দশ
চিৎকার দিয়ে উঠলেন রাধা, ‘পেটিকা! পেটিকা!’
অন্যমনস্ক অধিরথ চমকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
বয়স হয়ে গেছে তাঁর। যৌবনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের রথ চালিয়েছেন। একটা সময়ে ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে উঠলেন তিনি। সারথ্যে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন। বিগতযৌবনে শরীরসামর্থ্য কমে আসে। একদিন অধিরথের শক্তিতে ভাটা লাগল। ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে অধিরথ সারথিবৃত্তি ত্যাগ করলেন। সুহৃদ হিসেবে মহারাজ অধিরথকে তাঁর রাজসভায় স্থান দিলেন।
অধিরথ সব সময় হস্তিনাপুরে থাকতেন না। মহারাজ স্মরণ করলেই হস্তিনাপুরে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি সস্ত্রীক চম্পানগরীতে বসবাস করতেন।
চম্পানগরীর পার্শ্ববর্তী তটিনীর নাম গঙ্গা। স্ত্রীর অনুরোধে-উপরোধে অধিরথ মাঝেমধ্যে গঙ্গাস্নানে আসেন। আজও যেমন এসেছেন। গঙ্গা আজ বেশ বিক্ষুব্ধ। মাথাভাঙা ঢেউগুলো কূলে আছড়ে পড়ছে। সূর্যদেব মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছেন আজ। অবগাহনে নামবেন নাকি নামবেন না—দোনোমনা করছেন অধিরথ। তাঁর আগেই রাধা সোপান বেয়ে জল পর্যন্ত নেমে গেছেন। আরও অনেকে তখন গঙ্গাস্নানে রত। রাধাও জলে নেমে গেলেন। একটা ডুব দিয়েও ফেলেছেন তিনি। হঠাৎ ভেসে যাওয়া পেটিকাটির ওপর নজর পড়ল রাধার। অমনি চিৎকার, ‘পেটিকা! পেটিকা!
স্ত্রীর পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে অনেকটাই জলকিনারে নেমে এসেছেন অধিরথ। তখনো তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, স্নানে নামবেন কিনা। আনমনে ভেবে যাচ্ছিলেন তিনি। স্ত্রীর চিৎকারে সংবিতে ফিরলেন।
চাপা কণ্ঠে বললেন, ‘কী বলছ তুমি রাধা! কোথায় পেটিকা?’
‘ওই ওই যে।’ দেখাতে গিয়েও স্বামীকে পেটিকাটি দেখাতে পারলেন না রাধা। পেটিকা তখন ঢেউয়ের বাড়িতে জলতলে।
একটুক্ষণ পরে ভুশ করে পেটিকাটি ভেসে উঠল।
তখন তখনই রাধা বললেন, ‘ওই তো।’
অধিরথ দেখলেন, বেশ একটি শক্তপোক্ত পেটিকা কূলের অদূর দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে ভেসে যাচ্ছে।
রাধা ওই সময় উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘আমার ওই পেটিকাটি চাই আৰ্য।’
‘কী ছেলেমানুষি করছ রাধা! কীসের না কীসের পেটিকা! ওটা দিয়ে তুমি কী করবে?’
‘অতশত বুঝি না আমি। আমাকে পেটিকাটি পাইয়ে দিন, ব্যস।’
অধিরথ ফাঁপরে পড়ে গেলেন। তাঁর তেমন শক্তি নেই যে অতটুকু সাঁতরে গিয়ে পেটিকাটি কূলে টেনে আনেন। কী করবেন এখন? হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল ঘাটেবাঁধা নৌকাটির ওপর। পাটনি তখন তার সঙ্গীদের সঙ্গে কী যেন এক গভীর আলাপে মগ্ন।
উঁচু কণ্ঠে পাটনির উদ্দেশে অধিরথ বললেন, ‘শোনো তোমরা, ওই যে ভেসে যাচ্ছে পেটিকাটা, নৌকা বেয়ে নিয়ে এসো ওটা।’
পাটনিরা অধিরথকে বিলক্ষণ চিনত। তারা জানত, ইনি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সুহৃদ এবং চম্পানগরীর মাননীয়। অধিরথের আদেশ পেয়ে পেটিকার উদ্দেশে নৌকা ভাসাল পাটনিরা।
অচিরেই তারা পেটিকাটিকে কূলে তুলল।
রাধা অতি দ্রুত পায়ে পেটিকাটির নিকটে গেলেন। তিনি কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। দুহাত দিয়ে পেটিকাটির এপাশ-ওপাশ হাতড়াতে লাগলেন। তাঁর ভেতরটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠল। কেন জানি, হাত দুটো মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করল। কী রকম যেন ঘোর ঘোর লাগতে শুরু করল চোখেমুখে! এরকম হচ্ছে কেন আমার—দ্রুত ভেবে নিলেন রাধা। ভাবলেন, বয়স হয়েছে তাঁর, বয়সের কারণেই বোধহয় কৌতূহল আর উত্তেজনাবশত শরীর আর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
অধিরথ পেটিকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁর মধ্যেও যে ঔৎসুক্য জাগেনি, তা নয়। তবে রাধার মতো এত অস্থির হননি তিনি। শ্লথ পায়ে পেটিকাটির দিকে এগিয়ে আসছিলেন তিনি।
অধিরথকে লক্ষ্য করে অস্থির কণ্ঠে রাধা বললেন, ‘আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসুন আর্য।’ অধিরথ তাঁর হাঁটায় গতি বাড়ালেন।
নিকটে পৌঁছলে রাধা বললেন, ‘আমার মন বলছে, পেটিকাটি রহস্যপূর্ণ। এত দামি পেটিকা শুধু রাজবাড়িতেই দেখা যায়। এই দেখুন, পেটিকার ছিদ্রগুলো কেমন মোম দিয়ে সাঁটা! পেটিকার কারুকাজটা লক্ষ করেছেন আর্য! আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। আরে আরে! এই দেখুন, পেটিকার ঊর্ধ্বদিকে একটা রন্ধ্র মোম দিয়ে বন্ধ করা হয়নি! কিছু একটা আছে এর মধ্যে। নিশ্চয়ই গোপনীয় কিছু।
রাধা নিশ্বাস না ফেলে আরও কী কী বলতে চাইলেন।
অধিরথ তাঁকে থামিয়ে দিলেন।
অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি এরকম অস্থির হয়ে উঠলে কেন রাধা? বয়স হয়েছে তোমার! অত্যধিক চাঞ্চল্যে তোমার শরীর খারাপ হতে পারে। বসো তুমি। দেখি কী করা যায়!
স্বামীর মৃদু উষ্মা প্রকাশেও রাধার কৌতূহল কমল না। বরং তিনি আরও চঞ্চল হয়ে উঠলেন ওই অবস্থাতেই বললেন, ‘আপনি পেটিকাটি খোলার ব্যবস্থা করুন আর্য। এটা না খোলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না আমি।’
স্ত্রীর কথার কোনো জবাব দিলেন না অধিরথ। মাঝিদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘তোমাদের নৌকায় এমন কিছু আছে কি, যা দিয়ে এই পেটিকাটি খোলা যাবে?’
ততক্ষণে পেটিকাটি ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। গঙ্গাস্নানের দিন বলে ঘাট এলাকায় প্রচুর মানুষ এখন। দর্শকদের মধ্যেও নানা কথার সূত্রপাত হলো। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের মতামত জ্ঞাপন করতে শুরু করল। ফলে একটা গুঞ্জন-কোলাহল তৈরি হয়ে গেল পেটিকা ঘিরে। ওই কোলাহলের মধ্যে অধিরথের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু যাকে উদ্দেশ করে অধিরথের কথা বলা, সেই বয়স্ক মাঝিটি কথাগুলো শুনতে পেল।
পাটনিটি বলল, ‘মাঝেমধ্যে নৌকার তক্তা সরেনড়ে যায়। ঠিক করার জন্য কিছু যন্ত্রপাতি নৌকাতে রাখতেই হয়। আমরাও রেখেছি। আমি এখনই নিয়ে আসছি যন্ত্রপাতির ঝাঁপিটি।’ বলে সে ত্বরিত পায়ে কূলে ভেড়ানো নৌকাটির দিকে এগিয়ে গেল।
.
পাটনির যন্ত্রপাতি দিয়ে পেটিকাটির ওপর দিকের ঢাকনাটি খোলা হলো।
রাধা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন পেটিকাটির ওপর।
ওই অবস্থাতেই তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘অ মারে!’
‘কী হয়েছে! কী হয়েছে?’ বলতে বলতে দ্রুত পায়ে স্ত্রীর নিকটে পৌঁছলেন অধিরথ।
ততক্ষণে রাধা বলে যাচ্ছেন, ‘দেখুন দেখুন, এ কে? এটা কী! কী অপরূপ! কী লাবণ্যময়! কী সোনার বরণ!’
রাধার কথা শুনে উপস্থিত মানুষদের মধ্যে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। পেটিকার মধ্যে কী—দেখবার জন্য তাদের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হলো।
ওই হুড়াহুড়ি-কলকোলাহলের মধ্যে অধিরথ স্তব্ধ চোখে দেখলেন, পেটিকার মধ্যে অপূর্ব রূপলাবণ্যময় হেমবর্মধারী কুণ্ডলযুগল বিভূষিত মখমল জড়ানো এক শিশু শোয়ানো। শিশুটির চোখ নিমীলিত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শিশুটি ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত।
দীর্ঘ হাত দুটো বাড়িয়ে অধিরথ শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন।
জনকোলাহল আরও বৃদ্ধি পেল। এরকম দৃশ্য তারা আগে কখনো দেখেনি। জলেভাসা সন্তান! কার সন্তান? কোন অভাগীর সন্তান? এ কেমন নিষ্ঠুর-নির্দয় মা, যে নিজের সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিল! ইত্যাকার মন্তব্যে স্থানটিতে শোরগোল আরও বেড়ে গেল।
হঠাৎ করে এক মধ্যবয়সি নারী উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।
নিমিষেই কোলাহল থেমে গেল।
তখন সবাই অধিরথের আবেগমিশানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
অধিরথ তখন স্ত্রী রাধাকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘আয়ুষ্মতী, আমি এমন অদ্ভুত রূপময় শিশু আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে, শিশুটি দেবপুত্র। দেবগণ জানেন, আমরা নিঃসন্তান। আমাদের অনপত্য ঘোচানোর জন্য দেবতারাই বোধহয় এই শিশুটিকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। এই নাও, এই পুত্রটি আজ হতে তোমার। আমি যা তোমাকে দিতে পারিনি, স্বর্গের দেবগণ অনুগ্রহ করে তা তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। নাও রাধা, পুত্রটিকে তোমার কোলে নাও, বুকে জড়াও।’
শিশুটিকে কোলে নেবেন কি, রাধা তো তখন হতভম্ব! এ কী অপার লীলা ঈশ্বরের! দীর্ঘ বিবাহিত জীবন তাঁর। বিবাহিত জীবনে সন্তানকে বুকে জড়ানোর সুযোগ পাননি রাধা। সারাটা জীবন তাঁর সন্তান-হাহাকারে কেটেছে। সন্তান হবে—প্রথমদিকে এই আশায় থাকলেও শেষদিকে সন্তানপ্রাপ্তির আশা ত্যাগ করেছেন তিনি।
কিন্তু আজ কী হলো! ঈশ্বরের এত কৃপা হলো তাঁর ওপর! এই সৌম্যকান্ত রূপলাবণ্যে জড়ানো পুত্রটিকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর কাছে! ভাবতে ভাবতে জোড়হাত কপালে ঠেকালেন রাধা।
এই সময় অধিরথ বলে উঠলেন, ‘অত ভাবছ কেন রাধা? নাও, পুত্রটিকে বুকে জড়িয়ে নাও। এ তোমারই সন্তান, তোমার নদীসেঁচা পুত্র।’
অবশ হাত দুটো অধিরথের দিকে বাড়িয়ে দিলেন রাধা। অধিরথ মিহি কাপড়ে জড়ানো পুত্রটিকে রাধার হাতে অর্পণ করলেন।
অধিরথ আবেগায়িত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখো, দেখো তুমি রাধা, তোমার কোলে শিশুটিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! যেন পূর্ণচন্দ্র তোমার কোলে শোভা পাচ্ছে! তুমি আজ থেকে মা হলে।’
এর পর সমবেতদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা শুনে রাখুন, আজ এই মুহূর্ত থেকে এই শিশুটি আমাদের সন্তান হলো। রাধেয় হয়ে গেল এই পুত্রটি।’ বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে এলো অধিরথের।
ততক্ষণে রাধা আনন্দে বিগলিত প্রাণে শিশুটিকে বুকের গভীরে জড়িয়ে নিয়েছেন। এতদিনের রুদ্ধ বাৎসল্য মুখর করে তুলল রাধাকে।
সূতজননী রাধা আর সূতপিতা অধিরথ পুত্রটিকে নিয়ে আপন আলয়ে ফিরে গেলেন।
শিশুটির নামকরণের জন্য, কিছুদিন অতিবাহিত হলে, ব্রাহ্মণদের নিজ বাড়িতে ডাকলেন অধিরথ। ব্রাহ্মণরা অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, শিশুটির গায়ে সহজাত সোনার বর্ম আর কানে স্বর্ণকুণ্ডল। ব্রাহ্মণদের জীবনে এ প্রথম অভিজ্ঞতা। এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণরা আগে কখনো হননি।
নিজেদের বিস্ময়কে গোপন করলেন না তাঁরা। বললেন, ‘অধিরথ, এই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমরা আগে কখনো হইনি। তবে দেখেশুনে আমরা যা বুঝছি, এই পুত্রটি ভবিষ্যতে অতুলনীয় নৈপুণ্যের অধিকারী হবে। দানশীল হিসেবে এ একদিন জগদ্বিখ্যাত হবে।’
ব্রাহ্মণদের ভবিষ্যদ্বাণী উজ্জ্বল চোখে রাধা আর অধিরথ শুনে গেলেন।
ব্রাহ্মণরা আবার বললেন, ‘দেখছি, এই শিশুটি বর্ম আর কুণ্ডল নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এ দুটিই সোনার। আমরা আজ এর নাম দিচ্ছি বসুষেণ। বসু মানে জানো তো? বসু মানে সোনা। তাই এর নাম রাখলাম, সোনার ছেলে।’
প্রচুর উপঢৌকন-দক্ষিণা দিয়ে অধিরথ ব্রাহ্মণদের বিদায় করলেন।
.
পরবর্তীকালে শিশুটির নাম বসুষেণ রইল না। কেউ কেউ তাকে বৃষও ডাকা শুরু করল। সমাজের বর্ণবাদী চেতনার মানুষগুলো একে সূতপুত্র সম্বোধন করে স্বস্তিবোধ করতে লাগল। আরও পরে বসুষেণের নাম কর্ণ হয়ে গেল।
যে শিশুটির জন্মের জন্য কুন্তিভোজের প্রাসাদে মঙ্গল শঙ্খঘণ্টা বেজে ওঠার কথা, তা বাজল সূত অধিরথের গৃহে। যে শিশুটির রাজপ্রাসাদের কক্ষে কক্ষে, অলিন্দে অলিন্দে, উদ্যানে উদ্যানে ছোট ছোট পা ফেলে ফেলে হাঁটার কথা, সেই শিশুটি অধিরথের ম্লান গৃহে, তাঁর ধুলায় ধূসরিত উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে বড় হতে লাগল।
.
কুন্তীও একদিন কুরুরাজধানী হস্তিনায় এসেছিল।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তারই গর্ভজাত সন্তান কর্ণ তার আগেই কুরুরাজ্যে পৌঁছে গেল।
এদের দুজনের কেউ কি জানত, একদিন তারা একই রাজপরিবারের সদস্য হয়ে উঠবে?
এগারো
পুত্রসন্তানটিকে অশ্বনদীজলে ভাসিয়ে দেওয়ার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল।
এই যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, রাজপরিবারের কেউ টের পেল না। বিসর্জনের পর নিজকক্ষে ফিরে এসে ধাত্রী এবং মঞ্জরিকে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার উপহার দিল কুন্তী। এবং তাদের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল যে এই ঘটনাটি কখনো কোনো অবস্থাতেই তারা কাউকে বলবে না।
প্রণাম জানিয়ে ধাত্রী বিদায় নিল।
মঞ্জরি থেকে গেল। রাজকুমারীকে যে সুস্থ-সবল করে তুলতে হবে! মঞ্জরি কুন্তীসেবায় নিজেকে আরও বেশি করে যুক্ত করে নিল।
কিছুদিনের মধ্যে কুন্তী তার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেল। অতঃপর সে রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আগের মতো মিশে গেল। সবার সঙ্গে আবার মেলামেশা শুরু করল কুন্তী। মেলামেশা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে কী হবে, মনটা তার পূর্বের জায়গায় ফিরে গেল না। তার মনে দুর্বাসাধর্ষণের ঘৃণা আর পুত্রবিসর্জনের হাহাকার জাগরুক থাকল।
মা হওয়ার কারণেই বোধহয় কুন্তীর স্বভাব থেকে তরুণীসুলভ চঞ্চলতা উধাও হয়ে গেল। সেখানে দেখা দিল দৃঢ়তা, সুস্থিরতা এবং গাম্ভীর্য। তরুণী কুন্তী পরিণত ধীর এক রমণীতে রূপান্তরিত হলো। ধর্ষিত হওয়ার এবং সন্তান বিসর্জনের গ্লানি ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কুন্তী ব্রতধর্মে মন দিল। ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিশুদ্ধ এক জীবনবোধের উন্মেষ ঘটল। শুভ্রতা তাকে ঘিরেবেড়ে থাকল। তার যৌবনে শরৎ-সকালের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ল। শুদ্ধ জীবনের তেজে তার রূপযৌবন আরও বেশি করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যৌবনবতী কুন্তীর রূপময়তার কথা দ্রুত লোকসমাজে প্রচারিত হতে থাকল।
নানা দেশ থেকে বহু রাজা-রাজপুত্র কুন্তীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কুন্তিভোজের কাছে আসতে লাগল।
এতদিন মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে উদাসীন থাকলেও পাণিপ্রার্থীদের অত্যাগ্রহে মহারাজ কুন্তিভোজ কুন্তীর বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
হস্তিনাপুরের রাজা তখন পাণ্ডু। পাণ্ডুরা তিন ভাই। জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র—জন্মান্ধ। মধ্যম পাণ্ডু। ছোট বিদুর। তিনজনের কেউই পিতার ঔরসে জন্মায়নি। জেঠার ঔরসে জন্ম তাদের। তিনজনের মা তিনজন। জননীদের দুজন রাজমহিষী, একজন দাসী। ধৃতরাষ্ট্রের মা অম্বিকা, পাণ্ডুর মা অম্বালিকা। অম্বিকা-অম্বালিকা কুরুরাজ বিচিত্রবীর্যের মহিষী। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে ক্ষয়রোগে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তিনি অপুত্রক ছিলেন। আর বিদুরের মা ছিল রাজপ্রাসাদের দাসী। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, যিনি সম্পর্কে অম্বিকা-অম্বালিকার ভাশুর, এই সন্তানত্রয়ের পিতা।
বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে রাজমাতা সত্যবতী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কুরুবংশধারা যে বিলুপ্ত হতে চলল! যেকোনো মূল্যে বংশধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। তিনি তাঁর কুমারীপুত্র ব্যাসকে ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য আহ্বান জানালেন। মায়ের আদেশে ছোট ভাইয়ের বউদের সঙ্গম করতে দ্বিধা করলেন না ঋষি ব্যাস। ভাইবউদের ওপরচালাকিতে দাসীকেও সঙ্গম করেছিলেন ব্যাস।
কালক্রমে তিন পুত্রই যুবক হয়ে উঠল। কুরুরাজার চলতি দায়িত্বে তখন পিতামহ ভীষ্ম। ভীষ্ম এই যুবকদের অভিভাবক।
কুরুনৃপতি নির্বাচনের সময় উপস্থিত হলো। জ্যেষ্ঠের রাজসিংহাসনে অধিকার। কিন্তু জন্মান্ধ বলে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বিবেচনায় ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়ার উপযুক্ত নয়। সবাই মিলে মধ্যমপুত্র পাণ্ডুকেই কুরুনৃপতি বলে ঘোষণা দিলেন। দাসীপুত্র বিদুর রাজদরবারে উপদেষ্টার পদ পেল।
বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয় ক্ষেত্রজপুত্র পাণ্ডু এক শুভদিনে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে আরোহণ করলেন। তখন তিনি অবিবাহিত।
ভোজবংশীয় রাজা উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠপুত্র কংস। পিতার পরে কংস রাজা হলো। একটা সময়ে কংস দোর্দণ্ডপ্রতাপী হয়ে উঠল। ছোট ছোট রাজ্য জয় করা শুরু করল কংস। কংস তার সামরিকশক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। কংসের সামর্থ্য দেখে যাদববংশীয় রাজারা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। এমন যে প্রবল শক্তিধর, কুরুরাজঅভিভাবক ভীষ্ম, তিনিও ফাঁপরে পড়ে গেলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যাদবদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে হবে। কুরু-যাদবের সখ্য দেখে ভোজরাজ কংস ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু কী করে শূরসেন বা কুন্তিভোজের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা যায়? চিন্তা করে যেতে লাগলেন পিতামহ ভীষ্ম। ঠিক ওই সময়ে কুন্তীর রূপের কথা তাঁর কানে এসে পৌঁছল।
তখন তখনই পিতামহের মাথায় বুদ্ধিটা ঝলকে উঠল। পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তিভোজকন্যা কুন্তীর বিয়ে দিলে কেমন হয়? মহামতি ভীষ্ম তখন মহারাজ পাণ্ডুর জন্য পাত্রীর সন্ধান করছেন।
এই বিয়ের মাধ্যমে শুধু কুন্তিভোজের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো হবে না, এই বিয়ে দ্বারা যাদবরাজ শূরসেনের সঙ্গেও একটা যোগসূত্র তৈরি হবে। কুন্তিভোজ যতই কুন্তীকে দত্তক নিন, কুন্তী তো শেষ পর্যন্ত শূরসেনের কন্যা! সুতরাং এক বিয়েতে দুই রাজা খুশি—কুন্তিভোজ আর শূরসেন। বিয়ের প্রস্তাব শুনে দুই ভাই নিশ্চয়ই তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা করবেন। কুরুরাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থাপিত হলে কংসবিরোধী যাদবগোষ্ঠীর সামরিক শক্তি অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে—এই ভাবনাটা নিশ্চয়ই কুন্তিভোজ-শূরসেন ভাববেন। পিতামহ ভীষ্ম সিদ্ধান্তটা নিজের মনের মধ্যে পাকাপোক্ত করে ফেললেন।
একদিন ভীষ্ম বিদুরকে ডাকলেন।
দুজনে মুখোমুখি বসার পর ভীষ্ম বললেন, ‘কিছুদিন আগে গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়েটা হয়ে গেল।’
‘হ্যাঁ পিতামহ, এজন্য আপনাকে চোখ রাঙাতে হলো।’
‘দেখো বিদুর, গান্ধাররাজ সুবলকে ভয় না দেখিয়ে উপায় ছিল না আমার। কুলগুরু যখন গান্ধারীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, সরাসরি অস্বীকার করে বসল গান্ধাররাজ!’
‘ওঁর তো কোনো অপরাধ নেই পিতামহ! তিনি তো একজন পিতা! পিতা হয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর কন্যাটিকে কী করে জন্মান্ধ জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দেন?’
‘তুমি ঠিক বলেছ বিদুর। সুবিবেচক বলেই তুমি একথা বললে। কিন্তু আমিও তো নিরুপায় ছিলাম বিদুর! কন্যার সন্ধানে কত রাজ্যে দূত পাঠালাম, ঘটক পাঠালাম! অন্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্রকে কন্যা দিতে কোনো রাজা রাজি হলো না। শেষ পর্যন্ত কৌশলের আশ্রয় নিলাম।’
‘এই কৌশলটা সুখকর হয়নি পিতামহ। গান্ধাররাজ্য অতি ক্ষুদ্র একটা দেশ। এর সামরিক শক্তি নগণ্য। আপনি মহারাজ সুবলকে আক্রমণের ভয় দেখালেন।’
‘ভয় পেয়েই তো রাজি হয়ে গেল সুবল! ও জানত, কুরুবাহিনী একবার আক্রমণ করলে তার দেশ ছারখার হয়ে যেত। দেশ আর প্রজাদের বাঁচাবার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে কন্যা বিয়ে দিল সুবল।’
‘তাতে কি ফল ভালো হলো পিতামহ?’
‘ভালো হলো না? ভালো হলো তো! দেখছ না, গান্ধারী কী চমৎকারভাবে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সংসারটা করে যাচ্ছে!’
‘সংসার করছেন ঠিক, কিন্তু মনে অশেষ ঘৃণা নিয়ে।
‘অশেষ ঘৃণা নিয়ে!’ আকাশ থেকে পড়লেন ভীষ্ম
বিদুর স্পষ্ট গলায় বলল, ‘নয়তো কী? শুনেছেন নিশ্চয়ই, দেখেছেনও বটে, কুরুপ্রাসাদে আসার পর গান্ধারী বউঠান তাঁর দুচোখ রেশমি বস্ত্রখণ্ড দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন।’
ভীষ্ম বললেন, ‘শুনেছি এবং দেখেছিও। গান্ধারী নাকি বলেছে, এ তার স্বামীব্রত। স্বামী অন্ধ। তাই স্বেচ্ছায় সে অন্ধত্বকে বরণ করে নিয়েছে। কত বড় পতিব্রতা মেয়ে, ভেবে দেখেছ তুমি বিদুর?’ বিদুর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘মিথ্যে, সব মিথ্যে! পতিব্রতের জন্য গান্ধারী বউঠান কখনো চোখে বস্ত্রখণ্ড বাঁধেননি। বেঁধেছেন ঘৃণা প্রকাশের জন্য। এই ঘৃণা দাদা ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি, এই ঘৃণা আপনার প্রতি, পুরো কুরুরাজবাড়ির প্রতি।
পিতামহের সামনে কখনো উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে না বিদুর। আজ কেন জানি বলল।
ভীষ্ম অবাক হয়ে বললেন, ‘এসব কী বলছ তুমি বিদুর!’
‘যথার্থই বলছি পিতামহ। আপনি একবার ভেবে দেখুন, কোন রাজকুমারী একজন অন্ধকে বর হিসেবে মেনে নেবে? আপনি মেনে নিতে বাধ্য করেছেন। মহারাজ সুবলকে আপনার ভয় দেখানোর কথাটি তো আর চাপা থাকেনি! কোনো না কোনো সময়ে গান্ধারী বউঠান জানতে পেরেছিলেন।’
ভীষ্মের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। স্তব্ধ চোখে বসে থাকলেন তিনি
থমথমে পরিবেশকে হালকা করতে চাইল বিদুর। নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কী কারণে ডেকেছিলেন পিতামহ? নিশ্চয়ই জ্যেষ্ঠের বিয়ের কথা বলতে নয়?’
সংবিতে ফিরলেন ভীষ্ম। বললেন, ‘তুমি ঠিক ধরেছ বিদুর। আমি পাণ্ডুর বিয়ের কথা বলতে তোমাকে একান্তে ডেকেছি।’
বহু আগেই বিদুর জেনেবুঝে গেছে যে এই কুরুরাজপরিবারে তার কিছুই পাওয়ার নেই। সে দাসীপুত্র বলে আন্তরিকভাবে কোনোদিন এই পরিবারে গ্রহণীয় হবে না। রাজমাতা সত্যবতী নিতান্ত স্নেহের বশে তাকে জলে বা জঙ্গলে নিক্ষেপ করেননি। রাজপ্রাসাদের অদূরে সাদামাটা বাড়িটিতে তাকে স্থান দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে দাসী মা-টিকে নিয়ে বিদুর নিজের মতো করে গড়ে উঠেছে।
দাসীপুত্র হলে কী হবে, বিদুরের মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা, দানশীলতা, পরোপকারমনস্কতা ছোটবেলা থেকেই দানা বেঁধেছে। এখন সে কুরুরাজদরবারে সত্যপ্রিয় স্পষ্টভাষী হিসেবে মাননীয় হয়ে উঠেছে। বিচক্ষণতা আর সুবিবেচনার জন্য পিতামহ ভীষ্মের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে বিদুর। বিদুরের সঙ্গে একটা সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ভীষ্মের। ফলে বিদুরের কথায় কোনো জড়তা নেই।
বিদুর বলল, ‘মহারাজ পাণ্ডুকে বিয়ে করাতে চাইছেন?’
‘হ্যাঁ।’ আস্থার সঙ্গে বললেন ভীষ্ম।
‘ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো?’
‘ভাবনাচিন্তার কী আছে? পুরুষ সে! যুবক এখন! রাজা সে হস্তিনাপুরের! তার কি বিয়ে করার অধিকার নেই?’
‘না না, আমি তা বলছি না পিতামহ! অধিকার আছে। ক্ষমতা আছে কি পাণ্ডু দাদার?’
চমকে বিদুরের দিকে তাকালেন ভীষ্ম। তারপর হাহা করে হেসে উঠলেন। অট্টহাসি দিয়ে গভীর কোনো একটা কিছুকে আড়াল করতে চাইলেন পিতামহ।
হাসি থামিয়ে হালকা চালে বললেন, ‘তুমি যে ব্যাপারটার ইঙ্গিত করছ, বিয়ের পর তা কেটে যাবে। দেখে নিয়ো তুমি, পাণ্ডু সুস্থ হয়ে উঠবে।’
‘বউঠান গান্ধারীর মতো অন্য কোনো রাজকন্যার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না তো পিতামহ?’
‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না বিদুর। আমি শিগগির পাণ্ডুর বিয়েটা দিতে চাই। যাদববংশী রাজা কুন্তিভোজের কন্যা কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে দিতে চাই আমি! শুনেছি, মেয়েটি সুলক্ষণা এবং অপরূপ রূপময়ী।’
বিদুর আর কী বলবে! সে বুঝে গেছে, এই বিয়ের ব্যাপারে পিতামহ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
এই সময় ভীষ্ম আবার বললেন, ‘আমি চাই এই বিয়েতে তুমি মধ্যস্থতা করো।’
‘আমি!’ অবাক কণ্ঠে বলে উঠল বিদুর।
‘হ্যাঁ তুমি। তোমার মতো বিশ্বস্ত এই পরিবারে আর কেউ নেই আমার। আমি চাই, তুমি গোপনে কুন্তিভোজের সঙ্গে দেখা করো। বিয়ের প্রস্তাব দাও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কুরুপ্রস্তাব সে অস্বীকার করবে না। সানন্দে রাজি হবে। তবে তোমার প্রতি আমার একটা সাবধানবাণী, ঘুণাক্ষরেও পাণ্ডুর দুর্বলতাটির কথা কুন্তিভোজকে বলবে না তুমি। সত্যপ্রিয় মানুষ যে তুমি!’
পিতামহের শেষ বাক্যটি যে পষ্ট একটা খোঁচা, বুঝতে অসুবিধা হলো না বিদুরের।
পিতামহ আবার বললেন, ‘স্বয়ংবরসভার ছোট একটা আয়োজন করবে কুন্তিভোজ। সেখানে কুন্তীর অনেক পাণিপ্রার্থীর মধ্যে পাণ্ডুও থাকবে। কুন্তী যাতে পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য দেয়, সেই ব্যবস্থা করে রাখতে বলবে কুন্তিভোজকে। কুন্তীকে পাণ্ডুপত্নী হিসেবে দেখতে চাই আমি।’
বিদুর মাথা নিচু করে থেকেছিল সেদিন।
বারো
জীবন থেমে থাকে না। স্রোতস্বিনীর মতো ছোট-বড় বাধাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কুন্তীর জীবনও ওই দুটি ঘটনার পর থেমে থাকেনি। এগিয়ে গেছে।
একদিন সে যাদব শূরসেনের রাজপ্রাসাদে জন্মেছিল। সেখানে ছিল সে পৃথা হয়ে। তারপর তার অভিগমন হলো কুন্তিভোজরাজ্যে। সেখানে তার মাতা-পিতা বদলে গেল, নাম বদলে গেল। পৃথা থেকে সে কুন্তী হয়ে গেল। শারীরিকভাবেও তার রূপান্তর হলো। বালিকা থেকে যুবতি হয়ে উঠল। মনেও পরিবর্তন এলো কুন্তীর। বালিকাসুলভ চাঞ্চল্য তিরোহিত হলো। তার মনে জায়গা করে নিল দৃঢ়তা, স্থিরতা।
এই কুন্তীকে ঘিরে এর মধ্যে অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেছে। প্রতিটি ঘটনায় কুন্তীর জীবন দুমড়েমুচড়ে গেছে। মানুষেরা, আত্মীয় বা অনাত্মীয়রা তার জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেছে কুন্তী। জীবন থেকে ধীরে ধীরে ঝঞ্ঝা কেটে গেছে। স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে যখন, তখন অন্য একটা ঝড় তার জীবনে আছড়ে পড়েছে।
কুন্তীর জীবনে নতুন এক ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হলো। এই ঝঞ্ঝা নাটক হয়ে তার জীবনে উদয় হলো। এই নাটকের কুশীলব অনেক—মহারাজ কুন্তিভোজ, হস্তিনাপুরের বিদুর, রাজা পাণ্ডু। আর এই নাটকের পরিচালক—কুরুবংশের প্রধান পিতামহ ভীষ্ম।
.
কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদের বিশেষ একটি কক্ষে মৃদু আলো জ্বলছে। এই কক্ষটি অতি গোপনীয় কোনো বিষয়ে আলোচনা করবার সময় ব্যবহার করেন কুন্তিভোজ। তীব্র কোনো আলো জ্বালানো হয় না এই কক্ষে। হালকা আলোর প্রদীপ জ্বলে এখানে। এই আলোতে বিশাল কক্ষটির সর্বত্র যে আলোকিত হয়ে ওঠে, তা নয়। কক্ষের আনাচে-কানাচে অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে। আজও কক্ষে আলো-আঁধারের মেশামেশি।
কক্ষের মধ্যিখানে গোলাকার শ্বেতপাথরের তেপায়া। একে ঘিরে উচ্চ আসন। ওই আসনে দুজন মানুষ বসে আছেন। একজনের আবরণ-আভরণ উচ্চমূল্যের। অন্যজনের বেশভূষা রাজকীয় নয়। কিন্তু দেখেই বোঝা যায়, তার পরিধেয় অবহেলার নয়। বেশ শোভন, রুচিসম্মত।
এই দুজনের একজন মহারাজ কুন্তিভোজ, অন্যজন বিদুর। বিদুর কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদে এসেছে, মহামতি ভীষ্মের বার্তা নিয়ে। হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তিভোজকন্যা কুন্তীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বিদুর আজ সন্ধ্যানাগাদ কুন্তিভোজরাজ্যে এসে পৌঁছেছে।
অভ্যর্থনা শেষে বিদুর কুন্তিভোজকে বলে, ‘বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে আজ আপনার কাছে এসেছি মহারাজ।
কৃতার্থ কণ্ঠে কুন্তিভোজ বললেন, ‘সে আমার বড় সৌভাগ্য মাননীয়, উদ্দেশ্যটা খোলাসা করলে মনে ভরসা পাই।’
রাজপ্রাসাদের আকাশে তখন পূর্ণ শশী। জোছনায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। যেন জোছনার প্লাবন। নিভৃতকক্ষে মুখোমুখি বসা দুজনের কেউই জানলেন না যে বাইরে জোছনার এত উচ্ছ্বাস! বিদুর আসল কথা এড়িয়ে কুন্তিভোজকে বলল, ‘মহারাজ, আপনার অজানা নয় যে কংস যাদববিরোধী। যদুবংশীয় একজন রাজা হয়ে এটাও আপনার জানা যে কংস সামরিকশক্তিতে ইদানীং বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। শক্তি মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। কংসও সামরিকশক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠার কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারাতে বসেছে। এর মধ্যে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি রাজ্য সে নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছে। এর পরে কাকে যে শত্রু ভাবছে বা কোন রাজ্য যে তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে না।’
অনেকক্ষণ কথা বলার পর ইচ্ছে করেই থামল বিদুর। এতটুকু শোনার পর কুন্তিভোজের কী প্রতিক্রিয়া, জানা জরুরি।
কুন্তিভোজ দ্রুত বললেন, ‘আমি খুব শঙ্কায় আছি মহাত্মন। কংসের আগ্রাসনের কথা ভালোভাবেই জানা আমার। আমার গুপ্তচররা তার ওপর লক্ষ্য রাখছে। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য দিতে পারছে না আমায়। অনেকদিন ধরে ভোজবংশের সঙ্গে যাদববংশের শত্রুতা চলছে। ভোজরাজ কংস প্রবলতর হয়ে উঠেছে। কোন সময় আমার রাজ্য আক্রমণ করে বসে, বুঝতে পারছি না।’
বিদুর বলল, ‘সাম্রাজ্যের আয়তন, অর্থনীতি আর সামরিকশক্তি—এই তিন ক্ষেত্রেই কংস আপনার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিপত্তিশালী। আপনার রাজ্য আক্রমণ করতে কংস দ্বিধা করবে না।’ বিদুরের ইচ্ছা—কংসের ভয় দেখিয়ে কুন্তিভোজকে নরম করা।
‘দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না আমার! দিনে রাজকার্য করি বটে, কিন্তু মন সর্বদা উচাটনে থাকে।’ অসহায় ভঙ্গিতে বললেন মহারাজ।
বিদুর বলল, ‘আপনার আতঙ্ক স্বাভাবিক মহারাজ। কংস তো এখন অহংকারে উন্মাদপ্ৰায়! যেকোনো দুর্ঘটনা ও ঘটিয়ে ফেলতে পারে। ইতোমধ্যে চুরাশিটি রাজ্য নিয়ে সে একটি জোট গড়ে তুলেছে। এই জোট কংসেরই ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এই জোটের সামনে আপনার নিরাপত্তা কোথায়?’
বেশ ঘাবড়ে গেলেন কুন্তিভোজ।
অধীর কণ্ঠে বললেন, ‘এখন আমি কী করি! কী করলে আমার রাজ্য কংসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে!’
‘অত অধীর হবেন না মহারাজ। উপায় একটা আছে।’
‘উপায় আছে? কী সেটা? আমাকে বলুন মাননীয় বিদুর।’ ভেঙেপড়া কণ্ঠে বললেন কুন্তিভোজ।
বিদুর বললেন, ‘জোটবদ্ধতাই কংসের সাম্রাজ্যবিস্তারের সাফল্য। আপনিও সে পথে এগোতে পারেন।’
‘সেপথে এগোতে পারি! কিন্তু কীভাবে! যাদবশত্রু কংসের জোটে যোগ দেব?’
‘না না! আমি তা বলছি না!’
‘তাহলে! আপনি কী বলতে চাইছেন, একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
‘আপনিও জোটবদ্ধ হোন। কোনো একটা দলের সঙ্গে।’
‘কোন দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হব?’ অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কুন্তিভোজ।
বিদুর এবার বেশ ভারী গলায় বলল, ‘দেখুন মহারাজ, আপনাকে একটা কথা বলি। হস্তিনাপুরের সিংহাসনে এখন মহারাজ পাণ্ডু। যুবক তিনি। ধীরস্থিরভাবে রাজ্য চালাচ্ছেন। তবে একথা অস্বীকার করছি না, পাণ্ডুর অভিভাবক পিতামহ ভীষ্ম। তিনিই কুরুবংশের বিধাতা এখন। তাঁর সমরাভিজ্ঞতা তুলনাহীন। তিনি গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তো সেই পিতামহও কংসের আধিপত্যকে পছন্দ করছেন না। কংসের উত্থান সম্পর্কে তিনিও মাথা ঘামাচ্ছেন এখন। মহামতি ভীষ্ম মনে করেন, কংসের এই যথেচ্ছার থামিয়ে দেওয়ার জন্য কুরু আর যাদবদের মধ্যে একটা মৈত্রীসম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার। কুরুশক্তিকে এখন কোন রাজা ভয় করে না? এই অক্ষয়শক্তির সঙ্গে আপনার আর নৃপতি শূরসেনের সখ্য তৈরি হয়ে গেলে কংসজোট ভড়কে যাবে। আপনাকে হয়তো কংস পাত্তা দেয় না, কুরুশক্তিকে তো ভয় করে!’
বিদুরের কথা শুনে কুন্তিভোজের চোখ ঝকমক করে উঠল। তারপর হঠাৎ চোখের ঔজ্জ্বল্য স্তিমিত হয়ে গেল। অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘মহামতি ভীষ্ম কি আমাদের সঙ্গে সখ্যসেতু গড়ে তুলবেন?’
বিদুর উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বলল, ‘গড়বেন না মানে! অবশ্যই গড়বেন। আপনাদের সঙ্গে, মানে আপনি আর মহারাজ শূরসেনের সঙ্গে মৈত্রীসম্পর্ক গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন পিতামহ
‘মৈত্রীসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাঠিয়েছেন! আপনাকে! আমার কাছে!’ ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্যগুলো কুন্তিভোজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
বিদুর বলল, ‘আমার বয়স বেশি না—দেখতেই পাচ্ছেন আপনি। আপনার মতো প্রবীণাভিজ্ঞতা নেই আমার, অস্বীকার করছি না। তবে এটা জোরের সঙ্গে বলছি, আমি মিথ্যে বলি না। দূরস্থানে অবস্থান করেন বলে আমার সম্পর্কে সম্যকভাবে জানা হয়ে ওঠেনি আপনার। আমি আপনার সঙ্গে গল্পগাছি করতে আসিনি মহারাজ।’
মহারাজ ভড়কানো গলায় বলে উঠলেন, ‘আপনি আমার কথাকে ভুলভাবে নিয়েছেন মাননীয়। আমি আপনার কথাকে অবিশ্বাস করিনি। বরং উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছি। বিস্ময় আর উচ্ছ্বাস থেকে ওই রকম করে বলেছি।’
তারপর আনন্দের বিশেষ একটা ধ্বনি বেরিয়ে এলো কুন্তিভোজের গলা থেকে। বললেন, ‘আমি মহামহিম ভীষ্মের প্রস্তাবে রাজি। কুরুদের সঙ্গে মৈত্রীজোট আমার রাজ্যকে নিরাপত্তা দেবে, কংসকে সন্ত্রস্ত করবে।’
‘যথার্থ বলেছেন মহারাজ। মৈত্রীজোটকে সুদৃঢ় করার অন্য একটি উপায় আছে।’
‘সে কেমন?’ চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করেন কুন্তিভোজ।
‘দেখুন, সকল যাদবরাজার মধ্যে সুসম্পর্ক নেই। পিতামহের উদ্যোগে গঠিত জোটের সঙ্গে সকল যাদবনৃপতি যুক্ত না-ও হতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি কী করবেন?’
ইতস্তত কণ্ঠে কুন্তিভোজ বললেন, ‘কী করব বুঝতে পারছি না।’
বিদুর এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনি একটা কাজ করতে পারেন। হস্তিনাপুরের তরুণ নরপতি পাণ্ডুর সঙ্গে আপনার মেয়ে কুন্তীর বিয়ে দিতে পারেন। তাতে কুরুশক্তির সঙ্গে আপনার বিশেষ একটা সম্পর্ক তৈরি হবে।’
‘বিয়ে দিতে পারি? বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হবে!’
‘হ্যাঁ, এটা আপনার জন্য পরমানন্দের হবে, রাজ্যের জন্য সুখকর হবে। দেখুন, পাণ্ডু অত্যন্ত রূপবান একজন তরুণ। বেশ নরম প্রকৃতির তিনি। তাছাড়া শুনেছি, আপনার কন্যা কুন্তী খুব বুদ্ধিমতী। তিনি শিক্ষিতা। তাঁর রাজনীতিজ্ঞান নাকি অত্যন্ত প্রখর। কুন্তী নিজের মতো করে পাণ্ডু দাদাকে গড়েপিঠে নিতে পারবেন। আমি হলফ করে বলছি, এই বিয়ে স্বস্তিময় ও আনন্দবর্ধক হবে।’ খুশি খুশি মুখ করে বলল বিদুর।
কুন্তিভোজ বিস্ফারিত চোখে বিদুরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কথা বলতে ভুলে গেলেন তিনি। এ যে অবিশ্বাস্য! হস্তিনাপুরের রাজবাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তাঁর মেয়ের জন্য! এত বড় কুরুসাম্রাজ্যের অধিপতি পাণ্ডু তাঁর জামাতা হবে! ঠিক শুনছেন তো তিনি! কুন্তীকে এখন বড় চোখে পড়ছিল তাঁর। সেই ছোট্ট বালিকা পৃথা কত বড় হয়ে গেছে! তাঁর সামনেই তো বড় হয়ে উঠল কুন্তী! কিন্তু রাজকার্যের চাপে এতদিন ভালো করে লক্ষ করেননি কুন্তীকে। ইদানীং লক্ষ করছেন। কখন যে মেয়েটি যৌবনবতী হয়ে উঠল! অতুলনীয় রূপময়ী হয়ে উঠেছে কুন্তী। সে তো বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে! তার তো বিয়ে দেওয়া উচিত! কিন্তু কাকে দেবেন? কুন্তীর উপযুক্ত কোনো রাজা বা যুবরাজের কথা তাঁর জানা নেই। তাহলে…
এরকম ভাবনার মধ্যে কুন্তিভোজের দিন যাচ্ছিল। এই উদ্বিগ্নতার মধ্যে বিদুর বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে এলেন। এ তো না চাইতেই জল! এ তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই নয়! নিশ্চয়ই বিধাতা পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তীর পরিণয় নির্ধারণ করে রেখেছেন।
‘কী ভাবছেন মহারাজ? এটি আমার প্রস্তাব নয়। এটি পিতামহ ভীষ্মের প্রস্তাব। তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাবক হিসেবে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। মহারাজ, পিতামহ আসলে চাইছেন, পাণ্ডু দাদার সঙ্গে আপনার কন্যাটির বিয়ে হোক।’
হঠাৎ উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠলেন কুন্তিভোজ। কিন্তু তখন তখনই বুঝতে পারলেন, তিনি নৃপতিসুলভ আচরণ করেননি।
বললেন, ‘আনন্দে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। তাই…।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিদুর বলল, ‘ও কিছু না। যেকোনো অনূঢ়ার পিতা এই ধরনের প্রস্তাব শুনে উল্লসিত হয়ে উঠতেন। আপনার এই আনন্দধ্বনি স্বাভাবিক মহারাজ।’
‘আমি রাজি মাননীয়। আপনি মহামতিকে গিয়ে বলুন, এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই, সানন্দে সম্মতি জানাচ্ছি আমি।’
বিদুর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তা-ই গিয়ে বলব পিতামহকে।’
‘আরেকটি কথা মহারাজ।’ একটু ভেবে বিদুর আবার বলল, ‘ক্ষত্রিয় রীতি অনুসারে স্বয়ংস্বরসভার আয়োজন তো করতে হবে। করবেন। তবে তা অনাড়ম্বরভাবে। কন্যার স্বয়ংবরসভার কথা যথারীতি ঘোষণাও করবেন আপনি। অন্যান্য রাজা-যুবরাজের সঙ্গে হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুও স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত থাকবেন। শুধু আপনার মেয়েকে বলে রাখবেন, তিনি যেন পাণ্ডু দাদার গলায় বরমাল্যটি পরিয়ে দেন।’
‘ঠিক আছে। কন্যা কুন্তীকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব আমি।’ গদগদ কণ্ঠে বললেন কুন্তিভোজ।
.
পরদিন হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছিল বিদুর। আদ্যপ্রান্ত পিতামহকে জানিয়েছিল।
হস্তিনাপুরে ঘোষিত হলো, নৃপতি পাণ্ডুর বিয়ের কথা।
.
কুন্তীর স্বয়ংবরসভায় অতিথি-অভ্যাগতের সংখ্যা তেমন ছিল না। অনেকটা নিরুত্তাপ ছিল স্বয়ংবরসভাটি। অন্যান্যের সঙ্গে মহারাজ পাণ্ডুও উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়।
কুন্তী পাণ্ডুর গলাতেই বরণমালাটি পরিয়ে দিয়েছিল।
পাণ্ডু কুন্তীকে নিয়ে হস্তিনাপুরের ফিরে এসেছিলেন।
পুত্র কর্ণের রাজ্যে মাতা কুন্তী এসে পৌঁছল।
এ বুঝি বিধাতারই চাল।
তেরো
স্বয়ংবরসভার আগে কুন্তীকে নিয়ে একান্তে বসেছিলেন কুন্তিভোজ। বিদুরের আগমনবার্তা সবিস্তারে বলেছিলেন। সেই বলার অধিকাংশ জুড়ে ছিল ভোজরাজ কংসের আধিপত্যের কথা। কংস যে একজন হিংস্র নির্মম নৃপতি—এই কথাটা বারবার করে বলেছিলেন কুন্তিভোজ। ও যে ভীষণ যাদববিরোধী—এটাও বলেছেন বারংবার। এবং শেষে বলেছেন, যেকোনো মুহূর্তে কংস কুন্তিভোজরাজ্য আক্রমণ করে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে।
পিতার কথা শুনে শিউরে উঠেছিল কুন্তী। কংসের নিষ্ঠুরতার কথা তারও কানে এসেছে। কিন্তু তার পিতার রাজ্যের ওপর যে কংসের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে, জানত না কুন্তী। আশঙ্কায় তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কন্যার ম্লান রক্তশূন্য মুখের দিকে একবার তাকালেন কুন্তিভোজ। কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘বিদুর বলেছেন, কংসের আগ্রাসন থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় আছে। আর তা হলো কুরুশক্তির সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।’
কুন্তিভোজ দেখলেন, তাঁর কন্যাটি অত্যাগ্রহে কথাগুলো শুনছে। এতে তাঁর উৎসাহ বেড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘যদি আমরা কুরুশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হই, তাহলে আমাদের দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে, কংস আমাদের রাজ্য আক্রমণ করার সাহস পাবে না। কারণ কংস আর কোনো রাজাকে ভয় করুক না-করুক, নৃপতি পাণ্ডুকে ভয় করে। পাণ্ডুর সামরিকশক্তির কথা কংসের অজানা নয়।’
কুন্তী বলে উঠল, ‘রাজা পাণ্ডুকে ভয় করে! পাণ্ডু কে বাবা?’
‘ও হো! তুমি বোধহয় শোনোনি যে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে এখন পাণ্ডু।’
‘না বাবা। জানতাম, পিতামহ ভীষ্মই কুরুরাজ্য চালাচ্ছেন।’
‘তোমার কথা সত্যি মা। কিছুদিন আগপর্যন্ত তিনিই কুরুরাজ্যের শাসক ছিলেন। এখন ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুর হাতে রাজ্য শাসনের ভার অর্পণ করে দিয়েছেন পিতামহ। এখন পাণ্ডুই কুরুনৃপতি।’
‘ও—।’ বলে কুন্তী থেমে গেল।
‘মহাত্মন বিদুর বলেছেন, ওই পাণ্ডুর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিলে আমাদের রাজ্য একেবারে নিরাপদ হয়ে যাবে।’ থেমে থেমে বললেন কুন্তিভোজ।
‘আপনার কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না বাবা। আপনার কথার মধ্যে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত আছে?’
সুযোগ পেয়ে গেলেন কুন্তিভোজ। আড়াল-আবডাল থেকে বেরিয়ে স্পষ্টভাবে বললেন, ‘মাননীয় বিদুর তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে।
‘বিয়ের প্রস্তাব!’ কুন্তীর হৃদয়টা থরথর করে উঠল। কুন্তী বুঝতে পারল, এ ভয়ের কাঁপন নয়, এ অনাস্বাদিত এক শিহরণ!
কুন্তিভোজ বললেন, ‘হ্যা মা। পাণ্ডুর সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন বিদুর।’
কুন্তীর মুখের কথা ফুরিয়ে গেল। মাথা নত করে থাকল।
উচ্ছ্বাসে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুন্তিভোজের। বললেন, ‘অনিন্দ্য ক্লান্তিময় নাকি পাণ্ডু! তার কন্দর্পদর্শন রূপের কথা অনেকের মুখে মুখে এখন।’ বলে কন্যার দিকে একপলক তাকালেন কুন্তিভোজ। দেখতে চাইলেন, কুন্তীর ভাবান্তর। কুন্তী মাথা নিচু করে রয়েছে বলে তার মুখটি দেখতে পেলেন না। কিন্তু মহারাজ কন্যার হাত দুটোকে দেখতে পেলেন। কুন্তীর হাত দুটোতে তখন মৃদু কম্পন। এই কম্পন যে রোমাঞ্চিত হওয়ার, বুঝতে অসুবিধা হলো না রাজার। তিনি বুঝে গেলেন, তাঁর কন্যা এই বিয়েতে সর্বান্তঃকরণে সম্মত।
এরপর তিনি কুন্তীকে স্বয়ংবরসভার কথা সবিস্তারে বললেন। শেষে বললেন, ‘স্বয়ংবরসভায় যদি পাণ্ডুকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নাও, তাহলে তুমি বিশাল কুরুসাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবে মা। আর আমাদের সঙ্গে কুরুশক্তির অচ্ছেদ্য এক সখ্য গড়ে উঠবে।’
সেই সন্ধ্যায় অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে কুন্তী বলেছিল, ‘ঠিক আছে বাবা। আপনার কথার ব্যত্যয় হবে না।’
তারপর যথারীতি স্বয়ংবরসভার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
.
কুরুরাজপ্রাসাদ।
মহারাজ পাণ্ডুর শয়নকক্ষ।
কক্ষটি দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছে আজ। আজ পাণ্ডু-কুন্তীর বাসররাত।
কুন্তী এখন রাজমহিষী। হস্তিনাপুরের সম্রাটপত্নী। রাজবধূরূপে আজ তাঁকে সাজানো হয়েছে। তাঁর চেহারা তাতে আরও মনোলোভা হয়ে উঠেছে। এখনকার কুন্তীর মধ্যে অতীতের সকল গ্লানি বিলীন হয়ে গেছে।
আজ রাজপ্রাসাদকে আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়েছে। বহুকাল পরে কুরুরাজপ্রাসাদে বিয়ের মতো বিয়ে হলো। সেই কবে ধুমধামের সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হয়েছিল! হ্যাঁ, কদিন আগে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে হয়েছে বটে, কিন্তু সেই বিয়েটা ছিল অনেকটাই দায়সারা গোছের। ধৃতরাষ্ট্র এই বংশের বড় ছেলে, কিন্তু জন্মান্ধ হওয়ার কারণে এবং সে হস্তিনানৃপতি নয় বলে তার বিয়েতে আড়ম্বরের ছোঁয়া লাগেনি তেমন করে। আর গান্ধাররাজ সুবলকে ভয় দেখিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে কন্যা গান্ধারীকে সম্প্রদান করতে বাধ্য করিয়েছেন পিতামহ ভীষ্ম। কন্যাপক্ষ থেকেও এই বিয়েতে তেমন উচ্ছ্বাস যুক্ত হয়নি। যথার্থ রাজকীয় বিয়ে যাকে বলে, পাণ্ডুর বিয়েটা সে রকমভাবে হয়েছে। এই বিয়েতে কনে রাজি, কনেপক্ষ তৃপ্ত। ফলে কুন্তী-পাণ্ডুর বিয়েতে আলাদা একটা মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সেই আলাদা মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সজ্জায়, ভোজনে, দানে। দাসদাসী থেকে আরম্ভ করে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের প্রতিপ্রত্যেকের পরিধানে নতুন এবং বহুমূল্যের পোশাক, আলোতে-ফুলেতে রাজবাড়ির মূলফটক থেকে আরম্ভ করে আনাচ-কানাচ পর্যন্ত আলোকিত, সজ্জিত। বিয়ে উপলক্ষে রাজপ্রাসাদে এলাহি ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই আকণ্ঠ ভোজনে তৃপ্ত হয়েছে। আর নানারকম দানদ্রব্যে ব্রাহ্মণদের কোঁচড় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গোটা হস্তিনাপুরে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
এই রকম পরিবেশে ফুলশয্যার আয়োজন করা হয়েছে। আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদ আজ অকৃপণ হস্তে জোছনা ঢেলে দিচ্ছে রাজপ্রাসাদের ওপর।
রানি কুন্তী সজ্জিত শয়নকক্ষে অবস্থান করছেন। বাতায়ন পাশে তিনি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখ জোছনায় নিবদ্ধ। থরথর হৃদয়টি অপেক্ষা করে আছে পাণ্ডুর জন্য।
রাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হলো।
ধীর পায়ে রাজা পাণ্ডু কক্ষাভ্যন্তরে এলেন। দেখলেন, কুন্তী জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজা যে ঢুকেছেন, কুন্তী টের পাননি।
পাণ্ডুও সেটা বুঝতে পারলেন। এখন তিনি কী করবেন বা কী করা উচিত এখন তাঁর, ঠিক করতে পারলেন না। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর রানির দিকে এগিয়ে গেলেন পাণ্ডু।
পায়ের আওয়াজে পেছন ফিরলেন কুন্তী। তৎক্ষণাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে লাগল পাণ্ডুর চোখেমুখে। কুন্তীর রূপের আভায় পাণ্ডুর চোখ অন্ধ হয়ে গেল যেন! স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন পাণ্ডু। এত রূপ! এরকম চোখঝলসানো সৌন্দর্য আগে কখনো দেখেননি রাজা। নিজেকে সামলে নিতে কিছু সময় নিলেন।
তারপর মৃদু পায়ে কুন্তীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
হাস্যোজ্জ্বল মুখটি পাণ্ডুর দিকে তুললেন কুন্তী। মুগ্ধ চোখ দুটি কুন্তীর চোখের ওপর মেলে ধরলেন রাজা। দুজনেই স্তব্ধবাক।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
অবশেষে নরম কণ্ঠে পাণ্ডু বললেন, ‘আমাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছ তো কুন্তী?’
কুন্তী অকুণ্ঠ গলায় বললেন, ‘আমি আপনাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি রাজা।’
‘উহুঁ! আপনি নয়। তুমি। আজ থেকে তুমি আমায় তুমি করে সম্বোধন করবে রানি।’
চমকে উঠে কুন্তী বললেন, ‘তা কী করে হয় মহারাজ! আবহমান কাল ধরে রাজপ্রাসাদের রানিরা তাঁদের স্বামীদের আপনি সম্বোধন করে এসেছেন। আমার মাও তো বাবাকে আপনি বলে…।’
মুখের কথা কেড়ে নিলেন পাণ্ডু। বললেন, ‘অন্য প্রাসাদে কী হতো বা হয়, সেটা আমার জানার দরকার নেই কুন্তী। আমার প্রাসাদে কী নিয়ম চলবে, সেটা জেনে নাও। আজ থেকে কখনো তুমি আমাকে আপনি বলবে না।’
কুন্তী পাণ্ডুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে আর্য।’
আলতো করে কুন্তীর হাত ধরলেন পাণ্ডু। কুন্তী তড়িৎস্পর্শিত হলেন যেন! আবেশে তাঁর চোখ দুটো বুজে আসতে চাইল।
এই সময় পাণ্ডু বললেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি কুন্তী।’
গাঢ় কণ্ঠে কুন্তী বললেন, ‘আমিও রাজা।’
‘আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য, দেওয়ার জন্য এসেছি রানি। তোমার যা আছে, তা দিয়ে আমাকে ভরিয়ে দাও প্রিয়ে।’
‘আমার কী আছে যে তোমাকে দেব! তোমাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে তেমন কিছু তো নেই আৰ্য!’
‘তুমি জানো না কুন্তী, তোমার কাছে কী আছে! তোমার কাছে যা আছে, লক্ষ নারীর কাছে তা নেই রানি
শিহরিত হলেন কুন্তী। নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার কথার মানে বুঝতে পারছি না আমি।’
পাণ্ডু ঝট করে কুন্তীকে বুকের কাছে টেনে নিলেন। নিবিড় কণ্ঠে বললেন, ‘যে চোখ দিয়ে আমাকে দেখছ তুমি, যে মন দিয়ে আমার গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছ, সেই চোখ আর মন আমাকে দাও রানি। তাহলেই আমার জীবন ভরে উঠবে।’
কুন্তী নিজেকে পাণ্ডুর আলিঙ্গনে সমর্পণ করলেন।
পাণ্ডু কুন্তীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আদর করা শুরু করলেন।
কানের কাছে মুখ চেপে পাণ্ডু বললেন, ‘আমার হৃদয়ে অনেক ভালোবাসা কুন্তী। সকল ভালোবাসা আমার বুকের তলায় তোমার জন্য লুকিয়ে রেখেছি।’
পাণ্ডুর কথা শুনে কুন্তীর বুকের ভেতর বর্ষণ শুরু হলো। পাণ্ডু তখন তাঁর ঠোঁট কুন্তীর কানের লতিতে, গালে ঘষে যেতে লাগলেন। একটা সময়ে কুন্তীর পুরুষ্টু অধরে নিজের অধর ডুবিয়ে দিলেন পাণ্ডু।
কুন্তী তাঁর তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠাধর পাণ্ডুর কাছে সমর্পণ করলেন। পাণ্ডুর ঠোঁটের স্পর্শে কুন্তীর সারা শরীর গান গেয়ে উঠল। কুন্তী তাঁর বুক অনাবৃত করলেন। পুষ্ট স্তনযুগল বলে উঠল, আয় আয়। কুন্তী পাণ্ডুর মুখখানা স্তনের ওপর চেপে ধরলেন।
পাণ্ডুও সক্রিয় হয়ে উঠলেন। নারীর স্তন যে মধুভাণ্ড, এই ভাণ্ড যে অমৃতকুম্ভ, জানা ছিল না পাণ্ডুর। আজ, এই মুহূর্তে তিনি জানতে পারছেন, স্বর্গসুধা কুন্তীর কুচযুগলে সঞ্চিত হয়ে আছে। এই সুধায় যে শুধুমাত্র তাঁরই অধিকার, ভেবে রোমাঞ্চিত হলেন পাণ্ডু।
আসঙ্গলিপ্সায় উন্মাতাল হয়ে উঠলেন পাণ্ডু। কুন্তীও তখন শৃঙ্গারমোহিত। আনন্দঘন আশ্লেষে কুন্তীর অঙ্গে অঙ্গে ঝড়ের তাণ্ডব তখন।
কুন্তী পাণ্ডুকে সঙ্গমে প্ররোচিত করলেন।
কুন্তীর বুকের ওপর নিজের দেহকে তুলে দিলেন পাণ্ডু।
চরম মুহূর্তে স্থবিরতা হঠাৎ পাণ্ডুকে গ্রাস করল। কুন্তীর বুক থেকে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন পাণ্ডু। অক্ষমতার অপমানে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন তিনি
কাতর স্বরে বলতে থাকলেন, ‘কুন্তী, আমি পারছি না। সত্যি আমি পারছি না কুন্তী। আমি অক্ষম কুন্তী। সঙ্গমে আমি অসমর্থ কুন্তী। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও।’ বলতে বলতে কুন্তীর হাত দুখানি নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলেন পাণ্ডু। সম্বলহীন মানুষের মতো, নিরাশ্রয়ী উন্মুল শিশুর মতো কেঁদে যেতে থাকলেন পাণ্ডু।
কুন্তী তখন চোখ বুজে শুয়ে আছেন। তাঁর দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তখন। নিজেকে বড় নিঃস্ব বলে মনে হতে লাগল কুন্তীর। তিনি জেনে গেলেন, তাঁর পাশে শোয়া এই পুরুষটি সঙ্গমে অক্ষম, প্রজননে ব্যর্থ।
হঠাৎ কেন জানি দুর্বাসার কথা মনে পড়ে গেল কুন্তীর। কুন্তী ভাবলেন, এ কী নিষ্ঠুরতা বিধাতার! কোন পাপের শাস্তি এটি?
নিজেকে বড় দুঃখী মনে হতে লাগল কুন্তীর। মনে হতে লাগল, তাঁর ঘরে-বাইরে শুধু অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার।
চৌদ্দ
বেশ কিছুদিন হুল্লোড়ে-হট্টগোলে কেটে গেল।
আস্তে আস্তে আবেগ-আনন্দ স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল। মন্ত্রী-অমাত্যরা রাজকার্যে মনোনিবেশ করতে শুরু করলেন। নৃপতি পাণ্ডু আগের মতো রাজসভায় অংশগ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁকে ঘিরে ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, কৃপাচার্য। এবং সর্বোপরি পিতামহ ভীষ্মের উপস্থিতিতে কুরুসভা পুনরায় গমগম করতে লাগল।
সর্বত্র সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছে। কিন্তু বিদুরের কেন জানি মনে হচ্ছে, কোথায় যেন গহিন এক অসঙ্গতি! কী অসঙ্গতি, কোথায় অসঙ্গতি—ধরতে পারছে না বিদুর। কিন্তু তার মন বলছে, কোথায় যেন অস্বাভাবিকতা!
হঠাৎ একদিন পাণ্ডুর মুখের ওপর দৃষ্টি পড়ল বিদুরের। রাজসভায় এমনিতেই পাণ্ডুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়, কথাবার্তা হয়। কিন্তু কোনোদিন তেমন কোনো খটকা লাগেনি। আজ কেন জানি বিদুরের চোখ দুটো পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে আটকে গেল। বিদুর দেখল, সেখানে গভীর এক বিষাদ। প্ৰচণ্ড এক অন্তর্জালা কুরে কুরে খাচ্ছে যেন পাণ্ডুকে!
রাজসভার আড়ম্বরতা আর কর্মব্যস্ততার কারণে অন্য কেউ বুঝতে না পারলেও রাজা পাণ্ডুর অন্যমনস্কতা, আত্মগ্লানি বিদুরের চোখ এড়াল না। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল তার। রাজার মনখারাপের কারণ কী হতে পারে? রাজ্যে এখন কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, প্রজারা সুখে দিনাতিপাত করছে, কোনো করদ রাজা বিদ্রোহ করেনি, রাজপ্রাসাদে কোনো ষড়যন্ত্র নেই। তাহলে কীসের জন্য রাজার এত বিষণ্ণতা!
রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রের কথা ভাবতেই হঠাৎ কুন্তীর কথা মনে পড়ে গেল বিদুরের। মহারাজার বিষাদের কারণ কুন্তী বউঠান নন তো! আরে! বিয়ে হয়েছে এতদিন হয়ে গেল, একদিনের জন্যও তো বউঠানের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি সে! বিদুরের মুখ থেকে চুকচুক করে আফসোসের শব্দ বেরিয়ে এলো। তার তো কুন্তী বউঠানের খোঁজখবর নেওয়া উচিত ছিল! এটা মোটেই ঠিক হয়নি।
রাজসভায় বসেই বিদুর ঠিক করল, আজ অপরাহ্ণে কুন্তী বউঠানের সঙ্গে দেখা করবে। দেখা করেছিল বিদুর, কুন্তীর সঙ্গে। কুন্তী যতই সজ্জিত হয়ে থাকুন না কেন, ভেতরের বেদনা চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল।
কুন্তীর থমথমে চেহারা দেখে, তাঁর কথোপকথনে বিষণ্নতা দেখে বিদুরের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠেছিল। নিশ্চয়ই রাজা আর রানির মধ্যে কিছু একটা হয়েছে! নইলে দুজনেই সমানভাবে অন্যমনস্ক কেন, দুজনেই বিষাদমগ্ন কেন?
ভাবতে ভাবতে সেই কথাটি মনে পড়ে গেল বিদুরের। বিয়ের আগে যে কথাটি পিতামহকে বলতে চেয়েছিল বিদুর, সেই কারণটি দুজনের মধ্যে বিষাদের সঞ্চার করেনি তো? কিন্তু দেবর হয়ে কী করে জিজ্ঞেস করে কুন্তীকে?
দীর্ঘদিন রাজকার্যের সঙ্গে যুক্ত বিদুর। রাজসভায় কত বিচিত্র আর অভাবনীয় অভিজ্ঞতা! এসবের মধ্যে থেকে থেকে বিদুরের দূরদর্শিতা বেড়েছে, মানুষচেনার চোখ প্রখর হয়েছে। কুন্তীর সামনে বসে তার নিশ্চিতরূপে মনে হলো—গভীর এক শূন্যতা বউঠানের চোখেমুখে। সেই শূন্যতার সঙ্গে মিশে আছে অবসাদ।
এলোমেলো ভাবনা নিয়ে সেই অপরাহ্ণে নিজ আলয়ে ফিরে এসেছিল বিদুর।
দিনকয়েক পরে পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করেছিল।
‘ভুল হয়ে গেছে পিতামহ, মস্তবড় ভুল করে ফেলেছি আমরা।’ অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল বিদুর।
ভীষ্ম বিদুরের কথাটা ধরতে পারেননি।
ধীরস্থির কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তুমি কী বলতে চাইছ বিদুর বুঝতে পারছি না। কী ভুল করেছি আমরা?’
‘দাদা পাণ্ডুর বিয়েটা করিয়ে ভুল করেছি আমরা।’
বিয়েটা করিয়ে মানে! পাণ্ডু পুরুষ মানুষ! বিয়ে করার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে সে! তার বিয়ে দেব না তো কার বিয়ে দেব?’
‘ওখানেই ভুল করেছেন পিতামহ। দাদার বাহিরটা দেখেছেন আপনি, ভেতরের খোঁজ রাখেননি। এটা অবশ্য সত্যি বললাম না আমি। গোপন খবরটা আপনার অজানা নয় পিতামহ। বিদুরের কথার শেষাংশে অভিমান আর উষ্মার মাখামাখি।
‘তোমার কথায় অভিযোগের ছোঁয়া পাচ্ছি বিদুর! আসল ঘটনাটা খুলে বলবে?’ গম্ভীর হয়ে ভীষ্ম বললেন।
বিদুর এবার সরাসরি ভীষ্মের চোখের দিকে তাকাল। বলল, ‘দাদা পাণ্ডুর শারীরিক অক্ষমতার কথা আপনি জানতেন। রাজচিকিৎসক আপনাকে বলেছিলেন সেকথা।’
‘রাজচিকিৎসক আমাকে এ-ও বলেছিল, পাণ্ডুর এই অক্ষমতা সাময়িক। বয়স বাড়লে তার মধ্যে বীর্যবত্তা বাড়বে। বিয়ে করালে ওর অক্ষমতা পুরোপুরি কেটে যাবে। আমি রাজচিকিৎসকের ওপর আস্থা রেখেই পাণ্ডুকে বিয়ে করিয়েছি।’ বললেন পিতামহ।
বিদুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘চিকিৎসকের পরামর্শে ভুল ছিল।’
‘সে কী রকম?’ চকিতে জিজ্ঞেস করলেন পিতামহ।
বিদুর মৃদু মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার ধারণা, ধারণা বলছি কেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দাদা- বউঠানের দাম্পত্যজীবনে টানাপড়েন চলছে। আমি পাণ্ডুদাদার চোখেমুখে গভীর এক বিষণ্ণতা দেখেছি। বউঠানের সঙ্গেও দেখা করেছি আমি। বউঠানের চেহারায় যে শূন্যতা দেখে এসেছি আমি, তা কখনো একজন সুখী রমণীর নয়। না না পিতামহ, আমার দেখায় কোনো ভুল নেই! আমি নিশ্চিত, বৈবাহিকজীবনে দুজনের কেউই তৃপ্তি পাচ্ছেন না।’
বিদুরের কথা শুনে ভীষ্ম চাপা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসি থামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘ধরে নিলাম, তোমার কথা ঠিক। দুজনের মধ্যে দাম্পত্য-অতৃপ্তি চলছে। কিন্তু সেই অতৃপ্তির জন্য তুমি একতরফাভাবে পাণ্ডুকে দোষারোপ করছ কেন? শারীরিক অসঙ্গতি কুন্তীরও তো থাকতে পারে!’
এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে বিদুর, বুঝে উঠতে পারল না। মাথা নত করে থাকল।
‘আমার তো বিশ্বাস, রাজচিকিৎসকের কথা সত্যি। পাণ্ডুর শারীরিক অক্ষমতা কেটে গেছে। গোলমালটা নববধূর মধ্যে বলে আমার মনে হচ্ছে।’ অদ্ভুত এক রুক্ষ কণ্ঠে বললেন ভীষ্ম।
পিতামহের মন্তব্যের যে বিরোধিতা করবে, প্রমাণ নেই বিদুরের হাতে। হয়তো দাদার যৌন- অক্ষমতা কেটে গেছে, হয়তো-বা বউঠানের দেহে দাদার চেয়েও বড় অক্ষমতা বিরাজ করছে! দোলাচলে দুলতে লাগল বিদুর।
ওই সময় পিতামহের জলদগম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেল বিদুর, ‘শোনো বিদুর, তোমাকে বলে রাখছি কথাটা, আমি আর কিছুদিন দেখব, যদি দেখি কুন্তীর মধ্যে সন্তানসম্ভাবনা নেই, আমি পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিয়ে দেব। আমি কুরুবংশের উত্তরাধিকারী চাই। কুরুবংশ আবার নির্বংশ হওয়ার ফাঁদে পড়ুক, চাই না আমি।’
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন পিতামহ। বিদুরের কথা শুনবার জন্য অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে গেলেন তিনি।
বিশাল ফাঁকা ঘরটিতে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল বিদুর। তার এত বছরের জীবনে পিতামহকে এরকম একরোখা দেখেনি কখনো। এতদিন জানত, পিতামহের মতো এত বিজ্ঞ, বিবেচক, যুক্তিবাদী মানুষ ভূ-ভারতে নেই। আজ বিদুর অনুধাবন করল, তার এই বিশ্বাস ভুল। পিতামহের স্বজনপ্রীতি অভিযোগার্হ। তিনি আজ যে-কথা বলে গেলেন, তা তো একতরফা! নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রের খামতি তিনি জেনেও আমলে নিলেন না। কুন্তী বউঠান পরের মেয়ে বলে মনগড়া দোষটা তাঁর ওপর চাপিয়ে দিলেন। না না, এ বড় অন্যায়! পিতামহের এই অন্যায় রুখে দিতে হবে।
.
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভীষ্মের অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারেনি বিদুর। তবে তা বছরখানেক পরের ঘটনা। দাম্পত্যজীবনের অতৃপ্তি আর শূন্যতার মধ্যেও কুন্তী জীবনকে নতুন করে সাজাতে চাইলেন। জীবনের শাখা-প্রশাখাকে ফুল-কুঁড়িতে ভরিয়ে তুলতে চাইলেন। নিজের নারীসত্তাটিকে পরিপূর্ণ তৃপ্তির দিকে টেনে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন।
দিন যায়। সপ্তাহ, মাসও। বছরও গড়িয়ে গেল একটা সময়ে। কুন্তী গর্ভবতী হলো না। সত্যবতী তখন বার্ধক্যে জরজর। হলে কী হবে, তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত রইল না। নাতির যে কোনো পুত্রসন্তান হলো না এখনো! এই বয়সেও সেই জ্ঞান তাঁর টনটনে। ভীষ্মকে নিয়ে সত্যবতী পরামর্শে বসলেন একদিন। সেখানেই দুই নারীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। দুই নারীর একজন কুন্তী, অন্যজন মাদ্রী।
সত্যবতী আর ভীষ্ম সিদ্ধান্ত নিলেন—পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করাবেন।
যে কুন্তী একদিন হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদ আলো করে রাজবধূরূপে রাজপুরীতে প্রবেশ করেছিলেন, আজ সেই কুন্তীর আলো অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে।
পিতামহী সত্যবতী আর শ্বশুর ভীষ্মের সিদ্ধান্তের কথা একদিন কুন্তীর কানে এসে পৌঁছল। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি কুন্তী। তারপর কথাটি যখন নানাজনের মাধ্যমে তাঁর কানে আসতে শুরু করল, বিশ্বাস করলেন।
কী করবেন, কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন—সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না রাজমহিষী। আচমকা বিদুরের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। বিদুরকে ডেকে পাঠালেন তিনি।
বিদুর এসে দেখল, অশ্রুতে কুন্তীর বুক ভেসে যাচ্ছে। তাঁর সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকল বিদুর।
কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কুন্তী বললেন, ‘ঠাকুরপো, তুমিই তো গেছিলে কুন্তীভোজরাজ্যে, আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে? যদিও তোমার সঙ্গে সেই সময় আমার সাক্ষাৎ হয়নি। পিতার মুখে শুনেছি, খুব সাফাই গেয়েছিলে আর্য পাণ্ডুর পক্ষে। বলেছিলে, পিতামহ ভীষ্মের মতো মানুষ হন না। তিনি দেবতা—একথাও বলেছিলে তুমি। পাণ্ডুর রূপ-গুণের কথা বলে আমার বাবাকে একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে তুমি। কংসের ভয় দেখিয়েছিলে, কুরুদের সামরিক সামর্থ্যের কথা ফলাও করে বলেছিলে। কিন্তু ছোট্ট করে হলেও একবারও বলোনি পাণ্ডুর শারীরিক অসামর্থ্যের কথা। গোপন রেখেছিলে তুমি। তার জন্য তোমাকে একবারের জন্যও ধিক্কার দিইনি আমি। পাণ্ডুর অক্ষমতাকে নিয়তির বিধান বলে মেনে নিয়েছি। সকল শূন্যতাকে মেনে নিয়ে জীবনকে নতুন করে শুরু করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যখন, ঠিক তখনই রাজা পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নিলে তোমরা। পিতামহ হয়তো ভেবে নিয়েছেন, আমি বন্ধ্যা। কিন্তু আমি তো বন্ধ্যা নই বিদুর! কার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই, সেটা তুমি যেমন জানো, আমার শ্বশুরও তা ভালো করে জানেন। শুনছি, পিতামহী সত্যবতী নাতির পুত্রের মুখ দেখবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন। বৈধ-অবৈধ যেকোনো উপায়ে বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে—এই-ই তো তাঁর সিদ্ধান্ত? তোমরা ভুল করছ বিদুর, আরেকজন রাজকুমারীর জীবন তছনছ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মস্তবড় পাপ করতে যাচ্ছ তোমরা। এই পাপের মূল্য চুকাতে হবে তোমাদের।’ বলে মুখে আঁচলচাপা দিয়ে দ্রুত কক্ষান্তরে গেলেন কুন্তী।
.
রূপে-গুণে অতুলনীয়া মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে দিলেন ভীষ্ম।
মাদ্রী ছিলেন মদ্রদেশের রাজা শল্যের ভগিনী। শল্যের কাছে বিয়ের প্রস্তাব গেলে না করেননি শল্য। শল্য ভেবেছেন, পাণ্ডুর সঙ্গে বোনের বিয়ে হলে তাঁর বংশমর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
মাদ্রীকে হস্তিনাপুরে এনে পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ে দিলেন ভীষ্ম। কুন্তীর কাছে এই বিয়েটা শ্বশুর ভীষ্মের প্রবঞ্চনা বলে মনে হলো। জীবনে কোনোদিন ভীষ্মকে ক্ষমা করবেন না বলে পণ করলেন কুন্তী।
দ্বিতীয় বিয়ের পর দুই পত্নীকে নিয়ে মাত্র তিরিশ দিন বিহার করলেন পাণ্ডু। এই বিহারে পাণ্ডুর অন্তর-প্রদাহ আরও বেড়ে গেল। আগে তাঁর যৌন-অক্ষমতার কথা জানতেন একজন। এখন দুই নারীর কাছে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে তাঁকে।
ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকলেন পাণ্ডু। বিবেক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, দিগ্বিজয়ে বের হবেন।
দিগ্বিজয় করে বহু ধনসম্পত্তি নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরলেনও। তার পরও মনে শান্তি ফিরে এলো না রাজা পাণ্ডুর।
বিপুল ছটফটানির মধ্যে পাণ্ডু স্থির করলেন, দুই পত্নীকে নিয়ে অরণ্যবাসে যাবেন।