খলসেখালির পুঁটিরাম
খলসেখালির পুঁটিরাম মল্লিককে চেনে না এমন লোক খলসেখালিতে নেই। আহা খলসেখালি হবে কেন মাগুরখালি, কইখালি, ট্যাংরাখালি, চুনোখালি, আশপাশের সাত গ্রামের কে না শুনেছে দিল্লি ফেরত পুঁটিরাম মল্লিকের নাম! তিনি খলসেখালি থাকেন। তাঁদের সাতমহলা ভুতের বাড়িতে একা। খলসেখালির লোক বলে, তাঁর তিনটি পোষা ভূত আছে। একজনে রান্না করে। জামা কাপড় কাচে।আর একজন জমি চষে। শেষের জন ফাই ফরমাস খাটে। ফাই ফরমাস মানে দোকান-পাট করা, হাট-বাজারে যাওয়া ইত্যাদি। পুঁটিরাম ভূত খাটিয়ে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে আয়েশ করে। খলসেখালির বড় দোকানদার ধনঞ্জয় সামন্ত বলে, পরে টের পেয়েছে তারা ভূত,তার দোকানে এক একদিন, এক একজন আসে। দিনে নয় সন্ধের পর। তাকে এই গ্রামে দ্যাখেনি সে কোনদিন। সর্ষের তেল, চিনি, মুসুর ডাল, আটা ময়দা এইসব কিনে নিয়ে যায়।
কেমন চেহারা? সত্য হাজরা জিজ্ঞেস করে।
বলছি দাঁড়াও, একটু কাজ মিটিয়ে নিই। ধনঞ্জয় সামন্ত এক কেজি চিনি ওজন করতে করতে উত্তর দেয়। সে খুব খুঁতখুঁতে। ওজন যেন এক গ্রাম বেশি না হয়, আবার সিকি গ্রাম কমও না হয়। ফলে ওজন করতেই তার সময় যায়। ওজন করে সে আনন্দ পায়। ওজন করতে করতে সে পুঁটিরামের বিবরণ দেয়, তাও একেবারে নিক্তিতে নিক্তিতে ওজন করে। কমও হবে না, বেশিও না।
পুঁটিরাম বহুদিন নাকি দিল্লি ছিল। ফলে খলসেখালি গ্রামে তার দাম অনেক বেশি। সে কী না জানে? পুঁটিরামই তো প্রথম জানালো, দিল্লি কা লাড্ডু আসলে ভেলি গুড় আর মটর ডাল দিয়ে তৈরি হয়। টকে ভরা। খাইলেই পস্তাতে হবে।আবার না খাইলেও তাই। পুঁটিরাম চিমসে রোগা, দিল্লি থেকে গোলগাল মোটাসোটা হয়ে ফিরেছে। মাথা ভর্তি চুল, পান খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া দাঁত, পায়ে নাগরাই, পুঁটিরাম মল্লিক মায়ের মৃত্যুর পর বাড়িতে তালাচাবি মেরে দিল্লি চলে গিয়েছিল ভাগ্য ফেরাতে। বাবা ছিল না। সেই পুঁটিরাম পনের বছর বাদে দিল্লি থেকে ফিরেছে হঠাৎ। ফিরে দিল্লির গল্প করে শুধু। পুঁটিরামের কথা শোনাতে শোনাতে ধনঞ্জয় বলে, মুখ ঢাকা, চোখ দেখা যায় শুধু।
কার মুখ ঢাকা, চোখ দেখা যায়? সত্য হাজরা জিজ্ঞেস করে। খলসে খালির সত্য হাজরা খুব ঝগড়ুটে মানুষ। সবার সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধানো তার অভ্যেস। কিন্তু ধনঞ্জয়ের সঙ্গে সে ঝগড়া করে না বড় একটা। তাহলে এখানে বসে তার ছোট ভাই নিরীহ, ভালো মানুষ নিত্যহরির সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাতে পারবে না। ধারে বিস্কুট লজেন্স খেতে পারবে না। সত্যর কথার উত্তর দেয় ধনঞ্জয় একটু দেরি করে। খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। এক গ্রাম কম বেশি হচ্ছে অনেকক্ষণ। সেই সমস্যার সমাধান করতেই টাইম গেল। এরপর কর্মচারী ভুতোকে দায়িত্ব দিয়ে ধনঞ্জয় মন দিল পুঁটিরামের কথায়। সত্য শুনতে শুনতে বলে, তাহলে একদিন সন্ধেয় আসতে হয়, দেখতে হবে কেমন ভূত।
আরে তুমি ভূতের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করবে নাকি?ধনঞ্জয় উদ্বিগ্ন গলায় বলে।
দোষ করলে তো বলবই, ছেড়ে দেব না। সত্যহরি বলল।
না না, ভূতটুতে আমার একটু সমস্যা হয়, তার উপর খদ্দের বটে, শুনেছি, মানে পুঁটিরাম বলে, দিল্লির লাল কেল্লার ওখানে অনেক ভূত আছে, ভূত দিল্লিতে অনেক কাজ করে দেয়।ধনঞ্জয় বলে।
অনুচরগুলো কি সেখেন থেকে ধরে আনা? সত্য জিজ্ঞেস করে।
তাইইই হবে। ধনঞ্জয় বলে, কথায় চন্দ্রবিন্দু বসান, চিঁনি আঁছে গোঁ।
সত্যহরি বলে, মুখে টর্চ মের না খবদ্দার, তেনারা রাগলে খুব খারাপ, তা আমি জানি, তবে মুখে আমার সঙ্গে পারবে না, যতই চন্দ্রবিন্দু মারুক কথার ভিতরে।
ওসব করলে দোকানের নয়, কত শান্ত তাঁরা, তিনি এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাসকাবারি ফর্দ ধরিয়ে দেবেন,তিরিশ কেজি চাল, কুড়ি কেজি আটা, আট কেজি সর্ষের তেল, সাত কেজি চিনি…। একটু বাড়িয়ে বলল ধনঞ্জয়। এ তার অভ্যেস। বাড়িয়ে বললে বিক্রি বেশি দেখান যায়। তাতে দোকান এবং তার মর্যাদা বাড়ে।
পুঁটিরাম মল্লিকের বাড়ির বাজার? সত্য জিজ্ঞেস করে।
তা ছাড়া আর কার? ধনঞ্জয় বলে।
একজন এক মাসে অত খায়? সত্যহরি বলে, ভূতের খাঁই কি বেশি, আমি তো জানি এক পোয়া কাঁচা মাছেই তেনারা দিন কাবার করে দেন।
তখন দিল্লি ফেরত পুঁটিরামের আবির্ভাব হয় ধনঞ্জয়ের দোকানে। সে এসে বলে, সত্যহরি, তুমি কিসুই জান না, ওদিকে লোক মছলি খায় না, তেনারাও না, তাই তাদের নিয়ে এমন কথা বলবে না যে তাদের মানে লাগে, নিরিমিষি সবাই, কাঁচা মাছ খাবে কেন? গায়ে পড়ে কোঁদল করবে না, আর ভূত কইবে না, ভূত বলে কি যা খুশি বলা যায়, এদের ভিতর সুখবীর ভি আছে।
কে সুখবীর? সত্যহরি জিজ্ঞেস করল।
সুখবীর কে? না সে ছিল দিল্লির সব চেয়ে বড় পালোয়ান। শুধু ব্যায়াম করে আর ওজন তুলেই লাখ লাখ টাকা আয় করত। স্যাঙাৎ ছিল পুঁটিরাম মল্লিকের। এমনই স্যাঙাৎ যে মরে গিয়েও তার সঙ্গে আছে। ডেইলি ব্যায়াম করে আর ওজন তোলে, মাসল দেখায়।
শুনতে শুনতে সত্যহরি খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, সে কেমন খায়, ভাত রুটিতেই চলে?
চলে,পালোয়ান ভূত,বডি রাখতে হবে তো। শুনবে সুখবীর কেমন খায়? কেমন খেত?
ধনঞ্জয় সামন্ত জিজ্ঞেস করে, মন মন ভাত রুটি নিশ্চয় ?
এই এক কেজি আটা, হাফ কেজি ময়দা, হাফ কেজি চিনি, আড়াই কেজি চাল…।
প্রত্যেক দিন এত লাগুত? ধনঞ্জয় জিজ্ঞেস করে।
পুঁটিরাম মাথা নাড়ে, না, এক মাসে।
পালোয়ান এইটুকু খেত এক মাসে?
হ্যাঁ, পুঁটিরাম হাসে, বলে, দিল্লি কা লাড্ডু ডেইলি পঁচিশটা, আর ছোলা এক মাসে এক কুইন্টাল।
হে হে হে।ধনঞ্জয় সামন্ত হাসে, বলে, তাই বলো, এক কুইন্টাল ছোলা।
হ্যাঁ, পিষে ছাতু বানিয়ে বেচত পালোয়ান। বলে পুঁটিরাম পা নাচায়, ওইটাই ছিল তার বিজিনেস। বলতে বলতে পুঁটিরাম ওঠে, তার একটু দরকার আছে পোস্টাপিসে। দিল্লি থেকে চিঠি আসবে। এল কি না খোঁজ নেবে। সে চলে যেতেই সত্যহরি বলে, পুঁটিরাম মল্লিকের বাড়ি যাবে সে, দিল্লি ফেরত পুঁটিরাম মল্লিকের অনুচরদের খোঁজ নেবে। রাম কোঁদল লাগিয়ে দেবে। ভূতের সঙ্গে ঝগড়া করা তার বহুদিনের সাধ। শুনে ধনঞ্জয় এবং তাঁর দোকানের কর্মচারী ভুতো বলে ওঠে, কী দরকার, উনি আছেন ওঁর মতো, খোঁজ নিতে হবে কেন, তারপর ভূত নিয়ে তোমার কাজ কী?
সত্যহরি বলে, তাই বললে হয়, ভূত বলে কি ভয় করে চলতে হবে নাকি?
এই তোমার দোষ সত্য, তারা আছে তাদের মতো, পালোয়ান ভূত একজনা, তাদের বিরক্ত করা কেন? ধনঞ্জয় বলে। এই রকম কথা হয় যখন তখন দিনের বেলা। চারদিকে ঝমঝমে আলো। রাতে গ্রামের ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে বটে, কিন্তু ভোল্টেজ খুব কম। নিজের হাত নিজে দেখতেও চশমা লাগে। ধনঞ্জয় বলে, অত জিনিশ নাকি একটা থলেতে ভরে লোকটা অন্ধকারে মিশে যায়। একটা ছোট থলেয় তিরিশ কেজি চাল, তিরিশ কেজি আটা, ময়দা…। সব ধরেও নাকি জায়গা থাকে। শুনতে শুনতে সত্যহরি বলে, সে রাত্তিরে আসবে, এসব সে অনেক দেখেছে, গোবর পালোয়ান দুই হাতেই দুই কুইন্টাল তুলতে পারত, সে লোহা হোক আর তুলো হোক, তার চেয়ে বেশি পালোয়ান নাকি দিল্লির ভূত?
ভুতো জিজ্ঞেস করে, এক কুইন্টাল তুলোর ভার বেশি, না লোহার?
ধনঞ্জয় বলে, তুলোর ভার বেশিই হবে, নিক্তিতে সমান করে ওজন করো, তাইই দেখাবে।
ইস, আমার মনে হয় লোহার ভার বেশি। সত্যহরি বলে।
এই কথার ভিতরে আবার পুঁটিরাম এসে গেল। পুঁটিরাম এমনি। শুধু আনাগোনা করে। স্থির হয়ে বসতে পারে না। সেই জন্যই তো দিল্লি থেকে পনের বছর বাদে ফিরে এল। পোস্টাপিস থেকে ফিরে এল। পোস্ট মাস্টার বলেছিল, খুঁজে দেখবে, একটু বসতে হবে। সে আর বসেনি। অত সময় তার নেই। তার চিঠি আসেনি। আসবে। এলেই সে তিন অনুচর নিয়ে দিল্লি ফিরে যাবে। সে তুলো আর লোহার খবর খুব জানে, পুঁটিরাম মাথা নাড়ে, বলে, মস্ত বস্তা লাগবে এক কুইন্টাল তুলোর জন্য, লোহা তো একটা থলেয় ধরে যায়, সুখবীর পালোয়ান ফু দিয়ে সেই কুইন্টাল তুলো উড়িয়ে দিত দিল্লির লাল কেল্লার সামনে, বহুত লোক জমে যেত।
আর কী করত ? জিজ্ঞেস করে গাঁয়ের বেজায় ভালো মানুষ নিত্যহরি। সত্যহরির পরের ভাই। স্বভাবে তার উলটো। নিত্যহরির ভালো মানুষ হিশেবে সাত গ্রামে খুব খ্যাতি। যে যা বলবে মেনে নেবে। কেউ যদি বলে নিত্য, দিবস কালে তুমি স্নান করো?
কেন হুজুর, আমি স্নান তো করি। নিত্য বলে।
উহুঁ, মোটেই না, আমি জানি।
তখন নিত্য স্বীকার করে নেয়, আচ্ছা বাবু, তুমি যা বলছ তাই, আমি স্নান করি না, করলেও মনে হয় করিনি, না করলে মনে হয় করেছি।
নিত্য তুমি দিনের বেলা ঘুমোও কেন, সবাই যখন রাতে ঘুমোয়। পুঁটিরাম মল্লিক বলে।
নিত্য এই কথাটাও পাকে-প্রকারে স্বীকার করে নেয়। স্বীকার করলে যদি পুঁটিরামবাবু খুশি হয়, সে স্বীকার করবে না কেন? অথচ সে দিনে ঘুমোয় না। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার মানুষজন দ্যাখে। ফেরিওয়ালা দ্যাখে। পাহারাওয়ালা পুলিস রিকশায় করে ঝিমোতে ঝিমোতে নাক ডাকতে ডাকতে আসামী ধরতে যাচ্ছে, দ্যাখে। তখন অবশ্য সে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। তাকেই যদি আসামী ভেবে ফেলে পুলিস, সে তো খুব বিপদ হবে। নিত্য তবু স্বীকার করে নেয়, সে দুপুরে ঘুমোয়। কেন না সে ভালো মানুষ। কারোর কথার বিরুদ্ধে কথা বলে বিবাদ বাঁধায় না। কিন্তু তখন যদি তার বড় ভাই সত্যহরি উপস্থিত থাকে, নিত্যর বিপদ হয়। সে বলে, এই নিত্য, মিথ্যে কথা বলা তোর অভ্যেস, তুই দিনের বেলায় ছিপ ফেলে পুকুর পাড়ে বসে থাকিস না? নিত্য তার স্বভাবে বলল, থাকি।
তবে যে বললি, দুপুরে ঘুমোস? সত্য জামার হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যায়। ঝগড়া লাগাবে ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু ভাই যে খুব শান্ত। ঝগড়া করবে কেন? তাই ভাইয়ের সঙ্গেও তার কোন্দল হয় না। হতে পারে না।
নিত্য চুপ করে থাকে। সত্য আগডুম বাগডুম মিথ্যে কথা বলে আচমকা চুপ করে গেল পুটিরাম গলা খাঁকারি দিলে। পুঁটিরামের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধানো তার খুব ইচ্ছে, কিন্তু খুব সাহস হয় না। দিল্লি ফেরত পুঁটিরাম মল্লিক, ভূত নিয়ে ঘর করে। তার কত ক্ষমতা! প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে নাকি তার যাতায়াত ছিল। সে তুড়ি মারলেই নাকি সুখবীর পালোয়ানের ভূত এসে যাবে। তখন কী যে হবে? তবু সে একদিন চেষ্টা করবে। তবে কি না ভুল লোকের সঙ্গে কলহ করায় বিপদ আছে তাও জানে সত্য। সে একবার ভুল লোকের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়েছিল নিশিগঞ্জে। জানত না সে ক্যারাটে মাস্টার। এমন প্যাঁচ দিয়েছিল সে কুপোকাত। তাই দেখে চাদ্দিকের লোক সকলে হাততালি দিতে লাগল। সত্যর মনে খুব ইচ্ছে সে একবার পুঁটিরাম মল্লিকের সঙ্গে কলহ করে। কিন্তু তার তিনটে পোষা ভূত। সাহস হয় না।
ধনঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, আজ কজনের সঙ্গে হলো সত্য?
সত্য বলে, আমি মিথ্যে একদম সহ্য করতে পারি না, কিন্তু সকলে ভাবে ঝগড়া করি।
পুঁটিরাম বলল, ঝগড়ুটে লোকের পরিণতি আমি দেখেছি, ঝগড়া না করাই ভাল।
কী পরিণতি? নিরীহ ভালো মানুষ নিত্যহরি জিজ্ঞেস করল।
কী আবার,দিল্লির দরিয়াগঞ্জে একটা লোক ছিল, তার নাম সচদেব সিং, সেই সচদেব বহুত ঝগড়ুটে থা,এক দিন সুখবীরের সঙ্গে ঝগড়া করতে এল, তো কী হলো, সুখবীর এমন দিল।
কেমন দিল স্যার? সত্যহরি জিজ্ঞেস করল। তার মনে হচ্ছিল সচদেব সিং মানে সত্যহরি হাজরা। তাকেই বলছে। সত্যহরি ভাবে, বলবে নাকি পালোয়ান গোবরবাবুর কথা। গোবরবাবুর চেয়ে সুখবীর বেশি পালোয়ান ছিল? কী হলো সেই সচদেবের? পুঁটিরাম খুব বুদ্ধি ধরে। সে বলল, এক ঝটকায় তাল গাছের মাথায় তুলে দিল সচদেবকে, যা বেটা বসে থাক।
তালগাছের মাথায়, সত্যি? ভালোমানুষ নিত্য জিজ্ঞেস করল।
ইয়েস, সাচ। পুঁটিরাম পা নাচাতে নাচাতে বলল।
সত্য বলল, এ হতে পারে না, কভি নেহি।
পুঁটিরাম বলে, আরে হুয়া হুয়া হুয়া।
সত্য বলল, নেহি হুয়া নেহি হুয়া নেহি হুয়া।
লেগে গেল প্রায়। সত্য বলে,বললে হবে, এক চড়ে তালগাছের মাথায়?
দিল্লি যা, সব নিউজ পেপারে বেরিয়েছিল, এরোপ্লেন থেকে দেখা গিয়েছিল সব।বলে পুঁটিরাম চলল পান কিনতে।সত্যহরি একা একা গজরাতে লাগল। তার ক্ষোভ হলো নিত্যহরির উপর। সে কিছু বলুক তার পক্ষে। ভালমানুষ হয়ে থাকলে হবে? গোবর পালোয়ানের চেয়ে বড় পালোয়ান এই ব্রহ্মান্ডে জন্মায়নি। গোবরবাবু অবশ্য কারো গায়ে হাত দিতেন না। ভারি শান্ত আর ভালমানুষ ছিলেন। সে একা একা গজরাতে থাকল, কভি নেহি হুয়া, নেহি হুয়া।
পান কিনে চিবোতে চিবোতে ফিরে এল পুঁটিরাম। তখন তাকে নিত্যহরি খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হলো?
কী আবার হবে, ইতনা উচা তালগাছ, তালগাছের উপর বসে সচদেব কানতে লাগল, সুখবীর হাসতে লাগল নিচে দাঁড়িয়ে। পুঁটিরাম কথাটা বলে সত্যহরির দিকে তাকায়। সত্যহরি বলল, হতেই পারে না, টিভিতে বলেনি।
আরে টিভি কেন সিনেমায় ভি বলেছে,হ্যাঁ,তিনদিন ধরে কাঁদল সচদেব, তারপর একটা চিল এসে মুখে করে নিল সচদেবকে, তিনবার পাক দিয়ে কুতুব মিনারের উপর রেখে দিল। বলে পুঁটিরাম তার গোঁফ মুচড়োতে থাকে।
নিত্যহরি বলল, কুতুব মিনার, ইতিহাস বইয়ে ছবি দেখেছি, সে তো খুব উঁচু শুনেছি।
সাচ, বহুত উঁচা। আকাশে তার মাথা ছুঁয়েছে। বলল পুঁটিরাম।
হতেই পারে না। দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল সত্যহরি।
আরে হুয়া হুয়া হুয়া।
নেহি হুয়া নেহি হুয়া। বলল সত্যহরি।
নিত্যহরি ধনঞ্জয় তখন এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,লোকটা কুতুব মিনারেই রয়ে গেল?
নেহি। পুঁটিরাম পা নাচিয়ে বলল, সে এক কাণ্ড হলো।
কিছুই হয়নি। সত্যহরি গর্জন করে বলল।
আরে থাম থাম থাম, কী হলো তার তুই কী জানিস, সম্রাট কুতুবুদ্দিন শাহর সিপাই গিয়ে নামালো। বলে পুটিরাম পান মুখে দিল আবার।
কুতুবুদ্দিন শাহর সিপাই কী করে এল? নিত্যহরি নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করল।
এল, আসবে না কেন? পুঁটিরাম মল্লিক বিজ্ঞের মতো বলল।
তারা কি বেঁচে আছে, সে তো পাঠান আমল, পাঁচ-ছ’শো বছর আগের কথা? ভালমানুষ নিত্যহরি জিজ্ঞেস করল। আর তা শুনে সত্যহরি বলল, হাঁ, সব ঝুটা হায়।
হেসে হাত তুলে সকলকে থামিয়ে পুঁটিরাম মল্লিক বলল, বেঁচে থাকবে কেন, সব কবর থেকে উঠে এল কুতুব মিনারের মাথায়, সচদেবকে নামিয়ে দিল।
কবর থেকে উঠে…? সত্যহরির গর্জন থেমে গেল, সে অবাক।গা ছমছম করে উঠল। নেহি বলতে পারল না।কিন্তু ভালমানুষ নিত্যহরির অত ভয় নেই, সে বলল, তারপর সিপাইগুলো কী করল?
দুজন বাদে বাকি সব আবার কবরে গিয়ে ঘুমোতে লাগল। বলল পুঁটিরাম মল্লিক।
উফ, এমন গল্পে কি গা ছমছম করবে না ? কবর থেকে বেরিয়ে এসে আবার কবরে গিয়ে ঘুমোতে লাগল। পুঁটিরাম মল্লিক জানেও বটে। কিন্তু তারপর কী হলো? দুজন বাদ হলো কেন? সেই দুই সিপাই গেল কোথায় কবর থেকে বেরিয়ে কুতুব মিনার থেকে সচদেবকে নামিয়ে ?
পুঁটিরাম বলল, তারা তার সঙ্গে দিল্লি থেকে চলে এল।
আর সেই সুখবীর? তার কী হলো? কী আবার হবে? সেও এল এই খলসেখালিতে। সে তো আছে তার সঙ্গে। কিন্তু একটা কথা হয়নি জানা, সুখবীর কবে মরে গেল যে ভূত হলো? ধনঞ্জয়ের কর্মচারী ভুতো জিজ্ঞেস করল। শুনে হা হা করে হাসতে লাগল পুঁটিরাম। উঠলো। আবার পোস্টাপিস যাবে। চিঠিটা এল কি না দেখতে হবে। সে যাওয়ার আগে বলল, আরে সুখবীর তো আদমি ছিল না কোনো কালেই, সে তো ঘোস্ট ছিল, মানে ঘোস্ট হয়েই তার জন্ম হয়েছিল, তার মা ঘোস্ট, বাবা ভূত, ব্রিটিশ আমলে জন্ম।
তারা বসেই থাকল দোকানের বেঞ্চিতে। পুঁটিরাম গেল চিঠি আনতে। চিঠি এলেই সে তিন অনুচর নিয়ে আবার দিল্লি মেল ধরবে। কিন্তু সত্যহরি দাঁত ঘষছে। পুঁটিরাম ফিরে এলেই চেপে ধরবে তাকে। ঘোস্ট হয়েই কবে জন্মেছিল সুখবীর পালোয়ান, তা বলতে হবে পুঁটিরামকে। নতুবা তার রেহাই নেই।