পঞ্চাশ
কুরুক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের প্রতি কুরু-পাণ্ডব—উভয় পক্ষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং কৌরবদের প্রধান সেনাধ্যক্ষ নির্বাচন—এই দুটো কারণে একাদশ দিনের যুদ্ধ বিলম্বে শুরু হলো।
ভীষ্ম আহত হয়ে শরশয্যা গ্রহণ করলে কৌরববাহিনী সেনাধ্যক্ষশূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রধান সেনাপতি কাকে করবে—এ নিয়ে সংকটে পড়ে যায় দুর্যোধন। কৌরবদের সবাই কৰ্ণকেই একমাত্র ভীষ্মের সমান বলে মনে করলেন। এমন যে রণবিদ দ্রোণাচার্য, তাঁর কথাও ভাবলেন না কৌরবপক্ষের সমস্ত রাজপুরুষেরা। উন্মুক্ত রণক্ষেত্রের প্রত্যেকটি কুরুসেনা তখন ‘কর্ণ’
‘কর্ণ’ বলে চিৎকার করছিল। প্রত্যেকে মনে করছিল—বিগত দশদিন যুদ্ধ না করায় দৈহিক ও মানসিকভাবে কর্ণ অনেক বেশি সক্ষম। সবারই দাবি—ভীষ্মের পর কর্ণকে কুরুবাহিনীর সেনাপ্রধান করা হোক।
কিন্তু যার পক্ষে এত সমর্থন, সেই কৰ্ণই ভীষণ এক বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় দিল।
কর্ণের অনুগত রাজাদের বিপুল সমর্থন দেখে দুর্যোধন সমস্যায় পড়ে গেল। ভীষ্মের পর দ্রোণাচার্যকে সেনাধ্যক্ষ নির্বাচন করার ইচ্ছা দুর্যোধনের। কিন্তু সৈন্য আর রাজাদের সমর্থন যে কর্ণের দিকে! কিংকর্তববিমূঢ় হয়ে পড়ল দুর্যোধন।
কর্ণ বাস্তবতা বোঝে এবং বন্ধুর মন জানে। তাছাড়া প্রকৃত বীরকে শ্রদ্ধা জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না কর্ণ। নিজে বীর বলে অন্য বীরের প্রতি সম্মান জানাতে জানে সে।
সেনাধ্যক্ষ নির্বাচনীসভায় দুর্যোধনকে লক্ষ্য করে কর্ণ বলল, ‘তোমার পক্ষে এমন এমন খ্যাতিমান যোদ্ধারা আছেন, যাঁদের প্রত্যেকেই কৌরববাহিনীর সেনাপতি হওয়ার যোগ্য। যেহেতু তাঁরা সবাই সমান মাপের যোদ্ধা, সেজন্য ওঁদের মধ্য থেকে কাউকে সেনাপতি করলে অন্যরা মনে মনে আহত হবেন এবং ওঁরা মনেপ্রাণে তোমার জন্য যুদ্ধ করবেন না।’
কর্ণের কথায় কোনো সমাধান নেই, উপরন্তু ত্রাস আছে। এতে দুর্যোধনের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল, ‘তাহলে তুমিই বলো, এখন আমি কী করি!’
‘তোমাকে এই মুহূর্তে এমন একজনকে সেনাধ্যক্ষ করতে হবে, যিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র এবং অতুলনীয় ধনুর্বিদ।’
‘কে তিনি! কার কথা বলতে চাইছ?’
‘আমি মহামহিম দ্রোণাচার্যের কথা বলছি। অস্ত্রবিদ্যায় তিনি সবারই গুরুস্থানীয়। তাঁকে সেনাপতি করলে কারো কিছু বলার থাকবে না।’
দুর্যোধনের এখন কর্ণের প্রতি হাঁ-হয়ে তাকিয়ে থাকার পালা। যে দ্রোণাচার্য তাকে অস্ত্রপাঠশালা থেকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যে দ্রোণাচার্য তাকে অর্জুন-সমকক্ষ মনে করেননি কখনো, যে দ্রোণাচার্য সুযোগ পেলেই পদে পদে অপদস্থ করে গেছেন, সেনাপতি হিসেবে সেই দ্রোণাচার্যেরই নাম প্রস্তাব করল কর্ণ! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে চাইছে না মন।
ঘোর কাটলে দুর্যোধন বলল, ‘তুমি মন থেকে বললে তো কথাটা?’
হাহা করে হেসে উঠল কর্ণ, ‘এতদিনের বন্ধুত্ব আমাদের! তারপরও তুমি আমাকে চিনে উঠতে পারলে না দুর্যোধন!’ মনে মনে কী যেন একটু ভেবে নিল। এর পর বলল, ‘গুণের মর্যাদাই যদি দিতে না শিখলাম, তাহলে আমি কীসের কর্ণ?’
দুর্যোধন আর কথা বলেনি। মনে মনে কর্ণের সামনে মাথা নুইয়েছে।
স্বগত কণ্ঠে বলেছে, ‘এই না হলে কর্ণ! এই জন্যই তো তোমাকে বন্ধু মেনেছি! তোমার মতো উদার মানুষ আর একজনও তো নেই আমার দলে!’
দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকেই সেনাধ্যক্ষ ঘোষণা করেছে।
কর্ণ অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সৈন্যবাহিনীর অগ্রভাগে রথ নিয়ে গেছে।
বয়স হয়ে গেছে দ্রোণাচার্যের। নানা ক্লান্তি আর অবসন্নতা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। কুরু-পাণ্ডবে যুদ্ধ হোক—মনেপ্রাণেই চাননি। উভয়পক্ষের টানাহেঁচড়ায় বারবার বিব্রত হয়ে পড়েছেন তিনি। তার প্রিয় ছাত্রটি পাণ্ডবশিবিরে। কিন্তু একথাও তিনি ভুলতে পারেননি, তাঁর অসহায় অবস্থায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রই তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর ভরণপোষণ-প্রতিপত্তি-আবাসন—সব কিছুরই ব্যবস্থা করেছিলেন এই ধৃতরাষ্ট্রই। সুতরাং সংকটকালে তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে যান কী করে তিনি? তাছাড়া কুরুকুলের যে অভিভাবক পিতামহ ভীষ্ম, যাঁর আন্তরিক ব্যাকুলতা পাণ্ডবপক্ষের জন্য, সেই ভীষ্মও তো আপতন কুরুপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করে গেলেন! ভীষ্ম যদি যুধিষ্ঠিরদের ভালোবেসেও দুর্যোধনদের হয়ে যুদ্ধ করতে পারেন, তিনি পারবেন না কেন? অনুঋণ বলে শাস্ত্রে যে গভীর একটা কথা আছে, তাকে হেলা-অবহেলা করেন কী করে তিনি? তাই যুদ্ধের সময় তিনি কুরুপক্ষ ত্যাগ করে যাননি। ঋণ শোধ করবার জন্য দুর্যোধনদের পক্ষে থেকে গেছেন। ভীষ্ম দশদিন যুদ্ধ করেছেন, পাণ্ডবসৈন্য ও হত্যা করেছেন সহস্রে সহস্রে। সৈন্য মরেছে ঠিক, কিন্তু পিতামহ মূল পাণ্ডবদুর্গে হানা দিতে পারেননি। ওদের বড় বড় যোদ্ধারা এখনো বহালতবিয়তে রয়ে গেছেন, পাঁচ ভাইয়ের কারো গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত কাটতে পারেননি ভীষ্ম। ভীষ্মের মৃত্যুর পর তিনি আজ প্রধান সেনাপতি হয়েছেন। আজ তাঁর ঋণশোধের দিন। এতদিন তিনি যে সপরিবারে কুরুরাজা দ্বারা লালিত-সম্মানিত হয়ে এসেছেন, আজ তা ফেরত দেওয়ার দিন উপস্থিত। প্রশান্তিতে হঠাৎ দ্রোণের মনপ্রাণ ভরে উঠেছে
তিনি দুর্যোধনকে বললেন, ‘তুমি আজ আমাকে সর্বাধিক মর্যাদার আসনে বসালে দুর্যোধন। একজন যোদ্ধার সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত পদটির নাম সেনাধ্যক্ষ। তুমি তা-ই করলে আজ আমায়। আমার আনন্দের সীমা নেই। তুমি আজ আমার কাছে কিছু চাইলে বড় তৃপ্তি পাব আমি।’ কম কথার লোক এই আচার্য। কিন্তু এখন অনেক কথা বলে ফেললেন।
চোখ ঝিকমিক করে উঠল দুর্যোধনের, ‘আপনি প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে আমার সামনে নিয়ে আসুন আচার্য। তাতে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না আজ।’
দ্রোণ দ্রুত ভাবলেন, যাক দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু চাইল না, বন্দিত্ব চাইল শুধু। এ তেমন কঠিন কাজ তো নয়, পাপেরও নয়! মৃত্যু চাইলে শিষ্যহত্যার পাপ হতো তাঁর। কিন্তু বন্দিত্ব চেয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে দিল দুর্যোধন।
‘তা বেশ দুর্যোধন, আমি তোমার কথা রাখব। দিনশেষে দেখবে, যুধিষ্ঠির তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।’
দুর্যোধন ঈষৎ হেসে বলল, ‘তা-ই করুন আচার্য। তাতেই যুদ্ধজয় হয়ে যাবে আমার।’
দ্রোণাচার্য তার বাসনাপূরণ করতে চাইলেন যখন, একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল দুর্যোধনের মাথায়। ও ভাবল, যদি আচার্য যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে আনেন, তখন তখনই তাকে নিয়ে পাশাখেলায় বসে যাবে সে। বন্দি যেহেতু, পাশা খেলতে বাধ্য হবে তখন যুধিষ্ঠির। আবার তেরো বছর বনবাসের বাজি ধরবে সে। পাঁচ ভাইকে বনে পাঠিয়ে আবার নিষ্কণ্টক রাজ্যসুখ ভোগ করবে।
কিন্তু সেদিনের যুদ্ধশেষে দেখা গেল, যুধিষ্ঠির অক্ষত দেহে নিজশিবিরে ফিরে এসেছে আর দ্রোণাচার্য ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ব্রিত পায়ে আপন শিবিরে পায়চারি করছেন।
দুর্যোধনের বাসনা পূরণের জন্য দ্রোণাচার্যের প্রতিশ্রুতির কথা তৎক্ষণাৎ পাণ্ডবশিবিরে পৌঁছে গিয়েছিল। কুরুদের তুলনায় পাণ্ডবদের গুপ্তচরবাহিনী অনেক বেশি বিচক্ষণ ও করিৎকর্মা। এই গোপন কথাটি কৃষ্ণের কানে পৌঁছে দিতে বিলম্ব করেনি তারা।
সেদিনের যুদ্ধের শুরুতেই যুধিষ্ঠিরকে সুরক্ষিত করে তুলল কৃষ্ণ। তাকে ঘিরে দুর্ভেদ্য এক ব্যূহ রচনা করার আদেশ দিল। সেই ব্যূহের মুখে গাণ্ডীব হাতে অবস্থান নিল অর্জুন। তাকে ঘিরে সহস্ৰ সহস্ৰ পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী, রথারোহী সৈন্য-সেনাপতি সিংহনাদ করতে লাগল। সেই সঙ্গে শঙ্খ, ভেরি, মৃদঙ্গ ইত্যাদি রণবাদ্য বাজতে লাগল। কিছুতেই যুধিষ্ঠির পর্যন্ত দ্রোণাচার্যকে পৌঁছতে দেবে না তারা।
দ্রোণাচার্য তাঁর বিরাট চৌকস সেনাদল নিয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। কিন্তু সৃঞ্জয়, পঞ্চালযোদ্ধা, অভিমন্যু, অর্জুনকে ভেদ করে সামনে এগোতে পারলেন না দ্ৰোণ। উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধে বেধে গেল। দ্রোণাচার্যের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে পাণ্ডবপক্ষ কুরুপক্ষের তেমন ক্ষতি করতে পারল না। এদিকে স্বয়ং দ্রোণাচার্য ক্রমাগত তীক্ষ্ণ-তীব্র বাণ নিক্ষেপ করেও যুধিষ্ঠিরের নাগাল পেলেন না।
এইভাবে কুরুক্ষেত্রজুড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকল।
একদিকে ভীমের সঙ্গে শল্যের অন্যদিকে কর্ণপুত্র বৃষসেনের সঙ্গে নকুলপুত্র শতানিকের মরণপণ যুদ্ধ শুরু হলো। ভীমের গদাঘাতে শল্যের রথ চুরমার হলে শল্য প্রাণ নিয়ে পালাল। শতানিকের সঙ্গে দ্রৌপদীর অপর চার পুত্র এসে যুক্ত হলো। তাতে বৃষসেন অস্ত্রাহত হতে থাকল। তাকে রক্ষা করবার জন্য মহাবীর অশ্বত্থামা সদর্পে এগিয়ে এলো। এইভাবে দেব-দানবের যুদ্ধের মতো কুরু-পাণ্ডবের সংগ্রাম চলতে লাগল।
একটা সময়ে পাণ্ডবসেনাদের ভেদ করতে সক্ষম হলেন দ্রোণাচার্য, যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন তিনি। দুর্বারবেগে যুধিষ্ঠিরের দিকে শর নিক্ষেপ করে যেতে লাগলেন দ্রোণ। তীক্ষ্ণ আক্রমণে যুধিষ্ঠির তখন কাবু কাবু। দুর্যোধনের বাসনা পূরণ হতে যাওয়ার মুখেই অর্জুন অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দ্রোণের রথের সামনে এসে উপস্থিত হলো।
ঠিক এই সময় দ্রোণের বাণের গতি ও তীক্ষ্ণতা কমে এলো। প্রিয় শিষ্য যে সামনে দাঁড়িয়ে! স্নেহের কাছে শপথ ভেসে গেল।
সূর্য অস্তাচলে গেলে সেদিনের যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। একাদশ দিনের যুদ্ধে দ্রোণ পাণ্ডবপক্ষে সিংহসেন, ব্যাঘ্রদত্ত ও যুগন্ধর নামের তিন বীরকে বধ করলেও যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করতে পারলেন না।
বিষণ্ন মনে নিজশিবিরে ফিরে এলেন দ্ৰোণ।
বিব্রত ক্লান্ত দ্রোণ বললেন, ‘অর্জুন যতদিন বেঁচে আছে, যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা অসম্ভব দুর্যোধন।’
পাশেই ছিল ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা। কিছুদিন আগের পরাজয়ের গ্লানি তার বুকের তলায়। অর্জুনের সঙ্গে পূর্বশত্রুতার শোধ নেওয়ার এই তো সময়!
ত্রিগর্তরাজ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আগামী দিনের যুদ্ধে আমি এবং আমার ভাইয়েরা অর্জুনকে আহ্বান করব। কালকের যুদ্ধে পৃথিবী হয় অর্জুনশূন্য হবে, নয় ত্রিগর্তশূন্য হবে। ও হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে মালব, মালেক, ললিখ ও মদ্রক বীরেরা। আপনারা জানেন, এই সম্মিলিত বাহিনীর নাম সংশপ্তক বাহিনী। কাল আমাদের হাত থেকে অর্জুনের নিস্তার নেই।’
সুশর্মার কথা শুনে দুর্যোধন উজ্জীবিত হয়ে উঠল।
পরের দিনের যুদ্ধপরিকল্পনা সম্পন্ন করে নিজের শয়নশিবিরের দিকে এগিয়ে গেল দুর্যোধন।
একান্ন
যুদ্ধ বড় মারাত্মক। জীবননাশী। যুদ্ধে সব কিছু তছনছ। যুদ্ধ মানে বিশৃঙ্খলা, পাগলামি, উদাসীনতা যুদ্ধে ন্যায়নীতি, মানবতা, ধর্মবোধ—এসবের বিপরীত দিকের জয়গান। একটি যুদ্ধ শুধু সেই দেশের সমস্যা নয়, যুদ্ধজড়িত সৈনিকদের সমস্যা নয়। সেই যুদ্ধজড়িত দেশটির প্রতিবেশী দেশগুলোরও সমস্যা, সাধারণ মানুষদেরও জীবনসংকট।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটিও শেষ পর্যন্ত কুরু-পাণ্ডব নামের দুই জ্ঞাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতবর্ষের প্রায় সকল রাজা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। রাজা জড়ালে সাধারণ মানুষদেরও যুদ্ধসংকট থেকে দূরে থাকার উপায় নেই। যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটাবার জন্য সাধারণ প্রজাদের অতিরিক্ত কর দিতে হয়। অতিরিক্ত করের ভারে জনগণের জীবনে অভাব ঢুকে পড়ে। অভাবে জর্জরিত মানুষদের জীবন থেকে সকল প্রকার সুখ ও স্বস্তি তিরোহিত হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হয়েছেও তা-ই। প্ৰত্যক্ষে বা পরোক্ষে ভারতবর্ষের সমগ্র মানবসমাজ এই যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং সর্বস্বান্ত হয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের একাদশ দিনের যুদ্ধ শেষ হলো। একদিনের যুদ্ধ শেষ হয় পরের দিনের যুদ্ধ আরম্ভ করার জন্য। প্রতিদিনের যুদ্ধে শত সহস্র সৈন্য মারা যেতে লাগল। বড় বড় যোদ্ধারা ভূপতিত হতে থাকল। তারই মধ্যে উভয় পক্ষের রণহুঙ্কার, আনন্দের সিংহনাদ, বিষাদের কাতরধ্বনি, বিচিত্র রণবাদ্যের সমবেত ঐকতান, ধনুকের টঙ্কার, গদার ঘর্ষণধ্বনি, মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকের আর্তনাদ শোনা যেতে লাগল। মনুষ্যরক্তে গোটা কুরুক্ষেত্র ভিজে গেল। থরে থরে নিহত মানুষ, অশ্ব, হস্তীর দেহস্তূপ। উৎকট দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। শত শত কুকুর-শেয়াল আর সহস্র সহস্র শকুনির খেয়োখেয়িতে কুরুক্ষেত্রের পরিবেশ হয়ে গেছে বীভৎস এবং উৎকণ্ঠাময়।
এসবের মধ্যেই দ্বাদশ দিনের যুদ্ধ শুরু হলো।
যুদ্ধের শুরুতে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান জানাল। তার সঙ্গে তখন তার পাঁচ ভাই এবং বিশাল সংশপ্তকবাহিনী। আহ্বান করেই পূর্ব পরিকল্পনানুসারে কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রান্তে সরে গেল সুশর্মা।
যুধিষ্ঠিরকে পঞ্চালরাজকুমার সত্যজিতের তত্ত্বাবধানে রেখে সুশর্মার পশ্চাদ্গামী হলো অর্জুন।
অর্জুন ত্রিগর্তরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হলে দ্রোণ গরুড়ব্যূহ রচনা করে যুধিষ্ঠিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেল যুধিষ্ঠির। ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রুত এর প্রতিবিধান করতে বলল। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের সম্মুখভাগে গিয়ে দাঁড়াল এবং দ্রোণকে লক্ষ্য করে বেগবান তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। দ্রোণ বাণের জবাব দেওয়ার আগে ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্মুখ ধৃষ্টদ্যুম্নের আক্রমণের জবাব দিল। তীব্র বাণাঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রুখে দিল দুর্মুখ। এই অবসরে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করে বসলেন। অস্ত্রগুরুর ভয়ংকর আক্রমণে যুধিষ্ঠিরবাহিনী ছত্রখান হয়ে গেল। যুধিষ্ঠির সমরক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচল।
ওদিকে সংশপ্তকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পাণ্ডববাহিনীর আর্তনাদ শুনতে পেল অর্জুন। কৌরবপক্ষের গজারোহী বীর ভগদত্ত তখন পাণ্ডবসৈন্যদের লণ্ডভণ্ড করছিল। অর্জুন ভগদত্তের গজের দিকে রথ নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষ্ণকে অনুরোধ করল। ঘোরতর যুদ্ধে অর্জুন ভগদত্তকে যমালয়ে পাঠাল।
.
ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ ভয়াবহ এবং হৃদয়বিদারক। এইদিন দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ রচনা করলেন। এ এক মরণফাঁদ। এই ব্যূহে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরোনোর কৌশল না জানলে মৃত্যু নিশ্চিত। দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপাচার্য, দুঃশাসন, শল্য, শকুনি ও ভূরিশ্রবাকে চক্রব্যূহের দায়িত্ব দিলেন দ্রোণ।
চক্রব্যূহে চক্রাকারে সৈন্য সমাবিষ্ট থাকে এবং প্রবেশের একটিমাত্র পথ থাকে। পাণ্ডবপক্ষে এই ব্যূহ ভেদ করার উপায় জানে মাত্র চারজন বীর—অর্জুন, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন এবং অর্জুনতনয় কিশোর অভিমন্যু। প্রথম তিনজন সেই সময় ওই স্থানে অনুপস্থিত। অভিমন্যু ওই ব্যূহে ঢুকতে জানে, বেরিয়ে আসার উপায় জানে না।
যুধিষ্ঠির এই অভিমন্যুকেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করার আদেশ দিল। যুধিষ্ঠিরের আদেশে অভিমন্যু চক্রব্যূহে ঢুকে গেল ঠিক, কিন্তু প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারল না। সেই ব্যূহের মধ্যেই হত্যা করা হলো তাকে। ব্যূহের মধ্যে আহত অভিমন্যু একা যখন বীরবিক্রমে কুরুপক্ষের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিল, তখন যুধিষ্ঠির, ভীম, শিখণ্ডী, সাত্যকি, নকুল-সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্ৰুপদ, ধৃষ্টকেতু—কেউই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারেননি। কর্ণাদি সপ্তরথীরা চক্রব্যূহের সম্মুখভাগকে দুর্ভেদ্য করে তুলেছিল তখন।
চক্রব্যূহের মধ্যিখানে শেষ যুদ্ধটা হয়েছিল দুজনের মধ্যে—দুঃশাসননন্দনে আর অভিমন্যু। দুজনে গদাযুদ্ধে মত্ত। একে অপরকে আঘাত করে যাচ্ছিল। পরস্পরের আঘাতে দুজনেই ধরাশায়ী। প্রথমে দুঃশাসনপুত্র উঠে দাঁড়াল এবং রণক্লান্ত অভিমন্যু উঠে দাঁড়াবার আগেই গদাঘাতে তার মস্তকটি চূর্ণ করে দিল দুঃশাসননন্দন।
অভিমন্যুর নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ শেষ হলো।
.
ওই রাতেই অর্জুন প্রতিজ্ঞা করল—তার পুত্র অভিমন্যুহত্যার প্রতিশোধ নেবে। হত্যা করবে জয়দ্রথকে। আগামীদিন সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ করতে না পারলে অর্জুন স্বয়ং অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জন দেবে। অর্জুন মনে করেছে, তার পুত্র অভিমন্যুর নির্মম হত্যার জন্য জয়দ্রথই দায়ী।
গুপ্তচরমুখে অর্জুনের প্রতিজ্ঞার কথা কুরুশিবিরে পৌছে গেল।
জয়দ্রথহত্যাই চতুর্দশ দিনের যুদ্ধের মুখ্য ঘটনা হয়ে গেল। এই দিনের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য অতুলনীয় পরাক্রম দেখালেন। তিনি পাণ্ডবসৈন্যদের নির্বিচারে হত্যা করে গেলেন। তাঁর তাণ্ডব দেখে পাণ্ডবসৈন্যরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দ্রোণকে প্রতিহত করার জন্য ভীম এগিয়ে এলো। কর্ণ ভীমের গতিরোধ করে দাঁড়াল।
এইভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল, কিন্তু অর্জুন জয়দ্রথের নাগাল পেল না। কৌরবরা ভগ্নিপতি জয়দ্রথকে সেদিন বিশেষ সুরক্ষা দিল। কৃষ্ণ-অর্জুন বুঝে গেল—জয়দ্রথকে বধ করা নিতান্ত দুরূহ ব্যাপার।
ভেঙে পড়ল অর্জুন।
কৃষ্ণ বলল, ‘আমার ওপর ভরসা রাখো।’
অর্জুন বলল, ‘কী ভরসা রাখব দাদা তোমার ওপর? আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? সূর্যদেবের অস্তাচলে যেতে খুব বেশি দেরি নেই। শেষ পর্যন্ত আমাকেই না অগ্নিতে প্রবেশ করতে হয়!
‘তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের কারো মধ্যে ধৈর্য জিনিসটা নেই। আর কাউকে বিশ্বাস করতে শেখোনি তোমরা।’
‘এভাবে বলছ কেন দাদা?’
ধমকে উঠল কৃষ্ণ, ‘আমার ওপর ভরসা রাখো অর্জুন। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।
ধমক খেয়ে চুপসে গেল অর্জুন।
যতই বলা হোক কুরুপক্ষ সত্যনিষ্ঠ নয়। তারা অধার্মিক, অন্যায়কারী। কিন্তু পাণ্ডবরা কি সর্বদা ধর্ম ও ন্যায়ের পথে থেকেছে? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিশ্বাসঘাতকতা আর অধার্মিকতা কৌরবদের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে। পাণ্ডবপক্ষে যত অন্যায়, দুর্নীতি ও ছলচাতুরী হয়েছে, তাদের অধিকাংশই করেছে কৃষ্ণ। কৃষ্ণ অন্যায়বাজি না করলে পাণ্ডবরা জয়ের মুখ দেখত কিনা সন্দেহ।
জয়দ্রথের হত্যার পেছনেও কৃষ্ণের অপকৌশল ছিল। ছলনায় ফাঁদে ফেলে জয়দ্রথকে বধ করিয়েছে কৃষ্ণ।
এই সময় অস্তাচলমুখী সূর্য হঠাৎ গভীর ঘন মেঘে আবৃত হয়ে গেল। মেঘের পরত এত পুরু ছিল যে সূর্যের সমস্ত আলোকে গিলে খেল মেঘখণ্ডটি। অন্ধকার ছেয়ে ফেলল কুরুক্ষেত্রকে। সবাই ভাবল—সূর্যদেব বুঝি অস্ত গেছেন।
কৃষ্ণ আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘হায় হায় অর্জুন! তুমি কী ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করলে! জয়দ্রথকে হত্যা করা দূরে থাক, এখন তো তোমাকেই অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে!’
কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের চোখাচোখি হলো। উভয়ের চোখে ধূর্ততা।
যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই অগ্নিকুণ্ড সাজানো হলো। ওই অগ্নিকুণ্ডে অর্জুন প্রাণ বিসর্জন দেবে।
পাণ্ডবপক্ষ মর্মাহত ও কৌরবপক্ষ কৌতূহলী হলো। সবাই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের নিকটে চলে এলো।
জয়দ্রথও নিজের কৌতূহলকে দমন করে রাখতে পারল না। কর্ণ আর দুর্যোধনের নিষেধকে অগ্রাহ্য করে অর্জুনের আত্মহননদৃশ্য দেখতে এলো।
ঠিক ওই সময়েই সূর্যের সামনে থেকে মেঘখণ্ডটি সরে গেল। রৌদ্র ঝকমক করে উঠল। অর্জুন প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। দিব্যাস্ত্রের আঘাতে জয়দ্রথের মাথাটি ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল অর্জুন।
কৌরবপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ওই বিকেলেই দ্রোণাচার্য ঘোষণা করলেন—যুদ্ধ বন্ধ হবে না। রাতদিন যুদ্ধ চলবে।
মরণপণ যুদ্ধ অব্যাহত থাকল।
চতুর্দশ দিনের রাত্রিকালীন যুদ্ধটা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠল। রাত্রির যুদ্ধে ভীম ধৃতরাষ্ট্রের নয় পুত্রকে হত্যা করল। কর্ণের ভাই বৃকরথ, শকুনির পাঁচ ভাই ভীমের হাতে নিহত হলো। রাতেও দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের পিছু ছাড়েননি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ্য করে বায়ব্য, বারুণ, যাম্য, আগ্নেয়, ত্বাষ্ট্র, সাবিত্র প্রভৃতি অস্ত্র নিক্ষেপ করেও তাকে কাবু করতে পারলেন না। দ্রুপদসেনারা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে দ্রোণ ওদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন।
রজনী গভীর হলে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল। সামান্য তফাতেও শত্রুকে দেখা যাচ্ছিল না। দুর্যোধন তার পদাতিক সেনাদের অস্ত্রত্যাগ করে মশাল জ্বালাতে বলল। পাণ্ডবপদাতিকরাও মশাল জ্বালাল। মশালের আলোতে কুরুক্ষেত্র আলোকময় হয়ে উঠল।
ভীমের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্যোধন। উভয়ের মধ্যে ধনুর্বাণ, শক্তি, গদা নিয়ে যুদ্ধ চলতে লাগল।
হঠাৎ কর্ণের রথের সম্মুখে পড়ে গেল সহদেব। কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পঞ্চালদেশীয় এক বীরের রথে করে সহদেব পালিয়ে বাঁচল।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে দ্রোণের ঘোরতর যুদ্ধ চলতে লাগল। সাত্যকির পরাক্রমে কৌরবসেনারা দুর্বিপাকে পড়ে গেল। সাত্যকির দাপটে কুরুসেনারা পিছু হটতে শুরু করলে দুর্যোধন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। সাত্যকির সামনে দুর্যোধন বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। কৃষ্ণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডীর শঙ্খনিনাদে চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকল।
দুর্যোধন নিজসৈন্যদের নাজেহাল অবস্থা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ-দ্রোণের কাছে গিয়ে ক্ষোভ জানাল। কর্ণ-দ্রোণ নব-উদ্যমে শক্রনিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁদের বাণাঘাতে পাণ্ডবসেনারা পালাতে শুরু করল। কর্ণ-দ্রোণ ক্রমাগত সহস্ৰ সহস্ৰ পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে থাকলে কৃষ্ণ-অর্জুন আতঙ্কিত হয়ে উঠল। রাতের যুদ্ধে কর্ণ অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
ক্ষুব্ধ হয়ে অর্জুন তার সারথিকে বলল, ‘তুমি এখনই আমার রথটিকে কর্ণের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাও। তার সঙ্গে যুদ্ধ করব আমি।’
কৃষ্ণ বলল, ‘এখনো সময় হয়নি।’
ভ্রু কুঁচকে অর্জুন বলল,
‘মানে!’
‘এই মুহূর্তে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।’ কৃষ্ণের চাপা গলা।
মিনমিনে গলায় অর্জুন বলল, ‘কেন?’
‘ওর হাতে এখনো ইন্দ্রদত্ত একপুরুষঘাতিনী শক্তিশেলটি আছে। ওটি তোমারই জন্য জমা রেখেছে কর্ণ। ওই শক্তিশেলের আঘাতে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।’
‘তাহলে উপায়!’
‘উপায় তো একটা আছেই! বলছি।’ দম নিল কৃষ্ণ। ‘ভীমপুত্র ঘটোৎকচকে পাঠাও কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। ঘটোৎকচ দিব্য, আসুর ও রাক্ষস—এই প্রকার অস্ত্রে পারদর্শী। তাকে দমন করতে কর্ণের কালঘাম বেরিয়ে যাবে।’
অর্জুনকে কর্ণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ঘটোৎকচকে কর্ণের সামনে ঠেলে দিল কৃষ্ণ। সে জানে-কর্ণের হাতে ঘটোৎকচের প্রাণ যাবে।
বায়ান্ন
ঘটোৎকচ মধ্যমপাণ্ডব ভীমের পুত্র। হিড়িম্বা রাক্ষসীর গর্ভে জন্ম তার। শয্যাসঙ্গিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভীমের কোনো শূচিবায়ু ছিল না। কাম প্রশমনের জন্য নারী হলেই হলো—সে আর্য বা অনাৰ্য যা- ই হোক না কেন! ভীমের এই রুচিরই ফল ঘটোৎকচ।
ঘটোৎকচ ভীমের মতোই শক্তিশালী। চেহারা আর্যজনোচিত নয়। তার চেহারা স্বাভাবিকের তুলনায় বিশাল। মুখখানি বিরূপ ও প্রশস্ত। চোখ দুটো মনুষ্যোচিত নয়। কণ্ঠস্বর ভয়াল। ঠোঁট দুটো তাম্রবর্ণ। দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ দাঁত। গায়ের মাংসপেশিগুলো স্থানে স্থানে বক্র ও মাংসল।
অপরিসীম বলশালী এই ঘটোৎকচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করেছে। তার সঙ্গে ছিল বিশাল দুর্দমনীয় এক রাক্ষসবাহিনী। এই বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল এক অক্ষৌহিণী।
ঘটোৎকচের রথ ছিল ইস্পাত নির্মিত। রথের বাহক হাতিও নয়, ঘোড়াও নয়। হাতি ও ঘোড়ার মাঝামাঝি ধরনের একপ্রকার পশু ঘটোৎকচের রথ টানে। দিনের চেয়ে রাতের যুদ্ধে ঘটোৎকচ ভীষণ দক্ষ। রাক্ষসরা দিনের চেয়ে রাতে স্বাভাবিক বেশি। রাতের বেলায় তাদের দৃষ্টি প্রখর ও দূরগামী।
এই ঘটোৎকচ চতুৰ্দশ দিনের রাত্রিযুদ্ধে ভয়ংকর হয়ে উঠল। ওই রাতেই সে অলায়ুধ নামের এক কুরুপক্ষীয় রাক্ষসবীরকে বধ করে। তার হিংস্রতা, যুদ্ধপটুতা দেখে দুর্যোধন ভয় পেয়ে যায়।
দ্রুত কর্ণের কাছে গিয়ে সানুনয়ে বলে, ‘বন্ধু, ওই রাক্ষসটার হাত থেকে কুরুসেনাদের বাঁচাও।’
কর্ণের আহ্বানে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল না কর্ণ। কী যেন ভাবতে থাকল।
যুদ্ধরত ঘটোৎকচের কাছে তখন কৃষ্ণের বার্তা পৌঁছে গেছে। দূত এসে জানিয়ে গেছে—কর্ণকে আজ ধরাশায়ী করা চাই। পাণ্ডবরা বিশ্বাস করে, একমাত্র তুমিই পারবে কর্ণকে হত্যা করতে।
প্রবল উদ্দীপনায় উন্মত্ত হয়ে উঠল ঘটোৎকচ। সসৈন্যে মারমুখী ঘটোৎকচ কর্ণের নিকটে চলে এলো। কর্ণ ধনুকটি হাতে তুলে নিল।
ভীতিজাগানিয়া কোলাহলের মধ্যে দুর্যোধন গলা ফাটিয়ে বলে উঠল, ‘এ যেনতেন যোদ্ধা নয় কর্ণ। ভীমপুত্র ঘটোৎকচ এ। আসুরিক শক্তি তার দেহে। দেখতে বীভৎস, যুদ্ধে ভয়াল। নানা রকম
অস্ত্র তার হস্তগত। মায়া জানে সে। সাবধান বন্ধু।’ দুর্যোধনের শেষের দিকের কথাগুলো প্রচণ্ড শোরগোলের মধ্যে হারিয়ে গেল।
কর্ণের সঙ্গে ঘটোৎকচের অতি ভয়ংকর এক যুদ্ধ আরম্ভ হলো। এই দুই বীরের যুদ্ধ দেখে সকলে ভীত হয়ে পড়ল। ঘটোৎকচের অস্ত্রপারদর্শিতা পাণ্ডবদের উৎফুল্ল করে তুলল। তার সমরকুশলতা দেখে কৌরবরা কর্ণের জীবন সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে উঠল।
কর্ণ সংশয়হীন সমরবিদ। চোখা চোখা অস্ত্রাঘাতে সে ঘটোৎকচকে বিদীর্ণ করতে থাকল। ঘটোৎকচও পিছিয়ে যাওয়ার নয়। সে আরও ভয়ংকর, নির্মম ও জিঘাংসু হয়ে উঠল। একটা সময়ে ঘটোৎকচের অস্ত্রাঘাতে অতিষ্ঠ হয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো কর্ণ। এই সময় কুরুসেনারা ঘটোৎকচকে ঘিরে ধরল। ঘটোৎকচ তখন বেপরোয়া। হত্যাই যেন তার মূলমন্ত্র, নিষ্ঠুরতাই যেন তার চারিত্র্য। শত শত কৌরবসেনাকে সে হত্যা করে যেতে লাগল। তা দেখে দুর্যোধন ভড়কে গেল ভীষণ। ঘটোৎকচকে না থামালে আজই বুঝি কৌরবদের পরাজয় হবে—দ্রুত ভেবে গেল দুর্যোধন।
কর্ণের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো দুর্যোধন, ‘তুমি আমাদের বাঁচাও কৰ্ণ।’
‘কী হলো। এরকম করে ভেঙে পড়লে কেন?’
‘ঘটোৎকচের উন্মত্ত চেহারা দেখে এলাম। নির্বিচারে আমাদের সেনাদের হত্যা করে যাচ্ছে। তাকে থামাও কর্ণ। নইলে আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে আজ।’
এই সময় পর্যুদস্ত কৌরবসেনারা মরণচিৎকার দিয়ে উঠল
দুর্যোধন বলল, ‘ওই শোনো, আমাদের সেনাদের আর্তনাদ। ঘটোৎকচ তাদের বধ করছে কর্ণ। তার হাত থেকে আমাদের সেনাদের রক্ষা করো।’
দুর্যোধনের সানুনয়েও কর্ণ নড়ল না। রথের ওপর বসে থাকল।
দুর্যোধন বলল, ‘তুমি কিছু করছ না যে কর্ণ?’
‘কী করব?’ কাতর গলা কর্ণের।
‘ঘটোৎকচকে হত্যা করো।’
‘এতক্ষণ চেষ্টা করেছি। ঘটোৎকচ অবধ্যপ্ৰায়।’
উপহাস ঝরে পড়ল দুর্যোধনের কণ্ঠ থেকে, ‘অবধ্য! তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ। কত মারাত্মক অস্ত্র তোমার জানা! আর সেই তুমি বলছ, একজন সাধারণ রাক্ষস তোমার অবধ্য!’
‘অনেক অস্ত্র প্রয়োগ করেছি তার ওপর। কোনোটার আঘাত সয়ে নিয়েছে, অধিকাংশ অস্ত্র মধ্যপথে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি নিরুপায় দুর্যোধন।’
‘নিরুপায় বললে তো চলবে না বন্ধু। তোমার কাছে ঘটোৎকচকে নিধন করার অস্ত্র তো আছে।’
‘নিধন করার অস্ত্র আছে! কোন অস্ত্রের কথা বলছ তুমি।’
‘দেবরাজ ইন্দ্র প্রদত্ত অমোঘ শক্তিশেল। একবীরঘাতিনী যার নাম।’
‘এ কী বলছ তুমি দুর্যোধন!’ কর্ণের অক্ষিবলয় বেরিয়ে আসতে চাইল। ‘এই অস্ত্র আমি পরম যত্নে রক্ষা করে যাচ্ছি অর্জুনের জন্য। এর আঘাতেই আমি অর্জুনের ভবলীলা সাঙ্গ করব।’
‘এখন অর্জুনের কথা থাক কৰ্ণ। এই মুহূর্তে ঘটোৎকচের কথা ভাব। ওকে বধ না করলে আজ রাতে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত।’
‘কী করতে বলো তুমি?’
‘ওই একবীরঘাতিনী শক্তিশেলটি দিয়ে রাক্ষসটাকে যমালয়ে পাঠাও।’ হাঁপাচ্ছে দুর্যোধন।
‘তা হয় না।’ ধীরস্থির কর্ণ।
বিচূর্ণ কণ্ঠে দুর্যোধন বলে, ‘হয় হয় বন্ধু। আমি আমার বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বলছি—তুমি ওই অস্ত্র দিয়ে ঘটোৎকচকে হত্যা করো।’
‘তাহলে অর্জুন! অর্জুনকে কী দিয়ে বধ করব আমি?’
‘ভীম-অর্জুন কিছুই করতে পারবে না আমাদের। তাদের যুদ্ধ করে হারাব আমরা। আপাতত তুমি শক্তিশেলটা ঘটোৎকচের ওপর নিক্ষেপ করো।
দুর্যোধনের আর্ত-অনুরোধ আর কুরুসৈন্যদের কাতরতা শুনে কর্ণ তার সিদ্ধান্ত পাল্টাল। একবীরঘাতিনী অস্ত্রটি নিয়ে ঘটোৎকচের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো।
কর্ণের হাতে শক্তিশেলটি দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল ঘটোৎকচ। ওই অস্ত্রের মধ্যে নিজের মৃত্যুকে দেখতে পেল সে। পালাতে উদ্যত হলো ঘটোৎকচ।
কিন্তু তার আগেই কর্ণ শক্তিশেলটি নিক্ষেপ করে ফেলেছে। অচিরেই সেই একবীরঘাতিনী শক্তিশেলটি ঘটোৎকচের বুক বিদীর্ণ করে নক্ষত্রমণ্ডলে মিশে গেল।
ঘটোৎকচের মৃত্যু হলো, অর্জুন জীবন পেয়ে গেল।
.
চতুর্দশ দিবসের দিনরাত্রিব্যাপী যুদ্ধ শেষ হলো না। পঞ্চদশ দিবসে তা প্রসারিত হলো। সূর্যপ্রণামের নিমিত্ত যুদ্ধ সামান্য সময়ের জন্য স্থগিত হলো শুধু, বন্দনাশেষে মরণঘাতী যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলো। পিতামহ ভীষ্ম তখনো জীবিত। শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে নির্বাক চোখে পৌত্রদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখে যেতে লাগলেন তিনি। নিয়তির বিধানে ওই অবস্থাতেই তাঁকে আটান্ন দিন বেঁচে থাকতে হবে।
সকাল হতে না হতেই মৎস্যরাজ বিরাট আর পঞ্চালরাজ দ্রুপদ দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করে বসলেন। দ্রোণাচার্য তিনটি তীক্ষ্ণ বাণে প্রথমে দ্রুপদের তিন পৌত্রকে যমালয়ে পাঠালেন। এতে প্রচণ্ড বিক্রমে দ্রুপদ ও বিরাট দ্রোণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দ্রোণ আজ হিংস্র। তিনি ভয়ংকর পরাক্রমে বিরাট ও দ্রুপদকে হত্যা করলেন।
এই সংবাদে পাণ্ডবশিবিরে হতাশা নেমে এলো। পঞ্চালসেনারা পালাতে শুরু করল।
এতে ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। বিশালবাহিনী নিয়ে দ্রোণকে ঘিরে ফেলল। তা দেখে দুর্যোধন, শকুনি দ্রোণকে রক্ষার জন্য এগিয়ে গেল। এই সময় ভীম এসে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে যোগ দিল।
দ্রোণ-অর্জুনের এই দিনের যুদ্ধটা ছিল বিচিত্র ও দর্শনীয়। দ্রোণ যে বাণই নিক্ষেপ করেন, অর্জুন অনায়াসে সেই বাণ খণ্ডন করে। ঐন্দ্র, পাশুপত, ত্বাষ্ট্র, বায়ব্য, বারণ— দ্রোণের সকল অস্ত্রই অর্জুন নিরাকৃত করল। হয়তো নিক্ষেপিত অস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্রগুরুর স্নেহটা যুক্ত ছিল বলে অস্ত্রগুলো অর্জুনের কোনো ক্ষতি করতে পারল না।
এই সময় দ্রোণাচার্যের বয়স পঁচাশি বছর। তা সত্ত্বেও দ্রোণ এই দিনের যুদ্ধে ভয়ংকর ও দুর্দমনীয় হয়ে রইলেন। তাঁকে কোনোক্রমেই কাবু করা যাচ্ছিল না। আবার তাঁকে অতিক্ৰম না করে কুরুসেনাদের কাছেও পৌঁছানো যাচ্ছিল না। দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে কৌরবদের আড়াল করে থাকলেন দ্রোণাচার্য।
তা দেখে কৃষ্ণের মনে দুষ্টবুদ্ধি আবার কিলবিলিয়ে উঠল। মিথ্যে বলে দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করাতে হবে। নইলে আরও অজস্র অজস্র পাণ্ডবসৈন্য প্রাণ হারাবে দ্রোণের হাতে। তাতে পাণ্ডবদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে। না না, তা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। অধর্মের জয় কিছুতেই মেনে নেব না আমি—মনে মনে ভেবে গেল কৃষ্ণ।
তারপর দ্রোণহত্যার সিদ্ধান্তটি দ্রুত নিয়ে ফেলল। শক্তি দিয়ে দ্রোণকে কাত করা যাবে না, মিথ্যে দিয়েই তাঁকে কুপোকাত করতে হবে। দ্রোণকে গিয়ে বলতে হবে তাঁর প্রিয়পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু হয়েছে। তাতেই পুত্রশোকে কাতর হয়ে পড়বেন তিনি। তারপর কী করা হবে, তা কৃষ্ণের মগজেই থাকল। প্রথম কাজটি হলো মিথ্যে কথাটি দ্রোণকে বিশ্বাস করানো। দ্রোণ জানেন, তাঁর পুত্র অমর। তার মৃত্যুসংবাদ দ্রোণ বিশ্বাস করবেন না কিছুতেই। কিন্তু একজন বললে বিশ্বাস করবেন, সে যুধিষ্ঠির। কিন্তু যুধিষ্ঠির মিথ্যে বলতে রাজি নয়।
পরাজয়ের ভয় দেখিয়ে, দ্রৌপদী-লাঞ্ছনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে, বনবাসে অসহায় জীবনযাপনের কথা বলে কৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরকে অর্ধমিথ্যে বলার জন্য নমনীয় করাল।
কিছুক্ষণ আগে ভীম গদাঘাতে অশ্বত্থামা নামের এক হস্তীকে নিধন করেছে।
কৃষ্ণ বলল, ‘দাদা, তোমার গোটা মিথ্যে বলার দরকার নেই। অর্ধেক মিথ্যে বলবে দ্রোণের সামনে গিয়ে।’
‘অর্ধমিথ্যে বলব!’ ব্যাকুল চোখমুখ যুধিষ্ঠিরের।
‘হ্যাঁ, অর্ধমিথ্যে বললে চলবে। তুমি তো জানো, ভীম অশ্বত্থামা নামের একটা হাতিকে বধ করেছে। ওরই সূত্র ধরে বলবে—গুরুদেব, অশ্বত্থামা হত হয়েছে। তারপর স্বগত কণ্ঠে বলবে, এই অশ্বত্থামা একটা হাতির নাম।’
‘তাতে কী হবে?’
‘তাতে আমাদের কাজ হয়ে যাবে। পরের ঘটনা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না দাদা। পরের পরিকল্পনাটা আমার মাথার মধ্যে সাজানো। ওইটুকু বলেই তুমি দ্রোণাচার্যের সামনে থেকে সরে পড়বে।’
তার পরও যুধিষ্ঠিরের দোনামনা যায় না। বিবাগী উদাসী মুখ নিয়ে চুপ করে থাকে। সবাই বুঝল—যুধিষ্ঠিরের দ্বিধা কাটছে না। মিথ্যে বলার দ্বিধা আর গুরুকে বিত্রস্ত করে তোলার পাপবোধ তাকে ম্রিয়মাণ করে রেখেছে।
এই সময় ভীম বলল, ‘তুমি যদি এই মিথ্যেটা না বলো দাদা, তাহলে দ্রোণাচার্যের হাতে আমরা সবংশে নিহত হব। তুমি দেখো গিয়ে কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছেন দ্রোণ! আর দুই প্রহরের মধ্যেই সম্পূর্ণ পাণ্ডবসেনা তাঁর হাতে নিহত হবে।’
কৃষ্ণ বলল, ‘তুমি রাজি হয়ে যাও দাদা, সামান্য এইটুকু তো মিথ্যে কথা! মাত্র দুটো লাইন—প্রথম লাইনটা মিথ্যে, একটু জোরে বলবে। দ্বিতীয় লাইনটি সত্য, কিন্তু একটু আস্তে বলবে, যাতে আচার্য শুনত না পান। তাতে গোটা পাণ্ডবপক্ষ বেঁচে যাবে দাদা।’
তিপ্পান্ন
যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কথার প্যাচে বিভ্রান্ত হলো এবং দ্রোণের সামনে গিয়ে মিথ্যে কথাটি বলতে সম্মত হয়ে গেল।
দ্রোণাচার্য তখন যুদ্ধমগ্ন। হিংস্র, কঠোর, মারণ-উন্মুখ। হত্যালীলায় উন্মত্ত তখন গুরুদেব।
যুধিষ্ঠিরের রথটি দ্রোণের রথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
কোনো ভূমিকা ছাড়া চোখ বুজে যুধিষ্ঠির জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে।’
তারপর মৃদু স্বরে বলল, ‘হাতি।’
‘অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে—এই বাক্যটি যুধিষ্ঠির এত উচ্চৈঃস্বরে বলল যে শতসহস্র কণ্ঠের কোলাহলকে ছাপিয়ে কথাটা দ্রোণের কানে পৌছে গেল। আর ‘হাতি’ শব্দটি শোরগোলের মধ্যে হারিয়ে গেল।
দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের ঘোষণাটি শুনেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন। বিশ্বাস করবেন না-ই-বা কেন, যুধিষ্ঠিরকে তো মিথ্যে বলতে দেখেননি কোনোদিন গুরুদেব! স্বয়ং কৃষ্ণ বা পিতামহ ভীষ্ম এসে এই কথাটি বললে বিশ্বাস করতেন না তিনি। কিন্তু যুধিষ্ঠির যে তাঁর কাছে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!
পুত্রনিধনের সংবাদ শুনে নিতান্ত কাতর হয়ে পড়লেন আচার্য। অস্ত্রত্যাগের কথা ভাবলেন। অস্ত্রত্যাগ করতে যাবেন, ঠিক ওই মুহূর্তে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে আক্রমণ করে বসল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন দ্রোণ।
তা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল ভীম। তাহলে কি অস্ত্রগুরুকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করা গেল না! কৃষ্ণের সঙ্গে থেকে থেকে কূটকৌশলগুলো তারও কম জানা হয়ে ওঠেনি।
ভীম চাতুরীর আশ্রয় নিল।
কৃত্রিম কঠোর কণ্ঠে সে দ্রোণকে উদ্দেশ করে বলল, ‘গুরুদেব, আপনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হয়েও ব্যাধের মতো আচরণ করছেন। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন আপনি! কেমন পিতা আপনি? নিজের পুত্রের জন্য কাতর হন না!’
ভীমের কথা দ্রোণের মরমে আঘাত করল। তৎক্ষণাৎই অস্ত্র ত্যাগ করলেন তিনি এবং ম্রিয়মাণ হয়ে রথোপরে বসে পড়লেন।
ওই সময় তরবারি হাতে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের দিকে ধেয়ে গেল এবং ওই অবস্থাতেই দ্রোণকে হত্যা করল ধৃষ্টদ্যুম্ন।
সেদিনের যুদ্ধ সেখানেই শেষ হলো।
আচার্যের নিধনে কৌরবশিবিরে বিপর্যয়ের মস্তবড় ঢেউ আছড়ে পড়ল। অত্যন্ত শোকমগ্ন হয়ে পড়ল তারা। দুর্যোধনের চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরে যেতে লাগল। তাকে ঘিরে সবাই ব্যাকুল কণ্ঠে বিলাপ করতে থাকল।
মিথ্যেকে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে পাণ্ডবরা। দ্রোণাচার্যহত্যার সময় ন্যায়বোধ, ধর্মনীতি, মানবতা তাদের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কৃষ্ণের মতো সত্য ও ন্যায়ের ধ্বজাধারী এই মিথ্যের ফাঁদ তৈরি করবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচিত করেছে। শুধু প্ররোচিত করা তো নয়, রীতিমতো ভয় দেখিয়ে মিথ্যে বলাতে বাধ্য করেছে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে! কুরুবৃদ্ধদের মধ্যে এই দ্রোণাচার্যের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী আর প্রিয়জন, ভীষ্ম ছাড়া আর তো তেমন কেউ ছিলেন না পাণ্ডবদের! নিজেদের স্বার্থের জন্য, শুধু নিজেদের জয়ের জন্য এরকম একজন অকৃত্রিম সুহৃদের মাথা কেটে নামাতে দ্বিধা করল না পাণ্ডবরা! এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দুর্যোধনের শোক স্তিমিত হয়ে এলো।
.
আগামী দিনের সেনাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করা জরুরি। চোখের জল মুছে সিদ্ধান্তসভায় বসল দুর্যোধন। কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, দুঃশাসন, শকুনি এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বীর এই সভায় উপস্থিত।
‘আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না—শত্রুপক্ষ এসে বলল, আপনার পুত্র নিহত হয়েছে আর অমনি তিনি তা বিশ্বাস করে বসলেন! যাচাই করলেন না যুধিষ্ঠিরের কথাটি সত্য না মিথ্যে! শুধু তো তা-ই নয়, অস্ত্রই ত্যাগ করে রথের ওপর বেজার হয়ে বসে পড়লেন! এই সুযোগটাই তো চাইছিল ধুরন্ধর কৃষ্ণ আর মিথ্যেবাদী যুধিষ্ঠির!’ কর্ণের চোখেমুখে বিরক্তি আর ঘৃণা।
কৃপাচার্য হাততালি দিয়ে উঠলেন, ‘দারুণ বলেছ কর্ণ, দারুণ! তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি, দুর্যোধন এখনো অনাথ নয়। দ্রোণ মরেছেন, কী হয়েছে? তুমি তো আছ—এই-ই বলতে চাইছ তুমি?’
দুঃশাসন বলল, ‘আহা আচার্য, আপনি কর্ণের কথার ওরকম ভুল ব্যাখ্যা করছেন কেন? ও বলতে চাইছে—ওই সময় দ্রোণাচার্যের অস্ত্র ত্যাগ করা উচিত হয়নি।’
‘কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত তা বিচার করার কর্ণ কে?’ কড়া চোখ কৃপাচার্যের।
কৃপাচার্য আবার বললেন, ‘যুদ্ধ করছ করো। মৃত মানুষকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না। তাতে তাঁর আত্মা কষ্ট পাবে। আর শোনো কর্ণ, তর্জন-গর্জন ত্যাগ করো। তোমার ওই বাগাড়ম্বরের কোনো মূল্য নেই। তুমি হারুদলের সর্দার। ক্ষত্রিয়রা বাহুবলে নিজেদের বীরত্ব দেখায়, মুখে নয়। অর্জুন তার ক্ষমতা দেখায় ধনুক দিয়ে, আর তুমি দেখাও মুখে।’
গা জ্বলে উঠল কর্ণের, ‘আমি এত গর্জাচ্ছি, তাতে তোমার কী? তুমি একজন বিটলে বামুন ছাড়া কিছুই তো নও! কবে কোনকালে দু-চারটা অস্ত্রকৌশল শিখেছিলে, তা দিয়ে কুরুবাড়ির শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলে! তোমার বিদ্যার দৌড় আমার জানা নেই ভাবছ?’
মাতুলের প্রতি কর্ণের এই অপমানজনক কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না অশ্বত্থামা, ‘আমি তোর ধড় থেকে মুণ্ড নামিয়ে নেব’ বলতে বলতে খড়্গগ হাতে কর্ণের দিকে ছুটে গেল অশ্বত্থামা।
দুঃশাসন অশ্বত্থামাকে ধরে না ফেললে মস্তবড় দুর্ঘটনা ঘটে যেত।
কৃপাচার্য বললেন, ‘দ্রোণাচার্যের পর সেনাপতি হওয়া উচিত অশ্বত্থামার, অন্য কেউ নয়।’
দুর্যোধন এই প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে মনে মনে কর্ণকে পরবর্তী সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচন করে রেখেছিল। মাঝখানে কৃপাচার্যের প্রস্তাবে সেই সিদ্ধান্তে ঘোঁট পাকিয়ে গেল।
কৃপাচার্য তাঁর কথাকে আরও একটু এগিয়ে নিলেন, ‘পিতাকে অন্যায়ভাবে হারিয়ে ক্রোধে অশ্বত্থামা এখন টগবগ করে ফুটছে। সেনাপতি হলে সে পিতৃহত্যার ক্রোধকে কাজে লাগাবে। তাছাড়া লোকান্তক ব্রহ্মশিরা অস্ত্রটিও অশ্বত্থামার দখলে। অন্যজনের তাও তো নাই।’ শেষের বাক্যটি কর্ণের জন্য। ঘটোৎকচকে হত্যা করতে গিয়ে একবীরঘাতিনী অস্ত্রটি খরচ করে ফেলেছে কর্ণ। শেষবাক্যে তারই ইঙ্গিত।
কর্ণ হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘চোখের জল দিয়ে কি যুদ্ধ জেতা যায়?’
ধৈর্য হারাল অশ্বত্থামা। উন্মত্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরে রাধামায়ের ঋতুস্রাব, সারথির বেটা কর্ণ, আমার নাম অশ্বত্থামা। চোখের জলকে আগুনে রূপান্তরিত করতে জানি আমি। সেই আগুনে পুড়িয়ে ছারখারও করতে জানি। আমি কি তোর মতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বারবার পালিয়ে এসেছি? আর এই অস্ত্রগুলো, আমার এই অস্ত্রগুলো কি গুরুর অভিশাপে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, যেমনটি তোর হয়েছে! আমি তো তোর মতো হীন জাতের সারথির ঘরে জন্মাইনি!’
অশ্বত্থামার মর্মঘাতী এই কথাগুলো কর্ণকে চটিয়ে দিল।
গরম গলায় কর্ণ বলল, ‘আমি সূত হই আর সূতপুত্রই হই কিংবা আর যাই হই না কেন—তার জন্য তো আমি দায়ী নই! মানুষ কোন ঘরে জন্মাবে, তা তো সে নিজে নির্ধারণ করে না! নিয়তি নির্ধারিত তা। কিন্তু পৌরুষ মানুষের করায়ত্ত। অধ্যবসায়ে তা করতলগত করা যায়। তা-ই করেছি আমি। জন্ম নিয়ে উপহাস করছিস কেন? আর তুই বামুনের ঘরে জন্মেই-বা কী অসাধ্য সাধন করেছিস? বরং সমাজবিধি ভঙ্গ করেছিস। শুধু তুই কেন, তোর বাপও করেছেন। তোদের কাজ তো মন্ত্র-স্তোত্র পাঠ করা, ছাত্র পড়ানো, পুজো-টুজো করানো। তা না করে সমাজ-আইন লঙ্ঘন করে ধনুক হাতে তুলে নিয়েছিস। এখন তুই-ই বল কারা নিন্দার্হ? তোরা না আমি?’
এই কথা শুনে অশ্বত্থামার চুপ মেরে যাওয়া উচিত। কিন্তু অশ্বত্থামা চুপ করে থাকল না। ব্রাহ্মণ্যতেজে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল
রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ওরে সারথিপুত্র, দুর্যোধনের প্রিয়পাত্র বলে আজ তুই আমাকে এত কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছিস। যেকোনো কারণেই হোক, আমার বাবা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বাধা দেননি।’
চট করে অশ্বত্থামার মুখের কথা কেড়ে নিল কর্ণ, ‘বাধা দেননি কেন জানিস, শিষ্য অর্জুনের প্রতি অনুরাগবশত বাধা দেননি। নিজের জীবন দিয়ে হলেও যদি প্রিয় শিষ্যের জয় নিশ্চিত করা যায়!’
এরপর কর্ণ তার কথাকে তীক্ষ্ণমুখ করল, ‘এতদিন গুরুদক্ষিণা বলে একটা কথা শুনে এসেছি। যার বদৌলতে তোর বাপ রাজা দ্রুপদকে বন্দি করিয়ে আনিয়েছিলেন। কিন্তু শিষ্যদক্ষিণা বলে কোনো শব্দ আমার জানা ছিল না। তোর বাপকে দেখে সেই শব্দটির মাহাত্ম্য বুঝতে পারলাম। বিনা বাধায় নিজের মাথাটি ধৃষ্টদ্যুম্নের তলোয়ারের নিচে পেতে দিয়ে শিষ্যঋণ শোধ করেছেন তিনি! তিরস্কারে কর্ণের কণ্ঠ গরগর করে উঠল।
অশ্বত্থামাও কম যায় না। সেও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল
মেজাজ হারিয়ে বলল, ‘ওরে হীনজন্মা কাপুরুষ, আমি এই মুহূর্তে তোর মাথায় আমার এই বাঁ পা-খানি রাখছি। তোর ক্ষমতা থাকে তো সরিয়ে দে।’ বলে অশ্বত্থামা মাটিতে বাঁ পা-খানি বারবার দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। এমন ভঙ্গি করতে লাগল যেন কর্ণের মাথাটি তার বাঁ পায়ের নিচে পিষ্ট হচ্ছে, যেন কর্ণ দুঃসহ ব্যথায় কঁকাচ্ছে আর অশ্বত্থামার কাছ থেকে রেহাই প্রার্থনা করছে!
কর্ণ এবার কোমরে ঝোলানো কোষ থেকে তরবারিটা একটানে বের করে আনল। ব্রাহ্মণত্বের মুখে ঝামা ঘষে বলল, ‘ওরে বেটা অশ্বত্থামা, তুই যদি আজ ব্রাহ্মণ না হতিস, তাহলে এতক্ষণে দেখতিস তোর বাঁ পা-টা কাটা পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।’
ক্রোধের চরম সীমায় পৌঁছে গেল অশ্বত্থামা। চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমি ব্রাহ্মণ বলে তুই মারতে পারছিস না—এই তো? সবার সামনে সজ্ঞানে বলছি—আমি আমার ব্রাহ্মণত্ব ত্যাগ করলাম।’ বলে নিজের পৈতেটা ফট করে ছিঁড়ে ফেলল অশ্বত্থামা। ‘এখন তুই সামনে এগিয়ে আয় কর্ণ। দেখি তোর কেমন শক্তি!’ বলে সক্রোধে পাশে রাখা খড়গটি আবার হাতে তুলে নিল অশ্বত্থামা। কৃপাচার্য দ্রুত ভাগনেকে বিরত করলেন। হতাশ কণ্ঠে দুর্যোধনকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই সভায় আজ তোমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে দুর্যোধন।’
দুজনের কাণ্ড দেখে দুর্যোধনও বিবশ, বিমূঢ়। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কর্ণ-অশ্বত্থামার কাণ্ড দেখে যাচ্ছিল। কৃপের কথা শুনে সংবিতে ফিরল। তার অনুনয়ে-বিনয়ে কর্ণ-অশ্বত্থামা শান্ত হলো।
দুর্যোধন বলল, ‘বহু আগে থেকে কর্ণের প্রতি দ্রোণাচার্যের ঘৃণা-অবহেলা। সেই বোধ দ্রোণ থেকে কৃপ পর্যন্ত বিস্তারিত হয়েছে। পিতা ও মাতুল দ্বারা অশ্বত্থামাও প্রভাবিত হয়েছে। ছোটজাতের প্রতি ব্রাহ্মণদের সহজাত ঘৃণা। এই ঘৃণাবোধ থেকে অশ্বত্থামাও মুক্ত হতে পারেনি। তাই আজ বারবার ব্রাহ্মণ-সূতের কথা উঠেছে। আমি সবাইকে সব কিছু ভুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আমি আশা করে আছি—পাণ্ডবদের পরাজয় হবে কুরুদের হাতে। এই আশায় আমি পিতামহকে সেনাধ্যক্ষ করেছিলাম, দ্রোণাচার্যকে করেছিলাম। ঈপ্সিত জয় আসেনি। আমার বড় আশা, কৰ্ণ সেই জয় এনে দেবে আমাকে। আমি মহাবীর কর্ণকেই পরবর্তী কৌরব সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করছি।’
চুয়ান্ন
প্রভাতসূর্য সমগ্র ধরাতলকে আলোকময় করে তুললেন। সমস্ত প্রাণিকুল সচল হলো।
কুরুক্ষেত্রের রক্ত-পুঁজ-গলিতদেহ—ছিন্ন হাত-পা-মস্তকের ওপরও সূর্যদেব নিজের আলোকণা ছড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করলেন না। এই যুদ্ধক্ষেত্রে গত পনেরো দিন গড়ে প্রতিদিন এক অক্ষৌহিণী করে মানুষ নিহত হয়েছে। মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় বত্রিশ লাখ আশি হাজার পাঁচশ। আর বেঁচে আছে মাত্র ছয় লাখ ছাপান্ন হাজারের মতো যোদ্ধা। তাদের অধিকাংশই পাণ্ডবপক্ষের।
যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল কৌরবসৈন্যের সংখ্যাধিক্য দিয়ে। কিন্তু বিগত পনেরো দিনে কৌরবপক্ষের খ্যাতকীর্তি বীররা যেমন নিহত হয়েছেন, তেমনি সাধারণ সৈন্যও মরেছে অধিকসংখ্যক। কুরুদের তুলনায় পাণ্ডবদের সৈন্যক্ষয় হয়েছে অনেক কম। পাণ্ডুপুত্ররা তো অক্ষত রয়েছেই, পাণ্ডবপক্ষের দ্রুপদ-বিরাট-ঘটোৎকচের মতো কিছুসংখ্যক মাঝারি মাপের যোদ্ধা নিহত হওয়া ছাড়া তেমন বীরযোদ্ধা কেউ নিহত হননি।
পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধশেষে দেখা গেছে—কুরুদের তুলনায় পাণ্ডবদের সৈন্য বেঁচে আছে বেশি। ওই যে সাড়ে ছয় লাখ সেনা বেঁচে আছে, তাদের বেশির ভাগই পাণ্ডবপক্ষের।
তাই কর্ণ যখন সেনাধ্যক্ষ হলো, কৌরবপক্ষের সৈন্য তখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ষোড়শ দিনের যুদ্ধে ওই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে কর্ণ কুরুক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছে। কথা দিয়েছে দুর্যোধনকে, যারা বেঁচে আছে, তাদের নিয়েই জয়টা এনে দেবে তাকে।
প্রভাতআলো স্পষ্ট হয়ে উঠলে দুর্যোধন কর্ণকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করল।
কর্ণ শ্বেত পতাকাযুক্ত, শ্বেত অশ্বদ্বারা চালিত এবং নানা রকম অস্ত্রশস্ত্রে পরিপূর্ণ এক রথে চড়ে কুরুসেনাদের অগ্রভাগে গিয়ে উপস্থিত হলো। কুরুসেনাদের মধ্যে উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ল। হস্তী, অশ্ব, রথচক্রের ধ্বনি আর সৈন্যদের কোলাহলে কৌরবাংশ মুখরিত হয়ে উঠল।
কর্ণ মকর ব্যূহ তৈরি করল। সেই ব্যূহের নানা অংশে শকুনি, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য, শল্যকে অবস্থান করিয়ে নিজে ব্যূহের সম্মুখভাগে অবস্থান নিল। তারপর মহাশব্দে যুদ্ধারম্ভের শঙ্খ বাজিয়ে দিল। সেই শঙ্খধ্বনি শুনে কুরুসেনারা মারমার কাটকাট করে উঠল।
কর্ণের মকর ব্যূহ রচনা দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে কাছে ডেকে বলল, ‘আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল দুর্যোধন। ভারতবর্ষের বাঘা বাঘা মহারথী তার দলে ছিলেন। মাত্র পনেরো দিনের যুদ্ধে ওঁদের অধিকাংশকেই নিধন করতে পেরেছি আমরা।’
পাশে কৃষ্ণ ছিল, বলল, ‘বহু সহস্র সৈন্য নিধনের কথা বলছ না কেন দাদা! সাধারণ সেনাও কি কম নিহত হয়েছে ওদের?’
‘তুমি যথার্থ বলেছ কৃষ্ণ। এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্যের সামান্য সংখ্যকই বেঁচে আছে এখন। ওদের যুদ্ধতরী ডুবতে বসেছে।’
অর্জুন মুখ খুলল, ‘তুমি যা বলেছ, ঠিক বলেছ। দুর্যোধনের ভাইদের অধিকাংশই আজ ভীমের হাতে নিহত। এমন যে মহাক্রমশালী দ্রোণাচার্য, তাঁকেও…।’ কণ্ঠ বুজে এলো অর্জুনের।
কৃষ্ণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ওতে তুমি মন খারাপ করো না অর্জুন। ওটাই যুদ্ধনীতি। প্রেমে আর সমরে চাতুর্য গর্হিত নয়। আমরা ওই সামান্য মিথ্যের আশ্রয়টুকু না নিলে দ্রোণকে স্বর্গে পাঠাতে পারতাম না।’
দ্রোণের প্রসঙ্গ ওঠায় যুধিষ্ঠির হঠাৎ করে চুপসে গেল। প্রতিদিনের যুদ্ধ শুরুর যে সতেজতা, তা আচমকা কোথায় উবে গেল! চিবুক বুকে ঠেকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল যুধিষ্ঠির। তার মিথ্যে বলার জন্যই তো গুরুদেব দ্রোণের হত্যা!
বুঝতে পারল কৃষ্ণ, ‘তোমাকে আর পুরো ক্ষত্রিয় করে তুলতে পারলাম না দাদা! ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা এবং জয় করা। জয় করতে গিয়ে হত্যাকে ভয় পেলে চলবে? যুদ্ধক্ষেত্রে মিথ্যে বলা তো অপরাধের নয়! মিথ্যে বলে যদি যুদ্ধজয় করা যায়, তাতে তো কোনো পাপ নেই দাদা!’
কৃষ্ণের কথা শুনেও যুধিষ্ঠির স্বাভাবিক হতে পারছে না। তার ভেতর যে প্রচণ্ড ভাঙচুর হচ্ছে, তা তার ব্যাকুল চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কৃষ্ণ বলল, ‘যা বলছিলাম দাদা, যুদ্ধের শুরুতে হঠাৎ অর্জুনকে ডেকে পাঠালে কেন, তা তো বললে না!’
মুখ তুলল যুধিষ্ঠির, ‘কুরুদলের ভয়ংকর যোদ্ধারা মারা গেছেন। যে কজন জীবিত আছেন, তাঁদের মধ্যে সেরা হলো কর্ণ। সে কর্ণ আজ কৌরবদলের সেনাপতি। কর্ণ মারাত্মক। যুদ্ধই তার ধর্ম। যুদ্ধজয়ই তার গন্তব্য। তার চোখেমুখে জিঘাংসার তাণ্ডবনৃত্য আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দীর্ঘদিন পর সে সেনাপতিত্ব পেয়েছে। আমাদের বিরাট কোনো ক্ষতিসাধন করে সে আজ দুর্যোধনকে দেখাবে, অনেক আগে তাকে সেনাপতি না করে ভুল করেছে দুর্যোধন।
‘তোমার কথা অস্বীকার করব না দাদা। কর্ণের মতো ধনুর্বিদ কুরুশিবিরে কেউ ছিলেন না।’ বলল কৃষ্ণ।
প্রতিবাদ করল অর্জুন, ‘কেন! তুমি পিতামহ ভীষ্ম আর অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন দাদা?’
‘ওঁদের কথা না-ভুলেই কথাটা বলেছি আমি। তাঁরা যে কর্ণের চেয়েও মহান ধনুর্ধর একথা ভুলিনি আমি। কিন্তু ওই দুইজন তোমাদের বিরুদ্ধে যথার্থ যুদ্ধ করেননি। মানে মরণপণ যুদ্ধ যাকে বলে, সেটা করেননি ভীষ্ম আর দ্রোণ। ভীষ্ম দশদিন আর দ্রোণ পাঁচদিন যুদ্ধের অভিনয় করে গেছেন শুধু।
‘যুদ্ধের অভিনয়!’ অবিশ্বাসের চোখমুখ অর্জুনের।
‘ভীষ্ম আর দ্রোণ প্রকৃতপক্ষে পাণ্ডবদলেরই লোক ছিলেন। যুদ্ধের সময় চক্ষুলজ্জায় পাণ্ডবদলে যোগ দেননি, কুরুদলে রয়ে গেছেন। এই পনেরো দিন ওঁরা যুদ্ধ করেছেন নামকাওয়াস্তে। তাঁদের অর্জিত রণবিদ্যার সামান্যটুকু ব্যবহার করেছেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।’
যুধিষ্ঠির বলল, ‘তার পরেও তো ভীষ্ম-দ্রোণকে সেনাধ্যক্ষ করেছে দুর্যোধন!’
‘ওটাই দুর্যোধনের যুদ্ধপরিকল্পনার সবচাইতে বড় ভুল ছিল। সে জানত, ভীষ্ম-দ্ৰোণ তাকে পছন্দ করেন না। তারপরও শুধু মর্যাদার খাতিরে ওই দুইজনকে পরপর সেনাপতি করেছে। ওটা যদি না করত…।’
‘ওটা যদি না করত, তাহলে কী হতো?’ প্রশ্ন না করে পারল না অর্জুন।
‘কর্ণ সেনাধ্যক্ষ হতো। আর কর্ণ প্রথম থেকে কুরুসেনা পরিচালনার দায়িত্ব পেলে এতদিনে কমণ্ডলু হাতে নিয়ে হিমালয়যাত্রা করতে হতো তোমাদের।’
যুধিষ্ঠির বলল, ‘তাই তো! কর্ণ যে-মাপের ধনুর্ধর এবং আমাদের প্রতি যে-পরিমাণ তার ঘৃণা, তাতে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত, যদি প্রথম থেকে কর্ণ সেনাপতি হতো।’
কৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিজ্ঞের কণ্ঠে বলল, ‘দুর্যোধন যদি ভীষ্ম-দ্রোণকে সামরিক পরিষদের উপদেষ্টা রেখে যুদ্ধের সম্পূর্ণ ভার কর্ণের হাতে দিয়ে দিত…।’
‘থাক থাক কৃষ্ণ, আর শুনতে চাই না আমি। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে আমার। হ্যাঁ অর্জুন, যে কথাটি তোমাকে বলবার জন্য ডেকেছি, সেটা বলি।’
উৎসুখ চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাল অর্জুন।
যুধিষ্ঠির বলল, ‘কর্ণকে বধ করতে পারলে আমাদের জয়লাভ সহজ এবং সুনিশ্চিত হবে। আজ থেকে কর্ণই তোমার লক্ষ্য হোক ভাই। ও-ই কুরুদলের সর্বোত্তম যোদ্ধা এখন।’
চিন্তিত মুখে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মাতুল মদ্ররাজ শল্যের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন দাদা? তাঁর মতো পারঙ্গম ধনুর্ধর আমাদের দলে কজন আছে বলো! সেই মাতুলই কুরুপক্ষের হয়ে মরণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এখনো!’
শল্যের নাম শুনে প্রশান্ত একটুকরা হাসি যুধিষ্ঠিরের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। গোপন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল যুধিষ্ঠির। মাতুল শল্যের সঙ্গে তার গোপন চুক্তির কথাটি না-হয় গোপনই থাক!
যুধিষ্ঠির শুধু বলল, ‘শল্য এখনো অনেক দূরে। সম্মুখে মারমুখী যে কর্ণ, আগে তাকে খতম করো অর্জুন।’
‘ঠিক আছে দাদা। আজ থেকে কর্ণই আমার উদ্দেশ্য, কর্ণই আমার বিধেয়। তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হব আমি।’
‘তাই করো অর্জুন।’ বলে নিজের সৈন্যবাহিনীকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি করে সাজাল যুধিষ্ঠির। অর্জুনকে নির্দেশ দিল সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি ব্যূহের সম্মুখভাগে গিয়ে দাঁড়াতে।
কৃষ্ণ অর্জুনের রথকে ব্যূহের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল।
তারপর উভয়পক্ষে ধুন্ধুমার যুদ্ধ লেগে গেল।
ভীম গজে আরোহণ করে কুরুযোদ্ধা গজারোহী ক্ষেমধূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। উভয়ে মারাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল। বাণাঘাতে পরস্পরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল উভয়ে। একসময় তাদের হাতি দুটি নিহত হলে ভীম আর ক্ষেমধূর্তি মাটিতে নেমে পড়ল। খোলা তরবারি হাতে পরস্পরের দিকে ধেয়ে গেল ওরা। ক্ষেমধূর্তি আঘাত করার আগেই ভীম এক কোপে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন করে দিল।
ওদিকে অশ্বত্থামা অর্জুনকে আক্রমণ করে বসল। অশ্বত্থামার তীরের সঙ্গে পিতৃহত্যার ক্রোধ যুক্ত হয়ে আছে। অশ্বত্থামার বাণাঘাতের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না অর্জুন। ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো।
যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে তখন গজারোহী কৌরবসেনারা ধৃষ্টদ্যুম্নকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করল। তা দেখে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, সাত্যকি, শিখণ্ডী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কুরুসেনাদের প্রতিহত করল।
সহদেবের সঙ্গে দুঃশাসনের তুমুল যুদ্ধ চলছিল। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করার পরও কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারছিল না। হঠাৎ সহদেব তীক্ষ্ণ এক বাণ নিক্ষেপ করে বসল। এতে তীরটি দুঃশাসনের বর্ম ভেদ করে শরীরে আঘাত করল। অচেতন হয়ে গেল দুঃশাসন। সারথি তাকে দ্রুত রণস্থলের বাইরে নিয়ে গেল।
চক্রাকারে যুদ্ধ করতে করতে নকুলের সঙ্গে কর্ণের দেখা হয়ে গেল।
হঠাৎ মা কুন্তীর কথা মনে পড়ে গেল কর্ণের। অর্জুন ছাড়া অন্য চার পুত্রকে আঘাত করব না— মাকে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতির কথা তার মনে জেগে উঠল। নিজের ধনুকটি পাশে গুটিয়ে রাখল কৰ্ণ।
কিন্তু নকুল কর্ণকে ছাড়বে কেন? চোখা চোখা বাণ নিক্ষেপ করে কর্ণকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য ধনুকটি হাতে তুলে নিল কর্ণ। নকুলের জন্য কৰ্ণ ছিল বেশিমাত্রায় শক্তিশালী। অল্পক্ষণই টিকতে পারল নকুল। শেষ পর্যন্ত কর্ণের হাতে পরাজিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের রথে চড়ে প্রাণ বাঁচাল নকুল।
এর মধ্যে মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে।
বিরতিহীন যুদ্ধ অব্যাহত থাকল।
কৃপাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্নের সংগ্রাম বেধে গেল। কৃপাচার্যের শরজালে ধৃষ্টদ্যুম্ন কাতর হয়ে পড়ল। সবাই ভাবল—কৃপের হাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু সারথি রথটিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বাঁচিয়ে দিল।
আরেক দিকে যুধিষ্ঠির-দুর্যোধন মুখোমুখি। দুই বীরের মধ্যে বাণ, ভল্ল, শেল ইত্যাদি নিক্ষেপ চলতে লাগল। হঠাৎ যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে সারথি আর অশ্বগুলোর মৃত্যু হলে দুর্যোধন দিশেহারা হয়ে পড়ল। কর্ণ এগিয়ে এলে ভীমও এগিয়ে এলো। কৃপাচার্য আর অশ্বত্থামা এই সময় ভীমের সামনে তাঁদের রথ দাঁড় করালে ভড়কে গেল ভীম। এই সময় অর্জুন-সহদেব-নকুল ভীমকে রক্ষার জন্য দ্রুত এগিয়ে এলো।
এইভাবে সমস্ত কুরুক্ষেত্র মৃতদেহে ভরে উঠতে লাগল। অপরাত্নকাল সমুপস্থিত হলো। কর্ণ নব-উদ্যমে পাণ্ডবসৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত শত সেনা নিধন হতে লাগল। সাত্যকি এগিয়ে এসে কর্ণকে বাণবিদ্ধ করতে চাইল। কিন্তু কর্ণের আজ সংহারমূর্তি। সামনে যাকে পাবে, তাকেই ধ্বংস করবে—এই-ই সংকল্প যেন ওর।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।
ষোড়শ দিনের যুদ্ধ শেষ হলো। তেমন কোনো বড় যোদ্ধা নিহত হলো না এইদিন। তবে নিশ্চিত হওয়া গেল যে কুরুপক্ষ পরাজয়ের দিকে অনেকটাই অগ্রসর হয়ে গেছে।
দিনশেষে কর্ণকে কিছুটা অসহায় দেখাল।