ক্ষ্যাপা তিনজন – ৪

চার

কর্ন পেটে পড়ায় রনির ঘোড়া টপার বেশ দ্রুতবেগেই ছুটছে। ভোরের আলো পুবের আকাশকে ধূসর করে তোলার আগেই হর্স স্প্রিঙসকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। একটা ক্ষীণ ট্রেইল ধরে প্রথমে উত্তরে রওনা হয়ে, পরে কোনাকুনি এগিয়ে মাসট্যাঙ ট্রেইল ধরেছে। কেউ ওকে অনুসরণ করেনি নিশ্চিত হয়ে, শেষে দক্ষিণে যাবার স্টেজ রাস্তা ধরল।

কিছুক্ষণ পর ট্রেইল ছেড়ে পাথর আর গাছপালার ভিতর দিয়ে এগোল। ওর ধারণা, অতিথি-আপ্যায়ন পছন্দ নয় বলে ট্রেইলের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করবে শার্পি। তাই পাহাড়ী পথে এগোচ্ছে। সার্কেল এইচ অনেক দূরের পথ। সবার অগোচরে ওখানে পৌছতে চায় রনি।

তিন ঘণ্টা সোজা দক্ষিণে এগোবার পর একটা উঁচু পাহাড়ের কাঁধে উঠে থামল। সামনে গভীর আর চওড়া একটা উপত্যকা। কয়েক মাইল দূরে, ওর থেকে প্রায় দুহাজার ফুট নিচে সমতল জমিতে হালকা একটু ধুলো উড়তে দেখে স্যাডলব্যাগ থেকে বিনোকিউলার বের করে খুঁটিয়ে লক্ষ করল। ঘোড়ার পিঠে একজন আরোহী। কিন্তু এত দূর থেকে ঘোড়ার রঙটাও ঠিক চেনা যাচ্ছে না। লোকটা যদি ওর গতিপথ না বদলায় তবে সে রনির পথটা ক্রস করবে। অর্থাৎ সেও হয়তো সার্কেল এইচেই যাচ্ছে।

তবে কি হর্স স্প্রিঙসে অনুপস্থিতি কেউ টের পেয়েছে? লোকটা বুমারকে খবর দিতে চলেছে? কিন্তু রেড রিভার রেগানই যে রনি ড্যাশার, এটা ওখানকার কেউ বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। ও যে দক্ষিণেই যাচ্ছে, এটাও কারও জানার কথা নয়। আবার আগে বাড়ল রনি। ইচ্ছে করেই সামনের আরোহীর কিছুটা পুবে পণ্ডারোসা পাইনের আড়াল দিয়ে এগোল সে। লোকটা কে এবং এই ট্রেইলে কি করছে জানা দরকার।

বাড়ের দেয়া বিবরণ থেকে রনি জানে সার্কেল এইচ র‍্যাঞ্চটা ঠিক কোথায়। তাই অবাক হয়ে লক্ষ করল লোকটা এলক মাউন্টিনের দিকে রওনা হলো। অচেনা আরোহী অদৃশ্য হওয়ার পর নিচে নেমে ঘোড়ার খুরের ছাপ পরীক্ষা করে দেখল নালগুলো নতুন লাগানো হয়েছে। ওই ছাপ পরেও সে চিনতে পারবে।

কূনি ক্যানিয়নের উত্তরে চওড়া সমতল জমিতে কিছু গরু চরছে। ওগুলো সার্কেল এইচের গরু। অথচ মাত্র আধ-মাইল এগিয়েই একটা বাছুরের চামড়ায় সার্কেল বি ব্র্যাণ্ড ওর চোখে পড়ল। ছাপটা নতুন!

বুমারের বি? চিন্তায় ভুরু কুঁচকাল রনি। পুবে হিলা নদীর প্রধান শাখার দিকে এগোল সে। ব্ল্যাক মাউন্টিন মেসার উত্তর-পুব কোনা পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণে যাওয়ার ট্রেইল পেয়ে ওটা ধরেই এগিয়ে চলল। পথে গরুর ব্র্যাগুগুলো লক্ষ করছে। দেখল, পুরানো স্টকের ব্র্যাণ্ড সার্কেল এইচ থাকলেও, কমবয়সী নতুন স্টক সবই সার্কেল বি। অবশ্য H কে B-তে পরিণত করা সহজ কাজ, কিন্তু আপাতত কেবল বাছুরগুলোকেই সার্কেল বি ব্র্যাণ্ড করা হচ্ছে। এতে চুরি করে ব্র্যাণ্ড বদল করা হয়েছে বলে কেউ বুমারকে অপবাদ দিতে পারবে না, অথচ কয়েক বছরের মধ্যেই সব গরু সার্কেল বির গরু হয়ে যাবে। চমৎকার দূরদর্শী প্ল্যান।

বীভার পেরিয়ে সার্কেল এইচ রেঞ্জ পিছনে ফেলে এল রনি। পাহাড়ী পথেও দক্ষতার সাথে পথ চলছে টপার। বড়বড় পাথরে ঘেরা একটা জায়গা বেছে নিয়ে কর্ডরয় ক্যানিয়নের কাছে রাতের জন্য ক্যাম্প করল রনি, কিন্তু আগুন জ্বালাল না।

ভোরে উঠে আবার দক্ষিণে রওনা হলো। বিকেলের দিকে সামনে একজন লোক ওর চোখে পড়ল। কাছাকাছি পৌঁছে রনি হাত তুলল। লোকটা থেমে দাঁড়াল, উইনচেস্টারটা ওর হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা আছে। আরোহী সায়মন ড্রিল, ডি বার র‍্যাঞ্চের মালিক।

‘তুমি তাহলে ঠিকই হাজির হয়েছ,’ রেড রিভার রেগানকে চিনতে পেরে বলল ড্রিল। ‘দক্ষিণে চলেছ, নাকি কাজ খুঁজছ?’

শব্দ তুলে হাসল রনি। ‘হর্স স্প্রিঙসে যাওয়ার পরেও আমার টাকাটা এখনও রয়েছে। জায়গাটা নিরিবিলি, তুমি চাইলে হয়তো একটু কথাবার্তা বলার সুযোগ নিতে পারি আমরা।’

‘মন্দ কি?’ ঘোড়াটাকে ট্রেইল থেকে একপাশে সরিয়ে দাঁড় করাল সায়মন।

‘এই এলাকার লোকজন বেশ স্পর্শকাতর, একটুতেই চটে ওঠে,’ মন্তব্য করল রনি। ‘ওইসব রাসলাররা কি তোমার জন্যে খুব ঝামেলা করছে?

‘কিছুটা।’

‘এসব বুমার আসার পর শুরু হয়েছে?’

শান্ত চোখে রনিকে যাচাই করল ড্রিল। ‘তুমি আমাকে দিয়ে বলাতে চাইছ শার্লি চোর? সেটা আমি বলব না-যদি বলতেই হয়, তবে ওর মুখের ওপরই শিশুল হাতে বলব।

ড্যাশার হাসল। ‘আমি যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে সেটা খুব ভুল হবে না।’ ওপাশের ব্ল্যাক মাউন্টিনের চূড়ার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল রনি। ‘হ্যাডলে যখন সার্কেল এইচে একা ছিল তখন এসব ঝামেলা ছিল?’

‘মোটেও না!’ দৃঢ় স্বরে বলল সায়মন। ‘বাডের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। ওর ফোরম্যানটাও ভাল ছিল, কিন্তু বেচারা মারা পড়েছে।’

‘চার্লি মারা গেছে?’ দুর্বোধ্য অনেক কিছু এখন রনির কাছে পরিষ্কার হয়ে এল।

‘হর্স স্প্রিঙসে পিস্তলের লড়াইয়ে মরেছে। ভাসকোর সাথে ঝগড়া, কিন্তু জনি রিগই পাশ থেকে বেশি গুলি করেছে। এটা ওদের একটা চালাকি।’

‘কথাটা আমি মনে রাখব। তাহলে চার্লি মারা গেছে? সেটা কি শার্পি এখানে আসার পরে?’

‘হ্যাঁ, ঠিক পরপরই। কয়েকদিন পর চারজন পুরানো কাউহ্যাণ্ডও মারা গড়েছে। শোনা যায় অ্যাপাচিদের হাতে-অবশ্য এটা সত্যিও হতে পারে।’

‘কিন্তু তোমার তা মনে হয় না?’

কাঁধ উঁচাল সায়মন। ‘ওটা আমার নিজস্ব ধারণা।’

আপন মনেই মাথা ঝাঁকাল রনি। সবই মিলে যাচ্ছে।

‘কিন্তু বাড হ্যাডলের কি খবর?’ চানতে চাইল সে।

‘একটা দুর্ঘটনায় পড়ে খারাপ ভাবে জখম হয়েছে বলে শুনেছি। বেশ কয়েক মাস হলো ওকে বা ওর মেয়েকে কেউ দেখেনি।’

টপারকে আগে বাড়াল রনি। ‘চলো, এগোই। বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির থাকা আমার পছন্দ নয়। তোমার র‍্যাঞ্চটা এখান থেকে কতদূর?’

‘মাইল পাঁচেক হবে।’ রনিকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। ‘তুমি এই এলাকা মোটামুটি ভালই চেনো মনে হচ্ছে।’

‘অনেকদিন আগে এদিকে একবার এসেছিলাম। তাছাড়া বাড়ের কাছেও এই এলাকার কোথায় কি আছে শুনেছি।’

‘তাহলে তুমি বাড হ্যাডলেকে চেনো?’ অবাক হয়েছে সায়মন!

‘অবশ্যই চিনি! ওর প্রতিবেশী বাক উইলিয়ামসের র‍্যাঞ্চে কাজ করি-আমি ভ্যাশার।’

‘রনি ড্যাশার?’ চমকে উঠল সায়মন। ‘তোমাকে দেখেই আমার চেনা উচিত ছিল। বাড আর তার মেয়ের মুখে তোমার বহু গল্প আমি শুনেছি। ওরা তোমার কথা খুব বলে।’

‘ওদের সাথে দেখা করতেই আমি এসেছি। আমার ধারণা ওরা বিপদে আছে।’

‘হতে পারে।’ ড্রিলের চেহারা গম্ভীর হলো। ‘কিংবা আর সবার বিপাদ ঘটাচ্ছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওকে আমি ভাল বলেই জানতাম। কিন্তু শার্শি বুমারের মত লোককে কাজে নিয়ে সে মোটেও ভাল করেনি।

‘বাণ্ডি নামে কাউকে তুমি চেনো?’

‘বাণ্ডি বুল? নিশ্চয় চিনি, চমৎকার লোক। দেখতেও সুন্দর। ও পিস্তল ঝোলায় না, কিন্তু ওই শক্ত আউটফিটের লোকজনও ওকে সমীহ করে চলে।

‘লোকটার চেহারা কেমন?’

বিবরণ হর্স স্প্রিঙসে খাবার ঘরে বসা লোকটার সাথে হুবহু মিলে গেলা।। মাথা ঝাঁকাল রনি। ভুরু কুঁচকে ভাবছে, তাহলে কার কথা ঠিক? মরার আগো আউটল ইঙ্গিত দিয়েছিল যে দুজনের মধ্যে বুলই বেশি ভয়ঙ্কর।

হঠাৎ ছয়জন রাইডার গাছপালার ভিতর থেকে বেরিয়ে পথ আটকে খেমে দাঁড়াল। সায়মনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আড়চোখে ব্যাপারটা খেয়াল করে রনি বুঝল ওরা সায়মনের শত্রু।

‘হাওডি, সায়মন!’ নীল শার্ট পরা লোকটা কথা বলছে। বিশাল আকৃতি, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ‘আমাদের দেখে তুমি খুশি হওনি মনে হচ্ছে!’

‘খুশি হওয়া উচিত?’ ড্রিলের স্বর ঠাণ্ডা। ‘তোমাকে আমি চিনি, বার্কার! ‘শোনো কথা!’ হেসে উঠল বার্কার। ‘আমাকে নাকি চেনে! ভাল কথা। পরিচয় আরও গাঢ় করার সময় হয়ে এসেছে। ড্রিল’-সামনে ঝুঁকল বাকার ‘তোমাকে সাবধানে কথাবার্তা বলতে বলা হয়েছে! সব ব্যাপারে নাক গলাতেও মানা করা হয়েছিল! এখন তোমাকে শিক্ষা দেয়া হবে!’

‘হাওডি, বার্কার!’ শান্ত স্বরে বলল ড্যাশার।

বিশাল লোকটা ওর দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল। ‘তুমি আবার কে? ছোট ছোট চোখ দুটো চকচক করছে। ‘তোমার র‍্যাঞ্চের নতুন কর্মচারী, ড্রিল?

‘আমার লোক না,’ বলল সায়মন। ‘ও ভবঘুরে লোক। ও এর মধ্যে নেই।’ হঠাৎ লোকটার জন্যে কেমন একটা টান অনুভব করল রনি। সায়মন ভয় পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু এটা রনির ফাইট নয় বলে সে ওকে বাইরে রাখার চেষ্টা করছে।

‘ঠিক আছে, ও যদি নাক গলাতে না আসে তবে নীরবেই তামাশা দেখুক।’ হাঁটুর গুঁতোয় টপারকে আগে বাড়াল ড্যাশার। ওর নীল চোখ দুটো বরফ- শীতল হয়ে উঠেছে।

‘তামাশা দেখব?’ রনির স্বর মোলায়েম হলেও ভয়ানক শোনাল। ‘নিশ্চয়! আমি তামাশাই দেখতে চাই! পুরোটাই!’ টপার আগে বাড়ছে।

‘কী! আমার সাথে ওই সুরে কথা!’ রাগে লোকটার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ‘ফিউরি, ওকে একটু শিক্ষা দিয়ে দাও!’

পাতলা গড়নের একটা লোক আগে বাড়ল। ‘খবরদার!’

ধমকে উঠল ড্যাশার!

‘বাহাদুরি?’ টিটকারির স্বরে বলল বার্কার। ‘তোমাকে-’ পিস্তলের বাঁট ছুঁলো ওর হাত। পিস্তল দুটো রনির হাতে লাফিয়ে উঠে এল। দুটোই একসাথে গর্জে উঠল। বার্কারের পিস্তল খাপ থেকে অর্ধেক বেরিয়ে এসেছিল, ওটা আবার পিছলে খাপে ঢুকল। ধীরে, একটা বস্তার মত ঘোড়ার জিন থেকে নিচে পড়ল বার্কার। বোকার মত নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে চেয়ে আছে ফিউরি। রনির দ্বিতীয় গুলি ওর হাতে গভীর দাগ কেটে বেরিয়ে গেছে। পিস্তলটা মাটিতে পড়ে আছে। বাকি লোকগুলো অবাক বিস্ময় নিয়ে জিনের ওপর স্থির বসে আছে।

‘খুব দেখালে, স্ট্রেঞ্জার!’ রনির দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল ফিউরি। ‘কাজটা ভাল করলে না!’

‘তোমরা ডি বার রেঞ্জে আছ,’ হঠাৎ মুখ খুলল ড্রিল। ‘ভালয় ভালয় কেটে পড়ো!’ ওর উইনচেস্টারটা লোকগুলোকে কাভার করে আছে।

‘মালিকের নির্দেশ তোমরা শুনেছ,’ বলল ড্যাশার। ‘লাশটা তুলে নিয়ে সরে পড়ো!’

‘কাজটা ভাল করলে না,’ আবার বলল ফিউরি। ‘কথাটা শার্পির কানে গেলে দেখো সে কি করে!’

হেসে উঠল রনি। ‘তুমি ছুটে গিয়ে ওকে খবরটা দাও। আর বোলো, রনি ড্যাশার দেখা করতে আসছে, সে যেন তৈরি থাকে। লাল কার্পেট বিছিয়ে, বা পিস্তল হাতে, যেভাবে খুশি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *