খগম
পেট্রোম্যাক্সের আলোতে বসে ডিনার খাচ্ছি, সবেমাত্র ডালনার ডিমে একটা কামড় দিয়েছি, এমন সময় চৌকিদার লছমন জিজ্ঞেস করল, ‘আপলোগ ইমলিবাবাকো দর্শন নেহি করেঙ্গে?’
বলতে বাধ্য হলাম যে, ইমলিবাবার নামটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন, তাই দর্শন করার প্রশ্নটা ওঠেইনি। লছমন বলল, জঙ্গল বিভাগের যে জিপটা আমাদের জন্য মোতায়েন হয়েছে তার ড্রাইভারকে বললেই সে আমাদের বাবার ডেরায় নিয়ে যাবে। জঙ্গলের ভিতরেই তার কুটির, ভারী মনোরম পরিবেশ, সাধু হিসেবেও নাকি খুব উঁচু স্তরের; ভারতবর্ষের নানান জায়গা থেকে গণ্যমান্য লোকেরা এসে তাঁকে দেখে যান, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া আর যে ব্যাপারটা শুনে আরো কৌতূহল হল সেটা হল এই যে, বাবার নাকি একটা পোষা কেউটে আছে, সেটা বাবার কুটিরের কাছেই একটা গর্তে থাকে, আর রোজ সন্ধেবেলা গর্ত থেকে বেরিয়ে বাবার কাছে এসে ছাগলের দুধ খায়।
ধূর্জটিবাবু সব শুনেটুনে মন্তব্য করলেন যে, দেশটা বুজরুকিতে ছেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসীর সংখ্যা দিন দিন বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে। পশ্চিমে যতই বিজ্ঞানের প্রভাব বাড়ছে, আমাদের দেশটা নাকি ততই আবার নতুন করে কুসংস্কারের অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে।—‘হোপলেস ব্যাপার মশাই। ভাবলে মাথায় রক্ত উঠে যায়।’
কথাটা বলে ধূর্জটিবাবু হাত থেকে কাঁটা চামচ নামিয়ে রেখে পাশ থেকে ফ্লাই-ফ্ল্যাপ বা মক্ষিকা-মারণ দণ্ডটা তুলে নিয়ে টেবিলের উপর এক অব্যর্থ চাপড়ে একটা মশা মেরে ফেললেন। ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। বেঁটে রোগা ফরসা চোখাচোখা চেহারা, চোখ দুটো রীতিমতো কটা। আমার সঙ্গে আলাপ এই ভরতপুরে এসে। আমি এসেছি আগ্রা হয়ে, যাব জয়পুরে মেজদার কাছে দু’ হপ্তার ছুটি কাটাতে। এখানে এসে ডাকবাংলোয় বা টুরিস্ট লজে জায়গা না পেয়ে শেষটায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শহরের বাইরে এই ফরেস্ট রেস্ট হাউসে এসে উঠেছি। তাতে অবিশ্যি আক্ষেপের কিছু নেই, কারণ জঙ্গলে ঘেরা রেস্ট হাউসে থাকার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চকর আরাম আছে।
ধূর্জটিবাবু আমার একদিন আগে এসেছেন। কেন এসেছেন তা এখনও খুলে বলেননি, যদিও নিছক বেড়ানো ছাড়া আর কোনও কারণ থাকতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমরা দু’জনে একই জিপে ঘোরাফেরা করছি। কাল এখান থেকে ২২ মাইল পুবে দীগ বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম সেখানকার কেল্লা আর প্রাসাদ দেখতে। ভরতপুরের কেল্লাও আজ সকালে দেখা হয়ে গিয়েছে, আর বিকেলে গিয়েছিলাম কেওলাদেওয়ের ঝিলে পাখির আস্তানা দেখতে। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। সাত মাইলের উপর লম্বা ঝিল, তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ডাঙা মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, আর সেই ডাঙার প্রত্যেকটিতে রাজ্যের পাখি এসে জড়ো হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি আমি কোনওকালে চোখেই দেখিনি। আমি অবাক হয়ে পাখি দেখছি, আর ধূর্জটিবাবু ক্ষণে ক্ষণে গজগজ করে উঠছেন আর হাত দুটোকে অস্থিরভাবে এদিকে-ওদিকে নাড়িয়ে মুখের আশপাশ থেকে উন্কি সরাবার চেষ্টা করছেন। উন্কি হল একরকম ছোট্ট পোকা। ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মাথার চারপাশে ঘোরে আর নাকেমুখে বসে। তবে পোকাগুলো এতই ছোট্ট যে, তাদের অনায়াসে অগ্রাহ্য করে থাকা যায়; কিন্তু ধূর্জটিবাবু দেখলাম বারবার বিরক্ত হয়ে উঠছেন। এত অধৈর্য হলে কি চলে?
সাড়ে আটটার সময় খাওয়া শেষ করে সামনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চাঁদনি রাতে জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে ধূর্জটিবাবুকে বললাম, ‘ওই যে সাধুবাবার কথা বলছিল—যাবেন নাকি দেখতে?’
ধূর্জটিবাবু তাঁর হাতের সিগারেটটা একটা ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়ির দিকে তাগ করে ছুড়ে ফেলে বললেন, ‘কেউটে পোষ মানে না, মানতে পারে না। সাপ সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ছেলেবেলায় জলপাইগুড়িতে থাকতাম, নিজে হাতে অজস্র সাপ মেরেছি। কেউটে হচ্ছে বীভৎস শয়তান সাপ, পোষ মানানো অসম্ভব; কাজেই সাধুবাবার খবরটা কতটা সত্যি সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
আমি বললাম, ‘কাল তো বিকেলে এমনিতে কোনও প্রোগ্রাম নেই, সকালে বায়ানের কেল্লা দেখে আসার পর থেকেই তো ফ্রি।’
‘আপনার বুঝি সাধুসন্ন্যাসীদের উপর খুব ভক্তি?’ প্রশ্নটার পিছনে বেশ একটা খোঁচা রয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি জবাবটা দিলাম খুব সরলভাবেই।
‘ভক্তির কথা আর আসছে কী করে, কারণ সাধুসংসর্গের তো কোনও সুযোগই হয়নি এখন পর্যন্ত। তবে কৌতূহল যে আছে সেটা অস্বীকার করব না।’
‘আমারও ছিল এককালে, কিন্তু একটা অভিজ্ঞতার পর থেকে আর…’
অভিজ্ঞতাটা হল—ধূর্জটিবাবুর নাকি ব্লাড প্রেসারের ব্যারাম, বছর দশেক আগে তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের পাল্লায় পড়ে তিনি এক সাধুবাবার দেওয়া টোটকা ওষুধ খেয়ে নাকি সাতদিন ধরে অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন, আর তার ফলে তাঁর রক্তের চাপও নাকি গিয়েছিল বেড়ে। সেই থেকে ধূর্জটিবাবুর ধারণা হয়েছে ভারতবর্ষের শতকরা নব্বুই ভাগ সাধুই হচ্ছে আসলে ভণ্ড অসাধু।
ভদ্রলোকের বাবা-বিদ্বেষটা বেশ মজার লাগছিল, তাই তাঁকে খানিকটা উসকোনোর জন্যই বললাম, ‘কেউটের পোষ মানার কথা যে বলছেন, আমি আপনি পোষ মানাতে পারব না নিশ্চয়ই, কিন্তু হিমালয়ের কোনও কোনও সাধু তো শুনেছি একেবারে বাঘের গুহায় বাঘের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করে।’
‘শুনেছেন তো, দেখেছেন কি?’
স্বীকার করতেই হল যে, দেখিনি।
‘দেখবেন না। এ হল আষাঢ়ে গপ্পোর দেশ। শুনবেন অনেক কিছুই, কিন্তু চাক্ষুষ দেখতে চাইলে দেখতে পাবেন না। আমাদের রামায়ণ-মহাভারতই দেখুন না। বলছে ইতিহাস, কিন্তু আসলে আজগুবি গপ্পোর ডিপো! রাবণের দশটা মাথা, হনুমান ল্যাজে আগুন নিয়ে লঙ্কা পুড়োচ্ছে, ভীমের অ্যাপিটাইট, ঘটোৎকচ, হিড়িম্বা, পুষ্পক রথ, কুম্ভকর্ণ—এগুলোর চেয়ে বেশি ননসেন্স আর কী আছে? আর সাধু-সন্ন্যাসীদের ভণ্ডামির কথা যদি বলেন সে তো এইসব পুরাণ থেকেই শুরু হয়েছে। অথচ সারা দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকে অ্যাদ্দিন ধরে এইসব গিলে খাচ্ছে!’
বায়ানের কেল্লা দেখে রেস্ট হাউসে ফিরে লাঞ্চ ও বিশ্রাম সেরে ইমলিবাবার ডেরায় পৌঁছতে চারটে বেজে গেল। ধূর্জটিবাবু এ ব্যাপারে আর আপত্তি করেননি। হয়তো তাঁর নিজেরও বাবা সম্পর্কে একটু কৌতুহল হচ্ছিল। জঙ্গলের মধ্যে একটা দিব্যি পরিষ্কার খোলা জায়গায় একটা বিরাট তেঁতুলগাছের নীচে বাবার কুটির। গাছের থেকেই বাবার নামকরণ, আর সেটা করেছে স্থানীয় লোকেরা। বাবার আসল নাম কী তা কেউ জানে না।
খেজুরপাতার ঘরে একটিমাত্র চেলা সঙ্গে নিয়ে ভাল্লুকের ছালের উপর বসে আছেন বাবা। চেলাটির বয়স অল্প, বাবার বয়স কত তা বোঝার জো নেই। সূর্য ডুবতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি, কিন্তু তেঁতুলপাতার ঘন ছাউনির জন্য এ জায়গাটা এখনই বেশ অন্ধকার। কুটিরের সামনে ধুনি জ্বলছে, বাবার হাতে গাঁজার কলকে। ধুনির আলোতেই দেখলাম কুটিরের একপাশে একটা দড়ি টাঙানো, তাতে একটা গামছা আর একটা কৌপীন ছাড়া ঝোলানো রয়েছে গোটা দশেক সাপের খোলস।
আমাদের দেখে বাবা কল্কের ফাঁক দিয়ে একটু হাসলেন। ধূর্জটিবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘বৃথা সময় নষ্ট না করে আসল প্রসঙ্গে চলে যান। দুধ খাওয়ার সময়টা কখন জিজ্ঞেস করুন।’
‘আপ বালকিষণসে মিল্না চাহ্তে হেঁ?’
ইমলিবাবা আশ্চর্য উপায়ে আমাদের মনের কথা জেনে ফেলেছেন। কেউটের নাম যে বালকিষণ সেটা আমাদের জিপের ড্রাইভার দীনদয়াল কিছুক্ষণ আগেই আমাদের বলেছে। ইমলিবাবাকে বলতেই হল যে, আমরা তাঁর সাপের কথা শুনেছি, এবং পোষা সাপের দুধ খাওয়া দেখতে আমাদের ভারী আগ্রহ। সে সৌভাগ্য হবে কি?
ইমলিবাবা আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বললেন, বালকিষণ রোজই সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বাবার ডাক শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে কুটিরে এসে দুধ খেয়ে যায়, দু’দিন আগে পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু গতকাল থেকে তার শরীরটা নাকি তেমন ভাল নেই। আজ পূর্ণিমা, আজও সে আসবে না। আসবে আবার কাল থেকে।
সাপের শরীর খারাপ হয় এ খবরটা আমার কাছে নতুন। তবে পোষা তো—হবে নাই বা কেন! গোরু ঘোড়া কুকুর ইত্যাদির জন্য তো হাসপাতালই আছে।
বাবার চেলা আরো একটা খবর দিল। একে তো শরীর খারাপ, তার উপর কিছু কাঠ পিঁপড়ে নাকি তার গর্তে ঢুকে বালকিষণকে বেশ কাবু করে ফেলেছিল। সেইসব পিঁপড়ে নাকি বাবার অভিশাপে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। কথাটা শুনে ধূর্জটিবাবু আমার দিকে আড়চোখে চাইলেন। আমি কিন্তু ইমলিবাবার দিকেই দেখছিলাম। চেহারায় তেমন কোনও বিশেষত্ব নেই। পরনে সাধারণ একটা গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় জটা আছে, কিন্তু তাও তেমন জবড়জং কিছু নয়। দু’কানে দুটো লোহার মাকড়ি, গলায় গোটা চারেক ছোট-বড় মালা, ডান কনুইয়ের উপরে একটা তাবিজ। অন্য পাঁচটা সাধুবাবার সঙ্গে খুব একটা তফাত নেই। কিন্তু তাও সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় ধুনির পিছনে বসা লোকটার দিক থেকে কেন জানি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে চেলাটি দুটো চাটাই বার করে এনে বাবার হাত দশেক দূরে বিছিয়ে দিল। কিন্তু বাবার পোষা কেউটেকেই যখন দেখা যাবে না তখন আর বসে কী হবে? বেশি দেরি করলে আবার ফিরতে রাত হয়ে যাবে। গাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা, আর আশেপাশে জন্তু-জানোয়ারেরও অভাব নেই। হরিণের পাল তো রোজই দেখছি। তাই শেষ পর্যন্ত আর বসলাম না। বাবাকে নমস্কার করতে তিনি মুখ থেকে কলকে না সরিয়ে চোখ বুজে মাথা হেঁট করে প্রতিনমস্কার জানালেন। আমরা দু’জনে শ’খানেক গজ দূরে রাস্তার ধারে রাখা জিপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছু আগেও চারিদিকের গাছগুলো থেকে বাসায়-ফেরা পাখির কলরব শুনতে পাচ্ছিলাম, এখন সব নিস্তব্ধ।
কুটির থেকে বেরিয়ে কয়েক পা গিয়ে ধূর্জটিবাবু হঠাৎ থেমে বললেন, ‘সাপটা না হয় নাই দেখা গেল, তার গর্তটা অন্তত একবার দেখতে চাইলে হত না?’
আমি বললাম, ‘তার জন্য তো ইমলিবাবার কাছে যাবার কোনও দরকার নেই, আমাদের ড্রাইভার দীনদয়াল তো বলছিল ও গর্তটা দেখেছে।’
‘ঠিক কথা।’
গাড়ি থেকে দীনদয়ালকে নিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম। এবার কুটিরের দিকে না গিয়ে একটা বাদাম গাছের পাশ দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ ধরে খানিকদূর এগিয়ে যেতেই সামনে একটা কাঁটাঝোপ পড়ল। আশেপাশে পাথরের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে মনে হল এককালে এখানে হয়তো একটা দালান জাতীয় কিছু ছিল। দীনদয়াল বলল ওই ঝোপটার ঠিক পিছনেই নাকি সাপের গর্ত। এমনি দেখে কিছু বোঝার নেই, কারণ আলো আরো কমে এসেছে। ধূর্জটিবাবু তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট টর্চ বার করে ঝোপের ওপর আলো ফেলতেই পিছনে গর্তটা দেখা গেল। যাক, গর্তটা তা হলে সত্যিই আছে। কিন্তু সাপ? সে কি আর অসুস্থ অবস্থায় আমাদের কৌতূহল মেটানোর জন্য বাইরে বেরোবে? সত্যি বলতে কী, সাধুবাবার হাতে কেউটের দুধ খাওয়া দেখার বাসনা থাকলেও সেই কেউটের গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দর্শন করার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ধূর্জটিবাবুর কৌতূহল দেখলাম আমার চেয়েও বেশি। আলোয় যখন কাজ হল না তখন ভদ্রলোক মাটি থেকে ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো ঝোপের ওপর ফেলতে আরম্ভ করলেন।
এই বাড়াবাড়িটা আমার ভাল লাগল না। বললাম, ‘কী হল মশাই? আপনার দেখি রোখ চেপে গেছে। আপনি তো বিশ্বাসই করছিলেন না যে সাপ আছে।’
ভদ্রলোক এবার একটা বেশ বড় ঢেলা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘এখনও করছি না। এই ঢেলাতেও যদি ফল না হয় তা হলে বুঝব বাবাজি সম্বন্ধে এক স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প প্রচার করা হয়েছে। লোকের ভুল বিশ্বাস যত ভাঙানো যায় ততই মঙ্গল।
ঢেলাটা একটা ভারী শব্দ করে ঝোপের উপর পড়ে কাঁটাসমেত পাতাগুলোকে তছনছ করে দিল। ধূর্জটিবাবু টর্চটা ধরে আছেন গর্তের উপর। কয়েক মুহূর্ত সব চুপ—কেবল বনের মধ্যে কোথায় যেন একটা ঝিঁঝি সবেমাত্র ডাকতে আরম্ভ করেছে। এবার তার সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ হল। একটা শুকনো সুরহীন শিসের মতো শব্দ। তারপর পাতার খস্খসানি, আর তারপর টর্চের আলোয় দেখা গেল একটা কালো মসৃণ জিনিসের খানিকটা। সেটা নড়ছে, সেটা জ্যান্ত, আর ক্রমেই সেটা গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসছে।
এবার ঝোপের পাতা নড়ে উঠল, আর তার পরমুহূর্তেই তার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটা সাপের মাথা। টর্চের আলোয় দেখলাম কেউটের জ্বলজ্বলে চোখ, আর তার দু’ভাগে চেরা জিভ, যেটা বারবার মুখ থেকে বেরিয়ে এসে লিক্লিক্ করে আবার সুড়ুত করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। দীনদয়াল কিছুক্ষণ থেকেই জিপে ফিরে যাবার জন্য তাগাদা করছিল, এবার ধরা গলায় অনুনয়ের সুরে বলল, ‘ছোড় দিজিয়ে বাবু!—আব্ তো দেখ লিয়া, আব্ ওয়াপস চলিয়ে।’
টর্চের আলোর জন্যই বোধহয় বালকিষণ এখনও মাথাটা বার করে আমাদের দিকে চেয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে জিভ বার করছে। আমি সাপ দেখেছি অনেক, কিন্তু এত কাছ থেকে এভাবে কালকেউটে কখনও দেখিনি। আর কেউটে আক্রমণের চেষ্টা না করে চুপচাপ চেয়ে রয়েছে, এরকমও তো কখনও দেখিনি। হঠাৎ টর্চের আলোটা কেঁপে উঠে সাপের উপর থেকে সরে গেল। তারপর যে কাণ্ডটা ঘটল সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ধূর্জটিবাবু হঠাৎ একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে চোখের নিমেষে সেটা বালকিষণের মাথার দিকে তাগ করে ছুড়ে মারলেন। আর তারপরেই পর পর আরো দুটো। একটা বিশ্রী আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘আপনি এটা কী করলেন ধূর্জটিবাবু!’
ভদ্রলোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চাপা গলায় বেশ উল্লাসের সঙ্গেই বললেন, ‘ওয়ান কেউটে লেস!’
দীনদয়াল হাঁ করে বিস্ফারিত চোখে ঝোপটার দিকে চেয়ে আছে। ধূর্জটিবাবুর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে আমিই এবার গর্তের উপর আলো ফেললাম। বালকিষণের অসাড় দেহের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ঝোপের পাতায় লেগে রয়েছে সাপের মাথা থেকে ছিটকিয়ে বেরোনো খানিকটা রক্ত।
এর মধ্যে কখন যে ইমলিবাবা আর তার চেলা এসে আমাদের পিছনে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেই পারিনি। ধূর্জটিবাবুই প্রথম পিছন ফিরলেন। তারপর আমিও ঘুরে দেখি বাবা হাতে একটি যষ্টি নিয়ে আমাদের থেকে হাত দশেক দূরে একটা বেঁটে খেজুর গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ধূর্জটিবাবুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। বাবা যে এত লম্বা সেটা বসা অবস্থায় বুঝতে পারিনি। আর তাঁর চোখের চাহনির বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, বিস্ময়, ক্রোধ আর বিদ্বেষ মেশানো এমন চাহনি আমি কারও চোখে দেখিনি।
বাবার ডান হাতটা এবার সামনের দিকে উঠে এল। এখন সেটা নির্দেশ করছে ধূর্জটিবাবুর দিকে। হাতের তর্জনীটা এবার সামনের দিকে বেরিয়ে এসে নির্দেশটা আরো স্পষ্ট হল। এই প্রথম দেখলাম বাবার আঙুলের এক-একটা নখ প্রায় দু ইঞ্চি লম্বা। কার কথা মনে পড়ছে বাবাকে দেখে? ছেলেবেলায় দেখা বিডন স্ট্রিটে আমার মামাবাড়ির দেয়ালে টাঙানো রবি বর্মার আঁকা একটা ছবি। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিচ্ছেন শকুন্তলাকে। ঠিক এইভাবে হাত তোলা, চোখে ঠিক এই চাহনি।
কিন্তু অভিশাপের কথা কিছু বললেন না ইমলিবাবা। তাঁর গম্ভীর চাপা গলায় হিন্দিতে তিনি যা বললেন তার মানে হল—একটা বালকিষণ গেছে তাতে কী হল? আরেকটা আসবে। বালকিষণের মৃত্যু নেই। বালকিষণ অমর।
ধূর্জটিবাবু তাঁর ধুলোমাখা হাত রুমালে মুছে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘চলুন।’ বাবার চেলা এসে গর্তের মুখ থেকে কেউটের মৃতদেহটা বার করে নিল—বোধহয় তার সৎকারের ব্যবস্থার জন্য। সাপের দৈর্ঘ্য দেখে আমার মুখ থেকে আপনা থেকেই একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। কেউটে যে এত লম্বা হতে পারে তা আমার ধারণাই ছিল না। ইমলিবাবা ধীরে ধীরে তাঁর কুটিরের দিকে চলে গেলেন। আমরা তিনজন গিয়ে জিপে উঠলাম।
রেস্ট হাউসে ফেরার পথে ধূর্জটিবাবুকে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখে তাঁকে একটা কথা না বলে পারলাম না। বললাম, ‘সাপটা যখন লোকটার পোষা, আর আপনার কোনও অনিষ্টও করছিল না, তখন ওটাকে মারতে গেলেন কেন?’
ভেবেছিলাম ভদ্রলোক বুঝি সাপ আর সাধুদের আরো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে নিজের কুকীর্তি সমর্থন করার চেষ্টা করবেন, কিন্তু তিনি সেসব কিছুই না করে উলটে আমাকে একটা সম্পূর্ণ অবান্তর প্রশ্ন করে বসলেন—
‘খগম কে বলুন তো মশাই, খগম?’
খগম? নামটা আবছা আবছা চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু কোথায় শুনেছি বা পড়েছি মনে পড়ল না। ধূর্জটিবাবু আরো বার দু’-এক আপনমনে খগম খগম করে শেষটায় চুপ করে গেলেন। রেস্ট হাউসে যখন পৌঁছলাম তখন সাড়ে ছ’টা বাজে। ইমলিবাবার চেহারাটা মাঝে মাঝে মনে পড়ছে—দুর্বাসার মতো চোখ পাকিয়ে হাত তুলে রয়েছেন ধূর্জটিবাবুর দিকে। ভদ্রলোকের কেন যে এমন মতিভ্রম হল কে জানে! তবে মন বলছে, ঘটনার শেষ দেখে এসেছি আমরা, কাজেই ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। বাবা নিজেই বলেছেন বালকিষণের মৃত্যু নেই। ভরতপুরের জঙ্গলে কি আর কেউটে নেই? কালকের মধ্যে নিশ্চয়ই বাবার চেলা-চামুণ্ডারা আরেকটা কেউটে ধরে এনে বাবাকে উপহার দেবে।
ডিনারে লছমন মুরগির কারি রেঁধেছিল, আর তার সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা হাতের রুটি আর উরুৎকা ডাল। সারাদিনের ঘোরাফেরার পর খিদেটা দিব্যি হয়। কলকাতায় রাত্রে যা খাই তার ডবল খেয়ে ফেলি অক্লেশে। ধূর্জটিবাবু ছোটখাট মানুষ হলে কী হবে—তিনিও বেশ ভালই খেতে পারেন। কিন্তু আজ যেন মনে হল ভদ্রলোকের খিদে নেই। শরীর খারাপ লাগছে কি না জিজ্ঞেস করাতে কিছু বললেন না। আমি বললাম, ‘আপনি কি বালকিষণের কথা ভেবে আক্ষেপ করছেন?’
ধূর্জটিবাবু আমার কথায় মুখ খুললেন বটে, কিন্তু যা বললেন সেটাকে আমার প্রশ্নের উত্তর বলা চলে না। পেট্রোম্যাক্সের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে গলাটাকে ভীষণ সরু আর মোলায়েম করে বললেন, ‘সাপটা ফিস্ফিস্ করছিল…ফিস্ফিস্…করছিল…’
আমি হেসে বললাম, ‘ফিস্ফিস্, না ফোঁস ফোঁস?’
ধূর্জটিবাবু আলোর দিক থেকে চোখ না সরিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, না, ফিস্ফিস্।… সাপের ভাষা সাপের শিস, ফিস্ফিস্ ফিস্ফিস্…’
কথাটা বলে ভদ্রলোক নিজেই জিভের ফাঁক দিয়ে সাপের শিসের মতো শব্দ করলেন কয়েকবার। তারপর আবার ছড়া কাটার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘সাপের ভাষা সাপের শিস, ফিস্ ফিস্ ফিস্ ফিস্! বালকিষণের বিষম বিষ, ফিস্ ফিস্ ফিস্ ফিস্!…এটা কী? ছাগলের দুধ?’
শেষ কথাটা অবিশ্যি ছড়ার অংশ নয়। সেটা হল সামনে প্লেটে রাখা পুডিংকে উদ্দেশ্য করে।
লছমন শুধু দুধটা বুঝে ছাগল-টাগল না বুঝে বলল, ‘হাঁ বাবু, দুধ হ্যায় আউর অ্যান্ডে ভি হ্যায়।’
দুধ আর ডিম দিয়ে যে পুডিং হয় সে কে না জানে?
ধূর্জটিবাবু লোকটা স্বভাবতই একটু খামখেয়ালি ও ছিটগ্রস্ত, কিন্তু ওঁর আজকের হাবভাবটা একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছিল। তিনি নিজেই হয়তো সেটা বুঝতে পেরে যেন জোর করেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বড় বেশি রোদে ঘোরা হয়েছে ক’দিন, তাই বোধহয় মাথাটা…কাল থেকে একটু সাবধান হতে হবে।
আজ শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, তাই খাবার পরে আর বাইরে না বসে ঘরে গিয়ে আমার সুটকেসটা গোছাতে লাগলাম। কাল সন্ধ্যার ট্রেনে ভরতপুর ছাড়ব। মাঝরাত্তিরে সওয়াই মাধোপুরে চেঞ্জ, ভোর পাঁচটায় জয়পুর পৌঁছনো।
অন্তত এটাই ছিল আমার প্ল্যান। কিন্তু সে প্ল্যান ভেস্তে গেল। মেজদাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিতে হল যে, অনিবার্য কারণে যাওয়া একদিন পিছিয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হল সেটাই এখন বলতে চলেছি। ঘটনাগুলো যথাসম্ভব স্পষ্ট ও অবিকলভাবে বলতে চেষ্টা করব। এ ঘটনা যে সকলে বিশ্বাস করবে না সেটা জানি। প্রমাণ যাতে হতে পারত, সে জিনিসটা ইমলিবাবার কুটিরের পঞ্চাশ হাত উত্তরে হয়তো এখনও মাটিতে পড়ে আছে। সেটার কথা ভাবলেও আমার গা শিউরে ওঠে, কাজেই সেটা প্রমাণ হিসেবে হাতে করে তুলে নিয়ে আসতে পারিনি তাতে আর আশ্চর্য কী? যাক গে—এখন ঘটনায় আসা যাক।
সুটকেস গুছিয়ে, লণ্ঠনটাকে কমিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আড়ালে রেখে, রাতের পোশাক পরে বিছানায় উঠতে যাব, এমন সময় পুবদিকের দরজায় টোকা পড়ল। এই দরজার পিছনেই ধূর্জটিবাবুর ঘর।
দরজা খুলতেই ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন, ‘আপনার কাছে ফ্লিট জাতীয় কিছু আছে? কিংবা মশা তাড়ানোর অন্য কোনও ওষুধ?’
আমি বললাম, ‘মশা এল কোত্থেকে? আপনার ঘরের দরজা-জানলায় জাল দেওয়া নেই?’
‘তা আছে।’
‘তবে?’
‘তাও কী যেন কামড়াচ্ছে।’
‘সেটা টের পাচ্ছেন আপনি?’
‘হাতে মুখে দাগ হয়ে যাচ্ছে।’
দরজার মুখটায় অন্ধকার, তাই ভদ্রলোকের চেহারাটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। বললাম, ‘আসুন ভিতরে। দেখি কী দাগ হল।’
ধূর্জটিবাবু ঘরের ভিতরে এলেন। লণ্ঠনটা সামনে তুলে ধরতেই দাগগুলো দেখতে পেলাম। রুহিতন মার্কা কালসিটের মতো দাগ। এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি, আর দেখে মোটেই ভাল লাগল না। বললাম, ‘বিদ্ঘুটে ব্যারাম বাধিয়েছেন। অ্যালার্জি থেকে হতে পারে। কাল সকালে উঠেই ডাক্তারের খোঁজ করতে হবে। আপনি বরং ঘুমোতে চেষ্টা করুন। ও নিয়ে আর চিন্তা করবেন না। আর এটা পোকার ব্যাপার নয়, অন্য কিছু। যন্ত্রণা হচ্ছে কী?’
‘উঁহু।’
‘তাও ভাল। যান, শুয়ে পড়ুন।’
ভদ্রলোক চলে গেলেন, আর আমিও বিছানায় উঠে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম, রাত্রে ঘুমোবার আগে বিছানায় শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস, এখানে লণ্ঠনের আলোয় সেটা আর পড়া সম্ভব হচ্ছে না। আর সত্যি বলতে কী, সেটার প্রয়োজনও নেই। সারাদিনের ক্লান্তির পর বালিশে মাথা দেবার দশ মিনিটের মধ্যে ঘুম এসে যায়।
কিন্তু আজ আর সেটা হল না। একটা গাড়ির শব্দে তন্দ্রা ভেঙে গেল। সাহেবের গলা শুনতে পাচ্ছি, আর একটা অচেনা কুকুরের ডাক। টুরিস্ট এসেছে রেস্ট হাউসে। কুকুরটা ধমক খেয়ে চেঁচানো থামাল। সাহেবরাও বোধহয় ঘরে ঢুকে পড়েছে। আবার সব নিস্তব্ধ। কেবল বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে! না, শুধু ঝিঁঝি নয়। তা ছাড়াও আরেকটা শব্দ পাচ্ছি। আমার পুবদিকের প্রতিবেশী এখনও সজাগ। শুধু সজাগ নয়, সচল। তার পায়ের শব্দ পাচ্ছি। অথচ দরজার তলার ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই দেখেছি লণ্ঠনটা হয় নিভিয়ে দেওয়া হল না হয় পাশের বাথরুমে রেখে আসা হল। অন্ধকার ঘরে ভদ্রলোক পায়চারি করছেন কেন?
এই প্রথম আমার সন্দেহ হল যে, ভদ্রলোকের মাথায় হয়তো ছিটেরও একটু বেশি কিছু আছে। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ মাত্র দু’দিনের। তিনি নিজে যা বলেছেন তার বাইরে তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত, যাকে পাগলামো বলে, তার কিন্তু কোনও লক্ষণ আমি ধূর্জটিবাবুর মধ্যে দেখিনি। দীগ আর বায়ানের কেল্লা দেখতে দেখতে তিনি যে ধরনের কথাবার্তা বলছিলেন তাতে মনে হয় ইতিহাসটা তাঁর বেশ ভালভাবেই পড়া আছে। শুধু তাই নয়, আর্ট সম্বন্ধেও যে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে সেটার প্রমাণও তিনি তাঁর কথাবার্তায় দিয়েছেন। রাজস্থানের স্থাপত্যে হিন্দু ও মুসলমান কারিগরদের কাজের কথা তিনি রীতিমত উৎসাহের সঙ্গে বলছিলেন। নাঃ—ভদ্রলোকের শরীরটাই বোধহয় খারাপ হয়েছে। কাল একজন ডাক্তারের খোঁজ করা অবশ্যকর্তব্য।
আমার ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে তখন বলছে পৌনে এগারোটা। পুবের দরজায় আবার টোকা পড়ল। এবার বিছানা থেকে না উঠে একটা হাঁক দিলাম।—
‘কী ব্যাপার ধূর্জটিবাবু?’
‘শ্-শ্-শ্-শ্…’
‘কী বলছেন?’
‘শ্-শ্-শ্-শ্…’
বুঝলাম ভদ্রলোকের কথা আটকে গেছে। এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি! আবার বললাম, ‘কী বলছেন ঠিক করে বলুন।’
‘শ্-শ্-শ্—শুনবেন একটু?’
অগত্যা উঠলাম। দরজা খুলতে ভদ্রলোক এমন একটা ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করলেন যে, আমার বেশ বিরক্তই লাগল।
‘আচ্ছা স-স্-স্-সাপ কি দন্ত্য স?’
আমি আমার বিরক্তি লুকোবার কোনও চেষ্টা করলাম না।
‘আপনি এইটে জানবার জন্য এত রাত্রে দরজা ধাক্কালেন?’
‘দন্ত্য স?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সাপ মানে যখন সর্প, স্নেক, তখন দন্ত্য স।’
‘আর তালব্য শ?’
‘সেটা অন্য শাপ। তার মানে—’
‘—অভিশাপ।’
‘হ্যাঁ, অভিশাপ।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। শ্শ্শ্-শুয়ে পড়ুন।’
ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে আমার একটু একটু মায়া হচ্ছিল। বললাম, ‘আপনাকে বরং একটু ঘুমের ওষুধ দিই। ও জিনিসটা আছে আমার কাছে। খাবেন?’
‘না। শ্শ্শ্-শীতকালে এমনিতেই ঘুমোই। শ্-শ্-শুধু স্-স্ সন্ধ্যায় স্-স্-সূর্যাস্তের স্-স্ সময়—’
ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললাম, ‘আপনার জিভে কিছু হয়েছে নাকি? কথা আটকে যাচ্ছে কেন? আপনার টর্চটা একবার দিন তো।’
ভদ্রলোকের পিছন পিছন আমিও ওঁর ঘরে ঢুকলাম। টর্চটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ছিল। সেটা জ্বেলে ভদ্রলোকের মুখের সামনে ধরতেই তিনি হাঁ করে জিভটা বার করে দিলেন। জিভে কিছু যে একটা হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটু সরু লাল দাগ ডগা থেকে শুরু করে জিভের মাঝখান পর্যন্ত চলে গেছে।
‘এটাতেও কোনও যন্ত্রণা নেই বলছেন?’
‘কই, না তো।’
কী যে ব্যারাম বাধিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক সেটা আমার বোঝার সাধ্য নেই।
এবারে ভদ্রলোকের খাটের দিকে চোখ গেল। বিছানার পরিপাটি ভাব দেখে বুঝলাম তিনি এখনও পর্যন্ত খাটে ওঠেননি। বেশ কড়া সুরে বললাম, ‘আপনাকে শুতে দেখে তারপর আমি নিজের ঘরে যাব। আর জোড়হাত করে অনুরোধ করছি আর দরজা ধাক্কাবেন না। কাল ট্রেনে ঘুম হবে না জানি, তাই আজকের রাতটা ঘুমিয়ে নিতে চাই।’
ভদ্রলোক কিন্তু খাটের দিকে যাবার কোনওরকম আগ্রহ দেখালেন না। লণ্ঠনটা বাথরুমে রাখা হয়েছে, তাই ঘরে প্রায় আলো নেই বললেই চলে। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ; উত্তরের জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে, তারই প্রতিফলিত আলোয় ধূর্জটিবাবুকে দেখতে পাচ্ছি। স্লিপিং সুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর মাঝে মাঝে ঠোঁট ফাঁক করে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করছেন। আমি আসবার সময় কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে এসেছি, অথচ ধূর্জটিবাবু দিব্যি গরমটরম কিচ্ছু না পরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক শেষটায় যদি সত্যিই একটা গোলমেলে ব্যারাম বাধিয়ে বসেন তা হলে তো তাঁকে ফেলে আমার পক্ষে যাওয়াও মুশকিল হবে। বিদেশে বিভূঁইয়ে একজন বাঙালি বিপদে পড়লে আরেকজন তার জন্য কিছু না করে সরে পড়বে, এ তো হতে পারে না।
আরেকবার তাঁকে বিছানায় শুতে বলেও যখন কোনও ফল হল না তখন বুঝলাম ওঁর হাতটা ধরে টেনে নিয়ে জোর করে শুইয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। তিনি যদি অবাধ্য শিশু হতে চান, আমাকে তাঁর গুরুজনের ভূমিকা নিতেই হবে।
কিন্তু তাঁর হাতটা ধরামাত্র আমার শরীরে এমন একটা প্রতিক্রিয়া হল যে, আমি চমকে তিন হাত পিছিয়ে গেলাম।
ধূর্জটিবাবুর শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। জ্যান্ত মানুষের শরীর এত ঠাণ্ডা হতে পারে এ আমি কল্পনাই করতে পারিনি।
আমার অবস্থা দেখেই বোধহয় ধূর্জটিবাবুর ঠোঁটের কোণে একটা হাসির ভাব ফুটে উঠল। তাঁর কটা চোখ দিয়ে তিনি এখন আমার দিকে চেয়ে মিচকি মিচকি হাসছেন। আমি ধরা গলায় বললাম, ‘আপনার কী হয়েছে বলুন তো।’
ধূর্জটিবাবু আমার দিক থেকে চোখ সরালেন না। একদৃষ্টে চেয়ে আছেন প্রায় মিনিট খানেক ধরে। অবাক হয়ে দেখলাম যে, একটিবারও তাঁর চোখের পাতা পড়ল না। এরই মধ্যে তাঁর জিভটা বার কয়েক ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরোল। তারপর তিনি ফিস্ফিস্ গলায় বললেন, ‘বাবা ডাকছেন—বালকিষণ! বালকিষণ!…বাবা ডাকছেন…’
তারপর ভদ্রলোকের হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল। তিনি প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তারপর শরীরটাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে কনুইয়ের উপর ভর করে নিজেকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে খাটের তলায় অন্ধকারে চলে গেলেন।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে, হাত পা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ভদ্রলোক সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে এখন যেটা অনুভব করছি সেটা অবিশ্বাস আর আতঙ্কে মেশানো একটা অদ্ভুত ভয়াবহ ভাব।
নিজের ঘরে ফিরে এলাম।
দরজাটা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর কাঁপুনিটা কমল, চিন্তাটা একটু পরিষ্কার হল। ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং চোখের সামনে যা ঘটতে দেখেছি তা থেকে কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় সেটা একবার ভেবে দেখলাম। আজ বিকেলে আমার সামনে ধূর্জটিবাবু ইমলিবাবার পোষা কেউটেকে পাথরের ঘায়ে মেরে ফেললেন। তারপরেই ইমলিবাবা ধূর্জটিবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন—একটা বালকিষণ গেছে, তার জায়গায় আরেকটা বালকিষণ আসবে। সেই দ্বিতীয় বালকিষণ কি সাপ, না মানুষ?
না কি সাপ-হয়ে-যাওয়া মানুষ?
ধূর্জটিবাবুর সর্বাঙ্গে চাকা চাকা দাগগুলো কী?
জিভের দাগটা কী?
সেটা কি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবার আগের অবস্থা?
তাঁর শরীর এত ঠাণ্ডা কেন?
তিনি খাটে না শুয়ে খাটের তলায় ঢুকলেন কেন?
হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকের মতো একটা জিনিস মনে পড়ে গেল। খগম! ধূর্জটিবাবু জিজ্ঞেস করছিলেন খগমের কথা। নামটা চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু বুঝতে পারিনি। এখন মনে পড়ে গেছে। ছেলেবেলায় পড়া মহাভারতের একটা গল্প। খগম নামে এক তপস্বী ছিলেন। তাঁর শাপে তাঁর বন্ধু সহস্রপাদ মুনি ঢোঁড়া সাপ হয়ে যান। খগম— সাপ—শাপ…সব মিলে যাচ্ছে। তবে তিনি হয়ে ছিলেন ঢোঁড়া, আর ইনি কী—?
আমার দরজায় আবার কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। উপরদিকে নয়, তলার দিকে। চৌকাঠের ঠিক উপরে। একবার, দু’বার, তিনবার। আমি বিছানা থেকে নড়লাম না। দরজা আমি খুলব না। আর না!
আওয়াজ বন্ধ হল, আমি দমবন্ধ করে কান পেতে আছি। এবার কানে এল শিসের শব্দ। দরজার কাছ থেকে ক্রমে সেটা দূরে সরে গেল। এবার আমার নিজের হৃৎস্পন্দন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
ওটা কী? একটা চিঁ চিঁ শব্দ। একটা তীক্ষ্ণ মিহি আর্তনাদ। ইঁদুর নাকি? এখানে ইঁদুর আছে। প্রথম রাত্রেই দেখেছি আমার ঘরে। পরদিন লছমনকে বলাতে সে রান্নাঘর থেকে একটা ইঁদুর-ধরা কলে জ্যান্ত ইঁদুর দেখিয়ে নিয়ে গেল। বলল ‘চুহা’ তো আছেই, ‘ছুছুন্দর’ও আছে।
আর্তনাদ ক্রমে মিলিয়ে এসে আবার নিস্তব্ধতা। দশ মিনিট গেল। ঘড়ি দেখলাম। পৌনে একটা। ঘুম যে কোথায় উধাও হয়েছে জানি না। জানলা দিয়ে বাইরের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। চাঁদ বোধহয় ঠিক মাথার উপরে।
একটা দরজা খোলার শব্দ। পাশের ঘরে ধূর্জটিবাবু বারান্দায় যাবার দরজাটা খুলেছেন। আমার ঘরের যেদিকে জানলা বারান্দায় যাবার দরজাও সেইদিকে। ধূর্জটিবাবুর ঘরেও তাই। বারান্দা থেকে নেমে বিশ হাত গেলেই গাছপালা শুরু হয়।
ধূর্জটিবাবু বারান্দায় বেরিয়েছেন। কোথায় যাচ্ছেন তিনি? কী মতলব তাঁর? আমি একদৃষ্টে জানলার দিকে চেয়ে রইলাম।
শিসের শব্দ পাচ্ছি। সেটা ক্রমশ বাড়ছে। এবার সেটা ঠিক আমার জানলার বাইরে। জানলাটা ভাগ্যিস জালে ঢাকা, নইলে…
একটা কী যেন জিনিস জানলার তলার দিক থেকে ওপরে উঠছে। খানিকটা উঠে থেমে গেল। একটা মাথা। লণ্ঠনের আবছা আলোয় দুটো জ্বলজ্বলে কটা চোখ। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চোখ দুটো আমার দিকে চেয়ে আছে।
প্রায় মিনিটখানেক এইভাবে থাকার পর একটা কুকুরের ডাক শোনামাত্র মাথাটা বাঁ দিকে ঘুরে পরক্ষণেই আবার নীচের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কুকুরটা ডাকছে। পরিত্রাহি চিৎকার। এবার একটা ঘুম-জড়ানো সাহেবি গলায় ধমকের আওয়াজ পেলাম। একটা কাতর গোঙানির সঙ্গে কুকুরের ডাকটা থেমে গেল। তারপর আর কোনও শব্দ নেই। আমি মিনিট দশেক ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রেখে শুয়ে রইলাম। কানের মধ্যে আজই রাত্রে শোনা একটা ছড়া বারবার ফিরে ফিরে আসছে—
সাপের ভাষা সাপের শিস
ফিস্ ফিস্ ফিস্ ফিস!
বালকিষণের বিষম বিষ
ফিস্ ফিস্ ফিস্ ফিস্!
ক্রমে সেই ছড়াটাও মিলিয়ে এল। বুঝতে পারলাম একটা ঝিমঝিমে অবসন্ন ভাব আমাকে ঘুমের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ঘুমটা ভাঙল সাহেবদের চেঁচামেচিতে। ঘড়িতে দেখি ছ’টা বাজতে দশ। কিছু একটা গণ্ডগোল বেধেছে। তাড়াতাড়ি উঠে গায়ে একটা গরম কাপড় চাপিয়ে বাইরে এসে শ্বেতাঙ্গ আগন্তুকদের সাক্ষাৎ পেলাম। দুই যুবক, আমেরিকান—ডাকনাম ব্রুস আর মাইকেল— তাদের পোষা কুকুরটা কাল রাত্রে মারা গেছে। কুকুরটাকে নিজেদের ঘরেই নিয়ে শুয়েছিল, তবে ঘরের দরজা বন্ধ করেনি। ওরা সন্দেহ করছে রাত্রে বিছে বা সাপ জাতীয় বিষাক্ত কিছু এসে কামড়ানোর ফলে এই দশা। মাইকেলের ধারণা কাঁকড়াবিছে, কারণ শীতকালে সাপ বেরোয় না সেটা সকলেই জানে।
আমি আর কুকুরের উপর সময় নষ্ট না করে বারান্দার উলটোদিকে ধূর্জটিবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। দরজা খোলা রয়েছে, ঘরের মালিক ঘরে নেই। লছমন রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল গরম করে। তাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল ধূর্জটিবাবুকে দেখেনি।
নানারকম আশঙ্কা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যে করে হোক ভদ্রলোককে খুঁজে বার করতেই হবে। পায়ে হেঁটে আর কতদূর যাবেন তিনি! কিন্তু চারপাশের জঙ্গলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
সাড়ে দশটায় জিপ এল। আমি ড্রাইভারকে বললাম পোস্ট অফিস যাব—জয়পুরে টেলিগ্রাম করতে হবে। ধূর্জটিবাবুর রহস্য সমাধান না করে ভরতপুর ছাড়া যাবে না।
মেজদাকে টেলিগ্রাম করে, ট্রেনের টিকিট একদিন পিছিয়ে, রেস্ট হাউসে ফিরে এসে শুনলাম তখনও পর্যন্ত ধূর্জটিবাবুর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। আমেরিকান দুটি তাদের মরা কুকুরটাকে কবর দিয়ে এর মধ্যেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে উধাও।
সারা দুপুর রেস্ট হাউসের আশেপাশে ঘোরাফেরা করলাম। জিপটা আমার আদেশ মতোই আবার বিকেলে এসে হাজির হল। একটা মতলব ছিল মাথায়; মন বলছিল সেটায় হয়তো ফল হবে। ড্রাইভারকে বললাম, ‘ইমলিবাবার কাছে চলো।’
কাল যেমন সময় এসেছিলাম, আজও প্রায় সেই একই সময়ে গিয়ে পৌঁছলাম বাবার কুটিরে। বাবা কালকের মতো ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। শিষ্য আজ আরো দুটি বেড়েছে, তার মধ্যে একজন মাঝবয়সি, অন্যটি ছোকরা।
বাবা আমাকে দেখেই ঘাড় বেঁকিয়ে নমস্কার জানালেন। কালকের সেই ভস্মকরা চাহনির সঙ্গে আজকের চাহনির কোনও মিল নেই। আমি আর সময় নষ্ট না করে বাবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আমার সঙ্গে কাল যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তাঁর কোনও খবর তিনি দিতে পারেন কি না। বাবার মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেল। বললেন, ‘খবর আছে বইকী, তোমার দোস্ত আমার আশা পূর্ণ করেছে, সে আমার বালকিষণকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।’
এই প্রথম চোখে পড়ল বাবার ডান পাশে রাখা রয়েছে একটা পাথরের বাটি। সেই বাটিতে যে সাদা তরল পদার্থটা রয়েছে সেটা দুধ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সাপ আর দুধের বাটি দেখতে তো আর আমি এতদূর আসিনি। আমি এসেছি ধূর্জটিপ্রসাদ বসুর খোঁজে। লোকটা তো আর হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। তার অস্তিত্বের একটা চিহ্নও যদি দেখতে পেতাম তবু খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।
ইমলিবাবা মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলতে পারেন এটা আগেও দেখেছি। গাঁজার কলকেতে বড়রকম একটা টান দিয়ে সেটা পাশের প্রৌঢ় চেলার হাতে চালান দিয়ে বললেন, তোমার বন্ধুকে তো তুমি আর আগের মতো ফিরে পাবে না, তবে তার স্মৃতিচিহ্ন সে রেখে গেছে। সেটা তুমি বালকিষণের ডেরার পঞ্চাশ পা দক্ষিণে পাবে। সাবধানে যেয়ো, অনেক কাঁটাগাছ পড়বে পথে।’
বাবার কথামতো গেলাম বালকিষণের গর্তের কাছে। সে গর্তে এখন সাপ আছে কিনা সেটা জানার আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। আকাশে ডুবু ডুবু সূর্যের দিকে চেয়ে হিসেব করে দক্ষিণ দিক ধরে এগিয়ে গেলাম। ঘাস, কাঁটাঝোপ, পাথরের টুকরো আর চোরকাঁটার ভেতর দিয়ে গুনে গুনে পঞ্চাশ পা এগিয়ে গিয়ে একটা অর্জুন গাছের গুঁড়ির ধারে যে জিনিসটা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেরকম জিনিস এই কয়েক মিনিট আগেই ইমলিবাবার কুটিরে দড়ি থেকে ঝুলছে দেখে এসেছি।
সেটা একটা খোলস। সারা খোলসের উপর রুহিতন মার্কা নকশা।
সাপের খোলস কী? না, তা নয়। সাপের শরীর কি এত চওড়া হয়? আর তার দু’পাশ দিয়ে কি দুটো হাত, আর তলা দিয়ে কি একজোড়া পা বেরোয়?
আসলে এটা একটা মানুষের খোলস। সেই মানুষটা এখন আর মানুষ নেই। সে এখন ওই গতর্টার মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। সে জাতে কেউটে, তার দাঁতে বিষ।
ওই যে তার শিস শুরু হল। ওই যে সূর্য ডুবল। ওই যে ইমলিবাবা ডাকছে—‘বালকিষণ…বালকিষণ…বালকিষণ…’