খনামিহিরের ঢিপির দিকে
খাতাটা মুড়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল রঞ্জাবতী।
—কখন এত সব ভাবলেন, লিখলেন ভাই!
নিবারণ অন্য লোকদের মতো নয়। শহরের পরিশীলিত কায়দাদুরস্ত জ্ঞানীগুণী লোক দেখলে হাত কচলায় না। চোখ নিচু করে বিনয়ে গলে যায় না। খুব শান্ত। দৃঢ় অথচ নম্র ব্যক্তিত্বের ছেলেটি।
—এই সব দেখি দিদি, সাজাই গোছাই, রেফারেন্স বই পড়ি, ভাবি। সমস্ত ইতিহাসটা কেমন ঘুমের মধ্যে, দিবাস্বপ্নের মধ্যে দেখি। দেখি যেন সত্যি-সত্যি ঘটছে। কিছু মনে করবেন না— যেই আপনি এসে দাঁড়ালেন, আমার মনে হল এ মুখ যেন আমি কোথায় দেখেছি।
—জার্নালে-টার্নালে দেখে থাকতে পারেন। রঞ্জা বলল। কাগজে-টাগজেও… অনেক সময় বড় কনফারেন্স বা হিস্ট্রি কংগ্রেসের ছবি তো বেরোয়।
—হতে পারে দিদি… যেন সায় দিয়ে নিবারণ বলল… ইতস্তত করে বলল, জানি না আমার মনে হল এ মুখ অনেক অতীতকালের জল ঠেলে ঠেলে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে। বলছে দেখো, যা সত্যি তা সত্যিই। স্বপ্নে সত্যের প্রতিভাস ফোটে। এই তোমার রঞ্জা। বিবর্তিত হতে হতে হতে হতে আজ উলটে পালটে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
রঞ্জা চমকে উঠল। সামনে কোনও অতীতদর্শী কবির চোখ। কবি মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পায় লক্ষ লক্ষ বছরের সার। নিংড়ে বার করে দিতে পারে তার নির্যাস সামান্য ক’টি শব্দ চতুর্দিকে। মানুষ, প্রকৃতিতে, অতীত বস্তুতে, বর্তমান বস্তুতে মিল দেখে। কবি কিনা জাতিস্মর!
বলল—দেখুন দিদি। এই ফলকটা— পুরুষটি নারীটিকে চাইছে, ওপরে একটা ফাঁসের মতো দড়ি। কেন? —শাস্তির ভয় দেখিয়ে মিলনে বাধ্য করছে ওকে পুরুষটি। কতকাল আগে। এটা দেখেই আমার রঙ্কার হাত-পা-গলার দড়ির কথা মনে আসে। আর ইতিহাস তো বলছেই, তার প্রজনন ক্ষমতার জোরে আদি সভ্যতায় নারীই ছিল নেত্রী, পরিচালিকা। নারী-পুরুষের মিলনে তখন কোনও নিয়ম তৈরি হয়নি, কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। যে যাকে যখন চাইত অপর পক্ষ রাজি হলে অসুবিধে হত না। জোরজুলুম কি আর ছিল না। কিন্তু সে-ও বিলাস, লীলা! দিদি আপনি কিছু মনে করছেন না তো?
রঞ্জা হাসল, হাসিতে মুখটা একটু লাল হয়ে থাকবে। বলল—সত্য নিয়ে, সত্যের সন্ধান নিয়ে আমাদের কারবার, এগুলো সব তথ্য নিবারণ। মনে করার কী আছে?
আর দেখুন, এই যে নারী-পুরুষের বিবাদের একটা ট্যাবলেট। কী চিরন্তন দৃশ্য। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে, প্রতি জায়গায় ঘটছে। দেখুন যেন নারী-পুরুষই নয় শুধু, যেন দুটো বিবাদী শক্তি, দুজনেই জিততে চাইছে। তাদের মধ্যে মিল সামান্যই। অমিল গভীর। দুজনের চাওয়া পরস্পরের পরিপূরক নয়। নারীকে মেরেধরে বেঁধে কঠিন শাস্তি দিয়ে তবে তাকে বাধ্য করা হচ্ছে পুরুষের কথায় সায় দিতে।
রঞ্জা হাসি হাসি মুখে বলল—এই ফলকটা যা বলছে তার থেকেও অনেক বেশি আপনি দেখতে পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।
একটু অপ্রতিভ হল নিবারণ, তারপর হার-না-মানা গলায় বলল, এটা প্রতীকী। দেখুন দিদি নারী-পুরুষের মিলনের কত অজস্র ছবি আমরা পাই, পাথরে পাথরে উৎকীর্ণ রয়েছে। কোনার্ক, খাজুরাহো। দেখি বীরপুরুষের মূর্তি, বীরাঙ্গনা নারীর মূর্তি গ্রিক রোম্যান আর্টে। আমাদের চেনা অভিজ্ঞতা বলেই তো আঁকেন, গড়েন শিল্পী। কিন্তু এই যে বিরোধ, যা সত্য, ফ্যাক্ট, যা আজকের আপনাদের এই ফেমিনিস্ট জাগরণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে। একে শিল্পীরা কেন উপেক্ষা করলেন? মিলন মুহূর্তের দিদি, বিরোধ চিরদিনের, প্রতিদিনের…
নিজের আবেগে নিজেই অপ্রতিভ হয়ে থেমে গেল নিবারণ। রঞ্জা চোখে কৌতুক নিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছি আপনি বিয়ে করেননি কেন?
সে হাসল, বলল— ঠিক জায়গায় আপনার হাত পড়েছে দিদি। এই বিরোধ আমি দেখেছি আমার বাবা-মার মধ্যে। দুজনেই খুব তেজি। দুজনেরই নিজস্ব মতামত খুব জোরালো ছিল। সামান্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। বাবা চাইতেন আমি শহরে যাই, ইঞ্জিনিয়ার হই, মা বলতেন— ও তো পুতুল গড়ে, দেখো না ও আকাশ মাটি জল কীরকম ভালবাসে? ওকে যন্তরের হাতে দেবে? খবরদার না! ও শিল্পী। সে প্রায় হাতাহাতি অবস্থা। বাবার মত তো আমি মানলামই না, মায়েরটাও না —আমি গড়ি না, দেখি বা পুনর্গঠন করবার চেষ্টা করি। ভাল আছি। ভালই আছি।
রঞ্জা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল নিবারণের দিকে। এখন তার মনে হল ছেলেটি একটা সত্যকে স্পর্শ করেছে। সত্যিই যেই মেয়েরা পুরুষদের মতো শিক্ষিত, সংস্কৃত, কর্মী হচ্ছে অমনি প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। এত ডিভোর্স, এত কামড়াকামড়ি, চাকরির জায়গায় মেয়েদের এত অপমান, র্যাগিং যাকে বলে— সত্য তো! পুরুষে পুরুষে বা নারীতে নারীতেও প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু তা বোধহয় এমন ভয়ংকর নয়। এটার চরিত্র আলাদা। এখানে একটা লিঙ্গগত বিরোধের মানসিকতা কাজ করছে।
—যাই হোক, রঞ্জা বলল— খনামিহিরের ঢিপিটা আজ ভাল করে দেখব। চন্দ্রকেতুতে আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু কেন্দ্র ওই খনামিহিরের টিপি।
—খনার উত্তরাধিকারিণী তো আপনি, তাই! রঙ্কা থেকে খনা… একটু লজ্জা-লজ্জা মুখে সে বলল।
—যা বলেন— রঞ্জা হাসল— স্থানীয় লোকেরা ওটাকে ‘দমদমা’ বলে কেন ভাই?
—আর বলবেন না। অজন্তার গুহায় যেমন লোকে রান্না করে খেত। আগুনের কালি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ছবির, সেই একই বৃত্তান্ত। কোনও একসময়ে টিপিটাকে চাঁদমারি বলে ব্যবহার করত ইংরেজ সৈন্যরা। বন্দুক ছুড়লে আওয়াজ হত দমদম। তার থেকে দমদমা।
খনাকে নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। অনেকে বলেন খনা সিংহল-কন্যা। সিংহলের রাজার মেয়ে। সিংহলের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ইতিহাসের কথা ভেবে দেখলে সিংহল-কন্যার ভারতের বধূ হওয়ার কাহিনি এমন কিছু অবিশ্বাস্য নয়। নামটাও যেন কেমন। খনন-এর খন্ ধাতু থেকে কি?
—বারবারই সব বলছে ‘খনা’ মানে জ্ঞানী। খনার বচন মানে জ্ঞানীর বচন। রঞ্জা নিবারণকে জিজ্ঞেস করল।
নিবারণ বলল— হরিচরণ বন্দ্যো তো বলছেন তিব্বতি রুট থেকে এসেছে শব্দটা, তিব্বতি রুট ম্খন, উচ্চারণ খন।
ব্যাখ্যাটা পছন্দ হল না রঞ্জার। হঠাৎ দুম করে তিব্বতি রুট এসে গেল কোথা থেকে? আশ্চর্য তো! খনা শব্দটা কিন্তু ভীষণ দেশি শব্দের মতো শোনায়। তৎসম নামগুলোর একটা পরিষ্কার মানে থাকে, কিন্তু দেশি নাম, আদর করে দেওয়া নামের কি সব সময়ে মানে থাকে? টুকি, টুকু, বুবু, বুবাই, মনা, রুনা, —এসব নামের কি মনে আছে? খনা বাংলাতেই বা বচন তৈরি করলেন কেন? তবে কি তিনি বাংলার বউমা! এখানে এসে বাংলা শিখে গিয়েছিলেন মাতৃভাষার মতো? নাকি তিনি বাংলারই মেয়ে!
যদি বর্ষে ফাল্গুনে
শস্য হয় দ্বিগুণে॥
যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ॥
নিত্যি নিত্যি ফল খাও
বদ্যি বাড়ি না যাও॥
পটোল বুনলে ফাল্গুনে
ফল বাড়ে দ্বিগুণে॥
আশ্চর্য, এত বচন! এবং যুগের পর যুগ বাংলার কৃষকরা এগুলো মেনে ফল পেয়েছেন, কিন্তু সারা বাংলায় আর কোথাও খনার ভিটের কথা শোনা যায় না, একমাত্র উত্তর চব্বিশ পরগনার এই দেউলিয়া বা বেড়াচাঁপায় এই ঢিপিটি। একে খনন করে আশুতোষ মিউজিয়াম অনেক মূল্যবান আবিষ্কার করেছেন। কোথাও কোনও বিভ্রান্তি নেই। খনা তুমি এই বেড়াচাঁপা, উত্তর ২৪ পরগনারই। এই-ই তোমার আসল ভিটে।
খনামিহিরের ঢিপির মধ্যে বিখ্যাত মন্দিরটি দেখে স্পষ্ট নালন্দার আর্কিটেকচার মনে পড়ে যায়। ওইরকম পাতলা পাতলা, পালিশ করা ইট। গুপ্ত যুগের সঙ্গে সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। তবে কি সত্যিই এই বাংলার দেউলিয়া গ্রাম থেকে এক গ্রামপণ্ডিত, তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূ সুদূর উজ্জয়িনীতে বিক্রমাদিত্যর সভায় যাতায়াত করতেন? অসম্ভব কী! আজকের এম এল এ-রা যেমন পার্লামেন্টের অধিবেশন চলার সময়ে দিল্লিতে আসেন! বরাহ ও তৎপুত্র মিহিরের স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসস্থান নিশ্চয় ছিল উজ্জয়িনীতে। রাজার নবরত্ন সভার সদস্য বলে কথা! খনার পাণ্ডিত্যের কথাও রাজা জানতেন। একবার সভায় একটি দুরূহ গণিতের প্রশ্ন করে বসেন, বরাহ পারেন না। মিহির পারেন না। খনাকে ডেকে পাঠানো হয়, তিনি পারেন। কিন্তু শ্বশুর ও স্বামীর এই অপমানে লজ্জিত খনা নাকি নিজের জিব কেটে ফেলেছিলেন। কেটে ফেলেছিলেন, না কেটে ফেলা হয়েছিল, বরাহ অথবা মিহির অথবা উভয়ের আদেশে! দুটোই সম্ভব। শ্বশুর-স্বামী তো পারেনই। বউমারাও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বহু দুরূহ আত্মত্যাগ করে এসেছেন যুগে যুগে।
—দিদি, কিছু ভাবছেন?
—আমি ভাবছিলুম খনা নির্ঘাত নারী।
আশ্চর্য হয়ে নিবারণ বলল— নারীই তো! কেউ তো বলেনি তিনি পুরুষ। খনা, লীলাবতী —উভয়কে তো আমরা প্রাতঃস্মরণীয় বিদুষী বলেই জানি।
রঞ্জা বলল— না, আসলে প্রাচীন কথার একটা সত্য ভিত্তি থাকেই, কিন্তু অনেকে বলেন না, ডাকের বচন! —অসংলগ্ন রঞ্জার কথা। কিন্তু তার মধ্যে থেকে তার দ্বিধা বেরিয়ে এল।
—না, না খনার নারীত্ব নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করবেন না দিদি।
কার্তিকের উন জলে।
দুনো ধান খনা বলে॥
উঠোন ভরা লাউ শশা।
খনা বলে লক্ষ্মীর দশা॥
—এসব একেবারে মেয়েলি ভাষা। মেয়েদের বলা ছড়ার মতন।
মন্দিরের অদ্ভুত গহ্বরটি দেখে আস্তে আস্তে ফিরতে থাকে রঞ্জা। গভীরতা ২৩ ফুট ৬ ইঞ্চি। ৩৭টি ধাপ তির্যকভাবে কমতে কমতে পৌঁছেছে ভিত্তিভূমি পর্যন্ত। আশ্চর্য সুন্দর। সম্ভবত কুয়োর মতো এই গহ্বরটি মূল স্তম্ভটির আধার। এই ধরনের গঠন মহাস্থান, ময়নামতী, পাহাড়পুরের মন্দিরেও আছে। আর কিছুর সঙ্গে যদি মিল পায় তার গবেষকরা। আজ ওদের কেউই সঙ্গে নেই। লেখালেখির কাজ করছে লাইব্রেরিতে।
আজ নিবারণের বাড়িতেই থাকতে হবে। ধূলিধূসরিত রঞ্জা পথ চলে। ক্লান্তিতে অবসন্ন। উৎখনন দর্শন করে এমন অবসন্ন হয়েই তো ফেরবার কথা। কিন্তু তার অবসাদের কারণ কিছু জটিল।
কাল সন্ধেয় বাড়ি ফিরে সে একটি উত্তেজিত ফোন পায়। নিশীথ। ভদ্রতার মুখোশ খুলে, আদিমানব বেরিয়ে পড়েছে— আর নয়, আর নয়, আর চলছে না!
—কী চলছে না নিশীথ!
—আপনার মেয়েকে নিয়ে আর চলছে না!
—কেন বলো তো!
—ও কিছু করে না। করতে চায় না।
—মানে? তুমি তো জানতে ও চাকরি করবে না, তা ছাড়া তোমার কি টাকার খুব অভাব?
—চাকরি তো নয়ই, বাড়িতেও কিছু করে না।
—তা হলে তোমার সংসারটা চলছে কী করে? খেতে পাচ্ছ না? না জামা-কাপড় ঠিকঠাক পাচ্ছ না, জুতো পরিয়ে দিচ্ছে না? টাই! তা-ও না। শায়রী তো শুনছি ক্লাসে র্যাংক রাখছে।
—ওহ শিট, ওসব কিছুই নয়। একটা আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে ও যাবে না। বাড়িতে এনটারটেইনও করবে না।
—কেন? ওকে দাও তো!
—হ্যাঁ মা, বলো। কোনওক্রমে সুদূর থেকে, অশ্রুনদীর মধ্য থেকে বলে উঠল ঈশা। তুই কোথাও যাস না? কারও সঙ্গে মিশিস না? কাউকে বাড়িতে ডাকিস না?
—যাই তো মা! প্রতি সপ্তাহে একই বাড়িতে গিয়ে একই সঙ্গ একই কথা আমার ভাল লাগে না মা। নিজেদের মধ্যে কি সময় কাটানো যায় না? বাবা, মা, মেয়ে! আমরা কাটাতুম না? বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায় না! আমার ভাল লাগে না, ভাল লাগে না…!
—নিশীথ, কথাটা তো ও ঠিকই বলেছে। নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগে না তোমার? স্পিকারটা চালু করে দিয়েছে রঞ্জা।
গর্জন করে ওঠে নিশীথ—না, ভাল লাগে না। ক্যান শি টক! কী কথা আমি বলব ওর সঙ্গে?
—কী কথা তুমি ওর থেকে প্রত্যাশা করো জানি না। তোমার সাইবার ওয়র্ল্ড-এর কথা তো ও বলতে পারবে না— একটা কম্প্রোমাইজে এসো।
—সেটা তো আমি একাই করে যাচ্ছি। আর চলে না। আমার কলিগ বারোজনকে বাড়িতে ডাকা জরুরি— শি ইজ আনউইলিং।
—বারোজন? কাপ্ল নাকি? তার মানে চব্বিশজন? মাই গড নিশীথ! ইটস অ্যান ইমপসিব্ল প্রপোজিশন!
—আমার মা তো করতেন!
—তিনি হয়তো পারতেন। তাঁর ইনফ্রাস্ট্রাকচারও ছিল। তোমার বউ পারে না… অত বাসনই কি আছে তোমার ওখানে?
ঈশার গলা ভেসে এল— দেখো না মা আমি বলছি হয়, তিনটে করে কাপ্ল বলো— আমার সে বাসন আছে। আর নয় কেটারার বলে দাও, জেদ ধরেছে, যা বলছে তা-ই করতে হবে। আমি পারব না। আমার ভীষণ শরীর ক্লান্ত লাগে, শায়রীর পরীক্ষা, সাঁতার নাচের ক্লাস। বড্ড খাটুনি মা একটুও বিবেচনা…
নিশীথ আবার গর্জে উঠল— ঠিক আছে। তুমি পারবে না এবং আমার স্ত্রী হতে হলে পারতে হবে। উই আর ডিফরেন্ট। লেট্স পার্ট।
—নিশীথ শোনো নিশীথ— সে গলা তুলল— স্ত্রীর সঙ্গে এ ভাবে কথা বলবে না। আই কমান্ড।
—কে আপনার কমান্ড শুনছে! আমি ডিক্টেটেড হই না।
—অর্থাৎ ডিক্টেট করো। ভাল। পাঠিয়ে দাও। ওদের পাঠিয়ে দাও আমার কাছে।
তুমুল একটা গর্জন, কান্না, ভেসে এল। তারপর টেলিফোন যন্ত্রটা নীরব হয়ে গেল। কিছুতেই আর লাগাতে পারল না রঞ্জা। বোধহয় নামিয়ে রেখেছে। বহুবার চেষ্টা করেও পারেনি। সুইচ অফ্ করে রেখেছে, তা-ও হতে পারে। হাতে কড়া, পায়ে কড়া, গলায় গোরুর দড়ি। রঞ্জা সারারাত ধরে এপাশ ওপাশ করছে, রেগে অধীর হয়ে যাচ্ছে, রাগ গলে বেরিয়ে আসছে লাভাস্রোতের মতো। গাল পুড়ে যায়। হৃদয় পুড়ে যায়।
সুবীর বলল— ফট করে তুমি বললে কেন, আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। চিরকালের গোঁয়ার। রাগি তুমি। রাগলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না!
—ও যে বলল আর চলে না, লেট্স পার্ট— তার পরেও? আত্মসম্মান নেই একটা?
—আত্মসম্মান? ওই এক হয়েছে তোমাদের এই আজকালকার মেয়েদের। আত্মমর্যাদা! কেন, আমাদের বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুমাদের মধ্যে ঝগড়া হত না? তাতে সব পার্ট করে যেত!
—বাপের বাড়ি চলে যেতেন ওঁরা সুবীর। দু মাস তিন মাস… তারপর কর্তা হাতে পায়ে সেধে নিয়ে আসতেন!
—হ্যাঁ, আবার আরেকটা বিয়েও করে নিতেন…
—ঠিকই, ঠাকুমা, দিদিমারা আবার সেটা করতে পারতেন না। স্যাড।
—কী বলতে চাইছ?
—কী আবার বলতে চাইব? সমাজ তাঁদের যে স্যাংশন দেয়নি, পুরুষদের তাই দশ গুণ করে দিয়ে রেখেছিল। শোনো, তুমি ঠাকুমা-দিদিমাদের কালের কথা প্লিজ তুলবে না। আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়, অন দেয়ার বিহাফ!
—মাথায় আগুন জ্বললে চলবে না হে, ডেজ আর ক্রিটিক্যাল! ওই পার্ট-এর মানে কী জানো? আমরা চলে যাওয়ার পর অকূল সমুদ্র। নো সিকিওরিটি। ডিভোর্সি জানলে খ্যাপা কুকুরের দল…
—যাক, রঞ্জার মুখ তিক্ত হাসিতে ভরে গিয়েছিল, —এতক্ষণে কথাটা স্বীকার করলে, খ্যাপা কুকুর। দা রাইট ডেসক্রিপশন…
তার টাকার জোর আছে বলে সে টেলিফোনটাকে মূক পর্যন্ত করে দিতে পারে? এ কেমন মানুষ?
পরদিন ভোরবেলায় উঠে সে আবার চেষ্টা করল মোবাইলে। বেজে বেজে থেমে গেল। যাক বাজছে তা হলে। তারপরেই মনে হল— ভোর ছটার সময়ে কী করে ফোন ধরবে ঈশা! হয়তো কাল রাত একটায় শুয়েছে, কিংবা দুটোয়। এখুনি সাতটার সময়ে পড়িমরি করে উঠে পড়তে হবে। স্বামীর ব্রেকফাস্ট, মেয়ের স্কুল…।
সকালে তার লাল চোখ আর কাঁধের গুছোনো ব্যাগের দিকে তাকিয়ে নিবারণ বলল— এখুনি রেডি? আমি ভেবেছিলাম আজ আপনাকে কিছু প্লেট দেখাব। আসলগুলো আশুতোষ মিউজিয়ামে চলে গেছে।
—না ভাই, আমি বাড়ি যাচ্ছি, খুব দরকার!
একটু থতমত খেয়ে গেল নিবারণ, কিছু বলল না।
ধুলো উড়ছে। অকূল অনন্তকালের ধূলিবারিধি থেকে ধোঁয়ার মতো ধুলো উড়ছে। চোখ মুখ, শাড়ি সব ধূলিগ্রস্ত করে দিচ্ছে। নিজের শাড়ির ভাঁজের ধুলোর দিকে চেয়ে সে ভাবল— এইটাই আসল চেহারা আমার হে কালের ঈশ্বর, যতই অতীত খুঁড়ি, এক কণা আলো যদি বেরোয়, তার একশো গুণ ধুলোয় ভরে যায় সব। ধুলোই জীবন। ধুলোই সত্য। অথচ আমরা ভাবি, যখন জীবন আরম্ভ করি বাবা-মার স্নেহাশ্রয়ে, কিংবা স্বামীর শয্যায়, নিজের রসুইঘরে… আমরা ভাবি জীবন কত সরল। আনন্দ কী সহজপ্রাপ্য। জীবনটা একটা ‘সব পেয়েছির দেশ’ হয়ে উঠতেই পারে যদি আমি চাই। ঠিক ভাবে চাই। ঠিক ভাবে সব করতে পারি। তা ঠিকঠাকই তো সব করলুম। কিন্তু বাইরের শক্তি আছে যে। যার ওপর আমার কোনও হাত নেই! আছে সমাজ, আছে প্রবল জনসংখ্যার আধিপত্য, আছে রাজনীতির জটিলকুটিল ফাঁদ। আছে পরিস্থিতি। আর… আর… আর আছে বিচিত্র মানুষ। খুব নিজের মানুষ বলে যাকে জানি, সে-ও অচেনা-অজানা হয়ে যায়, আমি কিছু ভুল করেছি বলে সব সময়ে নয়। বাইরের কোনও রহস্যময়, ব্যাখ্যার অতীত কারণে অজানা হয়ে যায় জানা মানুষ। তখন জীবনও হয়ে ওঠে এক মহারণ। কার জন্য, কীসের জন্য এ যুদ্ধ তা গুলিয়ে যায়। শুধু কি নিজের ন্যায্য অধিকারের জন্য যুদ্ধ করছি! যেমন পাণ্ডবরা করেছিলেন? শুধু কি ন্যায়, সুবিচারের প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছি, যেমন কৃষ্ণ করেছিলেন! শুধু কি অবর্ণনীয় বিস্মরণ অসম্ভব অপমানের প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ করছি, যেমন যাজ্ঞসেনী করেছিলেন! জানে না, তখন মানুষ জানে না— তখন শুধু যুদ্ধ। আর যুদ্ধ জয়ই চৈতন্যে সর্বস্ব হয়ে জেগে থাকে।
দুদিকে ভেড়ি শুরু হল। ভেড়ির আঁশটে জোলো গন্ধ বাতাসে। বিস্তৃত জলাশয়ের মধ্যে কোথাও একটা দুটো সরু মাটির রাস্তা গিয়ে মিশেছে এক একখানা ঘরে। পাহারাদারের ঘর। ভেড়িতে চুরি বন্ধ করা এক অসম্ভব ব্যাপার। তাই ভেড়ির মালিকরাও সব সহজ মানুষ নয়। সবাইকারই লাঠিয়াল অর্থাৎ বন্দুকবাজ আছে, আছে বড় বড় পদস্থ পুলিশ, নীচস্থ পুলিশ ও পলিটিশিয়ান, দাঙ্গাবাজ, হুলিগানদের সঙ্গে সমঝোতার জটিল অঙ্ক। এই যুদ্ধ, নিরন্তর যুদ্ধও মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য বেছে তো নেয়! আর বেছে নেয় বলেই আমাদের পাতে পড়ে দুশো আড়াইশো টাকার অনুপম ভেটকি, ট্যাংরা, কই মাগুর!
সারা পথ, সারা আকাশ, বাতাস, মহাজগৎ, জীবন ও কাল ছেয়ে এক মহাবিতংস দেখতে পায় সে। বিতংস। জাল, আটাকাঠি, হাতিখ্যাদা। বিশ্বজোড়া এই ফাঁদে পড়ে মানুষ ছটফট করছে, এই ছটফট করাই তা হলে জীবন!
ঈশা! ঈশা! শক্তি সঞ্চয় করো মা! নিজের মধ্যে মহাউদাসীনতার সাধনা করো, সাধনা করো একনিষ্ঠ হবার কোনও না কোনও দৈনন্দিন-ঊর্ধ্ব বস্তুর সাধনায়। সেই জন্যই অনেক করুণা করে ঈশ্বর মানুষকে ললিতকলা দিয়েছেন, পার্থিব জটিলতার ঊর্ধ্বে এক গান্ধর্ব বিন্যাস! পৌঁছে যাও মা সেখানে! ঈশ্বর করুণা করে মানুষকে সাহিত্যও দিলেন, তুমি অজন্তার মহানির্বাণ তথাগতর সামনে দাঁড়িয়ে যেমন বাক্যহীন, রুদ্ধকণ্ঠ হবে, তেমনই হবে ওয়র অ্যান্ড পিস, তেই, ফাউস্ট, হ্যামলেট এবং সমগ্র রবীন্দ্ররচনার সামনে, বিভূতিরচনার সামনে। স্কলারশিপ, বিজ্ঞান এসবও ঈশ্বর তুলে দিলেন মানুষের হাতে। যদি সেই দুরূহে প্রবেশ করতে ইচ্ছে না-ও হয়— অন্তত সাহিত্যে প্রবিষ্ট হও। জীবনে প্রেম নলিনীদলগত জলমতি তরলম, যে কোনও মুহূর্তে গড়িয়ে পড়ে যায়। সুখ একমাত্র স্বার্থপর বা নির্বোধেরই আয়ত্ত। আর আনন্দ? তা সেই পোর্শিয়া কথিত করুণার মতো। ‘দা কোয়ালিটি অব মার্সি ইজ নট স্ট্রেইন্ড’ আকাশ থেকে মানুষ নির্বিশেষে সবার ওপর ঝরে পড়ছে। কিন্তু তাকে পেতে গেলেও এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ও সাধনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এক জীবনে কি মানুষ তা পারে? পায়? আমি চেষ্টা করেছি, ঝলক এসেছে, এসেছে যে তা অস্বীকার করব না, কিন্তু তা আবার হারিয়ে গেছে ঘোর তমিস্রায়। আমি যদি তার চাবিকাঠিটি হাতে পেতুম, কি তার ঠিকানাটা জানতুম। আমি তোমার হাতে তুলে দিতুম মা। আমি জানি না। কিন্তু জগজ্জননী জনয়িত্রী নিশ্চয় জানেন, তাঁর কাছে তোমার হৃদয়ের শূন্য মন্দির খুলে ধরো। খোলো খোলো হে আকাশ স্তব্ধ তব নীল যবনিকা।
সকাল থেকে ঘোর হয়েছিল আকাশ। হঠাৎ মুষলধারে অশ্রু ঝরতে লাগল। কী অঝোর ঝরন। বাপরে! দুদিকে ভেড়ির জল, মাঝখানে আকাশগঙ্গা ভেঙে পড়েছে। সাঁইসাঁই করে চলছে স্কর্পিওর সুইপার! তবু সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার বিনোদের ভুরু অভিনিবেশে কুঁচকে উঠেছে। আয়নার তার প্রতিফলন দেখতে পায় সে। আবহাওয়া অফিসের আজ বার্তা কী?
—ঠিক আছে বিনোদ, না থামবে?
—থামবার উপায় নেই ম্যাডাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ভেড়ি আর পথ এক হয়ে যাবে। দিক-দিশা বুঝতে পারব না। সোজা গিয়ে… সামলে নিল বিনোদ, ম্যাডামকে ভয় দেখানো ঠিক নয়। রায়চৌধুরীসাবও যদি থাকতেন! একটা হেলপার নেই, পুরুষমানুষ নেই। হঠাৎ কী ভয়ানক দুর্যোগ! ডিপ্রেশন একটা হচ্ছিল ঠিকই। বিল্ড করছিল। ঠিক এখনই ভাঙতে হবে! ম্যাডামেরও ঠিক এখনই, আজই ফিরতে হবে!