“খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
কথামৃতের শেষ পরিচ্ছেদে এসে প্রাণটা হুহু করে ওঠে। ঠাকুরের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো গৌর নিতাইয়ের ছবি একখানা বেশি ছিল। গৌর নিতাই সপার্ষদ নবদ্বীপে সঙ্কীর্তন করছেন। রামলাল শ্রীরামকৃষ্ণকে বলছেন : “তাহলে ছবিখানি এই এঁকে মাস্টারকেই দিলাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : “আচ্ছা, তা বেশ।”
সব ছাড়ার পালা। যাকে যা দেবার আছে সব দিয়ে যাচ্ছেন একে একে। যা বলার আছে সব বলে যাচ্ছেন।
ঠাকুর হঠাৎ একদিন মৌনী হলেন। সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ১১ আগস্ট ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দ। আগের দিন গেছে অমাবস্যা। শ্রীম লিখছেন : “শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখের সঞ্চার হইয়াছে। তিনি কি জানিতে পারিয়াছেন যে, শীঘ্র তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করিবেন। জগন্মাতার ক্রোড়ে আবার গিয়া বসিবেন? তাই কি মৌনাবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন? তিনি কথা কহিতেছেন না দেখিয়া শ্ৰীশ্ৰীমা কাঁদিতেছেন। রাখাল ও লাটু কাঁদিতেছেন। বাগবাজারের ব্রাহ্মণী এইসময় আসিয়াছিলেন, তিনিও কাঁদিতেছেন। ভক্তেরা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, ‘আপনি কি বরাবর চুপ করিয়া থাকিবেন?”
শ্রীরামকৃষ্ণকে ঘিরে যে লীলা শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়ে আসছে। এইবার প্রদীপ একদিন নিভবে। কাল চলে যাবে ইতিহাসের গর্ভে। তারই ইঙ্গিত সর্বত্র। শ্রীম লিখছেন : “শ্রীরামকৃষ্ণ-রোগ সারাবার কথা বলতে পারি না। আবার ইদানীং সেব্য-সেবক ভাব কম পড়ে যাচ্ছে। একবার বলি মা তরবারির খাপটা একটু মেরামত করে দাও; কিন্তু ওরূপ প্রার্থনা কম পড়ে যাচ্ছে, আজকাল ‘আমি’টা খুঁজে পাচ্ছি না। দেখছি তিনিই এই খোলটার ভিতরে রয়েছেন।”
এই কথার পর ঠাকুরের অনুমতি নিয়ে গোস্বামীজীর কীর্তন শুরু হলো। অনুমতি নেওয়ার কারণ, ঠাকুর অসুস্থ। কীর্তন হলেই ভাবাবেশ হবে। ভাবাবেশ হলেই গলায় চাপ পড়বে। কীর্তন শুনতে শুনতে ঠাকুর যথারীতি ভাবাবিষ্ট হলেন। দাঁড়িয়ে উঠে শুরু করে দিলেন ভক্তসঙ্গে নৃত্য। বাখাল ডাক্তার শ্রীময়ের সঙ্গে এসেছিলেন ঠাকুরের চিকিৎসার জন্যে। তাঁরা ঠাকুরের ভাবাবেশ দেখলেন। তাঁর ভাড়াটিয়া গাড়ি অপেক্ষা করছে বাইরে। কলকাতায় ফিরতে হবে। উঠে পড়লেন। একে একে প্রণাম সেরে বিদায়ের পালা।
শ্রীরামকৃষ্ণ সস্নেহে মাস্টারকে বললেন : “তুমি কি খেয়েছ?”
এ হলো ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বরের কথা। এরপর আর মাত্র একটি দিন। বৃহস্পতিবার ২৪ সেপ্টেম্বর। পূর্ণিমার রাত। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ঘরের ছোট খাটটির উপর বসে আছেন। মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা বসে আছেন মেঝেতে। গলার জন্যে ঠাকুর কিছুটা কাতর।
শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলছেন : “এক একবার ভাবি দেহটা খোল মাত্ৰ। সেই অখণ্ড (সচ্চিদানন্দ) বই আর কিছু নেই।”
কথামৃতের মূলপর্ব শেষ হচ্ছে এইভাবে—”তাহলে ছবিখানি এঁকেই (মাস্টারকে) দিলাম”–রামলাল এইকথা বলতে বলতে দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরের অতি প্রিয় ছবিখানি খুলে নিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে গৌর নিতাইয়ের ছবি একখানা বেশি ছিল, গৌর নিতাই সপার্ষদ নবদ্বীপে সঙ্কীর্তন করছেন।
ঠাকুর বললেন : “আচ্ছা তা বেশ।”
এরপর সামান্য একটু সংযোজন—”ঠাকুর কয়েকদিন প্রতাপের ঔষধ খাইতেছেন। গভীর রাত্রে উঠিয়া পড়িয়াছেন, প্রাণ আই-ঢাই করিতেছে। হরিশ সেবা করেন, ঐ ঘরেই ছিলেন; রাখালও আছেন; শ্রীযুক্ত রামলাল বাহিরে বারান্দায় শুইয়া আছেন। ঠাকুর পরে বলিলেন, মধ্যম নারায়ণ তেল দেওয়াতে ভাল হলাম, তখন আবার নাচতে লাগলাম।
‘সমাপ্ত’ লেখায় অপূর্ব এক লীলার সমাপ্তি। এরপরেই পরিশিষ্ট। “বরানগর মঠ। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি আজ শিবরাত্রির উপবাস করিয়া আছেন। দুইদিন পরে ঠাকুরের জন্মতিথি পূজা হইবে। বরানগর মঠ সবে পাঁচ মাস স্থাপিত হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিত্যধামে বেশিদিন যান নাই।… আজ সোমবার শিবরাত্রি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭।… পূজা হইয়া গেল। শরৎ তানপুরা লইয়া গান গাইতেছেন —
“শিব শঙ্কর বম্ বম্ (ভোলা)
কৈলাসপতি মহারাজরাজ! …
‘নরেন্দ্র কলিকাতা হইতে এইমাত্র আসিয়াছেন। এখনো স্নান করেন নাই। কালী নরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মকদ্দমার কি খবর?
“নরেন্দ্র (বিরক্ত হইয়া)—’তোদের ওসব কথায় কাজ কি? ‘
“নরেন্দ্র তামাক খাইতেছেন ও মাস্টার প্রভৃতির সহিত কথা কহিতেছেন– ‘কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে হবে না। কামিনী নরকস্য দ্বারম্। যত লোক স্ত্রীলোকের বশ। শিব আর কৃষ্ণ—এঁদের আলাদা কথা। শক্তিকে শিব দাসী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সংসার করেছিলেন বটে, কিন্তু কেমন নির্লিপ্ত। ফস করে বৃন্দাবন কেমন ত্যাগ করলেন!“
কথামৃতের এই পর্যায়টি উল্লেখ করলাম দুটি কারণে। প্রথম কারণ—আমরা যে লীলায় প্রত্যক্ষ অংশ নিতে পারিনি বা নিলেও দেহরূপ বদলাতে বদলাতে বর্তমানের নামরূপে এসে বিস্মৃত, সেই লীলার অমৃত স্বাদে কথামৃত জমজমাট। ঠাকুর, পরম ভক্ত শ্রীম-র মাধ্যমে অক্ষরের মালায় স্তব্ধ করে রেখে গেছেন, সেই কাল, সেই ভাব, সেই আন্দোলনকে। ঠাকুরের হাঁটাচলা, ওঠাবসা, ফিরে তাকানো, কথা বলা, হাত নাড়া, ক্ষণে ক্ষণে ভক্তদের আসা-যাওয়া, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে কাষ্ঠপাদুকার শব্দ তুলে মা ভবতারিণীর মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টাবাদন, পঞ্চবটীতে ঘুরে বেড়ানো, ভক্তসঙ্গে লীলাপ্রসঙ্গ, আরতির কাঁসর ঘণ্টা, কথামৃতের দুই মলাটে চিরকালের জন্যে বন্দী হয়ে আছে। আজও জীবন্ত।
দ্বিতীয় কারণ—ঠাকুর যেই নিত্যধামে আরোহণ করলেন দক্ষিণেশ্বর যেন ফাঁকা হয়ে গেল। ‘নন্দকূল চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।’ পদব্ৰজে অথবা নৌকাপথে কি ফিটনে চড়ে, দূর থেকে ভক্তরা আর আসেন না। মা আছেন; কিন্তু সেই পঞ্চবটীর সাধনপীঠের প্রাণপুরুষ ফিরে গেছেন অমর্ত্যলোকে। দেবী আছেন; কিন্তু তাঁকে জাগ্রত করার সাধকপ্রবর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তীর্থ আছে, স্মৃতি আছে, লীলা নেই। অন্তরঙ্গ পার্ষদ যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সেই মুহূর্তের শূন্যতা দুঃসহ। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন। কোথায় তাঁরা দানা বাঁধবেন। বরানগরের জীর্ণ কুঠিতে তাঁরা সমবেত হয়েছেন, ঠাকুরের পট প্রতিষ্ঠা হয়েছে, পূজার্চনাদিও হচ্ছে, সাধন-ভজনেরও কমতি নেই; কিন্তু কারুরই মন বসছে না। যিনি চলে গেলেন তাঁর তো কোন দ্বিতীয় হয় না। কথামৃতের পরিশিষ্টাংশ যেন দীর্ঘ একটি বিলাপের মতো। সন্তানদের অনেকটা দিশাহারা অবস্থা।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের ‘টাকা মাটি আর মাটি টাকা’ ভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আত্মদর্শন, ‘যা পাবি তা বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।’ ‘গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়।’ তিনি কিছু প্রতিষ্ঠা করে যাননি। বিশেষ কোন মত, বিশেষ কোন পথ, বিশিষ্ট কোন অর্ডার। বেছে বেছে, আধার বুঝে, দশ-বারটি বৈরাগ্যবান যুবকের অন্তরে বীজ ফেলে গিয়েছিলেন। এ যেন তাঁর নিজেরই ‘প্যার্য্যাবলস’-এর ধারা অনুসরণ। পাখি ঠোঁটে করে বীজ নিয়ে যেখানে সেখানে ফেলে। কোনটা পাথরে পড়ল, কোনটা পড়ল জলে, কোনটা মরুভূমিতে। ঠিক জায়গায় যেটি পড়ল, সেইটিই অঙ্কুরিত হলো, ধীরে ধীরে পরিণত হলো বিশাল বৃক্ষে। মঠ, মন্দির, মসজিদ অথবা কোন অর্ডারে ঠাকুর নিজেকে জড়াতে চাননি। তাঁর অসাধারণ মতবাদ—”যত মত তত পথ।”
“যথা নদীনাং বহুবোহম্বুবেগাঃ
সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি।”
আমার মত, আমার পথ বলে যাঁরা দম্ভ করতেন, ঠাকুর মুচকি হেসে বলতেন : “ওরে ও যে মতুয়ার বুদ্ধি।”
“যদি হৃদয়-মন্দিরে মাধব প্রতিষ্ঠা করতে চাও, যদি ভগবান লাভ করতে চাও, শুধু ভোঁ ভোঁ করে শাঁখ ফুঁকলে কি হবে! আগে চিত্তশুদ্ধি কর, মন শুদ্ধ হলে ভগবান পবিত্র আসনে এসে বসবেন। চামচিকার বিষ্ঠা থাকলে মাধবকে আনা যায় না। এগারজন চামচিকে একাদশ ইন্দ্রিয়—পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় আর মন। আগে মাধব প্রতিষ্ঠা—তারপর ইচ্ছা হয় বক্তৃতা লেকচার দাও! আগে ডুব দাও। ডুব দিয়ে রত্ন তোল, তারপর অন্য কাজ। কেহ ডুব দিতে চায় না। সাধন নাই, ভজন নাই, বিবেক-বৈরাগ্য নাই, দু-চারটে কথা শিখেই অমনি লেকচার! লোকশিক্ষা দেওয়া কঠিন। ভগবানকে দর্শনের পর যদি কেউ তাঁর আদেশ পায় তাহলে লোকশিক্ষা দিতে পারে।”
“তত্রৈবং সতি কর্তারমাত্মানং কেবলন্ত যঃ।
পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বাৎ ন স পশ্যতি দুর্মতিঃ।।”
তিনি নিজে দন্তশূন্য, সাধারণের থেকেও সাধারণ মানুষ ছিলেন। বুঝতেই দিতেন না, তিনি অবতার। দক্ষিণেশ্বরে এসে কেউ ধর্মকথা, তত্ত্বকথা শুনতে চাইলে লহমায় দেখে নিতেন আধারটি কেমন। যেই দেখতেন মতুয়া, অমনি বলতেন : “যাও না যাও, ঐ মন্দিরে মা-ভবতারিণী আছেন, পঞ্চবটী, বেলতলা, গঙ্গা, বিল্ডিং দেখ, সিনারি দেখ।”
ঠাকুরের পক্ষে সম্ভব ছিল না, টাটে বসে গুরুগিরি করার। তিনি সার জানতেন, ঈশ্বর মন দেখেন। মুখে এক, মনে আরেক, ও চলবে না।
“লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণমূষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ।
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ।।
কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্।
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্।।”
তাঁর কাছে অনেকে এসেছেন, একবার, দুবার, বহুবার দর্শন হয়েছে, শ্রবণ হয়েছে। এঁদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনই ‘ইনার-অর্ডার’-এ স্থান পেয়েছিলেন। মায়ের পায়ে দেবার জন্যে বেছে বেছে তুলে নিয়েছিলেন মাত্র কয়েকজনকে। তাঁদের তিন টানকে এক টান করে দিয়েছিলেন। ঠাকুর বলতেন : “তিন টান একত্র হলে তবে তিনি দেখা দেন—বিষয়ীর বিষয়ের ওপর, মায়ের সন্তানের ওপর আর সতীর পতির ওপর টান। এই তিন টান যদি কারো একসঙ্গে হয়, সেই টানের জোরে ঈশ্বরকে লাভ করতে পারে।”
ঠাকুর যাঁদের তুলে নিয়েছিলেন, তাঁদের তিনটান এক হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকেই ধাবিত হয়েছিল।
“তেজস্তরন্তি তরসা ত্বয়ি তৃপ্ততৃষ্ণাঃ
রাগে কৃতে ঋতপথে তুয়ি রামকৃষ্ণে।
মর্ত্যামৃতং তব পদং মরণোর্মিনাশং
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!”
ঠাকুর একদিন শ্রীমকে বলেছিলেন : “দেখ, চাষারা হাটে গরু কিনতে যায়; তারা ভাল গরু, মন্দ গরু বেশ চেনে। লেজের নিচে হাত দিয়ে দেখে। কোন গরু লেজে হাত দিলে শুয়ে পড়ে, সে গরু কেনে না। যে গরু ল্যাজে হাত দিলে তিড়িং-মিড়িং করে লাফিয়ে উঠে সেই গরুকেই পছন্দ করে। নরেন্দ্র সেই গরুর জাত; ভিতরে খুব তেজ।” ঠাকুর হাসছেন আর বলছেন : “আবার কেউ কেউ লোক আছে, যেন চিঁড়ের ফলার, আঁট নাই, জোর নাই, ভ্যাৎ ভ্যাৎ করছে।”
ঠাকুরের ভাব আর স্বামীজীর তেজ দুয়ে মিলে সারা বিশ্বে যে ভাবান্দোলন হয়ে গেল তার কি কোন তুলনা আছে? অবতার পুরুষরা এইভাবেই একটা প্লাবন সৃষ্টি করে দিয়ে যান। গৌতম বুদ্ধ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য করেছিলেন। করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
“অযুত কণ্ঠে বন্দনা-গীতি ভুবন ভরিয়া উঠিছে,
(তব) অমিয় বারতা দেশ দেশান্তরে
হৃদয়ে হৃদয়ে পশিছে।”
গীতায় ভগবান বলছেন :
“নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদশিভিঃ।।”
শ্রীরামকৃষ্ণ এই সত্যেই স্থিত হয়েছিলেন—
“যা নাই—তা হতে কিছু হয় না প্রকাশ
থাকে যদি—কিছুতেই নাই তার নাশ।”
তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি সত্য অবিনাশী। ঠাকুরের সার কথা ছিল, ঈশ্বরের জন্যে ব্যাকুলতা। “এই ব্যাকুলতা। যে পথেই যাও, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, শাক্ত, ব্রহ্মজ্ঞানী—যে পথেই যাও, ঐ ব্যাকুলতা নিয়েই কথা। তিনি তো অন্তর্যামী, ভুল পথে গিয়ে পড়লেও দোষ নাই—যদি ব্যাকুলতা থাকে। তিনি আবার ভাল পথে তুলে লন। আর সব পথেই ভুল আছে। সব্বাই মনে করে আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে, কিন্তু কারো ঘড়ি ঠিক যায় না। তা বলে কারু কাজ আটকায় না। ব্যাকুলতা থাকলে সাধুসঙ্গ জুটে যায়, সাধুসঙ্গে নিজের ঘড়ি অনেকটা ঠিক করে লওয়া যায়।”
ঠাকুর বড় আয়োজন করে দেহধারণ করেছিলেন। ঠাকুরের কথায় : “মা, আমি কি যেতে পারি! গেলে কার সঙ্গে কথা কব? মা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী শুদ্ধ ভক্ত না পেলে কেমন করে পৃথিবীতে থাকব!
একান্তে দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রের সঙ্গে ঠাকুরের এইসব কথা হয়েছিল। এরপর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলছেন : “তুই রাত্রে এসে আমায় তুললি, আর আমায় বললি, ‘আমি এসেছি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীকে তকমা দিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমকে একদিন একখানা কাগজে লিখে বলেছিলেন : “নরেন শিক্ষে দিবে।
নরেন্দ্র পরে শুনে ঠাকুরকে বলেছিলেন : “আমি ওসব পারব না। “ ঠাকুর বলেছিলেন : “তোর হাড় করবে।”
তিরোধানের পর সন্তানেরা যে একটু বিপদে পড়বে ঠাকুর মানসচক্ষে তা দেখেছিলেন। দেখে শ্রীমকে একদিন বলেছিলেন : “তোমরা রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াবে, তাই শরীর ত্যাগ করতে একটু কষ্ট হচ্ছে।”
তিরোধানের অব্যবহিত পরের অবস্থা শ্রীম লিখে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ তখনো বিশ্বজয়ী হননি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছেন। গুরুভ্রাতাদের দায়িত্ব নিয়ে কখনো বরানগর মঠে, কখনো কলকাতায়। অর্থকষ্ট, নানা সংশয়। ঠাকুরের অনন্ত পরীক্ষা চলেছে। “তুই পারবি না, তোর হাড় পারবে।”
“যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্ৰত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিই নিশ্চয়!”
শ্রীম লিখছেন : “দু-তিন জনের ফিরিয়া যাইবার বাড়ি ছিল না। সুরেন্দ্র তাঁহাদের বলিলেন, ‘ভাই তোমরা আর কোথা যাবে; একটা বাসা করা যাক। তোমরাও থাকবে আর আমাদেরও জুড়াবার একটা স্থান চাই। তা নাহলে সংসারে এরকম করে রাতদিন কেমন করে থাকব। সেইখানে তোমরা গিয়ে থাক। আমি কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরের সেবার জন্য যৎকিঞ্চিৎ দিতাম। এক্ষণে তাহাতে বাসা খরচা চলিবে।’ সুরেন্দ্র প্রথম প্রথম দুই-এক মাস টাকা ত্রিশ করে দিতেন। ক্রমে যেমন মঠে অন্যান্য ভাইরা যোগ দিতে লাগলেন, পঞ্চাশ, ষাট করিয়া দিতে লাগিলেন। শেষে ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতেন। বরানগরে যে বাড়ি লওয়া হইল, তাহার ভাড়া ও ট্যাক্স ১১ টাকা। পাচক ব্রাহ্মণের মাহিনা ৬ টাকা আর বাকি ডালভাতের খরচ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ অর্ডারের এই শুরু। শ্রীম লিখছেন : “ধন্য সুরেন্দ্র! এই প্রথম মঠ তোমারি হাতে গড়া। তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল। তোমাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার মূলমন্ত্র কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ মূর্তিমান করিলেন। কৌমার-বৈরাগ্যবান শুদ্ধাত্মা নরেন্দ্রাদি ভক্তের দ্বারা আবার সনাতন হিন্দুধর্মকে জীবের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন। ভাই, তোমার ঋণ কে ভুলিবে? মঠের ভাইরা মাতৃহীন বালকের ন্যায় থাকিতেন—তোমার অপেক্ষা করিতেন, তুমি কখন আসিবে। আজ বাড়িভাড়া দিতে সব টাকা গিয়াছে—আজ খাবার কিছু নাই—কখন তুমি আসিবে—আসিয়া ভাইদের খাবার বন্দোবস্ত করিয়া দিবে! তোমার অকৃত্রিম স্নেহ স্মরণ করিলে কে না অশ্রুবারি বিসর্জন করিবে!”
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দলীলা পাঠকের সামনে ঠাকুরের তিরোধান আর নরেন্দ্রের স্বামী বিবেকানন্দ হবার মাঝখানের কয়েকটি বছর যেন শূন্যতায় ভরা। শ্রীম প্রথম দিকের সংগ্রামের চিত্র যখন যেমন সুবিধে কথামৃতের পরিশিষ্টাংশে লিপিবদ্ধ করেছেন ঠিকই, তবে বেশ বোঝা যায় প্রাণপুরুষের প্রয়াণে তিনিও ধীরে ধীরে অন্তর্মুখী হয়ে আসছেন। অন্তরে তাঁকে আসন দিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছেন। তখন তাঁর ভাব—” you must find your rest in the Lord, for He is the eternal rest of the Saints.”
যাঁর কাজ তিনি ঠিকই করিয়ে নেন। অল্প ব্যবধান, তারপরেই অনবদ্য আরেকটি লীলাকাহিনী—’স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’। লিপিকার আরেক গৃহী-সাধক, শ্রীযুক্ত শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী। ঠাকুর কৃপা করেছিলেন শ্রীমকে। স্বামীজী কৃপা করলেন শরচ্চন্দ্রকে। শ্রীমর প্রথম দর্শনের কাহিনী বড় অপূর্ব। ‘বসন্তকাল, ইংরেজী ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস।
“মাস্টার সিধু [ বরানগরের সিদ্ধেশ্বর মজুমদার]-র সঙ্গে বরানগরের এ বাগানে ও বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে এখানে [দক্ষিণেশ্বরে] আসিয়া পড়িয়াছেন।”
শ্রীম অবাক হয়ে দেখছেন, এক ঘর লোক সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। তাঁরা ঠাকুরের কথামৃত পান করছেন। “ঠাকুর তক্তপোশে বসিয়া পূর্বাস্য হইয়া সহাস্য বদনে হরিকথা কহিতেছেন।”
দ্বিতীয় দর্শনে, ঠাকুরের ঘর বন্ধ ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃন্দে।
শ্রীম প্রশ্ন করলেন : “হাঁগা, সাধুটি কি এখন এর ভিতর আছেন?“
বৃন্দে : “হাঁ, এই ঘরের ভিতর আছেন।”
মাস্টার : “ইনি এখানে কতদিন আছেন?”
বৃন্দে : “তা অনেকদিন আছেন।”
মাস্টার : “আচ্ছা, ইনি কি খুব বই-টই পড়েন?“
বৃন্দে : “আরে বাবা বই-টই! সব ওঁর মুখে!“
১৮৮২ আর ১৮৯৭, পনের বছরের ব্যবধান। স্থান নির্জন, নিরালা দক্ষিণেশ্বর নয়, খাস কলকাতা। বাগবাজারে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘর। আর সেই বসন্তকাল। ফেব্রুয়ারি মাস। নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ। বিলেত থেকে সবে কয়েকদিন হলো ফিরেছেন। প্রিয়নাথবাবুর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ। স্বামী তুরীয়ানন্দ শরচ্চন্দ্রকে স্বামীজীর সামনে উপস্থিত করলেন। শরচ্চন্দ্র স্বামীজীর সেই দিব্যকান্তির কোন বর্ণনা দেননি। ঠাকুর যাঁকে বলতেন, “নরেনের অখণ্ডের ঘর।”
স্বামীজী ছিলেন ‘অল ফোর্স’, দীপ্ত অগ্নিশিখা। সংস্কৃতে সম্ভাষণ করলেন। সাধু নাগমহাশয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। স্বামীজী কিষ্ট-ফিষ্টর চেয়ে প্রকৃত মানুষ চাইতেন। কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, সবিবেক কর্মী। শিষ্যকে বললেন :
“মা ভৈষ্ট বিদ্বংস্তব নাস্ত্যপায়ঃ
সংসারসিন্ধোস্তরণেহস্ত্যপায়ঃ
যেনৈব যাতা যতয়োঽস্য পারং
তমেব মার্গং তব নিৰ্দিশামি।।”
—হে বিদ্বন! ভয় পেও না, তোমার বিনাশ নেই, সংসার-সাগর পার হবার উপায় আছে। যে পথ অবলম্বন করে শুদ্ধসত্ত্ব যোগী এই সংসার-সাগর পার হয়েছেন সেই পথের নির্দেশ তোমায় আমি দিচ্ছি।
ঠাকুর শ্রীমকে অন্যভাবে বলেছিলেন, অনেক নরম করে সহজ করে। প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়ে করেছিস? শ্রীম যেই বললেন, হ্যাঁ, ঠাকুর হতাশ হয়ে বললেন, যাঃ। প্রথম ধাক্কা। ছেলে হয়েছে শুনে, দ্বিতীয় ধাক্কা। শ্রীম বুঝতে পারছেন, ধীরে ধীরে ঠাকুর তাঁর অহঙ্কার চূর্ণ করে দিচ্ছেন। শেষ পথও বাতলে দিলেন কৃপা করে—”তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা নাহলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।”
স্বামীজী শরচ্চন্দ্রকে শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’ পাঠ করতে বললেন। দেখিয়ে দিলেন বেদান্তের পথ। ঠাকুর বলতেন রসেবশে, স্বামীজী বলতেন, “আমাদের ভিতর অনন্ত শক্তি, অপার জ্ঞান, অদম্য উৎসাহ।” আর “চেতনের লক্ষণ কি?” “প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।” “যেখানে struggle, যেখানে rebellion, সেখানেই জীবনের চিহ্ন, সেখানেই চৈতন্যের বিকাশ।” রস বশ নয়। একেবারে বিদ্রোহ।
স্বামীজী শিষ্যকে বললেন : “সকলকে গিয়ে বল——ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজের ভিতর রয়েছে, একথা বিশ্বাস কর, তাহলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে। ঐকথা সকলকে বল্ এবং সেইসঙ্গে সাদা কথায় বিজ্ঞান, দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাসের মূল কথাগুলি mass-এর ভিতর ছড়িয়ে দে। আমি অবিবাহিত যুবকদের নিয়ে একটি Centre তৈয়ার করব—প্রথম তাদের শেখাব, তারপর তাদের দিয়ে এই কাজ করাব, মতলব করেছি।’
দক্ষিণেশ্বরে মা-ভবতারিণী, ধূপ, ধুনো, আরতি, ধ্যান, প্রাণায়াম। প্রাণপুরুষ ঠাকুর মিত্যধামে। সময় এগিয়ে গেছে পনের বছর। স্বামীজী পাশ্চাত্য কাঁপিয়ে এসেছেন। মেটিরিয়ালিস্টদের কাছে চাইতে যাননি, দিতে গিয়েছিলেন— বেদান্তধর্ম।
“আমাদের দেশে আছে মাত্র এই বেদান্তধর্ম। পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় আমাদের এখন আর কিছু নেই বললেই হয়।” স্বামীজী ‘মিরর’ পত্রিকার সম্পাদককে বলছেন : “ধর্মের চর্চায় ও বেদান্তধর্মের বহুল প্রচারে এদেশ ও পাশ্চাত্যদেশ—উভয়েরই বিশেষ লাভ। রাজনীতিচর্চা এর তুলনায় আমার কাছে গৌণ উপায় বলে বোধ হয়।”
দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে ঠাকুর বেরিয়ে এসেছেন বিশ্বমঞ্চে। একদিকে ভোগবাদী পাশ্চাত্য, আরেক দিকে দরিদ্র প্রাচ্য। মাঝখানে প্রকৃত সাম্যকার বিবেকানন্দ। ক্লাসকে নয় জাগাতে চাইছেন মাসকে। মঠ তখনো বেলুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মঠ আলমবাজারের ভাড়াবাড়িতে। স্বামীজী কখনো বাগবাজারে, কখনো আলমবাজারে, কখনো কাশীপুরে। যখন যেখানে, সেইখানেই ভক্ত ও বিদ্বজ্জন সমাগম। কেউ আসছেন বিশ্বমানবকে চোখের দেখা দেখতে। কেউ আসছেন প্রাণের টানে পথের সন্ধান পেতে।
যিনি যেভাবেই আসুন, বৈদান্তিক, কর্মযোগী, তেজোময় স্বামীজীকে ঘিরে দক্ষিণেশ্বরের মতো শান্ত, একান্ত লীলা জমছে না। জমতে পারে না। কারণ, “বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।” মন্দিরে, মসজিদে নয়, কণ্ঠের প্রাণায়াম, ধ্যান জপে নয়, পথ অন্য, কর্ম অন্য।
“একটি জীবের মধ্যে ব্রহ্মবিকাশ হলে হাজার হাজার লোক সেই আলোকে পথ পেয়ে অগ্রসর হয়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরাই একমাত্র লোকগুরু। একথা সর্বশাস্ত্র ও যুক্তি দ্বারা সমর্থিত হয়। অবৈদিক, অশাস্ত্রীয় কুলগুরুপ্রথা স্বার্থপর ব্রাহ্মণেরাই এদেশে প্রচলন করেছে। সেসব সাধন করেও লোক এখন সিদ্ধ বা ব্রহ্মজ্ঞ হতে পাচ্ছে না। ধর্মের এসকল গ্লানি দূর করতেই ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শরীর ধারণ করে বর্তমান যুগে জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর প্রদর্শিত সার্বভৌম মত জগতে প্রচারিত হলে জগতের এবং জীবের মঙ্গল হবে।”
স্বামীজীর পরিকল্পনা “মাদ্রাজ ও কলিকাতায় দুইটি কেন্দ্র করে সর্ববিধ লোক-কল্যাণের জন্য নতুন ধরনের সাধু-সন্ন্যাসী তৈরি করতে হবে।”
স্বামীজী মা-ভবতারিণীর কাছে ঐহিক কিছু প্রার্থনা করতে পারেননি। চেয়েছিলেন শুদ্ধাভক্তি, বিবেক বৈরাগ্য। ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে গোপাললাল শীলের বাগানে বসে শিষ্যকে বললেন : “তুই কি বলছিস? মানুষেই তো টাকা করে। টাকায় মানুষ করে, একথা কবে কোথায় শুনেছিস? তুই যদি মন মুখ এক করতে পারিস, কথায় ও কাজে এক হতে পারিস তো জলের মতো টাকা আপনা-আপনি তোর পায়ে এসে পড়বে।
মা কালীকে তিনি আবাহন করেছিলেন, রক্ষাকারিণী শ্যামা হিসেবে নয়।
“করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে,
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালি, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মাগো আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ-দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।”
ঠাকুর আর স্বামীজীতে এই তফাত। গৃহী, জ্ঞানী, ভোগী, ত্যাগী—সকলকে নিয়েই ছিল ঠাকুরের মহতী পরিবার। তাঁর দৃষ্টি সকলের উপরেই ছিল। তিনি ছিলেন—ভবরোগবৈদ্যম্। তিনি বলতেন : “মা রাঁধেন ছেলেদের পেট বুঝে। একই মাছ কাউকে দিচ্ছেন ভাজা, কোন ছেলেকে ঝোল, কোন ছেলেকে ঝাল।” ঠাকুর কোন প্রার্থীকে বললেন : “কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ। বৈরাগ্য। তিনটান এক কর। সংসারে থাক দাসীর মতো।” কাউকে বললেন : “না হয় স্বদারা সহবাস হলো। দিনান্তে না হয় একবারই তাঁর নাম নিলে। শিবের সংসার কর। আর সত্ত্ব গুণের সাধনা চালা। মা, তুমি আছ, আর আমি আছি। বিষয়ীর সঙ্গ বেশি করিসনি। আঁশটে গন্ধ সংসারী নাই বা হলি। অহঙ্কার বিসর্জন দে। তুহুঁ তুহুঁ-তেই হাম্বার মুক্তি। রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না।” ঠাকুরের সবকিছুর মধ্যে একটা Personal সম্পর্ক ছিল। তাঁর কথামতো তিনি ছিলেন ধর্মবৈদ্য। রোগীকে ওষুধ দিতেন না, খাইয়ে তার পাশে বসে থাকতেন, সেবা করতেন। শ্রীমকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন : “একটু বেশি বেশি এখানে আসবে। কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে কালি লাগবেই
স্বামীজী ছিলেন Wide, ব্যাপক। তাঁর সব পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল Mass. একজন নয়, বহুজন। বহুজনহিতায়। ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন : “তুই নিজের মোক্ষ চাইছিস? তুই স্বার্থপর হবি কেন? তুই হবি বিশাল বটবৃক্ষের মতো। তোর ছায়ায় এসে কত মানুষ বসবে।
শরচ্চন্দ্র সেই স্বামী বিবেকানন্দকে পেয়েছিলেন। প্রদীপ্ত মুখমণ্ডল। অসীম তেজ। শরচ্চন্দ্রকে একদিন বলছেন : “বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। সন্ন্যাস গ্রহণ করে যে এই ideal ভুলে যায়, ‘বৃথৈব তস্য জীবনম্’। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্রবিয়োগ-বিধূরার প্রাণে শান্তি দান করতে, অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবন-সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ-বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম- সিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।”
“‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আমাদের জন্ম; কি করছিস সব বসে বসে? ওঠ—জাগ, নিজে জেগে অপর সকলকে জাগ্রত কর, নরজন্ম সার্থক করে চলে যা। ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’।”
‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ একটি প্রজ্বলিত হোমকুণ্ড। বিবেকানন্দ অগ্নি, রামকৃষ্ণ দ্যুতি। প্রায় পাঁচটি বছরের একটি দিনলিপি। স্বামীজী বলতেন : “Practical Religion.” শিষ্যকে একদিন বলছেন—মঠ প্রতিষ্ঠার পুণ্য দিনে। বহু পরিকল্পনা তাঁর। একটা International Religious Centre হবে। শিষ্য বললেনঃ “মহাশয়, আপনার এ অদ্ভুত কল্পনা।” স্বামীজী বললেন : “কল্পনা কিরে? সময়ে সব হবে। আমি তো পত্তনমাত্র করে দিচ্ছি—এরপর আরো কত কি হবে! আমি কতক করে যাব। আর তোদের ভিতর নানা idea দিয়ে যাব। তোরা পরে সেসব workout করবি। বড় বড় Principle কেবল শুনলে কি হবে? সেগুলিকে practical field-এ দাঁড় করাতে-প্রতিনিয়ত কাজে লাগাতে হবে। শাস্ত্রের লম্বা লম্বা কথাগুলি কেবল পড়লে কি হবে? শাস্ত্রের কথাগুলি আগে বুঝতে হবে। তারপর জীবনে সেগুলিকে ফলাতে হবে। বুঝলি? একেই বলে Practical Religion.“
স্বামীজী তাঁর স্বল্প জীবনকালে ঝটিকার মতো বয়ে গেছেন। স্বদেশ-বিদেশ, বিদেশ-স্বদেশ, পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। শরচ্চন্দ্র অসীম নিষ্ঠায়, গুরু-কৃপায় সেই মহাজীবনকে চিরস্পন্দমান করে রেখে গেছেন। অক্লান্ত নদী, সাগর মোহনায় বিশাল হয়েছে, চলার ছন্দে কিছু ক্লান্তি এসেছে। যা চেয়েছেন তা হয়নি। শিষ্যের জীবনের হতাশা কাটাতে প্রয়াণের কয়েকদিন আগে বলছেন : “হবে বৈকি। আকীট-ব্রহ্ম সব কালে মুক্ত হয়ে যাবে—আর তুই হবিনি! ওসব weakness মনেও স্থান দিবিনি। শ্রদ্ধাবান হ, বীর্যবান হ, আত্মজ্ঞান লাভ কর, আর ‘পরহিতায়’ জীবনপাত কর—এই আমার ইচ্ছা ও আশীর্বাদ।”
শিষ্য শরচ্চন্দ্র জানতেন না গুরুর সঙ্গে এই হবে তাঁর শেষ কথা। স্বামীজী বলছেন : “আগামী রবিবার আসবি তো?”
শিষ্য বললেন : “নিশ্চয়।”
স্বামীজী : “তবে আয়; ঐ একখানি চলতি নৌকাও আসছে। রবিবারে আসিস।” শরচ্চন্দ্র নৌকা ধরার জন্যে ছুটছেন। স্বামী সারদানন্দ বলছেন : “ওরে কলার দুটো নিয়ে যা। নইলে স্বামীজীর বকুনি খেতে হবে।” শিষ্য বললেন : “আজ বড়ই তাড়াতাড়ি, আরেক দিন লইয়া যাইব—আপনি স্বামীজীকে এইকথা বলিবেন।”
‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ শেষ হচ্ছে এইভাবে—”চলতি নৌকার মাঝি ডাকাডাকি করিতেছে সুতরাং শিষ্য ঐ কথাগুলি বলিতে বলিতেই নৌকায় উঠিবার জন্য ছুটিল। শিষ্য নৌকায় উঠিয়াই দেখিতে পাইল, স্বামীজী উপরের বারান্দায় পায়চারি করিতেছেন। সে তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রণাম করিয়া নৌকার ভিতরে প্রবেশ করিল। নৌকা ভাটার টানে আধঘণ্টার মধ্যেই আহিরিটোলার ঘাটে পঁহুছিল।”
নদীর টান। আর সময়ের টানে আমরা ১৯০২ থেকে চলে এসেছি ২০০০ খ্রীস্টাব্দে। জীবনের দুই সঙ্গী—’কথামৃত’ আর ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’। ঐহিক কিছু সঙ্গে যাবে না। কি হলো আর কি হলো না, সে বিচারেও কাজ নেই। পরমপ্রাপ্তি হলো কৃপা। স্বামীজীর সেই কথা—
“তাঁর কৃপা যারা পেয়েছে, তাদের মন-বুদ্ধি কিছুতেই আর সংসারে আসক্ত হতে পারে না। কৃপার test কিন্তু হচ্ছে কাম-কাঞ্চনে অনাসক্তি। সেটা যদি কারো না হয়ে থাকে, তবে সে ঠাকুরের কৃপা কখনোই ঠিক ঠিক লাভ করেনি।”
‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই কানে বাজে মঠের প্রার্থনা সঙ্গীত—”খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।” যেখানেই থাকি হুহু গঙ্গার বাতাস এসে লাগে গায়ে। আমার নিজের অনুভূতি, ‘কথামৃত’ আর ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’–অনুপম, অনাবিল এক জ্যোতির্ময় জগতে প্রবেশের দুই বিশাল স্তম্ভ। ঢুকে যাও, ঢুকে যাও, সব ভুলে যাও। স্বামীজীর আদর্শে দাও নিজেকে নাড়া—সব weakness ঝরে যাক, আর ঠাকুরের আদর্শে বসে পড়– মনে, বনে, কোণে।