খট্টাঙ্গপুরাণ

খট্টাঙ্গপুরাণ

বহুদিন পরে আবার ভাইদুটিকে দেখা গেল। আবির্ভাবের মতই দেখতে পেলাম। গোলদিঘী কফি হাউসের কোণ ঘেঁসে বসে।

আমিও ওদের কোল ঘেঁসে পাশের টেবিলে গিয়ে বসেছি। আমাকে দেখে হর্ষবর্ধন—ঠিক হর্ষধ্বনি নয়, প্রায় অর্ধপরিচিতের মতই অভ্যর্থনা করল—এই যে!

বলেই আবার ভাইয়ের সঙ্গে মশগুল হয়ে গেল সে গরে।

অনেকদিন পরে দেখা। মনে হলো, হয়তো আমায় চিনতে পারেনি ঠিক। কিংবা হয়তো বা হাড়েহাড়ে চিনেই? নইলে শুধু এই ভাষণ—এই শুক সভাবণ—এত কম ভাষণ নিতান্তই হর্ষবর্ধন-বিরুদ্ধ, কিন্তু ও নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের কফির পেয়ালায় মন দিলাম। আর কান দিলাম ওদের কথায়….

বুঝলি গোবরা, এ রকমের আরেকটা কফি হাউস আছে কলকাতায় চৌরঙ্গীর কাছে। কিন্তু সাবধান, সেখানে যেন ভুলেও কখনো যাস না।

কেন, যাব না কেন? কানাড়াকরা তাই মাথা চাড়া দিয়েছে কী হয় গেলে?

গেছিস কি মরেছিস। এ কফি হাউস তো ভাল। এখানে খালি বাণী। বাঙালী ছেলে মেয়েরাই আসে। নিতান্ত নিরাপদ। কিন্তু সেখানে বাবা, যা মারাত্মক!

বলে মারাত্মক ভাবের চোখখানা তিনি ভাইয়ের ওপর রাখেন।

মারাত্মকটা কিসে শুনি?

মেমরা আসে সেখানে। হর্ষবর্ধন বিশদ হন–মেমরা দেখা দেয়।

দিলেই বা। মেম তো আর বাঘ নয় যে গিলে ফেলবে!

বাঘেরা বেশি না গিলেই হজম করতে পারে। তবে আর বলছি কী!…সেদিন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম রে! ধরেছিলো আমায়।

কী করেছিলে তুমি?

কিছু না। সবেমাত্র সেখানে ঢুকে একটা খালি জায়গা পেয়ে বসেছি। অতো বড় হটা গিসগিস করছে মানুষে। বাঙালী, পাঞ্জাবী, চীনেম্যান, সায়ে মেমে ভর্তি। হলের মাঝামাঝি একটা থাম ঘেঁষে দুটি মাত্র চেয়ার খালি একখানা ছোট্ট টেবিল বিরে। তারই একটিতে গিয়ে বসেছি আমি। একটু পরেই একটা মেম এসে আমার সামনে চেয়ারটায় কালো।

ও এই ধরা! সে তোমাকে ধরবার জন্যে নয় গো দাদা, বসবার আর জায়গা ছিল না বলেই- বলতে যায় গোবর্ধন। নিজের দাদাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে জ্ঞান করে না।

শোন্‌ না আগে। সবটা শোন্ তো, হর্ষবর্ধন বাধা দেন-মেমটা বসেই না আমাকে বললো—গুড় ইভিনিং মিষ্টার। আমি তার জবাব দিলাম—গুড নাইট মিসেস্‌।

তুমি গুড নাইট বলতে গেলে কেন? গুড নাইট তো বলে লোকে বিদায় নেবার সময়।

তখন কি আর ইভিনিং হিল নাকি? সন্ধ্যে উতরে গেছে কতক্ষণ! আটটা বাজে প্রায়। আমি শুধু মেমটার ভুল শুধরে দিয়েছি। কিন্তু বলতে কি, আমি অবাক হয়ে গেছি বেশ। মেমরাও ইংরাজিতে ভুল করে তাহলে? আশ্চর্য!

তারপর? তারপর?

তারপর মেমটা কী যেন বলল ইংরাজিতে, তার একটা কথও যদি আমি বুঝতে পেরেছি–!

নিশ্চয় খুব ভুল ইংরেজি?

ক্যা জানে! তারপরে কী করলো মেয়েটা। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বার করলো; আর ছোট্ট একটুকরো পেনসিল। কী যেন লিখলো কিছুক্ষণ ধরে, তারপর সেটা দেখালো আমায়।।

তুমি পড়তে পারলে?

পারবো না কেন, ইংরেজি তো নয়। পেয়ালা।

পেয়ালা? পেয়ালা আবার কোনদেশী ভাষা দাদা?

এই পেয়ালারে বোকা! হর্ষবর্ধন কফির পাত্রটা তুলে ধরেন—এই বাংলা কাপ ডিশ। এই না এঁকে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যাকে বলে সপ্রশ্ন নেত্রে।

তুমি কী করলে?

আমি বুঝলাম মেমটা এক পেয়ালা কফি খেতে চাইছে। আমিও আর দ্বিরুক্তি না করে বেয়ারাকে কফি আনতে বললাম—দুপাত্তর আমাদের দুজনের জন্য।

মেমটা দেখতে কেমন?

মেম-মেম। আবার কেমন! মেমরা যেমন হয়ে থাকে। তবে বয়েস বেশি নয়। পচিশ কি ছাব্বিশ। বাঙালীর মেয়ের মত অত সুন্দর না হলেও দেখতে বেশ ভালোই।

তাই বলে। গোবর্ধন সমঝদারের মত ঘাড় নাড়ে, প্রেম করবার মত মেম? তা বলতে হয়।

কী যে বলিস! তোর বৌদি যদি জানতে পারে। তারপর শোন। আমি ভাবলাম একটা মেয়েকে কি শুধু শুধু কফি খাওয়ানোটা ঠিক হবে? সেটা যেন কেমন দেখায়। তাই ওর খাতাটা নিয়ে একটা পাতায় টোসটের মতন কতকগুলে আঁকম। এঁকে দেখালাম ওকে! দেখে সে বল্‌লো—ইয়েস্ ইয়েস্। থ্যাংকু।

ইয়েস্ ইয়েস্‌ মানে? জানতে চায় গোবরা।

মানে তুই করেছিস এখন। হাঁ, দাদা জানায়—ইয়েস, মানে জানিসনে বোকা? তারি ডবোল, বুঝেছিস এখন? আর থ্যাংকু মানে—।

জানি জানি। আর বলতে হবে না। তাহলে মেমটা তোমার কথায় হাঁ হাঁ করে উঠলো বলো?

করবে না? তারপরে মেটা করলো কী, একজোড়া ডিম এঁকে দেখালো আমায়। বুঝলাম যে টোসটের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ খেতে চাইছে। তাও আনতে বললাম বেয়ারাকে।

বাঃ বেশ তো! বলে গোবরা সুরুৎ করে জিভের ঝোল টানে।

মেমের কথা শুনে যে তোর জিভ দিয়ে জল পড়ছে দেখছি।

মেম নয়! মেমলেটের কথা ভেবে দাদা। মেমটা মেমলেট খেতে চাইল না? মেমলেট বা মামলেট যাই বলো!

ওর ডিম পাড়ার পর তারপর আমি খাতাটা নিলাম। নিয়ে এক প্লেট কাজু বাদাম আঁকলাম। আর ও আঁকলো কতকগুলো চ্যাপটা চ্যাপটা কী যেন। মনে হলো পাঁপড় ভাজা। কিন্তু বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করায় সে বললো পাঁপড় ভাজা সেখানে মেলে না। আলুভাজা হতে পারে। সে আলুভাজা নিয়ে এলো। আর কাজু বাদামও। আলুভাজা খেয়ে মেয়েটাকে খুশি দেখে তখন বুঝলাম যে সে আলুভাজাই চেয়েছিল।

আলুভাজার আর পাঁপড় ভাজার কি এক রকম চেহারা নাকি? গোবরা নিখুঁত চিত্রসমালোচকের ন্যায় খুঁত খুঁত করে।

তা কি হয় রে? কিন্তু ছবি দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই। এই যে মশায়, আপনাকে বলছি-হর্ষবর্ধন সম্বোধন করেন আমাকে—আঁকার বিষয়ে আপনি কিছু বলুন তো, আঁকতে গেলে এমনটা কেন হয়? পাঁপড় ভাজার সঙ্গে আলুভাজা এমন মিলে যায় কেন?

আঁকের বেলায় যেমন এক এক সময় মিলে যায় না? তেমনি আর কি। তেমনি আঁকের মতই অনেক সময় মেলেও না আবাব। ভালো আঁকিয়ে হলে তবেই মেলাতে পারে। এমন ইঁদুর আঁকবে যে মনে হবে যেন হাতি। আবাব উটপাখিকে মনে হবে যেন একটা মুর্গি। এইখানেই আঁকার বাহাদুরি।

কী করে তা হয়ে থাকে? দুই ভাই একসঙ্গে শুধায।

দুজনের মুখে ডবোল ইয়েস দেখা দেয় তখন।

ব্লকেব কেরামতি মশাই আর কিছুই নয়। আঁকিয়ে তো একটুকরো কাগজে ছোট্ট একটুখানি আঁকে। যারা ব্লক বানায় তারাই হচ্ছে ওস্তাদ। তাই মাথা খাটিয়ে দরকার মাফিক সেটাকে বাড়িয়ে কমিয়ে যার যে ছবিটি চাই তার মনের মতন বানিয়ে দেয়। ধরুন, আপনি লিচু এঁকেছেন কিন্তু আপনার দরকার কাঁঠালের! ব্লকমেকার সেই লিচুকেই বড় কবে-বাড়িয়ে কাঁঠাল বানিয়ে ব্লকে আনতে পারে। একই আঁকুনি ছোট্ট করলেই লিচু আর বড়ো করলেই কাঁঠাল।

ছোট করলেই লিচু আর বড়ো করলেই কাঁঠাল? বারে!-গোবরা অবাক হয়।

তাহলে আমি যে কাজু বাদাম এঁকেছিলাম, ব্লকওয়ালা ইচ্ছে করলেই সেই ছবিব থেকেই কুমডোর ঝুড়ি করতে পারতো?

পারতোই তো।

যাকগে, আমাদের শিল্পতান্ত্রিক আলোচনায় গোবর্ধন বাধা দেয়।–-তারপর কী হলো বলো না দাদা।

তারপর অনেক কিছুই খেলুম আমরা—একটাও কথা না কয়ে—শুধু কেবল ছবি চালিয়ে। প্রায় টাকা পনেরোর মতো খাওয়া হলো। তারপর বেয়ারা বিল নিয়ে এলে আমি একটা একশো টাকার নোট দিযেছি আর সে ভাঙ্গানি আনতে গেছে এমন সময় দেখলাম কী–একমনে মেয়েটা কী যেন আঁকছে তখনো।

তোমার চেহারা বুঝি? গোববার মুখে বেড়া হাসি দেখা দেয়।

এই চেহারা আঁকা কোনো মেয়ের কম্মো নয়—ছোট্ট একটু খাতার পাতায়। তোর মত রোগা পাতলা হলেও হতে হতো। আঁকা শেষ করে ছবিখানি সে আমার হাতে দিলো। দিয়ে একটুখানি—যাকে বলে সলজ্জ হাসি-হাসলো।

ওর নিজের ছবি বুঝি?

না, দেখলাম একটা খাট এঁকেছে সে।

খাট! খাট কেন! খাট কি কোন খাবার জিনিস? শোবার তো জানি! গোবরা অবাক হয়,–ও, বুঝেছি, তোমাকে খাটাবার মতলব ছিল মেয়েটার।

আমি কি মশারি যে আমাকে খাটাবে। অতো সোজা নয়। হর্ষবর্ধন আপত্তি করেন। কিন্তু কেন যে সে খাট আঁকলো তাই আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম।

কিরকম খাট? দুগ্ধফেননিভ? আমি শুধাই।

বেশ বড়ো খাট। জোড়া খাট যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু সেজন্যে নয়, আমার তাক লাগলো এই ভেবে যে, আমি যে খাটের জন্মদাতা, কাঠের ব্যবসা যে আমাদের, তা সেই মেয়েটা টের পেল কী করে? এর রহস্য ভাই আমি এখনো অব্দি বুঝতে পারিনি। থ হয়ে রয়েছি সেই থেকে–রহস্যের থই না পেয়ে, বুঝলেন মশাই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *