খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ৩০

৩০

আহির জানতো একটা রাম থাপ্পড় তার পাওনা হয়ে আছে এবং পেয়েও গেল বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই। মা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তেড়ে মেড়ে এসে থাপ্পড়টা বসিয়ে দিলেন। এ এক অদ্ভুত মহিলা! মেয়ে বাড়ি ফিরেছে সেই আনন্দে আনন্দিত হবে, তা না, রাগ দেখাচ্ছে! বেশ হতো যদি একেবারেই না ফিরত আহির। যত্তসব। তড়াক করে মেজাজটা সপ্তমে চড়লেও আহির মুখে কিছু বলল না। চড় খেয়ে জ্বলতে থাকা গালে একটা হাত চেপে রেখে নিজের ঘরে চলে আসলো। আশিক আর বাবাই দুজন বিস্ময়ে ফেটে পড়া সিনেমার দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই বাড়ির মানুষগুলো এমন অদ্ভূত কেন? উফ!

— ‘কোথায় ছিলি এ দুদিন?’ মা হুঙ্কার ছাড়লেন। কোমরে হাত রেখে।

আহির মিনমিনে গলায় বলল, ‘বাইরে’

— ‘বাইরে কোথায়?’ বাঘের মতো গর্জে উঠছে মা। সমস্যাটা কী? আহির ঘুরে দাঁড়িয়ে শীতল গলায় বলল, ‘তুমি এরকম করছ কেন? এরকম করলে কিন্তু আমি আবার চলে যাব, আর কোনদিন ফিরব না বললাম!’

আহিরের কথা বলার ঢঙে মা একটু বিচলিত হলো বলে মনে হলো। বাবাই এগিয়ে এসে বলল, ‘এটা কোনো কথা হলো! একটা মেয়ে মানুষ এরকম না বলে কয়ে হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়? আমাদের উপর দিয়ে কী গেছে তুই একটা বার চিন্তা করেছিস? তোর যদি কোনো বিপদ হতো? আজকাল কত রকম দুর্ঘটনার খবর ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন খবরের কাগজে! তোর কি একটুও বুক কাঁপলো না?’

আহির বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে, অধৈর্য ভাবে বলল,

— ‘বাবাই, আমি আর পারছিলাম না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একবার ভাবলাম সুইসাইড করব, কিন্তু সাহস হল না।’

ওই ‘সুইসাইড’ একটা শব্দ বাবাই আর মায়ের মুখশ্রী ভেলকি দিয়ে পাল্টে দিল। মা ছুটে এসে আহিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী আবোল তাবোল বলছিস? অত ভেঙে পড়ার মতো তো কিছুই হয়নি, তোর যা মন চাইবে তাই করবি। কেউ তোকে জোর করবেনা’

আহিরের চোখ দুটো ভিজে উঠল, ‘এ জন্যই ফিরে এসেছি মা, এই যে তোমরা এভাবে জড়িয়ে ধরবে, আর আমি আবার বেঁচে থাকার প্রেরণা পাব!’

বাড়ির সদস্যগুলোর মুখে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কাল বাদে পরশু তাদের নতুন বাসায় ওঠার কথা। আহির ছিল না বলে সব কাজ পড়ে ছিল, থমকে ছিল।

মা খুব যত্ন করে রান্না করলেন। আহিরের পছন্দের খাবার, বেগুন ভর্তা, আলুর ভর্তা, ভাত, ডাল। ওপরতলা থেকে চৈতী ছুটে আসলো। এসেই হইচই লাগিয়ে দিল। উত্তেজনায় তার কেঁদে ফেলার উপক্রম। অনেক দিন পর আপনজনদেরকে সত্যিকারের আপনজন বলে মনে হচ্ছিল আহিরের। মনটা কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসার উত্তাপে ভরে উঠছিল। কিন্তু এইসব কিছু ছাপিয়ে অন্য একটা মানুষের ভাবনা আহিরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিচ্ছিল। এলোমেলো করে দিচ্ছিল। ঘরভর্তি মানুষের মাঝেও একা করে তুলছিল। অনেক চেষ্টা করেও আহির ফোন নম্বরটা চাইতে পারল না চলে আসার আগের মুহূর্তে। এখন ভারি আফসোস হচ্ছে! লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন নম্বরটা চেয়ে বসলেই হতো। আর যদি কখনো দেখা না হয়? আর যদি কখনো কথা না হয়! মনে হতেই আহিরের সমস্ত মনটা খন্ড বিখন্ড হয়ে গেল। এমন কেন লাগছে? অয়ন তার কেউ নয়, বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়, অনেক দিনের চেনা পরিচিতও নয়, তবুও কেন মনে হচ্ছে ওই মানুষটা তার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে?

অয়নের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তুষার। কিন্তু তুষারের কাছে আহির কোনভাবেই অয়নের খোঁজ করতে পারবেনা। তুষার ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেবেইনা। মনে পড়ল আহিরের। তুষারকে একটা সুযোগ দিতে হবে, অয়নকে কথা দিয়েছিল সে।

তুষার সে রাতেই আসলো। কী করে যেন খবর পেয়েছে সে। শুকিয়ে মুখটা আধখানা হয়ে গেছে। আহিরের দেখে মায়া হলো। মনে হলো, ছেলেটাকে বোধহয় সে এখনো ভালোবসে। হয়তো এই অনুভূতিকে এখন আর ঠিক ভালোবাসা বলা যাবেনা। দীর্ঘদিন একসাথে থাকতে থাকতে একটা মমত্ববোধ জন্মে গেছে, মায়া জন্মে গেছে। কিন্তু শুধু এই মমত্ববোধ আর মায়াকে পুঁজি করেই কি বিয়ে করে সুখী হওয়া যায়? হয়তো যায়, হয়তো এ সংসারে টিকে থাকার শুধু একটিই মন্ত্র ‘মায়া…’। যদিও চারবছর আগের তুষার আর এই তুষারের মাঝে ঢের তফাৎ। তুষার ঠুনকো হয়ে গেছে আহিরের কাছে। হেরে গেছে কামনার কাছে, প্রবৃত্তির কাছে। হেরে যাওয়া, বহুকামী, হ্যাংলা পুরুষমানুষ আহিরের কোনদিনও পছন্দ না। বাবা মা’কে তুষার বলেছে ওই মেয়েটার সাথে তার কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল না। মেয়েটা তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। আহির তুষারকে ভুল বুঝেছে। কে জানে সত্য না মিথ্যা! আহির আর কিছু জানতেও চায়না। একটা দুটো সত্য না জেনেই কেটে যাক না এই একটা জীবন! আহির তবুও ক্ষমা করলো তুষারকে। তুষার যখন হামলে পড়ে আহিরের পা ধরে, কান্নায় ভেঙে পড়ে মাফ চাইল, আহির তখন ক্ষমা না করে পারল না। সুখে থাক তুষার, সুখে থাক বাবাই, মা, আশিক, আশেপাশের মানুষগুলো। তাদের সুখ থেকেই আহির সুখ খুঁজে নেবে।

৩১

অয়নের একটা চাকরি হয়েছে। যার এত ক্ষমতাধর মা থাকে, তার জন্য যে চাকরি আসলেই ছেলের হাতের মোয়া তা আরেকবার প্রমাণিত হয়ে গেলো। একটা ওষুধ তৈরির কোম্পানি। জয়েনিং সেলারিই দেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা। অয়ন খবর শুনে অনেক্ষণ হাসলো। প্রাণ খোলা হাসি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা? তোমাদের কি মনে হয় আমার দ্বারা চাকরি হবে? আমি মানুষটা অতটা সাধারণ না, রোজ নিয়ম করে অফিস যাব, আসব, সময় মতো ঘুমাব, তা আমার দ্বারা কোনোদিনও হবে না।’

—’তাহলে মায়ের বিজনেসটা দেখলেই পারিস’ বুশরা বলে।

দাদীমা বুশরার কথায় সায় দেয়,

— ‘ঠিকই তো বলেছে, ব্যবসাটা ধরে ফেল। এরপর দেখে শুনে একটা লক্ষ্মী দেখে মেয়ে বিয়ে করে ঘরে তোল, আমি একটু শান্তিতে মরি।’ অয়ন মিটমিট হাসে। কিছু বলেনা। সে জানে বিয়ে শাদি, চাকরি, ব্যবসা, কোনটাই আসলে তাকে দিয়ে হবেনা। স্রোতের বিপরীত দিকটিই তার গন্তব্য। যে কটা দিন বেঁচে থাকবে এভাবেই চলবে। কিন্তু পড়তে বা পড়াতে এখনো ভালো লাগে অয়নের। হয়তো আর কিছু না করলেও ওই একটা কাজ করা যায়। তবে আজকাল একটা অদ্ভূত রোগ হয়েছে তার। কেবলই মনে হয়, সে আর আগের মতো একা নেই, সর্বক্ষণ তার সাথে আরেকজন আছে। একাকী সময়গুলোও এখন সম্পূর্ণ তার নিজের না। প্রতিটি কাজে, প্রতিটি ভাবনায় অন্য একজনের দখল। অয়ন তো এমন ছিল না! কাল রাতে একটা আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখার পর মনটা বিষাদে ভরে গেছে। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছেনা। এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখল সে? দেখলো তার নিজের ঘরের বিছানায় একটা মেয়ে বসে আছে। কাছে যেতেই বোঝা গেল মেয়েটা আহির। আহির তার বিছানায় কী করছে? চমকে উঠে এক পা দূরে সরে গেল সে। আহির খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, ‘যাচ্ছ কোথায় আমাকে ফেলে? কোথাও যেতে পারবেনা, আরে বোকা, তুমিই তো আমি আর আমিই তো তুমি! পালিয়ে যাবে কোথায়?’ অয়ন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তার গলা শুকিয়ে গেছে। কপাল ঘামছে। তুমিই তো আমি আর আমিই

তো তুমি! লালনের গান মনে পড়ল,

“আমি আর সে অচিন একজন
এক জায়গাতে থাকি দুজন।
ফাঁকে থাকে লক্ষ্য যোজন না পাই দেখিতে।
সাধ্য কিরে আমার সেরূপ চিনিতে
অহর্নিশি মায়ার ঠুসি জ্ঞানচক্ষেতে।”

নিজের ভেতর কি অন্য কেউ বাস করতে পারে? নিজের আত্মার সাথে, মনের সাথে হয় কি বাসস্থান একই সাথে অন্য একজনের? হয়, হয়, নিশ্চয়ই হয়। এ জগৎ অন্তহীন রহস্যে ঘেরা। রহস্যের কূল কিনারা নাই।

শীতের প্রকোপ কমে গেছে। গাছে গাছে হলদে পাতা উঁকি দিচ্ছে। কোকিল ডাকছে হরহামেশা। প্রকৃতি তার যৌবন ফেরত পাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে দক্ষিণের আকাশ ঝির ঝির করা হাওয়া ছাড়ে। মানুষের সাথে এখানেই তার বিশদ পার্থক্য। মানুষের যৌবন একবার গেলে আর ফেরত আসেনা, প্রকৃতির যৌবন বার বার আসে।

এমনই এক স্নিগ্ধ হাওয়ার বাসন্তী বিকেলে অয়ন গেল তিয়ানার সাথে দেখা করতে। বনানীর এক অভিজাত, দামী রেস্তোরায়। তিয়ানা একটা সবুজ গাউন পরেছে। গলায় কানে সবুজ পাথরের সেট। ওকে দারুণ দেখাচ্ছিল। কথার ফুলঝুড়ি ছড়াচ্ছিল তিয়ানা। অয়ন কথা বলছিল কম, শুনছিল বেশি। শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হলো, এই মেয়েটির সাথে তার প্রেম হলো না কেন কখনো? এই দুরন্ত, সুন্দরী, মেধাবী বালিকাটি যে তার প্রতি কতটা মোহাবিষ্ট, কতটা আসক্ত এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেও তার হৃদয় কেন একটি বারের জন্য কাঁপলোনা? অথচ তুষার কেন একজনের সাথে দায়বদ্ধ থাকার পরেও কামনার বশে অন্য নারীর স্মরনাপন্ন হলো? মানুষে মানুষে এত তফাৎ কী করে আসে? কোত্থেকে আসে? দেহের সাথে আত্মার যোগ ঘটলে কি কখনো দেহকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায়? আর যদি যায়ই তবে পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যটা কোথায়? তবে কি বেশির ভাগ মানুষই তার ভেতরের স্বত্তাটার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষম? নিজেকেই যদি না জানল, না চিনল, তবে এই মানবজন্মের অর্থ কী? অয়ন তাকিয়ে থাকে তিয়ানার দিকে কিন্তু তার মন চলে যায়, তিয়ানাকে ছাড়িয়ে, তার নিজেকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে।

সন্ধ্যায় তুষারের সাথে দেখা হয়ে গেল রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে। অয়ন কেন যে ছেলেটাকে দেখে ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেল কে জানে। সে কেন তুষারের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা? কোথায় বাঁধছে তার? কিন্তু তুষার খুব খুশি হলো অয়নকে দেখে।

— ‘আরে অয়ন ভাই যে, আছেন কেমন?’

— ‘এইতো চলছে, তোমার?’

— ‘আমার তো বিয়েটা এগিয়ে আসলো ভাইয়া, তারিখ পড়ে গেছে, আগামী মাসের পনেরো তারিখ’। অয়নের নিশ্বাস ভারী হয়। মুখটা একটু রক্তশুন্য দেখায়। তবুও চমৎকার সামলে নিল নিজেকে। হেসে বলল, ‘খুব ভালো, খুব ভালো, কনগ্রাচুলেশনস!’

— ‘বিয়েতে আসবেন কিন্তু ভাইয়া, কার্ড ছাপা হলেই আপনাকে দাওয়াত দেব।’

— ‘অবশ্যই আসবো!’ অয়ন আর কথা বাড়ায়না। পায়ে হেঁটে তুষারের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যেতে চায়। এ কী হচ্ছে তার সাথে? নিজের সাথেই নিজের একটা বোঝাপড়া দরকার। ঠান্ডা লড়াই দরকার।

সেই রাতে খবরটা আসলো। বাবার লাশ পাওয়া গেছে ঢাকার একটি ব্যস্ত তম মহাসড়কে। বাস চাপা দিয়ে গেছে। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মায়ের ফোনে ফোন দিয়ে খবরটা জানিয়েছেন। সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ আছে, হস্তান্তর করবে আগামীকাল সকালে।

খবরটি পাবার পর অয়ন কোনো উচ্চবাচ্য করল না। এক ফোটা চোখের জলও ফেলল না। অনেক রাত অবধি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল। হয়তো বাবার মতো তার দেহটাও প্রাণ হারিয়ে একদিন এই শহরেরই আনাচে কানাচে পড়ে থাকবে। দেহ থাকবে, প্রাণ থাকবেনা। প্রাণ পাখিটি উড়াল দেবে খাঁচা থেকে। কেমন হবে সেই মুহূর্তটি? বাবার কেমন লেগেছিল? বাসটা যখন তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল? বাবা যতদিন ছিল, তার নিজের বেঁচে থাকার একটা কারণ ছিল, এখন অয়ন কী নিয়ে বাঁচবে?

হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যায়। ঢাকার বাইরে যেতে মন চায়, আবার চায়ও না। ঢাকার বাইরে গেলেই এখন অন্য একটা মানুষকে খুব বিশেষ ভাবে মনে পড়বে। সেই বিশেষ ভাবে মনে পড়াটাকে ভয় পায় অয়ন। মন বলে দেখা হবে। এই শহরেরই কোথাও আবার তার সাথে দেখা হবে। নিশ্চয়ই দেখা হবে। দেখা হবে হারানো মানুষগুলোর সাথে। আহিরের সাথে, বাবার সাথে। হয় এই জন্মে, নয় পরজন্মে। মৃত্যুর পরে যে জীবনের সূচনা ঘটে। মনে হয় ওই দেখা হওয়ার জন্যই এই ছুটে চলা। প্রহর গোনা। একটা রিক্সা একদল ছেলেকে নিয়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এক রিক্সায় চার পাঁচজন বোঝাই হয়ে বসেছে। গান গাইছে, খালি গলায়। সুমনের গান,

“ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও”

অয়ন ফুটপাতের ওপর বসে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসলো। হায়, জীবনটা বড় লক্ষ্যহীন হয়ে গেছে তার। সে কেন এমন হলো? সে কেন আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলো না? আকাশ গুমোট হয়ে আছে। গাছের পাতা নড়ছেনা। গভীর রাতের শহর রাস্তার ধারের ফ্লুরোসেন্ট আলোয় আলোকিত। খুব একটা শব্দ নেই কোথাও, শুধু দূর থেকে ছেলেগুলোর গানের আওয়াজ ভেসে আসে, গভীর রাতের গায়ে গায়ে মিশে যেতে থাকে গানের সুর!

“ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই
ছেলেবেলার সেই, বেহালাবাজানো লোকটা
চলে গেছে বেহালা নিয়ে, চলে গেছে গান শুনিয়ে!”

৩২

বিসিএস প্রিলিতে আহিরের হয়ে গেছে। দারুণ খুশির একটা খবর। এই ঘটনাটি মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের প্রতি নতুন করে টান অনুভব করছে সে। এবারে লিখিত পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু সময় কই? বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়ে গেছে। বিয়েবাড়ির আনন্দ। আজ সকালে আহিরের শাশুড়ি এসে বিয়ের গয়না দিয়ে গেল। দশ ভরি ওজনের সীতাহার, সাথে কানের ভারী দুল। হাতের বালা, সব মিলিয়ে তেরো ভরি ছাড়িয়ে গেছে। তুষারের ঘরটিতে বাবাই কেবিনেট তৈরী করিয়ে দিয়েছেন। মিস্ত্রী গতকাল কাজ শেষ করল। এ ছাড়াও একটা খাট এবং ড্রেসিং টেবিল দেয়া হচ্ছে। বাবাইয়ের জমা যা আছে সব আহিরের বিয়ের পেছনেই খরচ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আহির কতবার বারণ করল, ‘বাবাই কিছু টাকা রেখে দাও,আশিকের পড়াশোনার জন্য লাগবে। কখন কী বিপদ হয় বলা যায়না’ বাবাই বুঝি কারো কথা শোনার বান্দা। তার একটাই কথা, ‘আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র মেয়ে, এক মাত্র মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে হবেনা তা কি করে হয়!’

প্রায় দিন আহির চৈতির সাথে শপিং এ চলে যায়। হরেক রকম রং বেরঙের জিনিসের ভিড়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। স্বপ্নেরা উঁকি দেয়। একটা ছিমছাম সুন্দর সংসার। একটা ভালো চাকরি। তার মধ্যবিত্ত সহজ সরল জীবনটায় এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?

নতুন বাসাটা ছোট হলেও মন দিয়ে সাজিয়েছেন মা। দুটা বেডরুম, ড্রইং, ডাইনিং, আর দক্ষিণে চমৎকার একটা ঝুল বারান্দা। সাত তলার ওপরের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় যেন আকাশের কোলে ভাসছে। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আহির। মাঝরাতের আকাশটা খুব কাছের মনে হয়। ঝির ঝির হাওয়া দেয়। ভালো লাগে। পাহাড়ের ওপরে কাটানো সেই রাতটার কথা মনে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আবার সেই পাহাড়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। মানুষটা কেমন আছে? কেন জানতে ইচ্ছে হয় তার কথা? একটাবার খবরও নিল না! আহির বাঁচলো কী মরলো! অদ্ভুত মানুষ। তবু মন বলে দেখা হবে। একদিন ঠিক দেখা হবে।

দেখা হয়েও গেল একদিন। সেদিন শ্রাবণ মাস। বিকেলের দিকে আকাশ জুড়ে মেঘ করল। বৃষ্টি নামলো ঝেঁপে। দুপুরে এক বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত খেয়ে আহির মহাখালী বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল তুষারের অপেক্ষায়। তুষারের অফিস এদিকেই। দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে। বাস স্ট্যান্ডের ছাউনিতে বুক চাপা ভিড়। উত্তাল হাওয়া চুল উড়িয়ে নিচ্ছে, গায়ের ওড়না উড়ছে পতাকার মতো। সেই হরেক লোকের ভিড়ের মাঝে একটা চেনা মুখ দৃষ্টি কাড়লো। বৃষ্টিতে চুল ভেজা, পরনের টি-শার্ট ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে। চোখে চোখ পড়ল। স্থির হয়ে রইল বেশ খানিক্ষণ চারটি চোখ। বুক কাঁপতে থাকল। হৃদপিন্ডে ক্রমাগত ধুক পুক ধুক পুক। চারিদিকে যেন আর কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু বৃষ্টির নিবিড় রিমঝিম আর চারটি চোখের পরস্পর আটকে থাকা

ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসলো অয়ন। হাওয়ায় অনেক জোর। অয়ন বলল,

— ‘এদিকে ভিড়, চলুন সামনে এগিয়ে যাই।’

আহির কোনো কথা না বলেই এগিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরল। বলল,

— ‘ছাতার ভেতর আসুন, ঠান্ডা লেগে যাবে’। অয়ন হাসে,

— ‘আমার এসবে অভ্যাস আছে, কিচ্ছু হবেনা’

— ‘কেমন আছেন?’

— ‘চলছে, আপনি?’

— ‘ভালো’

— ‘শুনলাম আপনার বিয়ে’

— ‘ঠিক শুনেছেন

— ‘কনগ্রেচুলেশনস’

— ‘থ্যাংক ইউ, আমি বেশিদূর যাব না, এদিকেই থাকতে হবে।’ বলে আহির দাঁড়িয়ে পড়ল।

— ‘এদিকে কোনো কাজ ছিল?’

— ‘বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত ছিল, এখন তুষারের জন্য অপেক্ষা করছি, একসাথে বাড়ি ফিরব।’

— ‘ও! তাই বলেন’ বলে অয়ন চুপ করে যায়। কেউ কোনো কথা খুঁজে পায়না। দুজন দুজনকে আড়চোখে দেখে। ভাবে। কী যেন বলতে চায়, আবার বলেনা। একটা সময় আহির বলল, ‘কী করছেন এখন?’

— ‘দুটা টিউশনী ছাড়া কিছুইনা, ও হ্যাঁ, আমার বাবা মারা গেছেন

এই প্রথম অয়ন কাউকে তার বাবার মৃত্যুর খবরটা দিল। তার পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই যার সাথে এই কষ্টটি ভাগ করে নেয়া যায়।

— ‘বলছেন কী? কী করে?’

— ‘রোড এক্সিডেন্টে

শুনে আহির বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে রইল। বৃষ্টির তেজ তখন কমে গেছে। টিপ টিপ করে ঝরছিল শুধু। আহির ছাতাটা ভাজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে অয়নের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার খুব কষ্ট হয়েছে, তাইনা অয়ন?’

অয়ন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল, ‘এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায়না, বললাম না, সব কিছু অভ্যাস হয়ে গেছে!’

— ‘জীবনটাকে একটু গুছিয়ে তোলেন না কেন? আর কত দিন বলুন তো এভাবে চলবে?’ অয়ন হাসে, আহিরের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘কার জন্য গুছিয়ে তুলব? কে আছে আমার?’

আহির ঢোঁক গিলল, ‘নিজের জন্য’

— ‘নিজের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয়না’

— ‘আপনার মায়ের জন্য অয়নের যেন হঠাৎ মনে পড়ল, ‘ও হ্যাঁ, মায়ের সাথে প্যাঁচআপ করে ফেলেছি’

শুনে আহির খুশি হয়, ‘বেশ ভালো, ভীষণ ভালো খবর!’

— ‘মায়ের জন্য জীবন গুছিয়ে তোলার কথা বলছেন? মা তার ছেলেকে ফেরত পেয়েই খুশি, আর কিছু চায়না’ বলে অয়ন ফিচেল হাসি হাসে।

— ‘সিরিয়াসলী! আপনি এত ব্রাইট একটা ছেলে, কেন নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছেন বলুন তো? এবার একটু ঘুরে দাঁড়ান মশাই! একটা ভালো চাকরি খুঁজে নিন, বিয়ে শাদী করুন।

— ‘সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয়না। আমার দ্বারা হবেনা, আর বিয়ে করবেই বা কে আমাকে? আমি তো পাগল!’

— ‘আপনি মোটেই পাগল নন, আর আপনাকে তো যে কেউ বিয়ে করবে।’

— ‘যে কেউ?’

— ‘যে কেউ!’

অয়ন দুর্বোধ্য হাসে। কিছু বলেনা। বৃষ্টির তোড় আবার বাড়তে থাকে। বৃষ্টির জন্যই রাস্তায় লোকজন কম। ফুটপাতটা খালি খালি লাগে। ছাতা খুলে মেলে ধরার আগেই বৃষ্টির ধারালো ফোটা বন্য দস্যুর মত হামলে পড়ে শরীর ভিজিয়ে দেয়। দুরন্ত হাওয়ায় উড়ে ভেজা মাটির ঘ্রাণ। ভালো লাগতে থাকে। আহির হঠাৎ অন্য সুরে বলে ওঠে, ‘আপনার মনে আছে, অয়ন?’ কেন বলল কে জানে। শুনে অয়ন একটু চমকে গেল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার মনে আছে, আহির দিলশাদ! আমার সব কিছু মনে আছে’

অয়নের ওই দৃষ্টি আহিরের বুকের ভেতরের সমস্তটা ওলটপালট করে দিল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘মনে থাকলে এত দিন কোনো খবর নেন নি কেন? মরেও তো যেতে পারতাম!’

— ‘খোঁজ নেবার কোনো উপায় ছিল না, কিন্তু মনে মনে ঠিক বুঝেছিলাম, আপনি ভালো আছেন।’

আহির অভিমানের গলায় বলল, ‘ছাই বুঝেছেন

মোবাইলটা বাজছিল। তুষারের ফোন। হয়ত কাছাকাছি চলে এসেছে। আহির ফোনটা কেটে দিয়ে বলল,

— ‘আবার কবে দেখা হবে?’

— ‘হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু নেই। বলেছিনা? সোউল ইজ এটার্নাল! দেখা হতেই হবে, এ জীবনে না হলেও ওপার জীবনে হবে।

বলে হাসে অয়ন। আহিরও হাসে। ঝিলিক মারে ওর গজদাঁত। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বৃষ্টির মাঝেও চোখের জলের রং খালি চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে। কিছুটা সময় দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

— ‘যাই’ আহির বলে।

— ‘আসুন।’

আহির ধীর পায়ে হেঁটে ধোয়াটে বৃষ্টির সাথে ঝাপসা হয়ে যায়, মিলিয়ে যায়। শুন্য পথটিতে শুধু শন শন শব্দে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে। অয়ন নিষ্পলক চেয়ে থাকে সেদিকে। নিজের মনে বিড়বিড় করে,

“কপালের ফের নইলে কী আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন খানে পালায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়!”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *