পনেরো
অন্যরা না বুঝলেও কুন্তীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, নিজের অসামর্থ্যের বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই রাজা বনে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সত্যি তা-ই। রাজকীয় হট্টগোল পাণ্ডুর আর ভালো লাগছিল না। দু-দুজন নারীর কাছে ছোট হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। এই রাজপ্রাসাদ, তার জৌলুস আর ভালো লাগছিল না পাণ্ডুর। আড়ম্বরতা থেকে মুক্তি চান তিনি।
কিন্তু কোথায় গেলে আত্মানুশোচনা থেকে মুক্তি মিলবে?
রাজা পাণ্ডুর হঠাৎ অরণ্যের কথা মনে পড়ে গেল। বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-ফল-ফুলের চেয়ে তো ভালো বন্ধু আর নেই! অরণ্যই তাঁকে পরম শান্তি দেবে, অক্ষমতার দুঃখ ভোলাবে, মনে হলো তাঁর। আরেকটি কথাও আচমকা মনে পড়ে গেল পাণ্ডুর। মৃগয়ার কথা। কৈশোরের গায়ে তারুণ্যের আলো পড়ল যখন, তখন থেকেই মৃগয়ার প্রতি আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল পাণ্ডুর। সেই আসক্তি দিনের পর দিন প্রবলতর হয়েছে। আসক্তি থেকে দক্ষতাও এসেছে। শেষের দিকে মৃগয়া তাঁকে এমন বিভোর করে রাখত যে রাজপ্রাসাদে ফেরার কথা ভুলে যেতেন। আহা! কত আনন্দঘন ছিল সেই মৃগয়ার দিনগুলো!
অরণ্য আর মৃগয়ার আকর্ষণে এবং সর্বোপরি আত্ম-গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় রাজা একদিন অরণ্যযাত্রা করলেন।
সঙ্গে দুই রমণী—কুন্তী আর মাদ্রী।
যাত্রার পূর্বে একটা কাজ করলেন নৃপতি পাণ্ডু। রাজ্যপরিচালনার সকল দায়িত্ব জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করলেন। এমনিতেই রাজা পাণ্ডুর মধ্যে অপরাধবোধ ছিল। বড় ভাই থাকতে তিনি রাজা হয়েছেন! দাদা অন্ধ হলে কী হবে, রাজ্যশাসন করবার সকল ক্ষমতা তাঁর মধ্যে আছে। তার পরও কুরু-উপদেষ্টারা জ্যেষ্ঠকে বাদ দিয়ে তাঁকে নৃপতি নির্বাচন করেছেন। এই জন্য তাঁর আফসোসের সীমা ছিল না। এখন সুযোগ পেয়ে সেই পরিতাপ থেকে মুক্তি চাইলেন পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুসাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত নরপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন।
এরপর একদিন পাণ্ডু দুই পত্নীকে নিয়ে অরণ্যের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
যাত্রা করলেন হিমালয়ের দিকে।
হিমালয়ের দক্ষিণভাগ। ছোট-বড় অনেক পর্বতের সমন্বয়ে গঠিত এই অংশটি। প্রকৃতি এখানে অতীব মনোরম। অরণ্য এখানে ঘন। বৃক্ষসকল ফুলেফলে সুশোভিত। বাতাস মৃদু। সেই সমীরণে পুষ্পসুবাস। অনতিদূরে ক্ষীণাঙ্গী স্রোতস্বিনী বহমান। স্রোতে নূপুরধ্বনি।
এখানকার অনুচ্চ এক গিরিশীর্ষে রমণীয় এক আবাসগৃহ। বহু বছর আগে কুরুনৃপতি শান্তনু এই বাড়িটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তাঁরও ছিল প্রচণ্ড মৃগয়ানুরাগ। তিনি ছিলেন প্রবলপ্রতাপী রাজা। হিমালয়ের এই অংশটি নানা রকমের পশুপাখিতে পূর্ণ। এখানে মহারাজ শান্তনু বারবার আসতেন মৃগয়ায়। স্থানটির সুরম্যতা তাঁকে খুব করে টেনেছিল। তাঁরই নির্দেশনায় এই গিরিচূড়ায় আবাসগৃহটি নির্মিত হয়েছিল। তিনি গত হলেও তাঁর পুত্র ভীষ্ম এই ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণ করে গেছেন। এই ভবনটির কথা রাজা পাণ্ডুর অজানা ছিল না। তাই অরণ্যবাসের সিদ্ধান্ত যখন তিনি নিলেন, স্থির করলেন ওই ভবনটিতেই থাকবেন।
এলেনও রাজা পাণ্ডু ওই অরণ্যভবনে, দুই পত্নীসহ।
আগে থেকেই গভীর বনের মধ্যকার এই ভবনটি বনবাসীদের কাছে বিস্ময়ের ছিল। রাজকীয় হর্ম্যটির মধ্যে দুই নারী, এক পুরুষকে দেখে তাদের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। ঈষৎ পাণ্ডু বর্ণের উন্নত নাসা, প্রশস্ত কপাল, আয়তলোচনের রাজপুরুষটিকে তারা দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে যায়। নারীর এমন চোখ ধাঁধানো রূপ এরা আগে কখনো দেখেনি। মর্ত্যলোকের কোনো নারী এমন সুন্দরী হতে পারেন, ভাবনার অতীত তাদের।
পরে পরে অরণ্যচারীরা জানতে পারল, পুরুষটি হস্তিনাপুরের নৃপতি আর নারী দুজন তাঁরই সহধর্মিণী। এতে তাদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
কিছুদিন অতিবাহিত হলো।
রাজা পাণ্ডু মৃগয়ায় মশগুল হয়ে পড়লেন। প্রতিদিন আবাসগৃহ থেকে গভীর অরণ্যে ঢুকে যান রাজা। হাতে ধনুক, তূণভর্তি তীক্ষ্ণ তীর। কোমরে দুধারি অসি। রাজার এমন যে ভারী করুণ মুখ, পশুহত্যার সময় কঠোর হয়ে ওঠে তা। তখন তাঁকে চেনা যায় না। তিনি তখন অন্য জগতের মানুষ—নির্দয়, নিষ্ঠুর। বাঘ, বৃক, বন্যবরাহ ইত্যাদি হিংস্র জন্তু হত্যা তো করেনই, চিত্রলহরিণ, কৃষ্ণসার, কস্তুরীমৃগ, নীলগাই প্রভৃতি নিরীহ প্রাণীও বধ করতে রাজার হাত কাঁপে না। এইভাবে দিনের পর দিন পশুনিধন করে যান পাণ্ডু।
ভীষ্ম কিছুদিন অন্তর অন্তর বিশ্বস্ত দূতের নেতৃত্বে পাণ্ডু এবং তাঁর স্ত্রীদের জন্য খাদ্য-বস্ত্র- প্রসাধনসামগ্রী পাঠান। মাঝেমধ্যে দূতের বদলে বিদুর আসে। কয়েকটা দিন দাদা-বউঠানদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে যায়।
মাদ্রীর চেয়ে কুন্তীর প্রতি টান বেশি বিদুরের। বিদুর মনে করে, কুন্তিভোজের এই কন্যাটির আজকের এই যে লাঞ্ছনা-অসহায়তা—সব কিছুর জন্য সে-ই দায়ী। পাণ্ডুর যৌন-অসামর্থ্যের কথা জেনেও সে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল রাজা কুন্তিভোজের কাছে! এর জন্য যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, সেই অপরাধী সে নিজেই। তাই যতদিন অরণ্যে থাকে বিদুর, কুন্তীসান্নিধ্যে থাকবার চেষ্টা করে। প্রাতরাশ সেরেই দাদা পাণ্ডু বেরিয়ে পড়েন মৃগয়ায়, ফেরেন সেই দ্বিপ্রহরে। এই সময়টায় কুন্তীর সঙ্গে সঙ্গে থাকে বিদুর।
মাদ্রীর বয়স কম। জীবনজটিলতা তাঁকে এখনো তেমন করে স্পর্শ করেনি। দিনের অধিকাংশ সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মাদ্রী। সাজগোছের দিকে তাঁর বড় ঝোঁক। হস্তিনাপুর থেকে প্রেরিত প্রসাধনে সজ্জিত হতে হতে তাঁর সময় কেটে যায়।
একটা সময়ে মৃগয়া আর ভালো লাগল না পাণ্ডুর। অদ্ভুত এক অবসাদ তাঁকে পেয়ে বসল। তিনি আর মৃগয়ায় বের হন না। অলসপায়ে কল্লোলিনী স্রোতস্বিনীর পাশ দিয়ে, শরবন পেরিয়ে সবুজ বনের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান রাজা। তীর-ধনুক ভবনেই পড়ে থাকে। এগোতে এগোতে ক্লান্তি তাঁর দেহ ঘিরে ধরে। বিশাল এক অশ্বত্থের ছায়ায় বসে পড়েন তিনি। বৃক্ষকাণ্ডে হেলান দিয়ে নিস্পৃহ চোখে সামনের দিকে চেয়ে থাকেন। যূথবদ্ধ হরিণের দল তাঁর সম্মুখ দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যায়। পাণ্ডু নিজের মধ্যে এদের হত্যা করবার কোনো তাগিদ অনুভব করেন না।
কিছুদিন অভাবনীয় উল্লাসের পর রাজার এই অবসাদগ্রস্ততা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন কুন্তী। কী হলো রাজার! স্বর্ণসিংহাসন ছেড়ে অরণ্যবাস বেছে নিলেন! মৃগয়া ছেড়ে ভূমিতলে ধুলোর আসনে বসলেন!
নিজের যৌন-অসামর্থ্যের কথা বাদ দিয়ে আরেকটি চিন্তা পাণ্ডুকে পেয়ে বসল। এতটা দিন কেটে গেল, কই দাদা ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তো করছেন না! পিতামহ ভীষ্ম নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন ঠিকই, বিদুর মাঝেমধ্যে খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে আসছে—তাও ঠিক, জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্র তো তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি! এতটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল, দাদার দিক থেকে তো কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেন না রাজা!
তাহলে কি ধৃতরাষ্ট্র নবলব্ধ শাসনক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন? রাজ্যলোলুপতা তাঁর হিতাহিত বিবেচনা শক্তিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে? তাহলে কি পাণ্ডুর অরণ্য বসবাস যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই ধৃতরাষ্ট্রের লাভ?
অভিমান পাণ্ডুকে কুরে কুরে খেতে লাগল।
.
এবার খাদ্যসামগ্রী আর বিলাসদ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য পুষ্কর নামের এক দূত এলো। তার কাছেই পাণ্ডু সংবাদটা শুনলেন। পিতামহ ভীষ্ম উদ্যোগী হয়ে বিদুরের বিয়ে দিয়েছেন। দেবকরাজার শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভে জাত এক সুন্দরী কন্যার সঙ্গে ছোট ভাই বিদুরের বিয়ে হয়েছে।
বেদনায় আর অপমানে চুরচুর হলেন রাজা পাণ্ডু। তাঁকে ছাড়া রাজপরিবারে বিয়ে!
এই রাজ্য তো তাঁর! তাঁর অনুমতি ছাড়া পিতামহ বিয়ে দিলেন বিদুরের! তাঁর হঠাৎ মনে হলো, পিতামহ এত বড় ভুল করতে পারেন না। নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। বাধা দিয়েছেন দাদা ধৃতরাষ্ট্র। বলেছেন, এখন পাণ্ডুকে ব্যস্ত করে তোলার কী প্রয়োজন পিতামহ? অরণ্যেই তো সুখে আছে পাণ্ডু! হস্তিনাতে ফিরে এলে বিদুরের বউকে তো দেখতেই পাবে! এখন তাকে বিদুরের বিয়ের সংবাদ জানানোর দরকার নেই। পিতামহ ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের কথা ফেলতে পারেননি যথাসম্ভব। তাই তাঁর প্রতি এরকম অবহেলা। হতাশায় পাণ্ডুর মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। ব্যাপারটা স্ত্রীদের বললেন না তিনি। নিজে গুমরে মরতে লাগলেন।
এই সময় পাণ্ডুর কাছে আরেকটি সংবাদ এলো হস্তিনাপুর থেকে—ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারী গর্ভবতী। এই সংবাদটি পাণ্ডুকে ভীষণ বিচলিত করে তুলল। তাঁর পুত্রসন্তান চাই। ধৃতরাষ্ট্রের আগেই তাঁর পুত্রলাভ চাই। নইলে যে রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারিত্ব দাদার পুত্রের হাতে চলে যাবে!
পাণ্ডু ঠিক করলেন, পত্নীদের ক্ষেত্রজপুত্র উৎপাদনের জন্য অনুরোধ করবেন। সন্তান উৎপাদনে নিজে অক্ষম হলে কী হবে পত্নীরা তো উর্বরা!
কিন্তু ভাবা যত সহজ, পত্নীদের ক্ষেত্রজ পুত্রলাভের জন্য বলা তত সহজ নয়। বেশ কদিন ভাবলেন রাজা। মনকে বোঝালেন, নিজের সন্তান না হলে অসুবিধা কোথায়? দাদার সন্তান তো জন্মাচ্ছে! তারাও তো কুরুবংশের! তারা না হয় হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসবে!
মন রে রে করে উঠল, এসব কী বলছ পাণ্ডু! তোমার বংশপ্রবাহ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই ভূ-ভারত থেকে! ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র-পৌত্ররা রাজত্ব করবে হস্তিনাপুরে! না না, তা হতে দেওয়া যায় না! তুমি তো বেঁচে আছ এখনো! তোমার বুদ্ধি-বিবেচনা আছে! সমাজের নিয়ম-প্রথা মেনে তোমার স্ত্রীদের গর্ভে ক্ষেত্রজপুত্র জন্মাও। তাতে তোমার বংশধারা অক্ষুণ্ণ থাকবে। সিংহাসনে বসবে তোমারই পুত্ররা।
পাণ্ডু মনের কথা শুনলেন।
একদিন কুন্তীকে ডাকলেন। মাদ্রী তখন সাজগোছে অন্য কক্ষে ব্যস্ত।
পাণ্ডু ব্যথাতুর কণ্ঠে নিজের অক্ষমতার কথা কুন্তীকে বললেন। এতে কুন্তীর মধ্যে ভাবান্তর হলো না। এই কথাটি আগে বহুবার স্বামীর মুখে শুনেছেন রানি।
কুন্তীর নিস্পৃহতা রাজাও লক্ষ্য করলেন।
রাজা বললেন, ‘তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়া হয়নি রানি।’
রানি চোখ তুলে তাকালেন।
‘বউঠান গান্ধারী গর্ভবতী হয়েছেন।’ অস্থির কণ্ঠে বললেন পাণ্ডু।
ভীষণ চমকালেন কুন্তী। শ্বাস বন্ধ করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
রাজা কাতর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘আমি শেষ হয়ে গেলাম রানি! এই পৃথিবী থেকে পাণ্ডুর বংশধারা বিলুপ্ত হয়ে গেল! দাদার পুত্র-পৌত্ররাই এখন রাজসিংহাসনে বসবে!’
অশ্রুপাত করতে থাকলেন রাজা।
রাজার ঈর্ষা আর ভয় কুন্তীর মধ্যেও সংক্রমিত হলো।
ত্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এই সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো উপায় কি নেই আর্য?’
‘আছে।’ গভীর উৎসাহে বললেন পাণ্ডু।
তারপর রাজা শাস্ত্রে কত রকমের পুত্র পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়, কুন্তীকে বললেন। উত্তরাধিকারিত্বের আইনকানুনগুলো বিশদে বর্ণনা করলেন কুন্তীর কাছে। এর পর শারদণ্ডায়নী নামের এক ব্রাহ্মণীর কাহিনি বললেন কুন্তীকে। সেই ব্রাহ্মণী স্বামীর বংশরক্ষার জন্য ক্ষেত্রজপুত্র উৎপাদন করেছিল—এই কথাটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বোঝালেন রাজা।
তারপর রাজা কুন্তীর হাত ধরলেন। ধুম করে বললেন, ‘তুমিও ক্ষেত্রজপুত্র উৎপাদন করো কুন্তী।
কুন্তী রাজার মুষ্টিবন্ধন থেকে চট করে নিজের হাতটি টেনে নিলেন। বিস্মিত চোখে বললেন, ‘ক্ষেত্রজপুত্র উৎপাদন করব! আমি!’
‘হ্যাঁ রানি, তুমি। তুমিই কেবল পারো এই ভারতবর্ষে আমার বংশপ্রবাহকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখো কুন্তী, বাঁচিয়ে রাখো।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠলেন রাজা।
স্থবির হয়ে কুন্তী পাণ্ডুর পাশে বসে থাকলেন।
রাজা নিজেকে সংযত করলেন।
এর পরে দুজনের মধ্যে আরও কথা হলো। কুন্তী অন্যপুরুষে দেহ দিতে রাজি হলেন না। নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে স্বামীকে বোঝাতে চাইলেন তিনি। পাণ্ডুও পাল্টা যুক্তি দিলেন, নানা কাহিনি শোনালেন। শেষে নিজের জন্মবৃত্তান্ত কুন্তীর কাছে খুলেমেলে ধরলেন।
শেষমেশ কুন্তী সম্মত হলেন।
রাজা বললেন, ‘পুরুষ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমি তোমাকে দিলাম রানি।’
রানি কুন্তী দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে বিদুরকে বেছে নিই?’
চমকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন পাণ্ডু। দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন।
মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘আমার আপত্তি নেই।’
ষোলো
কুন্তীর গর্ভে একে একে তিনটি পুত্র জন্মাল—যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুন। তিন পুত্রকে পেয়ে পাণ্ডুর আনন্দের সীমা থাকল না।
ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারীর যথাসময়ে প্রসব হলো না। ফলে যুধিষ্ঠিরই হলো জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র। গান্ধারী পরে একশ একটি সন্তানের জননী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একশজন পুত্র ও একটি কন্যা। কন্যাটির নাম দুঃশলা। ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্রের নাম দুর্যোধন।
পাণ্ডুর কী হলো কে জানে, চতুর্থ পুত্রের আবদার করে বসলেন কুন্তীর কাছে। কুন্তীর এসব আর ভালো লাগছিল না। বারবার তাঁর প্রথম পুত্রটির কথা মনে পড়তে লাগল। কর্ণই তো তাঁর প্রথম পুত্র, প্রথম পার্থ সে! সে হিসেবে তিনি তো চতুর্থ সন্তান প্রসব করে ফেলেছেন। অর্জুনই তো তাঁর চতুর্থ পুত্র! নাহ্! আর না! সন্তান উৎপাদনে বিরক্তি ধরে গেছে কুন্তীর। রাজার অনুরোধে তাই অপ্রসন্ন হলেন কুন্তী।
বিবাগী কণ্ঠে বললেন, ‘ওসব আর ভালো লাগছে না আর্য। যারা জন্মেছে, তাদের মানুষ করবার চেষ্টা করুন।’
রাজা কুন্তীর অসন্তুষ্টি বুঝতে পারলেন। কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে রানির পাশ থেকে সরে গেলেন। রাজাকে একা পাওয়ার জন্য মাদ্রী বহুদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আজ রাজা ম্রিয়মাণ মুখে বনের দিকে যাচ্ছেন দেখে পিছু নিলেন মাদ্ৰী।
রাজা স্রোতস্বিনীর কিনারায় গিয়ে থামলেন। একটা গাছের নিচে বসে পড়লেন পাণ্ডু। সামনে ক্ষীণকায়া জলধারাটি আপনমনে বয়ে যাচ্ছে। পাড়ের বৃক্ষসকলের দীর্ঘছায়া জলের ওপর কারুকাজ তৈরি করছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে। এখন অপরাহ্।
মৃদু পায়ে রাজার কাছে এগিয়ে এলেন মাদ্রী। পাণ্ডু খেয়াল করলেন না। উদাসভঙ্গিতে কী যেন ভেবে যাচ্ছেন তিনি! মাদ্রী ইচ্ছে করে হাত দুটো জোরে জোরে নাড়লেন। রিনিঝিনি করে কঙ্কণ বেজে উঠল
সংবিতে ফিরলেন রাজা।
অস্ফুটে বললেন, ‘মাদ্রী, তুমি! এখানে! এই সময়ে!’
মাদ্রী চঞ্চল প্রকৃতির। কোনো দুঃখ সহজে তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
উচ্ছ্বাসভরা গলায় বললেন, হ্যাঁ আমি। কেন আমি কি আসতে পারি না আপনার কাছে? আপনার সঙ্গ পেতে পারি না আমি? এসে কি ভুল করলাম মহারাজ?’
মাদ্রীর মুখে একনাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন শুনে ভেবাচেকা খেয়ে গেলেন রাজা। কৌতুকী চোখে মাদ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
ওই সময় ঝরনার মতো অস্থির কণ্ঠে মাদ্রী আবার বললেন, ‘কিছু বলছেন না যে আর্য? এসে ভুল করলাম আমি!’
‘না না, ভুল করবে কেন? ঠিক কাজই করেছ তুমি।’ স্বগত কণ্ঠে বললেন রাজা, ‘এই সময় আমার কথা বলার সঙ্গীর প্রয়োজন রানি। কুন্তীর কথায় মনটি আমার খুব খারাপ হয়ে গেছে। কষ্ট দূর করার জন্য একজনকে খুব দরকার আমার। তুমি এসে আমার সেই দরকার মিটালে।
রাজার স্বগত কথাগুলো মাদ্রী শুনতে পেলেন না। চঞ্চল কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে আপনার পাশে বসি একটু।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। বসো না! বসো।’ আদুরে গলায় বললেন পাণ্ডু।
মাদ্রী রাজার পাশে বসলেন। কোনো কথা বললেন না। তাঁর মনে হলো, কোনো কারণে আর্যের মন খারাপ। কিন্তু কেন মন খারাপ বুঝতে পারলেন না। দিদি কুন্তীর পাশ থেকেই তো উঠে আসতে দেখলেন রাজাকে! তাহলে দিদির সঙ্গে কি রাজার মনোমালিন্য হয়েছে? বিয়ের পর থেকে মাদ্রী দেখে আসছেন, রাজা গম্ভীর প্রকৃতির। অনেকটাই অন্তর্মুখী। কথা বলেন কম। নিজের কষ্ট অন্যকে বুঝতে দেন না। আজও মাদ্রী খেয়াল করলেন, রাজা কিছু একটা লুকাতে চাইছেন তাঁর কাছ থেকে। গভীর কোনো বেদনা নয়তো? দিদির কারণে কষ্টটা পাননি তো রাজা? দিদিরও দোষ দিয়ে লাভ কী? অল্প সময়ের মধ্যে তিন-তিনটে পুত্রের জননী হয়েছেন দিদি। বড় যুধিষ্ঠির শান্তশিষ্ট হলেও ভীমটা উড়নচণ্ডী ধরনের। কথা শুনতে চায় না। ছোট ভাই অর্জুন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে অর্জুনের ওপরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ভীমটা। এ নিয়ে দিদির অশান্তির অন্ত নেই। গোটাটা দিন মহাব্যতিব্যস্ততার মধ্যে কাটে দিদির। ওই খিচড়ে মন নিয়েই রাজার সঙ্গে দিদি বোধহয় কথা বলেছেন! দিদির কথা হয়তো রাজার মন খারাপ করে দিয়েছে। না, এই সময় কথা বলা ঠিক হবে না। চুপচাপ রাজার পাশে বসে থাকা শ্রেয়। যদি কথা বলতে হয়, রাজাই বলবেন।
চারদিকে বনবনানীর নিস্তব্ধতা। অরণ্য থেকে যে কী গভীর শব্দ উত্থিত হয়, তা একমাত্র প্রকৃতিপ্রেমীই জানে! পাণ্ডুর অন্তরজুড়ে অগাধ প্রকৃতিপ্রেম। তিনি এখন গাছের কোটরে পক্ষীছানার শব্দ শুনছেন, আকাশ বেয়ে উড়ে যাওয়া বিহঙ্গদের পাখার শব্দ শুনছেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাদ্রীর কথা মনে পড়ল পাণ্ডুর। তাঁর খেয়াল হলো, পাশে দীর্ঘক্ষণ তাঁর দ্বিতীয় পত্নী বসে আছেন। মাদ্রীকে পছন্দ করেন রাজা। মাদ্রী একটু চঞ্চল বটে, কিন্তু পাণ্ডুপত্নী হওয়ার সকল গুণ তাঁর মধ্যে আছে।
মাদ্রীর দিকে চোখ ফেরালেন রাজা। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবে মাদ্রী?’
‘না না। হ্যাঁ। না।’ ধরাপড়া কণ্ঠে বললেন মাদ্রী।
এবার মৃদু হাসলেন পাণ্ডু, ‘কী হ্যাঁ, না, হ্যাঁ করছ মাদ্রী! আমি তো তোমার চোখমুখ দেখেই
বুঝতে পারছি, কিছু একটা বলতেই এসেছ আমার পিছু পিছু!’
‘আপনি চোখমুখ দেখে মনের কথা বুঝতে পারেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ পারি তো!’
খলবল করে হেসে উঠে মাদ্রী বললেন, ‘তাহলে আমায় দেখে বলেন তো কী কথা বলতে চাই আমি আপনাকে?’
শিশুসুলভ চঞ্চলতার জন্যই পাণ্ডু মাদ্রীকে পছন্দ করেন। যেকোনো কথায় হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়েন মাদ্রী। কোনো দুঃখ, কোনো গাম্ভীর্য তাঁকে ছুঁতে পারে না। কুন্তী একটু বেশি কেজো। সারাক্ষণ কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর!
‘তোমার মনে বড় দুঃখ। বোঝানোর লোক নেই। আমাকে পেয়ে গেলে। ঠিক করলে আমাকেই বোঝাবে।’ আন্দাজে বললেন রাজা।
রাজার কথা শুনে আচমকা গম্ভীর হয়ে গেলেন মাদ্রী।
রাজা ভয় পেয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে বড় রানির সঙ্গে মতান্তর হয়েছে, এখন আবার ছোট রানিকে কষ্ট দিলেন না তো!
আস্তে করে মাদ্রীর হাত দুটো নিজের করতলে টেনে নিলেন রাজা। কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমায় কষ্ট দিলাম না তো মাদ্রী?’
মাদ্রীর চোখে জল তখন টলমল করছে। মোছার কোনো চেষ্টা করলেন না মাদ্রী। ওই অবস্থাতেই বললেন, ‘আর্য, আপনি কী করে বুঝলেন, আমার বুকের তলায় কষ্টের মস্তবড় শিলাখণ্ড অবিরাম গড়গড় করছে?’
চমকে মাদ্রীর দিকে তাকালেন রাজা। তিনি তো এমনি এমনি বলেছেন কথাটা! এর পেছনে কোনো দৈবশক্তি কাজ করেনি মোটেই। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো করে আন্দাজে কথাটি বলেছেন তিনি। কথাটি যে মাদ্রীর মনে ধরে যাবে, ভাবেননি পাণ্ডু। একটু অভিনয়ের আশ্রয় নিলেন রাজা।
বললেন, ‘দীর্ঘদিন তুমি আমার সঙ্গে আছ মাদ্রী, স্বামী আমি তোমার। স্বামী হয়ে তোমার মনের কথা বুঝতে পারব না?’
উত্তেজিত হয়ে মাদ্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে বলুন তো আর্য, আমার মনের দুঃখটা কী?’
তটস্থ হলেন রাজা। কী মুশকিল, কথা একটা বলে তাঁর তো ফেঁসে যাওয়ার অবস্থা হলো! নাহ্, যেকোনো প্রকারে এখান থেকে বেরোতে হবে।
কণ্ঠে দরদ ঢেলে পাণ্ডু বললেন, ‘তোমার কষ্টের কথাটি তুমিই বলো প্রিয়ে। কথা দিচ্ছি, যেকোনো মূল্যে তোমার সেই কষ্ট দূর করব আমি।’
স্বামীর কথা শুনে মাদ্রীর চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ‘দিদির মতো আমাকেও পুত্রবতী করুন আর্য।’ বাৎসল্যে মাদ্রীর কণ্ঠস্বর সিক্ত।
পাণ্ডুর ফরসা মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন তিনি।
অনেকক্ষণ পরে ম্লান কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি তো জানো মাদ্রী, সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা আমার নেই!’
‘জানি আর্য। আর এও জানি দিদির পুত্ররা ক্ষেত্রজ। আপনি আমাকে যতই চঞ্চল আর হালকা মেজাজের ভাবুন, বুদ্ধিহীন নই একেবারে আমি। আমি সব জানি।’
‘কী জানো?’
‘যুধিষ্ঠিররা যে বিদুর ঠাকুরপোর ক্ষেত্রজপুত্র, জানতে বাকি নেই আমার।’
‘আমার আর কোনো উপায় ছিল না মাদ্রী! বংশরক্ষার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম!’
‘দিদি কুন্তীর কোনো আগ্রহ ছিল না?’
‘আগ্রহ? হ্যাঁ, কুন্তীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল শেষের দিকে। প্রথমদিকে সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না।’
‘শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। কোলজুড়ে সন্তানরা এলো তাঁর।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন মাদ্রী। ‘তুমি ঠিক বলছ মাদ্রী। কুন্তী খুব আনন্দিত হয়েছিল, যুধিষ্ঠির-ভীম-অৰ্জুন জন্মানোয়।’
মাদ্রী মাথা নামিয়ে নিচু স্বরে বললেন, ‘কুন্তী দিদির মতো আমারও আনন্দিত হতে ইচ্ছে করে না আর্য? আমারও কি মন চায় না আমার কোলজুড়ে চাঁদের মতো ফুটফুটে সন্তান আসুক? আমার কি সেই অধিকার নেই রাজা?’
রাজা কোমল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই, তোমারও সেই অধিকার আছে রানি। বলো তুমি কী চাও?’
কণ্ঠস্বরে কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে মাদ্রী বললেন, ‘দিদির মতো করে সন্তান ধারণের অনুমতি দিন আমায়। আমি বড় বুভুক্ষু রাজা। মা ডাক শুনবার জন্য ভিখারিনি হতে রাজি আমি।’
রাজা মাদ্রীর মুখ চেপে ধরলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ছি ছি রানি, ওভাবে বলো না। তুমিও কুন্তীর মতো ক্ষেত্রজপুত্রের মা হও—অনুমতি দিলাম আমি।’
‘কিন্তু কার কাছে যাব আমি? নিশ্চয়ই বিদুর ঠাকুরপোর কাছে যেতে বলবেন না আমায়?’
‘দেখো মাদ্রী, এই অরণ্যে শুধু আমরা বাস করি না। আরও অনেকে বাস করে। তুমি এরই মধ্যে বনচারীদের দেখেছ। ওদের কাউকে যদি…।’ বলে থেমে গেলেন পাণ্ডু।
যা বোঝার মাদ্রী বুঝে নিলেন।
সময়ান্তরে মাদ্রীও পুত্র লাভ করলেন—দুজন। নকুল ও সহদেব।
এখন পাণ্ডুর পুত্র পাঁচজন— যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব।
পঞ্চপাণ্ডব তারা।
পাঁচটি পুত্র লাভ করে পাণ্ডু নিজেকে কৃতার্থ মনে করলেন।
.
ছেলেরা ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করল। কিন্তু পাণ্ডুর মধ্যে হস্তিনাপুর ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। শতশৃঙ্গ হিমালয় রাজার কাছে হস্তিনাপুরের চেয়েও মোহনীয় বলে মনে হলো।
পুত্র আর স্ত্রীদের সান্নিধ্য রাজাকে পুলকিত করে তুলল। শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো। তাঁর দুগ্ধধবল শরীরে এখন স্ফূর্তির দ্যুতি।
প্রকৃতিতে বসন্ত এলো। বনভূমি নবরূপে সজ্জিত হয়ে উঠল। বসন্তস্পর্শে পশু ও পক্ষীকুলের মধ্যে দেহতৃষ্ণা তীব্র হলো।
পাণ্ডুর মধ্যেও প্রবল এক অস্থিরতা জাগল। এ অস্থিরতার অপর নাম দেহসান্নিধ্যকামনা। খোলা চোখে স্ত্রীদের দিকে তাকালেন পাণ্ডু। দেখলেন, কুন্তীর সারা শরীর বস্ত্রাবৃত। তাঁর চোখমুখ সন্ন্যাসিনীর মতো উদাসীন। কুন্তীর তুলনায় মাদ্রী অনেক খোলামেলা। তাঁর মধ্যে বাঁধনছেঁড়া আবেগ। স্বল্পবসনের শরীরটি যৌবনালোয় উদ্ভাসিত। এরকম নারীশরীর কোন পুরুষই-বা এড়াতে পারে? পাণ্ডুও পারলেন না। মাদ্রীকে কামনা করলেন রাজা।
মাদ্রী রাজি হলেন।
কুন্তীর দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলেন দুজনে। দুটো শরীর বহুদিনের ভূষিত। উপবাসী দুটো দেহ একদেহে লীন হওয়ার প্রচেষ্টায় মগ্ন হলো। নিখিল বিশ্বসংসার দুজনের কাছে অলীক বলে মনে হতে লাগল তখন।
রমণক্রীড়া পরিশ্রমসাধ্য। কাঙ্ক্ষিত ভঙ্গিতেই মিলন অগ্রগতি পেতে থাকল। মাদ্রীর দেহে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইলেন পাণ্ডু। তাঁর রমণপ্রচেষ্টা চরমে উঠল।
আচমকা বুকে ব্যথা অনুভব করতে থাকলেন রাজা। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইল। বাহির থেকে বুক ভরে বাতাস টেনে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন রাজা। পারলেন না। প্রচণ্ড খিঁচুনি উঠল শরীরে।
মাদ্রীর দেহবিচ্যুত পাণ্ডুর শরীরটি হঠাৎ নিথর হয়ে গেল।
মাদ্রীর বুকফাটা আর্তনাদ হিমালয়ের আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল।
নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হতে লাগল মাদ্রীর। মনে করলেন, রাজার মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। আত্মঘাতী হলেন মাদ্রী।
মৃত স্বামী ও সপত্নীর শব নিয়ে পাঁচ পুত্রের হাত ধরে হস্তিনাপুর পৌঁছলেন কুন্তী।
হিমালয়ের মুনিঋষিরা তাঁদের সঙ্গে এলেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের সাক্ষ্য জরুরি।
অম্বালিকা, সত্যবতী প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
প্রজারা শোকস্তব্ধ হলো।
প্রজাদরদি রাজা ছিলেন পাণ্ডু। রাজোচিত মর্যাদায় পাণ্ডুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলো।
হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে কুন্তী এবং পঞ্চপাণ্ডবের জীবনের অন্য একটি অধ্যায় শুরু হলো।
সতেরো
কুন্তী আর পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে তেমন সাদরে সম্ভাসিত হলেন না।
ধৃতরাষ্ট্র, মন্ত্রী-অমাত্য, সেনাপতি, বনেদি হস্তিনাপুরবাসী এমনকি সাধারণ প্রজাদের মনে এই প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠল, কুন্তীর সঙ্গে আগত পাঁচ কিশোর, এরা কারা? কুন্তী বলছেন বটে, এরা মহারাজ পাণ্ডুর পুত্র, কিন্তু তাঁর এই কথায় সত্যতা কতটুকু?
প্রথমে ফিসফাস, তারপর গুঞ্জন। পাণ্ডুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর রাজসভাতেই প্রশ্নটা উচ্চারিত হলো, এই পঞ্চপুত্র কে? তাদের প্রকৃত পরিচয় কী? তারা যে মহারাজ পাণ্ডুর সন্তান, প্রমাণ কী? সভার গুরুত্বপূর্ণ এক অমাত্য কথাটা উত্থাপন করলেন।
হিমালয় থেকে পাণ্ডুর মৃতদেহের সঙ্গে আগত ঋষিরা তখনো প্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সমস্বরে বললেন, ‘বেদের দোহাই দিয়ে বলছি আমরা, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, দিব্যকান্তির এই পাঁচটি পুত্রই মহারাজ পাণ্ডুর। এদের জননী কুন্তী এবং মাদ্রী। আমাদের চোখের সামনেই বড় হয়ে উঠেছে এরা।’
ঋষিদের কথা শুনে সবাই চুপ করে গেলেন। এঁদের কথা তো কখনো মিথ্যে হতে পারে না! কিন্তু যাঁরা জানেন, পাণ্ডুর সন্তান-জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, তাঁরা উশখুশ করতে থাকলেন। রাজপ্রাসাদের এই গূঢ় তথ্যটি দু-তিনজন ছাড়া খুব বেশি মানুষ জানতেন না। বিদুর জানত, পিতামহ জানতেন, পিতামহী সত্যবতী আংশিক জানতেন। আর জানতেন রাজকবিরাজ। রাজকবিরাজ গত হয়েছেন অনেকদিন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা সবাই কুন্তী-পাণ্ডবের হিতাকাঙ্ক্ষী। তাঁরা ঘটনাটা চেপে গেলেন।
বিদুর স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে বোঝা গেল, প্রশ্নটা অহেতুক। মহাত্মা মুনিঋষিরা বললেন, এরা পাণ্ডুপুত্র। তো ওরা পাণ্ডুপুত্রই।’
ভীষ্ম বললেন, ‘আমার বক্তব্যও তা-ই। ওদের জন্মকথা নিয়ে এই রাজসভায়, এমনকি এই রাজ্যে যাতে আর কোনোদিন কোনো কথা না ওঠে—এটা আমার নির্দেশ।
ধৃতরাষ্ট্র কিছু একটা বলবার জন্য ব্যগ্র হলেন। কিছু বলবার আগেই তাঁর কানে এলো, ‘সাধু, সাধু। আপনার আদেশকে আমরা সবাই সম্মান জানাব পিতামহ।
সভাসদরের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে থেমে গেলেন ধৃতরাষ্ট্র। বলশালী হাত দুটো দিয়ে সিংহাসনের দুই হাতল চেপে ধরলেন।
.
বিদুরের আপ্রাণ প্রচেষ্টায়, ভীষ্ম ও সত্যবতীর প্রবল সমর্থনে রাজপ্রাসাদে ঠাঁই পেলেন কুন্তী আর তাঁর পাঁচ পুত্র। তবে রাজান্তঃপুরে নয়। প্রাসাদের উজ্জ্বল অংশটি বহু আগেই ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর আবাসস্থল হয়ে গেছে। কুন্তীরা স্থান পেলেন প্রাসাদের অনুজ্জ্বল একটি অংশে।
রাজপ্রাসাদের জৌলুসময় অংশে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র বড় হয়ে উঠছে। ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরের রাজা এখন। যদিও নৃপতি হিসেবে তাঁকে ঘোষণা করা হয়নি। তবে কে না জানে আর মানে, কুরুকুলের প্রধান নরপতি এখন ধৃতরাষ্ট্র। সুতরাং তাঁর পুত্ররা সম্পূর্ণ রাজকীয় আড়ম্বরে লালিতপালিত হতে লাগল।
ধৃতরাষ্ট্রের বড় আশা ছিল, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রই হস্তিনাপুরের যুবরাজ হবে। যুবরাজ হওয়ার প্রথম এবং প্রধান শর্ত খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইদের মধ্যে সর্বাগ্রে জন্মাতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ধৃতরাষ্ট্রের, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের পরে জন্মেছে।
কুন্তীর বেশ আগে গান্ধারী গর্ভবতী হয়েছিলেন, কিন্তু গান্ধারীর গর্ভ আটকে গিয়েছিল। চব্বিশ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও গান্ধারীর প্রসববেদনা ওঠেনি। রাগে-ক্ষোভে নিজের উদরে আঘাত করেছেন গান্ধারী। আঘাতে জঠর থেকে সন্তানের বদলে মাংসপিণ্ড বেরিয়ে এসেছে। ব্যাসদেবের পরামর্শে পিণ্ডটি একশ এক ভাগ করে আলাদা আলাদা ঘৃতপূর্ণ কলসিতে রাখা হয়েছে। এক বছর পর কলসিতে দুর্যোধন জন্মাল। এর পরপর দুঃশাসন, দুঃসহ প্রভৃতি নিরানব্বইজন পুত্রের এবং দুঃশলা নামের একটি কন্যার জন্ম হলো। এই ঘটনায় দুর্যোধনের জন্ম হতে বিলম্ব হয়ে গেল। তার আগেই যুধিষ্ঠির জন্মে গিয়েছিল।
জ্যেষ্ঠতার নিরিখে যুধিষ্ঠিরই কুরুরাজবংশের যুবরাজ হওয়ার কথা। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মনে ভিন্ন চিন্তা। তিনি চান—দুর্যোধনই যুবরাজ হোক। কারণ যুবরাজই পরবর্তীকালে কুরুসিংহাসনে বসবে। বাসনাটা নিজের মধ্যে চেপে রাখেন ধৃতরাষ্ট্র। ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। ভবিষ্যৎ হয়তো তাঁর জন্য সুফল বয়ে আনবে।
ধৃতরাষ্ট্রপুত্র আর পাণ্ডুপুত্ররা হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে বড় হয়ে উঠতে লাগল। ভীষ্ম ভাবলেন, এদের অস্ত্রশিক্ষাপাঠশালায় পাঠানোর বয়স হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ করা প্রয়োজন। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ না করে পৌত্রদের অস্ত্রবিদ্যালয়ে পাঠান কী করে পিতামহ ভীষ্ম?
ধৃতরাষ্ট্রের সামনে কথাটা পাড়লেন পিতামহ। শুনে ধৃতরাষ্ট্র উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।
বললেন, ‘এ তো উত্তম প্রস্তাব পিতামহ! দুর্যোধনরা বড় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়ে গেছে তাদের। কুলপণ্ডিতের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তা। পুত্রদের শরীর শক্ত- সমর্থ হয়ে উঠেছে এখন। রণবিদ্যা আয়ত্ত করবার সময় হয়ে গেছে দুর্যোধনদের।’
পিতামহ বললেন, ‘তুমি শুধু দুর্যোধন-দুঃশাসনদের কথা ভাবছ কেন? এদের সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডুপুত্রদের কথাও কেন বলছ না? এরাও তো এই বংশের সন্তান!’
বিদ্ঘুটে কিছু একটা বলবার জন্য মুখটা চুলবুল করে উঠল ধৃতরাষ্ট্রের। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সামলালেন। বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, ‘পাণ্ডবরা এ প্রাসাদে থাকছে যখন, ওরাও দুর্যোধনদের সঙ্গে অস্ত্রপাঠশালায় যাবে। এ ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই।’
পিতামহ ধৃতরাষ্ট্রের মনোভাব স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। প্রাজ্ঞ মানুষ তিনি। এখন এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে গেলে ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নেবে। রাজসিংহাসনে ধৃতরাষ্ট্র এখন। তাঁকে চটানো যাবে না।
ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে প্রফুল্ল হওয়ার ভান করলেন ভীষ্ম। খুশি খুশি মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কোন অস্ত্রগুরুর কাছে পাঠাতে চাও কুরুপুত্র আর পাণ্ডুপুত্রদের?’
‘এই মুহূর্তে কৃপাচার্য ছাড়া আর কারো কথা তো মনে আসছে না পিতামহ!’
‘তুমি ঠিক নামটি ভেবেছ ধৃতরাষ্ট্র। কৃপাচার্য দক্ষ ধনুর্ধর। অস্ত্রবিদ্যা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অগাধ। আপাতত তাঁর কাছেই পাঠানো যাক ওদের।’
চোখ বড় করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘আপাতত বলছেন কেন পিতামহ!
কণ্ঠকে খাদে নামিয়ে ভীষ্ম বললেন, ‘কৃপাচার্য দক্ষ অস্ত্রবিদ, মানি। কিন্তু এই বংশের সন্তানদের শুধু কৃপাচার্যের বিদ্যা দিয়ে চলবে না। তাঁর চেয়ে আরও অধিক রণবিদ্যা অর্জন করতে হবে কুরুপাণ্ডবদের।’
‘আরও অধিক রণবিদ্যা অর্জন করতে হবে!’
‘হ্যাঁ ধৃতরাষ্ট্র, কৃপাচার্যের চেয়েও নিপুণ কোনো রণকৌশলী খুঁজে নিতে হবে আমাদের। যার ছত্রছায়ায় আমার বংশের সন্তানদের প্রত্যেকে যেন এক একজন পরশুরাম হয়ে ওঠে।’ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল পিতামহের।
‘কোথায় পাব এমন দক্ষ অস্ত্রবিদ্?’ বললেন ধৃতরাষ্ট্র।
‘অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। হয়তো একদিন সেরকম রণকৌশলী ধনুর্ধর আমরা পেয়ে যাব।’
পিতামহের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের মুখমণ্ডল হাসিতে ভরে গেল।
ভীষ্ম আবার বললেন, ‘তাহলে একটা শুভদিন দেখে কৃপাচার্যের কাছে বালকদের পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘ঠিক আছে পিতামহ। তা-ই করুন।’ তৃপ্তির কণ্ঠে বললেন ধৃতরাষ্ট্র।
এক সকালে দুর্যোধন-যুধিষ্ঠিররা কৃপাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায় গিয়ে উপস্থিত হলো। পাঠশালাটি অনেকটাই তপোবনের মতো। বিশাল জায়গাজুড়ে। সমতল ও টিলাময়। নানা গাছে ভর্তি। মাঝখানে বৃত্তাকারে খোলা জায়গা। অস্ত্রশিক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান এটি। এখানে মন্ত্রী- অমাত্যপুত্ররা অস্ত্রবিদ্যা শেখে। হস্তিনাপুরের বনেদি পরিবারের সন্তানরাও আসে এখানে। এর আগে হস্তিনাপুরের কোনো রাজপুত্র এখানে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করতে আসেনি। আজ এলো। তাই পাঠশালাজুড়ে আজ আনন্দ-কোলাহল।
ভারি খুশির দিন আজ কৃপাচার্যের জীবনে। বহুদিন পর ঋণশোধের সুযোগটা এলো। এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন তিনি। এই রাজবংশটির কাছে তাঁর ঋণের অবধি নেই। সেদিন যদি রাজচক্রবর্তী শান্তনু পথিপার্শ্ব থেকে দুই ভাইবোনকে কুড়িয়ে না আনতেন, যদি হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ঠাঁই না দিতেন, তাহলে কোথায় ভেসে যেতেন তাঁরা! মহারাজ শান্তনু শুধু তাঁদের আশ্রয়ই দেননি, লালনপালনের সুব্যবস্থাও করেছেন। কৃপ নামের ছেলেটি যাতে অস্ত্রবিদ হয়ে ওঠে, সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন মহানুভব শান্তনু।
ঋষি শরদ্বান কৃপাচার্যের পিতা। মহর্ষি গৌতমের পুত্র শরদ্বান গভীর তপস্যায় মগ্ন হলে দেবরাজ ইন্দ্র শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। শরদ্বানের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাবার জন্য ইন্দ্র জানপদী নামের এক স্বর্গসুন্দরীকে শরদ্বানের নিকটে পাঠালেন। অপ্সরাটিকে দেখে শরদ্বান কামোত্তেজিত হলেন। তাঁর উত্তেজনা এতই চরমে পৌঁছল যে রমণ ছাড়াই তাঁর বীর্য নির্গত হলো। এই বীর্য নলখাগড়ার ওপর পতিত হলো। শুক্র দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ওখানেই দুজন সন্তানের জন্ম হলো। একটি পুত্র, অন্যটি কন্যা।
ওই সময় কুরুরাজ শান্তনু শরদ্বানের তপোবনের পাশের অরণ্যে মৃগয়ায় রত ছিলেন। তাঁরই এক সৈন্য নলখাগড়ার ঝোপে মানবসন্তান দুটোকে দেখতে পেল। সৈন্যটি মহারাজকে জানালে রাজা উৎসুক হয়ে ওঠেন। শিশুদের দেখে শান্তনুর মধ্যে কৃপার সঞ্চার হয়। কৃপাসিক্ত শান্তনুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘এরা আমারই পুত্রকন্যা। রাজপ্রাসাদে নিয়ে চলো এদের।’
কুরুরাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছিল শিশু দুটোকে। তাদের লালনপালনের ব্যবস্থা করেছিলেন মহারাজ শান্তনু।
রাজার কৃপায় এরা লালিতপালিত হচ্ছে বলে ছেলেটির নাম রাখা হলো কৃপ, আর মেয়েটির নাম রাখা হলো কৃপী।
রাজপ্রাসাদে শিশু দুজন বড় হয়ে উঠতে লাগল।
একদিন ঋষি শরদ্বান রাজভবনে এলেন। কৃপ ও কৃপীকে তাদের গোত্র ও প্রকৃত পরিচয় অবগত করালেন। শরদ্বান ছিলেন মহাধনুর্ধর। তিনি কৃপকে নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে নানা রকম অস্ত্রবিদ্যা, ধনুর্বেদবিদ্যার বিভিন্ন জটিল বিষয় অধ্যয়ন করালেন।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে কৃপ রণনিপুণ যুদ্ধবিদ হয়ে উঠল। শরদ্বান তাকে আচার্যের আসনে বৃত করলেন। ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে কৃপের নাম হলো কৃপাচার্য।
এই কৃপাচার্য কৌরব আর পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্ব পেয়ে কৃতার্থ হলেন।
.
অস্ত্রশিক্ষা শুরু হলো। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কৃপাচার্য দুর্যোধন-যুধিষ্ঠিরদের বিদ্যা দান করতে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর সুখ্যাতি দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ল। বৃষ্ণি বংশীয় রাজপুত্ররা এবং অন্যান্য দেশের রাজকুমাররা কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা লাভ করবার জন্য এলো।
একদিন সকালে কৃপাচার্যের পাঠশালায় এসে উপস্থিত হলো কৰ্ণ।
খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে যে কর্ণের আগমন ঘটেছিল, তা নয়। বরং নীরবেই কর্ণ অস্ত্রপাঠশালায় এসেছিল।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে অধিরথের গভীর সখ্য। রথচালনা পরিত্যাগ করার পরও তাঁদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি কখনো। বরং গাঢ়তর হয়েছে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা আরও সংহত হলে অধিরথকে সপরিবারে হস্তিনায় নিয়ে আসেন ধৃতরাষ্ট্র। যথোপযুক্ত আবাসস্থলের ব্যবস্থা করেন।
রাধার পরামর্শে অধিরথ কৃপাচার্যের পাঠশালায় কর্ণের অধ্যয়নের অনুমতি চাইলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র হৃষ্টচিত্তে অনুমতি প্রদান করেন।
এই রাজানুমতির জোরেই কর্ণ কৃপাচার্যের অস্ত্রপাঠশালা এলো, সঙ্গে মহারাজার সিলমোহর অঙ্কিত পত্ৰ।
কৃপাচার্যের সম্মতিতে কর্ণ শিষ্যদের মধ্যে বসতে গেল। কৌরব আর পাণ্ডুবরা পাশাপাশি আলাদা হয়ে বসেছে। কর্ণ দুর্যোধনের পাশে গিয়েই বসল।
আঠারো
কৃপাচার্য অকৃতদার ছিলেন। ফলে দাম্পত্যজীবনের ঝামেলা-যাতনা তাঁর ছিল না। ছাত্রদের শিক্ষাদানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন কৃপাচার্য।
ধনুর্বিদ্যা, অসিচালনা, গদাসঞ্চালন, অশ্বারোহণ, গজারোহণ, রথচালনা—এসব বিষয়ে কৃপাচার্যের তেজস্বিতা অনেক খ্যাতিমান অস্ত্রবিদকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর অধীনে কুরুকুমাররা অস্ত্রবিদ্যায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠছিল। শুধু তো অস্ত্রচালনা নয়, তার সঙ্গে প্রয়োজন শারীরিক সুগঠন। ছাত্রদের স্বাস্থ্যগঠনের দিকে কড়া নজর ছিল অস্ত্রগুরুর। তাঁর তদারকিতে সকল পাঠার্থীর, বিশেষ করে দুর্যোধন, ভীমের শরীর সুগঠিত হয়ে উঠল। এদের মানসিক গঠনও সুবিন্যস্ত হতে থাকল। ছাত্রদের মধ্যে চারজন তাদের অস্ত্রপটুতার কারণে কৃপাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দুর্যোধন, ভীম, অর্জুন এবং কর্ণ। গদাচালনায় দুর্যোধন-ভীম অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। কর্ণ-অর্জুনের ধনুদক্ষতায় ভীষণ মুগ্ধ হলেন অস্ত্রগুরু।
গভীর চোখে কৃপাচার্য একদিন খেয়াল করলেন, ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে যেন একটা রেষারেষি! দুজনের মধ্যে এই প্রবণতা যে, এ বলে—গদায় আমি শ্রেষ্ঠ, ও বলে—আমি শ্রেষ্ঠ।
তিনি আরও লক্ষ করলেন, কর্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা! দুজনেই ধনুর্বিদ্যায় কৌশলী। ওরাও আচরণে দেখাচ্ছে, আমি তোমার চেয়ে কম কীসে?
বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল কৃপাচার্যের। এদের পারস্পরিক আক্রোশ শেষ পর্যন্ত কোনো অশুভ কিছু বয়ে আনবে না তো! তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে এই দুশ্চিন্তা মন থেকে বের করে দিলেন কৃপাচাৰ্য।
স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভালো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাত্রদের মধ্যে শেখার আগ্রহ তৈরি করে।’
কৃপাচার্য যতই আপ্রাণ চেষ্টা করুন, তাঁর তত্ত্বাবধানে শিষ্যরা যতই পারদর্শিতা অর্জন করুক- পিতামহ ভীষ্মের মন ভরছিল না। তাঁর বারবার মনে হচ্ছিল, কৃপাচার্যের শিক্ষায় কোথায় যেন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে! কৃপের শিক্ষাপদ্ধতি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়! ভীষ্ম চাইছেন—যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতি পৌত্ররা অস্ত্রবিদ্যায় এক-একজন দিকপাল হয়ে উঠুক। তাঁর বিশ্বাস—পৌত্রদের দিকপাল হিসেবে গড়ে তুলবার মতো বিদ্বান ও বুদ্ধিমান কৃপ নন। আর যিনি বিশেষ বুদ্ধিমান নন, দেবতার সমকক্ষ বলবান নন, তিনি কী করে কুরুকুমারদের শিক্ষিত করে তুলবেন? পিতামহ এমন একজন অস্ত্রবিদের সন্ধানে থাকলেন, যিনি কুরুকুমারদের অস্ত্রবিদ্যায় প্রতাপান্বিত করে তুলবেন।
একদিন সেই সুযোগ এসে গেল ভীষ্মের হাতে। তিনি দ্রোণাচার্যের সন্ধান পেয়ে গেলেন।
দ্রোণ ভরদ্বাজ ঋষির পুত্র। ‘দ্রোণ’ মানে শস্য মাপার পাত্র। দ্রোণের জন্মের সঙ্গেও কৃপাচার্যের জন্মের মতো মুনি-ধ্যান-স্বর্গ অপ্সরা-রেতঃস্খলন—এসব জড়িয়ে আছে।
ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম গঙ্গাতীরে। একদিন যজ্ঞ করার আগে সশিষ্য ভরদ্বাজ গেলেন গঙ্গানদীতে, গঙ্গাজলে অবগাহন করে দেহপবিত্র করার মানসে। কাম, ক্রোধ ইত্যাদি ষড়রিপু নাকি মুনিঋষিদের কাবু করতে পারে না কখনো! কিন্তু এটা সত্যি যে একটা রিপুর কাছে বারবার তাঁদের পরাস্ত হতে দেখা যায়। ভরদ্বাজও কামের কাছে পরাজিত ঋষি। ভরদ্বাজ গঙ্গানদীতে গেলেন শরীর পূত করার জন্য, কিন্তু সেখানেই তাঁর অঙ্গ অপবিত্র হয়ে গেল।
গঙ্গাতীরে গিয়ে এক নারীশরীরে ভরদ্বাজের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন, ঘৃতাচী নামের এক স্বর্গসুন্দরী স্নানশেষে বসন পাল্টাচ্ছে। স্বর্গ-অপ্সরারা একটু ঢিলেঢালা স্বভাবের হয়। তাদের বসন হয় মিহি এবং স্বল্প। যৌবন ও লাবণ্য ঢেকে রাখার কোনো চেষ্টা ওদের মধ্যে দেখা যায় না। ঘৃতাচীও তার ব্যতিক্রম নয়। বেশ বদলাবার একটা সময়ে ধমকা হাওয়া বইল। হাওয়া দেহঢাকা বসন সরাল। ঘৃতাচীর নগ্ন শরীরটা ভরদ্বাজ স্পষ্ট দেখতে পেলেন। চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল ঋষির। দেহ আলুথালু। নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না ভরদ্বাজ। রেতঃস্খলন হয়ে গেল তাঁর। মুনিঋষিদের বীর্য আবার ব্যর্থ হওয়ার নয়। ভরদ্বাজবীর্য তখন তখনই একটা দ্রোণে রাখা হলো। সেখানেই এক পুত্রের জন্ম হলো। ‘দ্রোণে’ জন্ম বলে শিশুটির নাম রাখা হলো দ্রোণ। দ্রোণ ভরদ্বাজ-আশ্রমেই লালিত- পালিত-শিক্ষিত হলো। কালক্রমে শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় দ্রোণ স্বসময়ের একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়ে গেলেন। বেদ-বেদান্ত, পুরাণ, ইতিহাসে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ধনুর্বিদ্যায় তিনি অদ্বিতীয়। ব্ৰহ্মাস্ত্র এবং অন্যান্য দিব্যাস্ত্র তাঁর হস্তগত। ছোটবেলা থেকে শাস্ত্রের চেয়ে শস্ত্র তাঁর পছন্দ।
দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজের সঙ্গে পঞ্চালরাজ পৃষতের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সেই কারণে দ্রোণের সঙ্গেও পৃষতপুত্র দ্রুপদের গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। দ্রুপদ ও দ্রোণ অস্ত্রগুরু অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে রণবিদ্যা শিখেছিলেন। একটা সময়ে দুজনে অভিন্নহৃদয় হয়ে উঠেছিলেন।
শিক্ষাশেষে পঞ্চালরাজপ্রাসাদে ফিরে যাওয়ার সময় দ্রুপদ দ্রোণকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘প্রাণের সখা তুমি আমার। আজ তুমি আশ্রমে ফিরে যাবে, আমি যাব রাজপ্রাসাদে। এই ফেরা আমার কাছে অসহনীয় বন্ধু। দুজন একসঙ্গে থেকে জীবনটা কাটাতে পারলে বড় সুখ পেতাম আমি।’ বলে একটুখানি থেমেছিলেন দ্রুপদ।
তারপর কণ্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার পিতার পরে পঞ্চালের রাজা হব আমি। তখন পঞ্চালরাজ্য হবে তোমার আর আমার। সেদিন রাজ্যটিতে সমান অধিকার হবে তোমারও।’
বিদায়ের দিন চোখের জলে বুক ভেসে গিয়েছিল দুজনের।
একদিন মহর্ষি ভরদ্বাজ মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় দ্রোণকে বিয়ে করবার অনুরোধ করে গেলেন।
দীর্ঘকাল তপস্যা ও শস্ত্রবিদ্যাচর্চায় ব্যাপৃত থাকলেন দ্রোণ। একদিন বিয়ে করবেন বলে মনস্থ করলেন। শরদ্বানের কন্যা কৃপের বোন কৃপীর সঙ্গে দ্রোণের বিয়ে হলো। যথাসময়ে একজন পুত্র জন্মাল তাঁদের। দ্রোণ তার নাম রাখলেন অশ্বত্থামা।
আগে একা ছিলেন, কোনোরকমে চলে যেত। এখন বিয়ে করেছেন, সন্তান হয়েছে। চাহিদা বেড়েছে অনেক। কিন্তু উপার্জনের উপায় নেই। দারিদ্র্য চরমে উঠল। এমন একদিন এলো, যেদিন পুত্রকে গোদুগ্ধ খাওয়ানোর ক্ষমতা থাকল না দ্রোণের। যজনযাজনে আর দিন চলছিল না। যজনযাজনের নামে এই ভিক্ষাবৃত্তি মোটেই পছন্দের নয় দ্রোণের। তাঁর বিশ্বাস—অস্ত্রবিদ্যার চেয়ে বাড়া কিছু নেই।
দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায় হঠাৎ একদিন দ্রুপদের কথা মনে পড়ে গেল দ্রোণের। দ্রুপদ তখন পঞ্চালের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। দ্রোণ ভাবলেন, পঞ্চালরাজ দ্রুপদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর দারিদ্র্য ঘুচে যাবে। সিদ্ধান্ত নিলেন, দ্রুপদের কাছেই যাবেন তিনি।
ঠিক এই সময় একজন দানবীরের কথা কানে এলো দ্রোণের। তিনি আর কেউ নন, মহর্ষি পরশুরাম। ভুবনবিখ্যাত ঋষি এবং অস্ত্রবিদ। শোনা গেল, পরশুরাম তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ দান করে বানপ্রস্থে যাবেন।
দারিদ্র্যজ্বালায় ধনপ্রার্থী হয়ে দ্রোণ পরশুরামের সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু দ্রোণ যখন পৌঁছলেন, পরশুরাম ততক্ষণে দানকার্য সম্পন্ন করে ফেলেছেন।
দ্রোণ বললেন, ‘মহর্ষি, আমি দ্রোণ, ভরদ্বাজপুত্র। দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবন আমার। আপনি আমাকে ধন দান করে আমার দারিদ্র্য দূরীভূত করুন।’
পরশুরাম বিব্রত হলেন। কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন, ‘বৎস, আমার যা কিছু ছিল, তুমি আসার আগেই সব দান করে ফেলেছি। তোমাকে দান করার মতো আমার কাছে কিছুই নেই এখন।
দ্রোণ বললেন, ‘বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম মহর্ষি!’
দ্রোণের কথায় আরও বেশি বিপন্নবোধ করতে লাগলেন পরশুরাম। কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘দেওয়ার মতো, এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে বিপুল এক অস্ত্রভাণ্ডার। তুমি কি এগুলো নিতে রাজি?’
দ্রোণের চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সানন্দে রাজি হলেন তিনি।
এরপর পরশুরামের কাছে সম্পূর্ণ শস্ত্রবিদ্যা অধ্যয়ন করে তপোবনে ফিরে এলেন দ্রোণ।
.
কিন্তু দারিদ্র্যের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে দ্রোণ শেষ পর্যন্ত স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে বাল্যবন্ধু দ্রুপদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
দ্রুপদরাজসভা তখন মন্ত্রী-অমাত্য-সভাজনে গমগম করছে। স্বর্ণসিংহাসনে দ্রুপদ উপবিষ্ট। সামনে শ্রীহীন ছিন্নবস্ত্রের দ্রোণকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল রাজার। শিরদাঁড়া সোজা করে তেজি চোখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কে? চিনতে পারলেন না দ্রুপদ, দ্রোণকে।
দ্রোণ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘দ্রুপদ, নিশ্চয়ই তুমি ঋষি ভরদ্বাজকে ভুলে যাওনি! যিনি ছিলেন তোমার পিতা পৃষতের বন্ধু। তুমিও আমার সুহৃদ ছিলে দ্রুপদ। নিশ্চয়ই তোমার ঋষি অগ্নিবেশ্যের আশ্রমের কথা মনে আছে, সেখানে আমরা দুজনে বহুদিন একসঙ্গে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছি।’
‘থামো থামো, ব্রাহ্মণ! সেই প্রথম থেকে কীসব আবোলতাবোল বকে যাচ্ছ তুমি? আমি, এই পঞ্চালরাজ দ্রুপদ হবে ছিন্নবস্ত্রের ব্রাহ্মণের বন্ধু! তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্যটা ভেবে দেখেছ? কোথাকার কোন ভিক্ষুক…।’ অহংকারে দ্রুপদের গলা গড়গড় করে উঠল।
দ্রুপদের পরের কথাগুলো দ্রোণের কানে ঢুকল না আর। কানে ঢুকবে কী, তিনি তো তখন অপমানে লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন!
দ্রুপদের কথা দ্রোণের কানে এসে আবার বাজল, ‘এসেই যখন পড়েছ, তোমাকে খালি হাতে ফিরাব না আমি। দ্রুপদ অত হৃদয়হীন নয়। তোমার আর তোমার পরিবারবর্গের জন্য একবেলার খাবার দিচ্ছি, তা নিয়ে বিদায় হও।’
বুক জ্বলে যাচ্ছিল তখন দ্রোণের! চোখে আঁধার আঁধার ঠেকছিল!
রাজসভায় দাঁড়িয়ে উন্নত মস্তকে জলদগম্ভীর কণ্ঠে দ্রোণ বলে উঠলেন, ‘ধনগৌরবে বন্ধুত্ব ভুলেছ তুমি দ্রুপদ? আমাকে না চেনার ভান করছ? এই সভায় দাঁড়িয়ে তোমার মন্ত্রী-অমাত্যদের সামনে ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে ওই সিংহাসন থেকে টেনে নামাব আমি একদিন। আমার পায়ের কাছে একদিন হাঁটু গেড়ে বসে প্রাণভিক্ষা চাইবে তুমি। সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করো তুমি দ্রুপদ।’ বলে স্ত্রীপুত্রের হাত ধরে দ্রুপদরাজসভা থেকে বেরিয়ে এলেন দ্রোণ।
বেরিয়েই দিশেহারা হয়ে পড়লেন দ্রোণ। এখন কোথায় যাবেন! কোথায় গেলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটি মিলবে!
স্বামীর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে ইতস্তত কণ্ঠে কৃপী বললেন, ‘একটি কথা বলি, যদি কিছু মনে না করেন।’
দ্রোণ কিছু না বলে কৃপীর দিকে তাকালেন। ক্রোধের উত্তাপ তখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে তাঁর।
কৃপী বললেন, ‘হস্তিনাপুরে আমার দাদা কৃপ থাকে। শুনেছি, দাদা এখন আচার্য। কুরুকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দেয় এখন দাদা। চলুন, আমরা হস্তিনাপুরে যাই। দাদা আমাদের ফেরাবে না।’
কথাটা মনে ধরল দ্রোণের। তাঁর হঠাৎ করে মনে পড়ল, কুরু-পাঞ্চালে চিরশত্রুতা। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শ্যালকের বাড়িতে যাবেন তিনি।
সপরিবারে কৃপাচার্যের ভবনে এসে উঠলেন দ্রোণ।
অকৃতদার কৃপাচার্য ভগ্নি, ভগ্নিপতি এবং ভাগনেকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
দ্রোণ পূর্বাপর সকল কথা কৃপাচার্যকে বললেন। দ্রুপদের অপমানের কথা আর নিজের অভাবের কথা খোলামেলাভাবেই বললেন তিনি।
কৃপাচার্য দ্রোণকে আশ্বস্ত করলেন, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি, তোমাদের খাবারের অভাব হবে না দ্রোণ। আর দেখি, রাজবাড়ির কোথাও তোমার জন্য একটা কাজ পাওয়া যায় কিনা। আর একটা কথা দ্রোণ, কাল থেকে অশ্বত্থামা আমার অস্ত্রপাঠশালায় যাবে।’
কৃপী এবং দ্রোণ কৃপাচার্যের কথা শুনে বড় তৃপ্তি পেলেন।
অশ্বত্থামা পরদিন মামার সঙ্গে পাঠশালায় গেল। অস্ত্রবিদ্যায় অশ্বত্থামা কুরুরাজকুমারদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। সে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে আরম্ভ করল। কুরুপুত্ররা চমৎকৃত হলো। ভাবল, যে-তরুণ এত ভালো শেখাতে পারে, তার পিতা না কত বড় অস্ত্রবিশারদ!
একদিন উন্মুক্ত এক মাঠে কুরুরাজকুমাররা একটি বল নিয়ে খেলছিল। খেলতে খেলতে একসময় বলটি পাশের কুয়োয় পড়ে গেল। অনেক চেষ্টার পরও বলটি তুলতে পারল না কুরুকুমাররা। তারা হঠাৎ লক্ষ করল—শ্যামবর্ণ, শুক্লকেশ, কৃশদেহের এক ব্রাহ্মণ অগ্নির সামনে হোম করছেন।
ব্রাহ্মণটি দ্রোণ ছাড়া আর কেউ নন।
রাজকুমাররা ওই ব্রাহ্মণের সামনে সাহায্যের আশায় গিয়ে দাঁড়াল।
দ্রোণ সেই কুয়োর মধ্যে তীর নিক্ষেপ করে বলটি তৎক্ষণাৎ তুলে আনলেন।
কুরুকুমারদের বিস্ময়ের অবধি থাকল না। তীর ছুঁড়ে গভীর কুয়োতলা থেকে বল তুলে আনা! না জানি আরও কী কী অস্ত্রদক্ষতা আছে তাঁর!
কথাচ্ছলে দ্রোণ জানালেন, এ সামান্য অস্ত্রকৌশলমাত্র! এর চেয়ে মারাত্মক, স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো অস্ত্রবিদ্যা তিনি জানেন।
রাজকুমাররা হইচই করতে করতে রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটে গেল। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে পিতামহকে কৃশকায় ব্রাহ্মণটির কথা জানাল।
ভীষ্ম অনুসন্ধান করে জানলেন, এই ব্রাহ্মণটি আর কেউ নন, অস্ত্রগুরু কৃপাচার্যের ভগ্নিপতি। এবং তিনি রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে কৃপাচার্যের বাসভবনে থাকেন।
পিতামহ আগে থেকেই শুনেছেন, দ্রোণ ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। দ্রোণ যে মস্তবড় এক অস্ত্রবিশারদ, জানতে বাকি নেই পিতামহের। তিনি তৃপ্তির দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললেন।
এতদিনে দক্ষ একজন শস্ত্রজ্ঞের সন্ধান পেলেন তিনি!
উনিশ
কুরুকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য কৃপাচার্য যথেষ্ট যোগ্য নন—এরকম একটা ধারণা পোষণ করতেন ভীষ্ম। দ্রোণের সন্ধান পেয়ে বর্তে গেলেন তিনি। পরদিনই দ্রোণকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন পিতামহ। এর আগে তিনি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপটা সেরে নিয়েছেন।
কৃপাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হলেন দ্রোণ। দেখেই দ্রোণকে পছন্দ হয়ে গেল ভীষ্মের। তিনি মনে মনে স্থির করলেন, এঁকেই আচার্যপদে বরণ করে নেবেন। কৃপাচার্য ঘরের লোক। তাঁকে বুঝিয়ে তাঁর স্থলে দ্রোণকে নিয়োগ দেবেন। তার আগে দ্রোণ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা দরকার।
ভীষ্ম বললেন, ‘ব্রাহ্মণ, আমার প্রণিপাত গ্রহণ করুন। আমরা আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।’
জন্ম থেকে শুরু করে বাল্যকাল, যৌবনবেলা, বিয়ে, সন্তান জন্ম দেওয়া—সব বৃত্তান্ত বলে গেলেন দ্রোণ। নিজের দারিদ্র্যের কথা অকপটে স্বীকার করলেন। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে পঞ্চালরাজ দ্রুপদের দুর্ব্যবহারের ঘটনাটি ব্যক্ত করলেন।
সর্বশেষে কণ্ঠে ব্রাহ্মণ্যক্রোধ মিশিয়ে দ্রোণ বলে উঠলেন, ‘পঞ্চালরাজ্য ছারখার করে ছাড়ব আমি। দ্রুপদের রাজমুকুট ধুলায় ধূসরিত করে ছাড়ব।’
এই ধরনের একজন লোককে খুঁজছিলেন পিতামহ, যিনি দ্রুপদের জন্য বুকের তলায় অগ্নিসম ক্রোধ লালন করেন। পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুদের দীর্ঘদিনের তিক্ততা। পঞ্চালবিরোধী ধনুর্ধর এই ব্রাহ্মণটিকে নিজেদের দলে রাখা জরুরি—দ্রুত ভেবে নিলেন ভীষ্ম।
নিম্ন স্বরে ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি কী বলো ধৃতরাষ্ট্র, দ্রোণের মুখে সব তো শুনলে! কুমারদের অস্ত্রগুরু হিসেবে তাঁকে নিলে ভুল হবে?’
ধৃতরাষ্ট্র আমতা আমতা করে বললেন, ‘ওই পদে তো কৃপাচার্য আছেন! তাঁর কী হবে!’
‘দেখো ধৃতরাষ্ট্র, কৃপাচার্য আমাদের আপনলোক। তাঁকে বুঝিয়ে বললে মেনে নেবেন। আর
আমরা তো ভিন্ন কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করছি না! আপন ভগ্নিপতি তাঁর!’
‘ঠিক আছে পিতামহ, আপনি যা ভালো বুঝছেন, তা-ই করুন। আমার চাওয়া—কুরুসন্তানদের প্রত্যেকেই এক একজন রণদক্ষ মহাবীর হয়ে উঠুক।’
মহারাজার কথা শুনে দ্রোণের দিকে মুখ ফেরালেন পিতামহ।
উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আজ থেকে কুরুপুত্রদের গুরুর পদে আপনাকে বৃত করছি আমরা।’
বলে চট করে কৃপাচার্যের দিকে তাকালেন পিতামহ। দেখলেন, কৃপাচার্যের চোখমুখ প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
চিন্তামুক্ত হলেন ভীষ্ম। বুঝে গেলেন, নিজের পদচ্যুতিতে মোটেই দুঃখিত হননি কৃপাচাৰ্য। উপরন্তু তাঁর পদে ভগ্নিপতি দ্রোণকে নিযুক্ত করায় পরম তৃপ্তি পাচ্ছেন।
এতক্ষণে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কথা বলে উঠলেন, ‘আজ থেকে আপনি আচার্য। দ্রোণাচার্য নামে আপনি হস্তিনাপুরে খ্যাত হবেন। আপনি কুরুসন্তানদের মানুষ করুন—এই-ই চাই আমি আপনার কাছে।’
তারপর কৃপাচার্যের দিকে ঘাড় ঘোরালেন ধৃতরাষ্ট্র। কৃতজ্ঞ চিত্তে বললেন, ‘আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার শেষ নেই কৃপাচার্য। আপনি কুরুকুমারদের প্রথম গুরু। আপনার হাত দিয়েই ওদের অস্ত্রদীক্ষা হয়েছে—ভুলব না আমি। আপনার শিক্ষাভিত্তির ওপরই দ্রোণাচার্য তাঁর শিক্ষাপদ্ধতিকে এগিয়ে নেবেন—এটা আমি বিশ্বাস করি।’
পিতামহ বললেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনারা সপরিবারে কৃপাচার্যের ভবনে থাকেন। এখন থেকে আলাদা বাসভবন হবে আপনার। আপনাদের সকল প্রকার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। আপনি শুধু একাগ্র মনে আমাদের সন্তানদের অস্ত্রশিক্ষায় মনোনিবেশ করুন।’
হৃষ্টচিত্তে দ্রোণাচার্য একবার মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দিকে, আরেকবার পিতামহের দিকে তাকাতে থাকলেন।
এই সময় ভীষ্ম বলে উঠলেন, ‘ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা, কৃপাচার্য আগের মতো তাঁর বাসভবনে সসম্মানে বাস করবেন। আমরা তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেব। তাঁর ভরণপোষণের কোনোই অসুবিধা হবে না। এ ব্যাপারে আপনারা দুজনেই নিশ্চিন্ত থাকুন। তিনি আমাদের রাজসভায় উপদেষ্টা হয়ে থাকবেন।’
পরদিন দ্রোণাচার্য আনন্দচিত্তে কুরুঅস্ত্রপাঠশালার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
কৃপাচার্যও উপস্থিত ছিলেন ওই সময়। পাঠার্থীদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমাদের বয়স কম। তোমরা কেউই হয়তো দ্রোণাচার্যের নাম শোনোনি। পরশুরামশিষ্য পৃথিবীখ্যাত অস্ত্রবিদ হলেন দ্রোণাচার্য। তোমাদের পরম সৌভাগ্য, দোর্দণ্ডপ্রতাপী দ্রোণাচার্য আজ থেকে তোমাদের অস্ত্রগুরু হলেন। তোমরা তাঁকে প্রণতি জানাও।
সদ্যাগত গুরুকে প্রণাম করবার সময় রাজকুমাররা নিজ নিজ পরিচয় দিল।
দুর্যোধন বলল, ‘আমি দুর্যোধন, ধৃতরাষ্ট্র আমার পিতা। আমি কৌরব।’
দুর্যোধনের দেখাদেখি তার অন্য ভাইয়েরাও দাদার মতো করে নিজেদের পরিচয় দিল।
দ্রোণাচার্য ‘তোমাদের শুভ হোক’ বলে আশীর্বাদ করলেন।
যুধিষ্ঠিরের পালা এলো। প্রণাম সেরে বলল, ‘আমার নাম যুধিষ্ঠির। আমি প্রথম পাণ্ডব।’
‘প্রথম পাণ্ডব! আমি তো জানি এরা সবাই কৌরব! কৌরবদের মধ্যে পাণ্ডব! এরা কারা?’ বলতে গিয়ে বললেন না দ্রোণাচার্য।
এর পর এলো অন্যান্য দেশের রাজপুত্ররা। গুরুপ্রণাম শেষে নিজেদের পরিচয় দিল তারা। সবাইকে যথাযোগ্য আশীর্বাদ করলেন দ্রোণাচার্য।
হঠাৎ দ্রোণ দেখলেন, দিব্যকান্তির এক তরুণ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। পিঠে তীরভর্তি তৃণ, হাতে ধনুক। নিকটে এসে ধনুকটি মাটিতে রেখে দ্রোণাচার্যকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল তরুণটি।
বলল, ‘আমার নাম কর্ণ। আমি রাধেয়।
‘রাধেয়!’ দ্রোণাচার্যের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তিনি লক্ষ করলেন, তরুণটির কণ্ঠস্বর নিষ্কম্প। তার আত্মবিশ্বাস কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত। দীর্ঘদেহী। পিঙ্গল চোখ। উন্নত নাসা। গৌরবর্ণ।
দুটো বস্তুর প্রতি গুরুদেবের চোখ আটকে গেল—এক. কুণ্ডল। কর্ণের দুকানের লতিতে সহজাত স্বর্ণকুণ্ডল ঝকঝক করছে। দুই. প্রশস্ত বক্ষটি আবৃত করে সোনার বর্মটি স্বর্ণাভা বিচ্ছুরণ করছে। সমরাভিজ্ঞ দ্রোণাচার্যের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এ দুটো কৃত্রিম নয়, সহজাত। অবাক বিস্ময়ে তিনি কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কর্ণের উত্তর এই সময় দ্রোণাচার্যের কানে এলো, ‘আমার মায়ের নাম রাধা, পিতা অধিরথ। তাই আমি রাধেয়।’
দ্রোণাচার্য মুহূর্তেই বুঝে গেলেন, তরুণটি কৌরব বা পাণ্ডববংশের কেউ নয়। অন্য কোনো রাজরাজড়ার পুত্রও সে নয়। নিজের পরিচয় দিল রাধেয় নামে। পিতার নাম বলল, অধিরথ। অধিরথ মানে তো রথচালক! রথচালকের ছেলেরও প্রবেশাধিকার আছে নাকি কুরুদের এই অস্ত্রপাঠশালায়! এখানে তাহলে বর্ণগৌরবের স্থান কোথায়! তীক্ষ্ণ কিছু একটা বলতে গিয়ে দ্রুত নিজেকে সংযত করলেন দ্রোণাচার্য।
সবাই যার যার আসনে বসে পড়লে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘আমার একটা একান্ত ইচ্ছা আছে।’
সব ছাত্র উৎসুক দৃষ্টিতে গুরুর দিকে তাকাল।
গুরু বললেন, ‘বিদ্যার্জন শেষে গুরুদক্ষিণা দিতে হয়, জানো তো তোমরা?’
দুর্যোধন বলল, ‘জানি আমরা সবাই।’
‘তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে গুরুদক্ষিণা হিসেবে আমার ওই একান্ত ইচ্ছাটা পূরণ করবে তোমরা। কী করবে তো?’ গম্ভীর এক অদ্ভুতুড়ে কণ্ঠে বললেন দ্রোণাচার্য।
রাজকুমাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তারা তো আর বুদ্ধিহীন নয় যে ধুম করে ইচ্ছাপূরণের প্রতিজ্ঞা করে বসে! তাছাড়া আচার্য সবে এলেন মাত্র। তাঁর সঙ্গে ভালো করে পরিচয়টাও হয়ে ওঠেনি! কিছু যে শিক্ষা দিয়েছেন, তা-ও নয়! কোনো গুরুগিরি না করেই গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন! এ কেমন কথা! কুরুরাজকুমাররা এখন তো আর নিতান্ত বালক নয়! রীতিমতো তরুণ হয়ে উঠেছে এক একজন! তাদের বুদ্ধি-বিবেচনাও এলনা-ফেলনা নয়!
ওই বুদ্ধি দিয়ে তারা দ্রোণাচার্যের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাটি কী, ধরতে পারল না। আর বুঝতে না পেরে কোনো কিছুর উত্তর দেওয়া বোকার কাজ, তাদের বলেছেন পিতামহ। নাহ! অস্ত্রগুরুর গোপনীয় বাসনাটা কী, না জেনে প্রতিজ্ঞা করবে না তারা।
দ্রোণাচার্যের কথা শুনে সব রাজপুত্র মৌন থাকল।
কিন্তু সমবেতদের মধ্য থেকে হঠাৎ একজন উঠে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি সোজা গুরুর চোখ বরাবর।
দুকদম সামনে এসে সে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার নাম অর্জুন— একটু আগে বলেছি। আমি তৃতীয় পাণ্ডব। আমি সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করছি, অস্ত্রশিক্ষা শেষে আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও আপনার ইচ্ছাটি পূরণ করব আমি।’ প্রতিটি শব্দকে পরিস্ফুটভাবে উচ্চারণ করল অর্জুন। ‘প্রাণের বিনিময়ে’ শব্দবন্ধের ওপর বিশেষ শ্বাসাঘাত করল। চোখ দুটি তখন তার প্রতিজ্ঞায় জ্বলজ্বল করছে।
অর্জুনের কথা শুনে দ্রোণের চোখে জল এসে গেল। মন তৃপ্তিতে ভরে গেল এই ভেবে যে এত এত ছাত্রের মধ্যে অন্তত একজন ছাত্রকে পাওয়া গেল, যে তাঁর সুপ্ত বাসনাটি কী, না জেনে শুধু গুরুর সন্তুষ্টির জন্য পণ করতে পারে। এই-ই তো প্রকৃত শিষ্য! একেই আমার সকল বিদ্যা উজাড় করে শেখাব! তৎক্ষণাৎ সংকল্প করে বসলেন দ্রোণাচার্য।
হাত-ইশারায় অর্জুনকে কাছে ডাকলেন দ্রোণ। বুকের কাছে টেনে নিলেন। মাথার ঘ্রাণ নিলেন। চুলে আশীর্বাদের আঙুল বোলালেন। তারপর সামনের দিকে ঠেলে দিলেন অর্জুনকে। এতসব যে করলেন, মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না।
সমস্ত ঘটনা কুরুপুত্ররা উৎসুক নয়নে দেখে গেল।
.
এরপর যথানিয়মে কৌরব এবং পাণ্ডব রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হলো।
অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ হিসেবে দ্রোণাচার্যের নাম ছড়িয়ে পড়ল।
বিদেশের রাজকুমাররা অস্ত্রপাঠশালায় আসতে শুরু করল।
কর্ণ দুর্যোধনের বন্ধু হয়ে গেল। কৌরব আর পাণ্ডবদের মধ্যে একধরনের রেষারেষি লক্ষ করা গেল। এই দ্বন্দ্বে কর্ণ দুর্যোধনের পক্ষ নিল। ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের সঙ্গে কর্ণেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হলো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে উভয়ের মধ্যে শত্রুতার জন্ম নিল। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাও পিতার অধীনে অস্ত্রবিদ্যায় আরও দক্ষতা অর্জন শুরু করল। কী এক অলিখিত কারণে পাণ্ডবদের চেয়ে কৌরবদের সঙ্গেই অশ্বত্থামার সখ্য গাঢ় হলো।
অর্জুন ধীরে ধীরে দ্রোণাচার্যের প্রিয়পাত্র হতে শুরু করল। দ্রোণের প্রতি অর্জুনের আনুগত্য অশ্বত্থামার আনুগত্যকে ছাড়িয়ে গেল। ফলে দ্রোণাচার্য অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতী হয়ে উঠলেন। একজন গুরুর জন্য এ পক্ষপাতিত্ব যে অখ্যাতির, তা-ও খেয়াল রাখলেন না দ্রোণাচার্য। অশ্বত্থামা তাঁর প্রিয় পুত্র, কিন্তু প্রিয় ছাত্র নয়। নিজের সকল অস্ত্রশিক্ষা উজাড় করে অর্জুনকে শেখাতে লাগলেন দ্রোণ
অন্যরা দ্রোণাচার্যের এই পক্ষপাতিত্ব ও ছলামি খেয়াল না করলেও কর্ণের চোখ এড়াল না তা। দুর্যোধনকে আকারে-ইঙ্গিতে ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করল।
দুর্যোধন দ্রোণের অর্জুনপ্রীতি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
হিসানো কণ্ঠে বলল, ‘আমার বাবাই আচার্যের ভরণপোষণ করছেন। প্রাসাদের মতন বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। রাজসভায় সম্মানের আসন দিয়েছেন। সেই আমার পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা! কোথাকার কোন বহিরাগত অর্জুন, রাজপ্রাসাদে যার কণামাত্র গুরুত্ব নেই, তাকেই চুপিসারে সকল অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়ে দিচ্ছেন! দেখাচ্ছি মজা।’
দ্রুত দুর্যোধনের মুখ চেপে ধরল কর্ণ। ‘খবরদার বন্ধু। এখন নয়। সময় হয়নি। যা করতে হবে, পরে ভেবেচিন্তে করতে হবে।’
কোনোরকমে দুর্যোধনকে সংযত করাল কৰ্ণ।