খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ১

পেটের কাছে কিসের যেন একটা খোঁচা লাগল। অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছিপছিপে দেহের এক মেয়ে ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভর দুপুরের বাসে এখন পিঁপড়ার মতো মানুষ ভিড় করেছে। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো প্রায়, কিন্তু শীতের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি নেই। বাতাসে কটু গন্ধ। ঘামে ভেজা জামা পরা বাস কন্ডাক্টর ভিড় ঠেলে লোকজনের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। সবার মুখে বিরক্তি আর ক্লান্তির ছাপ। অয়নের পরনে একটা সাদা পাঞ্জাবী। ঘামে ভিজে লেগে আছে শরীরের সাথে। এই এত মানুষের শরীরের ঘাম, তাপ, গন্ধের মাঝে ঘাড়ের কাছে একটা মেয়ের লেপ্টে লেগে থাকাটা আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিল অয়নকে। মেয়েটা আবার অয়নের পেটের কাছে তার শীর্ণ, শিরা ভেসে থাকা, ময়লা নখের হাতটা রেখে নাটুকে গলায় বলল, ‘দে ব্রাদার! দশটা টাকা দে!’

অয়ন এবার ভালো মতো তাকালো মেয়েটার দিকে। তাকিয়েই ভুলটা ভাঙলো। যাকে সে এতক্ষণ মেয়ে ভাবছিল সে আসলে কোনো নারীও না, পুরুষও না। তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ হিজড়া। শক্ত পোক্ত চোয়াড়ে চেহারা। হিজড়ারা সাধারণত দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু এর সাথে আশেপাশে কোনো সঙ্গীসাথী দেখা গেল না। অয়ন পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিল। টাকাটা হাতে নিয়ে হিজড়া সামনে দাঁড়ানো চল্লিশের কোটার এক টাকমাথা ভদ্রলোককে ঠিক একই ভাবে পেটে গুঁতা মারলো। ভদ্রলোক রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো, বজ্রসম কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার? গুঁতা মারতাসো কেন?’ হিজড়া সুরেলা গলায় বলে, ‘দে ব্রাদার! দশটা টাকা দিয়া যা!’ টাকমাথা বাসের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায়, ‘যা ঐদিকে! দূরে যা! একটা টাকাও দিমুনা! দূরে গিয়া খাড়ায় থাক!’ হিজড়ার গলাও সপ্তমে চড়ে যায়, ‘ও বাবা! কি দেমাগ! আরে কিপটারে কিপটা! দশটা টাকা দিতে তোর এত কষ্ট!’ টাকমাথা বাস কন্ডাক্টরের ওপর চড়াও হয় এবার, ‘কি মিঞা, এইসব লোকজনরে বাসে উঠাও ক্যান?’ বাস কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে ভিড়ের ভেতর থেকে হিজড়াকে হিড় হিড় করে টেনে বের করল। হিজড়াটারও কম তেজ না। সে বাস কন্ডাক্টরের হাতটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ক্যারে? আমগো উঠতে দিবিনা ক্যা?’

ভিড়ের ভেতর থেকে আরেকটা পুরুষ কন্ঠ ধমক দিয়ে উঠল, ‘এই চুপ থাকো!’

— ‘আপনে চুপ থাকেন!’

লেডিস সিটে বসে থাকা এক মাঝবয়সী মহিলা চাপা গলায় বলে উঠল, ‘কী, হচ্ছেটা কী এসব! ভদ্রলোকের জায়গা তো এটা নাকি!

মহিলার গলার আওয়াজ কন্ডাক্টরের কেরোসিন মাখা রাগে আগুন ধরিয়ে দিল। সে ঘোষণা দিল ‘ওই! পরের স্টপেজেই নাইমা পড়বি তুই, বুঝছস?’

হিজড়া কোনো কথা বলল না। বাশের কঞ্চির মত লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা থমথমে অপমানের ছায়া ভেসে উঠল তার পুরুষালী চেহারায়। বাসটা কিছুক্ষণের মাঝে ফার্মগেট চলে আসল। হুড়মুড় করে লোক নামতে থাকল। একজন আরেকজনের পা মাড়িয়ে ছুটতে লাগল। বাস কন-ডাকটর হিজড়াটাকে এবার পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় বাস থেকে। হিজড়া চিৎকার করে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। সে কিছুতেই নামবে না বাস থেকে। টাকমাথা ভদ্রলোক গলা চড়িয়ে গালাগাল দেয়া শুরু করে। সামনের সিটে বসে থাকা দুটো অল্প বয়সী ‘ছোকরা’ এবার নৈতিক দায়িত্ব মনে করে বসা থেকে উঠে হিজড়াটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামানোর কাজে লিপ্ত হয়ে যায়।

— ‘আরে আরে! করছেন কী!!’

ভিড়ের মাঝখান থেকে ভেসে আসা ভরাট একটা কণ্ঠস্বর বাসের ভেতরের ঘর্মাক্ত উষ্ণ বাতাসটাকে হঠাৎ থমকে দেয়। চমকে যাওয়া মুখগুলো এক দু সেকেন্ডের জন্য তাকায় অয়নের দিকে। লাভ হয়না খুব একটা আবার যে যার কাজে মগ্ন হয়ে যায়। অয়ন এবার তার প্রায় ছয়ফুট লম্বা শরীরটা নিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আচ্ছা এই মানুষটা আপনাদের কী প্রবলেম করছে বলুনতো! কেন একে বিরক্ত করছেন?’

টাকমাথা ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ জোরালো হলো, ‘আরে ভাই আপনি দেখলেন না, টাকা দেন টাকা দেন কইরা সবাইরে পাগল বানায় ফেলতেসে? কী প্রবলেম হইসে সেইটা আপনি চোখে দেখেন না?’

লোকটার কথা শেষ হবার আগেই হিজড়া সুযোগ পেয়ে বাপ মা তুলে গালাগাল দেয়া শুরু করে। অয়ন তার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

— ‘আহ! চুপ করুনতো! আপনি কোথায় নামবেন?’

হিজড়া অবাক চোখে তাকায় অয়নের দিকে। এই ভদ্রলোকের মত জামা পরা, ফর্সা, লম্বা চওড়া প্রায় দেবতার মতন দেখতে যুবকটি তাকে আপনি সম্বোধন করছে এ যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তার শক্ত পোক্ত লোহার গড়নের মুখ খানায় কোত্থেকে যেন হঠাৎ একটু নম্রতা চলে আসে, আমতা আমতা গলায় উত্তর দেয়, ‘মহাখালী’

— ‘ওকে ফাইন, মহাখালী পর্যন্ত আপনি এই বাসেই যাবেন কিন্তু কারুকে কোনো বিরক্ত করবেন না। একজন সাধারণ যাত্রীর মত চুপচাপ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন, স্টপেজ আসলেই নেমে পড়বেন।’ খুব রাশভারী গলায় কথাগুলো বলল অয়ন।

হিজড়া অস্বস্তি নিয়ে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো শুধু, মুখে কিছু বলল না।

অয়ন বাস কন্ডাক্টরের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আরে মিঞা, এমন কোনো ব্যাপার না, এত অস্থির হইওনা। বাস ছাড়তে কও, টাকমাথা ভদ্রলোক এবং তার সাগরেদরা হই হই করে উঠল, ‘এরা কি ভদ্রলোকের মত থাকতে জানে? আপনি ভাই বাঙালরে হাইকোর্ট দেখাইতেসেন। বাসে যে উঠসে বাসের ভাড়াটা পর্যন্ত দিবোনা আপনি জানেন?’

অয়ন বাস কন্ডাক্টরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওর ভাড়াটা আমি দিয়ে দেব, আপনি বাস ছাড়ুন।

কথাটা শোনা মাত্র কন্ডাক্টর তড়িৎ গতিতে ড্রাইভারকে বাস ছাড়ার নির্দেশ দিল। বাস চলতে শুরু করল। মারমুখো লোকজনগুলো কিছুক্ষণ নিজেদের মাঝে হইচই করে চুপ করে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো হিজড়াটা হঠাৎ করেই একেবারে নিপাট ভদ্র যাত্রী সেজে গেল। টু শব্দটি করল না বাকি পথ। মহাখালী আসতেই হুরমুড়িয়ে যাত্রীরা নামতে শুরু করল। হিজড়া নামার আগে একবার শুধু তাকালো অয়নের দিকে। ‘কিছু বলবেন?’ প্রশ্ন করল অয়ন।

একটু ইতস্তত করে কী যেন একটা চিন্তা করে নিয়ে হিজড়া বলল, ‘না, কিছুনা!’ বলেই নেমে পড়ল।

বাস আবারও চলতে শুরু করে। জানালা দিয়ে আসা গরম বাতাস নিশ্বাসের সাথে সাথে বুকের ভেতরটাকে শুষে নিতে থাকল। একটা সিট খালি হয়েছিল। অয়ন বসবার জন্য এগিয়ে যেতেই বয়স্ক এক ভদ্রলোক যেন ওর সাথে টেক্কা দিয়েই সেদিকে ছুটে গেল। কিন্তু জিতে গেল অয়ন। লোকটা কাছাকাছি আসার আগেই ঝপ করে বসে পড়ল সিটটায়। লোকটা ক্রুর চোখে তাকাল অয়নের দিকে। দৃষ্টি বাণে যেন ঝলসে দিতে চাইছে অয়নকে। অয়ন একটু মুচকি হাসল সেদিকে তাকিয়ে। বেচারা লোকটার চেহারায় সারা দিনের ক্লান্তির ছাপ। চোখের কোণে কালি। সব মিলিয়ে বড় অসুখী একটা মুখ তার। সেদিকে তাকিয়ে অয়নের হঠাৎ কেমন মায়া হলো। বলতে কী তারা মানুষ হয়েও দিন দিন কেমন ইট, পাথর গাছের মত অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়ছে। সবাই শুধু নিজের কথা ভেবে যাচ্ছে। অন্য একজনের সুখ দুঃখের কথা কেউ কখনো ভাবেনা। একটু ভালো থাকার জন্য, একটুখানি সুখের জন্য দিন রাত জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে থাকা, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো তবুও সুখের দেখা পায় না শেষ অবধি। রাস্তায় নামলেই দেখা যায় ক্লান্ত, অসুখী বিধ্বস্ত চেহারার মানুষগুলিকে। কষ্ট হয়, অয়নের বড় কষ্ট হয় এই বোকাসোকা, সহজ সরল অথচ পরিস্থিতির চাপে ধূর্ত হয়ে উঠতে চাওয়া মানুষগুলির জন্য। অয়নের মনটা অবশ্য আজ অন্য একটা কারণেও বেশ বিষণ্ণ। আজ বাবার জন্মদিন। একটা সময় এই মানুষটার জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হতো। এখন আর হয় না। বাবা যে আর আগের মতো নেই! আগের বাবা আর এই বাবাতে যে অনেক তফাৎ! বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। একটু বাদে বাসটা বনানী এসে থামে। অয়ন উঠে দাঁড়ায়। কেমন একটা অস্বস্তি খেলা করে তার চেহারায়। চিন্তার রেখা ফুটে উঠে কপালে। সচরাচর সে তার মায়ের অফিসে যায় না। আজ একটা বিশেষ দরকারে যেতে হচ্ছে। কিছু স্মৃতি মনে পড়লেই রোমকূপে রোমকূপে শুয়োপোকারা কামড়াতে শুরু করে। রাগে রি রি করে সারা শরীর। নিজের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখা দায় হয়ে ওঠে তখন।

আহির দিলশাদের সিরিয়াল নম্বর হয়। এখন তিন চলছে। জীবনে প্রথমবার ইন্টারভিউ দিতে এসেছে সে। এটা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী। আয়শা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। আহির শুনেছে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের মালিকের দেশের তিনটি টুরিস্ট স্পটে বিলাসবহুল হোটেল আছে। সাবান তৈরীর কারখানা আছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের মালকিন আয়শা খানম এ বছর বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পত্রিকায় নাম দেখেছে আহির। তার মানে অবস্থা বেশ রমরমা।

পোস্টটা যদিও একেবারেই যা তা। ফ্রন্টডেস্ক রিসিপশনিস্ট। মাইনে বিশ হাজার। মাইনেটা তার জন্য নেহাৎ কম নয়। ঝড়ে বকে চাকরিটা পেয়ে গেলে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে সে। এখানে কাজ করতে করতেই বিসিএস পরীক্ষাটা দিয়ে দেয়ার প্ল্যান আছে। যদিও চাকরী করে পড়াশোনা করা একটু ঝামেলার হয়ে যাবে। দশ তলার ওপরে এয়ার কন্ডিশন ঘেরা ওয়েটিং রুমের চেয়ারে বসে দুশ্চিন্তায় ঘামতে ঘামতে এইসব হাবিজাবি ভাবছিল আহির। আজকে ইন্টারভিউ উপলক্ষ্যে সে তার সবচেয়ে পছন্দের জামাটা পরেছে। ইস্ত্রি করা, সদ্য ভাঁজখোলা, অফ-হোয়াইট কালারের সুতার কাজ করা একটা সালোয়ার কামিজ। গত বছর ঈদের সালামীর টাকা জমিয়ে কেনা শখের হেয়ার স্ট্রেটনারটা দিয়ে ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে সোজা করেছে। মুখে হালকা ফেস পাউডার দিয়েছে। হাই হিল স্যান্ডেল পরেছে। লম্বায় অবশ্য অতটা খাটো না সে। পাঁচ ফুট চার, তবুও হাই হিল জুতোর সাথে স্মার্টনেসের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে তার ধারণা। সে নিজে যদিও খুব ভালো মতোই জানে যে যথেষ্ট স্মার্ট সে না। তবে তার চেহারায় এক ধরনের ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। কাটা কাটা নাক আর টানা চোখের মুখটায় একটা অসাধারণত্বের দাবী লুকোনো আছে। যেটা কোনো বুদ্ধিমান লোকের চোখ কখনো এড়াবেনা। এছাড়াও তার নজর কাঁড়া একটা হাসি আছে। হাসলে তার গজদন্ত ঝিলিক দেয়। ভারি মায়া লাগে।

আহিররা বসে ছিল কনফারেন্স রুমের সামনে, করিডোরে। মেঝেতে আয়নার মত ঝকঝকে টাইলস। নানা রকমের পেইন্টিং দিয়ে দেয়াল ঘেরা। বিশাল লম্বা আর প্রশ্বস্ত করিডোরটার দুপাশ বাহারী ফুলের টব দিয়ে সাজানো। টবে শোভা পাচ্ছে অর্কিড আর নানা জাতের পাতাবাহার। সিলিঙে ঝুলছে ঝাড়বাতি। আহির মুগ্ধ হয়ে দেখছিল চারপাশটা। ঠিক সেই সময় ওদের সামনে দিয়ে পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের এক দীর্ঘকায় যুবাপুরুষ বেশ দ্রুত পায়ে ঝড়ের বেগে কনফারেন্স রুমের দিকে এগিয়ে গেল। যুবকের পরনে সাদা পাঞ্জাবী। দরজার বাইরে একটা পিয়ন দাঁড়ানো ছিল। সে হন্তদন্ত হয়ে যুবকের পথ আটকে দিয়ে বলল, ‘স্যার, ভিতরে ইন্টারভিউ হচ্ছে, এখন যাওয়া যাবেনা!’

যুবক হুঙ্কার ছাড়ল, ‘আরে কিসের ইন্টারভিউ! আয়শা খানমকে ডাকো! বল আমি আসছি, এখনই দেখা করতে বল! আমার টাইম নাই!’

পিয়নটা হুঙ্কার শুনে ভয়ে জবুথবু হয়ে ঘরের ভেতর ছুটে গেল বার্তা নিয়ে। মিনিট দুয়েক পর ফিরে এসে বলল, ‘ম্যাডাম বলছেন একটু অপেক্ষা করতে।

যুবক যারপরনাই বিরক্ত হলো। পিয়নটার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অস্থির চিত্তে করিডোরের ভেতর পায়চারী করা শুরু করল। চেয়ারে বসে থাকা এবং এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে মেয়েগুলোর দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হলো। যুবক সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না। নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে রইল। ভ্রু কুঁচকানো, ঘামে ভেজা কাপড় পরা, অস্থির এলোমেলো যুবকটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আহির। নিঃসন্দেহে সুপুরুষ কিন্তু এর আচার আচরণে কোথায় যেন একটা অসংলগ্নতা আছে। কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে।

আরো মিনিট দশেক পর ছেলেটা ইন্টারভিউ রুমের দরজার ওপর হামলে পড়ল। এবারেও পিয়ন পথ আটকালো। একটা বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ল পুরো অফিস।

— ‘কিসের ইন্টারভিউ!! কোনো ইন্টারভিউ টিউ হবেনা এইখানে, যান যান! ভাগেন এইখান থেকে!

ঘরের ভেতরে যেন বজ্রপাত হলো। একটা অস্থিরতার ঢেউ খেলে গেল সবার মাঝে। পাগল ছেলেটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘আরে! কী বললাম! যেতে বললাম না আপনাদের? এখানে কোনো ইন্টারভিউ হবেনা!

কথায় কাজ হচ্ছেনা দেখে ছেলেটা একটা চেয়ার তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। একটা দুটো মেয়ে ভয়ে আৰ্তনাদ করে উঠল। এবার ফুলের টব ছুঁড়ে মারল। চিনে মাটির দামী ফুলের টবটা ঝকঝকে টাইলসের মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ছেলে মেয়ে গুলো দ্রুত পায়ে ছাড়তে লাগল জায়গাটা। আহির বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল পাগলটার দিকে। কিন্তু নড়তে পারছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় কেমন পাথর হয়ে গেছে সে। ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে একটা হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘কি? কথা কানে যায়না? যান এখান থেকে!!’

আহির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। দম বন্ধ করে এক নিশ্বাসে ছুটে এলো লিফটের দিকে। একি পাগলের পাল্লায় পড়ল! বাপরে বাপ!!!

রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে আসলো অফিস থেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুক ধড়ফড় করছে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউর দিনের অভিজ্ঞতাটা বেশ ভালোই হলো। একেবারে ইউনিক বলা চলে। ভবিষ্যতে নিজের ছেলে পুলে নাতি নাতনীদের সাথে বহুকাল এই গল্পটা করতে পারবে সে। একটা মুদির দোকান থেকে হাফ লিটারের ঠান্ডা পেপসি কিনে ঢক ঢক করে গলায় ঢাললো এবং ঠিক তখনই টের পেল তার প্রাণাধিক প্রিয়, বড় সাধের স্যামসাং গ্যালাক্সী এস ফাইভ ফোনটা সাথে নেই। হাতে ছিল। কিন্তু এখন দু হাতই খালি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে থাকল বুকের ভেতর। এখন কী হবে? এভাবেই গায়েব হয়ে যাবে তার এত কষ্টের টিউশনীর টাকা জমিয়ে কেনা জীবনের প্রথম এবং একমাত্র স্মার্ট ফোনটা! মনে হচ্ছিল কষ্টে কলিজাটা ছিঁড়ে যাবে। এই একটা ফোনের মাধ্যমেই পুরো দুনিয়ার সাথে সে কানেক্টেড বলা যায়। অসহায় একটা বোধ পুরো মনটাকে ছেয়ে ফেলল। খুব সম্ভবত যে চেয়ারটায় সে বসেছিল সেই চেয়ারটাতেই ফেলে এসেছে ফোনটা কিংবা এমনও হতে পারে ওই পাগলটার তাড়া খেয়ে দৌড়ে আসার সময় বেখেয়ালে হাত থেকে পড়ে গেছে মাটিতে। হায় খোদা! এখন কী হবে!! ওই পাগল পাড়ায় তো আবার ফিরে যাবার কোনো প্রশ্নই আসেনা! রাগে, দুঃখে, অপমানে চোখে পানি এসে গেল আহিরের। বেশ খানিক্ষণ তেজী রোদটা মাথায় নিয়ে হাভাতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আহির শেষ মেষ কী যেন ভেবে নিয়ে আবারও অফিসের দিকে এগিয়ে গেল। মোটা কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, যার হাতলের কাছে গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘Pull’ ঢুকতেই মোচওয়ালা এক গাট্টা গোট্টা সিকিউরিটি গার্ডকে সামনে পেয়ে গেল সে।

— ‘শুনুন!’

— ‘বলুন!’

— ‘আমার ফোনটা আপনাদের অফিসে ভুলে ফেলে এসেছি, দশ তলায়, আপনাদের কনফারেন্স রুমের সামনে, আপনি কি একটু বলবেন, কী করে ফোনটা ফেরত পেতে পারি?’ সিকিউরিটি উদাস ভাবে তাকালো আহিরের দিকে। তার তাকানো দেখে মনে হলো, ফোন হারিয়ে যাবার মত সস্তা এবং গুরুত্বহীন ঘটনা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সে ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘কী মোবাইল?’

— ‘কী মোবাইল মানে?’

— ‘মানে কী সেট?’

সেটের নামটা বলল আহির।

সিকিউরিটি এবার রিসিপশনে গিয়ে কিছু একটা বলল। রিসিপশনের মেয়েটা প্রায় মিনিট দশেক পরে ফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে খুব সাধারণ গলায় বলল, ‘ওয়েটিং রুমে একটা মোবাইল পাওয়া যায় নাকি দেখতো, স্যামসাং এর সেট’ আরো পনেরো কী বিশ মিনিট পর খবর আসল, না কোনো মুঠোফোন সেই দশতলার ওয়েটিং রুমে পাওয়া যায়নি। আহিরের চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসলো নিজের অজান্তেই।

অয়নের ডাক পড়ল ভেতরে। বিশাল কনফারেন্স রুমটা এখন ফাঁকা বললেই চলে। শুধু লম্বা টেবিলটার এক কোণে চিন্তিত মুখে বসে আছেন আয়শা খানম। এই পাওয়ারফুল এসির হিম বাতাসের ভেতরেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন এবং সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটু পর পর নাক টানছেন। যে কেউ দেখে ভাববে যে তার জ্বর, ঠান্ডা বা সর্দি হয়েছে বলে এই ঘন ঘন নাক টানা। কিন্তু ব্যাপার আসলে তা না। তিনি কোনো বিষয় নিয়ে অত্যাধিক চিন্তিত থাকলে বেখেয়ালে এই কাজটা করে থাকেন। আজকে তাঁর পরনে একটি লেমন কালারের সিল্কের শাড়ি। গলায় কানে ম্যাচ করা পাথরের দুল। উঁচু করে খোপা বাঁধা। ফর্সা গায়ের রঙ্গে হালকা লালচে আভা। একবার তাকালেই বোঝা যায়, যৌবনে এই মহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। যার রেশ এখনো এই বায়ান্নর কোঠায় এসেও রয়ে গেছে।

ধুপ ধাপ শব্দে বন্য জন্তুর মতো তেড়ে এসে সামনে দাঁড়ালো তার একমাত্র বখাটে এবং ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের অবাধ্য ছেলেটা। যে ছেলেটা একাই তার সমস্ত মান, সম্মান, প্রভাব, প্রতিপত্তি এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

আয়শা তাকালেন ছেলের দিকে। অয়ন ক্রুর দৃষ্টিতে তাঁকেই দেখছিল। আয়শার বুক থেকে দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। কত কত দিন কেটে গেল ছেলেটা তার দিকে মায়া ভরা চোখে তাকায় না। কে বলবে সামনে দাঁড়ানো কুটিল আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা তাঁর নিজের নাড়ী ছেঁড়া ধন! মায়ের দিকে কেউ এভাবে তাকায়!!

— ‘চাবিটা দিন!!’ অয়ন হুঙ্কার ছাড়ল।

আয়শা খুব ঠান্ডা স্বরে বললেন, ‘না, ওটা তোমাকে দেয়া যাবেনা!’

অয়নের ভ্রু দুটো আরো বেশি কুঁচকে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল, ‘ওটা আমার চাই!’

ছেলের সামনে আজকাল কিছুটা নার্ভাস বোধ করেন তিনি। পৃথিবীতে এই একটা মাত্র মানুষ! যার সামনে আয়শা খানম নার্ভাস হয়ে পড়েন!

— ‘একবারই বলেছি, দেয়া যাবেনা।’

— ‘কিন্তু কেন?’ অয়ন চিৎকার করে উঠল।

— ‘উনি অসুস্থ’

— ‘আপনি নিজেকে কী ভাবেন বলুন তো? কে আপনি? হু দা হেল আর ইউ? আমার বাবার সাথে আপনি আমাকে দেখা করতে দেবেন না!’

— ‘অয়ন! তুমি এখন যেতে পারো! অযথা সময় নষ্ট করছ। আর হ্যাঁ, আজকে যে ব্যবহারটা তুমি করেছ আমার অফিসের লোকজনদের সাথে ভবিষ্যতে আর কখনো এমনটা করার চেষ্টা করো না, খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি!’

— ‘আমাকে চাবিটা এই মুহূর্তে না দিলে আমি ওই ঘরের দরজা ভাঙতে বাধ্য হব!’ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল অয়ন।

আয়শা ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন। তিনি জানেন, অয়ন যা বলছে ঠিক তাই করবে। এই ছেলেকে আটকানোর মতো কোনো ক্ষমতা ঈশ্বর তাকে দেননি।

একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

— ‘অয়ন! আমি জানি আজকে তোমার বাবার জন্মদিন, কিন্তু এসব কিছুই বোঝার মতো অবস্থা তার নেই। অবস্থা এখন আরো খারাপ হয়েছে। তুমি সইতে পারবেনা।’

— ‘আমি সইতে পারব কী পারবনা সেটা আমার ব্যাপার! আপনি আমাকে আমার বাবার ঘরের চাবিটা দিন!’

আয়শা একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। হতাশ গলায় বললেন, ‘বাসায় যাও, মেইডের কাছে চাবি আছে, আমি ফোন করে দিচ্ছি, দরজা খুলে দেবে’। অয়ন আর দাঁড়ালো না।

দরজাটা খুলতেই স্যাঁতস্যাঁতে গুমোট একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। বন্ধ জানালার ফাঁক গেলে বেলা শেষের মরা আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। সেই আলোতে কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু মাথার ওপর সাঁই সাঁই শব্দে ঘুরছে সিলিং ফ্যান।

— ‘বাবা!’

অয়ন ডাকল। কোনো সাড়া শব্দ নেই। অয়ন আবার ডাকল,

— ‘বাবা!’

এবার ঝন ঝন শব্দে কিছু একটা নড়ে ওঠার আওয়াজ পাওয়া গেল। খুব ভারী একটা লোহার শেকল। যেই শেকলটা বাবার পায়ের সাথে বাঁধা আছে। আবছা আলো আঁধারে অয়ন দেখল মেঝেতে পড়ে থাকা একটা দেহ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। অয়ন আলো জ্বালালো। আলো জ্বেলে ওঠার সাথে সাথে পুরো ঘরটা একটা তীব্র আর্তনাদের ধাক্কায় ফেটে পড়তে চাইল। অয়ন চকিতে দেখল মাটিতে পড়ে থাকা তার বাবার শরীরে কোনো কাপড় নেই। তিনি আর্তচিৎকারে গলা ফাটিয়ে নিজের দুচোখ ঢেকে রেখেছেন। মুখ দিয়ে অদ্ভূত কিছু শব্দ গোঙানির মত বেরিয়ে আসছে। যার অর্থ অয়নের কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। অয়ন চট করে বাতিটা নিভিয়ে দিল। প্রকট চিৎকার থামল কিন্তু গোঙানি বন্ধ হলো না। সামনে এগিয়ে আসল অয়ন। হাঁটু গেড়ে বসলো বাবার সামনে। পকেট থেকে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে আগুন ধরালো। বাবার মুখটা একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠল লালচে আগুনের আলোয়।

মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোফ। চোখে ভয়াবহ অসহায়ত্ব। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। চাপা গলায় বলল,

— ‘বাবা… তুমি কেমন আছ?’

বাবা কোনো উত্তর দিলেন না ‘উঁ’ করে শুধু অদ্ভূত একটা শব্দ করলেন মুখ দিয়ে।

— ‘বাবা আমি অয়ন! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?’

বাবা তার থর থর করে কাঁপতে থাকা ডান হাতটা তুলে অয়নের আঙ্গুল ছুঁয়ে দিল। ছোট বেলায় সে বাবার আঙ্গুল ঠিক এইভাবে ধরত। মনে আছে শীতের সকাল গুলোতে বাবার আঙ্গুল ধরে মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়াটা অয়নের সবচাইতে প্রিয় কাজ ছিল। আজকে বাবার এই আলতো হাতে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়া দেখে সেই ছবিটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। অয়ন হাসল, প্রশ্রয়ের হাসি। উষ্ণ গলায় বলল,

— ‘শুভ জন্মদিন বাবা!’

বাবা কী বুঝলেন কে জানে, অয়নের আঙ্গুল দুটো নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে খেলা করলেন যেন কিছুক্ষণ। এরপর আকস্মিক একটা জোরালো কামড় বসিয়ে দিলেন অয়নের কানি আঙ্গুলে। অয়ন কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। বাবার দাঁতে জোর আছে বলতে হবে। হাতটা ছাড়িয়ে ছিটকে দূরে সরে আসল অয়ন। আঙ্গুলের চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। নিজের ঠোঁট দিয়ে রক্তাক্ত জায়গাটা শুষে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এ কী করলে তুমি? কেন করলে?’

বাবা নিশ্চুপ। বড় বড় দুটো চোখ ফেলে তাকিয়ে আছেন অয়নের দিকে। সামনে দাঁড়ানো এই ছেলেটাকে যেন তিনি চেনেনইনা। ছেলেটা যেন কথা বলছে কোনো অজানা বিদেশী ভাষায়। যে ভাষা তার কাছে পুরোপুরি দুর্বোধ্য।

অয়ন এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কেন তুমি এসব করছ? কেন পাগল সাজতে চাইছ!!’

অয়নের চিৎকার শুনে বাবা যেন একটু অবাক হলেন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ছেলের কথায় তিনি ব্যথা পেয়েছেন মনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার বন্য জন্তুর মত আক্রোশে ফেটে পড়ে অয়নের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন। বাঁধ সাধলো পায়ে বাঁধা লোহার শেকল। শেকলে টান খেয়ে এবারে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। ঘরের দরজাটা খোলা ছিল। দরজার সামনে বহু বছরের পুরনো চাকর রহিম মিঞা দাঁড়ানো ছিল। রহিম মিঞা অয়নের হাত ধরে তাকে টেনে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। বলল, ‘সাহেবের খাবার সময় হয়েছে! খাবার সময় হলে উনার পাগলামো বেড়ে যায়। সামনে যা পায় তাই কামড়াতে চায়। আপনি চলে আসুন। আমি ওনার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

অয়ন হেরে যাওয়া মন নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসলো। নিচতলার সবচেয়ে কোণের দিকের ঘর এটা। বসার ঘর আর খাবার ঘর থেকে যথেষ্ট দূরে। বাবাকে ইচ্ছে করেই মূল বাড়ি থেেেক একটু দূরবর্তী ঘরে রাখা হয়েছে যাতে বাইরের লোকজন বেড়াতে আসলে পাগলের চিৎকার শুনে হচকিয়ে না যায়। ঘরটার সামনেই একটা চৌকস বারান্দা। বারান্দা পার হলে চাকরদের দুটো বড় বড় ঘর সাথে রসুই ঘর। সেই ঘরের শেষে ছোট এক টুকরো উঠান। তারপর একটা লম্বা করিডোর গিয়ে মিশেছে বসার ঘরের সাথে। করিডোরের সাথেই লাগোয়া একটা ঘুরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।

এবার প্রায় মাস দুয়েক পর আসা এ বাড়িতে। অয়ন হঠাৎ হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়। প্রযুক্তির কোনো ডিজিটাল ফাঁদে তখন সে ধরা দেয়না। অয়নদের তিনতলা বাড়িটা বেশ পুরনো ধাঁচের হলেও একটা খানদানী ছাপ আছে। বোঝা যায় এদের পূর্বপুরুষদের বেশ জমিদারী হাল ছিল। এক পুরুষ যতটা কামিয়েছে তা দিয়ে পরবর্তী দুই তিন পুরুষ হেসে খেলে কাটিয়ে দিতে পারার মতো অবস্থা। হয়েছেও তাই। একটা সময় এমন ছিল যখন এ বংশের পুরুষরা বাইরে কোনো কাজ করত না। তাদের একমাত্র পেশা ছিল ভাড়ার টাকা আদায় করা এবং জমি বিক্রি করা। অয়নের নিজের দাদা অবশ্য এই করেই সহায় সম্পত্তি সব খুইয়ে পথে বসেছিলেন। শেষমেষ এই একটা বাড়িই কোনো রকমে বেঁচে যায়। যদিও জমিদারী চালটা এখনো এদের মাঝে বেশ খানিকটা রয়ে গেছে।

সিঁড়ি ঘরের কাছে এসে বুশরার সাথে দেখা হয়ে গেল। বুশরা, অয়নের একমাত্র ছোট বোন। অয়নের চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। ভাই বোনের মাঝে সচরাচর যেমন মধুর একটা সম্পর্ক থাকে, তাদের সম্পর্কটা ঠিক সে রকম নয়। একটা সময় অবশ্য বুশরা অয়নের বেশ ন্যাওটা ছিল। ছোট্ট, ফরসা, সিল্কি চুলের তুলতুলে ফুটফুটে বুশরা দেখতে অনেকটা বারবী ডলের মত ছিল। ভাইয়ু ভাইয়ু করে সারাটা দিন অয়নের পেছনে আঠার মত লেগে থাকত। অয়নেরও বেশ আদরের ছিল তার একমাত্র ছোট বোনটা। কিন্তু বাবার অসুস্থতার পর থেকেই সব কিছু বইয়ের পাতার মতো পাল্টে যেতে থাকল। বুশরার সাথে দূরত্বটাও সেই সময় থেকেই ঘনীভূত হচ্ছে। বুশরা অবশ্য এখন আর সেই ছোট্ট বারবী ডলটি নেই। এখন সে একুশ বছরের উঠতি যুবতী। একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে আছে সে।

বুশরা আসতেই চারপাশটা দামী পারফিউমের উগ্র গন্ধে ম ম করে উঠল । একটা রয়েল বসু কালারের আঁটসাঁট টপস তার পরনে আর কালো রঙের ঢোলাঢালা একটা অদ্ভুত প্যান্ট। মনে হয় নতুন কোনো ফ্যাশন হবে। পায়ে হাই হিল স্যান্ডেল। অয়ন আগাগোড়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তার বোনটিকে আজকাল অয়নের দিকে চোখ পড়লেই বুশরা নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের একটা ভাব করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবটা এমন যেন অয়নের গা থেকে ময়লা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। আজ অবশ্য একটু ব্যতিক্রম হলো। অয়নকে দেখে বুশরা চোখ কপালে তুলল,

— ‘তুই? এত দিন কোথায় ছিলি?’

অয়ন আলস্য ভরা একটা গলা নিয়ে বলল, ‘এইতো, ছিলাম আরকি!’

— ‘সব কিছুর একটা লিমিট থাকে ভাইয়া! পুরো দুইটা মাস তুই বাড়ি থেকে উধাও!’

— ‘হুম’

— ‘হুম মানে কী? এবার কী মতলবে এসেছিস? থাকবি কটা দিন? নাকি আবার ফুটুশ?’

অয়ন হাসলো। আজকে বাবার জন্মদিন! বুশরা সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। সে নিজেও বুশরার মত হতে পারলেই বোধহয় ভালো হত। বেশ হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়া যেত এই একটা জীবন। অয়নের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বুশরা অধৈর্য গলায় বলল,

— ‘কী, কথা বলছিস না কেন? তুই জানিস আমরা কি পরিমান দুশ্চিন্তায় ছিলাম তোকে নিয়ে? দাদীমার তো শরীরটা খারাপ করে গেল তোর চিন্তায়, মা ও ভীষণ দুশ্চিন্তা করছিলেন!’

অয়ন কাঠ কাঠ হাসলো, ‘কেন? তোর মায়ের আবার কিসের দুশ্চিন্তা?’

— ‘এভাবে বলিস কেন? মা কি শুধু আমার একার? তোরও তো মা!’ অয়ন ঠোঁট উল্টে উদাস গলায় বলল, ‘নাহ! আমার কোনো মা, টা নাই!’

— ‘ভাইয়া! তুই দিন দিন একটা যাচ্ছেতাই হচ্ছিস। ছিঃ! তোকে নিজের ভাই বলতে আমার লজ্জা করে।’

বুশরা একটু থেমে আবার বাঁকা সুরে বলে, ‘নিজেকে দেখেছিস আয়নায়? দাড়ি গোঁফ রেখে একি বানর সেজেছিস? তোর চেহারা খানা ভালোই ছিল। তুই ঠিক হয়ে যা ভাইয়া, আবার আগের মতো হয়ে যা!’

— ‘কিছুই আর আগের মতো হবে না রে, কোনো দিনও হবে না… তোকে বলছি, তুই নিজেও বেরিয়ে আয় ওই ব্ল্যাক ম্যাজিক থেকে, তোর জীবনটাও শেষ করে দেবে ওই কালো জাদুকর, কোন দিন দেখবি তুই নিজেও বদ্ধ পাগল হয়ে গেছিস, এরপর তোর জায়গা স্থানান্তরিত হয়ে প্রাসাদ থেকে নিচে নেমে চাকরদের ঘরে হবে।’

বুশরার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। ঘেন্নায় মুখ বাঁকিয়ে বলল,

— ‘নিজের মাকে নিয়ে কেউ এমন কথা বলতে পারে!! ছিঃ! তুই মানুষ না!!’

বাসায় ফিরতেই দেখা গেল বসার ঘরে বাড়িওয়ালার গোবেচারা ছেলেটা বেশ তেলতেলে মুখ নিয়ে সোফার ওপর বসে আছে। রান্নাঘরে উঁকি মারার সাথে সাথেই মায়ের নিত্য দিনকার রেডিওটা বিনা নোটিশে চালু হয়ে গেল।

— ‘এসেছেন আমাদের নবাবজাদী! ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন তিনি! বলি কেমন দেশ উদ্ধার করলেন আপনি ইন্টারভিউ দিয়ে?’

মায়ের সাথে আহির সচরাচর তর্কে যায়না। মা নিজের মতো নিজে বক বক করে যান, আহির শুনে যায়। আজকে আহিরের মেজাজটা আগে থেকেই তিরিক্ষি হয়ে আছে। সে অধৈর্য গলায় বলে উঠল, ‘উফ মা! চুপ করবে তুমি! কোনো ইন্টার ভিউটিউ হয়নি, উল্টা আমার মোবাইলটা খুইয়ে এসেছি।’

মা রান্নাঘরে টুং টাং শব্দে হাড়িপাতিল মাজছিলেন, আহিরের কথা শুনে বিষম খেলেন তিনি। হাতের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে চোখ কপালে তুলে বললেন,

— ‘সেকি! কীভাবে?’

আহির ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির একটা বোতল হাতে নিয়ে গলায় ঢক ঢক করে পানি ঢালল। এরপর ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার এত সাধের ফোনটা! আহ! কী কষ্টটা যে লাগছে মা!!’

— ‘আহা, হলো কীভাবে, তা তো বলবি!’

— ‘একটা পাগল! পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম! ওই পাগলটার জন্যই আমার ফোনটা হারালো! ওই হারামজাদা কে যদি সামনে পাই না কোনো দিন! উফ!! কী যে করব!! খুন করে ফেলব!

আহির রাগে গজ গজ করছিল। মা একটু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বললেন, ‘থাক, যা গেছে তা গেছে, জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিস সেই ঢের, কেন যে এইসব আজে বাজে জায়গায় যাস! তোর মতো মেয়ের কি চাকরীর অভাব হবে?’

আহির ফুঁসতে ফুঁসতে তার বেডরুমে আসল। মা হাতের কাজ ফেলে খুব ব্যস্ত হয়ে আহিরের পেছন পেছন এসে ফিস ফিস করলেন,

— ‘বাড়ি ওয়ালার ছেলে এসেছে ভাড়া নিতে, তুই গিয়ে একটু কথা বার্তা বল’

আহির খুব বিরক্ত হলো, ‘আমি কেন কথা বলতে যাব? ভাড়া নিতে আসছে, ভাড়া নিয়ে চলে যাবে, এত আদিখ্যেতার কী আছে?’

— ‘আমি বলছি আমার কথা শোন। ইয়ে, আমার মনে হয় এই ছেলের তোর প্রতি ইন্টারেস্ট আছে’

আহির চাপা আর্তনাদ করে উঠল, ‘উফ মা! ওর ইন্টারেস্ট থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! আমার ওই হাঁদারামটাকে একটুও ভালো লাগে না। দেখলেই বোঝা যায় যে এইটা একটা ফার্স্ট ক্লাস বেকুব’

মা আবার ফিসফিস করলেন ‘আস্তে বল, শুনবে তো!’

— ‘শুনুক কিচ্ছু আসে যায়না’

মা আহত চোখে আহিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অপরাধীর মতো মুখ করে চলে গেলেন। মায়ের এই মুখটা দেখলে মন খারাপ হয় এ কথা সত্য। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আহির জানে মা মনে মনে বাড়ি ওয়ালার ছেলেকে নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করে বসে আছেন। অথচ তুষারের সাথে আহিরের সম্পর্কের কথা মা খুব ভালো করে জানেন। ওদের সম্পর্কটা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। সবাই সবকিছু জানে, বুঝে কিন্তু ভাবটা এমন দেখাবে যে কিচ্ছু জানেনা।

তুষারের সাথে আহিরের প্রথম পরিচয় পাঁচ বছর আগে, কলেজ থেকে অংশগ্রহণ করা জাতীয় পর্যায়ের একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। ডিবেটে আহিরের পারফরমেন্স সবসময়ই খুব ভালো। রশিদ স্যার বলতেন ‘ট্রিমেনডাস পারফরমেন্স’ শেষ মেষ পুরো কলেজে আহিরের নাম হয়ে গিয়েছিল ট্রিমেনডাস আহির। রাস্তাঘাটে কলেজের বন্ধুদের সাথে আজও দেখা হলে দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলে আরে ট্রিমেনডাস আহির না? বসার ঘরের শো কেসটার বেশ বড় একটা অংশ দখল করে আছে তার ডিবেট করে পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার আর সন্মাননায়। আহির সেবার গ্রুপ লিডার ছিল। যথারীতি ‘ট্রিমেনডাস আহির’ তার যুক্তি খন্ডন দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করল এবং প্রতিপক্ষ দলের তৃতীয় বক্তা তুষার আহমেদ তার অসাধারণ যুক্তিখন্ডন দেখে একেবারে ‘প্রেমের মরা জলে ডুবেনা’ টাইপ প্রেমে পড়ে গেল। আহির কিন্তু তেমন একটা খেয়ালও করেনি হ্যাংলা পাতলা, লম্বাটে মুখের লাজুক তুষারকে। কিন্তু তুষার কী করে যেন আহিরের বাসার ল্যান্ড ফোনের নম্বর যোগাড় করে ফেলল। সে সময় আহিরের নিজস্ব কোনো মুঠোফোন ছিল না। তাই ল্যান্ড ফোনটাই তুষারের একমাত্র সম্বল হয়ে ধরা দিল।

প্রথমে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল ছোট ভাই আশিক। কদিন ধরে ঘটনাটা বার বার ঘটছে। ফোন ধরার সাথে সাথেই গলার আওয়াজ শোনা মাত্র ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া হয়। আচ্ছা যন্ত্রণা তো! আশিক বাবাইয়ের কাছে গিয়ে সরাসরি নালিশ করল, ‘বাবাই তুমি খুব দ্রুত ফোনটা কলার আইডি করো, কারা যেন ফোন দিয়ে তামশা করে।’

বাবাই একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এরপর ফোন আসলে আমি ধরব, তোরা ধরিসনা।’

ফোন আসল এবং বাবাই রিসিভ করতেই খুট করে লাইনটা কেটে গেল। বাবাই থমথমে মুখে মাকে বললেন, ‘এরপর তোমার পালা’

মা কিছু চিন্তাভাবনা না করেই বলে ফেললেন, ‘বাড়িতে জোয়ান মেয়ে থাকলে ওরকম রহস্যজনক ফোন এসেই থাকে’

বাবাই তার স্বভাব সুলভ আমুদে গলাটাকে গম্ভীর করার চেষ্টা করে বললেন, ‘তা সেই জওয়ান মেয়েছেলেটা কে? তুমি নও তো? তোমার মুখটা অমন শুকিয়ে গেল কেন শুনি?’

মার মুখটা দেখার মতো ছিল। ক্লাস এইটে পড়ুয়া উঠতি বয়সের ছেলের সামনে এহেন মশকরার কোনো মানে হয়? আহির পাশের ঘরে পড়ার টেবিলে বসে এইসব কথোপোকথন শুনে খুব হাসছিল। মা রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের সময় বাপু আমরা ঘরের বাইরেই পা রাখতামনা গার্জিয়ান ছাড়া, আমার কথা ছেড়ে নিজের আদরের কন্যাটির কথা একবার ভাবো, তাকেই ডেকে বল ফোনটা ধরতে, আমার তো মনে হয় সে কলেজে গিয়ে এর মাঝেই কোনো রোমিও জুটিয়ে ফেলেছে, সেই রোমিও এখন আমাদের ঘুম হারাম করছে

বাবাই উদাস গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ের পেছনে দু একটা রোমিও ঘুরে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক, এতে অন্যায় কিছু নেই, তবুও দেখি ডাকো তাকে, ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাক’

আহির পাশের ঘরে বসে এমন কোনো রোমিওর চেহারা মনে করতে পারল না। গিয়ে বসলো বাবাইয়ের পাশে। ফোন আসল, আহির ধরল, কিন্তু দেখা গেল ওটা ছোট খালার গলা। সেই রহস্যময় ফোনটা আর সে রাতে আসল না। আসল পরদিন সকালে। সবাই যখন নাশতার টেবিলে একটা হুড়োহুড়ির মাঝে মুখে খাবার ঢুকাচ্ছে সে সময়। বাবাই একটা সরকারি কলেজের ইংরেজির লেকচারার। সকাল দশটায় তার ক্লাস শুরু। আহিরের নটায় আর ছোট ভাইটার সাড়ে নটায়। সে রকম একটা নাকে মুখে ওঠা সময়ে ফোনটা আসল। মা হিমশিম খাওয়া গলায় ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে একটা ঘ্যাস ঘ্যাসে গলা খুব নরম সুরে বলল,

— ‘স্লামালিকুম! আন্টি! আহির আছে?’

— ‘তুমি কে?’ মা হুঙ্কার ছাড়লেন। কোনো ছেলে এই প্রথম আহিরকে ফোন

করে চাইল। ওই পাশের গলার স্বর আরো নরম হলো,

— ‘জ্বি, আমি ওর ক্লাসমেট!’

— ‘ক্লাসমেট? কিসের ক্লাসমেট? ওদের কলেজে তো ছেলেরা পড়েনা। ‘জ্বি, আমি ওর সাথে কোচিং এ পড়ি’

— ‘ও! তো কী দরকার তোমার ওর সাথে?’

ছেলেটা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে, ক্লাসের ব্যাপারে একটু কথা ছিল, ওকে কি একটু দেয়া যাবে?’

মা মুখখানা মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর বানিয়ে আহিরকে ডাকলেন, ‘এই, তোর ফোন’,

আহির ফোন ধরল, হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে যান্ত্রিক ভাবে একটা গলা কথা বলে উঠল,

— ‘আহির শোনো, আমি তুষার, তোমার কলেজের গেটের সামনে আজ পৌনে নটার দিকে দাঁড়িয়ে থাকব। আমি কালো শার্ট পরে থাকব, কথা আছে, প্লিজ, একটু সময় দিও, ওকে বায়!’

আহির স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। ফোনটা রাখতেই তিন মূর্তি তার দিকে এমন অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে রইল যে সে নিজেকে কোথায় লুকাবে বুঝে পেল না।

গেটের সামনে কালো শার্ট পরা কম পক্ষে তিনজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। এদের মাঝে একজন অবশ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। বাকি দুজন ছোকরার মাঝে কোনটা যে সেই ফোনের ছেলেটা, আহির তা বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকার মুহূর্তেই একজন পথ আটকালো।

আহির দেখল হ্যাংলা পাতলা, লাজুক লাজুক চেহারার একটা ছেলে। চোখের মাঝে এমন একটা অদ্ভূত ভালোমানুষীর ছাপ আঁকা আছে যে দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ছেলেটা ওকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল তা হলো,

— ‘তুমি কি ফেসবুকে আছ?’

হতবাক আহির অনেক কষ্টে উত্তর দিয়েছিল, ‘হুম, আছি, বাট অতটা একটিভ না’

ছেলেটা যেন চাঁদ হাতে পেল, উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘রিয়েলি! আমি তোমাকে এত খুঁজলাম, পেলাম না কেন? কী নামে আছ?’

আহিরের যেন এতক্ষণে একটু বোধদয় হলো সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে বলব কেন?’

ছেলেটা সাদাসিধে গলায় বলল, ‘আমি তোমার সাথে… আই মিন তোমার সাথে কথা বলতে চাই’

আহির বলল,

— ‘বলুন কী বলবেন?’

— ‘না মানে এভাবে না, ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই।’

আহির হঠাৎ খুব কঠোর হয়ে বলল, ‘হাঁটুন!’

— ‘সরি?’

— ‘বললাম, হাঁটুন, আমি ফ্রেন্ডশিপের দোকান খুলে বসিনাই!’

আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আহির হাঁটা দিল। এই ছিল তুষারের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের গল্প। এরপর অবশ্য দীর্ঘ দুই বছর তুষার আহিরের পেছনে জোঁকের মত লেগে ছিল। শেষ মেষ একটা সময় আহির নিজেও পটে গেল। মা প্রথমটায় ঘোর আপত্তি তুললেন। বরিশালের লোকের সাথে তিনি সম্পর্ক করবেন না। তুষারের একমাত্র দোষ তার দাদার বাড়ি বরিশাল, এই দোষে দুষ্ট বলে মা তাকে মেয়ের জামাই করতে নারাজ। আহিরের নিজের বাড়ি সিলেট। মা সিলেটের ছেলের সাথেই সম্বন্ধ করতে চান।

জীবনের ঘোর সংকটের সময় প্রতিবার বাবাই আহিরের একমাত্র সহায় হয়ে ওঠেন। এবার অবশ্য ঘটনা ব্যতিক্রম। মেয়ের প্রেমিককে তিনি কোন দৃষ্টিতে দেখবেন আহির সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল। বাবাই সব শুনে টুনে আহিরকে ডেকে বললেন,

— ‘কাহিনী কী? আম্মাজান?

আহির মিনমিনে গলায় বলল, ‘বাবাই, তুষার আমাকে খুব ভালোবাসে, খুব, আর কেউ কখনো আমাকে ওর মত করে ভালোবাসতে পারবেনা’

বাবাই চিন্তিত গলায় বললেন, ‘বেশ ভালো কথা, কিন্তু ও তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমি জানতে চাইনি। আমি জানতে চেয়েছি তুই তাকে কতটা চাস? সেটাই আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট’।

আহির কী বলবে ভেবে পেলনা। এভাবে সে কখনো চিন্তা করেনি। তুষারের চাওয়াটা বরাবরই এত বেশি ছিল যে সেই চাওয়ার ভারে তার নিজের চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে মুহূর্তে আহির কোনো উত্তর দেয়নি বাবাইকে। সারারাত ভেবেছে। ভেবে ভেবে কোনো কূল কিনারা পায়নি। আসলেই সে তুষারকে ভালোবাসে কিনা সেই টপিকের ওপর বান্ধবীদের সাথে বেশ কবার গোলটেবিল বৈঠক বসালো এবং শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, তুষারের সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে, তুষারের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে ভালো লাগে, দু একদিন তুষারের সাথে দেখা না হলেই তার মনটা ছটফট করে, এর মানে সে তুষারকে ভালোবাসে। এই উপলব্ধির পর বাবাইকে বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে বলল, ‘বাবাই, তুষার কেই চাই আমার, তুমি মাকে বুঝাও’

বাবাই চিরকাল আহিরের বড় বাধ্য। মাকে বোঝানোর দায়িত্বটা তিনি পুরোপুরি নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। কিন্তু হায় মা আজও বুঝে উঠতে পারলেন না। পারলে কি আর বাড়িওয়ালার ছেলেকে নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা করতেন?

বসার ঘরে ছাগলটা এখনো বসে আছে। আহির মাকে গিয়ে বলল, ‘ভাড়ার টাকা দাওনি তুমি এখনো ওর হাতে?’

— ‘দিয়েছি তো!’ মা থমথমে গলায় বললেন।

— ‘তাহলে বসে আছে কেন এখনো?’

— ‘আমি কী জানি!’

— ‘চা নাস্তা কিছু দেবার থাকলে দিয়ে দাও, খেয়ে দেয়ে বিদায় হোক’ মা একটু চুপ করে থেকে অপরাধীর গলায় বললেন, ‘আমি দুপুরে আমাদের সাথে খেতে বলেছি ওকে’

আহিরের মেজাজটা তড়াক করে সপ্তমে চড়ল। আজকের দিনটাই একটা কুফা। ধুর ছাই!

গট গট করে সে বাসা থেকে বেরিয়ে আসল। ওপর তলায় চৈতিদের বাসায় গিয়ে বরং বসে থাকা ভালো এই গাধাটার সাথে লাঞ্চ করার চাইতে। বের হবার মুহূর্তেই গাধাটা মিনমিনে স্বরে বলে উঠল, ‘ইয়ে, আহির! কোথায় যাচ্ছ?’

আহির মুখটা বাঁকা করে বলল ‘ডেটিং এ!’

বেচারার চেহারাটা মুহূর্তে ছাইবর্ণ হয়ে গেল। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে কোনো রকমে বলল,

— ‘মানে?’

— ‘মানে আমার বিএফের সাথে মিট করতে যাই!’

ছেলেটার মুখে তখন গভীর বিষাদের ছায়া। আহির নিষ্ঠুরের মত সেই বিষাদ মাখা মুখটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাঁটা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *