খণ্ডপানা – সুকুমার সেন
ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাজবৈদ্য ধন্বন্তরি হাত-মুখ ধুয়ে প্রাতরাশে বসবার জোগাড় করছেন এমন সময় দাস এসে খবর দিলে একজন জরুরী দর্শনপ্রার্থী এসেছেন। শুনে ধন্বন্তরি তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সমাধা করে বাইরে এসে দেখেন যে তাঁর এক বন্ধুর ভাই যজ্ঞদত্ত এসেছে তার দাদার আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ নিয়ে।
যজ্ঞদত্তর দাদা দেবদত্ত উজ্জয়িনীর একজন ধনী ব্যবসায়ী ব্যক্তি। তাদের তিনপুরুষের কারবার বিদেশ থেকে সাদা চিনি ও মিছরি আমদানির। দেবদত্ত বিয়ে থা করেনি। কারবার নিয়ে আছে। অবসর সময়ে সে সাহিত্য-সঙ্গীত-নাট্য-চটুল সংলাপ ইত্যাদি বিবিধ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে ভিড়ে চিত্ত বিনোদন করে। পিতা তাকে ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ ভার দিয়ে গেছেন। তাই ভাইকে সে সংসারভার ছেড়ে দিয়েছে। ভাই বিয়ে করেছে, তার ছেলেপুলে আছে। দেবদত্তর কারবারের ঘাঁটি দেশময় ছড়িয়ে আছে। সেসব সে যথাসাধ্য নিজেই দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে বিদেশেও যেতে হয়। উজ্জয়িনীতে সে বছরের মধ্যে মাস দুইও কাটায় না। এখানে থাকলে খাওয়াদাওয়া করে পৈতৃক বাড়িতে ও ভাইয়ের সংসারে। তবে প্রায়ই রাত কাটায় তার বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ি তার উজ্জয়িনীর কারবার ঘাঁটির সন্নিকটে।
ধন্বন্তরির সঙ্গে দেবদত্তর ঘনিষ্ঠতা হওয়ার ইতিহাস একটু বিচিত্র রকমের। দেবদত্তের একবার খুব কঠিন অসুখ করেছিল। সেই অসুখ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন ধন্বন্তরি। সেই থেকে ধন্বন্তরির উপর দেবদত্তের শ্রদ্ধাপ্রীতির ভাব জেগে ওঠে। ধন্বন্তরিও তরুণ যুবকের মনের স্বচ্ছতার ও চরিত্রের দৃঢ়তার পরিচয় পেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই থেকে দুজনের মধ্যে এক অসমতল বন্ধুত্বের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দুজনের কর্মে চিন্তায় কোন সমতা ছিল না। দেবদত্ত রাজসভার ছায়া মাড়াতেন না, ধন্বন্তরিও সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক ইত্যাদি গোষ্ঠীর চাঁদা দিয়েও যেতেন। দুজনের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ বেশি হত না। দেবদত্ত কাজের অবসরে মাঝে মাঝে ধন্বন্তরিকে দেখা দিয়ে যেত ওই পর্যন্ত। ভাল চিনি ও মিছরি বিনামূল্যে ধন্বন্তরিকে সে বরাবর যুগিয়ে যেত। ধন্বন্তরির কোন আপত্তি সে শুনত না।
সেই দেবদত্ত হঠাৎ পরলোকগমন করেছে শুনে ধন্বন্তরির মন বিচলিত হয়ে পড়ল। বললেন, কী হয়েছিল তার? আমাকে একটু খবর-ও দিতে পারলে না!
যজ্ঞদত্ত জানালে, তার কিছু হয়নি। অন্য দিনের মতো বাড়িতে সন্ধ্যার পরে খাওয়া দাওয়া করে বাগানবাড়িতে শুতে চলে গিয়েছিল। সকালে দাস এসে খবর দিলে যে সে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের ডাকাডাকিতে সাড়া দিচ্ছে না। তার অভ্যাস ভোরে ওঠার।
শুনে যজ্ঞদত্ত তাড়াতাড়ি বাগানবাড়িতে চলে যায়। গিয়ে দরজা কেটে ঘরে ঢুকে দেখে যে দাদা এক পাশ ফিরে শুয়ে আছে স্বাভাবিকভাবে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে গা ঠাণ্ডা। নড়নচড়ন নেই। তারপর সে দাসকে ঘরের পাহারায় রেখে ধন্বন্তরির কাছে ছুটে এসেছে।
দুজনে বাগানবাড়িতে পৌঁছলেন। ঘরের দরজার কাছে দাস পাহারায় মোতায়েন ছিল। ধন্বন্তরি দেখলেন যে চৌকাট কেটে হাঁসকল থেকে দরজার পাল্লা তুলে নেওয়া হয়েছে। ঘরে ঢুকে দেবদত্তর গায়ে হাত দিলেন। নাড়ী দেখবার দরকার হল না। কিন্তু শরীরে রোগ দূরের কথা একটুও অস্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষণ নেই। তখন তিনি নাড়াচাড়া করে গায়ের কাপড় সরিয়ে তন্নতন্ন করে দেখতে লাগলেন। কোথাও কিছু পেলেন না। চোখের কোল টেনে দেখলেন রক্তের চিহ্ন নেই। জিভ টেনে দেখবার চেষ্টা করলেন। কোন কিছু বৈলক্ষণ নজরে পড়ল না। শেষে পিছনে ঘাড়ের কাছটা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তার পরে দেহ যেমন ছিল তেমনি রেখে যজ্ঞদত্তকে বললেন, ‘এখনি কালিদাসকে খবর দিতে হবে। ব্যাপার ভাল বুঝছি না। কাগজ কলম দাও।’ যজ্ঞদত্ত তখনি ভোজপাতা ও তুলি কালি এনে দিলে। ধন্বন্তরি এই চিঠি লিখলেন,
কালিদাস, বিশেষ জরুরী ব্যাপার। তোমাকে এখুনি আসতে হবে দেবদত্তর বাগানবাড়িতে। পত্রবাহকের সঙ্গে আসবে। বিলম্ব অথবা ওজর করবে না।
ধন্বন্তরি
চিঠি যজ্ঞদত্তকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এখুনি এই চিঠি ও পালকি নিয়ে কালিদাসের বাড়ি যাও। তাকে নিয়ে এস। আমি এখানে রইলুম।’
আড়াই-তিন দণ্ডের মধ্যেই কালিদাস এসে পৌঁছলেন। ঘরে ঢুকতে দেখলেন দরজা ওপড়ানো ব্যাপার। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলেন কোন কথা না বলে। দেখলেন বিছানায় শায়িত দেহটি। তার কাছে একটি চৌকিতে বসে আছেন ধন্বন্তরি। একটু দূরে পিঁড়ির উপর একটি জলের কুঁজো, একটি খালি সুদৃশ্য কাঁচের বোতল, একটি পাতলা কাঁচের গেলাস। দেহের মাথার দিকে দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে কোন দেবমূর্তি, পিছন ফিরিয়ে রাখা। কালিদাস সোজা গেলেন কুলুঙ্গির কাছে, মূর্তিটি ঘুরিয়ে দেখলেন,—ধ্যানী বুদ্ধের মূর্তি। দেখে, সেটি যেমন ছিল তেমনি পিছন ফিরিয়ে রাখলেন। তারপর পিঁড়ির কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখলেন জলের কুঁজো, খালি বোতল আর গেলাস দুটি। হাত দিলেন না। জলের কুঁজো ভর্তি। বোতলে তলানি পর্যন্ত নেই। গেলাসটির কানায় একটু যেন লাল মতো ছোপ আছে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে কপাট দুটি দেখতে লাগলেন। পাল্লা দুটি ছোট, খিল দিয়ে আঁটা। হাঁসকলের মতো খিল। হাতে করে তুলতে ও লাগাতে হয়। হালকা খিল।
তারপর কালিদাস মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে ডাকলেন কেন। ভদ্রলোক হয় হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াবন্ধ হওয়ায় হঠাৎ মারা পড়েছেন নইলে কোন রকম বিষ বা ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে খিল ছিল, সুতরাং হত্যাকাণ্ড অনুমান করা চলে না।
‘এই দেখ—’, বলে ধন্বন্তরি মৃতদেহের ঘাড়ে যেখানে মেরুদণ্ড আর মাথার খুলি মিলছে এমন স্থানে একটি পিন-ফোটানোর গর্তের মতো কালো বিন্দু দেখালেন।
দেখে কালিদাস বললেন, ‘ও!’
ধন্বন্তরি বললেন, ‘এ দেহ আমার বন্ধু দেবদত্তের। আমি বুঝছি এ কোন কিছু খেয়ে আত্মহত্যা করেনি। করলে তার লক্ষণ থাকত কিছু না কিছু। এর হৃৎপিণ্ডে কোন দুর্বলতা ছিল না জানি। আমি এর চিকিৎসক ছিলুম। এ মোক্ষম সূচিভেদ আত্মকৃত হতে পারে না। বাজে লোকের দ্বারাও হয়নি।’
‘কিন্তু ঘর তো বন্ধ ছিল?’ কালিদাস বললেন।
সে তুমি বোঝ। সে জন্যেই তোমাকে আনিয়েছি। ধন্বন্তরি উত্তর দিলেন।
কালিদাস আবার ভাঙা দরজার কাছে গিয়ে পাল্লা দু’খানা ভাল করে দেখলেন। তারপর জানালাগুলির খিল পরীক্ষা করলেন। সব একই রকমের। ছোট আঁকশি দাণ্ডা এক পাল্লায়, তার আংটা অন্য পাল্লায়। এক পাল্লার ডাঁটির আঁকশি আর পাল্লার আংটাতে পড়লেই খিল আঁটা হল। ফিরে এসে কালিদাস যজ্ঞদত্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হালকা খিল। জোরে ধাক্কা দিলেই ভেঙে যেত। তা না করে চৌকাট কেটে জোড়া দরজা খুলে নেওয়ার কষ্ট করা হল কেন?’
যজ্ঞদত্ত বললে, ‘ভেবেছিলুম হুড়কো আঁটা আছে। তাই ধাক্কার চেষ্টা করিনি।’
কালিদাস বললেন, ‘সে চেষ্টা না করে ভালোই হয়েছে।’
ধন্বন্তরি বললেন, ‘কেন এ কথা বলছ?’
কালিদাস বললেন, ‘পরে বলব। আগে সব কথা শুনে নিই, সব জানবার জেনে নিই।’ তারপর যজ্ঞদত্তের দিকে মুখ করে বললেন, ‘যখন আপনারা ঘরে ঢোকেন তখন জানলাগুলো কেমন ছিল?’
যজ্ঞদত্ত বললে, ‘সব জানলা বন্ধ ছিল। সব খিল আঁটা।’
কালিদাস বললেন, ‘এখানকার যা দেখবার দেখেছি। এখন যা শোনবার তা শুনব। চলুন বাইরে।’
সকলে বাইরে এলেন দালানে। সেখানে অনেকগুলি বসবার চৌকি ছিল। তিনজনে বসলেন। তারপর কালিদাস যজ্ঞদত্তকে বললেন, ‘আপনার দাদা কাল কি কি কাজ করেছিলেন, তা জানেন কি?’
যজ্ঞদত্ত বললে, ‘আজ্ঞে, শুধু এইমাত্র জানি যে তিনি সন্ধ্যার পরে বাড়ি থেকে খেয়ে এখানে শুতে এসেছিলেন।’ তারপর যজ্ঞদত্ত সকাল থেকে যা ঘটেছে সে যা করেছে তার বিবরণ দিলে। তার বিবরণ সমাপন হলে ধন্বন্তরিও নিজের কাজের বিবরণ দিলেন।
শুনে কালিদাস ভারপ্রাপ্ত দাসকে ডাকতে বললেন। সে এল। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে এই বিবরণ দিলে।
কর্তা বাড়ি থেকে এখানে শুতে এসেছিলেন প্রহর রাতে। এসেই তাকে আদেশ দিয়েছিলেন সে যেন কাজকর্ম চটপট সেরে নিয়ে শুয়ে পড়ে। তাঁর কাছে লোক আসবে। কিন্তু সেজন্যে তাকে জেগে থাকতে হবে না। সদরদরজা যেন ভেজানো থাকে। লোক চলে গেলে সে দরজা তিনি নিজেই বন্ধ করে দেবেন। কর্তা খুব বিবেচক লোক। তিনি যা বলেন তারা তা করে।
কালিদাস বললেন, ‘কে এসেছিল তা টের পেয়েছিলে কি?’
‘আজ্ঞে হাঁ। কাজকর্ম সেরে যেই শুয়েছি অমনি সদরদরজার সামনে পালকি নামবার শব্দ শুনলুম। মনে হয় কোন মেয়েছেলে এসেছিলেন।’
‘মনে হবার কোন বিশেষ কারণ আছে কি?’
দাস বললে, ‘ওঁর কাছে পালকি করে মেয়েছেলেই আসেন। তাই মনে হয়েছিল মেয়েছেলে।’
‘কখন সে মেয়েছেলে চলে গিয়েছিল তা জান কি?’
দাস বলল, ‘আজ্ঞে না। সকালে উঠে দেখলুম সদরদরজা ভেজানো। তাহলে কর্তা বন্ধ করতে আসেননি। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।’
দাসকে ছুটি দিয়ে কালিদাস যজ্ঞদত্তকে বললেন,‘আপনি জানেন কি কোন্ বা কোন্ কোন্ স্ত্রীলোক আপনার দাদার কাছে আসতেন অথবা দাদা তাঁদের কাছে যেতেন?’
লজ্জানত মুখে যজ্ঞদত্ত বললে, ‘তা আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে কোন বেশে১ গানবাজনার ভাল আসর হলে যেতেন। শুনেছি এই বাগানবাড়িতে মাঝে মাঝে খণ্ডপানা আসতেন।’
কালিদাস বললেন, ‘খণ্ডপানা মিছরির সরবৎ,—নামটি তো বেশ। কিন্তু কে সে? তার নাম তো আমি শুনিনি।’
ধন্বন্তরি বললেন, ‘সর্বজ্ঞ তুমি, তোমার জানা উচিত ছিল। খণ্ডপানা এখানে এসেছে প্রায় বছর খানেক হতে চলল। বেশে থাকে না, বাড়ি ভাড়া করেও নেই। আগে থাকত মূলদেব-গোষ্ঠীর আশ্রমে। ও নাকি ওদের নেত্রীর মতন। বয়স কত বলা শক্ত, তবে দেখায় তিরিশ বত্রিশের মতো। খুব সুন্দরী। চোখ টানা তবে তির্যক্-বিন্যস্ত। একটু যেন বিদেশি ছোপ আছে। ওদের গোষ্ঠীর বাইরে ও মেলামেশা করে না। দেবদত্ত মাঝে মাঝে মূলদেব-গোষ্ঠীতে যেতেন। আমাকেও একবার নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি যাইনি। এঁদের আড্ডা হল উজ্জয়িনীর উত্তর প্রান্তে এক বড় বাগানবাড়িতে।
কালিদাস বললেন, ‘মূলদেব-গোষ্ঠীর কথা আমি জানি। এঁদের কাজকর্ম লোকে ভাল বলে না। গোষ্ঠীর সভ্যেরা ধনী ও বিলাসী বলে খ্যাত হলেও সাধারণ লোকে এঁদের পছন্দ করে না। দেবদত্ত কী সূত্রে এঁদের দলে গেল, তা জান কি?’
ধন্বন্তরি বললেন,‘ঠিক জানি না, তবে অনুমান করতে পারি। মূলদেব-গোষ্ঠীর আদি মূল বিদেশে। নিজেদের ব্যবসায়-সূত্রে দেবদত্ত কয়েকবারই বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে এঁদের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ ঘটেছিল বলে মনে হয়। শঠ-প্রবঞ্চক বলে দেবমূল-গোষ্ঠীর যতই কুখ্যাতি থাক দেবদত্ত সাঁচ্চা লোক ছিলেন।’
যজ্ঞদত্তের দিকে চেয়ে কালিদাস বললেন, ‘আপনাদের ব্যবসা কেমন চলছে?’
যজ্ঞদত্ত বললে, ‘আমি যা জানি তাতে ভালই।’
জিজ্ঞাসু চোখে কালিদাস ধন্বন্তরির দিকে মুখ ফেরালেন। ধন্বন্তরি বললেন, ‘আমি এঁদের ব্যবসা সম্বন্ধে কিছুই অবগত নই। তবে মাস দুয়েক আগে দেবদত্ত আমাকে একটা কথা বলেছিলেন সেটা এখন মনে পড়ছে। তাতে মনে হচ্ছে তিনি কারবারে কিছু পরিবর্তন আনতে উদ্যোগ করছিলেন।’
‘কী সে কথা?’—কালিদাস বললেন।
‘দেবদত্ত আমাকে সংসারের ও আরোগ্যশালার জন্যে সাদা বিদেশী চিনি সরবরাহ করতেন। সেদিন বললেন, “আপনাকে আর সাদা বিদেশী চিনির যোগান দেব না। এবার থেকে দেশী ময়লা চিনি ব্যবহার করতে হবে।” আমি কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, পরে বলব। আমি আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমার চিনির ভাণ্ডার শেষ হতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল।’
ধন্বন্তরির কথা শুনে কালিদাস চুপ করে রইলেন। তারপর উঠে বললেন, ‘চললুম এখন।’ যজ্ঞদত্তকে কাতর দেখে কালিদাস ধন্বন্তরিকে বললেন, ‘আপনি কিছুক্ষণ এখানে থাকুন। বেচারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।’
দেবদত্তের বাগানবাড়ি থেকে কালিদাস সোজা বলে গেলেন মহামন্ত্রীর উপকারিকায়। শারদানন্দকে তিনি দেবদত্তের মৃত্যুর কথা জানিয়ে তাঁর তদন্তের সব বিবরণ মহামন্ত্রীর গোচর করলেন। মহামন্ত্রী বুঝলেন, এ হত্যাকাণ্ড। আর এর মধ্যে গভীর রহস্য আছে, তা কালিদাস উন্মোচন করতে চান। তিনি কালিদাসকে বললেন, ‘দেবদত্তের হত্যার ব্যাপারে রাজকুলের বা রাজ্যের ইষ্টানিষ্ঠের কোন সম্পর্ক আছে কি?’
কালিদাস বললেন, ‘মনে হয় আছে। তবে আরও অনুসন্ধান না করলে তা ধরা পড়বে না। আমার বিশেষ আগ্রহ হয়েছে খিল-আঁটা ঘরের মধ্যে শান্তশিষ্টভাবে মানুষ খুন যে সুকৌশলী ব্যক্তির কাজ তাকে খুঁজে বার করা ও সম্ভব হলে শাস্তি দেওয়া।’
শারদানন্দ বললে, ‘খিল দেওয়া ঘরের মধ্যে হত্যা করে হত্যাকারীর অন্তর্ধান এ তো অত্যন্ত অসম্ভব, অলৌকিক কাণ্ড। এ হল কি করে আমায় বুঝিয়ে দিতে পার?’
কালিদাস বললেন, ‘পারি। শুনুন, আমি ব্যাপারটা এইরকম বুঝেছি। দেবদত্তর কাছে কোন গণিকার মতো নারী এসেছিল। তার সঙ্গে ফুর্তি করে মদটদ খেয়ে দেবদত্ত ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মেয়েটি চলে যায়। তারপর খুনী আসে। সে ঘুমন্ত দেবদত্তের ঘাড়ের নিচে মেরুদণ্ডে সরু ছুঁচ বিঁধিয়ে তাকে নিঃসাড়ে হত্যা করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দরজায় ছোট খিল লাগান ছিল। সে খিলের ডাঁটিতে সুতো বেঁধে উঁচু করে টেনে ধরে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে সুতো আলগা করে দেয়। তখন খিল আপনিই আংটায় পড়ে যায়, ঘর ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সে সুতো টেনে বার করে নেয়।’
শারদানন্দ বললেন,‘তোমার ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য বটে, কিন্তু কেউ যে খুন করেছিল, ঘটনাটা যে আত্মহত্যা নয় তার প্রমাণ কি?’
কালিদাস বললেন, ‘এ প্রশ্ন আপনার মুখে শোভা পায় না। দেবদত্তর শরীরের ভিতরে বাহিরে কোন আঘাতের অথবা বিষপানের চিহ্নমাত্র নেই। নিম্নের ঘাড়ের অমন জায়গায় ছুঁচ ফোটানো কোন শল্যচিকিৎসকের পক্ষেও সম্ভব নয়। তা ছাড়া আরও একটা বাহ্য প্রমাণ আছে।’
‘কী সে প্রমাণ?’
‘দেবদত্তর মাথার শিয়রের দিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে একটি ছোট বুদ্ধমূর্তি আছে। ইনি বৌদ্ধ ছিলেন। সে বুদ্ধ মূর্তিটির মুখ ওলটানো ছিল। অর্থাৎ বুদ্ধ যেন মৃত দেবদত্তের দিকে পিছন ফিরে ছিলেন।’
এর তাৎপর্য হল এই যে হত্যাকারীও বুদ্ধ-উপাসক। সে বুদ্ধ মূর্তির সামনাসামনি দেবদত্তকে হত্যা করতে চায়নি। তার আগে মূর্তিটির মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর সে মূর্তিটিকে আর স্পর্শ করবার সাহস করেনি।’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। লোকটা তো খুব চতুর ও কৌশলী। আমাকে কী করতে হবে বল।’
কালিদাস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি জানেন যে উজ্জয়িনীতে মূলদেবগোষ্ঠীর শঠ-প্রবঞ্চকদের একটি প্রবল আড্ডা আছে?’
‘হ্যাঁ, তা জানি। নগরপালের উপর হুকুম আছে ওদের কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখতে। কেন? ওরা কি এ ব্যাপারে আছে নাকি?’
‘সেইরকম তো মনে হচ্ছে। আচ্ছা, মাস কতক হল ওদের এক নেত্রীস্থানীয় মহিলা, নাম খণ্ডপানা, এখানে এসে রয়েছেন?’
‘তা তো মনে পড়ছে না।’
‘সেই মহিলাই বোধ হয় কাল রাত্তিরে দেবদত্তের বাগানবাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাকে আমি আজই জেরা করতে চাই।’
‘বেশ তো। জেরা করে এস না।’
‘ওদের আড্ডায় গেলে আমার সঙ্গে দেখা না করতে দিতেও পারে। তা ছাড়া আমাকে দেখলে ওরা সাবধান হয়ে যেতে পারে। তখন জেরা করে সত্য কথা টেনে বার করা সম্ভব হবে না। খণ্ডপানাকে আপনার এখানে আনতে হবে। আপনি যেন তার সঙ্গে আলাপ করতে চান। তাহলে ও নিঃশঙ্কচিত্তে আসবে।’
‘বেশ, তাহলে ওকে ডেকে পাঠাই।’
‘ডেকে পাঠান আজকে সন্ধ্যের আগে ওর অবসর মতো একবার আসবার জন্যে।’
শারদানন্দ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁর নিজস্ব করণিককে ডেকে চিঠি লিখিয়ে তখনই লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
অবিলম্বে খণ্ডপানার জবাব এল, সে আসবে বেলা তৃতীয় প্রহরের শেষাশেষি। পালকি পাঠাবার দরকার নেই। সে নিজের পালকিতেই যাবে মহামন্ত্রীকে বন্দনা করতে। চিঠি পড়ে দুজনেই খণ্ডপানার সৌজন্যে খুশি হলেন।
বেলা তিন প্রহরের ঘণ্টা পড়তে আর দণ্ডখানেক বাকি আছে। শারদানন্দ তাঁর আপিসকক্ষে বসে আছেন। তাঁর পাশে আছেন কালিদাস।
ঘণ্টা পড়বার ঠিক আগেই খণ্ডপানার পালকি মহামন্ত্রীর উপকারিকার দ্বারে এসে নামল। প্রহরী খণ্ডপানাকে মহামন্ত্রীর ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। মহামন্ত্রী ও কালিদাস উঠে দাঁড়ালেন। পরস্পর নমস্কার বিনিময় হল। তিনজনে বসলেন।
প্রথম মুখ খুললেন শারদানন্দ। নিজের পরিচয় দিলেন, কালিদাসেরও পরিচয় দিলেন। খণ্ডপানা বললে, ‘আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনাকে দেখেছিও। সাম্রাজ্যের সুদক্ষ কর্ণধার আপনাকে আমি নমস্কার করি। ওঁর নাম আমি শুনেছি, ওঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আমার খুবই ইচ্ছে। আজ সেই সৌভাগ্য ঘটে গেল। আমি নমস্কার করি।’
সুন্দরী মহিলার সপ্রতিভ ব্যবহারে ও সৌজন্যময় বাক্যে দুজনেই বেশ ভিজে গেলেন।
শারদানন্দ কালিদাসের দিকে চাইলেন। কালিদাস বললেন, ‘আপনার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারছি না। আপনার মতো মহিলা উজ্জয়িনীতে এসে রয়েছেন তার আমি কোন কিছু জানি না, এ আমার দুর্ভাগ্যের কথা।’
তারপর সুর ফিরিয়ে বললেন, ‘কাল আপনি সন্ধ্যার পর দেবদত্তর বাগানবাড়িতে গিয়েছিলেন?’
প্রশ্ন শুনে মুহূর্তের জন্যে খণ্ডপানা যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। তারপর বললে, ‘তবে শুনুন সব কথা।’
বাগানবাড়িতে যাওয়া থেকে আসা পর্যন্ত সব কথা খণ্ডপানা বলে গেল। একথা সবই কালিদাস অনুমান করে নিয়েছিলেন। শুনে বললেন, ‘আপনি কিছু পানীয় নিয়ে গিয়েছিলেন?’
খণ্ডপানা বললে, ‘হ্যাঁ। তা আমরা দুজনেই খেয়েছিলুম। দেবদত্তর সেদিন বোধ হয় শরীরে ক্লান্তি ছিল তাই সে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। আমি তাকে ভাল করে শুইয়ে রেখে চলে আসি। চাকরবাকর কেউ জেগে ছিল না। আমি ঘরের দরজা ও সদরদরজা ভেজিয়ে রেখে গিয়েছিলুম।’
খণ্ডপানার সরল সত্য ভাষণে মহামন্ত্রী ও কালিদাস দুজনেই খুব প্রীত হলেন। মহামন্ত্রী বললেন, ‘কিছু পানীয় আনালে অনুগ্রহ হবে কি?’
খণ্ডপানা হেসে উঠে বললে, ‘আজ থাক, অন্যদিন হবে।’
কালিদাস বললেন, ‘দেবদত্তের মৃত্যুর কথা আপনি কখন জানলেন?’
খণ্ডপানা উত্তর দিলে, ‘সকালে, বাগানবাড়িতে ধন্বন্তরি পৌঁছবার অল্পক্ষণ পরেই। ও বাড়ির আশেপাশে আমাদের লোক থাকে।’
‘জানেন কি, দেবদত্তকে হত্যা করা হয়েছে?’ কালিদাস বললেন।
‘বলেন কী!’ বলতে বলতে একলহমার জন্যে খণ্ডপানার চোখ ছলছল করে উঠল। তারপর কঠিন স্বরে বললে, ‘প্রমাণ?’
‘শুনুন তবে’, বলে কালিদাস তাঁর অনুসন্ধানের সব বিবরণ যা তিনি দুপুরের আগে মহামন্ত্রীকে শুনিয়েছিলেন তা আবার বলে গেলেন।
খণ্ডপানা মন দিয়ে শুনলে। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ‘বুঝেছি। আপনার অনুমান ঠিক।’
কালিদাস বললেন, ‘কে এ শত্ৰু, কেন এ শত্রুতা তা বলতে পারেন কি?’
খণ্ডপানা বললে, ‘হত্যাকারী কে তা বলতে পারব না। তবে শত্রুতা কোন্ পক্ষ থেকে তার হদিস হয়তো দিতে পারি। আপনারা অবশ্যই জানেন যে দেবদত্তদের তিন পুরুষের ব্যবসা বিদেশ থেকে চিনি আমদানি। এই আমদানির পরিমাণ যেমন দিন দিন বাড়ছিল তেমনি উৎপাদকেরাও চিনির দাম বাড়িয়ে চলছিল। ক্রমশ এমন অবস্থায় এসেছে যে কারবারে লাভ হচ্ছে না। দেবদত্ত চেষ্টা করছিল কিছুদিন থেকে দেশে খুব সাদা চিনি তৈরি করতে। কিন্তু পারছিল না। এ বিষয়ে কথায় কথায় আমি তাকে বলি যে বিদেশী চিনি অত সাদা হবার কারণ হচ্ছে নরাস্থিচূর্ণের মধ্যে দিয়ে চোলাই করা। এই কথা শুনে দেবদত্ত খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। সে খেদ করে বললে, “আমি এত যে সব দেবমন্দিরে বিহারে মঠে সাদা চিনি জুগিয়ে আসছি সে এমন দূষিত বস্তু। এ কারবার আমি তুলে দেব।” আমি বলেছিলুম, “তাড়াতাড়ি করো না। বিদেশী চিনির আমদানি কমাও, দেশী চিনির উৎপাদন বাড়াও।” ও সেই কাজে মন দিয়ে লেগে পড়েছিল।
‘আমার মনে হচ্ছে আমাদের এই পরামর্শের কথা বিদেশী চিনি উৎপাদকদের কানে গিয়ে থাকবে। তাদেরই এ কাজ।’
শারদানন্দ প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে আসবার আগে থেকেই কি আপনার সঙ্গে দেবদত্তর পরিচয় ছিল?’
খণ্ডপানা বললে, ‘হ্যাঁ, ছিল। ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বিদেশে। স্থানটির নাম করব না। সেখানে আমাদের গোষ্ঠীর একটি বড় আড্ডা আছে। তারপরেও অনেকবার দেখা হয়েছে বিদেশে নানা অঞ্চলে। বুঝতে পারছেনই তো, আমাদের সম্প্রদায়ের ঘাঁটি ধনী ব্যবসাদারদের আড়তদারির আশেপাশে জমে ওঠে। দেবদত্ত খাঁটি লোক ছিল। সে আমাদের সঙ্ঘের সভ্য নয়। শঠতা-প্রবঞ্চকতা তার প্রকৃতির বিরুদ্ধে ছিল। তাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওরও খুব আস্থা ছিল আমার বিবেচনার উপর। অনেক বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইত। আজ দেখছি আমার কথাই ওর মরণ ডেকে এনেছিল।’
কালিদাস বললেন, ‘আমি অনুমান করছি শল্যচিকিৎসা-সুনিপুণ কোন বিদেশী চর একাজ করেছে। সে বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিল।’
‘আপনার অভিমত যথার্থ। কিন্তু তাকে ধরবেন কি করে?’ খণ্ডপানা বললে।
‘যে জাতির লোকের কথা ভাবছি তারা সবাই তো একরকম দেখতে। সরষের গাদা থেকে ভুতুড়ে সর্ষেকে চিনব কি করে?’ কালিদাস বললেন।
খণ্ডপানা বললে, ‘দেবদত্তর খুনীকে না ধরতে পারলেও আপানারা অন্য উপায়ে কিছু শোধ নিতে পারেন।’
শারদানন্দ বললেন, ‘কি, কি?’
খণ্ডপানা বললে, ‘বিদেশী চিনি আমদানি অবিলম্বে নিষিদ্ধ করে দিন। তবে তার আগে সমস্ত সঞ্চয় রাষ্ট্রের ভাণ্ডারজাত করুন। তা না হলে লোভী ব্যবসায়ীরা যা তা করে বেড়াবে।’
শারদানন্দ খুশি হয়ে বললেন, ‘আপনাকে যদি সহকারী পেতুম!’
খণ্ডপানা একটু হেসে বললে, ‘এ জন্মে তা আর সম্ভব নয়।’
দুজনকে নমস্কার জানিয়ে খণ্ডপানা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। ওঁরাও দাঁড়ালেন। শারদানন্দ কালিদাসকে বললেন খণ্ডপানাকে পালকি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। খণ্ডপানা নিষেধ করল না।
মহামন্ত্রীর ঘরের বাইরে এসে খণ্ডপানা বললে, ‘আপনাকে আমাদের ওখানে আসতে বলতে পারি না, আর বলবও না। আমি একদিন আপনার বাড়ি যাব, তা বলে রাখছি। আপনার মুখে ঋতুসংহার ও মেঘদূত আবৃত্তি শুনব।’
কালিদাস বললেন, ‘বেশ তো।’ তারপর খণ্ডপানা পালকিতে উঠে বসলে পর বললেন, ‘খবর দিয়ে এলে ভাল হয়।’
খণ্ডপানা বললে, ‘ভয় নেই। গিন্নির বিক্ষোভ জাগাব না। তাঁর কথা আমি শুনেছি।’
পালকি চলতে শুরু করলে কালিদাস বললেন, ‘তাঁকে আপনার কথা বলে রাখব।’
খণ্ডপানা খিলখিল করে হেসে উঠল। পালকি চলে গেল।
১. সেকালে মহিলা পরিচালিত অতিথিশালাকে ‘বেশ’ বলত। বেশ থেকেই বেশ্যা শব্দটির উদ্ভব। বেশ্যা মানে বেশের সুন্দরী পারিচারিকা।