কৰ্ণ – ৩০

ত্রিশ

গুপ্তচর এসে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে খবর দিল— দ্রৌপদীকে অর্জুনই জিতে নিয়েছে। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন সকলে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে ওইদিন স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত ছিল। সবাইকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে পাণ্ডবরা।

কৌরবপক্ষের সবাই এই সংবাদে অসন্তুষ্ট হলো। কর্ণ-দুর্যোধন-দুঃশাসন সবাই নিজেদের ধিক্কার দিতে লাগল—কেন সেদিন অর্জুনকে চিনল না!

রোষায়িত কণ্ঠে দুঃশাসন বলে উঠল, ‘যদি ব্রাহ্মণের বেশ ধরে না থাকত অর্জুনটা, তাহলে তার আর দ্রৌপদীকে পেতে হতো না। আমাদের কর্ণ একেবারে ঠান্ডা করে দিত ওই অর্জুনটাকে।’

দুঃশাসনের এই মন্তব্যে কেউ খুশি হলো না। উপরন্তু চরের মুখে দ্রৌপদীর পঞ্চপাণ্ডবকে বিয়ে করার কথা শুনে প্রাসাদে প্রচণ্ড উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল।

অর্জুন দ্রুপদকন্যাকে বিয়ে করেছে শুনে সবচাইতে বেশি বিচলিত হলেন দ্রোণাচার্য। কী এক গভীর আশঙ্কায় তাঁর বুকটি কেঁপে উঠল হঠাৎ। বিচক্ষণ মানুষ তিনি। নিজের আতঙ্ককে নিজের মধ্যে চেপে রাখলেন। মনের তোলপাড়ের কথা কাউকে বুঝতে দিলেন না।

পাণ্ডবদের এমন সফলতার সংবাদে সবচাইতে বেশি অখুশি হলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি তার অসন্তাষ বাইরে দেখালেন না।

ভীষ্মের চোখেমুখে পরম তৃপ্তি দেখা গেল।

দ্রুপদ-পাণ্ডব-দ্রৌপদীর সংবাদে বিদুরই সবচাইতে বেশি তুষ্ট বলে মনে হলো।

আগবাড়িয়ে বিদুর বলল, ‘মহারাজ, এ তো বড় আনন্দের সংবাদ! যে পঞ্চালের সঙ্গে আমাদের চিরবিরোধ, সেটার বুঝি অবসান হলো আজ! দ্রুপদের সঙ্গে কুরুদের একটা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো।’

ধৃতরাষ্ট্র অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তা তো বটেই।’

‘এরপর থেকে হস্তিনাপুরের ক্ষতি করার আগে দশবার ভাববেন রাজা দ্রুপদ।’

বিদুর বলল। ধৃতরাষ্ট্র আবেগশূন্য কণ্ঠে বললেন, ‘তা তো বটেই।’  

বিদুরের কথায় যে ধৃতরাষ্ট্র উৎসাহবোধ করছেন না, সেদিকে খেয়াল নেই বিদুরের। অদ্ভুত এক গাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এখন তো পাণ্ডবদের সস্ত্রীক হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে আনা উচিত মহারাজ।’

মহারাজ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছে করো। তোমরা যা বলবে, তা-ই করব আমি।’

ততদিনে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণ রাজসভায় বসতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের নীতিনির্ধারণে দুর্যোধন রীতিমতো ভূমিকা রাখছে। দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম, কৃপ, বিদুর—এঁদের কথার অসারতা প্রমাণেও মাঝেমধ্যে তৎপর হয়ে উঠছে দুর্যোধন। তাকে সঙ্গত দিয়ে যাচ্ছে দুঃশাসন আর মামা শকুনি। এতে দুর্যোধনের সাহস বেড়ে গেছে অনেকগুণ। এ ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের যে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে—সভাসদদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।

এরপর দ্রুত কর্ণের দিকে ঘাড় ফিরিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। বলেছিলেন, ‘বিদুরকে যে বললাম কথাটা, এ বিষয়ে তোমার কোনো বক্তব্য আছে কিনা কর্ণ? তোমার মতামতটাও জানা দরকার আমার। এই অবস্থায় কী করা যায়?’

কর্ণ কিছু বলার আগেই দুর্যোধন আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সরোষে বলল, ‘কিছুতেই পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। এরা যদি হস্তিনাপুরে ফিরে আসে, তাহলে মহারাজ আপনার সিংহাসন টলিয়ে দেবে। ঘরের শত্রু বিভীষণের অভাব নেই এই রাজপ্রাসাদে। বিভীষণ যেমন রামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাবণকে হত্যা করিয়েছিল, হস্তিনাপুরের বিভীষণরাও তেমনি পাণ্ডবদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বেন মহারাজ।’ ভীষ্ম-বিদুরদের দিকে তাকিয়ে শেষবাক্যটা বলল দুর্যোধন।

দুর্যোধনের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র কেন জানি ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। খেই হারানো কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার প্রস্তাব কী?

‘বলছি মহারাজ। আমার প্রথম কথা পাণ্ডবদের কখনো এই রাজপ্রাসাদে আসতে দেওয়া যাবে না।’ ডান হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিল দুর্যোধন। তারপর বলল, ‘গুপ্তচর পাঠিয়ে পাণ্ডবদের মধ্যে ভ্রাতৃবিরোধ তৈরি করা যেতে পারে। দ্রুপদের মন্ত্রীদের অর্থ উৎকোচ দিয়ে রাজা দ্রুপদের মন যুধিষ্ঠিরের ওপর বিষিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অথবা যুধিষ্ঠিরের কানে কানে মন্ত্রী-অমাত্যরা বলতে থাকবে—তোমরা আর হস্তিনাপুরে ফিরে যেয়ো না বাপু। এখানেই সুখে আছ তোমরা। এই পঞ্চালেই থেকে যাও। আরেকটা কাজ করা যেতে পারে মহারাজ। নারীগুপ্তচর পাঠিয়ে দ্রৌপদীর মনে বহুস্বামিতার গ্লানি জাগিয়ে তোলা যায়। তাহলেই স্বামীতে-স্ত্রীতে ঝঞ্ঝাট লাগবে। লাভ হবে আমাদের। এছাড়া ছদ্মবেশে কিছু মল্লবীর পাঠিয়ে ভীমকে খতম করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ভীম নিহত হলে আমাদের কর্ণ হেলায় অর্জুনকে ধূলিসাৎ করে দেবে। আরও একটা উপায় আছে মহারাজ।’

‘থামো তুমি দুর্যোধন, থামো। আর প্রলাপ বকো না।’ অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল কর্ণ।

বিস্মিত দুর্যোধন কর্ণের দিকে ফিরে বলল, ‘থামব! কেন কর্ণ? আমার প্রস্তাবগুলোর একটিও কি তোমার পছন্দ হয়নি? তাহলে আরেকটি প্রস্তাব করছি আমি।’

দুর্যোধনকে থামিয়ে কর্ণ কী একটা বলতে চাইল।

কিন্তু কর্ণকে বলার সুযোগ দিল না দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আগের প্রস্তাবগুলোর একটিও যদি আপনার পছন্দ না হয় মহারাজ, তাহলে আরেকটা কাজ করুন। পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে নিয়ে আসার জন্য মহাবীর কর্ণকে দ্রুপদরাজ্যে পাঠান। নিয়ে আসার পথে কর্ণ ওদের হত্যা করার ব্যবস্থা নেবে।’ বলেই সোৎসাহে কর্ণের দিকে তাকাল দুর্যোধন। বলল, ‘কর্ণ, কী বলো, উপায়টা দারুণ না?’

কর্ণ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না, উপায়টা দারুণ নয়। শুধু এটা নয়, আগের প্রস্তাবগুলোও অপক্ব এবং নড়বড়ে। এই প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই দুর্যোধন।’

কর্ণের কথা শুনে চুপসে গেল দুর্যোধন। সভায় চাপা গুঞ্জন শোনা গেল।

মহারাজ বললেন, ‘আপনারা কথা বলা বন্ধ করুন। কর্ণ আর কী বলে, শুনি।’

রাজসভা নীরব হয়ে গেল।

কর্ণ ভালোবাসার চোখে দুর্যোধনের দিকে তাকাল একবার। তার পর বলল, ‘বুঝতে পারছি বন্ধু, আবেগ আর ক্রোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে কথাগুলো বলেছ তুমি। কিন্তু তোমার কথার একটিও আমার ঠিক মনে হচ্ছে না।’

‘একটিও ঠিক মনে হচ্ছে না!’ ভেঙেপড়া কণ্ঠে বলল দুর্যোধন।

‘তুমি কিছু মনে করো না বন্ধু। তোমার প্রস্তাবের কোনোটাই কুশলী নয়। বাস্তবতাবর্জিত।’

‘বাস্তবতাবর্জিত!’ বন্ধু হয়ে কর্ণ তার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, ভাবেনি দুর্যোধন।

নির্মোহ কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘এর আগে পাণ্ডবদের ক্ষতি করবার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছিলে, কিন্তু প্রতিটাতেই ব্যর্থ হয়েছ তুমি।’

‘মানে! কী বলতে চাও তুমি কর্ণ?’ দুর্যোধনকে উত্তেজিত দেখাল।

‘ভেবে দেখো, জতুগৃহের ঘটনায় কী নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছ তুমি! পাণ্ডবরা যখন সদ্য ডানাগজানো পাখির মতো, তখন কিছু করতে পারোনি তুমি। আর এখন তো ওরা দ্রুপদরাজার জামাতা। দ্রুপদের সকল সামরিকশক্তি ওদের পেছনে এখন। এই সময় কি পাণ্ডবদের ধ্বংস করা অত সহজ?’

অসহায় ভঙ্গিতে দুর্যোধন বলল, ‘সহজ নয়?’

কর্ণ দৃঢ়ভাবে বলল, ‘না, পাণ্ডবদের ক্ষতিসাধন করা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। আরেকটা কথা বন্ধু, তুমি বলছ— দ্রৌপদীর মনটা বিষিয়ে তুলতে। কী বলে বিষিয়ে তুলবে? পঞ্চস্বামিত্বের কথা বলে! আরে, ওই দ্রৌপদীটার তো পঞ্চস্বামিত্বেই সুখ! সতীত্ব বলে ওর মধ্যে কিছু আছে নাকি? থাকলে কি সে এক সঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের বউ হতো? আর পাঁচ ভাইয়ের তো এক দ্রৌপদীকেই ভোগ করতে আনন্দ! আমি বলছি, দ্রৌপদীর জন্য পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে কখনো বিরোধ বাধবে না দুর্যোধন। এঁটোতেই ওদের তৃপ্তি।’ প্রকাশ্য রাজসভায় দাঁড়িয়ে এরকম অসৌজন্যমূলক কথা বলতে কর্ণের মুখে আটকাল না।

কর্ণ নিজের কথায় ভদ্রতার আড়ালটুকু সরিয়ে নিল। দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে আবার বলল, ‘জানো দুর্যোধন, মেয়েদের এক স্বামী থাকা সত্ত্বেও তাদের সব সময় ইচ্ছে করে তাকে আরও বহু পুরুষ ভোগ করুক। দ্রৌপদীও তেমন একজন নারী, যে এক পুরুষে তৃপ্ত নয়। বহু পুরুষ না হলে তার মনে তৃপ্তি আসে না। এই ধরনের রমণীর মন কি ভাঙানো যায়? আমি বলছি, যায় না।’

স্বয়ংবরসভায় দ্রৌপদীর অপমানের আগুন কর্ণের বুকের তলায় এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে। শুধু অর্জুন নয়, নকুল-সহদেবের মতো এলেবেলেরাও দ্রৌপদীকে ভোগ করছে—এটা ভাবলেই মাথা গরম হয়ে ওঠে কর্ণের। আজ সুযোগ পেয়ে সর্বসমক্ষে দ্রৌপদীর বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গরণ করে ছাড়ল কর্ণ।

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন ঝিমিয়ে পড়ল অনেকটা। ওই অবস্থাতে মরা গলায় বলল, ‘তা হলে এখন কী করা! পাণ্ডুপুত্রদের এমনি এমনি ছেড়ে দেব?’

‘না। এমনি এমনি ছেড়ে দেবে কেন? আমি তো অর্জুনদের এমনি এমনি ছেড়ে দিতে বলছি না।’

পাঁচ ভাই সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ হিসেবে শুধু অর্জুনের নামই করল কর্ণ। কারণ তার বিবেচনায় পাণ্ডবশিবিরে তার প্রতিপক্ষ দুজন—অর্জুন এবং দ্রৌপদী।

ধৃতরাষ্ট্র অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কী করতে বলো তুমি?’

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কর্ণ হলেও বিদুর চট করে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মহারাজ প্রশ্নটা যেন তাকেই করেছেন, এমন করে বলল, ‘আমি বলি কী মহারাজ, এত ঝুটঝামেলা তৈরি না করে ওদের হস্তিনাপুরে নিয়ে আসা উচিত। বউটিকে বরণ করে নেওয়া উচিত আমাদের। শুধু তা-ই নয়, যুধিষ্ঠিরকে তার যুবরাজের পদটিও ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’

দুর্যোধন গর্জে উঠল, ‘আপনি থামবেন তাতশ্রী! আপনাদের কাছে কে পরামর্শ চেয়েছেন যে এতগুলো পরামর্শ দিয়ে গেলেন? আপনি থামুন। কর্ণকে কথা বলতে দিন।’

হস্তিনাপুরে দুর্যোধন-দুঃশাসনদের নিয়ে যে যুবগোষ্ঠী, সেই যুবগোষ্ঠীতে অল্পকালের মধ্যেই কর্ণ উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। এই স্থান এত উঁচুতে যে রাজসভায় তার মন্তব্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তো নিজের সকল প্রস্তাব কর্ণ খারিজ করে দেওয়া সত্ত্বেও তার ওপর বিন্দুমাত্র রুষ্ট হলো না দুর্যোধন। উপরন্তু কর্ণের মতামতকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবল।

কর্ণ বলল, ‘ওসব ছলচাতুরীতে না গিয়ে পাণ্ডবদের সরাসরি আক্রমণের ব্যবস্থা নিন মহারাজ। এখনই তাদের আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার সময়। এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের শিকড় তত দৃঢ় নয়, পাঞ্চালরাও কমজোরি। কুরুসেনারা সমস্ত শক্তি নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুক। নিমিষেই শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’

কর্ণের এরকম প্রস্তাব শুনে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ—এইসব প্রাজ্ঞ তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করে উঠলেন। পাণ্ডব-পাঞ্চালদের আক্রমণ করা বিরাট একটা গর্হিত কাজ হবে বলে মনে করলেন এই কুরুউপদেষ্টা-মন্ত্রীরা।

ভীষ্ম কঠিন স্বরে বললেন, ‘তুমি এ কাজ করো না ধৃতরাষ্ট্র।

দ্রোণ বললেন, ‘ওদের বিনা অপরাধে আক্রমণ করলে ভারতবর্ষে আপনার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠবে মহারাজ।’

ওঁদের কথা শুনে দোটানায় পড়ে গেলেন ধৃতরাষ্ট্র। কর্ণের প্রস্তাবটা তাঁর খুব মনে ধরে গিয়েছিল, কিন্তু পিতামহ আর দ্রোণের কথায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন তিনি।

ধৃতরাষ্ট্রের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে কর্ণ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘মহারাজ, ছোট মুখে বড় কথা বলছি না। আমি ঠিক কথাটাই বলছি। আপনি শুনে রাখুন, ভবিষ্যতে আপনাদের যদি কেউ মস্তবড় ক্ষতিসাধন করেন, তাহলে এই দুই জনেই করবেন। এঁরা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী নন। এঁরা আপনার রাজসভায় দুষ্ট মন্ত্রী মহারাজ। এঁদের কাছ থেকে সাবধান থাকবেন।’ ভীষ্ম-দ্রোণের দিকে আঙুল তুলে কথা শেষ করল কর্ণ। দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে কর্ণ আজ কুরুবৃদ্ধদের বিরুদ্ধে এত বড় কটূক্তি করতে পারল।

কিন্তু কর্ণের কটূক্তি আর অপমানে ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর-কৃপ টললেন না। আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন এবং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করলেন দ্রৌপদী কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডবকে হস্তিনাপুরে সাদরে ফিরিয়ে আনতে।

.

ওঁরা ফিরতে না ফিরতেই রাজপ্রাসাদে অস্থিরতা বেড়ে গেল।

কুরুসাম্রাজ্য পাণ্ডুপুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য দাবি তুলল বিদুর।

ভীষ্ম নীরব সমর্থন জানালেন।

একটা সময়ে কুরুরাজ্য পাণ্ডুপুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিতে বাধ্য হলেন ধৃতরাষ্ট্র।

একত্রিশ

ধৃতরাষ্ট্র খাণ্ডবপ্রস্থ অঞ্চলটা পাণ্ডবদের দিলেন।

বললেন, ‘হস্তিনাপুরে থেকে তোমাদের লাভ নেই বাছা। তোমরা এখন বড় হয়েছ। রাজ্য চালানোর মতো ক্ষমতা হয়েছে তোমাদের। খাণ্ডবপ্রস্থ অঞ্চলটা আমি তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। ওখানে গিয়ে রাজ্য স্থাপন করো তোমরা। রাজধানী বানাও। তোমাদের জন্য আমার আশীর্বাদ রইল।’

পাণ্ডুপুত্ররা ধৃতরাষ্ট্রের কথা মেনে নিল। এক সকালে খাণ্ডবপ্রস্থের উদ্দেশে রওনা দিল পাণ্ডবপরিবার।

কুরুসাম্রাজ্যের সবচাইতে দুর্গম এবং অরণ্যময় অঞ্চল এই খাণ্ডবপ্রস্থ। এর অধিকাংশ জায়গা মরুপ্রায়। খাণ্ডবপ্রস্থে পৌঁছে পাণ্ডবরা বড় হতাশ হলো। এরকম ঊষর ভূমি জ্যেষ্ঠতাত আমাদের ভাগে দিলেন! ততদিনে কৃষ্ণ পিসিতো ভাইদের সঙ্গে এসে মিশেছে। ততদিন কৃষ্ণ পাণ্ডবদের অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ী হয়ে গেছে।

যুধিষ্ঠিরদের ভেঙে পড়া দেখে কৃষ্ণ মনোবল জোগাল, ‘হতাশ হয়ে পড়লে চলবে না দাদা। একেবারে না-পাওয়ার চেয়ে এইটুকু পেয়েছ! এতেই তৃপ্ত থাকো। এখানে রাজ্য গড়ে তোলো তোমরা, পাণ্ডবরাজ্য। এমন একদিন আসবে, তোমাদের রাজ্যের ঐশ্বর্য দেখে কৌরবরা আর্তনাদ করে উঠবে।’ পাঁচ ভাই কৃষ্ণের কথা মাথা পেতে নিল। দ্রৌপদীকে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে নতুন বসতির সূচনা করল পাণ্ডবরা।

কৃষ্ণের সহায়তায় আর পাণ্ডবদের অধ্যবসায়ে খাণ্ডবপ্রস্থের চেহারা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করল। একদিন ইন্দ্রপ্রস্থ নামের রাজধানীটি ওই ঊষর খাণ্ডবপ্রস্থ অঞ্চলে মাথা তুলে দাঁড়াল। নতুন রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থ আর্যাবর্তের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী হয়ে উঠল অচিরেই।

ইন্দ্রপ্রস্থের ঐশ্বর্যের কথা শুনে বড় বিচলিত হয়ে পড়লেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধন ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে যেতে লাগল।

এই ঈর্ষা কর্ণের মনেও দ্রুত সংক্রমিত হলো।

ঈর্ষা ক্রমে ক্রমে অসন্তোষ বাড়াল।

এই সময় রাজা যুধিষ্ঠির হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল—রাজসূয় যজ্ঞ করবে।

রাজসূয় যজ্ঞ শুধু যজ্ঞ তো নয়! যজ্ঞের আগে দিগ্বিজয়ে বেরোতে হবে পাণ্ডবসৈন্যদের। আশপাশের-দূরের দেশগুলো জয় করে পাণ্ডববাহিনী ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেই তবে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করতে পারবে যুধিষ্ঠির। জানিয়ে দিল কৃষ্ণ।

কৃষ্ণের কথায় হতোদ্যম হলো না যুধিষ্ঠির, বরং উদ্দীপিত কণ্ঠে বলল, ‘তাই হবে কৃষ্ণ। আমার বাহিনী প্রথমে দিগ্বিজয় করবে, তারপর রাজসূয় যজ্ঞ হবে এই ইন্দ্রপ্রস্থে।’

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে জটিল একটু হাসল কৃষ্ণ।

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘হাসলে যে?’

হাসি থামিয়ে কৃষ্ণ বলল, ‘শোনো দাদা, তুমি দিগ্বিজয়কে যত সহজ মনে করছ, আসলে তা তত সহজ নয়।’

‘সহজ নয়!’ কিছুটা অস্থির দেখাল যুধিষ্ঠিরকে।

কৃষ্ণ পরিষ্কারভাবে বলল, ‘মগধরাজ জরাসন্ধ যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন তোমার পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা সম্ভব নয়।’

‘কেন সম্ভব নয়?’

‘কারণ জরাসন্ধ তোমার যজ্ঞে বাধা দেবে।’

‘বাধা দেবে!’

‘তাকে জয় না করলে তো তোমার দিগ্বিজয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! আমি জেনেই বলছি— তোমার বাহিনী তাকে কোনোদিন সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে না।’

‘কেন পারবে না? ভীম আছে, অর্জুন আছে!’ বেশ অস্থির দেখাল যুধিষ্ঠিরকে।

‘জরাসন্ধের এই মুহূর্তে বিশালবাহিনী। তার সামরিকশক্তিকে আর্যাবর্তের সকল রাজা ভয় করে। তোমার ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে ভীম-অর্জুন জরাসন্ধের কিছুই করতে পারবে না।’

‘কিছুই করতে পারবে না! তাহলে উপায়!’

‘উপায় একটা আছে আমার কাছে।’ বলল কৃষ্ণ।

‘কী সেই উপায়?’ জানতে চাইল যুধিষ্ঠির।

কৃষ্ণ বিজ্ঞের মাথা দুলিয়ে বলল, ‘সেটা তুমি না হয় নাই-বা জানলে! শুধু এইটুকু জেনে রাখো, কিছু দিনের মধ্যে আমি ভীম আর অর্জুনকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের বাইরে যাব।’

‘বাইরে যাবে! বাইরে মানে কোথায়? ভীমার্জুনকে নিয়ে কোথায় যাবে তুমি!’

‘আহা দাদা! ওই তোমার অভ্যাস! অল্পতেই ভেঙে পড়ো তুমি! আমার ওপর ভরসা রাখো। তোমার ভাইদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না আমি।’ একনাগাড়ে বলে থামল কৃষ্ণ।

যুধিষ্ঠির আর কথা বাড়াল না। ভাবল—কৃষ্ণ তাদের পরম শুভাকাঙ্ক্ষী। সে ভীম আর অর্জুনকে নিয়ে এমন একটা কাজে ইন্দ্রপ্রস্থের বাইরে যাচ্ছে, যে-কাজ সফল হলে নিশ্চয়ই পাণ্ডবদের মঙ্গল হবে।

.

একদিন ভীম এবং অর্জুনকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ল কৃষ্ণ।

মগধে গিয়ে উপস্থিত হলো তারা।

মগধের রাজপদে তখন জরাসন্ধ।

জরাসন্ধ অত্যন্ত পরাক্রমশালী। তাঁর দুই কন্যা—অস্তি ও প্রাপ্তি। কালক্রমে ওরা যুবতি হয়ে উঠলে জরাসন্ধ তার দুই কন্যাকে মথুরার রাজা কংসের সঙ্গে বিয়ে দেন। কৃষ্ণ একদিন কংসকে বধ করে মথুরা দখল করে নেয়। জামাতাবধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জরাসন্ধ আঠারো বার মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রতিবারই কৃষ্ণ জরাসন্ধের হাত ফসকে পালিয়ে যায়। জরাসন্ধের মনে প্রতিহিংসা রাবণের চিতার মতো বহ্নিমান থাকে।

কৃষ্ণের এমন কোনো সামরিক শক্তি ছিল না, যা দিয়ে জরাসন্ধকে পরাজিত করবে। তবে তার ছিল ধুরন্ধরতা আর ছলনা। তক্কেতক্কে থাকে সে। একদিন হাতে সুযোগ এসে যায়। রাজসূয় যজ্ঞ করবে বলে মনস্থ করে যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে জরাসন্ধের ভয় দেখিয়ে কাবু করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, যুধিষ্ঠিরের ভয়কে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করবে। ভীম আর অর্জুনের সহায়তায় বহুদিনের পুরনো শত্রুকে খতম করবে।

সেই উদ্দেশ্যেই জরাসন্ধের রাজ্য মগধে উপস্থিত হলো কৃষ্ণ। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম ছদ্মবেশ ধারণ করেই মগধে এসেছে। ব্রাহ্মণের বেশ তাদের, মাথার পেছনে লম্বা টিকি। তাতে দূর্বা-তুলসী বাঁধা। মগধরাজ্যের সবখানে ব্রাহ্মণদের অবাধ গতায়াত।

একদিন এরা তিনজন জরাসন্ধের সামনে এসে দাঁড়াল। জরাসন্ধ তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন—আগত তিনজন দেখতে ব্রাহ্মণের মতো, কিন্তু বাহুতে ধনুর্গুণের আঘাতের চিহ্ন। সন্দেহ হলো জরাসন্ধের।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কারা?’

কৃষ্ণ নিজেদের পরিচয় লুকাল না। পরিচয় দিয়ে বলল, ‘তোমার পাপের বোঝা অনেক ভারী হয়ে গেছে জরাসন্ধ। আমরা এসেছি সেই পাপের বোঝা হালকা করতে। এই পাণ্ডুপুত্ররা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে।’

‘যুদ্ধ করতে এসেছে! এই পুঁচকে কচি দুটো ছেলে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে! ওরা জানে তো আমার সঙ্গে যুদ্ধ করলে তাদের মৃত্যু অবধারিত?’

‘নিজেকে নিয়ে এত অহংকার করো না জরাসন্ধ। ও হ্যাঁ, দুজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে না তোমায়। যে কোনো একজনকে বেছে নাও তুমি।’

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন জরাসন্ধ। বললেন, ‘ওটা তো হ্যাংলা টিনটিনে।’ অর্জুনকে দেখিয়ে তাচ্ছিল্য করলেন। ‘আর ওটা একটু নাদুসনুদুস আছে। তার সঙ্গে যুদ্ধ করে মজা পাব আমি। তা বাছা, কী নাম তোমার?’

‘ওর নাম ভীম। ভীমই তোমাকে যমালয়ে পাঠাবে।’

কৃষ্ণের কথা শুনে হাহা করে হেসে উঠলেন জরাসন্ধ।

তারপর ভীমের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হলেন জরাসন্ধ। দীর্ঘক্ষণ ধরে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কিন্তু কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারেন না।

অবশেষে ভীমের হাতে সুযোগ এসে যায়। জরাসন্ধের দুটো পা ধরে ফেলতে পারে ভীম জরাসন্ধকে দুই হাতে শতবার ঘুরিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে এবং কৃষ্ণের ইশারায় দুই পা ধরে টান দিয়ে জরাসন্ধের দেহকে মাঝবরাবর ফেড়ে ফেলে ভীম

জরাসন্ধকে হত্যা করিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসে কৃষ্ণ।

যুধিষ্ঠিরকে বলে, ‘এবার তোমার বাহিনীকে দিগ্বিজয়ে বের হতে বলো দাদা। আর হ্যাঁ, এই অভিযানে অর্জুনকে পাঠানোর দরকার নেই। ভীম একাই দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে আসতে পারবে। আসল শত্রুকে বিনাশ করে এসেছি।’

ভীম পাণ্ডববাহিনী নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হয়েছিল। পূর্বদিকের রাজ্যগুলো একে একে জয় করে অঙ্গদেশের সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছিল ভীম। সে জানে—এই রাজ্যের নৃপতি কর্ণ। তার ক্রোধ দ্বিগুণ হলো। দুর্যোধনের দোসর কর্ণের রাজপ্রাসাদকে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে তবে দেশে ফিরবে সে। কর্ণের বাহুবল সম্পর্কে ভীম কি জানত না? জানত। কিন্তু সদ্য জরাসন্ধের হত্যাকারীর মনে তখন প্রবল সাহস। তাছাড়া একের পর এক রাজ্য জয় করে নিজের ওপর আস্থা বেড়ে গেছে ভীমের। ওই আস্থাতেই অঙ্গরাজ্য আক্রমণ করে বসল ভীমবাহিনী। কিন্তু কর্ণ কি এমন মানুষ, যে ভীমের আধিপত্য মেনে নেবে? প্রবল বিক্রমে পাণ্ডববাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল কর্ণ

কোনোরকমে সম্মানটুকু নিয়ে দ্রুত অঙ্গরাজ্য অতিক্রম করে গেল ভীম।

নানা রাজ্য জয় করে ভীম ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলো। এরপর রাজসূয় যজ্ঞের প্রস্তুতি সম্পন্ন করল যুধিষ্ঠির।

এই রাজসূয় যজ্ঞে অন্যান্য রাজা-রাজকুমারের সঙ্গে দুর্যোধনও আমন্ত্রিত হলো। দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণও ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলো। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজমণ্ডল রাজসূয় উপলক্ষে একযোগে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সভাপ্রাঙ্গণে হাজারো উপহার নিয়ে বশ্যভাবে উপস্থিত হলো।

এটা দেখে দুর্যোধনের মনে ঈর্ষা প্রবল হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে কর্ণের মনও উত্তেজিত হয়ে উঠল।

পিতামহ ভীষ্মের উপস্থিতি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকে আরও মহিমান্বিত করে তুলল।

রাজসূয় যজ্ঞের মূল পর্বে যেকোনো একজনকে সর্বোত্তম সম্মান জানাতে হবে। এটাই যজ্ঞের নিয়ম। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পরামর্শ চাইলে তিনি কৃষ্ণের নাম প্রস্তাব করলেন। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ হলো। কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করল না কেউ।

একজন চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি জরাসন্ধের একদার প্রিয়পাত্র চেদিরাজ শিশুপাল। ভীষ্মের এই নির্বাচনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন শিশুপাল। ভীষ্মকে গালাগাল দিতে শুরু করলেন। শিশুপালের ভর্ৎসনা থেকে যুধিষ্ঠিরও বাদ গেল না।

যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ্য করে শিশুপাল চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘আপনি এ কী করলেন মহারাজ! নামকরা কাউকে যদি সম্মান জানাতেই হয় তাহলে অনেকেই ছিলেন এখানে। যাঁরা কৃষ্ণের চেয়ে মহৎ, মহাবীর, স্বনামধন্য, দোর্দণ্ডপ্রতাপী। আপনি তাঁদের উপেক্ষা করে কোথাকার কোন কৃষ্ণকে নির্বাচন করলেন সবচাইতে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে! এ বড় আশ্চর্যের ব্যাপার মহারাজ! আপনাকে আমি সুবিবেচক, ধীশক্তিসম্পন্ন বলে জানতাম এতদিন। আজ দেখছি এসবের কিছুই নন আপনি।’

তারপর কণ্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য ঢেলে যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করে শিশুপাল আবার বললেন, ‘আপনি পরম শ্রদ্ধার মানুষ হিসেবে কর্ণকে সম্মান জানাতে পারতেন। কর্ণের মতো মানুষ আর একটাও খুঁজে পাবেন এই যজ্ঞানুষ্ঠানে? কর্ণের ক্ষমতা দেবরাজ ইন্দ্রের মতো। ধনুকচালনায় তিনি অতুলনীয়। যিনি অঙ্গ-বঙ্গের অধীশ্বর, সেই কর্ণকে আপনি সম্মান জানাতে পারতেন মহামতী ভীষ্ম।’ ভীষ্ম ছিলেন শেষবাক্যের উদ্দিষ্ট।

যুধিষ্ঠির আর ভীষ্মের প্রতি রূঢ় ব্যবহারে কৃষ্ণ ক্রুব্ধ হয়ে ওঠে। হঠাৎ সভার মাঝে নিরস্ত্র শিশুপালকে আক্রমণ করে বসে কৃষ্ণ।

অপ্রত্যাশিত আক্রমণে বিহ্বল হয়ে পড়েন শিশুপাল। বিহ্বলতার সুযোগে সবার সামনে শিশুপালকে হত্যা করে কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের পবিত্র রাজসূয় যজ্ঞস্থল অসহায় শিশুপালের রক্তে রঞ্জিত হয়। হত্যার মতো একটা কলুষিত কাহিনি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

যজ্ঞশেষে সবাই ফিরে যান। ইন্দ্রপ্রস্থের ঐশ্বর্য দেখার জন্য দুর্যোধন, কয়েক দিন থেকে যায়। এই সময়ে স্ফটিকসদৃশ্য স্থানকে জল ভেবে পরিধেয়কে ওপর দিকে তুললে দ্রৌপদীর উপহাসের শিকার হয় দুর্যোধন।

মনে গভীর ব্যথা আর প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঈর্ষা নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে দুর্যোধন।

ফিরেই অন্যরকম এক চক্রান্ত শুরু করে।

এই চক্রান্তের নাম পাশাখেলা।

এই চক্রান্তের সূত্রধর শকুনিমামা।

বত্রিশ

হস্তিনাপুরে যে পাশাখেলার চক্রান্ত তৈরি হয়েছিল, তার মূলপর্বের সঙ্গে কর্ণ জড়িত ছিল না।

প্রথমে কর্ণ জানতও না এই ষড়যন্ত্রের কথা। শকুনি আর দুর্যোধনে মিলে চক্রান্তের প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিল। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করে গেছেন স্বয়ং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র।

দুর্যোধন-শকুনির অনুরোধে ধৃতরাষ্ট্র পাশাখেলার প্রস্তাব নিয়ে বিদুরকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠালেন।

বিদুরের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাব শুনে যুধিষ্ঠির চঞ্চল হয়ে উঠল। পাশাখেলার প্রতি যুধিষ্ঠিরের প্রচণ্ড দুর্বলতা। সে যে ভালো পাশুড়ে, তা নয়। কিন্তু পাশাখেলা তাকে অস্থির করে তোলে। তার কাছে পাশাখেলা ধর্ম-মোক্ষ-কর্ম—সবকিছু। তাই পিতৃব্যের মুখে পাশাখেলার আমন্ত্রণ পেয়ে এককথায় রাজি হয়ে গেল যুধিষ্ঠির।

তার পরও সৌজন্যবশত যুধিষ্ঠির বলল, ‘আপনি কী বলেন পিতৃব্য, যাব হস্তিনাপুরে? পাশাখেলায় অংশ নিতে? যদি বলেন যাও, তাহলে যাব। আর যদি না করেন, যাব না। যাওয়াটা কি উচিত কাজ বলে মনে করেন না আপনি?’

বিদুর ততক্ষণে বুঝে গেছে, পাশাখেলার ঘোর লেগেছে যুধিষ্ঠিরের মনে। আগে একটু-আধটু শুনেছিল—যুধিষ্ঠির পাশায় আসক্ত। আজ সেই শোনা কথা যে মিথ্যে নয়, বুঝে গেল বিদুর। এই অবস্থায় হস্তিনাপুর যেতে বাধা দিলে শুনবে না যুধিষ্ঠির।

বিদুর তাই বলল, ‘আমি কিছু বলতে চাই না যুধিষ্ঠির। যা শ্রেয় মনে হয়, তা-ই করো।’ বিদুরের কাছ থেকে বাধা না পেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠল যুধিষ্ঠির। জিজ্ঞেস করল, ‘কোন কোন প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ্ পাশাখেলায় উপস্থিত থাকবেন?’

নিস্পৃহ গলায় বিদুর বলল, ‘দেশ-বিদেশের অনেক অক্ষবিদ্ উপস্থিত থাকবেন শুনেছি। তবে এটা নিশ্চিত যে দুর্যোধনের হয়ে অক্ষনিপুণ কৃতহস্ত শকুনি এই পাশাখেলায় অংশ নেবে।’

যুধিষ্ঠির শকুনিকে তেমন পাত্তা দিল বলে মনে হলো না। নিজের দক্ষতায় যুধিষ্ঠিরের গভীর আস্থা। সে নিজেকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম পাশুড়ের একজন মনে করে।

বিদুরের সঙ্গে সপরিবারে হস্তিনাপুর চলে এলো যুধিষ্ঠির। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কুন্তী-দ্রৌপদী- পঞ্চপাণ্ডবকে সাদরে রাজপ্রাসাদে অভ্যর্থনা জানালেন।  

তারপর সেই দিনটি এলো।

সভাগৃহ গমগম করছে। একদিকে দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ। দুর্যোধনের পাশ ঘেঁষেই মাতুল শকুনি। কর্ণ মূল পাশাপরিকল্পনায় না থাকলেও আজ বন্ধুকৃত্যের কারণে দুর্যোধনের বাঁ পাশে বসেছে। শতরঞ্জির ওপর বসেছে তারা। পাশা তো শতরঞ্জির ওপরেই খেলতে হয়।

দুর্যোধনদের মুখোমুখি বসেছে যুধিষ্ঠির। তার পেছনে পাশাপাশি বসেছে চার ভাই—ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব। এরা মাথা নিচু করে বসলেও যুধিষ্ঠিরকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। দাদার এই খেলা যে অন্য চার ভাই পছন্দ করছে না, তা তাদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

অপরদিকে দুর্যোধনকে বড় হিংস্র দেখাচ্ছে। দুঃশাসনের চোখেমুখে নিষ্ঠুরতা। কী এক অদমনীয় ক্রোধে কর্ণের ভেতরটা তোলপাড় করছে বলে মনে হলো। শকুনির চোখেমুখে শেয়ালের চাতুরী।

দুই পক্ষের মাঝখানে পাশাটি বিছানো। তার ওপর ঘুঁটিটি নিস্পৃহভাবে পড়ে আছে।

এসব কিছুকে ঘিরে দেশ-বিদেশের বাঘা বাঘা পাশুড়েরা বসেছে।

একটু দূরের আসনে বসেছেন কুরু-উপদেষ্টারা। ভীষ্ম সবচাইতে উচ্চাসনে। তাঁর পাশে পরপর বিদুর, দ্রোণ, কৃপ এবং অন্যান্য মাননীয় মন্ত্রী-অমাত্য।

সিংহাসনে যথামর্যাদায় ধৃতরাষ্ট্র বসে আছেন।

দুর্যোধনের অন্য আটানব্বইজন ভ্রাতা সভার তদারক করছে।

খেলার প্রারম্ভেই যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘এই খেলায় কে কার প্রতিপক্ষ? হারের অর্থ কে মিটাবে?’

যুধিষ্ঠিরের এই কথাতে পাশাখেলার সকল সৌজন্য আর আড়াল-আবডাল খসে পড়ল।

সবাই জেনে গেলেন, আসন্ন পাশাখেলাটি আমোদের জন্য হবে না। অর্থ-ধনসম্পদ-রাজ্য— এসবকে বাজি রেখেই অক্ষক্রীড়াটি হবে।

দুর্যোধন বা শকুনি পণের কথা বলেনি। যুধিষ্ঠিরই বলল। কেন বলল? কারণ তার ভেতর জুয়ার নেশার ঘূর্ণি তখন। সকল সুবিবেচনা তছনছ করে দিয়ে ওই নেশাটাই যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়ে পণের কথাটা বলিয়ে নিল।

দুর্যোধন মওকা পেয়ে গেল। এই সুযোগটির অপেক্ষাতেই ছিল দুর্যোধন।

দুর্যোধন তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমার পক্ষের পণের অর্থ দেব আমি। আর আমার হয়ে পাশার চাল দেবে মাতুল শকুনি।

‘এ তো অন্যায় দুর্যোধন! অর্থ দেবে তুমি, খেলবে অন্যজন! এটা তো পাশাখেলার নিয়ম নয়!’ প্রতিবাদ করল যুধিষ্ঠির।

এই সময় দুর্যোধনভ্রাতারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘খেলুন খেলুন। খেলা শুরু করুন। যে-ই খেলুক, পণের অর্থ তো মিটাবেন দাদা দুর্যোধন! অর্থটাই তো আসল! কে খেলছে, সেটা তো গৌণ!

চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতিবাদ কোথায় হারিয়ে গেল!

খেলা শুরু হয়ে গেল।

প্রথম চালেই হেরে গেল যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারল, মামার ঘুঁটি চালনায় কারসাজি আছে। যে কারসাজি অন্যরা ধরতে পারল না, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ধরতে অসুবিধা হলো না।

শকুনির চোখে চোখ রেখে যুধিষ্ঠির ধমকের সুরে বলল, ‘মামা, আপনার চালে কপটতা আছে। প্রতারণা করেই আপনি প্রথম বাজিটা জিতে নিলেন।

শকুনি যেন আকাশ থেকে পড়ল! এমন ভান করল যেন হতাশায় আর অপমানে ভীষণভাবে আহত হয়েছে সে। তার বিস্মিত বোকা চাহনির অন্তরালে শকুনির সকল ক্রূর কুটিলতা চাপা পড়ে গেল। হতবাক আর হতমান হওয়ার ভান করে নিশ্চুপ থাকল শকুনি। যুধিষ্ঠিরের প্রতিবাদটি শকুনির হতমানতার অভিনয়ের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।

খেলা আবার শুরু হলো।

বারবার বহুবার পাশার চাল ফেলল শকুনি। প্রতিবারই যুধিষ্ঠির হারল।

শকুনির সঙ্গে পাশাখেলায় রাজা যুধিষ্ঠির তার সর্বস্ব হারিয়ে বসল। ধনসম্পত্তি-অর্থ-রাজ্য—সব হারিয়ে যুধিষ্ঠির উদ্ভ্রান্তপ্রায়। জুয়াখেলার সময় জুয়াড়িরা যেমন ভাবে—পরের দানটা নিশ্চয়ই জিতব সেই প্রত্যাশায় আগের দান হারা সত্ত্বেও পরের দানটা খেলে। খেলে অথচ হারে। যুধিষ্ঠিরেরও একই অবস্থা। পরের দান জিতবে বলে বাজি ধরেছে এবং শকুনির প্রতারণাদক্ষতায় হেরেছে।

একে একে প্রাণপ্রিয় ভাইদের পণ রেখেছে যুধিষ্ঠির এবং হেরেছে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি সে। জুয়ার নেশা তাকে মত্ত করে তুলেছে। এই মত্ততার ঘোরে নিজেকে পর্যন্ত বাজি রাখতে দ্বিধা করেনি যুধিষ্ঠির। বাজিতে নিজেকেও হেরেছে।

শকুনি জানে, যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালোবাসে কিন্তু পাশাখেলাটাই সে ভালো করে জানে না। এই সুযোগটা নিয়েছে শকুনি-দুর্যোধনরা। একটি একটি করে সবই আদায় করে নিয়েছে তারা যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে।

সব কিছু হারিয়ে যুধিষ্ঠির যখন হতভম্ব, ঠিক ওই সময় শকুনি যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘নিজেকে বাজি ধরে হেরে যাওয়াটা বড় কষ্টকর মহারাজ। তাছাড়া পণ ধরার মতো তোমার তো অন্য জিনিস রয়েছে! অন্য ধন থাকতে নিজেকে হেরে বসাটা একেবারেই ঠিক হয়নি মহারাজ।’

যুধিষ্ঠিরের মধ্যে তখন হতাশা, লজ্জা আর বিস্ময়ের ঘূর্ণি। ওই অবস্থাতেই তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘অন্য ধন!

শকুনি চোখ চিকন করে বলল, ‘হ্যাঁ, অন্য ধন তোমার কাছে আছে মহারাজ। তুমি তো এখনো পুরোপুরি সর্বস্বান্ত হয়ে যাওনি! তোমার কাছে তো এখনো মহামূল্যবান দ্রৌপদী আছে। তাকেই বাজি ধরো এবং হারানো সর্বস্ব আবার জিতে নাও।’

যুধিষ্ঠির তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। তার সুচিন্তা আর শুভবোধ উধাও হয়ে গেছে। শকুনির প্রস্তাব যুধিষ্ঠিরের মনে ধরে গেল। উন্মত্ত যুধিষ্ঠির অমনি দ্রৌপদীকে পণ রাখবে বলে স্থির করে ফেলল। তার কাছে দ্রৌপদী তখন তার স্ত্রী নয়, রক্তসম্পর্ক আর প্রেমানুভূতির কোনো নারী নয়, দ্রৌপদী শুধু পণ্য তখন।

নিয়ম হলো যে-পণ্য বাজি ধরা হয়, তার গুণ বা মূল্যের বর্ণনা দিতে হবে। আর গুণকীর্তন করবে, যে পণ্যটি বাজি ধরে সে। এক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরের দায় দ্রৌপদীর রূপ-গুণ ইত্যাদির বর্ণনা করা। উন্মাদ দায়িত্বহীন জুয়াড়ির মতো যুধিষ্ঠির তার বাজিধরা পণ্য দ্রৌপদীর গুণগান করতে শুরু করল, ‘আপনারা সকলে জানেন কিনা জানি না। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে ঘর করে আমি তার সম্পর্কে যা জেনেছি বুঝেছি, তা-ই বর্ণনা করছি আপনাদের সামনে। আমার বর্ণনার মধ্যে চুল পরিমাণ মিথ্যে নেই।’ বলেই একটু থামল যুধিষ্ঠির।

পেছন থেকে ভীম ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এসব কী বলছ দাদা! আমাদের স্ত্রীকে বাজারের পণ্য করছ! তুমি কি সত্যি সত্যি উন্মাদ হয়ে গেলে!’

ডান হাতটা ওপর দিকে তুলল যুধিষ্ঠির। সেই হাতের ভঙ্গিতে ভীমকে চুপ থাকার নির্দেশ। ভীম চুপ করল বটে, কিন্তু তার ফোঁসফোঁসানি শুনতে পেল যুধিষ্ঠির। তাতেও হুঁশে ফিরল না সে। দ্রৌপদীর পরবর্তী বর্ণনার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।

এই যে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী পাশাখেলা চলছে, যাতে জেতার জন্য উল্লাসধ্বনি আর হারার জন্য আর্তনাদ হয়েছে, তাতে একবারের জন্যও অংশগ্রহণ করেনি কর্ণ। দুর্যোধনের পাশে স্থির হয়ে বসে থেকেছে। যুধিষ্ঠির একে একে রাজ্যপাট, ধনদৌলত, ভাই এবং নিজেকে পণ রেখে হেরেছে, তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি কর্ণের মধ্যে। একটা একটা দ্রব্য জিতেছে আর উন্মত্ত-উল্লাসে ফেটে পড়েছে দুর্যোধন। বারবার কর্ণকে আহ্বান জানিয়েছে জয়ের হুল্লোড়ে অংশ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কর্ণ আগের মতো স্থির হয়ে সকল কিছু নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখে গেছে। একটিও শব্দ করেনি, কোনো আঙ্গিক প্রতিক্রিয়া তো দূরের কথা!

কিন্তু দ্রৌপদীর নাম যখন উচ্চারিত হলো, নড়ে উঠল কর্ণ। এই সেই দ্রৌপদী, যাকে সে পায়নি। এই সেই দ্রৌপদী, যে তাকে উন্মুক্ত স্বয়ংবরসভায় জাত তুলে তিরস্কার করেছে। আজ তারই সামনে যুধিষ্ঠির সেই দ্রৌপদীর দৈহিক বর্ণনা দিতে যাচ্ছে! গাঢ় ঔৎসুক্য নিয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাল কর্ণ।

যুধিষ্ঠির তখন বলতে শুরু করেছে, ‘আপনারা যারা দ্রৌপদীকে দেখেছেন, দূর থেকে দেখেছেন। তাও বেশি সময়ের জন্য নয়। আমি এখন দ্রৌপদীর যে বর্ণনা দিতে যাচ্ছি, তা কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে, দীর্ঘদিন একসঙ্গে সহবাস করার অভিজ্ঞতা থেকে।’

স্ত্রী সম্পর্কে এমন ধরনের নাজুক কথা বলতে গেলে যেকোনো স্বামীর কণ্ঠস্বর বুজে আসবে, যেকোনো স্বামী ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ক্ষেত্রে তা হলো না। সকল লজ্জা, সকল ভদ্রতাবোধ আজ যেন তাকে পরিত্যাগ করে গেছে!

যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর প্রমত্ত বর্ণনা দিতে শুরু করল, ‘দ্রৌপদী বেঁটেও নয়, লম্বাও নয়। আবার রোগাও নয় সে। একজন পুরুষের মনে মাদকতা ধরানোর জন্য একজন নারীর যে দৈহিক গড়ন হওয়া উচিত, দ্রৌপদীর দেহ তার চেয়ে অনেক গুণ বাড়া। কালো-কোঁকড়া চুলের ঢাল নেমেছে তার পিঠ বেয়ে। মুখখানি দেখলে মনে হবে যেন পদ্মফুল ফুটে আছে। তার অধর পুষ্ট, ঠোঁট লাল। সমস্ত শরীরে একখানি লোমও খুঁজে পাওয়া যাবে না তার। দ্রৌপদীর অঙ্গসংস্থান অপূর্ব এবং অনিন্দ্য। তার মতো সুগঠিত দেহের রমণী সমস্ত ভারতবর্ষে আর একজনও খুঁজে পাবেন না আপনারা।’ একটু থামল যুধিষ্ঠির। দীর্ঘ শ্বাস টানল একটা।

তারপর আবার বলল, ‘দ্রৌপদীর স্বভাবচরিত্রের কথা বলার প্রয়োজন নেই এখানে। তারপরও বলছি, যেহেতু আমি তাকে পাশাখেলায় পণ ধরেছি, তার সম্পর্কে বলা আমার কর্তব্য। দ্রৌপদীর স্বভাব-অভ্যাস তুলনাহীন। স্পষ্টভাষী সে। আবার লাবণ্যময়ীও। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ শ্রোতার কানে সুখধ্বনি হয়ে বাজে। একজন পুরুষ ঠিক যা যা একজন রমণীর মধ্যে দেখতে চায়, দ্রৌপদীর মধ্যে ঠিক তা তা-ই আছে। এই অভূতপূর্বা দ্রৌপদীকে আজ আমি পণ রাখলাম।’

হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে, কি ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে ‘দ্রৌপদী’ একটি মর্যাদার নাম। তাকে নিয়ে অসভ্যতার কথা ভাবতেই পারে না দুর্যোধনরা। কিন্তু আজ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ্য বানিয়ে যে রগড়ানো বর্ণনা দিল, তাতে কৌরবপক্ষের ভয়টা ভেঙে গেল। যুধিষ্ঠিরই সেই সুযোগটা দুর্যোধনের হাতে তুলে দিল।

তেত্রিশ

এমন একটা দিনের জন্য প্রতীক্ষা করে ছিল কর্ণ।

যুধিষ্ঠিরের এই নগ্ন বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সভাগৃহের চারদিক থেকে ধিক্কারের গুঞ্জন উঠল।

ভীষ্মের তখন অধোবদন। ভাবছেন—এ কে! এ কী পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির! ন্যায়বান, ধর্মভীরু, সত্যনিষ্ঠ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল যে যুধিষ্ঠিরকে আমি এতদিন জেনে এসেছি, এ তো সে নয়! ছি ছি ছি!

দ্রোণাচার্য বিস্ফারিত চোখে একবার অর্জুনের দিকে, আরেকবার যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাতে লাগলেন। কৃপাচার্য দেখলেন, যুধিষ্ঠিরের পেছনে বসা পাণ্ডবচতুষ্টয়ের চিবুক বুকের সঙ্গে লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিদুর লজ্জায় আর ঘৃণায় চোখ দুটো বুজে আছে। রাজসভার অধিকাংশ‍ই যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে ভর্ৎসনাধ্বনি উচ্চারণ করছে। যে অল্পসংখ্যক অমাত্য দুর্যোধনের পক্ষপাতী, তাদের মুখেও কথা নেই—পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে, যে নিজের স্ত্রীর এমন নগ্ন বর্ণনা দিতে পারে! তাও প্রকাশ্য সভাগৃহে!

প্রমত্ত যুধিষ্ঠিরের এই নগ্ন বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সভাগৃহ যখন তিরস্কারের গুঞ্জনে এলোমেলো, ঠিক তখন দুজন মানুষের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।

তাঁদের একজন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। প্রতি চাল দেওয়ার পর যিনি কেবলই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিলেন, এই বাজিটা কে জিতল? দুর্যোধন জিতল তো শকুনি?

আর দ্বিতীয়জন হলো কর্ণ। এত হট্টগোলের মধ্যে কর্ণ সজোরে প্রতিহিংসার হাসি হেসে উঠল। সবাই কর্ণের দিকে তাকালেন।

কর্ণ ওঁদের চাহনিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হেসেই গেল। কর্ণের হাসির সঙ্গে দুর্যোধন-দুঃশাসনের হাসি যুক্ত হলো। ক্রমশ প্রতিশোধের হাসিটা অন্য আটানব্বই জন দুর্যোধনভ্রাতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মিলিত হাস্যধ্বনিতে সমস্ত সভাগৃহ কাচের মতো ঝনঝনাৎ করে ভাঙতে থাকল।

কর্ণের পরিহাসমাখানো উচ্চহাস্য সবার হাসিকে ছাপিয়ে গেল। তার উৎকট হাসির কারণ অর্জুনের জেতা দ্রৌপদী। পঞ্চপাণ্ডবের অঙ্কশায়িনী দ্রৌপদী আজ দুর্যোধন-শকুনির অপকৌশলে হাতের মুঠোয়। অহংকারী দ্রৌপদীর দর্প আজ রাজসভায় ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলা যাবে। কর্ণের এই হাসির সঙ্গে কর্ণের রমণেচ্ছা জড়িয়ে নেই, জড়িয়ে আছে অপমানের প্রতিশোধস্পৃহা।

যাই হোক, যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরল।  

যথানিয়মে শকুনির চালে হেরে বসল।

বাজি জিতবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন আদেশ দিল, ‘দ্রৌপদীকে সভাগৃহে নিয়ে এসো।’

দ্রৌপদী তখন রাজবধূর মর্যাদায় কুরুরাজপ্রাসাদে অবস্থান করছিল। কুরুরাজপত্নী হিসেবে গান্ধারীর যে সম্ভ্রম, পাণ্ডবরাজপত্নী হিসেবে দ্রৌপদীরও তেমনি সম্ভ্রম। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য দ্রৌপদীর সেই সম্মান আজ ধুলায় লুটাতে বসেছে। রাজবধূ থেকে নিমিষেই যে সে দাসীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, জানে না দ্রৌপদী। তখনো দ্রৌপদীর হারানো মর্যাদার খবর প্রাসাদাভ্যন্তরে এসে পৌঁছেনি।

দুর্যোধনের আদেশ পালন করার জন্য কেউ সাহস পাচ্ছিল না। এত বড় একজন রাজা যুধিষ্ঠির, তার যে দোর্দণ্ডপ্রতাপী ভাই ভীমার্জুন, তাদের উপেক্ষা দেখিয়ে কে যাবে দ্রৌপদীকে এই রাজসভায় নিয়ে আসতে? সবাই তটস্থ থাকল। যুধিষ্ঠির অধোবদনে নিরুত্তর। অন্য ভাইদের অবস্থাও তথৈবচ। শুধু ভীমের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ। তার নাক দিয়ে গরম নিশ্বাস নির্গত হচ্ছে।

দুর্যোধন এবার গর্জে উঠল, ‘কে গেছে দ্রৌপদীকে আনতে?’

দুঃশাসন বলল, ‘এখনো কেউ যায়নি দাদা। সাহস করছে না কেউ। এখন কী করব?’

‘ওই সূতপুত্র প্রতিকামীকে পাঠাও। ও বেটা গিয়ে দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে আসুক।’ অদূরে দাঁড়ানো একজন সারথিপুত্রকে লক্ষ্য করে দুর্যোধন বলল।

তার পাশে যে আরেক সূতপুত্র কর্ণ বসে আছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দুর্যোধনের। প্রতিহিংসা তখন তার মাথায় চড়েছে।

প্রতিকামী প্রাসাদাভ্যন্তরে গিয়ে ফিরে এলো। দ্রৌপদী তাকে যে যে প্রশ্ন করেছে, উত্তর দিতে পারেনি সে।

দুঃশাসন প্রতিকামীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি আবার যাও। গিয়ে বলো, তার সকল প্রশ্নের উত্তর এই সভাগৃহে দেওয়া হবে।’

প্রতিকামী গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার একা ফিরে এলো।

দুর্যোধন গালাগাল দিয়ে বলল, ‘ও সারথির বেটা ভীমকে ভয় করছে। যদি ভীম ওর মুণ্ডু ছিঁড়ে নেয়! তাই আমার আদেশ ঠিকঠাক মতন দ্রৌপদীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না সে। তুমি এক কাজ করো দুঃশাসন।’ বলে কর্ণের মুখের দিকে তাকাল দুর্যোধন। দেখল, কর্ণের চোখেমুখে প্রতিশোধের ক্রোধ।

কার ওপর রাগ, মুহূর্তেই বুঝে গেল দুর্যোধন। কর্ণের কাছ থেকে নীরব সমর্থন পেয়ে দুর্যোধন আরও সাহসী হয়ে উঠল।

দুঃশাসনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ওই সূতপুত্র যখন ভয় পাচ্ছে, তুমি যাও দুঃশাসন। দ্রৌপদীকে যে বেশে যে অবস্থায় পাবে, ধরে আনবে।’

দাদার আদেশ পেয়ে দুঃশাসন দ্রুত পায়ে দ্রৌপদীর আবাসনের দিকে এগিয়ে গেল।

অল্পক্ষণের মধ্যে দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে অনেকটা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে সভাগৃহে নিয়ে এলো দুঃশাসন। দ্যূতসভা তখন নির্বাক, নিস্তব্ধ। দ্রৌপদী তখন নিজের দুরবস্থার কথা ভুলে জ্বলন্ত চোখে পাণ্ডবদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কটাক্ষে আগুন যেমন আছে, অসহায়তাও আছে। দ্রৌপদীর অসহায়তা বুঝতে পেরে দুঃশাসন একঝটকায় দ্রৌপদীকে নিজের দিকে ফেরাল।

সশব্দে হেসে বলল, ‘তুই হলি আমাদের দাসী। দাসী শব্দের অর্থ জানিস তো? দাসী মানে ঘরের কাজকর্ম করার নারী নয় শুধু, সময়ে-অসময়ে গৃহস্বামীর ভোগ্যাও। বাজিতে তোকে হেরেছে তোর স্বামী। এখন তুই কৌরবদের অধীন। দাদা দুর্যোধনই এখন তোর মালিক।’

দুঃশাসনের কথায় বড় ফুর্তি পেল কর্ণ। তার এতদিনের ক্ষোভ-অপমানের অনেকটাই দুঃশাসনের ‘দাসী’ সম্বোধনের মধ্য দিয়ে মিটে যেতে থাকল যেন!

দুঃশাসনকে উদ্দেশ করে কর্ণ বলল, ‘তুমি দ্রৌপদীর জন্য যথোপযুক্ত শব্দটাই ব্যবহার করেছ। ও তো দাসী ছাড়া আর কিছুই নয়। দাসীরা বহুভোগ্যা। আর বহুদিন আগে থেকেই তো পাণ্ডবরা তাকে মিলেজুলে ভোগ করে আসছে! এই শব্দটির জন্য তোমাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না দুঃশাসন!’

কর্ণের প্রশংসায় আরও উদ্দীপিত হয়ে উঠল দুঃশাসন। দ্রৌপদীকে সবার সামনে টানাহেঁচড়া শুরু করল। দুঃশাসনের অসভ্যতায় দ্রৌপদীর ঊর্ধ্বাঙ্গের উত্তরীয় বাস খসে পড়ল। তবু দুঃশাসনের হাত থেকে রেহাই পেল না দ্রৌপদী।

জনসমক্ষে রাজসভায় স্ত্রীকে জঘন্যভাবে অপমানিত হতে দেখেও যুধিষ্ঠিরসহ চার ভাই মাথা নিচু করে থাকল।

কিন্তু ভীম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।

ক্ষিপ্রগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে তেড়ে গেল ভীম। বলল, ‘তুমি একজন জুয়াড়ি ছাড়া আর কিছু নও। জুয়ার নেশায় তোমার হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেছে। রাজ্য, ধন সব হারিয়েছ, কিছু বলিনি। আমাদের পণ ধরেছ, চুপ করে থেকেছি। নিজেকে বাজি ধরে হেরে গিয়ে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছ। তার পরও তোমার জুয়া-আসক্তি কমেনি। তারপর কী করলে, দ্রৌপদীকে পণ ধরে বসলে তুমি! তুই একটা অমানুষ ছাড়া আর কিছু নস। যুধিষ্ঠির, পশুরও অধম তুই। পশুরা কখনো তার সঙ্গিনীকে অন্য পশুর সঙ্গে ভাগাভাগি করে না। যা আজ তুই করলি। তুই বড় ভাই হয়ে বেঁচে গেলি, নইলে আজ তোকে যমালয়ে পাঠাতাম আমি।’

ভীমের রুদ্রমূর্তি দেখে যুধিষ্ঠির ভয় পেয়ে গেল।

ওই সময় অর্জুন দ্রুত পায়ে ভীমের কাছে এগিয়ে এলো। দুহাত ধরে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘শান্ত হও দাদা, শান্ত হও। এই সময় উত্তেজিত হয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললে পাণ্ডবদের কুকীর্তির আর অন্ত থাকবে না।’

‘তুমি কি বলতে চাইছ, যুধিষ্ঠিরের এই জঘন্য কীর্তির পরে আমাদের সুনাম গাইবে ভারতবর্ষের মানুষেরা?’

ভীমের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই অর্জুনের কাছে। আপ্রাণ চেষ্টা করে ভীমকে স্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গেল অর্জুন।

এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু নিশ্চুপ। উৎকর্ণ হয়ে সকলের কথা শুনে যেতে লাগলেন তিনি। তিনি মনে করলেন, এইবার তাঁর পুত্রদের ব্যভিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন কুরুবৃদ্ধরা। কিন্তু কেন জানি ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপদের মধ্য থেকে কেউ কিছু বললেন না। দুর্যোধনের হিংস্রতা আর দুঃশাসনের অনাচার দেখে তাঁরা কি ভয় পেয়ে গেছেন? নাকি দ্রৌপদী সুন্দরীর যৌবনদীপ্ত নগ্নদেহ দেখবার জন্য মনে মনে লালায়িত হয়ে উঠেছেন তাঁরা? তাঁরা ধমক দিলে দুঃশাসনের টানাটানি বন্ধ হয়ে যাবে, তখন তো দ্রৌপদীর বসন স্খলিত হবে না! বসন স্খলিত না হলে দ্রৌপদীর দেহ চোখ দিয়ে চাটবেন কী করে কুরুবৃদ্ধরা! তাই হয়তো তাঁরা সবাই নির্বাক থাকলেন। চোখ বড় বড় করে দেখে যেতে লাগলেন সব।

কুরুবৃদ্ধরা দ্রৌপদীলাঞ্ছনার বিরোধিতা না করলেও একজন করল। সে দুর্যোধনভ্রাতা বিকর্ণ। বিকর্ণ সভার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠিরের দ্রৌপদীকে পণ ধরার বৈধতার বিরোধিতা করে বলল, ‘বউঠান দ্রৌপদী শুধু দাদা যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী নন, তিনি অন্য চার পাণ্ডবেরও স্ত্রী। বউঠানের ওপর যুধিষ্ঠিরের একক অধিকার নেই, ওঁর ওপর অন্য চার ভাইয়েরও অধিকার আছে। কিন্তু আমরা সকলে দেখলাম, অন্য ভাইদের অনুমতি না নিয়ে দাদা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ ধরেছেন। সুতরাং এই বাজি অবৈধ।’

দুঃশাসন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ধমকে উঠল, ‘বিকর্ণ, তুই থামবি?’

‘না। আমি আজ থামব না দাদা। তোমরা সবাই মিলে আজ দ্রৌপদী বউঠানের ওপর যে অনাচার শুরু করেছ, তা অন্যায়। কুরুবৃদ্ধরা এই দুষ্কর্মের প্রতিবাদ না করলেও আমি করছি।’

একটু থামল বিকর্ণ। তারপর পিতামহ ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কাছেই জানতে চাই পিতামহ, যে স্বামী আগে নিজেকে পণ ধরে অন্যের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন, সেই স্বামীর কি দ্রৌপদী বউঠানের ওপর অধিকার থাকতে পারে?’

ভীষ্ম বা দ্রোণ অথবা বিদুর কিংবা কৃপাচার্য—কেউই বিকর্ণের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অদ্ভুত এক কারণে সবাই চুপ করে থাকলেন।

রোষে কঠিন হয়ে উঠল বিকর্ণের কণ্ঠস্বর, ‘আপনারা সুবিধাবাদী এবং ভীত—আজকে আপনাদের কর্মকাণ্ডে তাই প্রমাণ হয়ে গেল। আপনারা ভাবছেন, দুর্যোধন-দুঃশাসনের বিরোধিতা করলে রাজপ্রাসাদের আশীর্বাদ আপনাদের ওপর থেকে সরে যাবে। আমি কিন্তু ওসবকে তোয়াক্কা করি না। আমি স্পষ্ট গলায় বলছি, এ দুর্যোধনের অন্যায়, অবিচার। শুধু তা-ই নয়, দুষ্কর্মও।

তারপর কণ্ঠকে অগ্নিগর্ভ করে বিকর্ণ বলল, ‘নারীলাঞ্ছনা বন্ধ করো তোমরা। এর ফল কিন্তু মোটেই ভালো হবে না।’ বলে থরথর করে কাঁপতে লাগল বিকৰ্ণ।

দুর্যোধন হতভম্ব হয়ে গেল। বিকর্ণের যুক্তির বিপরীতে কোনো যুক্তি দুর্যোধনের কাছে নেই।

দুঃশাসনও থতমত খেয়ে গেল। দ্রৌপদীলাঞ্ছনার হাত দুটো থেমে গেল তার। নিরুপায় দুর্যোধন অসহায় ভঙ্গিতে কর্ণের দিকে তাকাল। কর্ণ বুঝল, দুর্যোধন তার কাছে সাহায্য চাইছে। বন্ধুকৃত্য তো তাকে করতেই হবে! শুধু বন্ধু দুর্যোধনকে সাহায্য করা তো নয়, যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীকে নিয়ে সংঘটিত গোটা ব্যাপারটাই তো তার ভালো লাগছে! পাঁচ ভাই পাশাখেলার জাঁতাকলে আটকে ছটফট করছে, কর্ণের মজা লাগছে। পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদীর বুকের প্রাবরণবাস খুলে পড়েছে দুঃশাসনের টানাটানিতে, কর্ণের ভালো লাগছে। এসব দেখেশুনে তার মনের ক্ষোভ কিছুটা কমে আসছে

এই যে মজা পাওয়া, এই যে ভালো লাগা—এটা কি তার মনের বিকার? আচমকা নিজেকে প্রশ্ন করে কর্ণ।

মন বলে, এটা তো তোমার বিকৃতিই কর্ণ!

মনের উত্তর পেয়েও কর্ণ সেই মানসিক স্বাস্থ্যহীনতাকে স্বাগত জানাল।

বিকর্ণের কথা শুনে কর্ণের খুব রাগ হলো। ক্রোধাচ্ছন্ন কর্ণ বিকর্ণের হাতে প্রচণ্ড এক ঝাঁকানি দিল।

চৌত্রিশ

ঝটকা খেয়ে বিকর্ণ শক্ত চোখে কর্ণের দিকে তাকাল।

তার বড় দাদা দুর্যোধন যে-কাজ কোনোদিন করেনি, আজ তা কর্ণ দাদা করল! তার গায়ে হাত দিল! এ কেমন অনধিকারচর্চা কর্ণ দাদার! ও যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র, ভুলে গেল? ভুলে তো গেছেই! নইলে এতবড় গর্হিত কাজ করে! দুর্যোধন দাদার প্রশ্রয়েই আজ কর্ণ দাদা এ কাজ করবার সাহস পেল।

এসব যখন ভেবে যাচ্ছে বিকর্ণ, ঠিক তখনই কর্ণের কথা কানে এসে বাজল, ‘বিকর্ণ, আমি অস্বীকার করছি না যে এই দ্যূতসভায় অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমি মানছি, দ্রৌপদীকে নিয়ে এই যে টানাহেঁচড়া করছে দুঃশাসন, তা মানসিক বিকার ছাড়া আর কিছু নয়।’

ঝটকার ঘোর বিকর্ণ তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কর্ণের কথা শুনে বিকর্ণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কর্ণ যেহেতু দাদা দুর্যোধনের বন্ধু, সুতরাং সে যে দুর্যোধনদের অন্যায়ের পক্ষ নেবে, তা তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু কর্ণ তো তা করছে না! সে তো উলটো সুরে বলছে! পরবর্তী কথা শুনবার জন্য উৎকর্ণ হলো বিকৰ্ণ।

কর্ণ বলল, ‘কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছ, এই বিকারের জন্য দায়ী কে? আমি বলছি, সভাগৃহের এই বিকারের জন্য দায়ী দ্রৌপদী নিজেই।’

‘আমি জানতাম, তুমি সকল দায় দ্রৌপদী বউঠানের ওপর চাপাবে। কিন্তু কেন চাপাচ্ছ জিজ্ঞেস করতে পারি? বউঠান নারী বলে, অবলা ভেবে তার ওপর সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের অপরাধকে চোখের আড়ালে নিয়ে যেতে চাইছ তোমরা।’ ঘাড় বাঁকা করে স্পষ্ট গলায় বলল বিকৰ্ণ।

দুঃশাসন গরম চোখে কী একটা বলতে গেলে কর্ণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্রৌপদীর প্রতি তোমার এত সোহাগ কীসের বিকর্ণ? যাদের বউ এই দ্রৌপদী, কই তারা তো দ্রৌপদীর পক্ষে কিছু বলছে না! তারা তো মনে করছে, দ্রৌপদীকে আমরা যখন জিতেই নিয়েছি, দ্রৌপদী এখন আমাদের!’

‘এই জেতাটাই তো মিথ্যা! দাদা যুধিষ্ঠিরের বউঠানকে পণ ধরার কোনো অধিকারই তো নেই!’

কর্ণ যুক্তির দিকে না গিয়ে ধমকের দিকে গেল।

বলল, ‘বিকর্ণ, তুমি একটা বাচ্চা ছেলে। সংসারের কতটুকু অভিজ্ঞতাই-বা তোমার আছে! বাচ্চা ছেলের মতো থাকো। ছোটমুখে বড়দের মতো কথা বলার দরকার কী তোমার?’  

কণ্ঠে আরও রূঢ়তা ঢালল কর্ণ, ‘ধর্মাধর্মের কী বোঝ হে তুমি? সেই প্রথম থেকে জেতা- দ্রৌপদীকে না-জেতা দ্রৌপদী বলে যাচ্ছ!’

কর্ণের ধমকানিটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে ধমককে মারার মতো মনে হলো বিকর্ণের।

কর্ণ ওখানে থেমে গেলে ভালো হতো। কিন্তু থামল না। বিকর্ণের ওপর তার রাগ তখনো কমে আসেনি।

কর্ণ বলল, ‘বিকর্ণ, এটা তুমি খেয়াল করেছ, যুধিষ্ঠির সর্বস্ব বাজি রেখে হেরেছে। তাহলে এই দ্রৌপদী কি যুধিষ্ঠিরের সর্বস্বের বাইরে?’

বিকর্ণ আজ ভয়পাওয়া ভুলে গেছে। মাথা সোজা করে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আজ ক্ষমতা তোমাদের হাতে। হস্তিনাপুর তোমাদের। এটা ইন্দ্রপ্রস্থ নয় যে সৈন্য আর জনগণ তোমাদের রুখে দেবে! তাছাড়া, এই অন্যায় পাশাখেলার আসরে সব কিছুই কৌরবদের অনুকূলে। যিনি তোমাদের দুষ্কর্মে বাধা দেবেন, সেই ধৃতরাষ্ট্র তোমাদের হয়েই কথা বলছেন। যে কুরুবৃদ্ধদের ভারতবর্ষের বিবেক বলে আপামর জনসাধারণ জানত, সেই পিতামহ-দ্রোণ-বিদুর-কৃপরা তাঁদের বিবেককে বিকিয়ে দিয়েছেন। তোমাদের হয়ে তারা নির্বাক রয়েছেন এখনো। তোমাদের জন্য আমার কাছে ধিক্কারধ্বনি ছাড়া আর কিছুই নেই।’

বিকর্ণের কথা শুনে দুঃশাসন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিয়ে বিকর্ণের দিকে এগিয়ে আসতে গেল দুঃশাসন।

বিকর্ণ তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘যেখানে আছ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো দাদা। খেয়াল করো, তোমার চেয়ে আমি হীনবলের নই। আমার গায়ে হাত তুলতে গেলে এই কুরুসভায় একটা রক্তারক্তি হয়ে যাবে।’

বিকর্ণের তেজি কথাগুলো শুনে ভড়কে গেল দুঃশাসন। যেখানে ছিল, কাঁচুমাচু মুখ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।

তারপর শক্ত ঘাড়টি কর্ণের দিকে ফেরাল বিকর্ণ। বলল, ‘তুমি যুধিষ্ঠিরের সর্বস্বের কথা বলছিলে না কর্ণ? বলছিলে—দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সর্বস্বের মধ্যে পড়েন। তোমাকে জিজ্ঞেস করি, দ্রৌপদী কি যুধিষ্ঠিরের একার? একার তো নয়! এই দ্রৌপদী বউঠানের ওপর অন্য চার পাণ্ডবের ও সমান অধিকার। কই যুধিষ্ঠির তো দ্রৌপদীকে পণ ধরার সময় অন্য চার ভাইয়ের অনুমতি নেননি! তাহলে এই বাজি মিথ্যে, দ্রৌপদীজয় মিথ্যে।’ শেষের দিকে ক্রোধে-ক্ষোভে বিকর্ণের কণ্ঠস্বর বুজে আসতে চাইল।

হো হো করে উপহাসের হাসি হেসে উঠল কর্ণ। হাসি থামিয়ে বলল, ‘বাজিতে দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ করেছে যুধিষ্ঠির। অন্য পাণ্ডবরা তখন তার পাশেই বসা ছিল। কেউ একটি শব্দ করেনি। মৌন থেকেছে সবাই। আর তোমার বয়স কম হলেও না-জানার কথা নয় যে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। পাণ্ডবদের মৌনতায় দ্রৌপদীর বাজি সমর্থিত হয়েছে। এখন তুমি বলছ, দ্রৌপদীকে আমরা জিতিনি!’

বিকর্ণ কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘এখনো বলছি, সেই জেতা সঠিক নয়, চাতুরীতে ভরা। জেতার নাম করে একবস্ত্রা একজন রাজমহিষীকে রাজসভায় এনে টানাহেঁচড়া করছ—এর চেয়ে বড় কোনো অন্যায় সসাগরা পৃথিবীতে কখনো হয়নি।’

কর্ণ-বিকর্ণের কথায় দুর্যোধন বেশ মজা পাচ্ছিল। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে ওদের কথাগুলো বেশ উপভোগ করছিল সে।

দ্রৌপদীকে টানাটানি করা হচ্ছে, তার উত্তরীয় খসে পড়ছে, দ্রৌপদীকে এককাপড়ে রাজসভায় নিয়ে আসা হয়েছে—এগুলো দুর্যোধনের বেশ ভালো লাগছে।

বিকর্ণের কথার উত্তরে কর্ণ বলল, ‘তুমি অবশ্য এটা ঠিক বলেছ, একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে বড় একটা অধর্ম করা হয়েছে। তোমার এই অভিযোগের উত্তর আমার কাছে আছে বিকর্ণ। আচ্ছা তুমি বলো তো, বিধি অনুসারে একজন নারীর কজন স্বামী থাকা উচিত? একজনই তো? কিন্তু দ্রৌপদীর স্বামী তো একটা নয়, পাঁচ পাঁচটা স্বামী তার। একাধিক পুরুষসঙ্গ যে নারী নেয়, তাকে তো সমাজে বেশ্যাই বলে, কী বলো বিকর্ণ? ভুল বলছি না তো আমি? তো একজন বেশ্যাকে উন্মুক্ত রাজসভায় টেনে এনে এমন কী অপরাধ করেছে দুঃশাসন? কোনো বেশ্যা এককাপড়ে এসেছে, না উলঙ্গ অবস্থায় এসেছে, তা নিয়ে মন খারাপ করার তো কিছুই নেই বিকৰ্ণ!’

সারা জীবনের অর্জিত ভদ্রতা, মানববোধ, ন্যায়বোধ—সব কিছু বিসর্জন দিল আজ কৰ্ণ। সে দ্রৌপদীর বিরুদ্ধে এই নগ্ন-নির্লজ্জ কথাগুলো বলতে গিয়ে একটুও ভাবল না রাধা আর অধিরথের মতো দুজন অসাধারণ মানুষ তাকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছেন, ভাবল না তার আবাসে তিন তিনজন স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, ভাবল না দ্রৌপদীকে অপমানের মধ্য দিয়ে মূলত সে রাধা-মঞ্জুলা-ঋজুলা-তটিনী নামের চার নারীকে অপমান করছে। প্রতিশোধস্পৃহা তাকে আজ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করেছে। তার কাছে এখন বহুদিন আগে দ্রৌপদীকৃত অপমানটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ভদ্রতা, শোভনতা, ন্যায়বোধ আজ তার কাছে গৌণ।

‘জেতা বস্তুকে নিয়ে আমরা যা ইচ্ছা, তা-ই করব। এখানে তোমার কিছু বলার নেই বিকৰ্ণ। তুমি বরং এক কাজ করো, নিজের আসনে ফিরে যাও। চোখ খোলা রেখে পরবর্তী মজাগুলো লুটে নাও।’

এরপর দুঃশাসনের দিকে তাকাল কর্ণ। বলল, ‘দেখো ভাই দুঃশাসন, এই বিকর্ণটা বড় পেকে গেছে। তুমি ওর কথায় কান দিয়ো না। বরঞ্চ তুমি এককাজ করো—তুমি সমস্ত পাণ্ডবের উত্তরীয়গুলো খুলে নাও। না না, দ্রৌপদীকেও ছেড়ে দিয়ো না। তাকেও বিবস্ত্র করো।’

গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল বিকর্ণ, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনি অন্ধ সবাই জানে, আপনি বধিরও? আপনি কি সূতপুত্র কর্ণের কথা শুনতে পাচ্ছেন না? একজন নীচুজাতের লোক আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রবধূর বসন খুলে নেওয়ার আদেশ দিচ্ছে! শুনছেন না আপনি?’

ধৃতরাষ্ট্র যেন বোবা, যেন বধির—এমন করে সিংহাসনে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলেন।

‘এ বড় অধর্ম মহারাজ। কুলবধূর অপমান ধর্ম সইবে না। এই অধর্মের মূল্য আপনাকে চুকাতেই হবে মহারাজ। একদিন আপনার পুত্রদের ওপর এমন বজ্রাঘাত নেমে আসবে, কোনোভাবেই তা ফেরাতে পারবেন না।’ বলতে বলতে বুক-মাথা চাপড়াতে লাগল বিকৰ্ণ

দ্রুত পায়ে সভাস্থল থেকে বেরিয়ে গেল সে।

কর্ণের মনুষ্যত্ব আজ লোপ পেয়ে গেছে। অনুকূল পরিবেশে তার অমানুষতা উৎকট আর বীভৎস হয়ে উঠেছে। দুর্যোধন-শকুনির জেতা যেন তারই জেতা! দ্রৌপদীকে চরমভাবে অপমান করার দায়িত্ব আর অধিকার যেন তারই!

কর্ণের কথা শুনে যুধিষ্ঠির উত্তরীয় বসন খুলে মেঝেতে নামিয়ে রাখল। তার দেখাদেখি অন্য পাণ্ডবরাও।

‘তাকেও বিবস্ত্র করো’—এই কথাটি দুঃশাসনকে বেশ পুলকিত করল। পরনারীকে বিবস্ত্র দেখাটাই মজা, তার ওপর দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী রমণী হলে তো কথাই নেই! দুঃশাসন দ্রৌপদীর পরিধানের বসন ধরে টান দিল।

রাজদরবারের সবচাইতে চুপচাপ থাকা মহামন্ত্রী, যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত টু-শব্দটি করেননি, তিনি হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘থামো তুমি দুঃশাসন, থামো। এ কাজ তুমি করো না। ‘ কী আশ্চর্যের ব্যাপার, মহামন্ত্রীর সঙ্গে অন্য মন্ত্রী-অমাত্যরাও কণ্ঠ মেলালেন। তীব্র রোষে গোটা রাজসভা ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। ‘এ অন্যায়, এ বড় দুরাচার’—এই কথাগুলো বারবার বলতে থাকলেন সভাসদরা।

মন্ত্রী-অমাত্যদের জোর প্রতিবাদে বিদুরের মনে সাহস এলো। সে দাঁড়িয়ে কর্ণকে বেশ করে গালাগাল দিতে আরম্ভ করল।

সভাসদদের বিরোধিতা আর বিদুরের গালাগালিতে থতমত খেয়ে গেল কর্ণ। দুঃশাসনকে লক্ষ্য করে ম্যাড়ম্যাড়ে গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি এখন এই দাসীটিকে প্রাসাদের কোথাও রেখে এসো তো দুঃশাসন।

দুর্যোধন তখন উল্লাসে মাতোয়ারা। রে রে করে উঠল দুর্যোধন, ‘না না দুঃশাসন! তুমি অত তাড়াতাড়ি ও কাজ করতে যেয়ো না। দ্রৌপদীকে বরং তুমি আমার কাছে নিয়ে এসো।’ বলেই নিজের ঊরু উন্মুক্ত করল সে।

তারপর ঊরুতে চাপড় মেরে বলল, ‘এই ঊরুতে দ্রৌপদীকে বসিয়ে মনের বাসনা মিটাই আমি।’

ভীম বজ্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘শোন দুঃশাসন, আজ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে যে পাপ তুই করলি, তার জন্য শাস্তি পেতে হবে তোকে।’

‘শাস্তি!’ দুঃশাসনের কণ্ঠে ব্যঙ্গ।

ভীম হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, ‘একদিন আমি তোর রক্ত পান করব দুঃশাসন। দুহাতের আঙুল দিয়ে তোর বুক বিদীর্ণ করব আমি এবং সেখান থেকে আঁজলা আঁজলা রক্ত খাব আমি।’

সভাগৃহের হুল্লোড় মুহূর্তেই থেমে গেল। ধৃতরাষ্ট্র হাহাকার করে উঠলেন।

উজ্জ্বল চোখে বিদুর ভীমের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ভীম দুর্যোধনের দিকে ঘাড় ফেরাল। চোখে আগুন ঢেলে বলল, ‘ঊরু উন্মুক্ত করে তুই আজকে আমাদের সবচাইতে সম্মানের নারীটিকে অপমান করলি। এই অপরাধ থেকে তোর মুক্তি নেই দুর্যোধন। একদিন গদার আঘাতে তোর ওই উরু দুটো চূর্ণবিচূর্ণ করে ছাড়ব আমি।’

ঠিক ওই সময়ে মহিষী গান্ধারী সভাগৃহে ঢুকলেন। দ্রৌপদীর অপমানের কথা তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ততক্ষণে।

চোখে পট্টবস্ত্র বাঁধা গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দুর্যোধন কুরুবংশের ধ্বংস ডেকে এনেছে। ওই কুলাঙ্গারটার সঙ্গে মিশেছে বজ্জাত শকুনি আর সূতপুত্র কর্ণ। আপনি তাদের কথা শুনে দ্রৌপদীকে অপমান করিয়েছেন। আপনি এখনই পাণ্ডবদের সর্বস্ব ফিরিয়ে দিন। দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন। পাণ্ডুপুত্রদের মুক্তি দিয়ে সসম্মানে তাদের ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।’

বলে শ্লথ পায়ে সভাগৃহ ছেড়ে গেলেন গান্ধারী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *