কুড়ি
এভাবে কয়েক বছর পার হলো।
এক সকালে দ্রোণের অস্ত্রপাঠশালায় সেই ঘটনাটা ঘটে গেল।
অস্ত্রশিক্ষাগুরু হিসেবে দ্রোণের খ্যাতি তখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে অস্ত্রশিক্ষার্থীরা হস্তিনায় আসতে শুরু করেছে। সবাই দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় পাঠার্থী হতে চায়।
একদিন এক যুবক, কালো কুচকুচে গায়ের রং, পরনে শত ছিদ্রের বসন, ধুলোধূসরিত, দ্রোণের সামনে এসে দাঁড়াল।
যুবকের গায়ের রং, বসনভূষণের ছিরিছাঁদ দেখে দ্রোণের চোখমুখ কুঁচকে গেল।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম?’
উত্তর এলো, ‘একলব্য।’
‘পিতার নাম?’
‘হিরণ্যধনু।’
দ্রোণ অবহেলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী জাত তোমরা?’
একলব্যের দ্বিধাহীন উত্তর, ‘নিষাদ আমি।’
চমকে দুকদম পিছিয়ে গেলেন ভরদ্বাজপুত্র ব্ৰাহ্মণ দ্রোণ।
ঘৃণাভরে বললেন, ‘ব্যাধ তুমি! অস্পৃশ্য হয়ে ব্রাহ্মণের পাঠশালায় এসেছ অস্ত্র শিখতে!
বেরোও, বেরোও এখান থেকে।’
চমকে উঠল একলব্য, কিন্তু ভয় পেল না। মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকল।
তার হয়ে কথা বলল কর্ণ, ‘একলব্য ছোটজাত বলে তাকে অপমান করছেন গুরুদেব? তার বড় পরিচয় তো সে মানুষ! ছাত্র হিসেবে কেমন হবে, সেটা যাচাই করুন।’
‘থামো তুমি কর্ণ। কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?
ও-পাশ থেকে অর্জুন বলে উঠল, ‘গুরুর সিদ্ধান্তই এখানে শেষকথা।
‘এখান থেকে তুমি বেরিয়ে যাও এখনই।’ বজ্রকঠোর দ্রোণের কণ্ঠস্বর। লক্ষ্য একলব্য।
দ্রোণকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে একলব্য পাঠশালা থেকে বেরিয়ে গেল।
রাজা হিরণ্যধনুর পুত্রটি নিষাদরাজ্যে ফিরে গেল না। গভীর অরণ্যে দ্রোণের মাটির মূর্তি গড়ে তার সামনে অস্ত্রসাধনা শুরু করল। একলব্য ধনুর্ধর হওয়ার সংকল্পে অটল। একাগ্র সাধনার ফলে একলব্য ক্রমে ক্রমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর হয়ে উঠল। কঠোর প্রয়াসে এমন কিছু অস্ত্র একলব্য আয়ত্ত করে ফেলল, যা দ্রোণাচার্যেরও অজানা। অর্জুনের তো প্রশ্নই ওঠে না!
এমন সময় একদিন দ্রোণাচার্য তাঁর সকল ছাত্র নিয়ে মৃগয়ায় গেলেন। একটি বৃক্ষতলে তিনি আসন গ্রহণ করলেন। রাজকুমাররা অরণ্যের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
অর্জুনের সঙ্গে ছিল একটি প্রশিক্ষিত কুকুর। জানোয়ারের সন্ধান পেলে চিৎকার করে ওঠে। তাতে অর্জুনের মৃগয়া সহজতর হয়।
কুকুরের পেছন পেছন বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল অর্জুন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, বেশ কিছুক্ষণ ধরে কুকুরটি ডাকছে না। সে কুকুরটির অনুসন্ধান করতে শুরু করল।
কুকুরটি ঘুরতে ঘুরতে একসময় সাধনায়রত একলব্যের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। একলব্য তখন ধ্যানমগ্ন। কৃষ্ণবর্ণ, মৃগচর্ম পরিহিত, জটাজুটধারী ধুলোমাখা একলব্যকে দেখতে পেয়ে কুকুরটি তারস্বরে চেঁচামেচি শুরু করল।
ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটলে একলব্য বিরক্ত হয়ে কুকুরটির দিকে সাতটি বাণ নিক্ষেপ করল। ওই বাণ আর কিছুই নয়, পাশে গজানো ঘাসের ডাঁটা। ওতেই কুকুরটির মুখ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু কুকুরের মুখ থেকে একবিন্দু রক্তপাত হলো না। সেই অবস্থাতেই কুকুরটি অর্জুনের কাছে ফিরে এলো।
বিস্ময়ের সীমা থাকল না অর্জুনের। কুরুরাজকুমাররা দ্রুত জড়ো হলো সেখানে। তাদের কেউই শব্দভেদী বাণ চালনার এমন কৌশল কখনো দেখেনি। কে সেই ধনুর্ধর? খুঁজে বের করতেই হবে।
সবাই কুকুরটির পিছু নিল। সবার আগে আগে অর্জুন। কর্ণ-দুর্যোধনরাও সঙ্গে চলল। একলব্যের কাছাকাছি গিয়ে কুকুরটি থেমে গেল।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে ধ্যানমগ্ন একলব্যকে রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি?’
চোখ খুলল একলব্য। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমার পরিচয় নতুন করে আবার দিতে হবে রাজকুমার? আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য।’
নাম শুনেই দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে এলো কৰ্ণ। আহত কণ্ঠে বলল, ‘একলব্য! বিতাড়িত একলব্য তুমি! এ কী চেহারা হয়েছে তোমার রাজপুত্র!
‘আমি শুধু রাজপুত্র নই কর্ণ, ছাত্রও। তুমি, অর্জুন এবং এরা যাঁর শিষ্য, আমিও সেই দ্রোণাচার্যের শিষ্য।’
আকাশ ফাটিয়ে এবার হাহা করে হেসে উঠল কর্ণ। হাসি থামিয়ে ধিক্কার দেওয়া কণ্ঠে কৰ্ণ বলল, ‘ছোটজাতে জন্মেছ বলে তুমি একলব্যকেই তো ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য কুকুরের মতো দূর দূর করে অস্ত্রপাঠশালা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন! তুমিই তো সেদিন দ্রোণাচার্যের হাতে অপমানিত লাঞ্ছিত হয়েছিলে! কী, হয়েছিলে না? সেই লাঞ্ছিত তুমি কী করে বলছ, তুমি দ্রোণাচার্যের শিষ্য!’
কোনো জবাব দিল না একলব্য। স্থির দৃষ্টিতে দ্রোণের মাটির মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকল।
এবার হু হু করে কেঁদে উঠল কৰ্ণ।
দুর্যোধন এগিয়ে এলো কর্ণকে থামাবার জন্য।
কর্ণ দুর্যোধনকে বিরত করে, যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করছে, এমন কণ্ঠে বলল, ‘তোমাদের ছোটজাতদের ওই এক বৈশিষ্ট্য, শত অপমানেও তোমরা জেগে ওঠো না। বামুনদের পায়ের নিচে তোমাদের স্বর্গ বলে মনে করো। বিশ্বাস করো না যে ওই ব্রাহ্মণজাতটি তোমাদের ঘৃণা করে, ওরা তোমাদের পছন্দ করে না রে একলব্য!’
হঠাৎ ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল কর্ণ। ওই অবস্থাতেই বলতে থাকল, ‘জাগো একলব্য, জাগো। জাতবর্ণের দুর্গ ভেঙে চুরমার করো।’
দুর্যোধন কর্ণকে মাটি থেকে তুলল। জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কৌরবরা তাদের অনুসরণ করল।
একলব্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অর্জুন আর কুকুরটি। অর্জুন ভাবতে থাকল, আচার্যের এ কোন ছাত্র, যে তার চেয়েও বেশি জানে! আচার্য তো বলেছিলেন, তিনি তাকেই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে গড়ে তুলবেন! কিন্তু আদতে তো তা করেননি তিনি! তার চোখের অন্তরালে একলব্য নামের এই নিষাদকে শ্রেষ্ঠ করে তুলেছেন! তুলেছেনই তো! নইলে ও দাবি করে কী করে যে সে দ্রোণাচার্যের ছাত্র? সকল কিছুর জবাব জানেন গুরুদেবই। নাহ্, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। গুরুদেবের কাছে যেতে হবে।
দ্রোণাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্জুন। পাশে বাণাহত কুকুরটি। গুরুদেবকে যা বলার, ততক্ষণে বলে ফেলেছে অর্জুন। এখন দ্রোণাচার্যের জবাব দেওয়ার পালা!
দ্রোণ ছাত্রদের দিকে মুখ ফেরালেন। বললেন, ‘আজকের মতো তোমাদের মৃগয়া শেষ। প্রাসাদে ফিরে যাও তোমরা। আমি একটু পরে আসছি।’
অদূরে দাঁড়ানো কর্ণ আঁতকে উঠল। তার অন্তরাত্মা বলে উঠল, বড় ধরনের কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
ফিসফিস করে দুর্যোধনকে বলল, ‘এরপর নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটবে। স্বার্থপর অর্জুন বর্ণান্ধ আচার্যকে দিয়ে কোনো একটা ঘৃণ্য ঘটনা ঘটাবে।’
‘এ তুমি কী বলছ কর্ণ!’ চমকানো গলায় বলে উঠল দুর্যোধন।
চট করে দুর্যোধনের মুখ চিপে ধরল কর্ণ। ওই অবস্থাতে হিসানো কণ্ঠে বলল, ‘আমি যা বলছি, তার ব্যত্যয় হবে না, দেখে নিয়ো তুমি দুর্যোধন। তুমি ভাইদের নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে যাও। আমি পরে আসছি।’ বলে দ্রুত বৃক্ষের আড়ালে চলে গেল কর্ণ।
বিচলিত দুর্যোধন সবাইকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে যাত্রা করল।
কিছুক্ষণ পর আসন ছেড়ে উঠলেন দ্রোণ। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘চলো।’
অর্জুন কুকুরটিকে কী একটা ইঙ্গিত করল! কুকুরটি চলতে শুরু করল। তার পিছু নিলেন দ্রোণ। দ্রোণের এক কদম পেছনে অর্জুন। ওঁদের পেছনে যে আরেকজন চুপিসারে এগোচ্ছে, কেউ খেয়াল করলেন না। কুকুরটি ব্যথায় জর্জরিত, দ্রোণ বর্ণবাদী উগ্রতায় আচ্ছন্ন এবং অর্জুন প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মূলে একাগ্র। তাই তাঁদের অনুসরণ করে সামান্য তফাতে কর্ণ যে এগিয়ে আসছে, টের পেলেন না কেউই।
একটা সময়ে একলব্যের পর্ণকুটিরের উঠানে এসে দাঁড়ালেন দ্রোণ। দুটো বস্তু তাঁর চোখে পড়ল—তাঁর নিজের মৃন্ময় মূর্তি এবং মূর্তির সামনে নিমীলিত চোখে ধ্যানমগ্ন একলব্য। সেই সকালে সামান্য সময়ের জন্য দেখেছিলেন একলব্যকে। এখনো একপলক দেখে চিনে ফেললেন। একলব্যের দেহরং আর গঠন যে ভোলার নয়!
তার পরও পাশ থেকে অর্জুন তার তর্জনীটা একলব্যের দিকে উঁচিয়ে ধরল। অভিমানভরে বলল, ‘ও-ই আপনার শিষ্য একলব্য! তার যা কিছু অস্ত্রবিদ্যা, তার সবই নাকি আপনার দান!’
ক্রোধ আর অভিমানে দুচোখ জ্বলে উঠল দ্রোণের। অস্পৃশ্য ব্যাধের এত বড় আস্পর্ধা! আমার নামে মিথ্যে অপবাদ! ব্রাহ্মণ হয়ে নাকি নীচুজাতকে পড়িয়েছি আমি!
অর্জুন চাপা গলায় বলে উঠল, ‘গুরুদেব, যা করবেন সংক্ষেপে এবং নির্মোহভাবে। বেশি সময় নিলে ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে।’
সপ্রশংস দৃষ্টিতে অর্জুনের দিকে তাকালেন দ্রোণ। বড় একটা শ্বাস ফেলে ক্রোধকে সংবরণ করলেন। তারপর একলব্যের একেবারে নিকটে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে সম্বোধন করলেন, ‘একলব্য।’
দ্রোণের কণ্ঠস্বর ভোলেনি একলব্য। নিজের কানের কাছে গুরুদেবের কণ্ঠস্বর শুনে একলব্য তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘তুমি নাকি আমার কাছে সকল অস্ত্রবিদ্যা শিখেছ?’ কোনো ভূমিকা ছাড়া জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণ। একলব্য মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দ্রোণকে প্রণাম করল।
দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, ‘আপনিই আমার অস্ত্রগুরু আচার্য।’
‘স্বীকার করছ তাহলে আমিই তোমার সকল শিক্ষার আধার?’
‘এতে কোনো মিথ্যে নেই গুরুদেব।’
‘শিক্ষাশেষে গুরুদক্ষিণা দিতে হয়, জানো তো?’
একলব্য ডান দিকে ঘাড় কাত করল।
‘তাহলে আমার গুরুদক্ষিণাটি দাও এখন।’
‘আজ্ঞা করুন, কী দক্ষিণা পেলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন?’
‘তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কেটে দাও আমায়। ওটাই আমার গুরুদক্ষিণা।’
পাশের গাছটির আড়াল থেকে হাহাকার করে উঠল কর্ণ, ‘খবরদার, ও-কাজ করো না তুমি। ধ্বংস হয়ে যাবে। তীর ছুড়তে পারবে না।’ বলতে বলতে একলব্যের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল কৰ্ণ।
কিন্তু তার আগেই কোমর থেকে ছোরা বের করে নিমিষেই নিজের দক্ষিণ হস্তের বুড়ো আঙুলটি কেটে ফেলল একলব্য। কর্তিত আঙুলটি দ্রোণের পায়ের কাছে রাখল।
আঙুলটির দিকে দৃকপাত করলেন না দ্রোণ। তাঁর চোখমুখ নির্মোহ। প্রতিশোধ নিতে পারার সন্তোষে তাঁর মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত।
ঝটিতি পেছন ফিরলেন দ্রোণ।
অর্জুনসহ দ্রোণ চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পর্ণকুটিরটির সামনে রেখে গেলেন শিক্ষকজীবনের গহিন এক কলঙ্কের অভিজ্ঞান।
কর্ণ নানা বনজ ওষুধ লাগিয়ে একলব্যের আঙুল থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করল।
একলব্যকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে চিৎকার করে কর্ণ বলল, ‘অর্জুনকেই সেরা ধনুর্ধর বানাবে ওই বুড়ো বামুনটা। কাউকে দাঁড়াতে দেবে না। তোমাকেও শেষ করে দিল। আমাকেও শেষ করে দেবে একদিন, জানি আমি।’
একুশ
দ্রোণের বিদ্যালয়ে কর্ণ যত দিন ছিল, দুর্যোধনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। উভয়ের মধ্যে গভীর সখ্যের মূল কারণ—বিদ্বেষ।
কর্ণ পাণ্ডবদের, বিশেষ করে অর্জুনকে মোটেই পছন্দ করে না। ধনুর্বিদ্যায় সে অর্জুনের চেয়ে হীন নয়। সে অর্জুনসম অস্ত্রদক্ষ। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে মূল্যায়ন করেন না। সুযোগ পেলে অবমূল্যায়ন করেন। দ্রোণাচার্যের যত পক্ষপাতিত্ব অর্জুনের দিকে। অর্জুনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ তাঁর পাঠশালায় হতে পারবে না—এ যেন দ্রোণের অঘোষিত সিদ্ধান্ত। দ্রোণ অর্জুনান্ধ। তাঁর ছাত্রপ্রীতির কাছে পুত্রপ্রীতিও হার মানছে বারবার। অশ্বত্থামাও পিতার কাছে অর্জুনের মতো স্নেহ পায় না। কর্ণের ধারণা, অর্জুনের প্ররোচনার কারণে আচার্য তাকে যথাযথ মর্যাদা দেয় না। শুধু তো তা-ই নয়, অর্জুনকে যে-যে তীর চালনার কৌশল রপ্ত করান, তা অন্য কোনো পাঠার্থীকে শেখান না তো শেখানই না, উপরন্তু কর্ণকে শেখাতে অনুরোধ করলে কৌশলে এড়িয়ে যান আচার্য। দ্রোণাচার্যের অর্জুনপ্রীতি আর কর্ণ-অবহেলায় বারবার আহত হয় কর্ণ। মুখে কোনো প্রতিবাদ না করলেও গভীর এক বিদ্বেষ তার বুকের তলায় জমা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মিলেজুলে প্রচণ্ড এক পাণ্ডববিদ্বেষ কর্ণের মনে জমাট বেঁধে যায়। এ যেন এক সহোদরের বিরুদ্ধে আরেক সহোদরের প্রতিহিংসা! পাণ্ডব আর কৌন্তেয়—কেউই জানে না, এরা একই মায়ের সন্তান।
দুর্যোধনও পাণ্ডব-ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল। ভীমের বাহুবল, ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের দক্ষতা আর যুধিষ্ঠিরের ঠান্ডা মাথার বুদ্ধি দুর্যোধনের মনে জ্বালা ধরাচ্ছিল। দুর্যোধনের বারবার মনে হয়- যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনরা পাণ্ডুপুত্র নয়। তাদের জন্মের সঙ্গে কোথায় যেন একটা অসত্য অপকৌশল জড়িয়ে আছে! তারা এই রাজপ্রাসাদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নয়। বহিরাগত এরা। কোনো বিশেষ একটা অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ওরা যেন পাণ্ডুপুত্রবেশে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছে! বাবা ধৃতরাষ্ট্র আর মা গান্ধারীর হাবেভাবে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে মাঝেসাঝে। মুখ ফুটে তাঁরা কিছু বলেন না ঠিক, কিন্তু ইঙ্গিতে-আচরণে বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না তাঁরা। দুর্যোধন বিচক্ষণ। রাজপ্রাসাদের হাজারো জটিলতার মধ্যে তার বড় হয় ওঠা। তাই প্রাসাদীয় আবর্ত বুঝতে দুর্যোধনের অসুবিধা হয় না। পাণ্ডবরা হয়তো তার জ্ঞাতি, কিন্তু ক্ষতিকারক জ্ঞাতি। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের রাজকীয়জীবনে কোনো একটা ঝড় তুলতেই হিমালয়-অরণ্য থেকে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছে যুধিষ্ঠিররা—বিশ্বাস করতে শুরু করেছে দুর্যোধন। তাই পাণ্ডবশত্রুতা দুর্যোধনের মনে তৈরি হয়ে গেছে।
পাণ্ডবশত্রুতাকে ভিত্তি করে কর্ণ আর দুর্যোধনের সখ্য প্রগাঢ়তর হয়ে উঠল।
যুধিষ্ঠির শান্ত প্রকৃতির হলে কী হবে, অতি বিচক্ষণ। তার দূরদৃষ্টি প্রখর। কর্ণের পাণ্ডববিদ্বেষ, দুর্যোধনভ্রাতাদের জ্ঞাতিশত্রুতা লক্ষ করে যুধিষ্ঠির। ভীম বাহুবলী। ইত্যবসরে সে গদাচালনায় দক্ষ হয়ে উঠেছে—এটা যে দুর্যোধন সহ্য করতে পারে না, অনুধাবন করে যুধিষ্ঠির। অর্জুনের ধনুদক্ষতা কর্ণের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে, এটাও চোখ এড়ায় না যুধিষ্ঠিরের।
সব কিছু বুঝতে পেরেও চুপ করে থাকে যুধিষ্ঠির। কর্ণ-দুর্যোধনদের পাণ্ডববিদ্বেষের কোনো জবাব দিতে নারাজ সে। যুধিষ্ঠির বিশ্বাস করে, এদের বিদ্বেষের জবাব দেওয়ার সময় হয়নি এখনো। ভাইদের ঘিরেবেড়ে রাখে। ভীম বেয়াড়া ধরনের। মারমুখী স্বভাবের বলে দুর্যোধন-দুঃশাসনের সঙ্গে ভীমের খিটিমিটি অবিরাম লেগে থাকে। যুধিষ্ঠির ভীমকে আগলে আগলে রাখে। অর্জুন ধীরস্থির মস্তিষ্কের। দাদা যুধিষ্ঠিরের ভীষণ অনুগত সে। ভীম মাঝেমধ্যে অবাধ্যতা দেখালেও অর্জুন কখনো যুধিষ্ঠিরের নির্দেশকে অবহেলা করে না। নকুল-সহদেব যুধিষ্ঠিরকে পিতার সমান মর্যাদা দেয়।
কর্ণ ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছিল, এই অস্ত্রপাঠশালার নানা প্রতিযোগিতায় অর্জুনের সঙ্গে সে পেরে উঠছে না। দ্রোণের পক্ষপাতিত্বের কারণে অস্ত্রকৌশলে অর্জুন নিজেকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে, সেখানে কর্ণের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় দ্রোণাচার্য যে অর্জুনকে রণবিদ্যার অত্যুৎকৃষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন, সহজেই বুঝতে পারছে কর্ণ। দ্রোণের পক্ষপাতিত্ব আর অর্জুনের পারদর্শিতা কর্ণকে হতাশ করে তুলল। কিন্তু কর্ণচরিত্রে থেমে যাওয়া বলে কোনো কথা নেই। অর্জুনকে অতিক্রমের পথ খুঁজতে শুরু করল সে।
একদিন সময় ও সুযোগটা এলো তার হাতে।
সেদিন পাণ্ডব-কৌরব কেউ কাছেপিঠে নেই। অশ্বত্থামাকেও পাঠশালায় দেখা যাচ্ছে না।
কর্ণ দ্রোণাচার্যের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল।
‘কী চাই?’ দ্রোণের কণ্ঠস্বরে বিতৃষ্ণা জড়ানো।
কর্ণ নিরুত্তর। অশেষ ধৈর্য ও গভীর বিনয় নিয়ে কর্ণ আজ গুরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গুরুর কাছে যে আজ তার বড় একটা কিছু চাওয়ার আছে! তাই দ্রোণের বিরাগমেশানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েও নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল কর্ণ।
উত্তর দিতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে দ্রোণ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘চুপ করে আছ কেন? বুঝছি, কিছু বলতে এসেছ, কিন্তু কিছু না বলে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ দ্রোণের চোখমুখ কোঁচকানো
এরই মধ্যে নিজেকে সংহত করে নিয়েছে কর্ণ।
বিনয়াবনত হয়ে বলল, ‘আপনার কাছে আমার একটা জিনিস চাওয়ার আছে গুরুদেব।’
‘একটা জিনিস চাওয়ার আছে! আমার কাছে? কী সেটা, যা গোপনে চাইতে হচ্ছে?’ আশপাশে তাকাতে তাকাতে নির্মম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে গেলেন দ্রোণ।
কর্ণ রাখঢাকে গেল না। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘গুরুদেব, আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়বার কৌশল শিখিয়ে দিন। শিখিয়ে দিন ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়েও তা সংবরণ করার উপায়।
দ্রোণের অক্ষিগোলক বেরিয়ে পড়বার উপক্রম হলো। বিস্ময়ের চরম সীমায় তখন তিনি। ওই অবস্থাতেই জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘ব্রহ্মাস্ত্রের মানে জানো তুমি!’
‘জানি। ব্রহ্মাস্ত্র অমোঘ। যার প্রতি ছোড়া হয়, তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মহাবীর মহর্ষি পরশুরামের কাছে আছে এটি। আর আছে আপনার কাছে। আপনি গোপনে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা অর্জুনকে শিখিয়ে দিয়েছেন।’
এবার বাকরহিত হলেন দ্রোণ। এত কিছুর সন্ধান জানে কর্ণ! তা জানুক। জানছে বলে এই বিদ্যা তাকেও শেখাতে হবে নাকি? ও তো আমার প্রিয় শিষ্য নয়! অস্ত্রদক্ষ, মানি। কিন্তু সে বিনীত নয়। উচ্চাভিলাষী। না না, কিছুতেই তাকে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা শেখানো যাবে না। যে করেই হোক, কর্ণকে ফেরাতে হবে। কিন্তু কী করে? চট করে দ্রোণের মাথায় বুদ্ধি এলো একটা। কর্ণকে রাগ দেখানো যাবে না, নরম কণ্ঠে কথা বলতে হবে ওর সঙ্গে। পালটে ফেললেন কণ্ঠস্বর, ‘তা ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা নিয়ে কী করবে তুমি?’ মোলায়েম গলায় বলতে চাইলেন দ্রোণ।
‘আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই।’
ভীষণ চমকে উঠলেন দ্রোণ। এ কী পণ কর্ণের! অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র হাতিয়ে নিতে চায় তাঁর কাছ থেকে! অর্জুন যে তাঁর প্রিয়তম ছাত্র, জানে না কৰ্ণ!
কর্ণের কথায় অতিশয় সচকিত হয়ে উঠলেন দ্রোণাচার্য।
দ্রোণের থতমত অবস্থা দেখে কর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। অনুযোগের কণ্ঠে বলল, ‘আপনি এই পাঠশালার আচার্য। আচার্যের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য সকল শিষ্যে সমদৃষ্টি। এমনকি নিজের পুত্রের সঙ্গেও ছাত্রদের ভেদাভেদ করেন না যথার্থ একজন আচার্য। আপনি এই সসাগরা পৃথিবীর সবচাইতে বেশি খ্যাতিমান একজন আচার্য—দ্রোণাচার্য। সুতরাং আপনার আচরণেও কোনো ব্যক্তিপার্থক্য থাকবে না—সবার মতো আমিও আশা করি তা।’
দ্রোণাচার্য কিছু না বলে সোজা কর্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কর্ণ আবার বলতে শুরু করল, ‘আপনার মতো এমন জগদ্বিখ্যাত একজন মানুষের চরিত্রে পক্ষপাতিত্বের কলঙ্ক লেপন করবে কেন হস্তিনাপুরের জনগণ? কেন তারা বলবে, শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও শুধু দ্রোণাচার্যের সমদর্শিতার অভাবে কর্ণ আচার্যের কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা লাভ করতে পারেনি?’
কর্ণের কথাকৌশল দেখে দ্রোণাচার্য একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কর্ণ নামের এই তরুণটি এত কথা জানে! কথার মারপ্যাচে তাঁকে যে একেবারে কুপোকাত করে ছাড়ল! কর্ণের মতো বদশিষ্য তাঁর পাঠশালায় আর দুটি নেই। সে চায় কিনা তাঁর পুত্রাধিক শিষ্য অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে! তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে! ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার পরিণতি জানে কর্ণ? মৃত্যু, মৃত্যুই এই যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি!
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিনি অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্রের শিক্ষা দান করেছেন। অর্জুনকে দান করবেন না তো কাকে দান করবেন? অর্জুনের প্রচেষ্টা, ধীরতা এবং বিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ। অর্জুনের মতো প্রিয় শিষ্য তো আর কেউ নেই এই বিদ্যালয়ে! সুতরাং তাকেই ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা শেখাবেন। শিখিয়েছেনও মেধাবী ও বিনয়ী ছাত্র অর্জুনকে। কিন্তু এই বিদ্যা কিছুতেই কর্ণকে শেখাবেন না তিনি
সেই প্রথম দিন থেকেই পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহপ্রবণ দ্রোণাচার্য। খাচ্ছেন-থাকছেন কুরুদের ছত্রছায়ায়, স্নেহটা ঢালছেন পাণ্ডবদের পাতে। এই-ই দ্রোণাচার্য! পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের রেষারেষিটা চোখ এড়ায় না দ্রোণের। দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের ভালোবাসাবাসিটাও কেন জানি পছন্দ নয় আচার্যের! কেন পছন্দ নয়, তার কার্যকারণ ভালো করে জানা নেই তাঁর। তার পরও কর্ণের প্রতি গভীর এক ঘৃণাবোধ তৈরি হয়ে গেছে দ্রোণের মনে। ওই ঘৃণার জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দেবেন না কিছুতেই।
কিন্তু কর্ণের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন না দ্রোণ। কৌশলের আশ্রয় নিলেন। ভারতবর্ষীয় বর্ণবাদীদের চিরাচরিত কৌশল। জাতপাতের কৌশল।
কণ্ঠে কৃত্রিম স্নেহ ঢেলে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘দেখো বৎস, তিন ধরনের মানুষের ব্রহ্মাস্ত্র জানার অধিকার আছে। এক. ব্রাহ্মণ, যিনি সাধারণত অস্ত্র ব্যবহার করেনই না। ব্রাহ্মণ সদাসর্বদা যজনযাজন, পঠনপাঠন নিয়ে থাকেন।’
‘দ্বিতীয় ধরনের মানুষ কারা?’ চোখ বুজে প্রশ্ন করে কর্ণ।
দ্রোণাচার্য উপবীতে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘দ্বিতীয়ত সদাচারী সচ্চরিত্র ক্ষত্রিয় এই ব্রহ্মাস্ত্র লাভের উপযুক্ত।’
‘আর তৃতীয়?’
‘সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও এই ব্রহ্মাস্ত্র লাভের অধিকার রাখে কর্ণ। এখন তুমি ভেবে দেখো, তুমি কোন শ্রেণিতে পড়ো।’ স্নেহাধিক্যে দ্রোণের কণ্ঠ ভেজাভেজা।
প্রসঙ্গের শুরুতেই কর্ণ বুঝে গিয়েছিল, আচার্য নতুন চাল চালতে যাচ্ছেন। এই চালের পরিণতিতে যে তারই পরাজয় অপেক্ষা করছে, অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়নি তার। তাই বলে দ্রোণের চাতুর্যে থেমে যাবে সে? কিছুতেই নয়।
নম্র ভঙ্গিতে কর্ণ বলল, ‘গুরুদেব, আপনি যে তিন শ্রেণির মানুষের কথা বললেন, তাদের কোনোটাতেই পড়ি না আমি। আমি ব্রাহ্মণ নই, সন্ন্যাসীও নই। এমনকি ক্ষত্রিয়ও নই আমি। আমি সারথিপুত্র রাধেয়। সব বুঝলাম আচার্য। কিন্তু এর পরও দুটো প্রশ্ন করার আছে আমার।’
কর্ণের নম্রতা দেখে দ্রোণ মনে করলেন, জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। এখন যাবি কোথায় বাছা? ভালো মানুষের মতো মুখ করে দ্রোণ বললেন, ‘বলো, তোমার সেই দুটো প্রশ্ন কী?’
‘আপনি ব্রাহ্মণ, সবাই জানে। আপনি কি কখনো অস্ত্রব্যবহার করবেন না? না করলে এই অস্ত্রবিদ্যা শিখলেন কেন? আর আপনি কি যথার্থ ব্রাহ্মণ? যদি তা হতেন, তাহলে গুরু না হয়েও গুরুদক্ষিণার অজুহাতে একলব্যের বুড়ো আঙুলটা কেটে নিতেন না। আর…।’
চট করে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন দ্রোণ।
কর্ণ বলল, ‘ঘাড় ঘুরিয়ে লাভ নেই গুরুদেব। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন—অর্জুন এমন কী সচ্চরিত্র সদাচারী ক্ষত্রিয় হয়েছে যে তাকে আপনি ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা শেখালেন? ও যদি সৎ হতো, যদি সদাচারী হতো, তাহলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিষাদপুত্র একলব্যের এতবড় ক্ষতি করতে আপনাকে প্ররোচিত করত না। জানি, এ দুটো প্রশ্নের একটিরও উত্তর আপনার কাছে নেই।’
তার পর টুপ করে দ্রোণাচার্যের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল কর্ণ।
তেজি কণ্ঠে বলল, ‘এখনই আপনার বিদ্যালয় ত্যাগ করে যাচ্ছি আমি। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার। সেদিন ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা আমার করতলগত থাকবে।’
বাইশ
দ্রোণের পাঠশালা থেকে বেরিয়ে গেল কর্ণ।
কাউকে কিছু না বলে মহেন্দ্র পর্বতে উপস্থিত হলো।
মহেন্দ্র পর্বতে মহর্ষি পরশুরামের তপাশ্রম।
পরশুরাম ক্ষত্রিয়বিদ্বেষী। একুশবার ক্ষত্রিয়নিধন করেও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। ক্ষত্রিয়ান্তকরূপে তিনি ভারতবর্ষে পরিচিত। তিনি ভুবনকাঁপানো ধনুর্ধর। অস্ত্রবিদ্যার আধার তিনি। পৃথিবীতে এমন কোনো অস্ত্র নেই, যা তাঁর আয়ত্তাধীন নয়। ব্রহ্মাস্ত্রের মতো আরও বহু বহু মারণাস্ত্র তাঁর করতলগত।
অস্ত্রবিদ্যা যদি শিখতেই হয়, তাহলে মহর্ষি পরশুরামের কাছেই শিখব—মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পরশুরামের আশ্রমে গিয়ে হাজির হলো কর্ণ।
কে এই পরশুরাম?
পরশুরামের প্রকৃত নাম—রাম। ভৃগুবংশীয় মহর্ষি জমদগ্নির পুত্র তিনি। মায়ের নাম—রেণুকা। জমিদগ্নি-রেণুকার পাঁচ পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন পরশুরাম। ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয়স্বভাবী ছিলেন তিনি। শাস্ত্রবিদ্যার চেয়ে শস্ত্রবিদ্যায় তাঁর আকর্ষণ আর পারদর্শিতা ছিল অধিক। ভৃগুবংশে শস্ত্রবিদ্যার চর্চা পুরুষানুক্রমে চলে আসছিল। পরশুরাম সেই ধারার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।
ব্রাহ্মণকুলে জন্মালেও জীবনের ঘটনাপ্রবাহ রামকে ব্রাহ্মণের মতো তৈরি হতে দেয়নি। তাঁর মধ্যে ব্রাহ্মণত্ব আর ক্ষত্রিয়ত্ব—এ দুটোর সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
ছোটবেলা থেকেই পিতা জমদগ্নির ভীষণ অনুরাগী ছিলেন রাম। তখন রামের অল্প বয়স।
এক সকালে রামজননী রেণুকা আশ্রম থেকে অদূরের নদীতে স্নান করতে গেছেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল দুজন নরনারীর ওপর। ওঁরা নগ্ন হয়ে জলকেলি করছিলেন। পুরুষটি হলেন মাৰ্তিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথ আর নারীটি তাঁর পত্নী। রাজার উন্মুক্ত শরীর দেখে রেণুকার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। চিত্তচাঞ্চল্যকে চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন রেণুকা। আশ্রমে ফেরার পরও রেণুকার চিত্তচাঞ্চল্য প্রশমিত হলো না। স্বামী জমদগ্নির কাছে ধরা পড়ে গেলেন রেণুকা। জমদগ্নি ক্রুব্ধ হয়ে স্ত্রীকে পাপিষ্ঠা, কুলটা ইত্যাদি বলে তিরস্কার করতে থাকলেন। তাতেও তাঁর ক্রোধ কমল না। শেষ পর্যন্ত রেণুকাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন জমদগ্নি। কিন্তু হত্যাটা নিজ হাতে করবেন না, পুত্রদের দিয়ে করাবেন।
চার পুত্রকে, কনিষ্ঠপুত্র রাম তখন ফলমূল আহরণে আশ্রমের বাইরে, ডেকে বললেন, ‘তোমাদের মা অসতী। এই কুলটা মাকে তোমরা হত্যা করো।’
ছেলেরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। বলেন কী পিতা! তাঁদের অতুলনীয় মাকে হত্যা করতে বলছেন! বাবার মধ্য থেকে ক্রোধোন্মত্ততাটা আর গেল না! ক্রোধে অন্ধ হয়েই পিতা তাঁদের মাকে হত্যা করতে বলছেন! না, তারা এ জঘন্য অপরাধ করবেন না।
চার ভাই একসঙ্গে বললেন, ‘আমাদের ক্ষমা করবেন পিতা। আমরা আপনার এই অন্যায় আদেশ পালন করতে রাজি নই।’
রাগ মাথায় উঠল জমদগ্নির। তৎক্ষণাৎ পুত্রদের অভিশাপ দিলেন, ‘তোদের মনুষ্যোচিত জ্ঞানবুদ্ধি লুপ্ত হোক।’
এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর রাম বনজ ফলমূল নিয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। জমদগ্নি তখন অগ্নিশর্মা, রেণুকা জড়সড় হয়ে উঠানের এক কোণে বসে আছেন।
রাম উঠানে পা রাখামাত্র জমদগ্নি কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার মাতাকে বধ করো রাম।’
রাম দ্বিরুক্তি করলেন না, পিতার এই নির্মম নির্দেশের ব্যাখ্যা চাইলেন না। পিতার আদেশ শোনামাত্র কুঠার হস্তে মায়ের দিকে ছুটে গেলেন রাম। কুঠারের এক ঘায়ে মায়ের মাথাটি ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। কুঠারের অপর নাম পরশু। সেই থেকে রামের নাম হয়ে গেল পরশুরাম।
রেণুকার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে জমদগ্নির ক্রোধ প্রশমিত হলো। পুত্র পরশুরামের ওপর ভীষণ খুশি হলেন মহর্ষি। এরকম পুত্রই তো চাই! যে পিতার আদেশে জননীর শিরশ্ছেদ করতে পিছপা হয় না!
পরশুরামকে জমদগ্নি বললেন, ‘ইচ্ছামতো বর প্রার্থনা কর পুত্র। তোমার মতো পুত্রের জনক হতে পেরে আমি ধন্য। ও হ্যাঁ, একটি দুটি বর নয়, যে কটি বর তোমার চাইতে ইচ্ছে করে, চাও। আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব।’
পিতার কথা শুনে একটু বাঁকা হাসলেন পরশুরাম। তারপর এক নিশ্বাসে বর প্রার্থনা শুরু করলেন, ‘আমার মা যেন আবার বেঁচে ওঠেন, তাঁকে যে হত্যা করা হয়েছিল একথা যেন তাঁর মনে না থাকে। মাতৃহত্যার পাপ যেন আমাকে স্পর্শ না করে, আমার ভাইয়েরা যেন শাপমুক্ত হয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান এবং…।’ এইটুকু বলে পরশুরামের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। বড় একটা শ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন তিনি।
জমদগ্নি অল্প একটু হেসে বললেন, ‘এবং! এবং-এর পর কী বৎস?’
পরশুরাম মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘এবং আমি যেন দীর্ঘায়ু আর যুদ্ধে অজেয় হই।’
মহর্ষি জমদগ্নি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটিকে সব কটি বরই দিয়েছিলেন।
যুদ্ধে অজেয় থাকার বর লাভ করবার পরপরই নিজের অজান্তে পরশুরাম অস্ত্রশস্ত্র আর যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন।
প্রপিতামহ ভৃগু পরশুরামের অস্ত্রপ্রীতি দেখে বললেন, ‘যদি দিব্যাস্ত্র লাভ করতে চাও, মহাদেবের আরাধনা করো। তিনি অস্ত্রের ভাণ্ডার। তাঁকে তুষ্ট করতে পারলে তুমি এই ত্রিভুবনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্রবিদ হয়ে উঠবে।’
প্রপিতামহের উপদেশ মেনে পরশুরাম মহাদেবের তুষ্টির জন্য কঠোর সাধনা শুরু করেন। অবশেষে পরশুরামের সাধনার কাল পূর্ণ হলে মহাদেব তাঁকে সমস্ত দিব্য অস্ত্রশস্ত্র দান করেন।
পরশুরাম প্রথম থেকেই ক্ষত্রিয়বিদ্বেষী ছিলেন না। একটি ঘটনা তাঁকে ক্ষত্রিয়বিদ্বেষী করে তুলল।
একদিন হৈহয়বংশীয় রাজা কার্তবীর্য্যার্জুন বহু সৈন্য নিয়ে মৃগয়ায় বেরোলেন। ঘুরতে ঘুরতে নর্মদার তীরে পৌঁছলেন রাজা কার্তবীর্য্যার্জুন। নর্মদার তীরেই ঋষি জমদগ্নির আশ্রম। আশ্রমের অতিথি হলেন রাজা। মহর্ষি তাঁর সাধ্যমতো অতিথিসৎকার করলেন। রাজার বিলাসদ্রব্য, উন্নতমানের খাদ্য-পানীয়ের অভাব হলো না আশ্রমে। রাজা তো অবাক! এত রাজকীয় আসন- ব্যসন, খাদ্য-পানীয় আসে কোত্থেকে? খবর নিয়ে কার্তবীর্য্যার্জুন জানলেন, জমদগ্নির কাছে একটি হোমধেনু আছে। এর কাছে যা-ই চাওয়া হয়, তা-ই পাওয়া যায়। রাজার তো মাথাটা খারাপ হয়ে গেল! এই হোমধেনুটি তাঁর চাই-ই চাই।
মহর্ষি জগদগ্নির কাছে গাভিটি চেয়ে বসলেন রাজা। কিন্তু ঋষি কিছুতেই রাজি হলেন না। ক্রুব্ধ হয়ে উঠলেন কার্তবীয্যার্জুন। আশ্রমটি ছারখার করে দিতে সৈন্যদের আদেশ দিলেন। আশ্ৰম তছনছ শেষে গাভিটিকে বেঁধে নিয়ে গেলেন রাজা। পেছনে পড়ে থাকল বিধ্বস্ত আশ্রমটি এবং প্রহৃত রক্তাক্ত জমদগ্নি মুনির অচেতন দেহটি।
এই বীভৎসতার সময় পরশুরাম আশ্রমে ছিলেন না। ফিরে দেখলেন, আশ্রমের উঠানে পিতার আহত দেহটি পড়ে আছে এবং মা রেণুকা তাঁর পায়ের কাছে বসে বুকে আঘাত করতে করতে বিলাপ করছেন।
কিছুক্ষণ পর পিতামহ ভৃগু এসে মৃতসঞ্জীবনীর সাহায্যে জমদগ্নিকে সুস্থ করে তুললেন।
ওই সময় আশ্রমে সমবেত সকলে পরশুরামের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘আমি যদি মহর্ষি জমদগ্নির ঔরসে জন্মাই, যদি রেণুকা আমার গর্ভধারিণী হন, তাহলে এই দুজনের নামে শপথ করছি—পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করে ছাড়ব আমি।’
পরশুরামের প্রতিজ্ঞাবাক্য শুনে উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠেছিলেন।
এই সময় পরশুরাম আবার বললেন, ‘আমার পিতা চেতনা লাভ করার আগে মা রেণুকা একুশবার বুক চাপড়ে বিলাপ করেছিলেন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করব আমি।’
তারপর অভেদ্য কবচ, নাগপাশ, পাশুপত অস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, নারায়ণাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, বায়ব্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, গান্ধর্বাস্ত্র, গরুড়াস্ত্র, জ্মুণাস্ত্র, গদা, শক্তি, শূল প্রভৃতি দিব্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ক্ষত্রিয়নিধনে বেরিয়ে পড়লেন পরশুরাম।
প্রথমেই আক্রমণ চালালেন কার্তবীর্য্যার্জুনের রাজ্যে। মিত্র রাজাদের নিয়ে কার্তবীর্য্যার্জুন পরশুরামকে প্রতিহত করতে চাইলেন। পরশুরামের বুকের তলায় তখন পিতৃলাঞ্ছনার আগুন। তুমুল যুদ্ধের পর কার্তবীর্য্যার্জুন নিহত হলেন। মিত্র রাজাদের মধ্যে যারা বাঁচল, পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল
এর পর একুশবার পরশুরাম ক্ষত্রিয়নিধনে মগ্ন হয়েছিলেন।
একটা সময়ে শান্ত হয়ে এলেন পরশুরাম। আশ্রমিক কাজে মনোনিবেশ করলেন।
.
এই পরশুরামের সামনে এক দ্বিপ্রহরে এসে উপস্থিত হলো কর্ণ। পরশুরামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।
করজোড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি ব্রাহ্মণ। ভার্গব গোত্রের ব্রাহ্মণ আমি। আমি আপনার পায়ের কাছে বসে বিদ্যা শিখতে এসেছি মহর্ষি।
আকাঁপা কণ্ঠে নিজের অসত্য পরিচয় দিল কর্ণ। মিথ্যে পরিচয় না দিয়ে উপায় ছিল না তার। কর্ণ জানত, পরশুরামের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদিতা প্রবল। নিচু জাতের কাউকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন না তিনি। দ্রোণাচার্য যা করেছেন, ইনিও তা-ই করবেন। সুতরাং নিজের আসল পরিচয় চলবে না এখানে। নিজেকে ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিতে পারত, কিন্তু কর্ণ তো জানে, কী ভীষণরকম ক্ষত্রিয়বিদ্বেষী পরশুরাম! পরশুরামের ছাত্র হতে গেলে নিজের আসল পরিচয় লুকানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আর মিথ্যে পরিচয় দেবেই যখন, একেবারে পরশুরামের বংশের লোক বলে পরিচয় দেওয়া ভালো। দিলও তা-ই কর্ণ
বলল, ‘আমি আপনারই গোত্রের ব্রাহ্মণ গুরুদেব। আমাকে আপনার শিষ্যত্ব দিন।’
কর্ণের পরিচয় পেয়ে তো পরশুরাম মহাখুশি! কাশ্যপ নয়, ভরদ্বাজ নয়, এমনকি মৌদগল্য গোত্রেরও নয়; একেবারে ভৃগুবংশীয় ভার্গবগোত্রের ছেলেটি! এক ভার্গব ব্রাহ্মণপুত্র এসেছে তাঁর কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে! খুশিতে বিগলিত হয়ে গেলেন পরশুরাম। বিগলিত কণ্ঠে কর্ণকে আহ্বান জানালেন।
বললেন, ‘এসো তুমি। আমার আশ্রমে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
কর্ণ জোড় হাতে বলল, ‘আমার নাম কর্ণ। আজ থেকে আপনি আমার পরম গুরু। আপনি আমার পিতা, আপনি আমার ত্রাতা।’
পরশুরামের চোখ চিকচিক করে উঠল। ভেতরটা খুশিতে ভরে গেল তাঁর। যাক, বহুদিন পর এমন একজন অনুগত ব্রাহ্মণসন্তান পাওয়া গেল, যে অস্ত্রবিদ্যা অধ্যয়ন করবে বলে এই দুর্গম পাহাড়ি আশ্রমে তাঁর কাছে এসেছে! বহু বছর আগে দ্রোণ নামে আরেক ব্রাহ্মণ এসেছিল তাঁর কাছে। বয়স তার একটু বেশি হলেও স্মরণশক্তি ছিল তার দুর্দান্ত। অতি সহজেই কঠিন অস্ত্রকৌশলগুলো রপ্ত করে নিতে পেরেছিল দ্রোণ। তাঁর যা কিছু অস্ত্রবিদ্যা, সব কিছু উজাড় করে শিখিয়েছিলেন দ্রোণকে। আজ অনেক দিন পর আরেক ব্রাহ্মণসন্তান এলো, যাকে দ্রোণের চেয়েও তেজোময়, অধ্যবসায়ী, কষ্টসহিষ্ণু, ধীশক্তিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে তাঁর। একে শিখিয়ে আনন্দ পাওয়া যাবে। অজিনাসনে বসে দ্রোণকে সামনে নিয়ে এসব কথা ভেবে গেলেন পরশুরাম।
পরশুরাম উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোমার মঙ্গল হোক বৎস। আমি আমার বিদ্যা দিয়ে তোমাকে কৌশলী করে তুলব। এই পৃথিবীতে যাতে তুমি প্রসিদ্ধ একজন রণবিশারদ হয়ে ওঠো, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে।’
পরশুরাম কর্ণের ভক্তি আর বিনয়ের মাধুর্যে এতটাই বিগলিত হয়ে গেলেন যে কর্ণের পিতার নাম কী, তার নিবাস কোথায়, এর আগে কার কার কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছে—কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।
পরম আদরে কর্ণকে আশ্রমের বিশেষ আবাসনে থাকতে দিলেন। তার আহারের সুবন্দোবস্ত করলেন।
কর্ণের বুক চিড়ে তৃপ্তির একটা ধ্বনি বেরিয়ে এলো।
স্বগত কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘অপেক্ষা করুন দ্রোণাচার্য। আমি আসছি। আপনার সকল গরিমা ভেঙে দেওয়ার জন্য, অর্জুনকে ছারখার করে দেওয়ার জন্য আমি আসছি।’
তেইশ
গভীর নিষ্ঠা আর পরম শ্রদ্ধায় পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা শুরু করল কর্ণ। দিন যায়, তার অস্ত্রশিক্ষা-প্রশিক্ষণ এগোয়। উন্নত অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করবার জন্য কর্ণ দিন আর রাতকে একাকার করতে থাকল।
কর্ণের বাহুবীর্য, তার অস্ত্রকৌশল দেখে পরশুরাম চমৎকৃত হলেন। গুরুসেবায় কর্ণের মনোযোগ দেখে অশেষ তৃপ্তি লাভ করলেন তিনি। তৃপ্তির উপহারস্বরূপ পরশুরাম একদিন কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করার কৌশল এবং সে অস্ত্র সংবরণ করার নিয়ম শিখিয়ে দিলেন।
কর্ণ হাতে স্বর্গ পেল। সে জানে, ব্রহ্মাস্ত্রকৌশল জানলে হবে না, এই অস্ত্রনিক্ষেপে চৌকস হতে গেলে এর পুনঃপুন অনুশীলন করে যেতে হবে। ঘুম-বিশ্রাম পরিত্যাগ করে কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্রের অনুশীলনে নিজেকে উৎসর্গ করে বসল। গভীর নিষ্ঠা দিয়ে সে ব্রহ্মাস্ত্র এবং অন্যান্য ধনুর্বিদ্যা অধিগত করার চেষ্টা করে যেতে লাগল।
কর্ণের অস্ত্রানুশীলন এবং কষ্টসহিষ্ণুতা দেখে পরশুরাম যারপরনাই আনন্দিত হলেন।
সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু নিয়তি বেঁকে বসল একদিন। আশ্রমে দুর্ঘটনা ঘটে গেল একটা। সেই ঘটনা কর্ণের জীবনকে ওলটপালট করে দিল।
উপবাসে দেহ ক্লিষ্ট সেদিন পরশুরামের। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চাইল। হঠাৎ গুরুদেবের ইচ্ছে হলো, শিষ্য কর্ণের কোলে মাথা রেখে শ্রান্তি দূর করবেন। করলেনও তাই। একটি বৃক্ষতলে কর্ণের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন পরশুরাম। মৃদু হাওয়া বইছিল তখন। ধীরে ধীরে পরশুরামের চক্ষু ঘুমে জড়িয়ে এলো। একটা পর্যায়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি। কর্ণ অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকল। গুরুর ঘুমে যাতে কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে—সেদিকে কড়া নজর কর্ণের। শিরদাঁড়া সোজা করে স্থির হয়ে গুরুর মাথার নিচে কোল পেতে বসে রইল কর্ণ।
পরশুরামের আশ্রমটা এমনিতেই নির্জন। পরশুরাম যেখানে আজ বিশ্রাম নিচ্ছেন, তা আরও নিভৃতস্থান। প্রাণীহত্যা নিষেধ বলে আশ্রমটি নানা কীটপতঙ্গ, পশুপাখির অভয়ারণ্য। এরা বিনাদ্বিধায় এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়।
এক কাঁকড়াবিছা কর্ণ-পরশুরামের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। খাদ্যের খোঁজেই বেরিয়েছিল সে। মানুষের গন্ধ নাকে এসে লাগল তার। ক্ষুধা চাগিয়ে উঠল। এগিয়ে গিয়ে কর্ণের উন্মুক্ত ঊরুতে হুল বসাল কাঁকড়াবিছাটি। উরু থেকে রক্ত চুষে নিতে শুরু করল কীটটি।
অসহনীয় ব্যথায় কর্ণের সমস্ত শরীর টনটন করে উঠল। কিন্তু কর্ণ অনড় রইল। গুরুর ঘুম ভেঙে যাবে বলে সকল ব্যথা দাঁতমুখ চেপে সহ্য করে যেতে লাগল কর্ণ। কীটটির মুখ চুইয়ে কর্ণের ঊরু বেয়ে রক্তের ধারা মাটিতে নামল।
সব কিছু দেখে যেতে লাগল কর্ণ। কিন্তু বিন্দুমাত্র দেহ হেলাল না। মাটির মূর্তির মতো স্থির রইল। দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে ধরে পরশুরামের ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করে রইল কৰ্ণ।
এদিকে রক্তের ধারাটি মাটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গুরুদেবের গায়ে গিয়ে লাগল। চটচটে কিছু একটা গায়ে লাগায় ঘুম ভেঙে গেল পরশুরামের। সচকিত হয়ে উঠে বসলেন তিনি।
বললেন, ‘এ কী! এ কী লাগল আমার গায়ে? আঠা আঠা! কী এটা?’
কর্ণ নিরুত্তর থাকল।
পরশুরাম বললেন, ‘তুমি কিছু বলছ না যে কর্ণ! তুমিই তো আমার পাহারায় ছিলে! তোমার কোলে মাথা রেখেই তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!’
কর্ণ শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনার গায়ে রক্ত লেগেছে গুরুদেব।’
‘রক্ত! কার রক্ত? কেন লাগল আমার শরীরে? তুমি কী করছিলে?’
কর্ণ গুরুদেবের শেষ প্রশ্নের উত্তর দিল না। প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিল, ‘আমার রক্ত আপনার গায়ে লেগেছে গুরুদেব।’
‘তোমার রক্ত আমার কাছে লেগেছে! কেন তোমার রক্ত আমার গায়ে লাগল?’
হঠাৎ গুরুদেবের দৃষ্টি পড়ল কীটদষ্ট কর্ণের ঊরুতে। সেখান থেকে তখনো রক্ত ঝরে যাচ্ছে। স্থির হয়ে গেল পরশুরামের দৃষ্টি। অপলক চোখে কিছুক্ষণ কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।
তারপর শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘কী ঘটনা আদ্যপ্রান্ত খুলে বলো আমায়।’
কর্ণ সব ঘটনা গুরুদেবকে বর্ণনা করল।
সব শুনে পরশুরামের মধ্যে দুধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। শিষ্যের সহ্যশক্তি আর গুরুভক্তি দেখে স্নেহে বিগলিত হয়ে পড়লেন তিনি। তারপর হঠাৎ করে একটা সন্দেহ তাঁর মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল—না না! কিছুতেই না! একজন বামুনের এমন সহ্যশক্তি থাকার কথা নয়! এরকম দহনজ্বালা সহ্য করবার ক্ষমতা একমাত্র ক্ষত্রিয়েরই আছে! তাহলে! তাহলে কর্ণ কি ব্ৰাহ্মণ নয়! যদি ব্রাহ্মণ না হয়, তাহলে কে সে?
কর্ণের দিকে তর্জনী বাড়িয়ে পরশুরাম বললেন, ‘তুমি পরিষ্কার করে বলো—কে তুমি? তুমি নিজেকে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছ, কিন্তু ব্রাহ্মণদের সহ্যশক্তি কতটুকু, ভালো করেই জানা আছে আমার। এই ভয়ংকর কীটের দংশন কোনো বামুনবেটা সহ্য করতে পারবে না। এই সহ্যশক্তি একমাত্র ক্ষত্রিয়কেই মানায়। বলো তুমি কে? তোমার আসল পরিচয় কী— বলো আমায়।’
কর্ণ নিজেকে আর লুকাল না। নিজের সত্যপরিচয় জানিয়ে কর্ণ বলল, ‘আমি জন্মেছি সেই ঘরে, যেখানে এক ক্ষত্রিয়পুরুষ এক ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। আমার বাবা অধিরথ ক্ষত্রিয়, মা রাধা ব্রাহ্মণগোত্রের। লোকে আমাকে রাধার ছেলে রাধেয় কর্ণ বলে ডাকে। আমাদের কাছে, এই ভারতবর্ষের মানুষদের কাছে পিতার চেয়ে মায়ের স্থান উঁচুতে। বলা হয়েছে—মায়ের পদতলে সন্তানের স্বর্গ। মায়ের সূত্রে আমি নিজেকে আপনার কাছে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছি। এতে তো আমি কোনো অপরাধ করিনি গুরুদেব!’
পরশুরাম কর্ণের কথা শুনে স্তব্ধবাক হয়ে গেলেন। কর্ণের কথার কী জবাব দেবেন, প্রথমে স্থির করতে পারলেন না।
পরে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘তাই বলে নিজেকে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিলে?’
কর্ণ বলল, ‘আপনি আমার গুরু। গুরু পিতার মতন। তাই আপনি আমার পিতা। একজন শিষ্যের গুরুর পরিচয়ে নিজের পরিচয় দেওয়া কি অপরাধ গুরুদেব?’
কর্ণ পরশুরামকে একথা বলল বটে, কিন্তু ভয়ে কাঁপতে থাকল।
কর্ণের ধৈর্যে, যুক্তিতে, সেবায় পরশুরামের মায়া হলো না।
উপরন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন তিনি। কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিথ্যে পরিচয় কেন দিয়েছিলি তুই আমার কাছে?’
কর্ণ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমি অস্ত্রের লোভেই আপনার কাছে এসেছিলাম। আমি জানতাম, ক্ষত্রিয় পরিচয় দিলে আপনি আমায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন। কারণ আপনি ক্ষত্রিয়দের প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। তাই নিরুপায় হয়ে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলাম আপনার কাছে।’
তারপর চট করে পরশুরামের পা জড়িয়ে ধরল কর্ণ। অনুনয়ের কণ্ঠে বলল, ‘এই পৃথিবীতে আপনার মতো অস্ত্রবিদ আর কেউ নেই গুরুদেব। আপনার পায়ের কাছে বসে অস্ত্রশিক্ষা নেওয়ার সৌভাগ্যে গর্বিত হতে চেয়েছিলাম আমি।’
কর্ণের এত অনুনয়-বিনয়েও পরশুরামের মন নরম হলো না। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘তুই একজন মিথ্যুক কর্ণ। তুই লোভী। সত্যের চেয়ে লোভ বড় তোর কাছে। এই অপরাধের মুক্তি নেই তোর।’
কর্ণ বিচূর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা অধিগত করবার জন্য আপনার কাছে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলাম প্রভু।’
প্রভু এবার ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ব্রহ্মাস্ত্র পাওয়ার লোভেই তুই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিস তো? আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি—তোর বিনাশকালে কিংবা পরম সংকটমুহূর্তে তুই ব্ৰহ্মাস্ত্র ছোড়বার কৌশল ভুলে যাবি। তবে হ্যাঁ…।’ বলে থেমে গেলেন পরশুরাম। ভাবলেন উৎসুক হয়ে কর্ণ কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে তাঁকে।
কিন্তু কর্ণ কোনো কিছু জানতে চাইল না। কী রকম এক উন্মুল চেহারা নিয়ে পরশুরামের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকল।
কর্ণকে নিস্পৃহ দেখে পরশুরাম বললেন, ‘তবে যুদ্ধকালে কোনো ক্ষত্রিয়পুরুষ তোমার সঙ্গে এঁটে উঠবে না কৰ্ণ।
যে গুরুর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটবার জন্য অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করে গেছে কর্ণ, সে গুরুর কাছ থেকে তার কোনো পুরস্কার জুটল না। উপরন্তু বিস্মৃতির অভিশাপ নেমে এলো তার ওপর। শুধু সান্ত্বনা এইটুকু যে যুদ্ধকালে কোনো বীরপুরুষ তাকে হারাতে পারবে না।
মহেন্দ্র পর্বতে পরশুরামের আশ্রম থেকে বিতাড়িত হয়ে কর্ণ নিজ আবাসভূমি চম্পানগরীতে ফিরে গেল না। ফিরে এলো হস্তিনাপুরের কুরুরাজপ্রাসাদে। হস্তিনাপুরে রাধা-অধিরথ স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছিলেন একদিন। কিন্তু বেশিদিন মন টিকেনি সেখানে। চম্পানগরীর পুরনো আবাসস্থলে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা। হস্তিনাপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল। রাতের আঁধারে নিজেকে অনেকটা ঢেকেই দুর্যোধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল কর্ণ।
কৌরবদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈরিতা তখন গোপন কোনো বিষয় নয়। তাদের জ্ঞাতিশত্রুতা রাজপ্রাসাদে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা হস্তিনাপুরে জানাজানি হয়ে গেছে।
যুধিষ্ঠিররা মনে করছে—হস্তিনাপুরের রাজদণ্ড তাদেরই হাতে থাকা উচিত। তাদের বাবা এই রাজ্যের নৃপতি ছিলেন। জেঠা ধৃতরাষ্ট্র ভারপ্রাপ্ত শাসক হিসেবে এদেশ শাসন করেছেন, এখন তারা বড় হয়েছে, জেঠার উচিত শাসনভার যুধিষ্ঠিরের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সিংহাসন না ছাড়ুন জেঠা, অন্তত যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা তো দিন!
কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তা চান না। তিনি চান, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন হস্তিনাপুরের যুবরাজ হোক। তাঁর এই ইচ্ছের সমানে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন পিতামহ ভীষ্ম আর বিদুর।
দুর্যোধন মনে করে, পাণ্ডবরা কুরুবংশের কেউ নয়। কানাঘুষায় সে জেনে গেছে, তার কাকার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না। তাহলে তাঁর পুত্র নামধারী এরা কারা? যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেবদের পিতা কে? নিশ্চয়ই কাকা পাণ্ডু নন। নিজেদের যতই এরা পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব বলে পরিচয় দিক, এদের জনক যে অন্য কেউ—বদ্ধমূল বিশ্বাস দুর্যোধনের। সেই হিসেবে এরা বহিরাগত। নিজেদের পাণ্ডুপুত্র বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কৌরবসিংহাসন হস্তগত করবার মতলবে আছে যুধিষ্ঠিররা।
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভীমের সঙ্গেই দুর্যোধনের ভয়াবহ বিরোধ। ভীম বেয়াড়া, মারমুখী, ঝগুড়ে। যেকোনো ছুতো ধরে সে কৌরবভাইদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ায়। এই ঝগড়া অল্প সময়ের মধ্যে মারামারিতে রূপ নেয়। মারামারিতে কৌরবরা ভীমের সঙ্গে পেড়ে ওঠে না। ভীমের দেহে অমিতশক্তি। দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে ভীম কৌরবদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। ভীম যা একটু ভয় করে দুর্যোধনকে। শক্তিতে এবং গদাকৌশলে দুর্যোধন ভীমের সমান। গদাযুদ্ধে ভীম দুর্যোধনের সঙ্গে পেরে ওঠে না।
দুর্যোধনের ক্ষোভের অন্ত থাকে না। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইদের নিরাপত্তা দিতে পারে না সে। রাজকুমার হয়েও ভীমের ভয়ে চোরের মতো মুখ লুকিয়ে চলতে হয় দুঃশাসন, বিকর্ণদের পিতার কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায় না দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্র যে এই অনাচারের প্রতিকার করতে চান না, তা নয়। ভীমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলে ভীষ্ম-বিদুর বাধা হয়ে দাঁড়ান। বারবার মনে করিয়ে দেন, যুধিষ্ঠিররা প্রাক্তন রাজা পাণ্ডুর পুত্র। এই রাজ্যে দুর্যোধনদের মতো তাদেরও অধিকার আছে। হস্তিনাপুরের জনগণ এদের মেনে নিয়েছে। পাণ্ডবদের অহিতকর কিছু করতে চাইলে প্রজা-অসন্তোষ হতে পারে। সুতরাং ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিয়ো মহারাজ।
ধৃতরাষ্ট্র পিছিয়ে আসেন।
পিতার কাছ থেকে কোনো প্রতিকার না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে দুর্যোধন। নাহ, পিতা না করুন, নিজেকে কিছু একটা করতে হবে—দ্রুত ভেবে যায় দুর্যোধন।
একদিন দূর-অরণ্যে নদীকূলে ভোজন আর জলক্রীড়ার আয়োজন করে দুর্যোধন। কৌরব- পাণ্ডব—উভয়পক্ষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে, সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়ে পানোন্মত্ত ভীমের হাত-পা বেঁধে নদীজলে নিক্ষেপ করে দুর্যোধন। কিন্তু জলে বিসর্জিত হয়েও ভীম মরে না। কয়েকদিন পরে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে। সেই ঘটনার পর থেকে কৌরবে-পাণ্ডবে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।
ঠিক ওই সময়ে কর্ণ, পরশুরামের আশ্রম থেকে হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছল। দুর্যোধন কর্ণকে পেয়ে দুর্লভ ধন পেয়ে গেল যেন!
দুর্যোধন জিজ্ঞেস করল, ‘এতদিন কোথায় ছিলে? একদিন কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি! কাউকে কিছু না বলে দ্রোণাচার্যের পাঠশালা ত্যাগ করে গেলে!’
কর্ণ সবিস্তারে গেল না। শুধু বলল, ‘অস্ত্রের সমস্ত কৌশল আয়ত্ত করে ফিরে এসেছি আমি।’
‘সমস্ত সমরাস্ত্র আয়ত্ত করে ফিরে এসেছ! কার কাছ থেকে শিখলে বন্ধু?’ পরম আগ্রহে জানতে চাইল দুর্যোধন।
চব্বিশ
উৎফুল্ল কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘জগদ্বিখ্যাত যুদ্ধগুরু পরমপুরুষ পরশুরাম। তিনি যুদ্ধাস্ত্রের আধার। এই পৃথিবীখ্যাত সমরবিদ পরশুরামের শিষ্য হয়ে তাঁর কাছে এতদিন অস্ত্রশিক্ষা করেছি আমি। তাঁর সকল বিদ্যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।’
‘ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যাও?’ ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইল দুর্যোধন।
‘শুধু ব্রহ্মাস্ত্র কেন বলছ, নারায়ণাস্ত্র-বরণাস্ত্র-গান্ধর্বাস্ত্র-বায়ব্যাস্ত্র—সব অস্ত্রেই দক্ষ করে তুলেছেন গুরুদেব আমায়।
দুর্যোধন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। হর্ষধ্বনি করে কর্ণকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল।
বলল, ‘আমি খুশি বন্ধু, আমি মহাখুশি। অর্জুনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো একজনকে এতদিনে পেয়ে গেলাম আমি!’
সেই সন্ধ্যায় এমন দুজন পুনরায় মিলিত হলো, যে দুজন পাণ্ডবদের শত্রু মনে করে। দুর্যোধন ভীমকে সহ্য করতে পারে না। কর্ণ পারে না ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে।
.
এদিকে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায় অস্ত্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে এলো। অস্ত্রগুরুর মনে হলো—কৌরব আর পাণ্ডবদের যার যা কিছু শেখার, সবই শিখে ফেলেছে তারা। শুধু শিখলে তো হবে না, কত শিখল, তার তো একটা পরীক্ষা হওয়া দরকার!
রাজসভায় গিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আর পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে একদিন দেখা করলেন দ্রোণ। কুশলাদি বিনিময়ের পর কথাটি পাড়লেন আচার্য।
বললেন, ‘রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। তারা প্রত্যেকে আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠেছে। কেউ গদাযুদ্ধে, কেউ অসিচালনায়, কেউ ধনুর্বিদ্যায়, কেউ গজারোহণে প্রশংসাযোগ্য নিপুণতার অধিকারী আজ।’
পিতামহ বলে উঠলেন, ‘সাধু সাধু! তা কে কোন ব্যাপারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে আচার্য! মানে আমি রাজকুমারদের কথা বলছি।’
‘সবাই দক্ষতা অর্জন করেছে। তবে সবার মধ্যে দুজনের নাম আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই।’
‘তারা কারা?’ আগ্রহসহকারে জানতে চাইলেন ধৃতরাষ্ট্র।
দ্রোণাচার্য বললেন, ‘তাদের একজন অর্জুন, দ্বিতীয়জন দুর্যোধন।’
‘তা দুর্যোধনের বীরত্ব কীসে?’ ধৃতরাষ্ট্র আবার জিজ্ঞেস করলেন।
‘গদাযুদ্ধে দুর্যোধন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গদাযুদ্ধে তার সঙ্গে পেড়ে উঠবে—কৌরব বা পাণ্ডবদের মধ্যে কেউ নেই।’ দ্রোণাচার্য বললেন।
এতক্ষণ চুপ থাকা বিদুর হঠাৎ বলে উঠল, ‘শুনেছি, ভীমও গদাচালনায় কম দক্ষ নয়।’
‘আপনি ঠিকই শুনেছেন। তবে আপনার শোনার মধ্যে কিঞ্চিৎ খামতি আছে।’
‘খামতি আছে!’ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল বিদুর।
দ্রোণাচার্য বললেন, ‘দুর্যোধন আর ভীম—গদাচালনায় দুজনই প্রায় সমানে সমান। তবে ভীমের তুলনায় দুর্যোধন এগিয়ে।’
নির্লজ্জের মতো বিদুর জিজ্ঞেস করে বসল, ‘কেন, দুর্যোধন এগিয়ে কেন?’
দ্রোণ বললেন, ‘ভীম গদা চালায় শারীরিক শক্তি দিয়ে। আর দুর্যোধন গদাচালনায় কৌশল প্রয়োগ করে।’
এবার পিতামহের দিকে তাকিয়ে দ্রোণ বললেন, ‘পিতামহ, আপনি তো ভালো করেই জানেন, গদাযুদ্ধে শারীরিক শক্তির চেয়ে প্রয়োগকৌশল কী ভীষণ কার্যকরী!
বিদুর ম্লান মুখে ঘাড়টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল
তৃপ্তির উজ্জ্বল আভা ধৃতরাষ্ট্রের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর অর্জুন কোন অস্ত্রে দক্ষ হয়ে উঠেছে?’
‘ধনুর্বিদ্যায় মহারাজ। আমার জ্ঞাত সকল অস্ত্রবিদ্যা আমি অর্জুনকে শিখিয়ে দিয়েছি। যেকোনো জটিল-কুটিল তীর অর্জুন অনায়াসে তার ধনুতে যোজনা করতে পারে এবং অদৃশ্য বস্তুতে সেই তীর দিয়ে আঘাত করতে পারে।’
‘তা বেশ, তা বেশ!’ ধৃতরাষ্ট্রের এই কথার মধ্যে পূর্বের প্রাণময়তা খুঁজে পাওয়া গেল না।
পিতামহ বললেন, ‘কুমাররা কী শিখল, তার তো একটা পরীক্ষা হওয়া দরকার, কী বলেন দ্রোণাচার্য?’
‘তা তো বটেই। মূলত সেই উদ্দেশ্যেই আজ আমি রাজসভায় এসেছি। আপনারা একটা দিন নির্ধারণ করে দিন। ওইদিন রাজকুমারদের অস্ত্রবিদ্যার পরীক্ষা নেওয়া হবে।’
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘দিনটা আপনিই ঠিক করুন। আপনি যেদিন বলবেন, সেদিন আমরা রঙ্গভূমিতে উপস্থিত থাকব।’
‘তাহলে আজ থেকে তিনদিন পর রাজকুমারদের অস্ত্রবিদ্যা পরীক্ষার দিন নির্ধারণ করলাম আমি। আশা করি, এর মধ্যে সকল রাজকীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারবেন মহারাজ।’
‘সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না আচার্য। আপনার পাঠশালার বিশাল মাঠে মঞ্চ তৈরি করবার নির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছি এখনই।’ ধৃতরাষ্ট্র বললেন। ইত্যবসরে অধিরথ জেনে গেছেন, কর্ণ হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছে। এতদিন পুত্র-অদর্শনে মনটা বড় কাহিল ছিল তাঁর। কর্ণের আগমনবার্তা শুনে প্রাণ একেবারে চঞ্চল হয়ে উঠল অধিরথের। পুত্র অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরল বটে, কিন্তু চম্পানগরীতে এলো না! মা রাধাকে দেখতে এলো না! পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল না! ভাবতে ভাবতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না অধিরথ। হস্তিনাপুরের উদ্দেশে রওনা দিলেন তিনি।
এদিকে কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্র পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। পাকেচক্রে অধিরথ সেদিনই হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছলেন, যেদিন রাজকুমাররা রঙ্গভূমিতে সমবেত হয়েছে।
স্বয়ং দ্রোণাচার্য অস্ত্রপরীক্ষার শুভক্ষণ ঘোষণা করলেন।
প্রথমে নিজ নিজ গদা নিয়ে ভীম আর দুর্যোধন মুখোমুখি দাঁড়াল। দর্শকসারিতে তখন রাজবাড়ির সকলে আসন গ্রহণ করেছেন। দেশ-বিদেশের রাজা-রাজন্য, মন্ত্রী-অমাত্য, সমরনায়কেরা যাঁর যাঁর আসনে বসেছেন রাজকুমারদের অস্ত্রদক্ষতা উপভোগ করার জন্য। রাজকন্যা, রাজমহিষীরাও এসেছেন। গান্ধারীর পাশে কুন্তীকেও দেখা যাচ্ছে।
দুর্যোধন-ভীমে গদাযুদ্ধ শুরু হলো। একপর্যায়ে তাদের কসরত এমন একপর্যায়ে পৌঁছল যে যুদ্ধটা আর কৃত্রিম বলে মনে হলো না। মনে হলো—উভয়ে গদাচালনায় তাদের ক্রোধকে মিশিয়ে দিয়েছে।
বুঝতে পারলেন দ্রোণ। দ্রুত উভয়কে গদাযুদ্ধ থেকে বিরত করলেন। উভয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে যার যার জায়গায় ফিরে গেল।
এরপর যুধিষ্ঠির, নকুল-সহদেব, দুঃশাসন, দুঃসহ, দুর্মুখ, দুর্মদ প্রভৃতি কৌরব-পাণ্ডবরা স্ব স্ব দক্ষতা রঙ্গমঞ্চে দেখিয়ে গেল। তাদের পারঙ্গমতা দেখে সবাই বাহবা দিতে লাগল। বাজনদাররা ধুন্ধুমার শব্দে বাজনা বাজিয়ে যেতে লাগল।
এবার বৃত্তের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন দ্রোণাচার্য। দীর্ঘ চুলে হাত দুটো বুলিয়ে নিলেন। সযত্নে উত্তরীয়টা কাঁধে তুলে দিলেন। সূর্যের দিকে পূর্ণ চোখে তাকালেন একবার।
তারপর জলদগম্ভীর কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘বাজনদাররা, তোমাদের বাজনা থামাও এবার। এখন আমি এমন একজনকে ডাকছি, যে আমার কাছে আমার ছেলে অশ্বত্থামার চেয়েও প্রিয়, যে অস্ত্রের সমস্ত কৌশল জানে। এসো অর্জুন, তুমি আর দূরে থেকো না। সামনে এগিয়ে এসো। তোমার অস্ত্রকৌশল দিয়ে চারদিক চমৎকৃত করে দাও।’
দ্রোণাচার্যের কথা শেষ হতে না হতে ঢাক-ঢোল-কাঁসর-ঝাঁজর-শঙ্খ-নাগরা-দগড় বেজে উঠল এই বাদ্যবাজনার মধ্যে অর্জুন দীপ্ত পদক্ষেপে রঙ্গভূমির মধ্যিখানে এসে দাঁড়াল।
এত কলরোল-আনন্দধ্বনির মধ্যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাশে বসা বিদুরকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ‘বিদুর, আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না ঠিক, কিন্তু মানুষের উৎফুল্ল-ধ্বনি শুনে মনে হচ্ছে, হস্তিনাপুর আর অরক্ষিত নয়। কুরুরাজ্য রক্ষা করার মতো যোদ্ধা আমরা পেয়ে গেছি।’
বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের মন্তব্যের জবাব দেবে কী, তার চোখ দুটো তখন আটকে গেছে অর্জুনে। এই সেই অর্জুন, যার দেহে তার রক্তধারা বইছে! জয় হোক তোমার পুত্র। মনে মনে আওড়ে গেল বিদুর।
ওদিকে গান্ধারীর পাশে বসা কুন্তীর বুক আনন্দাশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে।
অর্জুন ধনুকটি হাতে তুলে নিল। অস্ত্রকৌশল দেখাতে শুরু করল। কখনো বাণমুখে আগুন সৃষ্টি করল, কখনো জল, কখনো ঝড়। কখনো অর্জুনকে রথের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, কখনো অন্তর্হিত, কখনো তাকে লম্বা দেখাচ্ছে, কখনো হ্রস্ব। বাণের গতি-চাতুরীতে এরকম রহস্য তৈরি করে গেল অর্জুন।
দর্শকদের উল্লাসধ্বনি চরমে উঠল। সবাই বিস্মিত, চমকিত। বাজনদারদের বাজনার উচ্চতম গ্রাম স্পর্শ করল।
ঠিক সেই সময় রঙ্গদ্বারে বিকট একটা শব্দ হলো। ইন্দ্রের বজ্রের মতো তার আওয়াজ, মেঘধ্বনির মতো গম্ভীর এবং ভীতিজাগানিয়া।
সবাই একযোগে রঙ্গদ্বারের দিকে তাকালেন। দেখলেন, স্বর্ণ কবচ-কুণ্ডল শোভায় দীপ্তিমান হয়ে সূর্যের আলোকণা গায়ে মেখে এক যুবক রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করছে। তার প্রতি পদক্ষেপে পর্বতের গাম্ভীর্য ফুটে উঠছে।
যাঁরা চিনলেন না, স্তব্ধবাক হয়ে থাকলেন। যাঁরা চিনলেন, সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘কৰ্ণ, কৰ্ণ!’
সবার কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল দুর্যোধনভাইদের কণ্ঠস্বর, ‘কর্ণ, আমাদের কর্ণ! কর্ণ ফিরে এসেছে! আমাদের কর্ণ ফিরে এসেছে!’
কর্ণের নাম শুনে রঙ্গমণ্ডপের সবাই উৎসুক হয়ে উঠলেন। ভীষ্ম নিষ্পলক চোখে তাকালেন। বিদুরের চোখ কোঁচকানো। দৃষ্টিহীন চোখ নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র সামনের দিকে উৎকর্ণ হলেন।
সবচাইতে গভীর চোখে যিনি কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তিনি কুন্তী। কর্ণের নাম শুনে কুন্তীর ভেতরটা থরথর করে উঠল। তাঁর চোখেমুখে আঁধার আঁধার ঠেকল হঠাৎ। আচমকা মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। আসনের হাতলটা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন কুন্তী।
কুন্তী রাজবধূ হয়ে হস্তিনাপুরে আসার কিছুদিনের মধ্যে জেনে গেছেন, তাঁর কুমারীজীবনের বিসর্জিত পুত্রটি কুরুরাজ্যেরই কোনো একটা অঞ্চলে বড় হচ্ছে। পরে তিনি আরও জানলেন, চম্পানগরীর অধিরথ নামের এক সারথির ঘরে তাঁর পুত্রটি লালিতপালিত হচ্ছে। প্রথমে তার নাম বসুষেণ রাখা হলেও পরে তার নাম হয়ে গেছে কর্ণ। এসব জেনে নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল কুন্তীর। কিন্তু দুর্নাম, প্রাসাদীয় জীবন, পাণ্ডুর মনোকষ্ট ইত্যাদি বিষয় ভেবে নিজের বেদনা নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলেন কুন্তী।
আজ সেই চেপে রাখা বেদনা উদ্বেলিত হয়ে উঠল। তাঁর চোখ ফেটে অশ্রু গড়াতে লাগল। ভাগ্যিস সবার দৃষ্টি রঙ্গমঞ্চের মাঝখানে দণ্ডায়মান কর্ণের ওপর নিবদ্ধ ছিল! তাই কুন্তীর অশ্রুবিসর্জন তাঁরা দেখতে পেলেন না।
রঙ্গভূমির মাঝখানে, যেখানটায় অর্জুন দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেখানটায় এসে কর্ণ বুক চেতিয়ে দাঁড়াল। অর্জুন দুকদম পিছিয়ে গেল। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই অস্ত্রগুরু—কৃপাচার্য আর দ্রোণাচার্য। একজন প্রাক্তন, অন্যজন বর্তমান।
ওঁদের দেখে কর্ণের ঠোঁটে ব্যঙ্গমিশ্রিত একটুকরা হাসি ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। অবহেলা ও অনাদরের ভঙ্গিতে কর্ণ দুই অস্ত্রগুরুর চরণে প্রণতি জানাল।
তারপর অকস্মাৎ অর্জুনের দিকে ফিরল কর্ণ। দীপ্র চোখে বলল, ‘খুব বাহবা কুড়ালে তুমি আজ অর্জুন! অস্ত্রের ভেলকি দেখিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দিলে! রঙ্গভূমির সবাই ভাবলেন, এক মহাধনুর্ধর এসে গেছে! অস্ত্রকৌশলে ওর ধারেকাছে ঘেঁষবার কেউ নেই এই হস্তিনাপুরে! তাই না অর্জুন?’
তারপর কর্ণ তার দৃষ্টিকে দর্শকমণ্ডপের দিকে প্রসারিত করল। কণ্ঠে জোর ঢেলে বলল, ‘আপনারা সবাই ভেবে নিয়েছেন, অর্জুন অতুলনীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী সে। তার সঙ্গে প্রতিতুলনা দেওয়ার মতো কোনো বীর এ ভারতবর্ষে নেই। আমি আপনাদের অবগত করাচ্ছি যে অর্জুন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর নয়। তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো ধনুর্বিদ এই রঙ্গভূমিতে উপস্থিত আছে।’
দর্শকদের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠল, ‘কে সে?’
প্রজ্বলিত কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘আমি। অধিরথপুত্র রাধেয় কর্ণ বলছি—অর্জুন এতক্ষণ যা যা করে দেখিয়েছে, আমিও অনায়াসে তা করে দেখাতে পারি।’
দর্শকদের মধ্য থেকে দাবি উঠল, ‘দেখান, দেখান। আমরা অর্জুনের রণকৌশলগুলো আপনার হাত দিয়ে আবার দেখতে চাই।’
চাপে পড়ে দ্রোণাচার্য অনুমতি দিলেন। তাঁর ভাবখানা এই যে অর্জুনের মতো অস্ত্রকৌশল কিছুতেই দেখাতে পারবে না কর্ণ। কারণ অর্জুনকে ছাড়া আর কাউকে তো তিনি এরকম সমরকৌশল শেখাননি!