পঞ্চান্ন
আজ কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধের সপ্তদশ দিবস।
আজ ধ্বংসের দিন, আজ মৃত্যুর দিন।
আজ ভয়ংকরতার দিন, আজ বীভৎসতার দিন।
আজ বিশ্বাসঘাতকতার দিন, আজ বিশ্বাসহন্তাদের দিন।
আজ অধর্মের জয়ের দিন, আজ ধর্মের পরাজয়ের দিন।
আজ মনুষ্যত্ব, ন্যায়বোধ, সততা, ভ্রাতৃত্ব কুরুক্ষেত্রের রক্তভেজা মাটিতে মুখথুবড়ে পড়ার দিন। আজ আকাশে সূর্য উঠবেন, আলো ছড়াবেন না।
আজ অন্ধকারের রাজত্ব, মিথ্যের রাজত্ব, নিষ্ঠুরতার রাজত্ব।
আগের রাতে পরিকল্পনাসভা বসেছে, দুর্যোধনশিবিরে। সেখানে শল্য, দুঃশাসন, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং তখন পর্যন্ত জীবিত বীর যোদ্ধারা উপস্থিত। কর্ণ-দুর্যোধন পাশাপাশি আসনে আসীন।
দুর্যোধনের চোখমুখ ম্লান উদাসীন। বজ্রাহত যেন সে!
কর্ণ বলল, ‘ওরকম ঘাবড়ে বসে আছ কেন দুর্যোধন?’
‘অন্ধকার দেখছি।’
দুর্যোধনের কথা শুনে সবাই নড়েচড়ে বসল।
অশ্বত্থামা চটজলদি বলে উঠল, ‘মানে! যুদ্ধের কতটুকুই-বা হয়েছে এখন পর্যন্ত, হতোদ্যম হয়ে পড়লে!’
‘আমাদের কত কত মহাবীর নিহত হয়েছেন, জানো না তুমি অশ্বত্থামা? এগারো অক্ষৌহিণীর অধিকাংশই তো আজ নেই!’
‘তাই বলে ভেঙে পড়বে এমন করে?’ বললেন কৃপাচার্য।
দুর্যোধন হতাশ চোখে কৃপাচার্যের দিকে ঘাড় ফেরাল। বলল, ‘ওদের বড় বড় বীর সবাই বেঁচে থাকল! ওই যে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে আনবেন বলে কথা দিয়েছিলেন গুরু দ্রোণ! তিনি চলে গেলেন স্বর্গে। যুধিষ্ঠিরের কেশটিও নাড়াতে পারলাম না আমরা। সাত্যকি বেঁচে থাকল, ধৃষ্টদ্যুম্ন বেঁচে থাকল! আর ওই খাদক বৃকোদরটা, গদা ঘুরিয়ে যাচ্ছে এখনো! যে নকুল-সহদেব সামান্য চুনোপুঁটির মতো, তারাও কী আশ্চর্যরকমভাবে বেঁচে আছে! অর্জুনটা তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল! ওদের সবাই থাকল, আমাদের সবই গেল!’
দুর্যোধনের এই হাহাকার কর্ণের কাছে অপ্রত্যাশিত। বিস্ফারিত চোখে দুর্যোধনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কৰ্ণ।
তারপর অদ্ভুত এক মায়াময় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি আমার কথা ভুলে গেলে বন্ধু! আমার শৌর্যবীর্যের কথা বিস্মৃত হলে!’
বিব্রত ব্যাকুল দুর্যোধন কর্ণের দিকে তাকাল।
কর্ণ বলল, ‘তুমি বেশ ঘাবড়ে গেছ বন্ধু। বিপদে এত ঘাবড়ে যেতে নেই। সাহসই বীরদের বাঁচিয়ে রাখে। তুমি যথার্থই একজন বীর, দুর্যোধন। বুকের তলার সাহসটাকে মরতে দিয়ো না।’
‘কিন্তু ওই যে অর্জুন! ওই-ই তো পাণ্ডবকুলের প্রধানশক্তি! ভীমটাকে আমি না-হয় দেখে নেব। কিন্তু অর্জুনটা যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে রইল! তার হাতে প্রাণনাশী নানা অস্ত্র আছে, গাণ্ডীব নামের অব্যর্থ ধনুক আছে।’ দুর্যোধনের ভড়কে যাওয়া গলা।
কর্ণ সোৎসাহে বলে উঠল, ‘ইন্দ্রপ্রদত্ত একবীরঘাতিনী তীরটি খরচ করে ফেলেছি বলে তুমি ধরে নিয়েছ, অর্জুনকে আমি আর হত্যা করতে পারব না। তোমার এ ধারণা ভুল দুর্যোধন। আমার কাছে আর আর যে দিব্যাস্ত্র আছে, সেগুলো দিয়ে আমি অর্জুনের মাথা কেটে মাটিতে নামাব। তুমি অর্জুনের গাণ্ডীবের কথা বললে না? ওর গাণ্ডীব আছে তো আমার বিজয় নামের ধনুক আছে। এই ধনুকটি পরশুরাম আমাকে দিয়েছেন। এই ধনুকটির তীর লক্ষ্যভেদী। এটি ভীষণ কার্যক্ষমতাবিশিষ্ট।’
কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন উদ্দীপিত হয়ে উঠল।
কর্ণ বলল, ‘আগামীকাল এই পৃথিবীতে হয় অর্জুন থাকবে, নয় আমি থাকব।
কৃপাচার্য বলে উঠলেন, ‘কৃষ্ণের কথা মনে রেখেই কি কথাটা বললে কর্ণ? অর্জুনের সারথি কিন্তু কৃষ্ণ! যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাই শুধু যুদ্ধ করে না, যুদ্ধজয়ে সারথির ভূমিকাও কম নয়! কৃষ্ণ ধুরন্ধর! তার চিন্তা চাতুর্যময়। যেকোনো সংকটমুহূর্তে কৃষ্ণ কিন্তু অর্জুনকে বুদ্ধি জোগায়।’
পাশ থেকে দুঃশাসন বলে উঠল, ‘বুদ্ধি নয়, কুবুদ্ধি জোগায়।’
‘ওই মুহূর্তে ওই কুবুদ্ধিই অর্জুনের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়। অর্জুনের কৃষ্ণ আছে, তোমার তো তেমন সারথি নেই কর্ণ যে কুবুদ্ধি বা সুবুদ্ধি জুগিয়ে যুদ্ধে জিতিয়ে আনবে তোমাকে!’ কর্ণকে লক্ষ্য করে বললেন কৃপাচার্য
‘আছেন তো! কৃষ্ণের সমান গুণসম্পন্ন সারথি আমাদের পক্ষেও আছেন।’ কর্ণের কথায় সবাই চকিতে তার দিকে তাকাল।
দুর্যোধন উদগ্রীব দৃষ্টিতে বলল, ‘কে তিনি?’
কর্ণ মদ্ররাজ শল্যের দিকে তর্জনী তুলল। ‘মহারাজ শল্য যদি আমার সারথ্য গ্রহণ করেন, তাহলে অর্জুননিধন আমার জন্য মুহূর্তের ব্যাপার।
কর্ণের কথা শোনামাত্র শল্যের ভেতরটা আনন্দে টগবগ করে উঠল। কিন্তু ভেতরের খুশি বাইরে দেখালে বিপদ।
অতি কষ্টে নিজেকে দমন করে ক্রোধে ফেটে পড়ল শল্য, ‘কী! আমি সারথি হব? কর্ণের? এত বড় দুঃসাহস কর্ণের? আমার বংশমর্যাদা, ঐশ্বর্য, বিদ্যা, রণবুদ্ধি, শক্তির কথা কি কর্ণের জানা নেই? শূদ্র হয়ে ক্ষত্রিয়কে সারথি হওয়ার প্রস্তাব!’
বলতে বলতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শল্য। অপমান আর ঘৃণার আভা তার সারা মুখ ছেয়ে আছে। পারলে দুচোখের আগুনে এখনই জ্বালিয়ে ফেলে কর্ণকে।
এসবের পুরোটাই যে শল্যের অভিনয়, তার মনোবাসনা যে কর্ণের সারথি হওয়া—ধরতে পারলেন না কেউ। এমন যে জীবনাভিজ্ঞ কৃপাচার্য, তাঁরও চোখ এড়িয়ে গেল শল্যের কূটাভিনয়।
শল্য তখন ভেবে যাচ্ছে—হে ঈশ্বর, এতদিন পরে ভাগনেদের ঋণশোধের সুযোগটা এনে দিলে তুমি! আমি দুর্যোধনের ব্যসন-বিলাসে বিভ্রান্ত হয়ে যে ভুলটা করেছিলাম, আজ সেই ভুল সংশোধনের ব্যবস্থা করলে প্রভু! আমি যুধিষ্ঠিরকে কথা দিয়েছিলাম, সুযোগ পেলেই কর্ণের সারথি হব। রথ নিয়ে যাব অর্জুনের রথের সামনে। তারপর তো অর্জুনের কাজ! আজ সেই মোক্ষম সুযোগটা আমাকে দিলে ঈশ্বর! দুহাত তুলে কপালে ঠেকাতে গিয়ে সংবিতে ফিরল শল্য।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন দুর্যোধন তার নিকটে চলে এসেছে, টের পায়নি শল্য।
ঝট করে শল্যের দুহাত ধরে ফেলল দুর্যোধন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না মহারাজ। আপনার মতো সারথ্যবিচক্ষণতা কজনের আছে বলুন। আপনার তুলনা চলে শুধু কৃষ্ণের সঙ্গে। যথার্থ সারথির যে গুণ—রথীর লক্ষণ, ইঙ্গিত, দৈন্য, হর্ষ, খেদ, বল ও দুর্বলতা, স্থানসকলের সমতা-বন্ধুরতা, যুদ্ধের অবসর, শত্রুর দুর্বলতা দর্শন—এসবের সবটাই আপনার অধিগত। এই তথ্য কৰ্ণ জানে। কর্ণ এ-ও জানে—যথাসময়ে অস্ত্র এগিয়ে দিতে এবং সর্বোপরি রথীকে অভয় দিয়ে মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে আপনি বিশেষভাবে পারঙ্গম। সেজন্য কর্ণ আপনাকে আগামীকাল তার সঙ্গী হিসেবে চেয়েছে। আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন মহারাজ। কর্ণের প্রস্তাব মেনে নিন। আমাকে জেতান। ‘ দুর্যোধনের গলায় বাষ্প জমে গেল।
দ্রুত শান্ত হয়ে গেল শল্য। সবাই শল্যকাণ্ডে উৎকণ্ঠিত ছিল বলে এত ক্রোধোন্মত্ত মানুষ হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে গেল কেন, তার বিচারে গেল না। উপরন্তু শল্যের সম্মতিতে মাত্রাতিরিক্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠল সবাই।
এই সময় শল্য বলল, ‘ঠিক আছে, আমি কর্ণের সারথ্য করতে রাজি। তবে…।’
‘তবে!’ কর্ণ আর দুর্যোধন—উভয়ের মুখ থেকে একই সঙ্গে বেরিয়ে এলো।
‘আমার একটা শর্ত আছে। শর্তটা হলো—রথচালনার সময় আমি যা মুখে আসে, তা-ই বলতে
পারব। কর্ণ তাতে আপত্তি করতে পারবেন না।’
‘ও—! এই কথা! আমার কোনো আপত্তি নেই।’ নিরুদ্বিগ্ন কর্ণ।
‘আমার কোনো আপত্তি নেই’—এই কথার মধ্য দিয়ে কর্ণ যে নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে আনল, বুঝতে পারল না। বুঝতে পারল না—চরম এক শত্রুকে নিজের মুখে আহ্বান করে নিজের রথে তুলে নিল।
.
অন্যদিন ঢিমেতালে শুরু হলেও সপ্তদশ দিবসের যুদ্ধ অতি প্রত্যুষে শুরু হয়ে গেল।
কর্ণ দুর্যোধনকে কথা দিয়েছে—অর্জুনকে সে আজ বধ করবেই করবে।
অন্যান্য দিনের মতো উভয়পক্ষ যুদ্ধ শুরুর আগে সেনাব্যূহ রচনা করল। কর্ণ রচনা করল কক্ষপ্রকক্ষযুক্ত মহাব্যূহ আর পাণ্ডবপক্ষের সেনানায়ক ধৃষ্টদ্যুম্ন অনুপম নামের এক ব্যূহ নির্মাণ করল।
কর্ণ ধনুক উঁচিয়ে নিজেদের ব্যূহের সম্মুখভাগে অবস্থান নিল।
ধৃষ্টদ্যুম্ন নিজেদের ব্যূহরক্ষায় তৎপর হলো।
শুরু থেকে ঘোর যুদ্ধ বেধে গেল।
এই যুদ্ধে কখনো পাণ্ডবদল পিছিয়ে যেতে লাগল, কখনো কৌরবসেনারা। পূর্বাহ্ণের অধিকাংশ সময়ই অর্জুনের কেটে গেল সংশপ্তকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। ওদের নিধন করতে পারলেই কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। আর কর্ণের কাটল পঞ্চাল, চেদি আর সৃঞ্জয় বীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। অর্জুনের কাছে পৌঁছানোর প্রধান প্রতিবন্ধক এই বীর সেনানীরা।
আজ রণে উন্মত্ত যেন কর্ণ। তার হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলো ভানু দেব, চিত্রসেন, সেনাবিন্দু, তপন ও শূরসেন নামের পাঁচ পঞ্চালবীর। পরে বহু পঞ্চালসেনা তাকে ঘিরে ধরলে কর্ণ নির্বিচারে তাদের যমালয়ে পাঠাল। তা দেখে পাণ্ডবসেনাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল।
হঠাৎ চারদিক থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, ভীম, নকুল-সহদেব, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র কর্ণকে ঘিরে ফেলল। কর্ণ পিছিয়ে যাওয়ার যোদ্ধা নয়। এদের সবাইকে এক সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস ও অস্ত্রজ্ঞান তার আছে। আজ তার শৌর্যবীর্য অন্যদিনের দ্বিগুণ। আজ তার রথ চালাচ্ছে যে সারথিশ্রেষ্ঠ শল্য! বাণে বাণে কুরুক্ষেত্রের ওই অংশের আকাশ ছেয়ে গেল। চোখের পলকে কখন ভীম কর্ণপুত্র ভানুসেনকে হত্যা করল, টের পায়নি কর্ণ। যখন পেল, তুমুল শরাঘাতে ভীমকে ছিন্নভিন্ন করতে থাকল।
এই ভাবে সৈনিকরা কখনো চক্রাকারে, কখনো ত্রিভুজাকারে, কখনো বৃত্তাকারে, কখনো আয়তক্ষেত্রিকভাবে কুরুক্ষেত্রজুড়ে যুদ্ধ করে যেতে লাগল। এখন সাত্যকি অশ্বত্থামা মুখোমুখি তো একটুক্ষণ পরে দুর্যোধন-ধৃষ্টদ্যুম্ন মুখোমুখি। হাজার হাজার সৈন্য নিহত হতে থাকল। মারা গেল পঞ্চালবীর চন্দ্রদেব ও দণ্ডধার, ভীমের হাতে নিহত হলো দুর্যোধনভ্রাতা বিবিৎসু, বিকট, সম, ক্ৰাথ, নন্দ, উপনন্দ। কৃপের হাতে নিহত হলো পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবীর সুকেতু।
সৈনিক, সেনাপতি নির্বিশেষে সবাই আজ হত্যালীলায় মেতেছে। অন্য কোনো দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবার মনে একটি মন্ত্র গম্ভীর ধ্বনিতে উচ্চারিত হচ্ছে—হত্যা, রক্ত।
সূর্যদেব পশ্চিমে ঢলেছেন তখন।
তুমুল সংগ্রাম চলতে লাগল। সামনে যে যাকে পাচ্ছে, হত্যা করছে। আপন পর ভুলে হত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সবাই। কারো মধ্যে স্বাভাবিকতা নেই, মানবতা নেই, দয়া নেই, মায়া নেই। সবাই হিংস্রতায়, জিঘাংসায় উন্মাতাল।
যুদ্ধের একপর্যায়ে ভীমের সামনে পড়ে গেল দুঃশাসন।
ভীম দুঃশাসনকে দেখেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। দ্রৌপদীলাঞ্ছনার কথা মনে পড়ে গেল তার। দ্রৌপদীর আর্তনাদ-হাহাকার স্পষ্ট শুনতে পেল ভীম। দুঃশাসনের হস্তদ্বয় ছিন্ন করার এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তার রক্তপান করার প্রতিজ্ঞার কথা তার কানের পাশে ঝনঝনিয়ে উঠল। দুচোখ ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ভীমের।
দুঃশাসনকে আক্রমণ করে বসল ভীম।
দুঃশাসনও কম যায় না। কুরুপরিবারে দুর্যোধনের পরে শক্তিতে দুঃশাসনের নাম। বিপুলবিক্রমে সে ভীমের আক্রমণের জবাব দিতে শুরু করল। প্রথমে সে ভীমকে লক্ষ্য করে একটি শক্তিশেল নিক্ষেপ করল। ভীম তার গদা দিয়ে সেই শক্তিশেলটি প্রতিহত করে দিল। দুঃশাসনকে আর সুযোগ দিল না ভীম। রথ লক্ষ্য করে গদার প্রচণ্ড এক আঘাত করে বসল। গদাঘাতে দুঃশাসনের রথ চূর্ণ হয়ে গেল। সারথি নিহত হলো। দূরে ছিটকে পড়ল দুঃশাসন। গদাঘাত থেকে সেও রেহাই পায়নি। বিচূর্ণ বর্ম, ছিন্ন বসন তখন তার। মাটিতে পড়ে ছটফট করছে তখন দুঃশাসন।
ভীম সিংহগর্জনে দুঃশাসনের দিকে এগিয়ে গেল। অদূরে কর্ণ-দুর্যোধন দাঁড়িয়ে তখন। চোখের পলকে ভীম তার পা দিয়ে দুঃশাসনের গলা চেপে ধরল। বুকের ওপর উঠে বসে দুঃশাসনের ডান হাতটা ছিঁড়ে নিল এবং ওই বিচ্ছিন্ন হাত দিয়ে দুঃশাসনের মাথায় জোরে জোরে বাড়ি মারতে লাগল। এরপর এক অমানুষিক কাজ করে বসল ভীম। দুহাতের হিংস্র আঙুল দিয়ে দুঃশাসনের বুক ফেড়ে ফেলল। ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকল বুক থেকে। আর আঁজলাভরে সেই রক্ত ভীম পান করে যেতে লাগল।
স্তব্ধ দুর্যোধন, বধির কর্ণ।
ভীমের এই পাশবিক কাণ্ড দেখে কুরুক্ষেত্রজুড়ে গহিন এক নীরবতা নেমে এলো।
কর্ণ-দুর্যোধন কিছু করবার আগেই দুঃশাসনের মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল ভীম
ছাপান্ন
দুই বীরে দেখাদেখি হইল সত্বর।
রণেতে শোভিল যেন দুই দিবাকর ॥
দুই রথে দীপ্তিমান উভয়ের ধ্বজ।
এক ধ্বজে কপি শোভে আর ধ্বজে গজ ॥
কর্ণে বেড়ি কৌরবেরা করে সিংহনাদ।
শঙ্খ ভেরি বাজে আর জয় জয় নাদ ॥
অৰ্জ্জুনেরে বেড়ি নানাবিধ বাদ্য বাজে।
সিংহনাদ করে যত পাণ্ডবসমাজে ॥
—মহাভারত, কর্ণপর্ব্ব। কাশীরাম দাস
.
অপরাহ্ণ।
কিছুক্ষণ আগে বেশ জোরবৃষ্টি হয়ে গেছে।
হঠাৎ বৃষ্টি। এ বৃষ্টি যেন দুঃশাসনের রক্ত ধুইয়ে দেওয়ার জন্য। আকাশে এখন ঘন মেঘ নেই। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ।
পৌষ মাস। শীতকাল। বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তবু বৃষ্টি হয়েছে। অগ্রহায়ণে শুরু হওয়া যুদ্ধ পৌষে এসে ঠেকেছে।
সতেরোতম দিনের যুদ্ধ সমাপ্তির পথে। এই যুদ্ধ আর কতদিন চলবে, কে জানে। তবে বেশিদিন যে চলবে না, নিশ্চিত কৃষ্ণ। কৌরবশিবিরে কর্ণই এখন সবেধন নীলমণি। তাকে নিধন করতে পারলে কুরুরা বীরশূন্য হয়ে পড়বে। কর্ণের পরে কুরুদলে দুজন বীর থাকবে বটে—শল্য আর দুর্যোধন। শল্য তো বিশ্বাসঘাতক! পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে একদিনও যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা নেই দুর্যোধনের। কুরুজয়ের একমাত্র অন্তরায় এখন ওই কর্ণ। যেভাবেই হোক, তাকে আজ যমালয়ে পাঠাতেই হবে। রথে বসে ধীরেসুস্থে ভেবে গেল কৃষ্ণ।
পরিকল্পনাটা নিজের মনে পুষ্টিলাভ করার পর অর্জুনকে বলল, ‘তুমি তৈরি তো অর্জুন? আজ তোমার চরম পরীক্ষার দিন। তুমি কত বড় যোদ্ধা তার পরীক্ষা দিতে হবে আজ।’
‘আমি প্রস্তুত দাদা। এই দিনটির জন্য আমি প্রতীক্ষা করে আছি।’
‘ঠিক আছে। আমি কর্ণের রথের সামনে তোমার রথ নিয়ে যাচ্ছি।’
যুদ্ধক্ষেত্রের অনেকাংশই এখন বৃষ্টিভেজা। কোনো কোনো স্থান কর্দমাক্ত। ছোট-বড় গর্তে গর্তে জল জমে গেছে। জলভর্তি গর্ত এড়িয়ে ভেজা অংশ ছাড়িয়ে কর্ণের রথের সামনে অর্জুনের রথ নিয়ে গেল কৃষ্ণ।
কর্ণ-অর্জুনের যুদ্ধ আসন্ন দেখে হঠাৎ ঘাবড়ে গেল অশ্বত্থামা। তার মনে হলো—আজকেই কৌরবদের চূড়ান্ত ধ্বংস সংঘটিত হবে। যেকোনো মূল্যে এই ধ্বংসকে থামিয়ে দেওয়া দরকার।
দুর্যোধন সন্নিধানে অশ্বত্থামার রথ ছুটে গেল।
‘তুমি এই যুদ্ধ বন্ধ করো দুর্যোধন।’ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল অশ্বত্থামা।
বিস্ফারিত চোখে অশ্বত্থামার দিকে তাকাল দুর্যোধন, ‘কোন যুদ্ধ থামানোর কথা বলছ তুমি অশ্বত্থামা!’
‘প্রাণঘাতী জ্ঞাতিবিরোধী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা বলছি আমি।’
‘এই যুদ্ধের আর অবশিষ্ট আছে কী বলো! সব তো গেছে আমার, সবই তো গেছে!’
‘তারপরও তুমি একবার ভেবে দেখো দুর্যোধন। এখনো যুদ্ধ থামানোর সময় আছে। তুমি যদি রাজি হও, যুধিষ্ঠিরের কাছে সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে যাই।’
হঠাৎ গর্জে ওঠে দুর্যোধন, ‘কাদের সঙ্গে সন্ধি করতে বলছ তুমি? যারা পিতামহকে শরশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে, যারা মিথ্যে বলে দ্রোণগুরুর মাথা কেটে নামিছে, যারা আমার নিরানব্বইজন ভাইয়ের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছে, তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে বলো? আজ দুঃশাসনের হত্যাদৃশ্য দেখোনি তুমি? ভাই, দুঃশাসন রে! আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলি রে ভাই!’ বলতে বলতে রথেই মাথা কুটতে শুরু করল দুর্যোধন।
দুর্যোধনের পাগলপনা দেখে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল অশ্বত্থামা। সারথিকে ইঙ্গিত করল সেস্থান ছেড়ে যাওয়ার।
ওদিকে কর্ণ আর অর্জুনের রথ মুখোমুখি। উভয়ে জিঘাংসু। অরি নিধনে তারা আজ পদ্ধপরিকর। উভয়ের চোখেমুখে রক্তলিপ্সা। শত্রুর রক্তে ধরণীতলকে সিক্ত করার প্রতিজ্ঞা পূরণে নেমেছে যেন আজ কর্ণ আর অর্জুন।
অর্জুনের সারথি কৃষ্ণ। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও সে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। কুটিলতা তার প্রধান মূলধন।
আর কর্ণের সারথি শল্য। অর্জুনমাতুল শল্য। ঘটনাচক্রে কৌরবপক্ষের যোদ্ধা, কর্ণের দুর্ভাগ্যের ফেরে সে আজ কর্ণসারথি। সারথিকার্যে চৌকস সে, কৃষ্ণসম।
তবে কৃষ্ণের মতো কুচক্রী নয় সে। তার মূলধন বিশ্বাসঘাতকতা। ভাগনেদের ঋণশোধের জন্য শল্য আজ কর্ণের সারথি হয়েছে।
অর্জুন হাতে গাণ্ডীব তুলে নিল।
আজ কর্ণ প্রথম থেকেই পরশুরামপ্রদত্ত বিজয় নামের ধনুকটি দিয়ে যুদ্ধ করছিল।
কর্ণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে তীর যোজনা করতে যাবে, মা কুন্তীর কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ— তুমি অর্জুনকে মারবে না, কথা দাও আমায়।
আনমনা হয়ে পড়ল কর্ণ। ওই সময় অর্জুন-নিক্ষেপিত একটা বাণ এসে কর্ণের বাহুতে আঘাত করল। বাঁ বাহুর কিছুটা চামড়া তুলে নিয়ে তীরটি মাটিতে গিয়ে পড়ল।
কর্ণ বাস্তবে ফিরল। অর্জুন আর কৃষ্ণকে লক্ষ্য করে পরপর বেশ কয়েকটি বাণ নিক্ষেপ করে বসল কৰ্ণ।
উভয়ের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল। বিরাট এলাকা নিয়ে বৃত্তাকারে দুজনের রথ ঘুরতে লাগল। রথের রশি দুজন দক্ষ সারথির হাতে। কৌশলী হাতে শল্য আর কৃষ্ণ রথকে অস্ত্রাঘাত থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চক্রাকারে ঘুরিয়ে যাচ্ছিল। আর রথারোহী দুজন যোদ্ধা নানা রকম মারণাস্ত্র শত্রুকে লক্ষ্য করে নিজের ধনুকে যোজনা করে যাচ্ছিল। দুজনেই যুদ্ধে অটল। দুজনেই সমান পারদর্শী। একজন দ্রোণশিষ্য হলে অন্যজনের অস্ত্রগুরু পরশুরাম। বীরত্বে, অস্ত্রসঞ্চালনে এবং পৌরুষে কখনো অর্জুন এগিয়ে যাচ্ছিল, কখনো কৰ্ণ।
সাধারণ তীরে যখন কেউ কাউকে কাবু করতে পারছিল না, অর্জুন তূণ থেকে ব্রহ্মাস্ত্রটা তুলে নিল।
কর্ণের অব্যর্থ বাণে সেই ব্রহ্মাস্ত্র আকাশপথেই ধ্বংস হয়ে গেল।
এই সময় কর্ণের সর্পমুখ বাণের কথা মনে পড়ে গেল। দীর্ঘদিন সে এই বাণটিকে চন্দনচূর্ণের মধ্যে চুবিয়ে রেখেছে। এই বাণ মারাত্মক এবং লক্ষ্যঘাতী।
মুহূর্তে এই বাণ ধনুকে যোজনা করে বসল কর্ণ। কৃষ্ণ আর শল্য জানে—এই তীর অর্জুনের বক্ষ বিদীর্ণ করবেই করবে।
শল্য তার বিশ্বাসহন্তার চরিত্রে অবতীর্ণ হলো।
অপ্রয়োজনীয় উচ্চৈঃস্বরে সে বলে উঠল, ‘এই সর্পমুখ বাণ অত্যন্ত ভয়ংকর। এই বাণ কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। তার পরেও এই বাণ অর্জুনের গ্রীবা ছেদন করতে পারবে না। অর্জুনের মস্তক- বিচ্ছিন্ন করার জন্য অন্য কোনো বাণ নিক্ষেপ করুন অঙ্গরাজ।’
কর্ণের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবার জন্য অহেতুক চিৎকার করে কথাটা বলে গেল শল্য। উচ্চৈঃস্বরে বলার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল। তাহলো মারাত্মক বাণটির কথা কৃষ্ণ-অর্জুনকে শুনিয়ে সতর্ক করা।
সতর্ক হলোও কৃষ্ণ।
শল্যের কথা গ্রাহ্য করেনি কর্ণ। মনঃসংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়নি তার। অর্জুনকে লক্ষ্য করে ওই সর্পমুখ বাণটি ছুড়েছিল। কিন্তু বাণটি অর্জুনকে ভেদ করতে পারেনি।
শল্যের কথা শোনামাত্র কৃষ্ণ পদাঘাতে অর্জুনের রথটিকে ভূমিতে অনেকটাই দাবিয়ে দিয়েছিল, অশ্বগুলোও হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিল। ফলে তীরটি থেকে অর্জুনের মাথাটি বেঁচে গেল। অর্জুনের মুকুটটিই শুধু বাণাঘাতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
কৃষ্ণ আর অর্জুন রথ থেকে নেমে মাটিতে বসে যাওয়া রথকে টেনে তুলতে চাইল। কিন্তু রথের চাকা এত গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল যে দুজনের আপ্রাণ চেষ্টাতেও রথটিকে তুলতে পারছিল না।
এখনই শত্রুকে হত্যা করার মোক্ষম সময়। নিরস্ত্র অর্জুন, অসহায় কৃষ্ণ। কর্ণ চাইলে এখনই দুজনকে যমালয়ে পাঠাতে পারে। কিন্তু কর্ণ তা করল না। সে যে বীর! নিরস্ত্রকে আক্রমণ করতে শেখেনি সে। সে জানে—নিরস্ত্র শত্রুহত্যা ব্রাহ্মণহত্যার মতো মহাপাপ।
কর্ণ অপেক্ষা করতে থাকল।
একসময় অর্জুনের রথ স্বাভাবিক সমতলে উঠে এলো।
দুজনে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাণে কর্ণ জর্জরিত হতে থাকল। একটা সময়ে বাণাঘাতে রথের ওপরেই অচেতন হয়ে পড়ল কর্ণ। এরকম অবস্থায় সারথিরা রথকে শত্রুর দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যায়। কিন্তু শল্য তা করল না। সে কর্ণের রথকে অর্জুনের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে প্রতিস্থাপন করল।
কৃষ্ণ বলল, ‘কর্ণকে এখনই হত্যা করো অর্জুন।’
অর্জুন বলল, ‘তা হয় না। অচেতন শত্রুকে হত্যা করা যুদ্ধনিয়মের মধ্যে পড়ে না।’
‘যুদ্ধে কোনো নিয়ম খাটে না।’
‘আমাকে মাফ করো দাদা। আমি মূর্ছিত নিরস্ত্র কর্ণকে হত্যা করব না।’
‘তুমি যদি না করো, তাহলে আমি করব। সুদর্শনচক্র দিয়ে আমি এখনই কর্ণের মুণ্ড ছেদ করব।’ বলে লাফ দিয়ে রথ থেকে নামতে গেল কৃষ্ণ।
ব্যাকুল কণ্ঠে অর্জুন বলে উঠল, ‘তুমিই তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে দাদা, যুদ্ধচলাকালীন সময়ে অস্ত্র ধরবে না! আর এখন যাচ্ছ কর্ণকে হত্যা করতে!’
অর্জুনের কথায় চুপসে গেল কৃষ্ণ। মুখ বেজার করে রথের রশি হাতে তুলে নিল।
শল্য চাইছিল-অর্জুন এগিয়ে আসুক। কর্ণনিধনের এই তো সঠিক সময়! তীক্ষ্ণ চোখে অর্জুনের রথের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। কিন্তু কর্ণের রথের দিকে অর্জুন যখন এগিয়ে এলো না, বড় হতাশ হলো শল্য।
ইত্যবসরে কর্ণের শরীরে চেতনা ফিরে এলো। গা ঝাড়া দিয়ে রথমধ্যে উঠে দাঁড়াল কৰ্ণ। ধনুক তুলে নিল হাতে।
শল্যকে উদ্দেশ করে বলল, ‘রথ চালান মহাবীর শল্য।’
শল্য ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সে ধরে নিয়েছিল—অচেতন অবস্থাতেই অর্জুন কর্ণকে হত্যা করে বসবে। কিন্তু ফলত তা হলো না। কর্ণ আবার সংবিতে ফিরে অর্জুননিধনে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু তা তো হতে দেওয়া যায় না! কিছুতেই ভাগ্নে অর্জুনের ক্ষতি হতে দেবে না সে।
কর্ণের নির্দেশ পেয়ে শল্য এমন একটা স্থান লক্ষ্য করে রথ চালাল, যে স্থানের মাটি বৃষ্টিতে ভিজে কাদাময়।
ওই গর্তপূর্ণ কর্দমাক্ত স্থানটি লক্ষ্য করে রথ চালাতে চালাতে শল্য বলতে থাকল, ‘মহাবীর কর্ণ, আপনার ক্ষমতা নেই অর্জুনকে হত্যা করার। অর্জুন মহাধনুর্ধর। তার হাতে অব্যর্থ শক্তি। শুনছেন তো আমার কথা? বলছি—যতক্ষণ অর্জুনের হাতে গাণ্ডীব আছে, ততক্ষণ সে অজেয়। শুনতে পাচ্ছেন তো অঙ্গরাজ, আমার কথা?’
যতবারই বাণনিক্ষেপে কর্ণ মনোযোগ দিচ্ছিল, ততবারই শল্য চিৎকার করে এসব কথাগুলো বলে যাচ্ছিল।
‘অর্জুনের অস্ত্রজ্ঞান অতুলনীয়, যুদ্ধনৈপুণ্যে সে পশুরামের সমান, তার ভয়ে ত্রিভুবন কাঁপে—ইত্যাকার কথা বলতে বলতে কর্ণের রথকে ওই কর্দমাক্ত স্থানটিতে নিয়ে গেল শল্য।
হঠাৎ করে রথের বাঁ দিকের চাকাটি ভেজা মাটিতে বসে যেতে লাগল। রথটি কাঁপতে শুরু করল।
কর্ণ তৎক্ষণাৎ রথ থেকে নেমে এলো। তীর, ধনুক, ভল্ল, শেল, তলোয়ার সবই রথেই পড়ে রইল। সর্বশক্তি দিয়ে রথের চাকাটি আঁকড়ে ধরল কর্ণ। টেনে তুলতে চাইল চাকাটি। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী বীর কর্ণ কোনোভাবেই চাকাটি তুলতে পারল না।
এই সময় বিত্রস্ত গলায় শল্যকে লক্ষ্য করে কর্ণ বলল, ‘আপনি রথ থেকে নেমে আসুন মদ্ররাজ। নেমে আমার সঙ্গে হাত লাগাল। দুজনে মিলে ঠেললে রথচক্রটি অনায়াসে উঠে আসবে।’
শল্যের চোখে তখন ক্রূর হাসির ঝিলিক, বুকের তলায় বিভীষণেরও অধিক বিশ্বাসঘাতকতা।
কর্ণের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি কী করে রথ থেকে নামি অঙ্গরাজ! আমি যদি নেমে পড়ি তাহলে রথ আরও মাটিতে বসে পড়বে যে! তাছাড়া এই সময় ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকা চাই।’ বলে নিজ আসনে আরও চেপে বসল শল্য।
ওই সংকটসময়ে কর্ণ ভাববার অবকাশ পেল না যে শল্যের এই কথার মধ্যে সত্য নেই। মিথ্যে বলে তার সংকটকে আরও ঘোরতর করে তোলবার চেষ্টা করছে শল্য।
চাকায় কাঁধ লাগিয়ে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে রথের চাকাটি তোলবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগল কর্ণ। আর ওদিকে নিজের আসনে গা এলিয়ে নিষ্ঠুর হাসি হেসে যেতে থাকল অর্জুনমাতুল মদ্ররাজ শল্য।
যুদ্ধপ্রস্তুতির সময় কুরু-পাণ্ডব উভয় পক্ষ কয়েকটি শর্ত মেনে চলবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার মধ্যে একটা হলো—প্রতিপক্ষ সময় চাইলে তাকে সময় দিতে হবে, এমনকি বিপদের সময় সাহায্য করতে হবে।
অর্জুন কর্ণকে এই বিপদের সময় সাহায্য তো করলই না, উপরন্তু নিরস্ত্র অসহায় কর্ণকে আক্রমণ করে বসল।
কৃষ্ণের হিংস্র কণ্ঠস্বর কর্ণের কানে ভেসে এসেছিল, ‘হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন অর্জুন? ওরকম ত্ৰস্তচোখে কী দেখছ তুমি? এ-ই সুযোগ অর্জুন, মোক্ষম সময়। এই সুবর্ণসুযোগ তোমার জীবনে আর আসবে না। যদি দুর্যোধনকে ধ্বংস করতে চাও, যদি যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের অধিপতি করতে চাও, যদি ভারতবর্ষে পাণ্ডব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাও—এখনই কর্ণকে হত্যা করো। অস্ত্রহাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। যমালয়ে পাঠাও কর্ণকে।’
কৃষ্ণের কথা স্পষ্ট শুনতে পেল কৰ্ণ।
অর্জুনের রথটি ততক্ষণে কর্ণরথের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে কৃষ্ণ।
রথচাকা রেখে কর্ণ উঠে দাঁড়াল। অর্জুনের উদ্দেশে বলল, ‘হে পার্থ, কৃষ্ণের কথায় তুমি বিভ্রান্ত হয়ো না। নিরস্ত্র আমাকে হত্যা করলে তোমার পাপ হবে অর্জুন। তুমি আমাকে একটু সময় দাও, রথের চাকাটি আমি টেনে তুলি। তারপর দুজনে যুদ্ধ করব। বীরভোগ্যা এই পৃথিবীতে বীরই বেঁচে থাকবে, কাপুরুষ নয়। অন্যায় করো না তুমি অর্জুন।’
অর্জুনকে কথা বলতে দিল না কৃষ্ণ। বলল, ‘ওরে রাধেয়, এতদিন তোমার এই ন্যায়বোধ কোথায় ছিল? দুর্যোধনের সঙ্গে মিশে পাণ্ডবদের সমূহ ক্ষতি করতে যখন তৎপর হয়েছিলে, তখন তোমার ন্যায়বোধ কোথায় ছিল? কুরুসভায় যখন দ্রৌপদীকে লক্ষ্য করে বেশ্যা বেশ্যা বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলে, তখন তোমার নীতিজ্ঞান কোথায় লুকিয়ে ছিল রে সূতপুত্র? তোমাকে বলছি অৰ্জুন, শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। ছলেকৌশলে শত্রুকে নিধন করতে হয়। ওই কর্ণটাকে এখনই হত্যা করো তুমি।’
প্রথম দিকে অর্জুন দিশেহারা হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত মনস্থির করল—কর্ণকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না।
নিরস্ত্র অসহায় কর্ণ তখন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে আছে।
অর্জুন গাণ্ডীবে অঞ্জলিক নামের বাণটি যোজনা করল।
অঞ্জলিক তীক্ষ্ণমুখ। লক্ষ্যভেদী। অব্যর্থ। জীবননাশী। এবং তীব্র গতিসম্পন্ন।
অর্জুনের লক্ষ্যস্থল কর্ণের গলদেশ।
চোখের পলকে অঞ্জলিক কর্ণের গলায় গিয়ে আঘাত করল।
কণ্ঠ বিদীর্ণ করে তীরটি গ্রীবা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কর্ণের মস্তকটি ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরের মৃত্তিকায় গড়িয়ে পড়ল।
নিজের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যে-কর্ণ ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্রকে নিজের রক্ষাকবচ আর কুণ্ডল অনায়াসে দিয়ে দিয়েছিল, সেই দানবীরের দেহ আজ অর্জুনের অন্যায় তীরাঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
দুর্যোধনের বন্ধুত্বের ঋণ যে-কর্ণ মুহূর্তকালের জন্যও বিস্মৃত হয়নি, সেই কর্ণ আজ কৃষ্ণের নির্মম প্ররোচনায় নিহত হলো।
সারাটা জীবন বঞ্চনা তাকে পরাজিত করেছে, শেষ পর্যন্ত বঞ্চনাকে পরাজিত করে জয়ী হলো কর্ণ।
***