খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ১৫

১৫

— ‘হুম বলো!’

— ‘কী বলব!’ রিকশায় অয়নের পাশে বসে অবাক গলায় বলল তিয়ানা।

— ‘এত জরুরী তলব কেন?’ শেষ বিকেলের বিষণ্ন, ধূসর আকাশটার দিকে তাকিয়ে তিয়ানা উদাস গলায় বলল,

— ‘ওহ! এমনি!’

— ‘মানে কী! তুমি এমন ভাবে ফোনে কথা বললে যে আমি ভাবলাম কোনো বিপদ আপদ হয়েছে তোমার।’ অয়ন বেশ বিরক্ত হলো।

— ‘ওভাবে না বললে আপনি আসতেন বুঝি!

অয়নের কপালে একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কথাটা অবশ্য তিয়ানা ঠিকই বলেছে। ওরকম আঁকু পাকু হয়ে ফোন না দিলে অয়ন কিছুতেই আজ এমুখো হতোনা। সে যাচ্ছিল মিরপুর, তার বাল্যবন্ধু শাহজাহানের আজ সকালে একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। শাহজাহান এই বয়সেই ছেলে পুলে বানিয়ে পাক্কা সংসারী হয়ে উঠেছে। এটা বেশ আনন্দের খবর। অয়ন বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে বন্ধুর বাসায় যাবার জন্য তৈরী হয়েছিল। সেই সময় হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই মেয়ে ফোন দিয়ে শুরু করল, মেকী কান্না। এই মুহূর্তেই নাকি তার অয়নকে দরকার! জীবন মরণ সমস্যা। অয়ন আর কিছু ভাববারই সময় পেলনা। তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসলো।

— ‘এত রাগছেন কেন? কুল ডাউন ম্যান! আপনাকে ডাকার পেছনে প্রয়োজন যে একবারে ছিল না তা না! একটা প্রয়োজন ছিল!’

— ‘প্রয়োজনটা কী ছিল?’ বরফ শীতল কণ্ঠে বলল অয়ন।

তিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আজকে কিচ্ছু ভালো লাগছিল না সকাল থেকে। বাবা মা দেশের বাইরে, বোনের সাথে ঝগড়া হলো, দিনটাই খারাপ গেল। বাট এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, আপনার কথা মনে পড়ল। মনে হলো, আপনার মতো একজন বন্ধুকেই আমার দরকার এই মুহূর্তে’

একটু থেমে অয়নের থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল, ‘আর ইউ শ্যাটার্ড?’

অয়ন ভাবলেশহীন চোখে তাকালো তিয়ানার দিকে। ষোলো কী সতেরো বছরের উঠতি বয়সের ঝলমলে একটা মেয়ে। তাকালেই মায়া লাগে। মনে হয় পৃথিবীর কোনো অশুভ শক্তি আজ পর্যন্ত এই মেয়েটাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার বাস এই ধুলো মাখা জগৎটাতে নয়, অন্য কোথাও। এই ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটা কেন তার মতো একটা ছন্নছাড়া, অপদার্থ, পাগল ছাগল বিপজ্জনক মানুষের বন্ধু হতে চাইছে?

— ‘এত বয়সের ডিফারেন্সে বন্ধু হওয়া যায় না তিয়ানা! তোমার সাথে আমার অনেক তফাৎ!’

তিয়ানা পরনের শালটা ভালো করে মাথায় জড়িয়ে নেয়। মাঘ মাসের হিম জড়ানো বাতাসের ধাক্কায় হালকা কেঁপে কেঁপে ওঠে। নরম চোখে অয়নের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ‘ডিসটেন্স ডাজন্ট ম্যাটার!’

— ‘আমি… আমি মানুষটা ঠিক স্বাভাবিক না, বেশ পাগল আছি আমি। যে কোনো সময় পাগলামোর বশে তোমার ক্ষতি করে ফেলতে পারি!’

তিয়ানা খিল খিল করে হেসে উঠল, ‘মিথ্যে বলছেন আপনি! আপনি কখনো কারো ক্ষতি করতেই পারেননা! আপনি তো অনেক কিউট আর অনেক ইনোসেন্ট!

অয়ন প্রসঙ্গ ঘোরালো,

— ‘চলো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।

— ‘ওকে!’ তিয়ানা এক কথায় রাজি হয়ে গেল।

তিয়ানার ফ্ল্যাটে এসে দেখা গেল, পুরো ফ্ল্যাট খালি। বাসায় একটা চাকর পর্যন্ত নেই। অয়ন তো অবাক! বিস্ময় নিয়ে বলল,

— ‘সেকি! পুরো বাসা খালি কেন? লোকজন সব কই?’

— ‘বাবা মা তো আমেরিকায়, বড়বোন আছে ওর শ্বশুর বাড়িতে, আমি এখানে একাই!’ নির্বিকার ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল তিয়ানা।

অয়নের মুখটা হা হয়ে গেল, ‘তুমি এখানে একা থাকো!!’

— ‘মাঝে মাঝে থাকি একা, থাকতে হয়!’

— ‘বল কী!’

—হুম, ইউজুয়ালি আমি আমার বোনের সাথে থাকি, কিন্তু যখন বোনের সাথে ঝগড়া হয় তখন এখানে এসে উঠি, খারাপ লাগেনা, আমি একা থাকাটা এনজয় করি।

অয়ন তখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না প্রায় তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাটে এত বাচ্চা একটা মেয়ে একা থাকতে পারে। তিয়ানা অয়নকে একটা সোফা দেখিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘বসুন তো! বসুন, ওয়েলকাম হোম! মি কাসা। সু কাসা! (মাই হোম ইজ ইওর হোম)

অয়ন বসলো। মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। সে ভেবেছিল মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়া যাবে। কিন্তু চালাকী করতে গিয়ে আরো বেশি ফেঁসে যাওয়া হলো।

তিয়ানা অয়নের পাশে বসে বলল, ‘বলুন, ডিনার কী করবেন? আমি খুব ভালো পাস্তা বানাতে পারি!’

অয়ন দীর্ঘশ্বাস চাপলো। বিপন্ন গলায় বলল, ‘তিয়ানা! আমার খুব কাছের এক বন্ধুর আজকে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে। আমি না গেলে ভীষণ কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে’

তিয়ানার ঝলমলে মুখখানা নিভে গেল হঠাৎ। চোখ দুটোয় পড়ল কিসের যেন গভীর ছায়া। অয়ন একটু চমকালো ওই চোখের দিকে তাকিয়ে। সে জানে, এই বয়সটা খারাপ। যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবার জন্য এই বয়সের ছেলে মেয়েরা এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনা। এই বয়সের একটা মেয়েকে এভাবে একা ফেলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তিয়ানার ঠোঁট দুটো হঠাৎ অভিমানে কেঁপে উঠল,

ভারী গলায় বলল, ‘ওকে ফাইন! যান, চলে যান!’

— ‘তুমিও চলো, তোমাকে তোমার আপুর বাসায় রেখে আসি।’

— ‘মাথা খারাপ! মরে গেলেও না! আজকে ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে আমার!’

— ‘আহ তিয়ানা! যা বলছি শোনো, পাকামো করোনা,’

— ‘নো ওয়ে!’

অয়ন হঠাৎ বুনো মোষের মতো তেড়ে এসে তিয়ানার একটা হাত শক্ত করে

চেপে ধরে বলল,

— ‘চলো, আর একটা কথাও না! তোমাকে বলেছি না যে আমি পাগল? তুমি কি আমার পাগলামী দেখতে চাও?’

তিয়ানা বেশ ঘাবড়ে গেছে অয়নের এই আকস্মিক আক্রমণে। কিছুক্ষণ বোকার মত অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বললো, ‘সে কি! আপনি আমাকে জোর করছেন!’

— ‘হ্যা, করছি, কথা না বাড়িয়ে এখনই বের হও এখান থেকে।’

রিক্সায় উঠেই তিয়ানা প্রশ্নটা করে ফেললো ফট করে, ‘আচ্ছা! আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?’

অয়ন অপ্রস্তুত হলো কিছুটা। গম গম করে উত্তর দিল, ‘নাহ!

তিয়ানা যেন আকাশ থেকে পড়ল, সেকি! নো গার্লফ্রেন্ড?’

— ‘নো গার্লফ্রেন্ড’ অয়ন বলল।

— ‘স্টপ মেসিং উইথ মি!’

অয়ন কিছু বলল না। মেয়েটা একটু বেশি পাকামো করছে। এবার কড়া গলায় একটা ধমক লাগাতে হবে।

— ‘ওকে, কিন্তু কেন? মেয়েদের প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট নেই? বাই দ্যা ওয়ে আপনার অন্য কোনো সমস্যা নেই তো? আই মিন, গে’ নন তো আপনি?’

বলেই হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল তিয়ানা। অয়ন জ্বলন্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো ওর দিকে। তিয়ানা ভ্রুক্ষেপও করল না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। অয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলে উঠল, ‘অর বাই এনি চান্স, আপনি ইম্পোর্টেন্ট নন তো?’

— ‘জানিনা’ কাঠ কাঠ গলায় বলল অয়ন। এই মেয়েটা কি ফাজিল? অসভ্য? নাকি বোকা?

তিয়ানা এবার একটু সিরিয়াস হবার চেষ্টা করে বলল, ‘জানেন না? এর মানে আপনি এখনো ভার্জিন?’

— ‘ডেফিনিটলি!’

তিয়ানা ভীষণ অবাক চোখে তাকালো অয়নের দিকে। এরপর হঠাৎ বাঁধ ভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘ওহ মাই গড, ইউ আর স্টিল ভার্জিন! শেইম অন ইউ।’

অয়নের রিকশা থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। কী বলছে এই মেয়ে এইসব? মাথাটা কি একেবারে গেছে নাকি!

১৬

আজ সকালে চৈতির ফোনটা পেয়ে আহির রীতিমত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভুল শুনছে নাতো সে? তার কান ঠিক আছে তো?

— ‘আহির শোন, একটা জরুরী কথা আছে!’

— ‘বলে ফ্যাল’, আহির তখনও ঘুমে ঢুলুঢুলু। গলা ভারী

— ‘আরে শোন না, ইম্পর্টেন্ট কথা’

— ‘আরে বল না কী? কী হইসে?’

— ‘আমার তো বিয়া!’

আহিরের ঘুম ভাবটা চকিতে পালালো, ‘হ্যাঁ! কি বলিস!’

— ‘ঠিক বলছি’

— ‘কার সাথে?’

— ‘তোকে বলেছিলাম না, ঐ যে মেন্টরসের ছেলেটার কথা।’ আহির মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, কদিন আগে চৈতি বলেছিল একটা কম বয়সী ছেলের কথা।

— ‘ওই পিচ্চিটার সাথে?’

— ‘হুম’

— ‘মানে কি! কীভাবে সম্ভব?’

— ‘সবই সম্ভব বন্ধু! তুমি চট করে চলে আসো বাসায়, সামনা সামনি বলবো।’

আহির পড়ি মরি করে ছুটে গেল চৈতির ফ্ল্যাটে। উত্তেজনার বসে কথা খুঁজে পাচ্ছিলনা সে। চৈতিই কথা বলল প্রথম, ‘কিরে ওরকম থাম্বু খেয়ে গেলি কেন?’

— ‘তুই কী বলছিলি?’

— ‘বলছিলাম আমার বিয়ে!’

— ‘ওই ছেলেটার সাথেই?’

— ‘হ্যা!’

আহির বিস্ময়ে ফেটে পড়ল, গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘কিন্তু ওই ছেলেতো বয়সে তোর চেয়ে ছোট!’

— ‘এত ফিসফিস করার কিছু নেই আহির! ব্যাপারটা বাবা মা জানেন, হ্যাঁ বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হবে, কী এসে যায়!’

— ‘আঙ্কেল আন্টি রাজি?’

— ‘রাজি, রাজি করাতে যদিও বেগ পেতে হয়েছে, তবুও শেষমেষ রাজি হয়েছে এটাই স্বস্তির খবর। ‘

আহিরও এবার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, ‘যাক! তাহলেতো ভালোই, তোর সুখেই আমাদের সুখ।’

— ‘সত্যি আমি খুব সুখীরে আজ! নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হওয়ার চেয়ে সুখের আর কিছু কি হতে পারে রে এই দুনিয়ায়?’

চৈতির চোখ দুটো চকচক করে উঠল। মুখে প্রশান্তি এঁকে দিল স্বৰ্গীয় রূপ! আহির মুগ্ধ হয়ে গেল দেখে। সত্যি ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার মাঝে এত নির্ভেজাল আনন্দ মিশে থাকে? সেও তো তুষারকে বিয়ে করবে কদিন পরেই, কিন্তু কই সেই ভাবনা তো কোনদিন তার মাঝে এতটা সুখ এনে দিতে পারেনি? আহির একটু আনমনা হলো, সে মানুষটা এমন কেন? তুষারকে ভালোবেসে কেন সে চৈতির মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারেনি কোনদিন, সত্যি, আমি খুব সুখীরে আজ! আহিরেরও বড় সাধ জাগে, চৈতির মতো করে বলতে, পারবে কি কখনো আহির?

— ‘আজকে কী করছিস? বাইরে যাবি আমার সাথে?’ ভাবনায় ছেদ পড়ল চৈতির কথায়।

— ‘তেমন কোনো প্ল্যান নেই, পড়তে বসবো, পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই তো!’

— ‘কী পরীক্ষা?’

— ‘বিসিএস’

— ‘ওহ! এবার মনে হচ্ছে তুই চান্স পেয়েই ছাড়বি!’

— ‘আরে ধুর! আমার ভাগ্যটা কখনো আমার সঙ্গ দেয়না, আমি কি আর তোর মত চাঁদ কপাল নিয়ে জন্মেছিরে?’

শেষের লাইনটা নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা ঠেকলো আহিরের কাছে। সে কি চৈতিকে হিংসে করতে শুরু করেছে? নইলে অমন ছোটলোকের মতো কথাটা বলতে গেল কেন? একটা পাপবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। ধ্যুর ছাই! আজকাল কী যে হচ্ছে তার সাথে!

চৈতি ভ্রু দুটো ত্রিভূজের মতো করে বলল, ‘তোর মনটা কি খারাপ নাকি রে আজ?’

আহির কী বলবে, সে নিজেও জানেনা মন খারাপ নাকি ভালো। শুধু এটুকু বোঝা যায় ভেতরটা কেমন থ মেরে আছে। কিছু ভালো লাগেনা, নাহ কিচ্ছুনা! কী হয়েছে আহিরের? গভীর কোনো অসুখ?

— ‘কিরে চুপ করে রইলি কেন? কী নিয়ে ভাবছিস বলে ফেল, আমার সাথে শেয়ার কর, দেখবি বলে ফেললে ভালো লাগবে।’

আহির ঝিম ধরা গলায় বললো, ‘কিছু হয়নি, কিচ্ছুনা, তুই বল তোর বিয়েটা হচ্ছে কবে?’

— ‘ফেব্রুয়ারিতে’

— ‘তবে তো আর বেশি দেরী নেই’

— ‘হ্যাঁ ঠিক, তার এক মাস পরেইতো তোর বিয়ে, তাইনা?’

— ‘হুম, মার্চে হতে পারে তবে এখনো তারিখ পড়েনি

— ‘আমার পড়েছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ভ্যালেনটাইনস ডে!’ বলেই এক গাল হাসলো চৈতি।

আহিরও হাসলো। চৈতির আনন্দটা দেখতে এখন ভালো লাগছে। নাহ, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল চৈতিকে সে হিংসে করেনি। এই উপলব্ধিটা মনের মাঝে একটা প্রশান্তি এনে দিল। হিংসে কি আদৌ করেছে সে কারুকে কোনো দিন? মনে পড়েনা। কিন্তু অমন ধোয়া তুলসী পাতাও তো সে নয় যে এই এতটুকু জীবনে কোনদিন কাউকে হিংসে হয়নি। হয়েছে নিশ্চয়ই, আহির তা টের পায়নি।

— ‘যাবি নাকি নিউমার্কেট? একটু কেনাকাটা ছিল।’

— ‘আজ মঙ্গলবার, মার্কেট বন্ধরে!’

— ‘ওহ, তাই বল, তাইতো সকালে রাস্তা এতো ফাঁকা দেখলাম’

— ‘সকালে বেরিয়েছিলি?’

— ‘হম, কোচিং এ গিয়েছিলাম’

— ‘ও আচ্ছা’ আহির বললো, দায়সারা গলায়। চৈতি বাতাসে রহস্যের গন্ধ পেয়ে বলল,

— ‘এই মেয়ে তোর হয়েছে কী? ঝগড়া করেছিস তুষার ভাইয়ের সাথে?’ আহির পাশ কাটানো উত্তর দিল, ‘আরে না, শোন আজ আমি উঠি, এমনিতেও বাড়িতে অনেক কাজ, বাড়ি বদলানো মানেই বিরাট ঝামেলা’

— ‘ও হ্যারে, তোরা কবে যাচ্ছিস?’

— ‘সামনের মাসেই’

— ‘তুই চলে গেলে আমার কী হবে?’ চৈতি এবার সত্যি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। মেয়েটা আহিরকে বাস্তবিকই ভালোবাসে। আহির হেসে বলল,

— ‘তুই ও তো চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি, অত মন খারাপ করা কেন?

১৭

আজকে অয়ন বাড়ি ফিরে একটি চমকপ্রদ খবর শুনতে পেল। তার বাবার শরীর আজ কিছুটা ভালো। তিনি ভদ্রলোকের মতো কাপড় জামা পরেছেন। চেয়ার টেবিলে বসে দুপুরে ভাত খেয়েছেন এবং আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো তিনি অয়নের নাম ধরে দু একবার ডেকেছেন, অয়নকে খুঁজেছেন।

খবরটা শোনা মাত্র অয়ন কয়েক সেকেন্ড থ মেরে রইলো। এরপর এক ছুটে দৌড়ে গেল বাবার ঘরের দিকে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। আহা! অয়ন কত কত দিন ধরে আশা পুষে রেখেছে, কোনো এক মায়াবী বিকেলে সে বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে আবার সেই আগের মতো করে ফিরে পাবে।

বাবার ঘরটি আজ আলোকময়। ১০০ ভোল্টের বাল্ব জ্বলছে। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধটিও নেই। কটকটে একটি এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে ঘরটিকে সুগন্ধময় করে রাখা হয়েছে। ঠিক মাঝখানে, যেখানে শেকল দিয়ে এতদিন বাঁধা ছিলেন বাবা, সেই জায়গাটায় একটি চকি পাতা হয়েছে। বাবা সেখানে বসে আছেন। তার পরনে একটি আকাশী রঙের গেঞ্জি এবং লুঙ্গী। শেকলটির অস্তিত্ব নেই আশেপাশে কোথাও। বাবা বসে আছেন খুব সাধারণ ভঙ্গীতে। একটু কুঁজো হয়ে। তার দাড়ি কামানো হয়েছে। বেশ ভদ্রলোকের ছাপ এসেছে চেহারায়। শুধু চোখে মুখে একটা ভয় খেলা করছে। চোখ জুড়ে ছেলেমানুষী। ভীত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন এদিক সেদিক এবং আকাশ পাতাল ভাবছেন যেন নিতান্তই অপরিচিতের বাড়িতে তিনি চলে এসেছেন হঠাৎ করে। বাবার এক পাশে দাদীমা বসেছেন। অন্য পাশে আয়শা দাঁড়িয়ে আছেন। মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তার পাগল স্বামীটিকে। অয়ন সামনে এসে দাঁড়াতেই আয়শা একটু তটস্থ হলো। দাদী মা’ও। নির্বিকার হয়ে রইলেন কেবল বাবা। অয়নের দিকে একবার তাকালেন। কী যেন বিড়বিড় করলেন নিজের মনে। এরপর আবার মগ্ন হয়ে গেলেন তার নিজস্ব চিন্তায়। একটা তীব্র ব্যথা বুকের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে নিশ্বাস আটকে দিল অয়নের। বাবা কি তাকে চিনতে পারেনি? তাহলে ওরা যে বলছিল তিনি তার নাম ধরে ডেকেছেন!

অয়ন এগিয়ে এসে বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো মাটিতে। অয়ন কাছে আসতেই আয়শা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি জানেন অয়ন তার উপস্থিতি আজকাল একেবারেই সহ্য করতে পারছেনা। ঘরে বাড়ির চাকর বাকররাও উপস্থিত আছে, এসময় একটা হই হট্টগোল বাঁধিয়ে দিলে তিনি লজ্জিত হয়ে পড়বেন সবার সামনে। এরচেয়ে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।

— ‘বাবা!’ অয়ন ডাকলো। বাবা শুনলেন কিনা বোঝা গেলনা। ভাবলেশহীন চোখে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন এহেন আশ্চর্য বস্তু তিনি ইহজন্মে দেখেননি

— ‘বাবা!’ অয়ন আবার ডাকলো।

বাবা তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন গভীরভাবে। অয়নের চোখ দুটো একটু ভিজে আসছিল। কান্নার একটা ঢোঁক গিলে সে বলল,

— ‘বাবা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি অয়ন!’

বাবা নাকটা সুঁচালো করলেন একবার, বিড়বিড় করলেন তার নিজস্ব ভাষায়, এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে আবার তাকালেন সিলিং ফ্যানের দিকে। হঠাৎ একটা তীব্র আক্রোশে পেয়ে বসলো অয়নকে। রোমকূপে রোমকূপে সেই বিষাক্ত পোকার ছোবল। দাঁতে দাঁত ঘষে সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারছনা?’ বাবা নির্বিকার। অয়ন এবার ফেটে পড়ল আর্তনাদে, ‘তুমি চিনতে পারছো না? আমাকে চিনতে পারছনা?’ বলেই টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের গ্লাসটা হাত দিয়ে তুলে ছুঁড়ে মারলো। চোখের সামনে ভেঙ্গে চুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গ্লাসটা। দাদিমা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘একি সর্বনাশ! করছিস কী?’

অয়ন বন্য মোষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে সটান শুয়ে পড়ল। মাথার ভেতর চিনচিনে ব্যথা। বুকটা ভারী। একটা বোবা কান্না গলায় আটকে আছে। নিচতলার ওই কোণের ঘরের উন্মাদ লোকটা যেদিন তার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন থেকে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল। তার বাবা হারিয়ে গেছে, মরে গেছে কিংবা উধাও হয়ে গেছে, ওই অপ্রকৃতস্থ জড় বস্তুর মতো লোকটা কোনভাবেই তার বাবা হতে পারেনা। আচ্ছা! অয়নই বা কেন এত দিনেও এই সত্যটিকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছেনা? যেভাবে দাদীমা মেনে নিয়েছেন, যেভাবে বুশরা মেনে নিয়েছে ঠিক সেভাবে অয়ন কেন মানতে পারছেনা! অয়ন তো জানে পরিবর্তন প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কোনো কিছুই স্থির নয়। একবার এক বইতে পড়েছিল একই নদীতে আসলে কেউ দুবার গোসল করতে পারেনা। দ্বিতীয়বার যখন নদীতে নামা হয় তখন নদী বা নদীতে নামা মানুষটি কোনটিই আগের মতো নেই। এ গতিশীলতাই জগৎকে টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক যেভাবে প্রতিটা বস্তু পরিবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত, ঠিক সেভাবেই বাবাও বদলে গেছে। এই সহজ কথাটা অয়ন কেন মেনে নিতে পারছেনা! অয়ন নিজেকে বোঝায়, দিন রাত বোঝাপড়া করে নিজের সাথে কিন্তু অবাধ্য মনটা মানতে চায়না। কেবলই মনে হয় এ সব কিছুর পেছনে শুধু একটা মানুষ দায়ী!

নিচতলার ঘর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার সাথে বিকট চিৎকার। অয়ন উঠল না। ঝিম ধরে শুয়ে রইল।সে জানে পাগলের তান্ডব শুরু হয়েছে। এখনই আবার শেকল পরানো হবে। পুরোপুরি বেঁধে ফেলে বন্দী করে রাখা হবে খাঁচার ভেতর। যাতে বাইরের দুনিয়ার একটি ধুলো কণাও জানতে না পারে এ বাড়িতে একটি বদ্ধ উন্মাদ বাস করে।

ঘরের দরজা খোলা ছিল। আলো না জ্বালানোয় ভেতরটা অন্ধকার। বুশরা কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি অয়ন। ঝাঁঝালো কন্ঠের ঝাপটা এসে কানে লাগল।

— ‘কি শুরু করেছে দেখেছিস? উফ! এইসব চলতে থাকলে কিন্তু আমিও তোর মতো একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাব!’

অয়ন নির্বিকার ভাবে বলে,

— ‘যা না, যেতে মানা করেছে কে তোকে?’

বুশরা রাগে ফোঁস ফোঁস করে,

— ‘লোকটা মরে না কেন? আর কতদিন এইসব সহ্য করতে হবে!’

অয়ন নড়ে চড়ে উঠে বসে। গলা খাকারি দিয়ে বলে, ‘এক কাজ করনা, তুই আর তোর মা মিলেমিশে একটা প্ল্যান করে পাগলটাকে বিষ খাইয়ে দে, তাহলে তোদের জ্বালা জুড়াবে!’

— ‘যদি পারতাম! তবে আমি তাই করতাম!’ বুশরা রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটা দেয়। যেদিকটায় গেছে সেদিকে ওর ঘর না, ছাদে যাবার সিঁড়ি। অয়নের বুশরার জন্য একটু চিন্তা হয়। বুশরা কি বেশি হতাশ হয়ে পড়ছে ব্যাপারটা নিয়ে? নেশা টেশা করছে নাতো আবার? কিংবা কোনো খারাপ সঙ্গ? কে জানে!

১৮

বাবাই বসার ঘরে একটা পুরনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলেন, চশমাটা নাকের ডগায়। আহিরকে দেখে একটু চমকানো গলায় বললেন, ‘কিরে? কী হয়েছে তোর?’ আহির একটু বেসামাল হলো, – ‘কই? কিছু হয়নিতো!

বাপ মেয়ের কথার মাঝখানে মা এসে হাজির হলো ঝড়ের মতো, ‘আশিকের কান্ডজ্ঞানটা দেখেছিস?’

— ‘কেন সে আবার কী করলো?’ আহিরের প্রশ্ন।

— ‘তার নাকি ল্যাপটপ চাই, এইমাসের মধ্যেই চাই! তুই বল, তোর বাবার কি এই মূহুর্তে এইসব বিলাসিতা করার কোনো সুযোগ আছে?’

বাবাই খানিকটা ন্যাতানো গলায় বলল, ‘থাক! এ নিয়ে আর তুমি চোটপাট করোনা! ছেলে মেয়েরা আহ্লাদ করে কিছু চাইলে আমি দিতে পারিনা, এ আমার ব্যর্থতা, ওদের ই বা কী দোষ বল?

আশিক ঘরের কোনে ডিভানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল। মায়া হলো আহিরের ভাইয়ের জন্য। তার নিজের কম্পিউটারটা গেল বছর নষ্ট হয়ে গেল। বড় ফুপু জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। খুব জরুরী কাজগুলো এখন সে চৈতীর কম্পিউটারে সেরে ফেলে। আশিক এইচএসসি পরীক্ষা দিবে আগামী বছর। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। এ সময় একটা কম্পিউটার যে সত্যি কতটা জরুরী আহির তা বুঝতে পারে। ওর বন্ধুদের সবার নিশ্চয়ই পার্সোনাল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে, দামী মোবাইল আছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হ্যাংআউট করার মতো পকেটে ভালো হাত খরচ আছে। বেচারা তার ভাইটা সবদিক থেকেই ঠটো হয়ে বসে আছে।

— ‘কিন্তু মা, আমার কাছে মোটেও মনে হচ্ছেনা আশিক কিছু মাত্র বিলাসিতা করছে। ওর পড়াশোনার জন্য একটা কম্পিউটার খুব দরকার’

আহিরের কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র আশিক বুঝি শরীরে বল ফিরে পেল। নড়ে চড়ে উঠে বসে সে অভিযোগ করার সুরে বলল, ‘দেখলি বুবু, ওরা কি ভীষণ প্রি-ডেটেড কথা বার্তা বলছে! আচ্ছা বাবাই তুমি একজন শিক্ষক হয়ে কী করে এমন একটা কথা বললে বল তো?’

বাবাই অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, ‘আমি পড়াই ইংরেজি, সেখানে তো কম্পিউটারের কোনো আবশ্যকতা আমার নজরে পড়েনা।’

— ‘উফ! তোমরা বুঝবেনা, সে যাই হোক, আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছি তোমাদের চিন্তা করতে হবেনা।’

আশিকের কথাটা মাটিতে পড়তে পারলোনা, তার আগেই মা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘সে কি! কী করেছিস তুই? চুরি ডাকাতি করেছিস নাকি?’

মায়ের বলার ঢঙে আশিক হেসে ফেলল, বিজয়ীর মতো বলল, ‘না সেসব কিছুই করিনি। তুষার ভাই বলেছেন এবারের বার্থডে তে উনি আমাকে একটা ল্যাপটপ গিফট করবেন।’ আহিরের কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সে আগুন ঝরা কন্ঠে বলল, ‘মানে কী! তুষার কেন তোকে কম্পিউটার দিবে?’

আশিক ভারী অবাক হলো যেন, ‘কী আজিব! সে আমার হবু দুলাভাই! দুলাভাই শালাকে ভালো কিছু উপহার দিতেই পারে! শালাকে দেবেনা তো কাকে দেবে?’ মায়ের চোখ দুটো ততক্ষণে চকচকে হয়ে উঠেছে, বিগলিত হয়ে বলল, ‘সত্যি?’ বাবাই একটু মিন মিন করল, ‘কী দরকার তার এত টাকা খরচ করার!

ব্যাস এটুকুই! আহিরের সমস্ত শরীরে একটা প্রচন্ড প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে গেল। এদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? দুলাভাই হয়ত শালাকে আদর করে কিছু না কিছু উপহার দিতেই পারে। কিন্তু আহির নিজেও জানেনা তার কেন মনে হচ্ছে তুষারের কাছ থেকে এই গিফট নেয়া আর ভিক্ষা নেয়ার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। আহির ঠোঁট কামড়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পরিবারের বাকি তিন সদস্যের চোখে মুখে এক বিগলিত আভা। জামাইয়ের বদান্যতায় তারা অতি আনন্দিত! হায়! আহিরের মনে হলো যদি মাটি দু ফাঁক হয়ে গর্ত হয়ে যেত, আর সে যদি সেই গর্তে লুকাতে পারত!

১৯

ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ল কাল সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা। আচ্ছা! ওই মেয়েটার সাথে তুষারের কী সম্পর্ক! তুষারের মাঝে একটা লুকোচুরির ভাবই বা আহির কেন টের পেয়েছিল? বুক দুরু দুরু করতে থাকে। একটা অজানা ভয় জাপটে ধরে চারপাশ থেকে।

দাদীমা প্রায় জোর করে অয়নকে আয়শার ঘরে নিয়ে আসলেন। অয়নকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই তিনি কেটে পড়লেন। এই বৃদ্ধা মহিলার সম্মোহনী শক্তি দেখে অয়ন আজও অবাক হয়। সে না পারতে এসে দাঁড়ালো আয়শার সামনে, ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’

আয়শা তাকালেন ছেলের দিকে। ছেলেটা দেখতে ঠিক কার মতো হয়েছে তা আজও তিনি ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। বাবার সাথে মিল আছে, কিন্তু ছেলে হয়েছে বাবার চাইতেও বেশি রুপবান। দেবতার মতো দেখতে। কিন্তু হলে কী হবে, চলাফেরা হয়েছে উজবুকের মতো। গাল ভর্তি দাড়ি, ময়লা কাপড়, পায়ে চপ্পল, মুখে দার্শনিক উদাসীনতা, সব মিলিয়ে দৈন্যতার লালন। এ যেন এক শৌখিন দৈন্যতা। অয়নের দৃষ্টি ছিল মেঝেতে নিবদ্ধ। আয়শাও ছেলের চোখে চোখে তাকান না। চারপাশে অস্বস্তি দানা বাঁধতে থাকে। বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

— ‘একটু জরুরী কথা ছিল তোমার সাথে, সময় হবে?’

অয়ন যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘বলুন’। বাইরে তখন ঝিম ধরা দুপুর। জানালা গলে ঘরের ভেতর এসে পড়েছে শেষ মাঘের মিষ্টি রোদ্দুর। আয়শার গায়ে একটা গেরুয়া রঙের পাতলা চাদর। চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। বসে আছেন বিছানায়। হাতে খবরের কাগজ। আজ ছুটির দিন বলে তিনি দুপুরবেলায় বাড়ি আছেন। অয়ন এ ঘরটায় দীর্ঘ দিন পর আসলো। বাবা সুস্থ থাকা অবস্থায় শেষবার এসেছিল। ঘরের সাজসজ্জা তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। পর্দাগুলোর রং পাল্টেছে শুধু আর পুবদিকের দেয়ালে একটা বাঁধাই করা নতুন ছবি। ছবিতে সাত কি আট বছর বয়সের ছোট্ট অয়ন। বারবি ডলের মতো দেখতে চার বছর বয়সী বুশরা, মাঝখানে বাবা তার অপূর্ব হাসিটি মুখে ঝুলিয়ে জমিদারী ভঙ্গীতে বসে আছেন। এই ছবিতে আয়শা নেই। তার ঠিক পাশের ছবিটিতে আয়শা দাঁড়িয়ে আছেন দুই বা তিন বছর বয়সের অয়নকে কোলে নিয়ে। অয়ন ফোকলা দাঁত বের করে হাসছে আয়শার দিকে তাকিয়ে। আয়শা ও হাসছেন ঠোঁট টিপে। সেই ছবির দিকে চেয়ে অয়নের হঠাৎ মনে হলো, আহা ছোটবেলাটা বড় ভালো ছিল। কত কতকাল অয়ন ঐভাবে হাসেনা!

‘বসো’ আয়শা বললেন। অয়ন বসলোনা। একটা আড়ষ্টতা গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আয়শা গলাটা একটু কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা! বুশরা আজকাল কি করছে কিছু জানো? আই মিন, ও আসলে কাদের সাথে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, এসব কি কিছু জানো তুমি? বেশ কদিন যাবৎ ওকে একটু কেমন অন্যরকম লাগছে, সেদিন দেখলাম বাড়ি ফিরল খুব রাত করে।’

জানালায় একটা বাচ্চা চড়ুই এসে বসেছে। কিচিরমিচির শব্দে জানান দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা। অয়ন সেদিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসল, এরপর নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল, ‘বুশরা কোথায় যায়, কী করে বা কাদের সাথে মিশে তা আমি জানিনা, তবে এটুকু জানি যে বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়েরা কী করতে পারে, বা কতটা নিচে নামতে পারে, বুশরাও যেহেতু বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে বৈ আর কিছুইনা, তাই অন্তত ধারণা করতে পারি যে তার গতিবিধি কী ধরনের হতে পারে’ আয়শার মুখখানা দপ করে নিভে গেল, ‘নিজের বোনকে নিয়ে এভাবে কথা বলছ তুমি? তুমি কি মানুষ?’

অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, ‘আমাকে দেখতে যদিও মানুষের মতো! কিন্তু ভেতরটা আসলে মানুষের মতো নেই। ‘

— ‘দেখতেও তুমি মানুষের মতো নও, মানুষ এভাবে থাকে না! ভেতরে আর বাইরে আগাগোড়া একটা অমানুষ তুমি! তোমাকে ডেকেই আমি ভুল করেছি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি নষ্ট হয়ে গেছ! এখন মনে হচ্ছে বুশরাও তোমার পথ বেছে নিয়েছে, তুমি কানপড়া দিচ্ছ না তো ওকে? শেষ হয়ে গেছে এই সংসারটা, পঁচন ধরেছে এই সংসারে।’

অয়ন তাকাল আয়শার দিকে, তীক্ষ্ণ গলায় বলল- ‘শেকড়ে পঁচন ধরলে, ডাল পালায় তো তার প্রভাব পড়বেই, তাই না?’

আয়শা আরেকবার কুঁকড়ে গেলেন। অয়ন সেই কুঁকড়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘অবাক লাগল এটা জেনে যে এই সংসারটা পঁচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে, সেই উপলব্ধিটা আপনার এতদিনে হলো! আপনি কি সত্যি এতটাই বোকা? নাকি বোকা সাজার অভিনয় করেন?

আয়শার চোখের কোণে কয়েকবিন্দু জল চিক চিক করছিল। তিনি হঠাৎ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। এরপর অস্থির ভাবে বললেন, ‘তুমি… তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো?

অয়ন কয়েক সেকেন্ড আয়শার দিকে চেয়ে থেকে, কিছু একটা খুব কঠিন ভাবে বলতে গিয়েও বলল না, ঢোঁক গিলে ফেলল, শুধু বলল, ‘চলি’।

আয়শা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি জাননা উত্তরটা না দিয়ে তুমি আমার কত বড় উপকার করলে!’

বুশরাকে দেখা গেল তার ঘর থেকে বেরোতে। হাই হিল জুতোর টিক টিক আওয়াজ তুলে, মুখে রাজ্যের কসমেটিকস মেখে এই ভর দুপুরবেলা সে কোথায় যাচ্ছে কে জানে? অয়ন সেধে বুশরার সাথে খুব একটা কথা বলেনা। কিন্তু আজকে বলল।

— ‘এই, কই যাস তুই?’

বুশরা ভারি অবাক হলো অয়নের প্রশ্ন শুনে, চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী?’

— ‘কোথায় যাস?’ অয়ন টেনে টেনে স্পষ্ট ভাবে প্রশ্নটা আরেকবার করল। ‘বাইরে!’ বুশরার নির্বিকার উত্তর।

— ‘বাইরে কোথায়?’

— ‘তোকে বলতে হবে কেন?’

— ‘তো কাকে বলবি?’

— ‘যাকেই বলি না কেন, তোকে কেন বলব? হু দা হেল আর ইউ?’ অয়নের মাথায় হঠাৎ রক্ত চড়ে গেল। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘কী ব্যাপার? এভাবে কথা বলছিস কেন?

বুশরা আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গীতে বলল,

— ‘লুক, হু ইজ টকিং! তুই নিজে আগে ঠিক হ, তারপর আমার ওপর জাসুসি করতে আয়, ওকে?’

— ‘আমি বেঠিক আছি সেটা তোকে কে বলল?’

— ‘কাউকে বলতে হবেনা, আমি নিজেই টের পাই, আর তুই যে একটা পাগল, সেটা সবাই জানে, সো প্লিজ! নিজের রাস্তা নিজে দেখ, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাস না!’

— ‘খুব কথা বলতে শিখেছিস দেখছি?’ অয়ন কঠোর হবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভেতরটা ওলট পালট লাগছিল। বুশরা এতটা বদলে গেল কবে? এতটা ডেয়ারিং তো ও আগে ছিল বলে মনে পড়েনা। বুশরার এই চারিত্রিক পতনের পেছনে কি অয়নের একেবারেই হাত নেই? অয়ন যদি অতটা উদাসীন না হত, অতটা পাগলামো না করত তাহলে কি বুশরা এই সাহস কোনদিনও পেত! বুশরার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, অয়ন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে কখনো?

— ‘যেতে দে ভাইয়া, অযথা ঝামেলা করিস না!’ বুশরা বলল যারপরনাই বিরক্ত হয়ে। কথা কাটাকাটি বাড়ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময় রহিম মিয়া ছুটে আসলো ঝড়ের মতো সিঁড়ি ভেঙ্গে, ‘অয়ন বাবা! সাহেবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, তার ঘরে শেকলটা শুধু পড়ে আছে, কিন্তু তিনি নেই!’

হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো, অয়ন নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘কী বলছেন আপনি? বাবা কোথায়?

— ‘তা তো বুঝতাসিনা, পাওয়া যাইতেসেনা কোথাও!’ অয়ন এক ছুটে নিচে নেমে আসলো। বুকের ভেতর দুম দুম শব্দে কে যেন তখন হাতুড়ি পিটাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *