খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ২০

২০

মাঝে মাঝে কিচ্ছুতে মন বসেনা আহিরের। বেকার জীবনের চাইতে জঘন্য আর কিছু হতে পারে? সারাদিন এই চার দেয়ালের মাঝে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো। কোনো কাজ নেই, দায়িত্ব নেই, ব্যস্ততা নেই। আর ভালো লাগছেনা আহিরের এই ঘটনাবিহীন জীবনটা বয়ে নিতে।

বিসিএস এর গাইড বইটা সামনে নিয়ে বসে থাকল বেশ খানিক্ষণ। কোনো লাভ হলোনা। মাথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। খানিক বাদে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,

— ‘আহির শুনছিস? আজকে যা পারিস কিছু একটা রান্না করে ফেল তো! আমি একটু বের হচ্ছি, জরুরী কাজ আছে!’

— ‘তোমার আবার কী কাজ? আর আমি কী রান্না করব’ আহির আকাশ থেকে পড়ল। মা তেড়ে আসলেন,

— ‘আমার আবার কি কাজ! সেই তো! রাজ্যের কাজ তো সব তোমাদের থাকবে, আমি তো হলাম গিয়ে সংসারের সবচেয়ে অকাজের মানুষটা! এত বয়স হলো এখনো যদি বল কী রান্না করব, তাহলে চলবে কী করে হ্যাঁ? পড়াশোনা নাই, চাকরি বাকরি নাই, সারাদিন ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়াচ্ছ, লজ্জা লাগেনা তোমার? দুটা রেঁধে দিলেতো তাও আমাদের কিছু উপকার হয়’

আহির বেসামাল গলায় বলল,

— ‘না মানে, বাড়ির বাইরে তো তোমার খুব একটা কাজ থাকেনা’

— ‘থাক আমার ব্যাপারে আর অত দাদাগিরি করতে এসোনা, যা বললাম তাই করোগে যাও, আজকের খাবারের যোগানটা তুমিই করো, তোমার বাবা বিকেল নাগাদ ফিরবেন, আর আশিক দুপুরে এসেই খেতে চাইবে

আহির বুঝলো মায়ের রাগ ধরে গেছে। রাগ ধরলে মা ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে যান। চমৎকার ভাবে কথাগুলো শুনিয়ে দিলেন মা। আহির যে দিন কে দিন একটা বোঝা বই অন্য কিছুই হচ্ছেনা সেই সত্যটা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বুকের চাপটা আরো বাড়ল আহিরের। পড়ার টেবিল থেকে উঠে রান্নাঘরে উঁকি মারলো। আজকে ঠিকা ঝি টা আসেনি। সব কাজ নিজেরই করতে হবে। মা বেরিয়ে গেল মিনিট দশেকের মধ্যে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে!

কাজ করতে গিয়ে দেখলো অতটা খারাপ লাগছেনা। বিষণ্ণ মনটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শীতকালে রান্নাঘরটা মোটামুটি আরামদায়ক থাকে। আহির ভাত চড়ালো চুলায়। বরবটি ভাজি করল। ডাল রাঁধল যত্ন করে, আর আলু দিয়ে মুরগীর মাংস। রান্না তখনও চুলায়। আর একটু হলেই মুরগীর মাংসটা নামিয়ে আহির গোসলে যাবে। ঠিক সেই সময় বিরক্তিকর ডোর বেলটা বেজে উঠল। একটা পাখি অনবরত টিউ টিউ করে ডাকতে থাকে। কানে লাগলেই কেমন গা রি রি করে ওঠে। পাখির ডাকও এত কর্কশ হয়!

ঘড়িতে দুটো। বাড়ির মানুষগুলো ফিরতে শুরু করেছে। মা অথবা আশিক হবে। দরজা খুললো আহির। বেশ চমকালো। তুষার দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ফুল হাতা ফর্মাল শার্ট, গলায় টাই। বোঝা যাচ্ছে অফিস থেকে এসেছে।

— ‘তুমি!’

— ‘হ্যাঁ, আমি!’

আহির বিব্রত বোধ করল। এই অসময়ে না বলে কয়ে কেউ আসে? তুষারের যদি একটু আক্কেল বুদ্ধি থাকত।

— ‘কী হলো, ভূত দেখার মতো চমকে উঠলে কেন?’

— ‘না, ইয়ে, শোনো তুষার, বাড়িতে কেউ নেই, আজকে তোমাকে ফিরে যেতে হবে’

তুষার এক গাল হাসলো, ‘বাহ, চমৎকার, তাহলে তো আর কথাই নেই, আজ শুধু তুমি আর আমি!’

— ‘না তুষার, তুমি চলে যাও, বাবা মা ফিরে এসে খালি বাড়িতে তোমাকে দেখতে পেলে ভীষণ মাইন্ড করবেন’

— ‘কেন যাবো? না আমি যাবনা! আমার বুঝি তোমাকে একলা পেতে ইচ্ছে করেনা?’

আহির শিউরে উঠলো। তুষারের গলার এই স্বরটা সে চেনে। এই ছেলেকে আজ ফেরাতে পারবে বলে মনে হচ্ছেনা। অসহায়ের গলায় বলল,

— ‘তুষার প্লিজ! এখন যাও, তুমি বরং বিকেলে এসো একবার

তুষার এবার ভারী তেজী ভাবে বলল, ‘কেন বলো তো তুমি সবসময় আমাকে কেবল দূরে ঠেলে দাও? এত দিন ধরে প্রেম করছি, আজ পর্যন্ত শান্তিতে তোমাকে একটিবার চুমু পর্যন্ত খেতে পারলাম না, রিকশায় কিছু করা যাবেনা, রাস্তায় না, নিজের বাড়িতে না, তুমি কী, মানে তোমার প্রবলেমটা কী বলতো?’

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কী সব হাবিজাবি কথা বলে যাচ্ছে তুষার। কেউ শুনে ফেললে? আহির ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আস্তে বলো, কেউ শুনবে!’

তুষার ডাকাতের মতো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল, ‘উঁহু, আজ আমি কোনো মানা শুনবো না, দু দিন পর তুমি আমার বিয়ে করা বউ হতে যাচ্ছ, এখনো এত কিসের বাঁধা শুনি?’

আহির নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘তুষার, লক্ষী আমার! একটু বোঝার চেষ্টা করো, আজ নয়, কদিন পরে, অন্য কোথাও! কথা দিচ্ছি!’

তুষার বাচ্চা ছেলের মতো হেসে বলল, ‘সত্যি? কথা দিচ্ছ? প্রমিজ?’ মায়া লাগলো আহিরের। নরম স্বরে বলল, ‘প্রমিজ!’

খবরটা দিল আশিক। তুষারের বাবা, মা দেশের বাড়ি গেছে, বরিশাল। দু দিনের জন্য হঠাৎ করেই। আশিক কী করে জানলো খবরটা? জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল তুষার নিজেই বলেছে আশিককে। আহির চট করে প্ল্যানটা করে ফেলল। আজ তাহলে তুষারকে সে সারপ্রাইজ দেবে। ঠিক যেমনটা তুষার দিয়েছিল তাকে সেদিন। যেহেতু তুষারের বাবা মা আজ কালের মাঝে ফিরছেন না তাই অন্য কোনো ধরনের ঝামেলা হবার সম্ভাবনা নেই।

সেই বিকেলে খুব যত্ন করে সাজলো আহির। একটা হালকা গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি পরল। গলায় কানে মুক্তোর গয়না। সুন্দর দেখাচ্ছিল আহিরকে। মনটাও বেশ ফুরফুরে। আজকে খুব চমকে দেবে সে তুষারকে! কিন্তু হায়! সে যদি জানত জীবনের সব চাইতে বড় চমকটা সেদিন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে আসে তুষার অফিস থেকে। আহির তুষারের বাড়ি পৌঁছে গেল সন্ধ্যের মুখে মুখে। বেল টিপলো বেশ কবার, কেউ দরজা খুললনা। প্রায় মিনিট সাতেক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আহির ক্রমাগত ডোর বেল চাপতে লাগল। তুষার বাড়ি আছে, এই খবরটা গার্ডদের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে। তাহলে এতক্ষণ লাগছে কেন দরজা খুলতে?

দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু তুষার নয়। দরজা খুললো একটি মেয়ে। কোথায় যেন দেখেছে আহির মেয়েটাকে। খুব চেনা! কিন্তু কে এই মেয়ে? তুষারের বাসায় তার কী কাজ? আহিরকে দেখে মেয়েটা ভালোই চমকালো। মুখে কোনো রা নেই। ঠোঁট দুটো হালকা ফাঁক করে সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আপনি?’

মাথাটা হঠাৎ টলে উঠল। পায়ের তল থেকে সরে যেতে থাকল মাটি। মনে পড়েছে আহিরের, মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে সে। সেই যে যমুনা ফিউচার পার্কে তুষারের সাথে ধাক্কা খেলো, হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে! কিন্তু এই মেয়ে এখানে কী করছে? কী করছে এখানে? তুষারের বাসায়? ফাঁকা বাসায়? পেছনে তুষারের মুখখানা দেখা গেল। বিস্ফারিত কন্ঠে তুষার বলল, ‘আহির তুমি!

আহিরের হাত পা কাঁপছিল। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে ঝড়ের মতো ঘুরে দাঁড়ালো। টল মল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকল। তুষার পেছন থেকে ডাকছিল, ‘আহির! শুনে যাও, শুনে যাও বলছি!’

কান্নার একটা স্রোত আহিরের, গাল বেয়ে গড়িয়ে গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে তখন। তুষার তাকে ঠকিয়েছে! এত বড় ধোঁকা!

২১

ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল অয়ন। ওর পেছন পেছন আয়শা আর দাদীমা। বাবার ঘরটা ফাঁকা। মেঝেতে পড়ে আছে শেকলটা। ঘরের জানালা বন্ধ দরজাও বন্ধ ছিল। কী করে উধাও হয়ে একটা জলজ্যান্ত মানুষ?

অয়ন মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। আজ কি তবে সে সত্যিকার অর্থে পিতৃহারা হলো? পাগল হোক অপ্রকৃতস্থ হোক, যেমনি হোক না কেন ওই মানুষটার জন্যই অয়নের বার বার এ বাড়িতে ফিরে আসা। আজ কি তবে এ বাড়ি থেকে তার শেষ পিছুটানটিও নিশ্চিহ্ন হলো?

পুরো বাড়িতে খুঁজে দেখা হলো। বাবা নেই। থানায় জানানো হয়েছে। পুলিশও খোঁজা শুরু করেছে। আয়শা তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক এর মাঝেই লাগিয়ে দিয়েছেন তার স্বামীকে উদ্ধারের কাজে। দাদিমা গলা ফাটিয়ে কাঁদছেন। অয়ন শুধু নির্বাক ছিল। এক আকস্মিক নাম না জানা শোক যেন তাকে পাথর করে দিয়েছে।

অনেক রাত অবধিও বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন কাকডাকা ভোর। অয়নের মনে হলো এ বাড়িটির প্রতি তার আসলে আর কোনো দায় নেই। বাবা কোনো একভাবে না থেকেও তার সমস্তটা জুড়ে ছিল। এ বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে শুধু তার বাবারই স্মৃতি। পরিবারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কিছু টাকা ছিল দাদীমার কাছ থেকে পাওয়া। তাই নিয়ে বেরুলো সে। খোলা আকাশটা টানছিল তাকে। চার দেয়ালের বন্দী ঘরটায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

২২

আহিরের মুখ খানা দেখে মা চমকে উঠলেন,

— ‘একি! কী হয়েছে তোর?’

আহির কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বসার ঘরে আশিক আর তার এক বন্ধু খুব ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা করছে। আহিরকে দেখেই আশিক কলকলিয়ে বলে উঠল,

— ‘বুবু, দেখ আমার কম্পিউটার চলে এসেছে, তুষার ভাই পাঠিয়ে দিয়েছে’।

কথাটা শুনে আহির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। চকিতে একবার তাকালো টেবিলের ওপর রাখা জাদুর বাক্সটার দিকে। তার মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল। এক ছুটে পালিয়ে গেল নিজের ঘরে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। আর না! কোনো দিন না! আর কোনোদিন সে কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করবেনা। ছিঃ! পুরুষ মাত্রই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর আর কামুক! এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা! আহির কী বোকা! কী ভীষণ বোকা! সেদিন যমুনা ফিউচার কী পার্কে মেয়েটার সাথে দেখা হবার পরেও কিছুই ঠাওরে উঠতে পারেনি সে। পাপ করেছিল আহির? বিধাতা এ কোন পাপের শাস্তি দিলেন তাকে?

দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা পড়ছে। মা ডাকছেন, বাবা ডাকছেন, আশিক ডাকছে। আহির শুনতে পাচ্ছে সবই। কিন্তু নড়তে পারছেনা, কিছু ভাবতে পারছেনা। তার ভেতর বাহিরে, সমস্ত শিরা উপশিরায় এক প্রবল বিদ্রোহের সুর বেজে উঠছে। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো ওরা তিনজন। আহির বালিশে মুখ গুঁজে ছিল। মা এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বলল, ‘কিরে কী হয়েছে? কিছু হয়েছে কি?

আহির নড়লনা। কিছু বলল না। একটু বাদে বাদে শুধু কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তার শরীর। মা একটা সময় বাকিদের বললেন, ‘তোমরা একটু এসো তো, আমি দেখছি ওকে’।

বাবাই আর আশিক বাধ্য ছেলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা একটু সময় দিল আহিরকে স্বাভাবিক হবার। আহির অবশ্য সে রকম অর্থে স্বাভাবিক হলোনা, শুধু কান্নাটা একটু ধরে আসলো।

— ‘আহির, মা আমার, কী হয়েছে বল তো! তুষারের সাথে আবার ঝগড়া করেছিস?’

আহির উঠে বসলো শোয়া থেকে। মাকে ঘটনাটা খুলে বলতে হবে। না, এত বড় ঘটনা সে চেপে রাখতে পারবে না।

— ‘না, মা ঝগড়া নয়, এবারে সব কিছুই চুকে বুকে গেল, তুষারের সাথে আর আমি নেই’

মা আঁতকে উঠল, ‘কী বলছিস? কেন?’

আহির পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। মায়ের মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। বেশ খানিক্ষণ মা কোনো কথা বলতে পারলোনা। আহিরের কষ্ট হলো মায়ের জন্য। সে জানে তুষারকে ঘিরেই তাদের পরিবারটা একটা স্বপ্ন বুনতে যাচ্ছিল। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আহির তুষারকে বিয়ে করে একটা পরিচ্ছন্ন সংসার করবে।

যে সংসারের অভিধানে অন্তত অভাব বলে কোনো শব্দ থাকবেনা। আহিরের চোখ উপচে জল গড়িয়ে আসলো। আহা! বাবা মায়ের এই একটি স্বপ্ন ও সে পূরণ করতে পারলো না, সংসার যে তার আর কোনো দিন হবেনা, সে যে জীবনে আর কখনো কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবেনা! শেষ হয়ে গেল, সব কিছু শেষ হয়ে গেল।

মা একটা সময় বলল, ‘তুই কী বলছিস? ছেলেটা তোকে এত ভালোবাসতো! সেই ছেলে কী করে এমন করে? হ্যারে, তুই ঠিক দেখেছিস তো?’

আহির কিছু বললনা। ওর চোখ থেকে শুধু কয়েক ফোটা জল গলা বেয়ে বুকে নেমে আসলো।

একটু বাদেই বাড়িতে তুষার এসে হাজির হলো। আহির দরজা খুললনা। মা একবার ডাকতে আসলেন। আহির কঠোর স্বরে শুধু একবার বলল, ‘মা! মরে গেলেও আমি ওই ছেলের সাথে দেখা করব না, তুমি ওকে চলে যেতে বল!’

এরপর তুষার গেল না থাকলো আহির তার কিছুই জানেনা। সে গুম হয়ে বসে রইলো। কতক্ষণ কে জানে, একটা সময় দরজার ওপাশ থকে বাবাইয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘আহির মা, দরজা খোল!’

বাবাইয়ের মুখটা ভারী শুকনো। আহিরের মন কেমন করে ওঠে। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠে হৃদপিন্ডের ওপর চেপে বসে। বাবাই বলল, ‘একটু খাবি আয়’।

আহির পাল্টা কোনো কথা না বলে পেছন পেছন এগিয়ে আসলো। ডাইনিং টেবিলে বসে প্লেটে ভাত তুলে নিলো। খাওয়ার পাট-টা চুকে বুকে গেল নির্ভেজাল ভাবেই। রাতে শুতে যাবার আগে বাবাই তার ঘরে ডেকে পাঠালেন আহিরকে।

— ‘বোস মা, আমার পাশে এসে বোস’ আহির বসলো। বাবাইয়ের পাশে মা কায়দা করে বসে পান চিবুচ্ছে। আহির জানে বাবাই এখন যা বলবে তা একটু আগে মা বাবাকে পই পই করে মুখস্থ করিয়েছেন। বাবাই এখন সেই মুখস্থ বিদ্যা খুব ভালোভাবে আওড়াবেন। আহির কান পাতল।

— ‘আমি সবই শুনেছি, তোর মায়ের কাছে শুনলাম, তুষার ছেলেটাও এসেছিল, ওর সাথেও কথা হলো’ এটুকু বলে বাবাই থামল। আহির কিছু বলল না। চোখ দুটো নিচের দিকে নামিয়ে রাখল।

— ‘শোন মা, আমি বলছিলাম কি, ভুল তো মানুষই করে তাইনা? মানুষকে ভুল শোধরানোর সুযোগ দিতে হয়। আর সেই সুযোগটা মানুষই মানুষকে করে দেয়।’

আহির চমকে তাকালো বাবাইয়ের দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। এ কথাগুলো বাবাই বলছে? আহির হতবাক গলায় বলল,

— ‘তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছিনা, তোমরা কি বলছ এই এত বড় একটা ঘটনার পরেও আমি ওই ছেলেকে ক্ষমা করে দেই? ওকে বিয়ে করি?’

বাবাই একটু হোঁচট খাওয়া গলায় বলল, ‘না আসলে, ছেলেটা অনেক কান্নাকাটি করেছে, সে বাস্তবিকই তোকে ভালোবাসে’

— ‘অসম্ভব! এগুলো সব ওর নাটক, আমাকেই যদি ভালোবাসতো তাহলে ওই মেয়ের সাথে কী করছিল? সেই প্রশ্ন করোনি তোমরা?’

— ‘মানুষ মাত্রই ভুল করে মা, ক্ষমা করে দিতে হয়, ছেলেটা এমনি মাটির মানুষ, বড় অমায়িক!’

আহির ঘেন্না জড়ানো গলায় বলল, ‘তোমার মেয়েকে যে এভাবে ধোঁকা দিল, তাকে তুমি অমায়িক বলছ! বুঝতে পারছিনা, তুষার কি তোমাদেরকে তাবিজ টোনা করলো নাকি?’

মা এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘শোন আহির, তুষারের সাথে আমাদের অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, সে নাকে খত দিয়ে বলেছে, এরকম ভুল আর জীবনেও হবেনা,

— ‘আমি বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস ভেঙে গেছে মা, কাঁচের টুকরোর মত ঝন ঝন করে ভেঙে গেছে, আর জোড়া লাগবেনা’

মা এবার একটু ধমকের সুরে বলল, ‘পাগলামো করিস না আহির! এই সম্বন্ধ ভেঙে গেলে আর কোনো ভালো সম্বন্ধ আসবেনা তোর জন্য, আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালোনা, তুই তো সব জানিস, তুষারের মতো একটা যোগ্য ছেলেকে পায়ে ঠেলে দিবি, বলি কোন রাজপুত্র অপেক্ষা করছে তোর জন্য?’

— ‘অসম্ভব! এমন দুশ্চরিত্র লোককে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না’

— ‘সংসারে কয়টা লোক চরিত্রবান হয় শুনি? মেয়েদের জীবনটা এমনই, মানিয়ে চলতে হয়, আর তুষার আমাদেরকে বলেছে মেয়েটা তার আত্মীয়া ছিল। এরপরও তুই এতটা বাড়াবাড়ি কেন করছিস শুনি?’

আহির উঠে পড়ল। মাথার ভেতরটা এলোমেলো লাগছে। কিছু ভাবতে পারছেনা সে। সে রাতে ঘুম হলোনা। খুব ভোরের দিকে আহিরের হঠাৎ মনে হলো, এই পরিবারের মানুষগুলো আসলে প্রকৃত অর্থে তাকে ভালোবাসেনা। সবাই কেবল নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন। সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই এই পরিবারের মানুষগুলো ও শুধুই সামাজিক। আত্মিক সম্পর্ক বলে আসলে কিছু নেই এদের সাথে তার। তখন কাকডাকা ভোর। আহির একটা ব্যাগে দু’তিনটা কাপড় আর সাতশটা টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে জানেনা কোথায় যাবে। শুধু মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে না পারলে সে মরে যাবে।

২৩

ট্রেনটা যখন হেলে দুলে চলতে শুরু করল আহির তখনও জানেনা সে কোথায় যাচ্ছে। বাসা থেকে বের হবার আগে শুধু মাকে একটা চিরকুট লিখে এসেছিল,

— ‘মা, আমি কয়েকটা দিন বাড়ির বাইরে থাকব। এখানে, এই চার দেয়ালের ভেতরে আমার দম আটকে আসছে। কতদিনের জন্য যাচ্ছি জানিনা। কোথায় যাচ্ছি তাও জানিনা তবে কথা দিচ্ছি ফিরে আসব। তোমরা ভালো থেক।

আহির বসেছে জানালার পাশে। মাঘ মাসের সকালের ঘন, পুরু কুয়াশার সাদা চাদর ভেদ করে ট্রেনটা হুইসেল ছেড়ে এগিয়ে চলেছে। জানালা দিয়ে শন শন করে ধেয়ে আসছে হিম জড়ানো শীতল হাওয়া। বহুদিন এমন ভোর দেখেনি সে। নাক, কান, গলা সব ঢেকে ফেলেছে একটা মোটা শাল দিয়ে। শালটা মায়ের। বড় ফুপু গত বছর এনে দিয়েছিলেন কাশ্মির থেকে। মায়ের শাল থেকে একটা মা, মা গন্ধ আসছে। অথচ মা এই শালটা পরেছে খুব কম। তবুও মনে হচ্ছে যেন মাকে খুব কাছ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। আহির একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ঘুম থেকে উঠে মা চিরকুটটা আবিষ্কার করার পর কী হবে? খুব ভেঙে পড়বে কি? হাউ মাউ করে কাঁদবে কি? আহির চোখ জোড়া বন্ধ করল। সারা রাত ঘুম হয়নি বলেই হয়তো মাথাটা ধরেছে এখন। কপালের দুপাশের রগ টনটন করছে।

চোখে মুখে একটু পানির ঝাপটা দেবার জন্য ওয়াশরুমের খোঁজে উঠে দাঁড়ালো। বগির একেবারে শেষ মাথায় টয়লেট। হেঁটে অপর বগিতে যাবার প্যাসেজের বাম পাশের দরজাটা খোলা। সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। কানে তালা পড়ে যাবার উপক্রম। বাতাসে হেলে দুলে উঠছে ভারী লোহার পাল্লা। দরজার কাছেই একটা লুঙ্গি পরা লোক, দাঁড়িয়ে আছে হাতে বিড়ি নিয়ে। আহির সেখানটায় যাওয়া মাত্র একটা বিশ্রী নজর দিল সে। গা গুলিয়ে উঠল। ভাগ্যিস টয়লেট ফাঁকা পাওয়া গেল। নইলে এই খাচ্চর লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল টয়লেট থেকে বের হবার সময়। ছিটকিনিটা খুলে দরজা টান দিতে গিয়েই দেখা গেল দরজা আটকে গেছ। খুলছেনা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল। ট্রেনের দুলুনিতে পা টলছে আহিরের, ঘুরছে মাথা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোহার পাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছে সে। পারছেনা। হায় খোদা, এখন কী হবে? কী করে বেরোবে আহির? দরজাটা খোলা যাচ্ছেনা কেন? সে প্রাণপনে চেঁচালো কয়েকবার, ‘এই যে! কে আছেন? দরজাটা খুলুন প্লিজ!’

চারপাশে শুধু ইঞ্জিনের সাঁ সাঁ গোঙানির শব্দ। গর্জনের তোড়ে আহিরের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। ঘামতে লাগল সে। ঘন কুয়াশার হিম জড়ানো সকাল বেলায় দর দর করে তার কপাল পেয়ে ঘাম ঝরতে থাকল। চোখ ফেটে গড়িয়ে আসলো জল। একটা সময় সে দরজার হাতল ছেড়ে দিয়ে হত বিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কতক্ষণ কে জানে। দরজাটা কেউ একজন খুলল। দরজার বাইরে এক যুবক দাঁড়িয়ে। লম্বা শরীর, গায়ে চাদর জড়ানো। আহির ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসলো। ট্রেনের দুলুনীতে টালমাটাল হলো সে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার গায়ের ওপর প্রায় ছিটকে পড়তে যাচ্ছিল। সামলে নিল নিজেকে। ঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে তাকালো মানুষটার দিকে। তাকানো মাত্রই মনে হলো আগে কোথাও দেখেছে সে মুখটা। এই চোখ জোড়া। মনে হয় যেন এই জন্মে না আর জন্মের কোনো এক সময় এই মানুষটার সাথে ছিল তার গভীর কোনো সখ্যতা!

বিস্মিত নয়নে চেয়ে আছে অয়ন আহিরের দিকে। বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে এই মেয়েটা ভেতরে কী করছিল? বাইরে থেকে দোরটা লাগালোই বা কে? আহিরও চোখ জোড়া ছানাবড়া করে অয়নের চোখে চোখ রেখে মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।

— ‘ইটস ওকে, কুল ডাউন, আপনি এখন নিরাপদে আছেন, আর ভয় নেই’

অয়ন আহিরকে আশ্বস্ত করতে চাইল। ট্রেনের ঝিক ঝিক গর্জনের মাঝে যদিও অয়নের কথাগুলো অস্পষ্ট শোনালো। আহির কয়েক মিনিট সময় নিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ঢুলতে ঢুলতে পা বাড়ালো সামনে, নিরুত্তাপ গলায় অয়নকে বলল,

— ‘দরজাটা কি বাইরে থেকে আটকানো ছিল?’

— ‘হ্যাঁ, আমি তো এসে তাই দেখলাম!’

আহির অবাক হলো। খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিগারেট হাতের লোকটাই কি তাহলে এই কাজ করেছে? কিন্তু কেন? তাকে বাথরুমে আটকে রেখে তার লাভটা কী হলো? কী আশ্চর্য আর বিকৃত মানসিকতা! আহির অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না।

টলমল পায়ে এগিয়ে চলল নিজের সিটের দিকে। পেছনে অয়নও। আহির সিটের কাছটায় এসে আবিস্কার করলো তার বসার জায়গাটা এর মাঝেই দখল হয়ে গেছে। পাশের সিটের মহিলার দশ বারো বছরের বাচ্চাটা পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে মায়ের কোলে মাথা রেখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যেহেতু কোনো টিকেট নেই তাই ওই সিটের মালিকানা প্রমাণ করার কোনো উপায় আহিরের কাছে নেই। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে দিতেও এই মুহূর্তে বিবেকে বাঁধছে। মহা ঝামেলায় পড়া গেল!

অয়ন আহিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি, কোনো সমস্যা?’

আহির বলতে গিয়েও কিছু বললনা অয়নকে। চুপ করে রইল। অয়নই কথা বলল আবার, ‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলেন যে? আপনি বসেছেন কোথায়?’

আহির হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল। অয়ন সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওহ! আপনার সিট তো দখল হয়ে গেছে!’ ঠিক সেই সময় আহিরের মাথায় ব্যাপারটা ক্লিক করল। এই ছেলে এখন টিকেটের খোঁজ করলেই তো সে পড়বে মস্ত বিপাকে। টিকেট ছাড়া ট্রেনে উঠে পড়ার কারণ কী করে বোঝাবে সে এই ছেলেটাকে? সে জানে তুষারের সাথে এর ভালো যোগাযোগ আছে। হুট করে যদি ফোন দিয়ে তুষারকে কিছু জানিয়ে দেয়? যদিও ছেলেটা বেশ পাগল আছে। আহির শুনেছে এর সাথে কখনো মোবাইল টোবাইল থাকেনা। সর্বদাই সে আউট অফ নেটওয়ার্ক থাকতে পছন্দ করে।

আহির অয়নকে আর ব্যাপারটা নিয়ে না ঘাটাতে দিয়ে নিজেই এগিয়ে গিয়ে মহিলাটির সাথে কথা বলল। মহিলা কিন্তু নির্দ্বিধায় ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে ফেলল। আহির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ধপ করে বসে পড়ে তাকালো একবার অয়নের দিকে। অয়নের চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। খুব আপনজন হারালে মানুষের চেহারায় যেমন একটা চাপা হাহাকার লুকিয়ে থাকে, অয়নের মুখ খানায় সেই হাহাকারটা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়ে আছে। দেখলে মায়া লাগে। আহির গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষারের কাছে অয়নের গল্প শুনে মনে হয়েছিল একদিন ছেলেটাকে সামনাসামনি পেলে খুব করে শুনবে ছেলেটার জীবনের গল্পগুলো। কেন সে এতটা ছন্নছাড়া, কেন এই উদাসীনতা? কী এমন ঘটনা ঘটেছে তার জীবনে যা তাকে এমন উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছে, কিন্তু হায় আজ দেখা হলো এমন একটা সময়ে, যখন এ পৃথিবীর আর কোনো খবরই আহিরকে ভাবান্বিত করে তুলবেনা। হোক না সেটা যতই চমকপ্রদ। আজ আর কোনো কিছু নিয়েই তার কোনো কৌতূহল নেই। শেষ, সব শেষ। তবুও সে জোর করে একটু হাসলো অয়নের দিকে তাকিয়ে। অয়ন হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে একটু উঁচু গলায় কথা বলল, যেন ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে ওর কথা গুলো আহিরের কান পর্যন্ত যায়, ‘আপনি… আপনি তুষারের গার্লফ্রেন্ড না?’

প্রশ্নটা শোনা মাত্র দপ করে নিভে গেল আহির, ম্লান গলায় বলল, ‘গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। এখন আর নেই!’ কথাটা বলেই মনে হলো, যাচ্চলে, এই মুহূর্তে এই তথ্যটা দেবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। মাঝে মাঝে নিজের বোকামিতে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে যায় সে।

অয়ন একটু ভড়কালো। সে বুঝতে পারলনা এ ধরনের একটা খবর শোনার পরে আসলে কী বলা উচিত! তুষার এই মেয়েটাকে এত বেশি ভালোবাসতো যে খবরটা সত্যি অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তা ছাড়া অয়ন যতটুকু জানে মেয়েটাও বেশ সিরিয়াস ছিল এই সম্পর্কটি নিয়ে। হঠাৎ এমন কী হলো? হয়তো সাময়িক ঝগড়া। সে যাই হোক, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোটা অয়নের ধাতে নেই। সে শুধু একবার বলল, ‘ও!’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলার মতো সহজ সম্পর্কও আসলে মেয়েটির সাথে তার নেই। তাই এটুকু বলে থেমে যাওয়াই উত্তম। আহির মুখ ফিরিয়ে নিল জানালার দিকে। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা। তুষারের কানে খবর চলে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। সে চাইছেনা আপাতত কেউ তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করুক।

নতুন একটা দুঃশ্চিন্তা পেয়ে বসলো তাকে। এই ছেলে তুষারকে আবার ফোন করে কিছু বলে বসবে নাতো? নাহ, আর কোনো দুশ্চিন্তা করতে চায়না সে। মুক্তি চায়, মুক্তি! বাইরে কুয়াশায় আবছা দিগন্তের দিকে চোখ রেখে সে আজ মনের মাঝে প্রবল এক মুক্তির আস্বাদ টের পায়। এই মাঘ মাসের কুয়াশা ভেজা ভাঙাচোরা ট্রেনের কামরায় আজ সে মুক্ত, বিহঙ্গ। কিন্তু একা, বড্ড একা। সম্পর্কগুলো থেকে মুক্ত হলেই কি মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা পায়? সম্পর্কের পিছুটানই কি মানুষকে সর্বদা বন্দী করে রাখে? একটা মানুষ কি কখনো সম্পূর্ণভাবে সকল সম্পর্কের ঊর্ধে যেতে পারে? হয়তো পারে, মানুষ হয়তো মানবিক সম্পর্কগুলো, চাওয়া পাওয়া গুলো অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সাথে যে সম্পর্ক তার জন্ম জন্মান্তরের জন্য হয়ে গেছে সেই সম্পর্ককে কী করে অস্বীকার করবে? পৃথিবীর সাথে মানুষের যে আশ্চর্য বাঁধন, সেই বাঁধনের ঊর্ধে কে কবে যেতে পেরেছে? বাপ মায়ের থেকে পালানো যায়, সংসার ছেড়ে পালানো যায়, এমনকি নিজের থেকে নিজেও পালিয়ে বেড়ানো যায়, কিন্তু এই পৃথিবীকে ধোঁকা দিয়ে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া। কিন্তু মৃত্যু তো কখনো মুক্তি হতে পারেনা। মৃত্যু মানে সমাপ্তি। সমাপ্তি কি কখনো স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে? কে জানে! হয়তো মৃত্যুতেই সত্যিকারের মুক্তি মেলে মানুষের অন্তরাত্মার!

২৪

ট্রেনে উঠলেই অয়নকে টইয়া ভূতে পায়। সে এক বগী থেকে অন্য বগীতে অনবরত ঘুরে বেড়ায়। কোথাও স্থির হয়ে বসতে চায়না। আউল বাউল পাগল মনটায় আরো দুটো পাখনা বেশি গজিয়ে ওঠে। ছটফট করতে থাকে। এদিকটায় একটা সিট খালি পেয়ে সে বসলো একটু। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ছটা। আকাশ পিঙ্গল। রুক্ষ বাতাসের সাথে ধুলোর মিছিল চারপাশে। অয়ন তবুও জানালা ঘেষে বসলো। বাতাসের ধারালো ঝাপটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায় মনের ভার কিছুটা কমে আসছে। কোন লোহার বোঝা যেন কেউ তার বুকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে। একটা সংকেত টের পাচ্ছে অয়ন। মন বলছে বাবা আর ফিরবে না। প্রকৃতি কোনো এক রহস্যজনক উপায়ে মানুষের মনের দুয়ারে কিছু খবর পৌঁছে দেয়। সবাই সেই খবর টের পায়না। এই সুবিশাল প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের ভেতরের মনটার কোথায় যেন একটা যোগাযোগ আছে, একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা হঠাৎ হঠাৎ টের পায় অয়ন। আজও পাচ্ছে, বাবা ফিরবেনা, বাবা আর ফিরবেনা কোনো দিনও। কোথায় গেল বাবা? এই অসহায় পাগল অসুস্থ লোকটা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা?

বুক পকেটে হঠাৎ একটা কম্পন অনুভূত হলো। অয়ন চমকে উঠল। হাত দিয়ে দেখল মোবাইলটা বাজছে। এই ভুলটা অয়ন করলো জীবনে প্রথমবারের মতো। বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর সময় কখনো মোবাইল সাথে রাখেনা সে। আজ ঘটনার আকস্মিকতায় খেয়ালই ছিলনা এই যন্ত্রনাদায়ক যন্ত্রটাকে বাড়ি ফেলে আসার কথা। স্ক্রীনে অচেনা নম্বর। অয়ন রিসিভ করল না। টানা অনেকক্ষণ রিং টোন বেজে থামল। ফোনটা সুইচ অফ করতে যাবে ঠিক সে সময়ই স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা মেসেজ। লেখা,

‘প্লিজ, আনসার দা কল, ইমার্জেন্সী! তিয়ানা’

সেকেন্ড না গড়াতেই আবার বেজে উঠল রিং টোন। অয়ন কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকল মোবাইলটার দিকে। অনীহা নিয়ে ফোনটা ধরল। কে জানে হয়তো কোনো বিপদে পড়ে ফোন করেছে। ইমার্জেন্সী বলল যেহেতু।

— ‘অয়ন!’

  • ‘হুম তিয়ানা, বলো’

— ‘অয়ন আপনি কোথায়? আমি গত একটা সপ্তাহ ধরে আপনাকে খুঁজছি বাট রিচই করতে পারছিনা আপনাকে, আপনি কী বলুনতো!’

তিয়ানা বড্ড চেঁচাচ্ছে। ট্রেনের শব্দে এমনিতেই কানে তালা লাগার উপক্রম। অয়ন বিরক্ত গলায় বলল,

— ‘হুম’

— ‘হোয়াট হুম? অয়ন? আপনি ভীষণ খারাপ! আপনার বন্ধু আপনাকে খুঁজে চলেছে দিনের পর দিন আর আপনি লাপাত্তা!’

বন্ধু! শব্দটা কানে লাগলো অয়নের। ও হ্যাঁ, তিয়ানা তো তার সাথে কোনো এক রকমের বন্ধুত্ব করেছিল। সেই বন্ধুত্বের দাবীতেই এত বক বক! ওরে বাবা! অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। বোকার মতো চুপ করে রইল।

— ‘অয়ন!’

— ‘হুম!’

— ‘আজ বিকেলে মিট করুননা আমার সাথে, প্লিজ!’

— ‘তিয়ানা, আমি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি আজ, সম্ভব না’

— ‘কী বলছেন? কেন?

— ‘কাজে’

— ‘কী কাজ?’

— ‘উফ! এত প্রশ্ন করছ কেন? তোমার কী হয়েছে তাই বল, দেখা করতে চাইছো কেন?’

তিয়ানা একটু চুপ করে থেকে আহত কন্ঠে বলল,

— ‘আপনার কী হয়েছে অয়ন? ইজ এভরিথিং অলরাইট?

— ‘আবার শুরু হয়েছে পাকামো, তোমার প্রবলেমটা কী বলতো? সরাসরি উত্তর দিতে পারোনা? কী চাই তোমার? কেন মিট করতে চাও?’

— ‘বারে!, বন্ধুর সাথে বন্ধুর কি দেখা করার জন্য কোনো কারণ লাগে? আমার বুঝি আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হয়না? আর আপনার? আপনার কি আমাকে কখনো দেখতে ইচ্ছে করেনা?

— ‘উফ! তিয়ানা, কাম অন! আমার কখনো কাওকে দেখতে ইচ্ছা করেনা! ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনা, আমি একটা অমানুষ… বুঝতে পেরেছ?

তিয়ানা ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল, অয়ন শুনতে পেলনা। শোনার চেষ্টাও করল না। ফোনটা কেটে দিল। এরপর একেবারে সুইচড অফ। উঠে দাঁড়ালো সে। নিজের সিটে ফিরে যাওয়া দরকার। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ক্ষিদেও পেয়েছে হালকা। পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে হয়তো দিন পনেরো চলা যাবে। ট্রেনটা যাচ্ছে চিটাগাং। কক্সবাজারের ওই ছোট্ট দ্বীপটা টানছে তাকে। সীমাহীন জলরাশির উপর ভেসে থাকা এক টুকরো দ্বীপ মহেশখালী। অয়নের ভারি পছন্দের জায়গা। অয়ন ফিরে যাচ্ছিল। ফেরার সময় আবার সেই মেয়েটার সাথে দেখা। টিকেট কালেক্টারের সাথে কী নিয়ে যেন বাদানুবাদ হচ্ছে। পাশে বসে থাকা পরিবারটা এখন নেই, খুব সম্ভবত আগের স্টেশনে নেমে গেছে। অয়ন একটু কাছে যেতেই শুনতে পেল, টিকেট চেকার বলছে, ‘আপনি নামবেন কোথায়?’ মেয়েটা ইতস্তত করছে, উত্তর দিতে পারছেনা। লোকটা আবার একই প্রশ্ন করলো, এবার অনেকটা ধমকের সুরে। মেয়েটা ভারী নিষ্পাপ গলায় বলল, ‘এই… এই ট্রেনটা যাচ্ছে কোথায়?’ আসেপাশে যতগুলো কান এই বাক্যটি শুনতে পেল তারা প্রত্যেকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো মেয়েটার দিকে। টিকেট চেকার মনে হল একা মেয়েমানুষ বুঝতে পেরে এবার একটু আমোদ আমোদ আঁচ পেতে লাগল। সে হো হো করে ডাকাতের মতো হেসে উঠে বলল, ‘কই যাইতাসেন সেইটাই জানেন না? আপনের মাথা ঠিক আসে তো ম্যাডাম?’ পাশের সিটে বসা কয়েকজন অল্প বয়স্ক ছেলে বিষয়টায় ব্যাপক বিনোদন খুঁজে পেল। একজন বলে উঠল, ‘মেন্টাল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছে নাকি?’ বাকিরা তার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

— ‘কী ব্যাপার? হচ্ছেটা কী এখানে?’

টিকেট চেকার অয়নের দিকে তাকালো, ‘আপনি কে?’

— ‘আগে বলুন, এখানে হচ্ছেটা কী?’

— ‘কী আর হবে, এই মেয়েটা টিকেট ছাড়া উঠেছে, তার ওপর এটাও বলতে পারছে না যে সে যাচ্ছেটা কোথায়! একলা মেয়েছেলে নিয়ে এখন কী মুশকিলে পড়লাম বলেন!

— ‘এত মুশকিলের কী আছে? উনার কাছ থেকে টিকেটের টাকা নিয়ে নিন এখন, ব্যাস হয়ে গেল তো!’

— ‘না মশাই এত সহজ না, উনি টিকেট ছাড়া উঠে যাবেন, একা একা, শেষে একটা কেলেঙ্কারী ঘটে গেলে দায়িত্ব নেবে কে?

— ‘আপনার অত ভাবা লাগবেনা, উনি একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মানুষ, একা নাকি দোকা, সেটা সম্পূর্ণ উনার নিজস্ব ব্যাপার, আপনি টাকা নিয়ে কেটে পড় ন!’

লোকটা মুখ সুঁচালো করে অয়নের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনি কে? আপনি কি উনার সাথে আছেন? আপনার টিকেট কই, দেখি?’

— ‘আরে, মিয়া আপনি খালি খালি প্যাঁচ করতেসেন কেন, বললাম তো টাকা নিয়ে কেটে পড়েন!’

অয়ন নিতান্তই দেখতে লম্বা চওড়া, সুঠাম দেহী এবং সচরাচর বাঙালী পুরুষদের মতো নয় বলে অপরিচিত লোকেরাও তাকে খানিকটা সমঝে চলে। ভারি গম গমে গলায় দু একটা কড়া কথা বললেই সাধারণ লোকেরা একটু ভয় পেতেও আরম্ভ করে। এই লোকটাও একটু ভড়কালো। আহিরের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা ছাড়ল। আহির টাকাগুলো দেবার সময় প্রমাদ গুনছিল। বাসা থেকে বের হয়েছে মোটে সাতশো টাকা নিয়ে। এর মাঝে চারশো টাকাই চলে গেল এই টিকেটের পেছনে। কী করে চলবে সামনের দিনগুলো?

আশেপাশের লোকগুলো যারা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে তামাশা দেখছিল এবং নানা রকম মশকরা করছিল, তাদের মধ্যেই একজন বলে উঠল, ‘খাইছে! নায়কের আবির্ভাব!’

আরেকজন বলল, ‘আরে, বয়ফ্রেন্ড মনে হয়, দুইজন মিলা বাড়ি থিকা পালায় আসছে!’

অয়ন দাঁত মুখ খিঁচে শুনছিলো সব আর আহিরের দিকে বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে ছিল। আহির অপ্রস্তুত হাসলো সেদিকে তাকিয়ে। অয়ন হাসলোনা। হেঁটে এসে আহিরের মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে, মাথাটা আহিরের দিকে ঝুঁকিয়ে এনে চাপা গলায় বলল, ‘কী ম্যাডাম? কেসটা কী?’

আহিরের চুলগুলো হাওয়ার ঝাপটায় বড্ড এলোমেলো হয়ে ছিল। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আহির বলল, ‘কই, কিছুনা!’

অয়ন বিরক্ত হলো, ‘কোনো কারণ ছাড়াই না জেনে, না শুনে একটা ট্রেনে উঠে গেলেন? আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?’

আহির চুপ করে রইল। দৃষ্টি রাখলো জানালার বাইরে। চারিদিকে ধূলোমাখা সবুজ। শুকনো পুকুর আর খাল। প্রকৃতি বড় জরাজীর্ণ এখন অনেকটা তার নিজেরই মতো। আহির চুল বেঁধে নিয়ে পুরো মাথাটা পরনের চাদর দিয়ে ঢাকলো কপাল পর্যন্ত। মুখের ওপর খেলছে হাওয়ায় তির তির করে কাঁপা শীতের সকালের মিষ্টি রোদ।

— ‘আচ্ছা! আপনার নামটা যেন কী?’

— ‘আহির’

— ‘মিহির?’

— ‘আহির!’

— ‘সরি?’

আহির কটমটে চোখে তাকালো অয়নের দিকে, ‘আপনি সত্যিই বয়রা? নাকি বয়রা সাজার ভান করছেন?’

— ‘না, সিরিয়াসলি! আমি বুঝতে পারছিনা’

আহির এবার কাটা কাটা গলায় বলল, ‘আহির দিলশাদ! অয়ন যেন খুব বোঝা বুঝেছে এমন ভাবে ঠোঁট দুটো গোল করে বলল, ‘ও!’

এরপর একটু থেমে বলল, -’আহির দিলশাদ, কী কিছু বলছেন না যে? আমি কি তুষারকে একটা ফোন করব?

কথাটা কানে ঢোকা মাত্র আহির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকলো অয়নের দিকে, উত্তেজিত গলায় বলল ‘কী আশ্চর্য! কেন?

— ‘কেন আবার? আপনি একটা বিপদে পড়েছেন, ওকে জানানোটা কি জরুরী নয়?

— ‘না জরুরী নয়, ভারি অবাক কান্ড! আপনি সেই তখন থেকে তুষার তুষার করছেন কেন বলুন তো?’ অয়ন কী বুঝলো কে জানে। খানিকক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে স্মিত গলায় বলল, ও আচ্ছা! তাহলে আপনার আম্মার নম্বরটা দিন, উনাকে ফোন দিয়ে বলি’

আহির ঝগড়াটে ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল, ‘বলবেনটা কী শুনি?’

— ‘বলবো যে আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, আউলা বাতাসে পাইছে আপনাকে। কিছু না জেনে শুনেই একটা ট্রেনে উঠে পড়েছেন, আপনার সম্মুখে এখন সমূহ বিপদ।’

— ‘কে বলেছে আপনাকে আমার সম্মুখে সমূহ বিপদ? হ্যা? কেন নাক গলাচ্ছেন আমার ব্যপারে?’

অয়ন অপ্রস্তুত হলো, ‘নাক গলাচ্ছি?’

— ‘নয়তো কী?’

— ‘আপনি নেহাত তুষারের গার্লফ্রেন্ড বলেই… ‘অয়ন কথা শেষ করতে পারল না। আহির হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, ‘আর একটা বার যদি আপনি তুষারের নাম ধরেছেন তো দেখবেন!

— ‘ওরে বাবা কী দেখবো?’ -’দেখবেন আমি কী করি!’

অয়ন হেসে ফেলল, ‘বুঝেছি, খুব ভালো মতোই ঝগড়াটা বাঁধিয়েছেন, কিন্তু ম্যাডাম! শুনেছি ভালোবাসা ঝগড়া ঝাঁটি আর বিরহ হলে পরেই মজবুত হয়, তাই বলছি, যান বাড়ি ফিরে যান, দু দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাদের এই দেশটা এখনো মেয়েদের জন্য ততটা নিরাপদ নয়। একা একা এমন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরবেন তো, হঠাৎ কোনো বিপদে জড়িয়ে যাবেন বলে রাখলাম।’

— ‘দেখুন, আপনাকে কেউ আমার দায়িত্ব নিতে বলেনি। আপনারা পুরুষেরা একলা মেয়েছেলে দেখলেই নিজের সম্পত্তি ভেবে মাতব্বরী শুরু করেন। ঘেন্না হয় আমার!’

অয়ন বিস্মিত হয়ে বলল, ‘সেকি! আপনি তো দেখছি ভীষণ অকৃতজ্ঞ একজন মানুষ! সেধে এসে আপনার উপকার করলাম আর আপনি কিনা মূহুর্তের মাঝেই ভেল্কি দিয়ে পাল্টে গেলেন?’

— ‘উপকার করেছেন তো আমাকে উদ্ধার করেছেন, এবার আসুন প্লিজ!’ অয়ন চট করে উঠে দাঁড়ালো, ‘এ জন্যই লোকে বলে, মেয়েদের উপকার করতে নেই!’

অয়নকে উঠতে দেখে পাশে বসে থাকা এক দঙ্গল ছেলেগুলোর ভেতর থেকে কেউ একজন উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘প্রেম শেষ? আহ, নায়ক তো সুবিধা করতে পারল না!’

আরেকজন বলল, ‘নায়িকা মেন্টাল পেশেন্ট হলে যা হয় আর কী! যাক তাও ভালো, এবার আমরা একটু চান্স নিয়ে দেখবো, যদি লাইগা যায়!

কথাগুলো কানে যেতেই অয়নের পায়ের গতি একটু শ্লথ হলো। পেছন ফিরে আহিরকে দেখলো একবার অয়ন। কপাল অবধি মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে সে। পেছন থেকে আবার কে যেন শিস দিয়ে গান গেয়ে উঠল, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না….’ অয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসল। শরীর রি রি করে উঠল রাগে। ক্রুর চোখে তাকালো দলটার দিকে, চেঁচিয়ে বলল, ‘কী সমস্যা?’

ছেলেগুলো হাসি থামাল না। অয়নের কথা খুব একটা পাত্তা দিল বলেও মনে হলো না। একজন শুধু বলল, ‘ব্রাদার, রাগ করেন কেন? আমরা জাস্ট একটু মজা করছি!’

— ‘এগুলো কোন ধরনের মজা শুনি?’ অয়ন উত্তেজিত। আহির একটু তটস্থ হয়ে গেল। সে জানে এই ছেলেটা রেগে গেলে ভয়ংকর কান্ড করে বসে। ইন্টারভিউর দিনের ঘটনাটা তার সম্পূর্ণ মনে আছে। আবার সেরকম কিছু করে বসবেনা তো? এখানে ওই ছেলে গুলোর দল ভারী। কিছু একটা গোলমাল লেগে গেলে অয়নের একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হবে। আহির চট করে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে অয়নের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আহ! এদের সাথে কথা বলে লাভ নেই, চলুন তো, সামনে চলুন!’

অয়ন অন্য লোকের কথা কদাচিৎ শোনে। তার স্বভাবটাই ঘাড়ত্যাড়া। নিজে কিছু করবে বলে ঠিক করলে তা করেই ছাড়ে। কিন্তু আজকে সে আহিরের কথাটা শুনলো। সত্যি এসব ছিঁচকে ছেলেপেলের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে কোনো লাভ নেই ক্ষতি ছাড়া। আর যেহেতু আহির বিপদটা টের পেয়ে নিজেই উঠে এসেছে, সুতরাং আপাতত চিন্তার কিছু নেই। অয়ন পা বাড়ালো। ট্রেইনের দুলুনীতে অতটা জোরে হাঁটতে পারছিল না ওরা। হাঁটার পেসেজটা নিতান্তই সরু। দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটলে গায়ে গা লেগে যায়। আহির তাই অয়নের পেছন পেছন হাঁটছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *