো কথা আছে। নিকুঞ্জ ময়রাও অর্জুন নয়, ভৈরব তেলীর বখাটে ছেলে যতেও কিছু অভিমন্যু নয়, অথচ আসরে সেজেগুজে ভোল ফিরিয়ে কি বাহবাটাই না লুটছে! তোমরা যখন দেখছ নিকুঞ্জ অভিমন্যুর মৃত্যুতে ছেলের রূপগুণ ব্যাখ্যানা ক’রে হাপুস-নয়নে কাঁদছে আর খুলে যাওয়া গালপাট্টা এক হাতে চেপে অন্য হাত নেড়ে ভীষণ প্রতিহিংসা নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছে, আমি ততক্ষণে স্পষ্ট দেখছি, অভিমন্যু যতে সাজঘরে পরচুলাটা বগলে করে গাঁজায় দম মারছে। দেখার ভুলে তোমরা দাও বাহবা, আর আসল রূপটি মনশ্চক্ষের সামনে থাকে বলে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হয়। যতেকে যদি চিনতে তো বুঝতে পারতে, সপ্তরথীতে মিলে তাকে সাবাড় ক’রে পাড়ার কি উপকারটাই করেছে! অবশ্য যদি সত্যি সাবড়াতে পারত। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মেয়ে-পুরুষ মিলিয়ে দুশো লোকে তার মৃত্যু কামনা করছে। আবার আশ্চর্য দেখ, একটা মখমলের সাজ প’রে সেই যতেই মরেছে ব’লে তারাই সব কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে, লজিক্যালি দেখতে গেলে যতে যথার্থই ম’ল না ব’লেই যাদের কাঁদা উচিত ছিল। মিছে বলছি?

সিনেমা দেখতে গেলে—এতে আর্টের আরও কারচুপি, তার মানে ভাঁড়ামি আরও এক পর্দা ছাড়িয়ে। সেবারে কি একটা ইংরিজি সিনেমা দেখে এসে বউ তো রাত্তিরে আহার- নিদ্রাই ত্যাগ করলে এক রকম; কেবলই—আহা, অমন সতীলক্ষ্মীর এত হেনস্তা! যত বলি, ও গল্প, ওসব কি ধরতে আছে? কিন্তু এসা গেঁথে ব’সে গেছে মনে, কিছু কি শুনতে চায়? শেষে বললাম, তোমার ওই সতীলক্ষ্মী নায়িকার খোঁজ ক’রে দেখতে গেলে একাদিক্রমে বোধ হয় আটদশটি বিবাহ, তা ছাড়া স্বাধীন প্রেমের পরীক্ষা যে মাঝে মাঝে কত চলছে—

বলতে যা দেরি! সে আমার যে নাকালটা হ’ল, তা আর ক’য়ে কাজ নেই। হিন্দুর মেয়ে নিজের গা বাঁচিয়ে স্বামী-দেবতাকে যতটা গালমন্দ দিতে পারে সে তো হ’লই, সে রাত্রে অনাহার, তার পরের দিন সাধন ময়রার দোকান না থাকলে তাই হ’ত; তিন দিন কথা বন্ধ, চার দিনের দিন ঘাট মেনে শান্তি স্থাপন হ’ল, বলে, টের পেলে তো সতীলক্ষ্মীর নামে কুকথা বলার মজা?

বিদ্যাসাগর মশাই গিরিশ ঘোষকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শুনেই তোমাদের তাক লেগে যায়, প্রবঞ্চনাটা কতদূর এগুতে পারে বোঝ! স্বামীস্ত্রীতে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ!

কি কথায় কি এসে পড়ল! হ্যাঁ, পরশু বললে, আজ সিনেমা দেখতে চল। সাফ জবাব দিলাম, কোন মতেই না। যেতেই হবে; আলবত যাব না। আমারও মরদকা বাত—একেবারে গ্যাঁট হয়ে ব’সে রইলাম। দাঁতে দাঁত দিয়ে উঠে টেবিল থেকে অ্যাস-ট্রেটা নিয়ে মারলে ছুঁড়ে জানলায়, আমার চোখ ঘেঁষে সোজা গিয়ে গরাদে লেগে চুরচুর হয়ে গেল। বললাম, চোখটা যেত এক্ষুনি।

উপযুক্তই হত। ব’লে সিগারেটের টিন থেকে এক গোছা সিগারেট বের ক’রে দু হাতে ছিঁড়ে কুচি-কুচি করে ঘরময় দিলে ছড়িয়ে। বলে, হিন্দুর মেয়ের ঘরে এসব নেশাপত্র চলবে না। বললাম, বেশ, চলবে না তো চলবে না, আর আসব না ঘরে! আরও উঠল আগুন হয়ে; ও গরমের সময় বরফ আর রাগের সময় ঠাণ্ডা জবাব মোটেই বরদাস্ত করতে পারে না। আমার হাতটা ধ’রে মারলে একটা হ্যাঁচকা, দোরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, তুমি যাও বেরিয়ে, এ ঘরে নেশাখোরের জায়গা নেই, হিদুর ঘর। আমিও গোঁ ধ’রে বসে আছি—বঙ্কার গোঁ বাবা! আস্তে আস্তে আসছি বেরিয়ে, ‘ওই, নাও তোমার নেশার সরঞ্জাম’ ব’লে দিলে সিগারেটের খালি টিনটা ছুঁড়ে। রেলিঙে ঠিকরে পায়ে লেগে পড়ল গিয়ে উঠোনে।

আমার জিদটা গেল আরও বেড়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, বটে? তারপর হনহন ক’রে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, না, আর নাই দেওয়াটা ঠিক নয়, ঢের হয়েছে।

বঙ্কু মুখটা বাঁকাইয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে একদিকে তাকাইয়া রহিল। আমি বললাম, না গিয়ে ঠিকই করেছিস; ও-জাতের সব কথাতে সায় দিলে—

বঙ্কুর মুখটা মোলায়েম হইয়া আসিল। আমার দিকে না চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিল, তোমাদের কি ভাই? বেপরোয়া জীবন দিব্যি, কত ধানে কত চাল তা তো জানে না; বলে দিলে, না গিয়ে ঠিকই করেছিস। না যাওয়া এমনই মুখের কথা কিনা!

যাক, তোকে আর কত বলব, কতই বা তুই শুনবি? শেষ পর্যন্ত আমার জিদটা গিয়ে রাগে দাঁড়াল, ঘুরে এসে বললাম বেশ, চল যাচ্ছি।

পুরুষকে বোঝা যায়; কিন্তু কথায় বলে—স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং—মেয়েমানুষের মেজাজ বোঝাই দায়রে ভাই! এই এতক্ষণ রাগে কাঁই হয়েছিল দেখলে তো? আমি যেই রাজী হলাম, সঙ্গে সঙ্গে জিদ ধ’রে বসল, কক্ষনই যাব না। কেন যাবে না? এই এর জন্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল! আমি যাব না আমার খুশি। খুশি আমার।—ব’লে সে এক ঘর-ফাটানো চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে গলা ভেঙে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, নিজের খোঁপা টেনে ছেঁড়া; গায়ের ব্লাউজ ছিঁড়ে, ড্রয়ার থেকে সাবান, পাউডার, জরির ফিতে, আলতার শিশি টান মেরে ফেলে দিয়ে, পানের ডিবে আছড়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ল।

বঙ্কু থামিল।—যেন সদ্যই ওই দুর্যোগটার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া একটু বিশ্রাম লইতেছে।

আমি বলিলাম, যাক, এবারে তা হ’লে আত্মনেপদ হ’ল; তোর জিনিসপত্র এবং পৈতৃক শরীরটা বেঁচে গেল! তবু ভাল।

বঙ্কু বলিল, মুখের কথায় কিছু লাগে না, অমনই ব’লে দিলে—তবু ভাল। হ’লে টের পাবি রে ভাই, পরস্মৈপদীর চেয়ে আত্মনেপদীর হেপা সামলানো কত শক্ত! নিজের গায়ে একটা চোটফোট লাগলে তবু ভরসা থাকে, দেখে বোধ হয় একটু মমতা হবে এক সময় না এক সময়। জিদ রাগ মাথায় রইল, খোশামোদ করতে করতে প্রাণান্ত। আর এই সময় খোশামোদই কি কম শক্ত! কোন্ কথা যে কি ভাবে নেবে ঠাহরই হয় না; ওর চেয়ে চার হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ নিয়ে নাড়াচাড়া করা ঢের সহজ।

যাক, বিস্তর সাদাসাধির পর যেতে রাজী হ’ল; কিন্তু শাসিয়ে দিলে, খবরদার, শেষে কোনদিন যদি খোঁটা দাও যে, জিদ করে বায়স্কোপ দেখতে গিয়েছিলাম তো ভাল হবে না। নেহাত অবাধ্য বলে লোকের কাছে দুষবে, তাই রাজী হচ্ছি।

ভয়ঙ্কর আশ্চর্য হয়ে বললাম, বাঃ, জিদটা তোমার হ’ল কোনখানটা? গোড়া থেকে নেহাত গোঁ ধ’রে ব’সে আছি, না নিয়ে গিয়ে ছাড়ব না, তাই না যাচ্ছ? দয়া মানে জিদ হ’ল?

বঙ্কিম স্ত্রীর সামনের সেই বিস্ময়ের ভাবটি মুখে ফুটাইয়া কথা বলিতেছিল, আমার হাসি লক্ষ্য করিয়া বলিল, হাসছ? বেশ, হেসে নাও যদ্দিন পার। তখন বললে, যাব তো আলতার শিশিটা তো গেল তোমার পাল্লায় প’ড়ে।

বললাম, তোমার নিজের দোষ। কেন, বালিশের ওপর ছুঁড়ে ফেলতে পারলে না? নিদেন আমার গায়ে এসে পড়লেও আমি সামলে নিতে পারতাম তো?

ভয়ে ভয়ে হাসবার চেষ্টা করে একটু ঠাট্টাও ক’রে দিলাম চোখ কান বুজে; বললাম, মনে করতাম না হয়, মানের পালার পর একটু হোলিখেলাই হয়ে গেল।

ও-ও হেসে ফেললে, মুখ ঘুরিয়ে বললে, নাও, আর রঙ্গ করতে হবে না, কতই জানেন!

পকেট থেকে একটা টাকা ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

ফার্স্ট শোতে যাওয়ার সময়ই পাওয়া গেল না; কাজেই যখন বায়স্কোপ দেখে ফিরে এলাম, তখন বারোটা বেজে গেছে। শুতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। তখন থেকে ঠায় আড়াইটে পর্যন্ত বায়স্কোপের গল্প শুনে কাটাতে হ’ল—আচ্ছা, ইলা ব’লে ওই মেয়েটির সেইখানটা তোমার কেমন লাগল? সেই যেখানটা ডাক্তারের কথায় অম্লানবদনে নাড়ী কেটে রক্ত দেওয়ার জন্যে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলে? নাড়ী কেটে রক্ত দিতে আমার বেশ লাগে, হ্যাঃ, তোমার যেন কিছু হয়ে কাজ নেই, মা-ওলাইচণ্ডী রক্ষে করুন। কি রকম আস্তে আস্তে নির্জীব হয়ে পড়ল মেয়েটা! আহা, আমার সেই থেকে মনটা এমন হয়ে আছে— সেই আস্তে আস্তে চোখ দুটি বুজে আসছে, সেই ঠোট নেড়ে কি যেন বলবার চেষ্টা, সেই দুবার ডান হাতটি তোলবার চেষ্টা ক’রে হার মেনে ডাক্তারের দিকে চাওয়া, ডাক্তার ভাগ্যিস বুঝে নিয়ে হাতটা সীতেশের কাঁধে তুলে রেখে দিলে। তুলে দিতে চোখ দুটি কেমন বুজে এল আপনি আপনি! শেষকালে যতক্ষণ না হাসপাতালে বেঁচে উঠতে দেখলাম, আমার মনের মধ্যে কি যে হচ্ছিল! আর তোমার মনে?

আমার বোধ হয় চোখ ঢুলে এসেছিল, একটা ঠেলা দিয়ে বললে, ছাই হয়েছিল ওঁর মনে। হ্যাঁ গা, তোমার চোখে ঘুম আসছে আজকে? মনিষ্যি না কি!

আমি সামলে নেবার চেষ্টা ক’রে বললাম, আমার সেই গানের সুরটা কানে লেগে রয়েছে, হাজার চেষ্টা ক’রেও চোখ চেয়ে থাকতে পারছি না। এখনও যেন শুনতে পাচ্ছি নিশি ভোর হ’ল শুধু জাগরণে।

বউয়ের গলার স্বর বদলে গেল; আস্তে আস্তে স্পষ্ট ক’রে জিজ্ঞাসা করলে, এটা সেই বাইজীটার গান না?

ঝাঁ ক’রে আমার ঘুমটা ছুটে গেল। আবার সামলাবার চেষ্টা ক’রে বললাম, হ্যাঁ, পেত্নী বেটীর নাকে-কাঁদুনি; শুনে আমার এমন মাথা ধ’রে গেছে যে, কোন মতেই চেয়ে থাকতে পারছি না। ঠিক এই ভুরুর ওপরটা যেন—

বউ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর চিপটেন কেটে বললে, দেখ, আমি কচি খুকীটি নই। কিছু কিছু বুঝি। এসব কথা ব’লে কি আর মেয়েছেলেদের ঠকানো যায়? ওঁর মাথা ধ’রে গেছে, তাই চোখ চাইতে পারছেন না! আসলে সে মাগী তোমার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে। সীতেশবাবুকে প্রায় শেষ করেছিল, এবার তোমার দফা নিবেশ করতে বসেছে।

শাসিয়ে বললে, কিন্তু স্থির জেনো, আমি ইলার মত নাড়ী কেটে রক্ত দিতে পারব না। ঘুমোও, আর বড়বড় ক’রে ব’কে আমায় জ্বালিও না। উনি পেত্নী দেখেছেন! আমার চোখে ধুলো দেবে, না?

আমার বেজায় রাগ হ’ল। এ কি ব্যাপার! প্রতিজ্ঞা ভেঙে খোশামোদ ক’রে নিয়ে গেলাম। এককাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ, তার ওপর প্রায় দু ঘণ্টার ওপর বসে যেন পিঁজরেয় বন্ধ হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা; তার পুরস্কার গিয়ে এই দাঁড়াল? একেবারে চরিত্র নিয়ে সন্দেহ?

পাছে রাগের মাথায় উৎকট একটা কিছু ক’রে বসি, এই ভয়ে আর কোন কথা কইলাম না। রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে সক্কালবেলা মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চা-টা সারলাম পুরন্দরের বাড়ি; সেইখানে প্রায় নটা পর্যন্ত কাটিয়ে মনে করলাম এইবার বাড়ি যাওয়া যাক! গিয়ে কি দেখলাম বল তো?

কি জানি, বুঝি মনস্তাপ—

বঙ্কু একটা কঠিন ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া বলিল, হয়েছে! মনস্তাপ! না প’ড়েই সব বিদ্বান হয়েছে কিনা। মনস্তাপ ওর শত্রুর হোক। গিয়ে দেখি, নীচে ঝিটা থামে ঠেস দিয়ে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। উনুনে আঁচ পড়ে নি। বেড়ালটা ধীরে-সুস্থে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিচ্ছু নেই, চুরিও করতে হয় নি, না-হক লোক দেখেই বা ভড়কাতে যাবে কেন? ঝিকে ন ভূতে ন ভবিষ্যতি যাচ্ছেতাই ক’রে জিজ্ঞেস করলাম, বউ কোথায়? বললে ওপরে। সেই রাগ মাথায় ক’রে ওপরে উঠে গেলাম। দেখি, বউ শোবার ঘরে সোফাটায় হেলান দিয়ে ব’সে টিপয়ে একটা হাত আলগাভাবে ফেলে রেখে জানলার বাইরে চেয়ে আছে।

দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার সিনেমার একটা দৃশ্য মনে প’ড়ে গেল। সীতেশ এক মাস কোন চিঠিপত্তর না দিয়ে আজ বাড়ি এসেছে, ইলা ঠিক এই রকম ভাবে আকাশের দিকে চেয়ে ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে বসে আছে। সীতেশ এসে ঘরে ঢুকল, তারপর একচোট নানা রকম বিটকেল পসচার দেখিয়ে সোফার এক পাশটিতে বসল। তারপর মানভঙ্গের সে এক পালা!

আমার দুঃখে রাগে ঘেন্নায় মনটা যে কি ক’রে উঠল বলতে পারি না। আমি দশটা পর্যন্ত বাড়ি নেই, পরের বাড়ি চা খেয়ে বেড়াচ্ছি, সমস্ত রাত চক্ষে ঘুম নেই, আর ও কিনা ব’সে ব’সে অভিমানের পোজ অভ্যেস করছে! যে অভিনয়কে ন্যাকামিকে, আদিখ্যেতাকে আমি এত ঘেন্না করি, শেষকালে তাই কিনা আমার বাড়ির মধ্যে! ওর আমি কি অত্যাচার, কি আবদারই না সইছি! ঝগড়াঝাঁটি, গালমন্দ, ছেঁড়াছিঁড়ি— কোন্‌টা বাদ যাচ্ছে? কখনও কখনও রেগেছি বটে, সেটা ব্যাটাছেলের পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু মনে গ্লানি উপস্থিত হয় নি আজ পর্যন্ত; তার কারণ কি—না, সেগুলো ওর মনের খাঁটি অভিব্যক্তি, অভিনয় নয়। সেই ও কিনা আজ—

বঙ্কু একটু গুম হইয়া রহিল, তাহার পর বলিল, তক্ষুনি ফিরলাম, মনে মনে কড়া দিব্যি করলাম, সমস্ত দিন আর বাড়িতে পা দোব না; থাক্ ও ওর থিয়েটারি পোজ নিয়ে।

ঠিকই করেছিলি। বলিয়া আমি বঙ্কুর কার্যের সমর্থন করিতে যাইতেছিলাম, আমার কথায় কান না দিয়া বলিল, কিন্তু সিঁড়ির কাছে এসে মনে হ’ল—এ ঠিক হচ্ছে না; পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালে চলবে না তো, ঠিক ক’রে বুঝে নিতে হবে—ব্যাপারটা খাঁটি, না, মেকী— সত্যিই মনে দুঃখ হয়েছে, না, অভিনয়; একেবারে কৃতনিশ্চয় হয়ে তারপর অন্য ব্যবস্থা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা বের করতে হবে।

আস্তে আস্তে গিয়ে সোফার ধারে ওর পিছনটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম, ঠিক সীতেশ যেমনটি ক’রে এক মাস পরে এসে দাঁড়িয়েছিল—অবশ্য যতটা পারলাম। বুঝলে—এসেছি, কিন্তু, ফিরে চাইলে না। আমি তখন একটু সামনে এগিয়ে গেলাম, ও-ও ঠিক সেই পরিমাণ অন্যদিকে ঘুরে গেল। ঠিক মিলে যাচ্ছে—ইলার নকল। দুঃখে বিরক্তিতে আমার গা জ্ব’লে যাচ্ছে, কিন্তু ছাড়লাম না। একটু মুখে হাসি টেনে এনে সোফাটা ঘুরে সামনে এসে দাঁড়ালাম। বউ জানলার উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল; হুবহু সীতেশ-ইলা, আর কোন সন্দেহই নেই, পাশ ঘেঁষে সোফাটাতে ব’সে পড়লাম, কোণটাতে স’রে গিয়ে সোফার হাতলে মাথা গুঁজড়ে দিলে। বুঝতে পারছ তো? তুমি সব সিনেমাতেই অভিনয়ের এই মার্কামারা অভিনয় দেখতে পাবে- পেটেন্ট। ইংরিজি ফিল্ম থেকে বাংলা ফিল্মে এসেছে, সেখান থেকে এখন বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকছে; ভীম-দ্রৌপদীই বল, আর সীতেশ-ইলাই বল, ওই এক জিনিস— সোফার চারিদিকে ঘোরাঘুরি।

আমি মনের রাগ মনে চেপে স্থির ক’রে ব’সে আছি, শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। ঘুরে মাথা গুঁজড়ে বসতেই আমি আমার ডান হাতটা ওর ডান হাতের চুড়ির ওপর তুলে দিলাম, তারপর বাঁ হাতটা পিঠের ওপর দিয়ে সীতেশী স্টাইলে যেই খোঁপার ওপর রাখব, বাস্, আর কোথায় আছে! বন্ ক’রে ঘুরে গিয়ে দিলে টিপয়টা লাথিয়ে ঠেলে, সেটা ছিটকে গিয়ে একটা ঠ্যাং ভেঙে গড়িয়ে পড়ল; তারপর উঠে আমার চশমাটা টেনে নিয়ে মারলে আছাড়, চুরচুর করে কাঁচগুলো ছড়িয়ে পড়ল—ষোল টাকা দামের চশমা। তারপর আমার ফাউন্টেন পেনটা পকেট সুদ্ধ ছিঁড়ে টেনে ফেলে, বোতামগুলোয় একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে কেঁদে চেঁচিয়ে সে এক মহামারী কাণ্ড করে তুললে; তাতেও যখন আশ মিটল না, আমি সাবধান হবার আগেই—’খোঁপায় টান দিলে কেমন লাগে এই দেখ দেখ এই’–বলে আমার সামনের চুলটা দু মুঠোয় কষে ধ’রে দুটো কড়া ঝাঁকানি দিয়ে, আছড়ে সোফায় প’ড়ে ফোঁপাতে শুরু ক’রে দিলে! বড় জোর দুটি মিনিট—কিন্তু ঘরে যেন একটা খণ্ডপ্রলয় হয়ে গেল।

বঙ্কু চুপ করিয়া উত্তেজনায় অল্প অল্প হাঁপাইতে লাগিল।

আমি মেয়েছেলের এতটা স্পর্ধায় একটা রূঢ় মন্তব্য প্রকাশ করিতে যাইতেছিলাম, হঠাৎ বঙ্কুর মুখে প্রসন্ন হাসির উদয় দেখিয়া থামিয়া গেলাম। বঙ্কু আমার হাত হইতে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা লইয়া হাসিমুখেই বলিল, বুঝতে পারলি তো?

বিমূঢ়ভাবে চাহিয়া রহিলাম। বঙ্কু সিগারেটে একটা টান দিল, তাহার পর হাসিতে একটু ব্যঙ্গ মিশ্রিত করিয়া বলিল, এটুকু আর বুঝলি নি?—বোকা! অভিনয় নয়, খাঁটি জিনিস। আমারই ভুল হয়েছিল; অভিনয় হ’লে কি আর মাথার চুল ধ’রে হ্যাঁচকা টান মারে! সেই থেকে ভাই, মনটি এমন হাল্কা হয়ে আছে, কি বলব! একবার ভেবে দেখ না, সন্দেহে সন্দেহে একেবারে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলাম—সোজা কথা!

অনেকক্ষণ পরে, বিস্তর সাধ্যিসাধনার পর ঠাণ্ডা হল, কথা কইলে। তখন জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, কি চাই বল?

বললে, পদ্মলতা পাড়ের শাড়ি।

মনে পড়ল, ফিল্‌মে ইলা ঐ রকম একখানা শাড়ি পরেছিল বটে। তা হোক, দিলাম একখানা এনে।

বলিয়া বঙ্কু খুব পরিতৃপ্ত একটা হাসি হাসিয়া, সামনের চুলগুলা ধীরে ধীরে মাথার উপর তুলিয়া দিতে লাগিল।

তাহাদের গোড়ায় যেন খাঁটি সুখের আমেজ তখনও লাগিয়া আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *