১০
আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটা দুঃসংবাদ পেয়ে। বাড়িওয়ালা নোটিশ পাঠিয়েছে। এক মাসের ভেতর বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ি ওয়ালার মেয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসছে দেশে। এসে এই ফ্ল্যাটেই উঠবে। এর জন্য তাড়াহুড়ো করে এক মাসের ভেতরেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে আহিরদের। সকাল থেকে বাবাইয়ের মুখখানা বিষণ্ণ। কলেজ যাননি তিনি আজ। সাত সকালে এই নোটিশের কারণে দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসেছে তাকে। খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে রেখে স্নান মুখে কিসব ভেবে যাচ্ছেন তিনি। মা রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছছেন। আহির সমস্তটাই টের পাচ্ছে।
ছোট ভাইটা সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং এ গেছে। এই খবর সে জানেনা এখনো। জানলে নির্ঘাত মুখটাকে হাড়ির মতো বানিয়ে ঘুরতো। বুকের ভেতর একটা অসহায় হাহাকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। কী হবে এখন? কী হবে? এই একটা মাসের ভেতর নতুন বাড়ি কোথায় খুঁজে পাবে তারা? যে হারে বাড়ি ভাড়া বাড়ছে। দুই বেডরুমের এত বড় কোনো নতুন ফ্ল্যাটে উঠতে গেলে কম করে হলেও বিশ হাজার টাকা ভাড়া পড়বে। এখন তারা পনেরো দেয়। বাবাইয়ের মাসিক বেতন পঁচিশ হাজার। এর মাঝে বড় একটা অংক বাড়ি ভাড়াতেই চলে যায়। সংসারের বাকি খরচ গুলো তিনি দু’একটা টিউশনী করে বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন করে কোনো রকমে চালান। বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ যদি এর থেকে বেড়ে যায় তো না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। এবার তবে আরো ছোট ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে। এদিকটায় পাওয়া যাবেনা এত কম ভাড়ায় মোটামুটি মানসম্মত বাড়ি। অন্যদিকে খুঁজতে হবে। এদিকে আবার তুষার আসার কথা। একটু আগেই ফোন করে বলল, মিনিট দশেকের ভেতর আসছে। আহির আর না করতে পারল না। কিন্তু বাসার এরকম একটা আবহাওয়ায় তুষারের হুট করে চলে আসাটা কতটা মানানসই হবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে।
রান্নাঘরে গিয়ে একটা কোকোলা নুডলসের প্যাকেট ছিঁড়ে অনভ্যস্ত হাতে রান্নায় লেগে গেল। তুষার আসলে কিছু না কিছুতো সামনে দিতে হবে। মায়ের মনের যা অবস্থা, এখন কোনো আয়োজন করতে বলাটা অন্যায় হয়ে যাবে। মা নিজের মনে বটি পেতে তরকারী কুটছিলেন। আহিরকে দেখে বাঁকা গলায় বললেন,
— ‘কথা বললে তো তুমি কথা শোননা, সেদিনকে বললাম, বাড়িওয়ালার ছেলেটার সাথে বস, বসে দু দন্ড কথা বল, এক সাথে লাঞ্চ কর, তা না মহারানী ডাট মেরে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন, বলি এখন গেল কোথায় আপনার ডাট শুনি? হা: ….ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম!! পথে বসিয়ে দিলি তুই আমাদের!’
মায়ের গলার স্বর কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, ‘এবারে পথে নামতে হবে, বস্তিতে গিয়ে থাকতে হবে, হায় খোদা সহায় হও তুমি!’
কেউ যেন ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বুকটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। আহির কান কাটার মত হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো। সে জানতো মা ঠিক এই ইঙ্গিতটাই করছেন মনে মনে। এবার মুখ ফুটে বলেই ফেললেন। সত্যি অভাব মানুষের স্বভাব একেবারে নষ্ট করে দেয়। মা তাহলে পরোক্ষ ভাবে এটাই বলতে চাইছেন যে এ বাড়িতে টিকে থাকার জন্য আহিরের উচিত ছিল ওই ছেলের সাথে গিয়ে ফস্টি নস্টি করা কিংবা যে কোনো ভাবে ওই ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া। এতে আহিরের চরিত্রের ওপর দাগ পড়ল তো পড়ুক, তাতে কিচ্ছু আসে যায়না। আহিরের চোখ ফেটে জল আসতে চাইছিল।
তুষার এসে পড়ল কিছুক্ষণের মাঝেই। আজ শনিবার। অফিস ছুটি। তবুও সকাল সকাল একেবারে ফিট বাবুটি সেজে এসেছে সে। ফুলহাতা শার্ট, কালো প্যান্ট, জেল দিয়ে পাট করে চুল আঁচরানো। ভালো লাগলো তুষারকে দেখে। দম বন্ধ করা গুমোট ভাবটা একটু হালকা হতে শুরু করল বুঝি ও আসাতে।
বাবাই নিজের ঘরে খবরের কাগজ পড়ছেন। মা রান্না ঘরে। তুষার তাদের দুজনকে সালাম দিয়ে এসে বসার ঘরে বসল।
— ‘শোনো, খুব জরুরী কথা আছে’ তাগাদা দিল তুষার।
আজকাল জরুরী কথা আছে, এই বাক্যটা শুনলেই বুক ধক করে ওঠে। নাহ, আর ভালো লাগেনা! আহির কিছু বলল না। বিষণ্ন চোখে তাকাল তুষারের দিকে।
— ‘তুমি আঙ্কেলকে একটু বুঝিয়ে বল, বিয়ের আগে আমাদের ঘরে, মানে তোমার আমার বেডরুমে একটা ওয়াল কেবিনেট করে দিতে পারলে খুব ভালো হয়, আব্বা আম্মা সেটাই চাইছেন আর একটা খাট আর ড্রেসিং টেবিল, ব্যাস এতটুকুই, তুমি একটু ম্যানেজ করো লক্ষ্মীটি!’ কত অকপটে বলে ফেলল তুষার কথাগুলো। ভারী অবাক লাগল আহিরের।
— ‘বিয়ের তো এখনো ছ, সাতমাস বাকি আছে, এত আগে এসব বলছ কেন?’
— ‘ছ, সাতমাস খুব বেশি সময় না,’
— ‘এখনো তো তারিখও পড়েনি!’
— ‘তা পড়েনি, কিন্তু পড়তে কতক্ষণ, তোমায় বলে রাখলাম আগে ভাগেই কারণ তোমাদের তো আবার সমস্যা আছে। সব কিছুকে বেশি প্যাঁচাও তোমরা। আগে থেকেই প্রিপেয়ার থাকো, মানে প্রিপেয়ার করো আঙ্কেল আন্টি কে’
আহির শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আর যদি বলি পারব না?
— ‘কী আজব! পারবেনা কেন? এভারেস্ট জয় করতে তো বলিনি তোমাকে! আর এতটুকু একেবারে না পারলেই নয়, মান ইজ্জতের সাওয়াল হয়ে যাবে, আমাদের ফ্যামিলির মানুষ জনের কাছে কী জবাব দেব? সবাই তো দেখতে চাইবে মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে কী কী জিনিস আসলো!’
— ‘তুমি কি এসব বলার জন্য আসছ তুষার?’
— ‘হ্যাঁ… তা এসেছি এসব বলার জন্যই, তবে তোমাকে দেখতেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল’
— ‘তাহলে এবার তুমি যেতে পারো’ ঝাঁঝালো গলায় বলল আহির। তুষার আহত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আহিরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
— ‘ওভার রিঅ্যাক্ট করছ কেন?
— ‘আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই করছি!’ আহির কঁকিয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল তুষার। মৃদু গলায় বলল, ‘তুমি বদলে যাচ্ছ! খুব বদলে যাচ্ছ!’
আহির দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মূর্তির মত বসে রইল। নড়ল না অনেকক্ষণ। সেই পুরনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আজ অনেকদিন পর। দূরে কোথাও হারিয়ে যাবার অদম্য ইচ্ছেটা। এই সমাজ সংসার ছেড়ে, বহু দূরে কোনো এক অচিন পুরে চলে যেতে খুব ইচ্ছে করে। যেখানে এ পৃথিবীর টুকরো টুকরো মৃত্যুগুলো থাকবেনা, থাকবেনা কোনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ, মান অভিমান, হৃদয়ের টানাপোড়েন, ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয়। কোথায় আছে গো এমন জায়গা?
১১
শীতকালের এই এক সমস্যা। বিকেলটা একেবারে ছোট। দুপুর বেলা ভাত খেয়ে উঠে এক দুবার আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই বেলা ফুরিয়ে যায়। মাত্র কিছুটা সময় সূর্যদেব পশ্চিমের আকাশে বিরক্তি নিয়ে ঢলে থাকেন। এরপর সুযোগ বুঝে দৌড়। ঝপ করে ভারী কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা। আজ বিকেলে তিয়ানার সাথে দেখা করার কথা অয়নের। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বিছানায় একটু গা রেখেছিল। কম্বলের নিচে শুয়ে পড়তেই দুচোখ দখল করে আস্তানা গড়লো দুপুরবেলার বড় আদরের শৌখিন ঘুমটা। ঘুম ভেঙে দেখলো ঘড়িতে সারে চারটা বেজে গেছে। মোবাইলে তিয়ানার সাত আটটা মিসড কল। অয়নকে অবশ্য তেমন একটা বিচলিত হতে দেখা গেল না। তার ভাব দেখে মনে হলো, তিয়ানার তার জন্য অপেক্ষা করা এবং এত এত বার ফোন দেয়াটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সে আরো খানিকক্ষণ বিছানায় ইচ্ছে মতো গড়িয়ে নিল। এরপর বাথরুমের গীজার অন করে গরম পানি দিয়ে আরাম করে গোসল করল। দাদীমার নিজের হাতের বানানো দুধ চিতই পিঠা খেলো। সাথে গরম গরম চা। এত সব রাজকীয় কাজ সমাধা করতে করতে ঘড়িতে বেজে গেল সাড়ে পাঁচটা। মসজিদে তখন মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। গায়ে সাদা টি শার্ট আর ধুসর রঙের মোটা উলের চাদর জড়িয়ে রাস্তায় নেমে সে আয়েশী ভঙ্গিতে তিয়ানাকে ফোন করল।
— ‘হ্যালো’ তিয়ানার গলা থমথমে।
— ‘হুম, ফোন দিয়েছিলে?’
— ‘আশ্চর্য! কোথায় ছিলেন আপনি?’ তিয়ানা রাগে ফেটে পড়ল।
— ‘আমি? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম!’ অয়ন বলল উদাসীন ভাবে।
তিয়ানা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কী করছিলেন?’
— ‘ঘুমাচ্ছিলাম!’
— ‘মানে?’
ফোনের ওপাশে বোমা পড়ল যেন। তিয়ানার চিৎকারটা পুরোপুরি কানের পর্দা ভেদ করে মগজের ভেতর ঢুকে গেল। মোবাইল হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অয়ন। কোনো রকমে বলল, ‘কী আশ্চর্য! ঘুমাতে পারব না আমি?’ বেশ ইনোসেন্ট শোনালো ওর প্রশ্নটা।
— ‘আপনার আমার সাথে দেখা করার কথা বিকেল চারটায়, আমি আপনার জন্য ওয়েট করছি আর আপনি ঘুমাচ্ছেন!!!’
অয়ন কী বলবে খুঁজে পেল না। বেশ অনেক দিন হয় তাকে কেউ এমন ধমকের সুরে কথা বলেনা। এ লেভেলে ম্যাথস পরীক্ষার আগের দিন ক্রিকেট খেলতে যাবার অপরাধে বাবার কাছ থেকে শেষ বারের মতো রাম ধমক খেয়েছিল। বাবা অসুস্থ হয়ে যাবার পর অয়নকে ধমক দেবার মতো লোকের সংখ্যা খুব একটা থাকল না। দাদীমা মাঝে মাঝে কঠিন হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেন না। এ ছাড়া অয়নের আর আছে কে? বড্ড স্বাধীন জীবন তার। কোনো পিছুটান নেই। আজ তাই হঠাৎ করে এই পুঁচকে মেয়ের কথা বলার ধরন দেখে অয়ন রীতিমত বিষম খেয়ে গেল। মাথার ভেতর সব কেমন তাল গোল পাকিয়ে গেল। খুব হালকা গলায় বলল,
— ‘ইয়ে… তুমি এখন কোথায় আছ? আমি কি আসব?’
লাইন কেটে গেল, কিংবা কেটে দেয়া হলো। অয়ন রাস্তার ওপর কিছুক্ষণ বেক্কলের মত দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা চুলকে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো হাতড়ে আকাশ কুসুম ভাবল। এরপর ডায়াল করল আবার তিয়ানার নম্বরে।
— ‘হ্যালো!’ অভিমানে মেয়েটার গলা কাঁপছে।
— ‘হ্যালো! ইয়ে… মানে, একচুয়ালী, সরি! ইটস টোটালি মাই ব্যাড! তুমি কোথায় আছো বল তো! আমি আসছি’
— ‘শংকর’
— ‘ওহ, আচ্ছা তুমি থাকো, আমি আসছি’
— ‘আপনাকে শংকর আসতে হবেনা, বত্রিশ নম্বরে আসুন
— ‘ওকে ফাইন!’
বারিধারা থেকে ধানমন্ডি পৌঁছুতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। অয়ন বত্রিশ নম্বরের ব্রীজের ধার ধরে হাঁটছিল। বাতাসে শীতল ছোবল। চাদরটা দিয়ে মাথা মুড়িয়ে নিল সে। দু কান ঢেকে ফেলল। এই হাঁড় কাঁপানো শীতেও ঢাকার রাস্তায় রাজ্যের ভিড়। মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়, জীবনের ভিড়! এত এত মানুষ!! ছোট, বড়, ছেলে, বুড়ো, সব বয়সের মানুষ। সবার গায়ে নানা রঙের, নানা রকমের শীতের পোশাক। সারাটা বছর রোদের তেজে, গরমে পুড়তে থাকা মানুষ গুলোর চেহারায় পৌষ মাসের হাওয়া বুঝি একটু চাকচিক্য এনে দিয়েছে। শীতে কুঁকড়ে গেলেও সেই কোঁকড়ানোতে কোথায় যেন একটা শান্তির ছোঁয়া আছে। এরই মাঝে ফুটপাথে বসে থাকা শীতে কাবু হওয়া ছেঁড়া কাপড়ের হত দরিদ্র লোক গুলোর দিকে হঠাৎ তাকালে একটু কেমন বেমানান মনে হয়। সত্যি আমরা মানুষেরাই নিজেদের মাঝে নিজেরা কতটা বিভেদ তৈরি করে ফেলেছি। মনুষ্যত্ব বোধটাকে পকেটে পুরে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে চলাটাই আজকাল ভদ্রতা এবং সভ্যতার সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
— ‘ভাইজান, দুইটা ট্যাকা দিয়া যান, ভাত খামু!’
কথাটা শুনে অয়ন ধরা ধামে অবতীর্ণ হলো। দেখলো শীতে মরে যাওয়া খসখসে চামড়ার ছোট্ট একটা হাত তার দিকে এগিয়ে আছে। দশ কী এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। গায়ে একশত ফুটো ওয়ালা একটা সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট। ছেলেটার নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেই সর্দি মুছে নিয়ে পুনরায় সেই হাত নিজের প্যান্ট এই ঘষলো সে।
অয়ন বলল,
— ‘এই সন্ধ্যা বেলা তুই ভাত খাবি?’
প্রশ্ন শুনে বাচ্চাটা ফিক করে হেসে দিল, ফোকলা দাঁতে
— ‘হ খামু!’
— উঁহু, মিথ্যে বলছিস, সত্যি করে বল, টাকা দিয়ে কী করবি?’
ছেলেটা এবার কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেলল, ‘পিডা খামু, পিডা!’
অয়ন দেখল সত্যিই রাস্তার ধারে একটা বয়স্ক লোক বসে গরম গরম ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। দেখে তার নিজেরও লোভ হয়ে গেল। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে অয়ন বলল, ‘আয় আমার সাথে, পিডা খাওয়াই তোরে।’
বাচ্চা ছেলেটা আনন্দে নেচে উঠে অয়নের পেছন পেছন দৌড় লাগালো। রাস্তা বোঝাই গাড়ি আর রিকশা। কয়েকটা সিএনজিও আছে। গাড়ির হর্ণ, ইঞ্জিনের শব্দ, মানুষের কোলাহল সব কিছু মিলিয়ে একটা বিশাল হট্টগোল তৈরি হয়েছে। এই সন্ধ্যা বেলায় ঢাকার রাস্তা যেমন থাকে আর কী! যান্ত্রিক ব্যস্ততা।
— ‘ঠান্ডার মধ্যে হাফ প্যান্ট পরে আছিস কেন, শীত করেনা?’
ছেলেটা অদ্ভূত হাসে। যেন এমন মজার প্রশ্ন সে জীবনে কখনো শোনেনি।
— ‘শীত করে, কিন্তু ফুল প্যান্ট নাই, গত বসরের শীতে আব্বায় একটা কিনা আনছিল, হেইডা চুরে নিয়া গেসে’
অয়নের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে নিজে একটা বয়স্ক মানুষ জিন্সের প্যান্ট আর মোটা চাদরে সমস্ত শরীর ঢেকে রেখেছে আর এই বাচ্চা ছেলেটা কনেকনে ঠান্ডার ভেতর হাফ প্যান্ট পরে আছে। চিন্তা করা যায়! অয়নের মনে হলো সে অপরাধ করছে। গুরুতর কোনো অপরাধ। শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে কেমন একটা পাপবোধ জন্ম নিতে লাগল। হঠাৎ করে তার চেহারাটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দোষী সাব্যস্ত আসামীর মতো হয়ে গেল। সে বেকার মানুষ। পকেটে হয়তো টেনে টুনে দুইশ কী তিনশ টাকা থাকতে পারে। এই যৎসামান্য টাকা বিলিয়ে দিলে তার কাছে আর কিছুই থাকবেনা। নইলে বাচ্চাটাকে একটা প্যান্ট কিনে দেয়ার কথা ভেবে দেখা যেত। ভাপা পিঠায় কামড় বসিয়ে অয়ন ছেলেটাকে বলল,
— ‘আমিও… আমিও অনেকটা তোর মতোই’
গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা নিয়ে ছেলেটা তখন যারপরনাই ব্যস্ত। তবুও কোনো রকমে বলল,
— ‘কী কন? আপনে আমার মতো কেমনে হইলেন!’
অয়ন উদাস গলায় বলল,
— ‘গরীব! তোর মতোই গরীব আমি!’
ছেলেটা ফিক করে হেসে ফেলল, চোখ দুটোতে ফুটে উঠল গভীর বিস্ময়। অয়নের মতো এহেন চিড়িয়া সে জীবনে আর দুইটা দেখেনি সেটা তার চোখের ভাষাই বলে দিল। ফোকলা দাঁত নিয়ে হেসে উঠে সে বলল, ‘কী কয়!’
অয়ন হাসে, বড় দুর্বোধ্য হাসি, সুর করে বলে,
‘আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা।
আমি হলাম জন্মকানা
না পাই দেখিতে’
ছেলেটা শব্দ করে হেসে ওঠে। একটা পিঠা খাওয়া শেষ করে বলে ‘আরেকটা খামু!’
অয়ন আরো একটা পিঠার অর্ডার দেয়। হাঁটা দেবার আগে নিজের গায়ের চাদরটা খুলে পরিয়ে দেয় বাচ্চাটাকে।
লেকের দিকে আসতেই তিয়ানার সাথে দেখা হয়ে গেল। আজকে তিয়ানার সাথে গাড়ি নেই, আছে সাইকেল। পরনে সাদা লেদারের জ্যাকেট, কালো জেগিংস। মাথায় কান টুপি। চুলগুলো কানের ওপর দিয়ে এসে ঝুলে আছে ঘাড়ের ওপর। অয়ন মেয়েটার চেহারা সত্যি বলতে ভুলেই গিয়েছিল। ওর এই এক দোষ। এক দুবার দেখলে কোনো চেহারা মনে থাকেনা। আজকে মেয়েটার দিকে ভালো মত তাকিয়ে বোঝা গেল আর বছর কয়েক পরে এই মেয়ে নামকরা সুন্দরীদের খাতায় নাম লেখাবে। এখন এই বয়সেই রূপের তেজ ঝিলিক দিচ্ছে। অবশ্য বেশ অনেকদিন হয় তার কোনো মেয়েকে দেখে বুক কাঁপেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় বুকের ভেতরে মন নামের জিনিসটাই আর বাস করেনা।
তিয়ানা সাইকেল থেকে নামতে নামতে চমকে ওঠা গলায় বলল,
— ‘সে কি! আপনার গায়ে কিছু নাই কেন? এইরকম ফ্রিজিং ওয়েদারে আপনি জাস্ট একটা টি শার্ট পরে আছেন! রিডিকিউলাস!’
অয়ন হেসে বলল, ‘প্রায়শ্চিত্য করছি!’
— ‘কিসের প্রায়শ্চিত্য?’
— ‘পাপের!’
তিয়ানা হাসলো, ‘কী পাপ করেছেন আপনি, শুনি?’
— ‘সে কত পাপই তো করলাম এ জীবনে! হিসেব কি আছে?’
সাইকেলটা দু হাত দিয়ে টেনে নিয়ে হাঁটছিল তিয়ানা অয়নের পাশে। এদিকে লেকের ধারটায় বেশ অন্ধকার। সরু হাঁটার পথটা দিয়ে লোকজন আসা যাওয়া করছে। সাদা কুয়াশা ঘাপটি মেরে বসে আছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে।
শীতটা জানান দিচ্ছিল এবার। পাতলা টি শার্ট ভেদ করে একদম পাঁজরের হাড়ে গিয়ে কামড় বসাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। অয়ন হালকা কাঁপছিল।
— ‘আপনি কিন্তু বেশ অদ্ভুত আছেন!’ তিয়ানা নীরবতা ভাঙ্গলো।
— ‘হম.. তা আছি!’
— ‘যাই হোক, কী ঠিক করলেন?’
— ‘কী বিষয়ে?’
— ‘এই যে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবেন, কি করবেন না?’
অয়ন হেসে ফেলল। মেয়েটা সত্যি বাচ্চা। একটু বোকাও মনে হয়। অয়ন ঢং করে বলল,
— ‘বন্ধুত্ব কী করে করতে হয় জানিনা তো! শিখিয়ে দাও!’
তিয়ানা জেদী গলায় বলল, ‘ফাজলামো হচ্ছে?’
— ‘না সিরিয়াসলি! যেহেতু তুমি প্রশ্নটা করলে যে আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই কি চাই না, এর মানে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন অবশ্যই আছে যেটা করলে তুমি বুঝতে পারবে যে আমি তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই, রাইট?’
তিয়ানা একটু লাজুক গলায় বলল, – ‘আপনি খুব ভালো মতো বুঝতে পেরেছেন যে আমি কী বলতে চেয়েছি’
অয়ন হাসলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তুমি থাকো কোথায়?’
— ‘লালমাটিয়া’
— ‘শংকর কী করছিলে?’
— ‘ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলাম’
— ‘ওহ’
— ‘আপনি কী করছেন এখন? জব করেন?’ তিয়ানার প্রশ্ন।
— ‘কিছুই করিনা, খাই, দাই, ঘুমাই… হাঁটি, আর চিন্তা করি’
— ‘মানে? কিছুই করেননা আপনি? পড়ালেখা, চাকরি বাকরি কিছুইনা?
— ‘নাহ!’
— ‘কেন? আপনি বসে আছেন কেন?’
— ‘কী করব?’ অয়ন যেন খুব অবাক।
- ‘কী করবেন আবার, জব করবেন, ফারদার স্টাডি করবেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন!’
— ‘কেন এসব করতে যাবো? ধ্যুর!’
তিয়ানা বেশ অবাক হয়ে তাকালো অয়নের দিকে। বলল, ‘তাহলে আপনি করেন কী? সময় কাটে কী করে?’
— ‘বললাম না, খাই, ঘুমাই আর ভাবনা চিন্তা করি’
— ‘হিমু হতে চান?’
অয়ন এবার শব্দ করে হেসে ফেলল, ‘হা হা! ভালো বলেছ, হিমু!… রাইট! হিমু হওয়ার জন্য একটা চেষ্টা চালানো যায়!’
— ‘আঙ্কেল কী করেন?’ তিয়ানা ফট করে প্রশ্নটা করে ফেলল এবং এই প্রথমবারের মতো অয়ন তিয়ানার সামনে বিব্রত বোধ করলো। একটা অস্বস্তির ছায়া এসে ঢেকে দিল তার মুখ। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বেশ সময় নিয়ে আগুন ধরালো। চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলল,
— ‘কিছু করেনা
তিয়ানা ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’
অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। তার বাবা পাগল, বদ্ধ উন্মাদ। পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই একটা সত্য কথা তার স্বীকার করতে প্রচন্ড বাঁধে। এই একটা সত্যের মুখোমুখি হতে সে সর্বদা ভয় পায়। ব্যাপারটা মনে পড়লেই বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা হয়। হৃদপিন্ডের গতি কমে যায়। হাঁস ফাঁস লাগে।
অয়ন স্তিমিত গলায় বলল,
— ‘অসুস্থ, আমার বাবা অসুস্থ’
— ‘ওহ্, স্যাড! কী হয়েছে আঙ্কেল এর?’
— ‘সব কথা একদিনেই শুনে ফেলবে? এখন বরং তুমি বল, তোমার কথা শুনি
এই পর্বটা বুঝি তিয়ানার খুব পছন্দ হলো, ঝলমলিয়ে উঠে সে বলল, ‘আমি এবার ও লেভেল দিচ্ছি, আব্বু- আম্মু দুজনই আমেরিকায় থাকেন, এখানে শুধু আমি আর আমার বড় বোন আছি, আমার ফাইনাল হয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি ফ্লাই করব, ভিসার প্রসেসিং চলছে।’
— ‘বাহ! বাবা মা সাথে নেই, সীমাহীন স্বাধীনতা! হ্যা!’
তিয়ানা মিষ্টি হাসলো, একটুক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘একটা ব্যাপার জানেন?’
অয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, কিছু বললনা। তিয়ানা উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে বলল, ‘ইউ আর আ ড্যাম হ্যান্ডসাম ম্যান! ওহ মাই গড! আর আপনি কথাও বলেন দারুণ।’
অয়ন বোকার মতো হাসলো। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘রিয়েলি!’
— ‘রিয়েলি! আমার বয়ফ্রেন্ড কে আপনার কথা বলেছি লাস্ট ডেটে, হি ওয়াস কাইন্ডা জেলাস, ইউ নো!’
অয়ন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিল, মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। বলল কোনরকমে, ‘ওহ, এটা ভালো লাগারই বয়স, বয়সটাই এমন’
তিয়ানা জেদী গলায় বলল, ‘মোটেও না! আমার বয়স চল্লিশ হলেও আমি আপনাকে লাইক করতাম, আর আমাকে অত কচি খুকি ভাবাটা ঠিক হচ্ছেনা আপনার। ষোলো তে পড়লাম এবার, আপনি রাগ করলেননা তো আবার?’
— ‘না না, রাগ করব কেন, এ ধরনের কমপিস্নমেন্ট পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার, আমি হ্যাপী!’
তিয়ানা খিল খিল করে হেসে উঠলো, ‘তাই বুঝি? আপনাকে দেখে কিন্তু একটুও মনে হচ্ছেনা আপনি হ্যাপী, বরং মনে হচ্ছে আপনি ভয় পেয়েছেন।’
অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। তিয়ানার সামনে হঠাৎ নিজেকে বড্ড গেঁয়ো আর আনস্মার্ট মনে হতে লাগল। মিন মিনে গলায় বলল, ‘এবার যাওয়া দরকার, আমার তো আবার বাসা অনেক দূরে।’
১২
এক লোকমা ভাত মুখে তুলতেই বোঝা গেল তরকারিতে একটা ফোটা লবণ দেয়া হয়নি। ছোট চিংড়ি মাছ দিয়ে শিমের তরকারী, ডাল আর রুই মাছ। মা সচরাচর এহেন ভুল করেননা। বোঝা যাচ্ছে আজ তার কাজে মন নেই। ভুলক্রমে কখনো যদি এমনটা হয়েও যায় বাবাই খাবার টেবিলে খুব মেজাজ করেন। আজকে বাবাইয়েরও কোনো রিঅ্যাকশন দেখা যাচ্ছে না। নিষ্প্রভ চেহারা নিয়ে তিনি ভাতের গ্রাস তুলে যাচ্ছেন মুখে। আশিক পানসে মুখে বলল, ‘ইশশ! মা! কী রান্না করেছ এসব? লবণ হয়নি।’ মা বিষণ্ণ চোখ দুটো তুলে আশিককে একবার দেখলেন। এরপর বিষাক্ত গলায় বললেন, ‘যেমন আছে, তেমনই খেয়ে নে, বেশি ফট ফট করিসনা। তোদের জন্য এই খাবারই ঠিক আছে, তোরা তো ফকিরের জাত, মাইনসে তোদের লাথি দিয়া ঘর থেকে বের করে দেয়, তোদের আবার এত ফুটানি কিসের?’
আশিক চুপসে গেল। সে বাড়ি ফিরেছে একটু আগে। ঘটনা কিছুই তার জানা নেই। হতবাক চোখে সে একবার মায়ের দিকে তাকালো আরেকবার বাবাইয়ের দিকে। কোনো উত্তর না পেয়ে শেষমেষ আহিরের শরণাপন্ন হলো। মায়া লাগল আহিরের ছোট ভাইটার জন্য। বেচারার কাল বাদে পরশু পরীক্ষা। ওকে এভাবে আঘাত দিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয়? ওর কী দোষ? আহির এবার মুখ খুলল,
— ‘আহ! থামো তো মা!! কি শুরু করলা তুমি সকাল থেকে? ওরে এইসব বলতেছো কেন? ওর কি দোষ?’
মা আক্রোশে ফেটে পড়লেন, ‘তুই চুপ থাক! বেয়াদব কোথাকার! আমার ছেলের সাথে আমি কী বলব সেটা তোর শিখিয়ে দিতে হবে?’
বাবাইয়ের চিরদিনের স্বভাব এইসব সাংসারিক ঝগড়াগুলোর সময় মার পক্ষ নেয়া। আজকেও তিনি ঠিক তাই করলেন। বিরক্তি মাখা গলায় হঠাৎ উচ্চস্বরে আহিরকে বলে উঠলেন, ‘আহা থামতো! এত কথা বলিস কেন? চুপচাপ খেয়ে নে’
আহিরের এবার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
— ‘কেন চুপ করে থাকব বাবাই? বিপদটা আমাদের সবার ওপর এসেছে তাই না? মায়ের একার তো বিপদ না! আমাদের সাথে চোটপাট করে কী হবে তাই তো বুঝতে পারছিনা’
আশিক তারস্বরে বলে উঠল, ‘আহা হয়েছে কী সেটা তো শুনি!’
আহির খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। বাড়িটা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ঝুটা হাত বেসিনে ধুয়ে নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে আসলো। আশিকও আসলো পেছন পেছন। আজ আর কারো খাওয়া হলো না।
— ‘বুবু! কাহিনী কী বল তো?’ আহির বলল। সংক্ষেপে যতটা বলা যায়। আশিক থ বনে যাওয়া গলায় বলল, ‘হঠাৎ করে এমন করল কেন? মানে আমরা এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছি, ওদের কোনো রাইট নেই এভাবে এত অল্প দিনের নোটিশে তাড়িয়ে দেয়ার
— ‘এসব কথা তুই আর আমি বললে তো হবেনা। বাবাইয়ের কান্ডটা দেখেছিস? সকাল থেকে মুখের ভেতর ডিম নিয়ে বসে আছে। কোনো কথা বলছেনা। লাইফে বিপদ আপদ আসতেই পারে। সবাই এক সাথে ডিসকাস করে ডিসিশন নিয়ে সেই বিপদ মোকাবেলা করতে হবে তাইনা? আর মা আমাকে সমানে ঝাড়ি মেরে যাচ্ছে, তার ধারণা আমি বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে ফ্লার্ট করিনাই বলে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে। উফ! এই বাসার মানুষ গুলা সব এরকম কেন? পাগল হয়ে যাব আমি!’ আশিক ভ্রু কুঁচকালো, ‘তুমি কেন ওই ছেলের সাথে ফ্লার্ট করবা, আজব!’
— ‘তোর কী মনে হয়, আমার কি বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে গিয়ে কথা বলা উচিত? গিয়ে জিজ্ঞাসা করব হঠাৎ করে কেন এইসব করল?’
— ‘না না কোনো দরকার নেই’ আশিক বেশ পরিণত বয়সের মানুষের মতো বলল কথাগুলো।
— ‘তাহলে কী করবো?’ আহির অসহায়ের মত প্রশ্ন করে।
— ‘কথা বাবাইকে বলতে হবে, বলতে হবে যে আমরা যাব তো অবশ্যই, কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে সম্ভব না, কম পক্ষে তিন মাস সময় চাই।’
আহির একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু বাবাই কে সকাল থেকে খুব আপসেট দেখছি, তুই একটু কথা বলবি ওঁর সাথে?’
— ‘হুম, তা তো বলতেই হবে, তুইও চল’
মা জোহরের নামাজ পড়ছেন মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে। বাবাই টেবিলে বসে পরীক্ষার খাতা কাটছিলেন। আহিরদের দেখে একটু মেকী হাসলেন। তাঁর চোখের নিচে চিন্তার গভীর ছাপ। ঠোঁট দুটো শুকনো। এ কয়েক দিনে চেহারা আরো ভেঙ্গে গেছে। তাকালেই বড় মায়া হয়।
— ‘কিরে কিছু বলবি?’ আশিক একবার আহিরের দিকে তাকালো। আহির চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই সে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
— ‘ইয়ে, বাবাই, আমি বলি কি, তুমি একটু বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের সাথে কথা বল। উনাকে বুঝায়ে বল যে আমরা বাসা ছেড়ে দেবো, অবশ্যই ছেড়ে দেবো কিন্তু সময় দিতে হবে, কমপক্ষে তিন মাস সময় চেয়ে নাও’
বাবাই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললেন- ‘হ্যাঁ, সেটা না হয় বলা যাবে, কিন্তু তোরা এত ভাবছিস কেন? কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে, তোদের এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’
— ‘না ভেবে করব কী বাবাই? মা সকাল থেকে কি করছে তুমি দেখছনা? সব দোষ তো আমার ওপরেই চাপাচ্ছে।’
বাবাই হাসার চেষ্টা করলেন, ‘তোর মার কথা বাদ দে, সে বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করে, যাই হোক, আহির মা, তোর সাথে আমার একটু কথা ছিল।’
— ‘বল’
— ‘তুষারের আব্বা ফোন করেছিলেন।’
বুকটা ধক্ করে উঠল আহিরের। স্নায়ু টান টান হয়ে উঠল। কান হয়ে উঠল খাড়া।
— ‘তাই নাকি? কী বললেন তিনি?’ শীতল গলায় বলল আহির। বাবাই কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন,
— ‘উনি বললেন তোদের বিয়ের আগে একটা ওয়াল কেবিনেট বানিয়ে দিতে তুষারের ঘরে, মানে তোদের ঘরে, সাথে খাট, ড্রেসিং টেবিল এইসব আসবাবপত্র আর কী! ‘
আহিরের মুখে আগুনের গরম হলকার মতো কী যেন এসে লাগল। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আক্রোশ মাখা কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘আশ্চর্য! তোমাকে ফোন করে এসব বলার মানে কী! লোকটার সমস্যা কী?
বাবাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,–’থাক বাদ দে, যার যেমন কালচার আর কী!
আহির ঝড়ের মতো বের হয়ে আসল ঘর থেকে। ফোনটা হাতে নিয়ে তুষারের নম্বর ডায়াল করল। দুই তিনটা রিং পড়তেই তুষার ‘হ্যালো’ বলল ওপাশ থেকে।
— ‘এই, তুমি কোথায়?’
— ‘এইত, বাসায়, আজকে তো ছুটির দিন, কোথায় আর যাব!!’
— ‘শোনো, তুমি আমার সাথে একটু দেখা কর তো! কথা আছে!’
— ‘আবার কী হলো! কী কথা?’ তুষারের গলায় আতঙ্ক স্পষ্ট।
— ‘আরে বলবই তো, সামনা সামনি দেখা হইলে বলব’
— ‘কোথায় আসব?’
— ‘টিএসসি’
— ‘ওকে’
আহির যখন টিএসসি এসে তুষারের মুখোমুখি দাঁড়ালো, তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে। বাতাসে শীতের দাপট। আহির সুতির কামিজের ওপর একটা ফুলহাতা কালো সোয়েটার আর ধূসর রঙের পশমিনি শাল জড়িয়ে রেখেছে গায়ে।
— ‘তোমরা এইসব কী শুরু করেছ?’
— ‘মানে?’ তুষার অবাক!
— ‘তোমার আব্বা আমার বাপকে ফোন দিয়া যৌতুক চায় কেন?’ আহির প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে। তুষার একটু হকচকিয়ে উঠে বলল,
— ‘যৌতুক? যৌতুক হবে কেন?’
— ‘তাহলে কী? যৌতুক না তো কী?
— ‘গিফট! কাইন্ড অফ গিফট’
— ‘বাহ! প্রশংসা করতে হয় তোমার দৃষ্টিভঙ্গির, চমৎকার! যৌতুকের মডার্ন ভার্সন তাহলে গিফট তাইনা? তা আমি তো আমার ইহজন্মে কাউকে চেয়ে চেয়ে গিফট নিতে শুনিনি, গিফট দেয় মানুষ নিজের ইচ্ছেয়, আমার বাপের গিফট দিতে ইচ্ছে হলে নিজের পছন্দ মতো যা খুশি দিবে, তোমরা কেন বলে দিবা?’
তুষার এবার একটু চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি করছ, এত বাড়াবাড়ি কর কেন সব কিছু নিয়ে?’
— ‘বাড়াবাড়ি করছি আমি? তোমার কাছে এটা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে?’
— ‘তা নয়তো কী? আমার আব্বা যা মন চায় বলুক তোমার আব্বাকে তাতে তোমার এত কী? গালিগালাজতো আর করেনাই তাই না?’ তুষারের গলা চড়ে গেল।
— ‘তুমি!! তুমি কী করে বলতে পারছ কথাগুলো? লজ্জা করেনা তোমার? ছি:’
— ‘না লজ্জা করেনা, লজ্জা করার মত কিছু নাই এখানে, বিয়া দিবে তোমার বাপ আর এই অল্প কিছু ডিমান্ড ফুলফিল করতে পারবেনা, এইটা কেমন কথা!
আহির বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তুষারের দিকে। যেন সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কেউ একজন ধারালো ফলা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা। কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল,
— ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা! তুমি এতটা! এতটা নিচে নামতে পারো! আমি… আমি তোমাকে বিয়ে করবো না… আজকে থেকে সব শেষ! তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো চেষ্টা করবেনা, বুঝলে?’
তুষার কাঁধ নাচিয়ে বলল, ‘আচ্ছা যাও যাও, তোমাকে বিয়ে করার সাধ আমার মিটে গেছে, প্রতিটা জিনিস নিয়া হাউ কাউ না করলে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না না? ফালতু! যাও যাও! ভাগো!’
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের দরজা আটকে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলো আহির। রাতের খাবারও খেলনা। কারো সাথে কোনো কথাও বলল না। তার কান্না পাচ্ছিল না। বুকের ভেতর শুধু একটা ভারী বোঝা সাঁড়াশির মত আটকে আছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাবাই কয়েকবার দরজা নেড়ে ডেকে গেলেন। আহির কোনো সাড়া দিল না। তুষারের সাথে তাহলে সব চুকে বুকে গেল। কথাটা মাথায় আসতেই গা শির শির করে উঠল। তুষার! তুষারকে ছাড়া সে সত্যি থাকতে পারবে? পুরো একটা জীবন! মাথাটা ওলট পালট লাগছিল। অনেক রাতে তুষারের ফোন আসল। আহির কাঁপা হাতে ফোনটা ধরতেই তুষার ভাঙ্গা গলায় বলে উঠল, ‘তোমার কী হয়েছে বল তো? এমন করছ কেন তুমি আমার সাথে?
আহির আর পারলনা। ডুকরে কেঁদে উঠল ফোন হাতে নিয়ে। তুষার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘প্লিজ লক্ষ্মীটি! কান্না করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি দেখো, আমি সব ঠিক করে ফেলব।’
১৩
একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে বসেছিলো বারান্দার রেলিঙে। কর্কশ সুরে ডেকেই যাচ্ছে। অয়ন চেয়ারে বসে আছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে সে কাকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ওই ব্যাটা, কী সমস্যা তোর?’ কাকটা কী বুঝলো কে জানে, অয়নের প্রশ্ন শুনে নতুন উদ্যমে বুক ফুলিয়ে কা কা করে ডাকতে থাকলো। অয়ন আবার ধমক লাগালো, ‘চুপ থাক! ফাজিল কাক কোথাকার!’ কাক মহাশয় নির্বিকার। ডেকেই যাচ্ছেন, কা, কা, কা!
তখনও ভোরের আলো ফোটেনি পুরোপুরি। সাদা কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে রাতের আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে এখনো থমথমে ভোরবেলাটা। অয়ন বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি। ঘুম না আসার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। দ্যা বুক থিফ নামে একটা বই পড়তে গিয়ে রাত দুটো বেজে গেল। এরপর আর ঘুম আসলোনা। অয়ন টিভি দেখেনা, তার কোনো পার্সোনাল কম্পিউটার নেই। টেলিফোনে অযথা বক বক করার মতো কোনো বন্ধু নেই। গান শোনে মাঝে মাঝে। কিন্তু সেটা হঠাৎ হঠাৎ। খুব মন দিয়ে একটার পর একটা পছন্দের গান গুলো শুনে যায়। কিন্তু মূলত বই পড়া ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ নেই। শুধু এই একটা কাজ করতেই সে খুব ভালোবাসে, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে পার করে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু বই কিনতেও পয়সা লাগে। আজকাল তাই বই পড়ার পরিমানটা একটু কমে এসেছে বলতে হবে। হঠাৎ হাতে কিছু টাকা পয়সা চলে আসলে সে পটাপট বেশ কিছু বই কিনে ফেলে। কিন্তু হঠাৎ হাতে টাকা আসার সম্ভাবনা আজকাল একেবারে নেই বললেই চলে। দাদীমা তাকে মাসে একটা লাম সাম হাত খরচ দেয়। তাই দিয়ে কোনো রকম চলে তার। কিন্তু দাদিমার ওপর আর কত দিন এভাবে ডিপেন্ড করা যাবে? আজ নয়তো কাল তাকে তো নিজের পেটটা অন্তত চালাতে হবে! এছাড়া সে যে হারে সিগারেট খায়! এই ছাই পাস কেনার জন্যও তো টাকা চাই! নইলে বাঁচবে কী করে? কিন্তু করবেটা কী অয়ন! সকাল সন্ধ্যা চাকরী করা দাসত্বের জীবন সে কখনই মেনে নিতে পারবেনা। টাকার পেছনে ছুটে বেড়ানোর মত হীন কাজ পৃথিবীতে আর একটা আছে বলে তার মনে হয়না। অর্থের আদান প্রদানই মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের এক মাত্র কারণ। এই একটা জিনিস তৈরি করেছে মানুষের ভেতর বৈষম্য, লোভ, লালসা। ‘The same knife cuts bread and fingers!’ ব্যাপারটা ঠিক তাই। মানব সমাজ এই অভিশাপ থেকে কবে বেরিয়ে আসতে পারবে কে জানে! এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে রাতটা কেটে গেল। শেষ মেষ অবশ্য অয়ন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সে ঠিক করেছে টিউশনি করবে।
পাশের মসজিদে ফজরের আজান পড়ল। বহুদিন এত ভোর দেখা হয়না তার। শেষ রাতের দিকে রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে আসে। আজ অনেক দিন পর তাই এই পৌষ মাসের ভোরের কনকনে হাওয়াটা বেশ লাগছে। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হলো। অয়ন মৃদু চমকালো। চারপাশে তাকিয়ে দেখল। কোনো মানুষজন নেই। দোতলায় তার ঘরের বারান্দাটা থেকে বাড়ির উঠোন দেখা যায়। গ্যারেজ দেখা যায়। এখন পুরো জায়গাটা খালি। সুপারি গাছ আর কাঁঠাল গাছের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে বাড়ির মূল ফটক। শব্দটা আরেকবার হতেই অয়ন ঘুরে তাকালো। এবারে বুঝতে পারল শব্দটা আসছে তার ঘরের ভেতর থেকে। ঘরের সাথে লাগোয়া পেছনের বারান্দার দরজাটা বন্ধ। বুকটা হালকা ধুপুক্ করে উঠল। এই রাতভোরে তার খালি ঘরে এটা কিসের শব্দ? দরজা ভেতর থেকে লক করা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারারও কথা না! চোর টোর নয়তো আবার! অয়ন সন্তর্পণে বারান্দার দরজাটা খুলল। ঘরের বাতি নেভানো। অন্ধকার জেঁকে বসে আছে পুরো ঘরটায়। বারান্দার দরজা খুলতে একটু ফিকে হলো চারপাশটা। অয়ন অবাক হয়ে দেখল ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে। চাদর দিয়ে মাথা মোড়ানো। অয়নকে দেখে ছায়া মূর্তি কেঁপে উঠল একটু। এরপর এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কেউ কিছু বলল না, কিন্তু অয়ন কী করে যেন টের পেলো, ছায়া মূর্তিটি আর কেউ নয়, আয়শা।
অয়ন মনে করতে পারলো না রাতে ডিনার করে ঘরে আসার পর দরজা লক করা হয়েছিল কিনা। মনের ভেতর একটা ধোঁয়াটে রহস্যের জাল দানা বাঁধতে থাকে। তার হঠাৎ মনে হলো এই মুহূর্তে যদি সে জেগে না থেকে ঘুমিয়ে থাকতো তাহলে কোনো দিনও জানতে পারতোনা যে আয়শা এই ঘরে এসেছিল। এর মানে কি মাঝে মাঝেই আয়শা গভীর রাতে তার ঘরে আসে? কিন্তু কেন? কী আশ্চর্য! কেন??
১৪
কিছু কিছু দিন শুরুই হয় খুব সুন্দর ভাবে। সেই দিন গুলোতে কোনো খারাপ সংবাদ আসেনা, কেউ অযথা রাগ হয়না, খারাপ ব্যবহার করেনা। টিভিতে পছন্দের অনুষ্ঠান দেখার সময় হুট করে কারেন্ট চলে যায়না, গোসলের সময় কলে পানি থাকে, এমনকি মায়ের অল টাইম রেডিওটা পর্যন্ত সেদিন বিধাতার নির্দেশে একটু ধীর গতি সম্পন্ন হয়ে পড়ে। আহিরের মনে হলো আজকে সেরকম একটা দিন। ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে ঝলমলে একটা সকাল। আকাশ নীল। রোদ্দুরে তেজ নেই, গাছের শুকনো পাতায় হালকা হাওয়ার নাচন। সোনালি কাঁচের টুকরোর মত মিঠে রোদটা জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। চুপটি করে শুয়ে আছে আদুরে বেড়ালের মত আহিরের লেপের ওপর। দেখেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। দরজার কড়া নড়ছিল। আহির দরজা খুলে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছেন। আজকে তাঁর মুখ খানা হাসি হাসি। ঘুম থেকে উঠতেই মায়ের হাসি মুখ দেখতে কী যে ভালো লাগে! আহির মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মা এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন,
— ‘হ্যাঁ রে! তুষারের সাথে ঝগড়াটা মিটেছে তো?’
আহির অবাক গলায় বলল, ‘তোমার কাছেও চলে গেছে এই খবর! বাহ!’
— ‘তুই নাকি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি, ছেলেটা আমার কাছে কত আকুলি-বিকুলি হয়ে ফোন করল, তোর সাথে যাতে একবার কথা বলিয়ে দেই। তোকে এসে ডাকলামও কতবার, সাড়াই দিলিনা! তোর বাবাও ডেকে গেছে অনেকবার।’
— ‘ওহ!’ আহির অস্ফুট স্বরে বলল।
মা হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলে উঠলেন, ‘ছেলেটাকে কখনো কষ্ট দিস নারে! তোকে খুব ভালোবাসে!’
আহির একটু লজ্জা পেয়ে তাকালো মায়ের দিকে। মা কখনো এভাবে বলবে ভাবতেও পারেনি সে! বোঝা যাচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে বাবা মাও চাইছেন না তুষারের সাথে তার সম্পর্কে কোনো রকম চির ধরুক। হাজার হোক তুষার ভালো ছেলে। বিয়ের বাজারে আজকাল ওরকম ছেলে পাওয়া সত্যিই বড় কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় তুষারের সাথে আহিরের বিয়েটা না হলে বাবা মা বেশ সমস্যায় পড়বেন বলা যায়। আহিরের বয়সও তো একেবারে কম হলো না। চব্বিশ হয়ে গেল। নিজেরা দেখে শুনে বিয়ে দিতে হলে কম কাঠখড় পোড়াতে হবেনা।
আহির মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, ‘কষ্ট তো আমি দেইনা মা, সে আমাকে কষ্ট দেয়!’
মা এবার একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘সে কী! কেন? কী করে সে? নেশা টেশা করেনা তো আবার?’
আহির ফিক করে হেসে দিল। মায়ের হিসাব কত সোজা! কষ্ট দিতে হলেই যেন নেশা করতে হবে। নেশাগ্রস্ত মানুষ ছাড়া অন্য কেউ যেন কখনো কষ্ট দিতে পারেনা। মা কত সহজ, কতটা সরল! পুরো দুনিয়াটা কেন তার মায়ের মতো সহজ হলো না?
— ‘না মা, নেশা টেশা করেনা, কোনো নেশা না করেই কষ্ট দেয়ার অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সারাক্ষণ।’
— ‘এ আবার কেমনতর কথা!’ মা বললেন বিছানা গুছাতে গুছাতে।
আহির মায়ের গালটা একটু টেনে দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। এই একটু বাদেই তুষারের সাথে দেখা করার কথা তার। আজকে তারা যমুনা ফিউচার পার্ক যাবে। মার্কেটটা হয়েছে অনেক দিন, কিন্তু আহিরের এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ওটা যেহেতু তুষারের বাসার কাছে তাই আহির তুষারের বাসার ওদিকটায় চলে যাবে সোজা।
সে ঠিক করলো আজকে খুব সাজবে। এমন সুন্দর একটা দিনে একটু ভালো মতো না সাজলে কি হয়?
একটা জলপাই সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরল। মনে হলো এই রঙের একটা চাদর হলে ভালো হত। কিন্তু নেই। হাতে গোনা তিনটা উলের শালের মধ্যে দুটা কালো আর একটা বেগুনী। সাজতে গিয়ে দেখা গেল আই লাইনার শেষ হয়ে গেছে। কেমন মেজাজটা খারাপ লাগে! আজকের দিনে তো এমনটা হবার কথা ছিল না! আজ হলো সব ভালো হবার দিন। চোখ খুলেই আহির সেটা টের পেয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাটা মনের ভেতর একটু খচ খচানি ভাব এনে দিল 1 শুধু কাজল দিয়ে চোখের মেকআপ শেষ করল সে। আজকাল প্রায়ই মনে হয় তার গায়ের রংটা আরেকটু ফর্সা হলে বোধহয় ভালো হত। শ্যামলা গায়ের রঙে সাজগোজ করে আরাম নেই। আহির নিজের মনে নিজে ধ্যুর!’ বলে মেকআপের সরঞ্জামগুলো একপাশে সরিয়ে রাখল। ফুরফুরে মনটা একটু কেমন বেসামাল হয়ে পড়ল। নাহ! সাজটা মনের মতো হল না। প্রতিটা মেয়ের জীবনেই বোধহয় এমন একটা দিন আসে, যেদিন তার নিজেকে নিজের অসম্ভব রূপবতী হিসেবে দেখতে ইচ্ছে হয়। শুধু মাত্র নিজের জন্য, অপ্সরা সাজতে ইচ্ছে করে এবং সেই ইচ্ছেটা বেশির ভাগ মেয়েরই অপূর্ণ থেকে যায়। আহিরেরও আজ ঠিক তাই হলো।
সে যাই হোক। সকাল দশটার দিকে আহির তুষারের বাসার কাছাকাছি চলে আসলো। মাঘ মাসের মিহি সকালটায় তখন রিম ঝিম করা সোনালি রোদ। গাছের পাতা মৃদু দুলছে। আবছা হয়ে ঝুলে আছে পাতলা একটা কুয়াশার চাদর। আকাশ পরিষ্কার। তুষার রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটায় বসে ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কার সাথে যেন গল্পে মশগুল। আহির সিএনজি’র ভাড়া চুকিয়ে কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে আসলো। তুষার কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে অন্য কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একটা অদ্ভুত ছেলে!
সকাল সকাল বলে চায়ের দোকানটায় তেমন একটা মানুষ জন নেই এখন। তুষারের পাশে শুধু একজন বসে আছে বেঞ্চের ওপর। গেরুয়া রঙের চাদর পরা একটা বেশ লম্বা চওড়া ছেলে। চোখ পড়তেই চোখ আটকে গেল সেদিকে। ছেলেটার মাথা ভর্তি উস্কো খুস্কো চুল। মুখে কয়েকদিনের অবহেলার দাড়ি। ফরসা মুখে রোদ পড়ায় চিক চিক করছে গাল। চোখ দুটোতে কেমন অদ্ভূত গভীরতা। তুষারের আগে সেই ছেলেটাই দেখলো আহিরকে। চারটা চোখ একত্রিত হলো। কেউ জানলোনা দুটো মানুষ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হারিয়ে গেল বিস্মৃতির তীরে। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই শুধু মস্তিষ্কের নিউরনে স্ক্যান করে যাবার মতো টি টি টি একটা শব্দ। দেখেছে…. কোথায় যেন দেখেছে আহির এই চেহারাটা এর আগে। ভালো মতো তাকাতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, মনে হয় যেন অনেক অনেক দিন আগে, এই জন্মে না, আর এক জন্মে এই মানুষটার সাথে বুঝি ছিল তার অন্তরের গভীরতম সখ্যতা। এই জন্মে তাই ওই মুখটা এত বেশি চেনা চেনা লাগছে।
— ‘তুমি এসেছ?’ তুষারের কথার দমকে আহির ধরাধামে অবতীর্ণ হলো। একটু লজ্জা পেয়ে গিয়ে ব্ৰিত একটা হাসি দিল। তুষারের পাশে বসা ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে চট করে আহিরকে বলে বসলো,
— ‘আপনার সেল ফোনটা ভালো আছেতো?’
আহির অনেক কষ্টে হাসি সামলালো এবার। মনে পড়ে গেছে তার। আগের
জন্ম না, এই জন্মেই পাগলটা তাকে কম জ্বালায়নি। সেই যে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এই পাগলটার পাল্লায় পড়েছিল! পরে অবশ্য তার সৌজন্যেই হারানো
ফোনটা খুঁজে পেয়েছিল আহির। তুষার বেশ অবাক করা গলায় বলল,
— ‘কাহিনী কী? তোমরা কি পরিচিত নাকি?
অয়ন একটু কাব্যিক গলায় বলল, ‘হ্যাঁ তুষার, তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার পুরনো একটা হিসেব ছিল, তা অবশ্য চুকে বুকে গেছে’
আহির আবারও মিষ্টি হাসলো। ঝিলিক দিলো তার গজদন্ত। তুষারের মুখে তখনও কৌতূহল খেলা করছিল। অয়ন হাত বাড়িয়ে তুষারের সাথে হ্যান্ড শেক করে বলল,
— ‘আমি আসছি, তোমরা এনজয় করো, হ্যাভ আ নাইস ডেট!’
অয়ন চোখের আড়ালে সরে যাবার সাথে সাথেই তুষার আহিরকে জেঁকে ধরলো,
— ‘তুমি চেনো উনাকে?
— ‘একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি! তুমি চেনো উনাকে?’ বেশ ধারালো ভাবে বলল আহির।
— ‘আমি চিনবোনা কেন? আমার পাড়ার বড় ভাই, কত বছর হয়ে গেল আমরা এক সাথে আছি!’
— ‘ও আচ্ছা! কখনো শুনিনি তো তোমার কাছে ওনার নাম!
— ‘আজব! আমার এলাকায় তো কত বড় ভাইই আছেন তাইনা? সবার নাম তোমাকে শোনানোটা কি খুব জরুরী?’ তুষার একটু রেগে যাচ্ছিল। আহির সামলে নিলো পরিস্থিতিটা, নরম গলায় বলল,
— ‘না না, জরুরী কিছুই নয়, যাই হোক, উনি মানুষ কেমন?’
— ‘ভীষণ ব্রাইট! কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকায় বেচারা একটু কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে’
— ‘হুম, আমারও তাই মনে হয়েছে, কিছু একটা প্রবলেম আছে ছেলেটার ভেতর।’
আত্রি সংক্ষেপে ইন্টারভিউর দিনের ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে তুষার খুব হাসলো। হাসতে হাসতেই একটা সময় হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ে বলল,
— ‘ঝামেলাটা ওনার মায়ের সাথে, আমি যতদূর জানি উনার নিজের মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বাবাও বেঁচে নেই। লোকে এসব নিয়ে নানা কথা বলে, বলতে ভালোবাসে। আমি অবশ্য পার্সোনালি মানুষটাকে খুব পছন্দ করি।’
আহির কিছু বলল না। কিন্তু মনের ভেতর একটা অদ্ভূত নিষিদ্ধ ইচ্ছা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন যেন ওই এলোমেলো ছেলেটার কথা আরো জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল সারাটা জীবন ধরে ওই পাগলের গল্প শুনতে থাকলেও সে কখনো বোর হবে না।
ফিউচার পার্কের সামনে এসে দেখা গেল আজ বেজায় ভিড়। শনিবার। ছুটির দিন। সেই সুবাদে অনেকেরই পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা। গেটের কাছে জমে আছে মেয়ে, ছেলে, বুড়ো নানা বয়সের মানুষ। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব চারপাশে। ভালো লাগছিল আহিরের।
ঢোকার মুহূর্তে তুষারের সাথে এক অপরিচিতা মহিলা ধাক্কা খেলো। অপরিচিতার চোখে রোদ চশমা, গায়ে কালো সিল্কের শাড়ি, মুখে বেশ উগ্ৰ সাজ। তুষার সরি বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মেয়েটা চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুমি? তুমি এখানে কী করো?
তুষারের মুখখানা মুহূর্তে ছাই বর্ণ হয়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, ‘এইতো আসলাম!’
— ‘এইতো আসলাম মানে কী! সকাল থেকে তোমারে ফোন দিতেসি, তোমার ফোন বন্ধ!’
আহির দেখলো মেয়েটা কথা বলছে খুব পরিচিত ভঙ্গীতে। যেন তুষার তার অনেকদিনের বন্ধু। মেয়েটা এবার আহিরের দিকে অবহেলায় তাকালো।
— ‘এই মেয়ে কে?’
তুষার আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আহিরের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল। আহির পেছন ফিরে মেয়েটাকে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল। খুঁজে পেলনা। দাঁড়িয়ে পড়ে এক ঝটকায় হাতটা তুষারের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জোরালো গলায় বলে উঠল,
— ‘কী ব্যাপার? মেয়েটা কে?’
— ‘আরে! আর বলোনা! আমার পিছে লাগসে!’ তুষার বলল, আহিরের চোখের দিকে না তাকিয়েই।’
— ‘তোমার পিছে লাগসে মানে কী! তুমি কোনখানকার কোন শাহরুখ খান আসছো শুনি?’
— ‘আহ! সিনক্রিয়েট করোনা তো!’ তুষার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল। আহির ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। খচ করে যেন কেউ একজন বুকের ভেতর ধারালো কাঁটা বিধিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে উঠতে পারছিল না সে।